সুখস্বপ্নের দিন

চন্দন আনোয়ার

 

ভরা বসমেত্মর দুপুরের ঘুমে স্বসিত্মকর কিছু স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে অথবা স্বপ্নঘোর শেষ না হতেই কোমর ভাঁজ করে উঠে বসতে-বসতে প্রফেসর হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন, এখনি বেরিয়ে পড়বেন। বাথরুমে এক মিনিট, জামা-প্যান্টে এক মিনিট, ৩০ সেকেন্ডে অ্যাপেক্সের ফিতাওয়ালা স্যান্ডেলে দুই পা ঢুকিয়ে আড়াই মিনিটের নিশ্বাসরুদ্ধ ব্যস্ততা শেষে প্রায় লাফিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, আজ সুখস্বপ্ন দেখার দিন, আমি আসছি। সিঁড়ির ধাপে-ধাপে পা ফেলে দ্রুত ধাবমান পদশব্দ তৈরি করে গেটের কাছে পৌঁছে গাড়ির ব্রেককষার মতো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়ালেন, বিকেল হয়েছে, এখনো ব্যাটা সুখের ঘুম ঘুমায়। আবার নাকও ডাকে। সুখ উছলে পড়ছে। এই  ইয়াকুব, এই ব্যাটা, বিকেল হয়ে গেছে, সূর্যটা মুখের ওপরে ডিম পারছে, হুঁশ নেই।

সুখের ঘুম ভেঙে ছেলেটা কিছুতেই চোখ খুলতে চাইছে না। এবার প্রফেসরের কণ্ঠ আদর মাখানো, ওঠো বাবা! বিকেল হয়ে গেল। ১২-১৩ বছর বয়সী কিশোর ইয়াকুব যেন স্বপ্ন দেখছে, ওর বাবা ইয়াছিন আলী ডাকছে। লাঙল-গরু নিয়ে বিলে যাবার সময় এ-সুরেই ডেকে ঘুম ভাঙাত প্রত্যুষে। ঘুমের মধ্যেই ইয়াকুবের পাতলা কচি ঠোঁটদুটি কলাপাতার মতো কাঁপছে। ঠোঁটে ফুটে উঠেছে মৃদু হাসির স্ফীত রেখা। ছেলেটি এখন স্বপ্ন দেখছে। আশ্চর্য এক নিমগ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর। ছোট্ট এক চৌকির ওপরে পাতলা ময়লা কালো রঙের ছেঁড়া একটি চাদর বিছিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে প্রাণভরে স্বপ্ন দেখছে ছেলেটা। বেরিয়ে পড়ার ব্যস্ততার কথা ভুলে যাননি প্রফেসর। এ-মুহূর্তে জাগিয়ে তোলার অর্থই হলো, ওকে স্বপ্নভাঙার কষ্ট দেওয়া। ঘুমন্ত শরীর, নিশ্বাসের ওঠানামার সঙ্গে বুকের খাঁচার ভাঙা-গড়া দেখার পরই চোখে পড়ে, ছেলেটির গলার নিচে কালো মোটা একটি দড়ির দাগ। এ-বয়সেই ফাঁস নিতে গিয়েছিল কি-না? স্বপ্নের মধ্যেই ইয়াকুব হঠাৎ স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলে, উঠছি আববা, উঠছি। প্রফেসরের সমস্ত শরীর জুড়ে বসমেত্মর বাতাস দোল খেয়ে যায়; ছেলেটির প্রতি মনোযোগ আরো গভীর হয়; যেন ঘুমিয়ে থাকা ছেলের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মহাকালের এক বাবা।

বিকেল ফুরিয়ে আসছে, এখনি বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রফেসরের ঘন নিশ্বাসের শব্দে চোখের পাতা কিঞ্চিৎ মেলেই, প্রফেসর কাকা! শোয়া থেকে জালে আটকা মাছের মতো লাফিয়ে ওঠে ইয়াকুব। গেটে তালা মেরে ঘুমাচ্ছিস, বের

হই কী করে? ইয়াকুব বলে, আমারে ডাকলেন না ক্যারে? প্রফেসর বললেন, ডেকেছি কিন্তু তুই তো শুনিসনি, স্বপ্ন দেখছিলি কি-না। ইয়াকুব এবার লজ্জায় জিভ কেটে হেসে ওঠে, ওহ, আপনি ডাকছেন! আমি হুনলাম যেন আমার আববায় ডাকছেন। প্রতিদিন ঘুমের থে উইঠা কামে যাওনের সময় আববা আমারে ডাইকা ঘুম ভাঙাইয়্যা থুইয়া যাইতেন। আববাডা আমার মইরা গ্যালো আলসারে। ছেলেটির চোখ ভিজে আসে।

প্রফেসরের ফুসফুস কেঁপে উঠল। প্রায় লংজাম্প দিয়ে গেট পার হয়ে ত্রস্ত পদক্ষিপে গলির সীমানা অতিক্রম করে দাঁড়ালেন চৌরাস্তার মোড়ে। ৫১-৫২ বছর বয়সী, সুঠাম ও দীর্ঘদেহী, নীরোগ প্রফেসরের দেহে এই উপসর্গটি ছয় মাসের; হঠাৎ ফুসফুস কেঁপে ওঠে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার এই সুখস্বপ্ন দেখার দিনে শ্বাসকষ্ট জেগে উঠুক, আমি তা চাই না। বুক টান করে লম্বা দমে নাক দিয়ে শ্বাস টানেন জোরে, ফুসফুস পূর্ণ হলেই তবে বাতাস বের করেন মুখ দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় শ্বাসকষ্ট ঠেকিয়ে শামিত্মর নিশ্বাস ফেলে পকেটে হাত রেখে দেখেন, মোবাইল ফেলে এসেছেন। ভালোই হলো, সুখস্বপ্নের দিনে কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করুক, আমি তা চাই না।

হেলেপড়া সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছেন প্রফেসর;  বিকেলের রোদ পড়েছে  ক্লিনসেভ মুখে। এ-সময়, বিপুল কণ্ঠের মিছিল মোড়ে এসে পৌঁছলে তার মন পুলকিত হয়ে ওঠে। মানুষের ভিড় তাকে আনন্দ দেয়। নিউমার্কেটের মূল ফটকে, অথবা ব্যস্ততম বিপণিবিতানের ফটকে নিশ্চল প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকা তাঁর এক অদ্ভুত নেশা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে করপোরেশনের মেয়রের সুখ-সমৃদ্ধির বক্তৃতা শুনে, বিপুল কণ্ঠের মিছিল আর হাততালি শুনে বিকেল কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব; কিন্তু আজ তার সুখস্বপ্ন দেখার দিন।

