সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সাহিত্যকৃতি : নীলাভ রেখার ঘূর্ণি

পিয়াস মজিদঁ

জানুয়ারি ২০০১-এ প্রকাশিত হয় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের (১৯৫০-২০১৫) উপন্যাস নীল ঘূর্ণি। মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনের গবেষণায় মগ্ন প্রৌঢ় বোধিসত্ত্ব মজুমদার তার বৈজ্ঞানিক যুক্তি-সূত্রকে দয়িতা নামে এক তরুণীর দুরন্ত-দুর্বার ঘূর্ণিতে সমর্পণ করে চেয়েছিলেন শমশান্তি। দয়িতাও চেয়েছিল তাই। কিন্তু ঘূর্ণি তো আর মাপজোখ মানে না। তাই ভাসিয়ে নিয়ে যায় বোধিসত্ত্ব-দয়িতা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আর সবাইকে। সবচেয়ে ভাসায় বুঝি দয়িতাকে –

শিশুর মতো কী খুঁজছিলেন তিনি দয়িতার দেহে? দয়িতা কি আকাশ হয়ে গিয়েছিল? অচেনা ব্রহ্মান্ডকে প্রাণ ভরে দেখছিলেন বোধিসত্ত্ব? সৃষ্টিরহস্যের মূলে পৌঁছতে চাইছিলেন?

আর অন্যদিকে –

অপরূপ এক প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছিল দয়িতা। বোধিসত্ত্বই তার প্রেম, তার জীবনে প্রথম পুরুষ…

না, এই প্রশান্তি দীর্ঘাবয়ব পায়নি কারণ বোধিসত্ত্বের কাছে দয়িতা ছিল তার ইনটেলেক্টের ক্ষুধা মেটানোর এক্সপেরিমেন্ট আর দয়িতা ছিল অপার প্রেমপূর্ণ। অশান্ত ঘূর্ণি এসে বোধিসত্ত্বের প্রকৃত রূপ দয়িতার কাছে স্পষ্ট করলে চারপাশের বাস্তবটাও অনুধাবনে আসে তার। ভেতরের হাজার ভাঙচুরেও বাইরে নুয়ে না-পড়া এই নারী তার আত্মসত্তার অন্বেষণে চলে। সে-যাত্রায় সৌমিককে সে পায় অপ্রত্যাশিত সঙ্গী হিসেবে। না পেলেও হয়তো ক্ষতি ছিল না। আর উলটোদিকে বোধিসত্ত্বের স্ত্রী রাখী; স্বামীর প্রত্যাখ্যানের আকস্মিক আঘাত তাকে ক্রমে রূপান্তর দেয় এক অন্য মানবী হিসেবে। স্বামী-সংসার ছিল যার জীবনগৃহে প্রবেশ-বাহিরের একমাত্র দরোজা; সেই নারী কিছুদিন একলা থেকে অনুভব করে প্রত্যেক মানুষেরই একান্ত নিজের একটা জানালা থাকা লাগে। তাই দয়িতাকে ছেড়ে নিজের স্বার্থসুখে বোধিসত্ত্ব যখন ফের ফিরতে চায় স্ত্রী রাখীর কাছে, রাখীর স্বজনপরিজন সবাই যখন সম্মত এই পুনর্মিলনে, তখন রাখী তার ছেলে বাবুয়াকে যে বলে ‘মেয়েটা (দয়িতা) চলে যাওয়ার জন্যই আমার ডাক পড়েছে। এত বড় অসম্মান আমি কী করে মাথা পেতে নেব?’ এতেই নেহায়েত এলেবেলে এক নারী রাখীর পুনর্জন্ম স্বাক্ষরিত হয় যেন। না, কাউকে কৃষ্ণগাঢ় বা কাউকে আলোকিত-উজ্জ্বল চরিত্র হিসেবে নির্মাণ করেননি সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বরং বাস্তবের মারে পর্যুদস্ত মানুষ, বিশেষত নারীর আন্তর-অবয়বের নকশা এঁকেছেন তিনি। সেই সঙ্গে নারীর প্রচল অভিমুখকে ভেঙে দিয়ে গড়েছেন তার ইপ্সিত নতুন গন্তব্য। সাহিত্যে নারীর এই অভিনতুন পরিসর প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করে দিন পালটাচ্ছে – ভেতরে ও বাইরে। ভার্জিনিয়া উলফ নারীর নিজের জন্য একটি ঘরের কথা বলেছিলেন আর সুচিত্রা তাঁর  গল্প-উপন্যাসে বলেছেন অন্তর্পৃথিবীতে নারীর আপন আলয়ের কথা। আবার বৃহদার্থে শুধু নারী নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ মানুষের আত্মবিশ্বের বিষয়েই সমুদয় জোর তাঁর।

