সৃষ্টি ও স্রষ্টা : বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক স্থাপত্য

সামসুল ওয়ারেস

মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষিত আধুনিক স্থপতি। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক স্থাপত্যকর্মের স্রষ্টা। তিনি বাংলাদেশে শুদ্ধ স্থাপত্য নির্মাণ ও চর্চার পথিকৃৎ। তাঁর স্বপ্ন ছিল ৫৫ হাজার বর্গমাইলের প্রতি বর্গফুট জায়গা ভৌত পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, রুচিশীল ও সভ্য দেশে পরিণত করা। মোগল, ঔপনিবেশিক ও প্রথাগত সব ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ আধুনিক ও যুগোপযোগী স্থাপত্যের স্বরূপ নির্ণয়, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সর্বাধিক।
সত্য ও সুন্দরের প্রতি আসক্তি মাজহারুল ইসলামের জীবন-সংগীতের মূল সুর। সত্যের সন্ধানে তিনি আবিষ্কার করেন মানবতা যা সত্যেরই নিগূঢ় অর্থ এবং মানবতার সন্ধানে আবিষ্কার করে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ক্রমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে মার্কসীয়-লেনিনীয় রাজনৈতিক চিন্তা ও সংগ্রামে বিশ্বাসী হন। সুন্দরের সন্ধানে তিনি কলকাতাকেন্দ্রিক উনবিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁস ও রবীন্দ্রনাথের আঁভাগার্দ অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করেন এবং ক্রমে এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হন। এই কারণে তাঁর মনোজগতে দুটি সত্তা সবসময় পাশাপাশি কাজ করে। একটি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন : শোষণমুক্ত, শ্রেণিহীন ও ইহজাগতিক সমাজ নির্মাণ এবং সমঅধিকারের ভিত্তিতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। অপরটি তাঁর সাংস্কৃতিক দর্শন : রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধতা ও আভিজাত্য এবং বেঙ্গল রেনেসাঁসের সংবেদনশীল মানবতা। বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা তাঁকে ক্রমে একজন আদর্শবান, সৎ ও আপসহীন ব্যক্তিতে পরিণত করে, যার পরিণতিতে তিনি অর্জন করেন বহু শত্রু ও যৎসামান্য বন্ধু। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন ও বিকাশে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী অপশক্তি নিধনের সংগ্রামে তাঁর জীবনব্যাপী অবদান সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
মাজহারুল ইসলাম ১৯৬৪ সালে পুরকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ‘বাস্তুকলাবিদ’ (স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান) গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাত বছর সিংহের স্বভাবে, সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতা নিয়ে, তাঁর শতভাগ ক্ষমতা উজাড় করে স্থাপত্যচর্চা করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ওই সময় বাস্তুকলাবিদ ছিল সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান। এই সাত বছর ছিল ইসলাম ও শহীদুল্লাহর পেশাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। বাস্তুকলাবিদ থেকে মাজহারুল ইসলাম একের পর এক বিশ্বমানের স্থাপত্য সৃষ্টি করেন। এসব প্রজেক্টের বেশিরভাগই ছিল সরকারি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিচারে মাজহারুল ইসলামই ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ স্থপতি। তিনি বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আপসহীন, আদর্শবাদী ইসলাম খাপ খাওয়াতে পারেননি। একের পর এক তাঁর সব সরকারি প্রজেক্ট বাতিল হয়ে যায়। স্বাধীনতার আগে জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান ও কিছু ভবন তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন মাত্র। অনেক কাজ বাকি ছিল। প্রজেক্টগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার ফলে তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেননি। প্রজেক্ট দুটি সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ করা গেলে সংসদ ভবনের মতো এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখতে বিদেশি স্থাপত্য সমঝদার ও পর্যটকদের ভিড় হতো সন্দেহ নেই। মাজহারুল ইসলাম পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতিও পেতেন। অর্বাচীন ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের শিকার হন