মোটাতাজা, খাটো, লম্বা, মাঝারি, রাগি উদ্ধত তরুণ-তরুণীর বিপস্নবী পদভারে প্রকম্পিত মাটি। মোড়ের চতুর্দিকের প্রবেশপথগুলোতে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে রাইফেল হাতে নিয়ে। এই মুহূর্তে মেয়রের সুখী-সমৃদ্ধ মহানগর গড়ার পরিকল্পনা ও উন্নয়নবিষয়ক বক্তৃতা শোনার চেয়ে নগরবাসীর জন্য জরুরি কাজ নেই। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে, পাগলের মতো ছুটে আসেন ষাটোত্তর বয়সী এক প্রবীণ। কালো স্বাস্থ্যবান পিস্তল হাতে নিয়ে ক্রুদ্ধভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে-থাকা যুবক পুলিশ অফিসারের পেছনে হাতজোড় করে, শিরদাঁড়া বাঁকা করে দাঁড়ালেন প্রবীণ, আমার স্ত্রীর অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা উঠেছে, এখনি হাসপাতালে না নিলে সর্বনাশ। প্রবীণের দেখাদেখি তিনজন মধ্যবয়সী ও একজন তরুণ হাতে একটি বই নিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। তুখোড় ব্যস্ত পুলিশ অফিসার, তার পেছনে একদল কুকুর দাঁড়িয়েছে বলে মনে করল কি-না কে জানে, মুখ বাঁকিয়ে বাপ তুলে গালি দিয়ে পিস্তল উঁচিয়ে এমন এক দাবড় দিলো যে, পেছনে ফিরতে গিয়ে পায়ে পা বেঁধে পাল্টি খেয়ে পড়ে গেল প্রবীণ আর তরুণ; প্রবীণের দিকে পা তুলেছিল কিন্তু কী মনে করে লাথি না মেরে তরুণকে ফুটবলের মতো কিক মারতে-মারতে প্রবেশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে এনে ফেলে, তরুণকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগই দিলো না, বইটি পৃষ্ঠা খুলে পড়ে আছে। প্রফেসর এগিয়ে গিয়ে প্রবীণকে তুলে আনলেন। ভাবলেন, নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিশ অফিসারকে অনুরোধ করবেন, মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন যেখানে; কিন্তু অনুরোধ করার সময় পেলেন না – স্থূলকায় কালো ঘাড়মোটা হলুদ পাঞ্জাবি ওপরে কোটপরিহিত মেয়র মঞ্চে উঠে হাত নাড়ছে। প্রবীণের মুখের দিকে তাকানো যায় না; আতঙ্কে কাঁপছে বয়স্ক শরীর। প্রফেসর ভাবলেন, আজ আমার সুখস্বপ্ন দেখার দিন, কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। জগতের এই নিয়ম, সুখী হতে হলে নিষ্ঠুর হতে হয়।

প্রফেসর হাঁটছেন শহরের উত্তর দিকের সোজা সড়কটি ধরে। পশ্চিমে হেলেপড়া সূর্যের দিকে মুখ করে ভাবছেন, ফুরিয়ে আসছে, বেলা ফুরিয়ে আসছে, দিন ফুরিয়ে আসছে, …।  কচি ডাবের নোনতা পানির স্বাদ নেওয়ার জন্য ডাব-বিক্রেতার ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন হঠাৎ। পঞ্চাশ টাকায় সবচেয়ে বড় ডাবটি কিনে পাইপ ঢুকিয়ে বুকের ওপরে নিয়ে নোনতা পানির স্বাদ নিতে-নিতে ছেলে মারুফ, মেয়ে মারুফা এবং স্ত্রী মিনুর মুখচ্ছবি ভাবেন, ওরা কেউ কচি ডাবের নোনতা পানি পছন্দ করে না। ওরা পছন্দ করে ডাবের সর ও মিষ্টিপানি। গ্রামের বাড়িতে পুকুরপাড়ে তিনটি নারিকেল গাছ আছে। বারোভূতে খায়। হঠাৎ কী ভাবলেন প্রফেসর, কচি ডাবের নোনতা পানি নয়, যেন সাপের বিষ গলাধঃকরণ করছেন, নীল হয়ে আসে শরীর, হাতের ডাবটা ছুড়ে ফেললেন, রেলের ইঞ্জিনের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে চলন্ত গাড়ির মতো শহরটা চলতে শুরু করলে ঘুণেধরা বাঁশের মতো কোমর থেকে ভেঙে পড়ার মুহূর্তে প্রথমে ছেলে মারুফকে, পরে মেয়ে মারুফাকে ডাকলেন, অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আমি, হারিয়ে যাচ্ছি, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছি, তুমি কোথায় মিনু? ছেলেমেয়েরা কোথায়, কোথায় গেলি তোরা? দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করেন ওদের ধরতে, ওদের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়াতে; ডাব-বিক্রেতা ধরে ফেলে; প্রফেসরের হুঁশ তখনো টনটনে, আমাকে কোথাও শুইয়ে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।