দুই

সুচিত্রা ভট্টাচার্য জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৫০-এর ১০ জানুয়ারি ভারতের বিহারে, ভাগলপুরের মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। তাঁর মৃত্যু-উত্তর ২৩ মে ২০১৫ সংখ্যা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ভগ্নিকন্যা মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যের স্মৃতিলেখন-সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী সুচিত্রার প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল একটি ছড়া, যা বেরোয় স্কুল ম্যাগাজিনে। অভিনয় ও নৃত্যকলায় হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই। মঞ্চনাটক তো বটেই, এমনকি বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র কাবুলিওয়ালা এবং হারানো সুরে অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী হিসেবে। রক্ষণশীলতার দুর্গ ভেঙে প্রথাভাঙার শুরু নিজের জীবনের শুরুতেই আর তার অনিবার্য ছায়াপাত সাহিত্যে। লেডি ব্রেবোর্ন, যোগমায়া কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বিষয় যেমন কখনো ছিল বাংলা সাহিত্য, তেমনি শেষ দিকে রসায়নশাস্ত্র। মিশ্র পড়াশোনা বিচিত্র সব পেশায় যেমন সম্পৃক্ততা ঘটিয়েছে তাঁর, তেমনি লেখালেখিতেও প্রভাব পড়েছে এই মিশ্র ও বহুকৌণিক পাঠাভিজ্ঞতার। ১৯৭৯ সালে চাকরি নেন ‘ওজন ও পরিমাপ দপ্তরে’ আর অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার হিসেবে সেখান থেকে সার্বক্ষণিক সাহিত্যচর্চার জন্য স্বেচ্ছা-অবসর নেন ২০০৩-এ।

দেশ ও আমি শীর্ষক দেশ পত্রিকার সত্তর বছর স্মারকপুস্তিকায় প্রকাশিত সুচিত্রার স্মৃতিভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে, স্কুলজীবনই সাহিত্যে আগ্রহের সূত্রপাত। নিজস্ব নির্মিতিতে নেপথ্য রসায়কের ভূমিকা রেখেছে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্টজনদের লেখাপত্র – বিমল মিত্র, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, সমরেশ বসু, গৌরকিশোর ঘোষ, শংকর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের উপন্যাস, বিশেষ করে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কুবেরের বিষয় আশয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য, সুনন্দর জার্নাল, মার্কিন মুলুক থেকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর চিঠি ইত্যাদি।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে গল্পসাহিত্যে সুসক্রিয় পাই সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে। লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকেই সাহিত্যিক শোভাযাত্রা শুরু তাঁর। সমসাময়িক লেখকবন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য-আড্ডা ‘গল্পচক্র’। এই আড্ডার মুখপত্র  ঋতুপত্র গাঙ্গেয় নামের লিটলম্যাগে এবং রোচনা, গল্পপত্র, প্রসাদ, যুগান্তর, বর্তমান ইত্যাদিতে গল্প লিখেছেন তখন। ‘রূপকথার জন্ম’ নামে তাঁর একটি গল্প পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান দেশ পত্রিকায় লিখতে। ‘বাদামী জড়ুল’ নামেই একটি গল্প দিয়ে দেশে প্রথম গৃহপ্রবেশ তাঁর। গল্পে মানুষের ব্যক্তিক সংকট-টানাপড়েন-সময়ের সুনামিতে ধসেপড়া মূল্যবোধ – পারস্পরিক সম্পর্কের সরলতা-গভীরতা-জটিলতা চিহ্নায়িত করেছেন নিরূপম শিল্পীর তুলিরেখায়।

তিন

আশির দশকে উপন্যাসে গৃহনির্মাণ সুচিত্রার। ঋতুপত্র গাঙ্গেয়তেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস আমি রাইকিশোরী। নিজের চাকরিজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ঔপন্যাসিক অবয়বে আলোছায়া ফেলেছে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চীনা, তিববতি মেয়েদের জীবনাভিজ্ঞতার দেখা পাই আমরা এ-উপন্যাসে। তারপর ১৯৯২-এর আনন্দবাজার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস কাচের দেওয়াল।  এই উপন্যাস তাঁর লেখকজীবনে সৃষ্টি করে নতুনতর বাঁক। বৃহত্তর পাঠকের কাছে যেমন পৌঁছে যান, তেমনি লেখক হিসেবে নিজের ভিত্তিভূমিও টের পেতে থাকেন। কাচের দেওয়ালে আমরা দেখি সুচিত্রার নিজস্ব নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পর্কচ্ছিন্ন বাবা-মায়ের সন্তান বৃষ্টির মনোবিকারকে জাজ্বল্য করেন লেখক; একই সঙ্গে বৃষ্টিকে দিয়েই আমাদের উপলব্ধিতে আনেন এই সাধারণ সত্য যে, ‘শুধু একটা দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সম্পর্ককেই বিচার করা যায় না। করাটা বোকামি। প্রতিটি মানুষই কোন এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে নিজের কাছেই অসহায়।’ বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে নিজ জীবনে বিদীর্ণ বৃষ্টি যখন বোঝে ‘জীবন তো একটাই। সেই জীবন কত ভাবেই না ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে মানুষ। জীবনের মানে খুঁজছে। নিজেদের মত করে।’ তখন গহনগভীর থেকে উঠে আসা প্রত্যাশা তার, ‘আর একটাও বৃষ্টি যেন তৈরি না হয় কোথ্থাও’; কিন্তু বৃষ্টির এই উপলব্ধির রূপান্তরের মধ্য দিয়েই যেন একটি নয়, ঝমঝমিয়ে আকাশ ভেঙে নেমে আসা সহস্রলক্ষ বৃষ্টির ফোঁটা পাঠকের চেতনমহলের রুক্ষ কন্দরগুলো সিক্ত করে দিয়ে যায়।

এভাবে সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর – যখন যুদ্ধ, অর্ধেক আকাশ, অন্য বসন্ত, অাঁধারবেলা, আয়নামহল, আলোছায়া, উড়ো মেঘ, অলীক সুখ, একা, তিনকন্যা, ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ে, মেঘপাহাড়, প্রেম-অপ্রেম কাছের মানুষ, গভীর অসুখ, গহীন হৃদয়, চার দেওয়াল, ছেঁড়াতার, জলছবি, দহন, পরবাস, পালাবার পথ নেই, ভাঙনকাল, রঙিন পৃথিবী, বৃষ্টি নামার পর, শেষ শান্তিপুর লোকাল, মনোভূমি, ঢেউ আসে ঢেউ যায়, সুখ অসুখ, সুখদুঃখ, হাতেমাত্র তিনটি দিন, শূন্য থেকে শূন্যে, রূপকথা নয়, হেমন্তের পাখি, এই আকাশের নিচে একের মধ্যে অনেক, শেষবেলায়, হলুদ গাঁদার বনে, খাঁচা, রূপকথার জন্ম, ময়না তদন্ত, এই মায়া – এমন চবিবশটি উপন্যাস এবং দুই শতাধিক গল্পের মধ্য দিয়ে মানবীয় বাস্তবতা ও অনুভাবনের এক ভিন্ন দিগন্ত সৃজন করে চলেন, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজের মতো করে পৃথিবীর মুখোমুখি হয়; যুগপৎ তার বিজয় ও পরাস্ততা সমেত। অপ্রিয় অনুষঙ্গ সুচিত্রায় সুদূর কোনো বিষয় নয়, বরং কঠিন সত্যের ভালোবাসায় যে কোনো প্রকার প্রবঞ্চনাকে অস্বীকরণে যেন তাঁর স্বস্তি।