শাহ পরান বস্ত্রালয়ে এক যুবক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কাপড় দেখছিল, মানুষের কোলাহল দেখে কৌতূহলবশত একবার উঁকি দিয়েই সামনের জনকে ধাক্কা মেরে ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করে, আমার স্যার, এম.এ. হোসেন স্যার। বুকের ওপরে লুটিয়ে পড়ে প্রায় চিলের মতো ছো মেরে প্রফেসরের নিথর শরীর তুলে নিয়ে দৌড়াতে লাগল যুবক। নিকটেই মায়ের দোয়া ক্লিনিক। যুবতী ডাক্তার দেখেই চমকে ওঠে, আমার স্যার যে, স্যারকে এ-অবস্থায় পেলেন কোথায়? মুহূর্তের মধ্যে ডাক্তার কন্যায় রূপান্তরিত হয়ে গেল; যেন নিজের বাবাকে সেবা দিচ্ছে। প্রফেসরের শার্টের বোতাম খুলে, প্রেসার মেপে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেই দৌড়াল স্যালাইনের জন্য। স্যালাইন গুলিয়ে, স্যারের মাথা আপন বুকের ওপরে নিয়ে মুখে ধরে, প্রফেসরের মনে হলো, মেয়ে মারুফার বুকে মাথা রেখেছেন। মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেল কবে! মেয়েরা বড় হয় কেন? এবার তো বিয়ে দিতে হবে। মিনুর জেদ, মেয়েকে ডাক্তার বানাবে এবং বিয়ে দেবে ডাক্তার ছেলে দেখে। শুনে প্রফেসর হাসেন, চারাগাছ দেখে কি বলা যায় কেমন ফল হবে। মিনু যুক্তি দেখায়, গাছটার শেকড় কোথায় দেখবে না? তোমার মতো একজন মেধাবী মানুষ, বিসিএস দিয়ে টিকেছ, পিএইচ.ডি করেছ, কত বই বের করো, দেশ-বিদেশের পত্রিকায় লেখো, সেমিনারে বক্তৃতা করে বেড়াও, তোমার শত-শত ছাত্রছাত্রী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার; তোমার নিজের মেয়ে ডাক্তার হবে, এ তো সামান্য কথা। প্রফেসরের চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি, চেষ্টা চালিয়ে যাও, আমি আছি তোমার পেছনে। মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে ডাক্তার বলে, স্যারের ঠোঁটে এখনো সেই মৃদু হাসি লেগে আছে। যুবক বলে, ঠিক বলেছেন, স্যার বরাবর হাসিখুশি ছিলেন। ক্লাসে কখনো গম্ভীর মুখ দেখিনি। কোনোদিন রাগ করেছেন বলে মনে পড়ে না।

মিনিট বিশের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে উঠে বসেন প্রফেসর। ডাক্তার ও যুবক হাঁটু ভাঁজ করে বসে প্রফেসরের মুখোমুখি। ডাক্তার বলে, স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন, আমি জয়মত্মী দাশ, আপনি সংক্ষেপে জয়ী বলে ডাকতেন। গত মাসেই এখানকার মেডিক্যালে বদলি হয়ে এসেছি। বিকেলে এই ক্লিনিকে বসি। এবার যুবক বলে, স্যার, আমি ওসমান গণি, একটি মেডিসিন কোম্পানির ফার্মাসিস্ট হিসেবে আছি। আমাকে চিনতে পারছেন স্যার? ডাক্তার ও যুবকের মাথা দুই হাতে টেনে বুকের দুদিকের দুই অলিন্দে ঠেসে ধরেন প্রফেসর, তোমরা বড়ো হওনি দেখছি। আমার ছেলেমেয়েদের কথা আমি কখনো ভুলি না।

অপেক্ষা করার সময় নেই, বেলা ফুরিয়ে আসছে। প্রফেসর উঠে দাঁড়ালে ডাক্তার অনুরোধ করে, স্যার, আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আপনার কি মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট হয় স্যার? প্রফেসর বললেন, ছ-মাস ধরে হচ্ছে। ডাক্তার ভয় পেয়ে গেল, মাইনর অ্যাটাক হয়ে গেল

হাত কামড়ায়। এটা মেয়েটার ফুচকা খেলা। এ-খেলা খেলতে না দিলে কেঁদেকেটে এক শেষ।  প্রফেসরের চোখ চঞ্চল, ঠোঁটে চাপা হাসি স্ফীত, হঠাৎ মুখ হা করে সামনে ঝুঁকে পড়লেন অভ্যাসবশত। পাশের টেবিলের ভদ্রলোকের ছেলেটি শব্দ করে হেসে উঠলে প্রফেসরের হুঁশ ফেরে, মেয়ে তো নেই এখানে। তড়িঘড়ি করে উঠে, ফুচকার বিল মিটিয়ে বেরিয়ে সোজা প্রবেশ করেন পার্কে।

পার্কের বেঞ্চিগুলোতে জড়াজড়ি করে বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা, না-হয় যুবদম্পতি। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে যে-বেঞ্চিটা মিনুর পছন্দের, সে-বেঞ্চিতে এক যুবকের কাঁধে মাথা ফেলে এক যুবতী চোখ বুজে আছে; সুখস্বপ্ন দেখছে বোধহয়। মিনুর এ-স্বভাব ছিল না। ওর একটাই স্বভাব ছিল, হঠাৎ দুই হাত দিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরত সাপের মতো। বেহুলা-লখিন্দর মিনুর প্রিয় চরিত্র, তাই নদীর কাছে এলেই মনে হয়, বেহুলার ভেলা ভেসে যাচ্ছে নদী দিয়ে। যুবদম্পতিকে অনুরোধ করা যায় কি-না, আমি এ-বেঞ্চিটাতে বসতে চাই এক মিনিট। মাথা নাড়িয়ে প্রফেসর সিদ্ধান্ত নিলেন, না, ঠিক হবে না, মোটেই ঠিক হবে না। ওদের এখন সুখস্বপ্ন দেখার দিন; যুবকের কাঁধে মাথা ফেলে যুবতী তার সুখস্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করছে; ছেলেমেয়ে হবে, ছেলেটা বড় হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, মেয়েটা হবে ডাক্তার, সুখে-আনন্দে কাটবে জীবন…

পার্ক থেকে বের হয়ে লাফিয়ে রিকশায় উঠলেন প্রফেসর, ফুল দমে টানো, বিশ মিনিটে পৌঁছাতে হবে ড্রিম প্রোপার্টিজে; দেখো, সূর্যটার সর্বশরীর ভয়ানক রক্তলাল হয়ে উঠেছে; আত্মাহুতি দিচ্ছে, রক্তক্ষরণ হবে না? কে চায় মরতে? নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে কেঁপে ওঠেন ভয়ে, নড়ে ওঠে রিকশা, রক্তরঙে লালে লাল হয়ে উঠেছে শরীর। এক রঙে বাঁধা পড়েছে মরণোন্মুখ সূর্য আর প্রফেসর।

৮০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ধারে ড্রিম প্রোপার্টিজ। রাস্তা থেকে তিন পস্নট দূরে প্রফেসরের পস্নট। চারকাঠা জমি বর্গাকৃতির, বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা, জমিতে ছোট-ছোট ২৫-২৬টি মেহগনি গাছ, সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে তিনটি আমগাছের চারা। বাড়ি করার জন্যে কিছু মাটি ফেলতেই হবে। বাউন্ডারি নেই এমন দুটি পস্নটে ক্রিকেট খেলছে চারটি ছেলে।

জমির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ শেষে পশ্চিমদিকে মুখ করে পূর্বদিকের বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে বুকভরে শ্বাস নিলেন প্রফেসর। কায়দামাফিক সূর্যাস্ত দেখার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত এখন। সূর্যের আগুনের মতো লাল রং ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। ‘আগুনের মতো লাল রং’ উপমাটি মনে হতেই প্রফেসরের চোখে ভাসে সুখস্মৃতি। যেদিন জমি দেখতে এসেছিলেন, হেমমেত্মর বিকেল ছিল, মিনুর ফর্সা মুখে সূর্যের আলো পড়ে আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছিল দুটি গাল, ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম জমেছিল নাকের ডগায়, গলার ভাঁজে-ভাঁজে; এত ঔজ্জ্বল্য মিনুর শরীরে আর কোনোদিন দেখেননি। এই শহরে একখ- নিজের জমি, নিজের একটি বাড়ি। উফ্! বিশ্বাস করতে পারছি না, ওগো স্বপ্ন দেখছি না তো, বলেই প্রফেসরের হাতে জোরে চিমটি কাটে মিনু। প্রফেসর ইস্ করে লাফিয়ে উঠলে বলে, সত্যিই তো স্বপ্ন দেখছি না।

বাসায় ফিরে হঠাৎ প্রফেসরের হাত টেনে নিজের মাথায় নিল মিনু, দিব্যি কাটো, জমি এবার কিনবেই। প্রফেসর হাত টানেন, পাগলি! কৃত্রিম অভিমানে মিনুর গাল ফুলে ওঠে বাতাসভর্তি বেলুনের মতো। মিনুর ঘর্মাক্ত শরীর লতার মতো জড়িয়ে ধরেন প্রফেসর, ‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে, অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে’; কৃত্রিম অভিমান ভেঙে হেসে ওঠে মিনু, ওসব কবিতা-টবিতা শুনিয়ে কাজ হবে না। ছেলেমেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ আছে না? উনিশ বছর ধরে সরকারি চাকরি করো, তোমার সহকর্মীদের একজনের নাম বলো শুনি, যে বাড়ি করেনি বা ফ্ল্যাট কেনেনি।

প্যান্ট-শার্ট খুলে খাটের ওপরে আরাম করে বসলেন প্রফেসর, হলো, হলো, চেষ্টা তো করছি। এখন নাস্তাপানি দাও কিছু। ছেলেমেয়েদের খেলা দেখা বন্ধ করে পড়তে বসাও। মিনু পোশাক পালটায়নি, হলো হলো না, এখনি হতে হবে, নইলে আর কোনোদিনই পারবে না। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে, মেয়েটা মেডিক্যালে ভর্তি হলে কত খরচ আজকাল, জানো? তখন তুমি জমি কিনবে কী করে? হঠাৎ কী হলো মিনুর, চোখ জলময় হয়ে ওঠে, শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে ফেলে, কত সাধ আমার, নিজের একটা বাড়ি হবে, মনের মতো সাজাব, ছেলেমেয়েরা খেলবে-ঘুরবে স্বাচ্ছন্দ্যে। হাঁটতে-চলতে সর্বক্ষণ মনের মধ্যে বাড়িওয়ালির ভয়, বুড়ি হয়ে গেলাম জেলখানায় থেকে, ছাদে উঠতে হলেও অনুমতি লাগে। প্রফেসর মিনুর হাত ধরে কাছে টানেন; কিন্তু চার কাঠা জমির দাম কত জানো? বেতনের ওপরে দশ লাখ লোন নেওয়ার পরও পাঁচ লাখ টান। বড়জোর দুই লাখ টানাটানি করে জোগাড় সম্ভব, বাকিটা?

মিনু উন্মাদের মতো আলমারির চাবি খোঁজে, কোথায়? কোথায়? আলমারির চাবিটা কোথায় রাখলাম? আর মায়া করে লাভ নেই, স্মৃতি ধরে রেখে লাভ নেই। প্রফেসর ভয় পেলেন, বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, হঠাৎ তোমার কী হলো? এরকম পাগলের মতো করছ কেন? ভ্যানিটি ব্যাগে চাবি ছিল। আলমারি থেকে লাল কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট একটি বক্স বের করে মিনু। খাটের ওপর রেখে বক্সটি হঠাৎ উপগত হয়ে পায়ে ধরতে গেল, কী করছ, এ কী করছ, মাঝপথে ধরে ফেলেন প্রফেসর। মিনুর চোখে নোনা জলের জাফরি কাটা। তোমার পায়ে পড়ি, আমার এই অলঙ্কারগুলি নাও। জীবনে কোনোদিন তোমার কাছে এমন কাঙালের মতো আর কিছু চাইব না। ছেলেমেয়ে দুটির ভবিষ্যৎ… হঠাৎ প্রফেসরের চৈতন্য ফেরে, আমি তো সূর্যাস্ত দেখার জন্যে বসে আছি এখানে।

মাটি বড়ো উর্বরা, ফের প্রফেসর স্মৃতিমগ্ন, মাত্র আট মাসেই দেখো আম গাছগুলো কেমন শক্তপোক্ত, আর কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে, নতুন পাতা গজিয়েছে ডালপালায়। বাড়ি করার সময় কাটা পড়তে পারে, তাই আমগাছ লাগানোর ইচ্ছে ছিল না; কিন্তু মিনু বলে, বাড়ির আঙিনায় একটা-দুটা আম-পেয়ারার গাছ থাকবে না, একটু জায়গা থাকবে না লাউ-পুঁইশাকের মাচার জন্যে, ছেলেমেয়েরা সখ করে ফুলের বাগান করতে চাইলে দু-এক হাত জায়গা দিতে পারব না, তা কী করে হয়, বলো? প্রফেসর হেসে বলেন, চার কাঠা জমি তোমার। এ তো দেখছি, এক গজ কাপড় দিয়ে শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবি-টুপি বানানোর গল্পের মতো। মিনু প্রতিবাদ করে, একদম ফোঁড়ন কাটবে না, হেঁয়ালি করবে না, সিরিয়াসলি আমার কথা শোনো; ধরো, আমাদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল; থাকল শুধু ছেলে, আমি আর তুমি; দুই কাঠার ওপর তিনতলার একটি বাড়িই আমাদের জন্য যথেষ্ট। বাকি দুই কাঠায় থাকবে ফলগাছ-সবজির চাষ-ফুলবাগান ইত্যাদি। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো মাথা নাড়লেন প্রফেসর, করছি কি! চোখের চশমা মুছলেন রুমাল দিয়ে, চোখ দুটি মুছলেন; চোখে পরিষ্কার চশমা দিয়ে বুকের ওপর দুহাত পেঁচিয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন মাত্র, ঠিক তখনি উড়ে এসে পড়ল একটি ক্রিকেট বল, মুহূর্তের মধ্যে ১৩-১৪ বছরের এক ছেলে ছুটে এলো, দৌড়ের ধকল সামলানোর জন্যে একটি আমগাছ ধরে দাঁড়ালে প্রফেসর আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, করো কী বাবা, করো কী, কচি চারাগাছ; আমার ছেলের হাতে লাগানো গাছ। বলটি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন, তুমি বোলার, না ব্যাটসম্যান? ছেলেটি হাঁপিয়ে কূল পাচ্ছে না, আমি অলরাউন্ডার। প্রফেসর আনন্দে নেচে উঠলেন, ছেলের পিঠ চাপড়ে আশীর্বাদ করলেন, মন দিয়ে খেলে যাও, দেখবে, সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হবে। জানো তো, আমার ছেলেও অলরাউন্ডার।