১৯৯৪-এ পত্রিকায় প্রকাশ পায় দহন উপন্যাস, যা পরবর্তীকালে প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ কর্তৃক চলচ্চিত্রায়িত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দহনের নারী-সাহসিকা ঝিনুক লড়তে লড়তে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়। উইশফুল থিংকিংয়ের মতো জিতিয়ে দেননি সুচিত্রা তাকে। তাই পাঠকের কেউ কেউ ঝিনুকের হেরে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি ছুড়ে দিয়েছেন পালটা প্রশ্ন, ‘ঝিনুক হেরে যাওয়ায় আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন?’ তারা ‘হ্যাঁ’ বললে লেখকের উত্তরের অভিঘাত এমন, ‘আমি আপনাকে এই কষ্টটাই দিতে চেয়েছিলাম! এই কষ্টের থেকে একটা ঢেউ উঠবে। সেটা আরও নানা ঢেউয়ের জন্ম দেবে। আর এভাবেই সমাজে পরিবর্তন আসবে। আর সত্যি বলতে কী, এখনকার সমাজে ঝিনুকেরা ক্রমাগত হেরেই যায়, জেতে না।’ (সূত্র : স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, বইয়ের দেশ, এপ্রিল-জুন ২০১৩)

১৯৯৫-এর নভেম্বর থেকে ১৯৯৭-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সাময়িকপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মহাকায় উপন্যাস কাছের মানুষ। এ-উপন্যাসের নামটি এখন এক বহু উচ্চারিত বিশেষণে রূপ নিয়েছে। উপন্যাসের তিতির-ইন্দ্রানী-টোটো-কন্দর্প-বাপ্পা চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমকালের মানুষ যেন নিজেকেই দেখেছে সুচিত্রা-সৃজিত দর্পণে। বড় ক্যানভাসে জীবনকে ধারণ ও দেখার যে ঔপন্যাসিক সাফল্য তিনি এখানে রেখেছেন, অকস্মাৎ মৃত্যুর ঢেউ তাঁকে এক্ষেত্রে আর নতুন কোনো নিরীক্ষার সুযোগ দিলো না। নানান সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যতে বড় ক্যানভাসে এমন আরো কিছু লেখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

সুচিত্রার লেখায় ডিটেলিংয়ের অনন্যতা যেমন লক্ষযোগ্য, তেমনি তাঁর গদ্যরীতিও স্বাতন্ত্র্যখচিত। বিষয়ানুগ হয়েও বিষয়াতীত ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। কখনো কবিতার লালিত্যময় কিন্তু কাব্যাক্রান্ত এলায়িতের ভঙ্গি নেই কোথাও। এমন গতিমান গদ্যই যেন তাঁকে দিয়েছে পাঠকের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের সুযোগ। তৈরি করে নিয়েছেন নিজস্ব এক পাঠকগোষ্ঠী। এ বিষয়ে জয় গোস্বামীর মন্তব্য ভাবার মতো, ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, রমাপদ চৌধুরী, মহাশ্বেতা দেবী এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছেন সাহিত্য জগতে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অনেক আগে থেকেই এঁরা বিস্তার করে রেখেছেন নিজের নিজের পাঠক-সাম্রাজ্য। তার মধ্যে নিজের স্বতন্ত্র স্থান করে নেওয়া এ বড় শক্ত কাজ।’ (সংবাদ প্রতিদিন, মে ২০১৫)

এ-শক্ত কাজটি সুচিত্রার হাতে সুসম্পন্ন হয়েছে তাঁর স্বর্ণময়ী সৃষ্টির জোরে। সুচিত্রা লিখেছেন নিজের চেনা পরিপার্শ্ব নিয়ে। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের রূপান্তরের পর্বগুচ্ছ তাঁর লেখায় ভাষারূপ পেয়েছে। বারবার বলেছেন, সাহিত্য তাঁর নিজের জীবনের চেতনা ও অবচেতনার মিশ্রণফল। সামাজিক নানা অভিঘাত তাঁর গল্প-উপন্যাসে ব্যক্তিচরিত্রের মাঝে জারিত হয়েছে অনুপম আলকেমিতে। পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাহিত্যিক বিমল করের কাছে তিনি পেয়েছেন এই মহার্ঘ্য শিক্ষা যে, নিজের বৃত্তের বাইরে গিয়ে লিখলে সেটা মেকি হয়ে পড়ে। নিজের প্রতিটি লেখাকে তিনি ধারণ করেছেন নিজের আত্মার অন্তর্মহলে। তাই লিখতে গিয়ে তিনি নিজেই অনুভব করেছেন নিজের চরিত্রকে; কখনো গহীন হৃদয়ের অনুপম, কখনো নীল ঘূর্ণির দয়িতা আবার কখনো কাছের মানুষের তিতির। ‘মহিলা ঔপন্যাসিক’ বলে বাংলা সাহিত্যের কোনো আলাদা হারেমে তাঁর আস্থা ছিল না মোটেও। মেয়েদের হয়ে যখন পুরুষরা লেখে তখন তাদের সংকট বা অবস্থা অনেকটা রোমান্টিসাইজ হয়ে থাকে; কিন্তু নারী হয়ে নির্মোড়ক সত্যটাকে মাংসের তলায় হাড়পাঁজরাসহ দেখাতে চেয়েছেন তিনি। মাসকয়েক আগে কথাশিল্পী প্রতিভা বসুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে এক রচনায় তিনি যখন বলেন, ‘প্রতিভা বসুর জন্মশতবর্ষে অধমের একটাই মিনতি সাহিত্য সমালোচক নামক প্রজাতির কাছে। লিঙ্গভেদের চশমাটা অাঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে প্রতিটি লেখকের লেখাকে সার্বিক প্রেক্ষাপটে দেখতে শিখুন।’ (দেশ বই সংখ্যা, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) তখন নারীর রচনা বিষয়ে তাঁর সর্বতোমুখী দৃষ্টিভঙ্গি অস্পষ্ট থাকে না মোটেও। এ-বিষয়ে নবনীতা দেবসেনের মূল্যায়নেও বিষয়টি ব্যখ্যাত হয়েছে যথাযথ, ‘সুচিত্রার লেখা শুধুই তো মেয়েদের নিয়ে নয়, তাদের জীবনের সঙ্গে জড়ানো মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষদের নিয়েও, তাদের বাঁচা-মরার, প্রেম-ঘৃণার অন্তরঙ্গ সামাজিক, হার্দিক সম্পর্ক নিয়ে। মধ্যবিত্তের জীবনযাপন নিয়ে সুচিত্রা লেখেন, অন্যান্য লেখকও প্রধানত তা-ই লেখেন, কিন্তু এভাবে চিহ্নিত হন না। সুচিত্রার দেখার চোখটি যেহেতু মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষের  নয়, একমাত্র যে চোখটিকে আমাদের উন্নাসিক সমালোচকেরা সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির উপযুক্ত বলে মেনে নেন, তাই সুচিত্রার লেখার ভিতরের শাঁসটুকু তাঁরা চিনতে পারেন না।’ (সংবাদ প্রতিদিন, মে ২০১৫)