ছেলেটি বল হাতে পেয়ে দৌড় দিলো।

আমগাছটি সামান্য হেলে পড়েছে। আদুরে হাতে গাছটি সোজা করে দেওয়ার সময় প্রফেসরের মনে পড়ে, ছেলেটির ফজলি আম পছন্দ, মেয়েটির ল্যাংড়া। মিনু বলে, আমাদের পছন্দের কি আছে, ওরাই খাবে, ওদের সন্তানরা খাবে, ওদের পছন্দের গাছ, ওদের হাতেই লাগাক। গাছ লাগানোর দিনে দুই ভাইবোনের সে কি ঝগড়া। ছেলেটা মেয়েটাকে বলে, তুই ল্যাংড়া আম পছন্দ করিস, ল্যাংড়া আমের গাছ

কি-না। স্যার, কালকেই একবার আসুন, আপনার ইসিজি করে দিই। প্রফেসর রুম থেকে বের হতে-হতে বললেন, সে দেখা যাবে। ভালোই হলো তোমাদের সঙ্গে দেখা হলো; আজ আমার সুখস্বপ্ন দেখার দিন। ডাক্তার-যুবক একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, স্যার, আপনার স্পেশাল ডে? আপনার ম্যারেজ ডে, ছেলেমেয়ের বার্থ ডে, নাকি… প্রত্যুত্তর না দিয়ে লম্বা পা ফেলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর।

ডাক্তার বলে, দেখেন ভাই, স্যার এখনো ইয়াং এনার্জিটিক স্মার্ট হাসিখুশি। স্যারের জন্য গর্ব হয়।

প্রধান সড়কে এসে দাঁড়ালেন প্রফেসর। হেলেপড়া সূর্যটা বেদম দৌড়াচ্ছে, ধীরে-ধীরে বহুতল ভবনগুলোর আড়ালে চলে যাচ্ছে। এত তেজ, এত আগুন আর এত শক্তি বুকে নিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার এত সাধ তোর! সূর্যাস্তপ্রেমী কোনোদিনই ছিলেন না প্রফেসর, এখন ভাবলেন, নির্জন কোনো একটি স্থানে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে সূর্যাস্ত দেখবেন। নির্জন স্থানের কথা ভাবতেই মনে পড়ল, শহরের উত্তর প্রামেত্মর সিটি করপোরেশনের সীমানা ঘেঁষে ড্রিম প্রোপার্টিজের চার কাঠা পস্নটটির কথা। বছর দেড়েক আগে কিনেছিলেন। দু-তিনটি বাড়ি উঠলেও বাকি সব পস্নট প্রায় ফাঁকা। সূর্যাস্ত দেখার জন্য চমৎকার একটি জায়গা। এছাড়া নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা হবে।

হেঁটে সম্ভব নয়, একটি আটোরিকশা ডাকলেন প্রফেসর। রিকশায় উঠেই ভাবলেন, সামনেই ল্যাবরেটরি স্কুল; এ-স্কুলে ছেলেটাকে ভর্তি করার জন্য টানা দুই বছর সে কি ভয়ানক যুদ্ধ। এরকম যুদ্ধে একটা দেশই দখল করা সম্ভব। রোদ-বৃষ্টি-শীত বলে কথা নেই। তিন-চারটা কোচিংয়ে ঘড়ি ধরে দৌড়ানো, বাসায় প্রাইভেট টিচার, তারপরে নিজে তো আছেই। পারেও মিনু। এমন কঠিন জেদি একরোখা মেয়েমানুষ জীবনে আর দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি। অবশেষে ছেলে যেদিন ল্যাবরেটরি স্কুলে চান্স পেল, খবর নিয়ে গেলেন প্রফেসর, খবর শুনে মিনুর প্রমত্ত আবেগ উছলে উঠে বিপদসীমা অতিক্রম করে। হাত-পা আছাড়ি-পাছাড়ি করে সে কী কান্না। সুখের কান্না। মেয়েটির বয়স তখন এক বছর। সুখস্বপ্নের দিনে প্রফেসরের চোখের কোণেও একফোঁটা অশ্রম্ন জমে ওঠে।

স্কুলের ফটকে এসে দাঁড়াল রিকশা। ছুটির দিন। বাইরে থেকে তালা দিয়ে পান কিনতে গিয়েছিল গেটম্যান, প্রফেসরকে দেখে ছুটে আসে, স্যার, ছুটির দিনে! প্রফেসর বললেন, এদিক দিয়ে যাচ্ছি, ভাবলাম, ব্যস্ততার জন্যে ছেলের স্কুলে কতদিন আসা হয় না। একবার দেখে যাই। ক্লাসরুমের চাবি তোমার কাছে? গেটম্যান জিজ্ঞাসু-চোখে তাকালে, প্রফেসর বললেন, তেমন কিছু নয়। তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসরুমের ফাস্ট বেঞ্চি দেখে যেতে চাই। ছেলেটার আমার একটাই জেদ, ফার্স্ট বেঞ্চিতে বসতে হবে। যেদিন ব্যত্যয় হয়, ওর মা খাবার দিতে দেরি করে, সেদিন অর্জুন কুরুক্ষেত্রে আর কী করেছে, তার চেয়ে বেশি শক্তি দেখায়, সেদিন ছেলের কাছে মাফ চেয়ে কূল পায় না মিনু।

ক্লাসরুমের চাবি নেই গেটম্যানের কাছে। অগত্যা মাঠে এক চক্কর দিতে গিয়ে প্রফেসরের শরীর কেমন যেন টাল খেয়ে ওঠে। স্কুলের ক্রিকেট টিমের অলরাউন্ডার ছেলে আমার এই মাঠে কতশতবার দৌড়ায়,  আর দেখো, বাপ হয়ে এক চক্কর দিতে পারি না। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে, ভয় নিয়ে মাঠের মধ্যিখান থেকে গেটের দিকে ছুটে এলেন প্রফেসর। লোহার গেট দিয়ে বের হতে গিয়ে নিচু হতে হবে এ-কথা ভুলে গিয়েছিলেন, কপালে আঘাত খেয়ে ছিটকে পিছু হটেন। দ্বিতীয়বার মাথা নিচু করে বেরিয়ে রিকশায় ওঠেন। কপালে হাত দিয়ে দেখেন ক্রিকেট বলের মতো গোল হয়ে ফুলে উঠেছে।

বুকে মৃদু চাপ, নাক দিয়ে বাতাস নিয়ে কূল পাচ্ছে না ফুসফুস, মাঝেমাঝে মুখ হা করে শ্বাস টানতে হয়। কিছুদূর গেলেই নদীর ধার, সেখানে দাঁড়ালে জলধৌত বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়া যাবে। মহানগরের সুখী মানুষেরা বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিতে, সুখস্বপ্নের গল্পগুজব করতে বিকেল কাটায় নদীর ধারে। প্রফেসর ভাবলেন, অন্তত পাঁচ মিনিট নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিতে  চাই, প্রবীরের ফুচকা হাউসের দক্ষিণ কোণের সেই বেঞ্চিতে বসে এক পেস্নট ফুচকা খেতে চাই, আর পার্কের সেই বেঞ্চিতে বসে পা দোলাতে চাই কিছুক্ষণের জন্যে। সঙ্গে মিনু নেই, ছেলেমেয়ে নেই, আমি একা এসেছি, আমার সুখস্বপ্নের দিন কি-না।

নদীর ধারে পা ফেলাও কঠিন, এত ভিড়। ভিড় ঠেলে দু-পা ফেলার মতো জায়গা তৈরি করে নদীর দিকে মুখ করে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছেন প্রফেসর; পেছন থেকে ডেকে ওঠে অশরীরী কেউ, কী করছ, নদীর এত কিনারে যেতে নেই, পড়ে যাবে যে। বিরক্তির বলিরেখা ফুটে ওঠে প্রফেসরের কপালে। এখানেও শাসন। বলে এলাম, আজ আমার সুখস্বপ্ন দেখার দিন। লুঙ্গিটা উঁচু করে পরো, ঘরের ময়লা সব ঝাড় দিচ্ছ যে; বাথরুমে পানি বেশি করে দাও কেন, হাতটা সাবান দিয়ে তিনবার ধুয়েছ তো, পা-টা ভালোভাবে ধোয়া হয়নি আর একবার ধুয়ে আসো; শব্দ করে হেঁটো না, নিচতলার ওরা বিরক্ত হবে; আর খেতে বসলে তো কথাই নেয়, একমুঠ ভাত বেশি খেলে গলা শিরশির করে এই বুঝি কোপ মারল। এত উৎপাত ঘাড় পেতে মেনে নেয় প্রফেসর, তাই বলে, এখানে। এই দিনে। সুখস্বপ্ন দেখার দিনে! মেয়েমানুষটা কি মনে করে আমাকে; পা পিছলে পড়ে যাব নদীতে! কৃষকের ছেলে আমি, পরিশ্রম আর সতর্কতার গুণে এতদূর পৌঁছেছি, আমি এত সহজে খাদে পড়ি না, আমি এত সহজে ভাঙি না। ১২-১৩ বছরের একটি ছেলে ও পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে কণ্ঠ সমস্বরে আববু বলে ডেকে উঠলে প্রফেসরের শরীর নড়ে ওঠে, এবার আর ঘাড় না ঘুরিয়ে পারেননি। প্রফেসরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওদের সুখী বাবা। ছেলেমেয়ে দুটি বাবার দুদিকে দাঁড়ালে প্রফেসর নিজের ছেলেমেয়ের কথা ভাবেন, ছেলেটা ধীরস্থির হলেও মেয়েটা ভীষণ চঞ্চল। নববর্ষের দিন মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছিল প্রায়, ভাগ্য ভালো, এক সহকর্মীর ছেলে দেখে ফেলেছিল। কোথায় যাচ্ছিল জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, নদীর ওপারের সূর্যটাকে ধরতে যাচ্ছিল। সূর্যটাকে বাড়ি নিয়ে পুষবে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রফেসর হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যে কী হলো, নদীর জলবিধৌত বসমেত্মর বাতাস বৈশাখের তাপদাহে পোড়া বাতাসের মতো তপ্ত হয়ে ওঠে। নদীতে আগুন লেগে গেল নাকি, হঠাৎ গরম বাতাস বইতে শুরু করল। প্রফেসরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ফুসফুস জেগে ওঠার জন্যে নড়েচড়ে ওঠে।

নদীর ধার থেকে বের হয়ে প্রবীরের ফুচকা হাউসের দক্ষিণ কোণের সর্বশেষ টেবিলে বসেন প্রফেসর। নিরিবিলি বলে এ-টেবিলটা মিনুর খুব প্রিয়, টেবিলের তিনটি চেয়ার ফাঁকা। এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে বসতে এলে প্রফেসর অনুরোধ করেন, আমি একটু নিরিবিলি চাই। ভদ্রলোক মানতে নারাজ। প্রফেসর এবার ক্ষেপে উঠলেন, আমার স্ত্রী-সন্তান আছে তো, নাকি আমাকে আপনার নিঃসন্তান মনে হয়? ভদ্রলোকও এবার রেগে গেলেন, এ-কথা বললেই তো হয়, আপনার স্ত্রী-সন্তানরা বসবে, আপনি তো বলছেন অন্য কথা। ওয়েটার দৌড়ে আসে, স্যার আপনি? সেই যে ছ-মাস আগে একবার এসেছিলেন বউদি-ছেলেমেয়ে নিয়ে, আর তো আসেননি। ভদ্রলোক ছেলেকে নিয়ে পাশের টেবিলে বসেছেন। প্রফেসর তখনো উত্তেজিত, ভদ্রলোককে শুনিয়ে ওয়েটারকে আদেশ করেন, চার পেস্নট ফুচকা দাও চটজলদি। তোমার বউদির আর মেয়ের পেস্নটে টক দেবে বেশি, ছেলের পেস্নটে একেবারেই সামান্য, আর আমারটা তো জানোই। নরমাল।