চার

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মাঝে সুচিত্রা ভট্টাচার্য সৃষ্টি করেছেন নতুন সেতুবন্ধ। তাঁর দহন উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ যেমন পেয়েছে জাতীয় পুরস্কারের সম্মান, তেমনি তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে অন্য বসন্ত, অলীক সুখ, রামধনু, ইচ্ছে ইত্যাদি চলচ্চিত্র। তাঁর লেখায় ‘পিকচারাস্ক’ বৈশিষ্ট্যের কথা অনেকে বলেন, যা পাঠকের প্রাথমিক পাঠেই একটি নিটোল ছবি উপহার দেয় মানসপটে এবং তাই হয়তো চলচ্চিত্রকারদের  আগ্রহী করেছে বিপুলভাবে। তবে চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দিয়েও তিনি সবসময় একে ভেবেছেন সম্পূর্ণ পৃথক শিল্পমাধ্যম হিসেবে। মঞ্চরূপও পেয়েছে তাঁর সৃষ্টি। প্রথম দিকের উপন্যাস কাচের দেওয়াল কলকাতার নাট্যদল থিয়েটারওয়ালা নাট্যপ্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে। সুচিত্রার কাছের মানুষ উপন্যাসটি নাট্যজন আফসানা মিমির নির্মাণে ১০০ পর্বেরও বেশি ধারাবাহিক নাটক হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে।

সুচিত্রার সাহিত্যভুবন বৈচিত্র্যে ভাস্বর। তাই তাঁর সৃষ্টির এক বিশেষ অংশ জুড়ে থাকে গোয়েন্দাকাহিনি এবং শিশুকিশোর-সাহিত্য। তাঁর ‘মিতিন মাসি’ নামের গোয়েন্দা সিরিজ ছিল সবার প্রিয়। নারী গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যে নারীর অবস্থানকে যেন আরেকটু ব্যাপ্ত করলেন। ছোটবেলায় পড়া আগাথা ক্রিস্টির ‘মিস মার্পল’ বা প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘কৃষ্ণা সিরিজ’ তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে এই নারী চরিত্র নির্মাণে, যেখানে মেয়েদের বুদ্ধি, মনন, পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার সবল প্রকাশ ঘটে। আর তাঁর এই চরিত্র মোটেও আরোপিত বোধ হয় না পাঠকের কাছে, কারণ দেখা যায়, এই গোয়েন্দা নারীর ঘর-স্বামী-সংসার সবই আছে; আর দশটা নারীর মতোই অতি স্বাভাবিক তার দৈনন্দিন জীবনযাপন। গোয়েন্দা গল্পের মোড়কে তিনি ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতির ছবিও অাঁকেন। তাই চেনা জনজীবনের বাইরে চীনা-আর্মেনীয়দের জীবনও তাঁর সৃষ্টির দৃষ্টিতে চলে আসে অনায়াসে। ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য বইতে আমরা এর দৃষ্টান্ত পাই। অন্যান্য শিশুকিশোর গ্রন্থের মধ্যে আছে – ভাঙা ডানার পাখি, জোনাথনের বাড়ির ভূত, কেরালায় কিস্তিমাত, দুঃস্বপ্ন বারবার ইত্যাদি। জুলাই ২০০১-এ প্রকাশিত হয় তাঁর কিশোরকাহিনি সংকলন জার্মান গণেশ।

কিশোরগল্পে রহস্য-রস-উদ্ভাবনময়তার যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন তিনি তা সত্যিই সুদুর্লভ ‘…এই তো সেদিন আমি একটা পোয়েম কিছুতেই মুখস্থ করতে পারছিলাম না, বাবা খুব বকছে, ঠাম্মা বলল, পুপসির তো এমন হওয়ার কথা নয় রে খোকা! ওর এত মাথা, গেল কোথায়! আমিও ভেবে মরি। সত্যি তো, গেল কোথায় আমার মাথা! কিডন্যাপড্ হয়ে গেল!’ (‘টুটানমামার বিপদ’, জার্মান গণেশ)