চার পেস্নট ফুচকা, চারটি পানির বোতল চারটি চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপরে চমৎকার গোল করে সাজিয়ে রেখেছে ওয়েটার। ফুচকার দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেলে হেসে ওঠেন প্রফেসর, মিনুর ফুচকা খাওয়ার লোভ একটু বেশিই। ছেলেমেয়েদুটি তো মার চেয়ে বেশি ফুচকা-বিলাসী। নিজের হাতে টক মিশিয়ে প্রথমে মা, তারপর বাবা, তারপর ভাইয়ার মুখে একটা করে ফুচকা তুলে দিয়ে শেষে নিজে মুখে নেবে মেয়ে। ফুচকা তুলে দেওয়ার সময় প্রায় মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় ওর ছোট্ট হাতটি। ছেলেটা বদমায়েশি করে মাঝেমধ্যে

ল্যাংড়ার অভিনয় করেও দেখায়। মেয়েটা রেগে আগুন। পাশে দাঁড়িয়ে মেহগনি গাছ গুনে দেখছিল মিনু, হঠাৎ কী হলো, ঠাস করে এক চড় মারল ছেলের গালে, বদমায়েশ, ভাই হয়ে বোনকে অভিশাপ দিচ্ছিস, ও পঙ্গু হলে তো তোকেই সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনুর চোখ ভিজে আসে, আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মোছে, ঘুরেফিরে এসে প্রফেসরকে বলে, ছেলের গায়ে হাত তুললাম। এ তো ভালো কথা না। এত বড় হয়েছে, কোনোদিন হাত তুলিনি, রাগের মাথায় এ কী করলাম আমি। ছেলেটা অবশ্য চড়ের কথা ভুলে গিয়ে কাজে মন দিয়েছে। এবার সম্বিত ফিরে এলে প্রফেসর শরীর ঝাড়া দিয়ে বসেন, আমি এখন নিবিড় মনোযোগ দিয়ে সূর্যাস্ত দেখব।

পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলে আহত পশুর মতো ছটফটিয়ে ওঠেন প্রফেসর। তার পিলে চমকে দিয়ে হঠাৎ কোথায় থেকে উদয় হলেন শরিফ সাহেব। আরে, আপনি এখানে? দুই বছর পরে এখানে আপনার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। এখানে পস্নট নিয়েছেন নাকি?

এই পস্নটটি। নিচু কণ্ঠে বললেন প্রফেসর।

আমি একটা নিয়ে রেখেছি। ভাবছি, দাম বাড়লে বিক্রি করে দেব।

বিরক্তি ও হতাশা আড়াল করা চেষ্টা করেন প্রফেসর, লালমনিরহাট থেকে কবে এলেন, ভাবি-বাচ্চা এসেছে? আজ আমার সুখস্বপ্ন দেখার দিন, এখন সূর্যাস্ত দেখছি, এসব কথা বললে কী ভাবে লোকটি কে জানে।

আপনার তো রাজকপাল। ঘরে-বাইরে জিতে আছেন। সারাজীবন এত পরিশ্রম করে শেষে হেরেই গেলাম কি-না; নিজের মুখোমুখি হলে মনে হয়।

আমার রাজকপাল! কি রকম? প্রফেসরের ঠোঁটের কোণে হাসি।

এই দেখুন, যতবার আপনার প্রমোশন হলো, শহরের কোন একটি কলেজে ঠিকই পদ শূন্য পেলেন। আমার কপাল দেখুন, প্রত্যেকবার প্রমোশনের পরে শহর ছাড়তে হয়। এবার তো লালমনিরহাট থেকে আর ফেরার সম্ভাবনা নেই।

প্রফেসরের ঠোঁটের কোণে এখনো হাসি, ঠিকই বলেছেন, আমি ভাগ্যবান মানুষ।

ভাগ্যবান কাকে বলে, হিরের টুকরো ছেলেমেয়ে, এমন ভাবি, ঘরভরা সুখ, আপনাকে রীতিমতো হিংসে করি। অট্টহাসি দিয়ে সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তের শান্তসুনিবিড় রহস্যঘেরা পরিবেশকে হালকা করে ফেললেন শরিফ সাহেব। আমি কী করব বলুন? আমার কোনো দোষ নেই। উঠতে-বসতে-খেতে-শুতে আপনার ভাবি একই রেকর্ড বাজায়, আমি নাকি আপনার মতো হতে পারিনি। টিউশনি-কোচিং এসবের পেছনে পাগলা হাতির মতো চোখ-কান বন্ধ করে ছুটছি। আচ্ছা বলুন ভাই, আমি কি এসব করি সখে? এখানে নগদ টাকায় ছ-কাঠার একটি পস্নট, শহরের ভিতরে ছোটখাটো একটা বাড়ি করেছি; প্রফেসর হেসে উঠলেন, সাত কাঠা জমির ওপর টু-ইউনিটের পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্টকে আপনি ছোটখাটো বাড়ি বলছেন? শরিফ সাহেব হাসলেন, আপনি দেখি কিছুই খবর রাখেন না, চোখ বন্ধ করে চলাফেরা করেন নাকি, এ-শহরে এখন বিশ-পঁচিশ তলার অ্যাপার্টমেন্ট হরহামেশা উঠছে। প্রফেসর ঘাড় কাত করলেন, তা ঠিক বলেছেন, সেই তুলনায় আপনার বাড়িটা ছোটই বটে।

আপনাকে এতো করে অনুরোধ করলাম, আমার বাড়িতে ওঠেন। অন্যদের চেয়ে ভাড়া কিছু কমিয়ে নেব, আপনি শুনলেন না। এতোদিনের সহকর্মী আপনি, আপনি থাকলে নিশ্চিমেত্ম থাকতে পারি। ভাড়াটিয়ারা যা জ্বালায়…।

প্রফেসর শুধুমাত্র প্রচ্ছন্ন হাসলেন।

এবার লোন নিয়ে বাড়িটা করে ফেলুন। আর কতদিন থাকবেন পরের বাড়ি। স্বপ্ন ঠেকিয়ে রাখতে নেই। বাড়িটা করে ফেলুন। আপনি হোমলোন পেয়ে যাবেন ইজিলি।

প্রফেসর এবার মুচকি হাসলেন।

আপনার ছেলে তো এবার জেএসসি দেবে, এ-ছেলে ডাক্তার না-হয় ইঞ্জিনিয়ার হবে হেসেখেলে; আবার ক্রিকেট খেলায় অলরাউন্ডার। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলের এদিকটায় একটু বেশি নজর দিয়েন?