এমন বুদ্ধিদীপ্ত-অমল রসধারায় সুচিত্রার শিশুকৈশোরক লেখায় আমরা প্ল্যানচেটের আসরে পাবলো পিকাসোকে দেখতে পাই মাকে এসে পেইন্টিং শেখান, বহুভাষাবিদ ভূতেদের মুখে শুনি চাইনিজ-ইডিশ-সোয়াহিলি-সাঁওতালি-সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষার বোলচাল আর গুলবাজ রাজুর ভাষ্যে নাট্যকার-আবৃত্তিকার শম্ভু মিত্রকে পাওয়া যায় গুলকয়লার ব্যবসায়ী হিসেবে। সুচিত্রার শিশুকিশোর সাহিত্য তাই রূপ নেয় সর্বজনপ্রিয় পাঠ্যে।

পাঁচ

সুচিত্রা তাঁর সাহিত্যে যেমন মানব-অবমাননার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন, তেমনি বাস্তবিক জীবনেও তাই। সকল প্রকার পীড়ন ও কর্তৃত্ববাদের প্রতিবাদে তাঁকে আমরা বিভিন্ন সময় সরব দেখেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক দুর্ঘটে তাঁর কণ্ঠ বেজে উঠেছে অভীক। সম্প্রতি কলকাতায় সন্ন্যাসিনী নিপীড়নের ঘটনায় তিনি সোচ্চার হয়েছেন জোরগলায়। এক জীবনে একলা একা মানুষের দুঃখ-হতাশা-পরাজয়ের কাহিনি বুনেছেন অনেক। তাই হয়তো বিশ্বাস করতেন মানুষের যূথবদ্ধ মানবিক উত্থানে। এগিয়ে যেতে চাইতেন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। ‘সই’সহ বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠন ও সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তাঁর। নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে সাবলীল সম্পর্ক তাঁর দেখার জগৎকে দিয়েছে বিস্তার আর সবার ওপর ছিল পাঠকের সঙ্গে সহজ-সুন্দর ও হার্দ্য যোগাযোগ। পাঠক তাঁকে গ্রহণ করেছে ভালোবাসার ব্যাপকতায়। নানান ভাষাভাষী পাঠকের বিপুল আগ্রহেই তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। পশ্চিমবঙ্গ ছাপিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পুরস্কার ও সংবর্ধনায় অভিষিক্ত হয়েছেন, তবে তাঁর লেখার প্রতি পাঠকের আগ্রহকেই জ্ঞান করেছেন জীবনের সেরা পুরস্কার হিসেবে। মৃত্যুর পর প্রবীণ-নবীন-সমসাময়িক সাহিত্যিক ও পরিচিতজনদের স্মৃতিচর্যায় উঠে এসেছে সুসাহিত্যিক সুচিত্রার পাশাপাশি একজন নির্ভীক-অকপট-বন্ধুবৎসল-সমালোচনাসহিষ্ণু-খোলা মনের মানুষ সুচিত্রার কথাও; যিনি জীবন ও সাহিত্যের মাঝে কোনো দূরত্বের মেরু রাখেননি কখনো।

১২ মে ২০১৫ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। সদাসক্রিয় এ লেখক ইচ্ছে পোষণ করতেন যেন লিখতে লিখতেই মৃত্যু হয় তাঁর; তাই হলো। ভগ্নিকন্যা মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘মাসির প্রায় সব লেখাতেই ছিল গহন কোনো দুঃখের দাগ।’ হ্যাঁ, আমাদের যাপিত জীবনে সদা বহমান দুঃখের নীল ঘূর্ণিকে নিপুণ অক্ষরের আভায় যিনি ধারণ করে চলেন, বছর পঁয়ষট্টিতে তাঁর মৃত্যু তাই অকালমৃত্যুর দুঃখ হয়ে বেজে ওঠে বারবার। সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে সহস্র শ্রদ্ধা।