প্রফেসর না শোনার ভান করলেন, কোন দিকটা?

ক্রিকেট খেলা। আমার ছেলেটার জন্য এতো চেষ্টা করছি, এত খরচ করছি, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। লেখাপড়াও এগোবে বলে মনে হয় না। আমার ছেলে পায় বি-গ্রেড, ভাবুন তো? তবে মেয়েটা আমার লক্ষ্মী, পড়াশোনায় যেমন, নাচে-গানেও তেমন। আপনার মেয়ে নাচ-গান শিখছে তো?

আসি ভাই, আর দাঁড়াতে পারছি না, হাঁটার জন্যে পা বাড়ালেন প্রফেসর, আলো কমে আসছে, গভীর অন্ধকার নেমে আসছে, এখনি ফিরতে হবে ঘরে।

প্রফেসর জোরে জোরে হাঁটছেন আর ভাবছেন, রিকশাটাকে ধরে রাখলেই ভালো হতো। কিছুদূর হাঁটার পর রিকশা পেলেন। গলির ভিতরে যখন প্রবেশ করে রিকশা, তখন লোডশেডিং চলছে। সুখস্বপ্ন দেখার দিনে এমন অন্ধকার ভালো লাগে? প্রফেসর ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠেন। বেরোবার সময় দরজাটা যেভাবে ভিড়িয়ে রেখে গিয়েছেন সেভাবেই আছে। ভেতরে ঢোকার মুখে একবার, স্যান্ডেল খোলার ফাঁকে দুইবার, এবং সমাধিক্ষেত্রের অন্ধকারের মতো নিস্তব্ধ অন্ধকার হাতড়ে মিনুর খাটের কাছে পৌঁছার আগে পর্যন্ত ননস্টপ ডেকে যান, মিনু, মিনু, মিনু শুনছো। সাড়া না পেয়ে প্রফেসর ভাবলেন, অভিমান করেছে নির্ঘাত। বিছানায় হাত ফেলে দেখেন, মিনু নেই। অন্ধকার নাড়িয়ে কেuঁপ ওঠে প্রফেসরের শরীর। ঘোলা পানিতে মাছ ধরার মতো খাটের ওপরে, রুমের ফ্লোরে, এমনকি খাটের নিচে হাতড়ে খোঁজেন, নেই, মিনু নেই। অর্ধেকটা শরীর নিয়ে তুমি কোথায় গেলে? হঠাৎ মনে পড়ল, ছেলের ঘরে যেতে পারে, কিন্তু কীভাবে? কেউ কি ঢুকেছিল বাসায়?

বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে চোখ ধাঁধিয়ে। রুমের কোথাও নেই মিনু।

প্রফেসর দৌড়ে এসে দেখেন, ছেলের বিছানার উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বইগুলো গুছিয়ে বুকের কাছে নিয়ে খাটে মাথা ফেলে ঘুমিয়ে আছে মিনু।

ও তুমি ছেলের ঘরে! এ-ঘরে এলে কী করে! দেখো কা-, এখানে এসে আবার ঘুমিয়েও পড়েছে। ছেলেকে পড়তে বসিয়ে খাটের ওপর মাথা দিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তে। অভ্যাসটা তোমার এখনো গেল না দেখছি! প্রফেসরের ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি।

মিনুর নড়াসাড়া নেই। প্রফেসর এবার ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন, হাতটা মিনুর পিঠের উপরে রাখলেন, শরীরটা বরফের মতো ঠা-া ঠেকল, সামান্য নাড়া দিতেই আলগোছে মিনুর শরীর হেলে পড়ল কোপ-খাওয়া কলাগাছের মতো। ফ্লোরে আসন পেতে বসলেন প্রফেসর; মিনুর নিথর মাথা কোলের ওপর নিয়ে মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, আমি কী এখন কাঁদব মিনু? আমাকে ছেড়ে তুমি ছেলেমেয়েদের কাছে গেছ, আমি কি কাঁদতে পারি? যেদিন কাঁদবার কথা ছিল, সেদিন তো কাঁদতে পারিনি।

ছেলেমেয়ে দুটির জন্যে হাত-পা ছেড়ে কাঁদব, স্বামী হিসেবে তোমার জন্য কাঁদব। সময় পেলাম কই?

চোখের পলকে কি ঘটল। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার পাশে, তোমার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর; ওদের বাঁচাতে তুমিও লাফিয়ে পড়লে রাস্তার ওপর; আমার চোখের সামনে তোমার পাদুটির হাড়-মাংস এক করে মরিচ বাটার মতো বেটে পিষে গেল বর্বর  ট্রাকটা, তখন তুমি দুই হাত বাড়িয়েছিলে, দেখেছি আমি, কাকে ধরতে চেয়েছিলে দুই হাতে, মেয়েকে? ছেলেকে? নাকি আমাকে? তোমার ছেলেমেয়ে দুটির চিৎকার ততক্ষণে থেমে গেছে, ওদের কচি দুটি শরীরের ওপর দিয়ে গিয়েছে কি-না ট্রাকের সামনের চাকা দুইটা। ছোট্ট দুটি দেহে এত মাংস, এত রক্ত ছিল, ছোট্ট  দুটি মাথায় এত মগজ ছিল, আমার এই দুই হাতে জমিয়ে-কুড়িয়ে কুল পাচ্ছিলাম না, কারা যেন তুলে নিয়ে গেল তোমাকে, আমি ছেলেমেয়ের হাড়-মাংস-মগজ-রক্ত জমা করছি, ছেলেমেয়েকে আলাদা করছি না, আমারই তো শরীর, আলাদা করব কেন?  r