তিনি। বাস্তুকলাবিদ ক্রমে সম্পূর্ণ কর্মহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে তিনি স্থাপত্য সৃষ্টি করার সামান্যই সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর যখন সৃষ্টি করার শ্রেষ্ঠ সময় ছিল, তখনই তাঁর জীবনে নেমে আসে কষ্টকর সৃষ্টিহীনতা, অবহেলা ও নীরবতা। তিনি সারাজীবন সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার কিন্তু নিজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ। তাঁকে অনেকেই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে; কিন্তু প্রয়োজনে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়নি।
মাজহারুল ইসলাম ছিলেন প্রচণ্ড ধীশক্তিসম্পন্ন, স্থাপত্যের এক মহান দার্শনিক-কবি। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এক নির্ভীক সৈনিক, তাঁর যুদ্ধ তিনি একাই লড়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্য ইতিহাসে ধ্রুপদ যুগের সমাপ্তিই শুধু ঘটেনি, বাংলাদেশ হারালো একজন ঋষিতুল্য মানুষ।

এক
১৯৫০ সাল। বিংশ শতাব্দীর ঠিক মাঝামাঝি সময়। ২৭ বছরের সুদর্শন যুবক মাজহারুল ইসলাম, একজন পুরকৌশলী, যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালেই তিনি কলকাতায় স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার জন্য বেঙ্গল সরকারের অধীনে ‘পোস্ট ওয়ার ডেভেলপমেন্ট স্কলারশিপ’ লাভ করেন; কিন্তু দেশভাগের কারণে এ-বৃত্তি স্থগিত হয়। পরে পুনর্জীবিত হলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে ১৯৫০ সালে তিনি এই বৃত্তি ফিরে পান। দেশভাগের পরপর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে যোগাযোগ, বিল্ডিং ও সেচ (সি বি অ্যান্ড আই) মন্ত্রণালয়ে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সরকারি কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ‘স্টাডি লিভ’ দিতে অপারগতা জানায়। অনন্যোপায় ইসলাম সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অরেগনের উদ্দেশে রওনা হন। পেছনে রয়ে যান স্ত্রী সালমা ইসলাম ও দুই শিশুপুত্র। বড় ছেলের বয়স তখন দুই ও ছোটটি নবজাতক। সালমা ইসলাম পুত্রদের নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দেবপাহাড়ে মাজহারুল ইসলামদের পৈতৃক বাড়িতে আশ্রয় নেন। পিতা অধ্যাপক ওমদাতুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পরিবারকে রেখে সংসার খরচের জন্য অর্থায়নের কোনো ব্যবস্থা না করেই মাজহারুল ইসলাম পাড়ি দেন অজানার পথে, এক অদম্য আকাক্সক্ষায়।
অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রির জন্য পাঁচ বছরের কোর্স। কিন্তু মাজহারুল ইসলামের পুরকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি থাকায় তিনি বেশ কয়েকটি বিষয়ে অব্যাহতি পান। তাছাড়া প্রতি সেমিস্টারে বাড়তি কিছু কোর্সের বোঝা নিয়ে এবং ছুটিছাটায় ও বন্ধের সময়ে ক্লাস নিয়ে তিনি পাঁচ বছরের কোর্স মাত্র দুই বছরের কিছু বেশি সময়ে শেষ করেন। অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে তীব্র ঝড়ো সময়।
অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শেখেন কীভাবে দেখতে হয়। দেখা, শুধু রেটিনার সাহায্যে বাহ্যিক অবয়ব অবলোকন করা নয়, বরং বোধশক্তিসম্পন্ন বা কগ্নিটিভ। দেখা কোনো বস্তুর নিগূঢ় পরিচয়, বস্তুর বিভিন্ন উপাদানের সম্যক ধারণা এবং বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থের (মিনিং) সন্ধান সম্পর্কিত। এই অরেগনেই মাজহারুল ইসলাম একজন পেশা অনুশীলনকারী পুরকৌশলী থেকে ধীরে ধীরে একজন সংবেদনশীল স্থপতিতে রূপান্তরিত হন। তাঁর এই মেটামরফসিসের জন্য যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁরা হলেন তাঁর দুই শিক্ষক অধ্যাপক হেইডেন ও অধ্যাপক রস্। স্থাপত্য ডিজাইন ক্লাসে অধ্যাপক হেইডেন বলতেন,  প্রোগ্রাম, সাইটের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু, নির্মাণ সামগ্রী, সার্ভিসেস, ইত্যাদি বিষয় একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে, কোনো বিবেচনাই বাদ দেওয়া যাবে না বরং স্থাপত্যের সব উপাদান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুশৃঙ্খলভাবে, সাযুজ্য বজায় রেখে একীভূত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে প্ল্যানের দ্বিমাত্রিক নকশা থেকে ত্রিমাত্রিক অবয়বে এমনভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে যেন সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিনন্দন হয়। ইউরোপীয় স্থাপত্যের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে অধ্যাপক রস্ মাজহারুল ইসলামকে সচেতন করে তোলেন যে, সমকালীন আধুনিক পৃথিবীতে বর্তমানে কাজ করতে হলেও প্রতিটি স্থপতিকে তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। অরেগনে অবস্থানকালেই মাজহারুল ইসলাম একটু একটু করে বিংশ শতাব্দীর মহান স্থাপত্য-অর্জনগুলো আত্মস্থ করেন, সৃষ্টির ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হন এবং ক্রমে দৃশ্য ও বিস্তার উভয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কজনিত চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করেন।
১৯৫২ সালে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে মাজহারুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রদেশে স্থাপত্য নিদর্শন দেখার জন্য বেরিয়ে পড়েন এবং ১৯৫৩ সালের প্রথমদিকে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হন। আকাশে উড়ন্ত প্লেনে দেশ ও তাঁর জীবনের নানা কথা মনের পর্দায় ভেসে আসে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় দেশে না থাকতে পারা তাঁকে পীড়িত করে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তাঁর এক শিক্ষক ড্রইংয়ের প্রশংসা করতেন, মনে পড়ে। মনে পড়ে অধ্যাপক রসের কথা, প্রত্যেক স্থপতিকে তাঁর দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। জানতেন, তিনিই হবেন বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম আধুনিক বাঙালি স্থপতি। কিন্তু এই সহজ সত্যটি ততো সহজ নয়। তিনি তাঁর হৃদয়ে এক ভারী চাপ অনুভব করেন। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর স্থাপত্য তত্ত্ব, জ্ঞান ও আদর্শকে এমন একটি দেশের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্র, কৃষিনির্ভর এবং অশিক্ষিত। তিনি জানতেন যে, তিনি এমন একটি দেশে ফিরে যাচ্ছেন যেখানে কমপক্ষে তিন হাজার বছরের স্থাপত্য ও সভ্যতার ইতিহাস আছে; কিন্তু একশ নব্বই বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে তা আজ আহত, নি®প্রভ ও বিব্রতকর অবস্থায় পরিণত। প্লেনের চাকা দেশের মাটি স্পর্শ করার আগেই তিনি দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবে ভারাক্রান্ত হতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁকে সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। দেশের মাটিতে একটি নতুন পেশাকে শুধু পরিচয় করিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট হবে না। যথেষ্ট হবে না শুধু একটি নতুন মান (স্ট্যান্ডার্ড) নির্মাণ করা, যা দেশের ভবিষ্যৎ স্থপতিরা অনুকরণ করবেন। তিনি সুউচ্চ আকাশে কিছুটা মন্ত্রাবিষ্টের মতো বুঝতে পারেন যে, তাঁর দায়িত্ব হবে দেশের মানুষের জন্য এমন এক বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য স্থাপত্য রচনা করা, যার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের স্থপতিরা যুগ যুগ ধরে নির্মাণ করতে পারবেন। তিনি আরো বুঝতে পারেন, তাঁকে এমন একজন স্থপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে যার কাজ হবে প্রগতিশীল জীবনের কথা বলা এবং যার মূল উদ্দেশ্য হবে মানবতা ও সৌন্দর্যের এক নবযুগ রচনা করা। জানালা দিয়ে মাজহারুল ইসলাম নিচে তাকালেন। সবুজ আয়তাকার কৃষিজমি যেন শিল্পী মন্দ্রিয়ানের জ্যামিতিক বিন্যাস, এসবের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা নদীনালার মুক্ত বিচরণ, জলের গভীর রং, নানাবিধ সবুজের সমারোহ, মাজহারুল ইসলাম অভিভূত হন, বুঝতে পারেন তিনি দেশের সীমানার ভেতর চলে এসেছেন। তাঁর চোখের পর্দায় পরিবারের ছবি ভেসে আসে, তাদের সঙ্গে কতদিন দেখা নেই। প্লেনের চাকা ততক্ষণে আলতোভাবে রানওয়ে স্পর্শ করে, মাজহারুল ইসলামের দুটি অশ্র“ভেজা চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

দুই
মাজহারুল ইসলাম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার কৃষ্ণনগরের সুন্দরপুর গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে কৃষ্ণনগর হাইস্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ওই সময় তাঁর পিতা ওমদাতুল ইসলাম (১৮৯৩-১৯৮০) কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৩২ সালে তাঁর পিতা যখন কৃষ্ণনগর থেকে রাজশাহী সরকারি কলেজে বদলি হন, তখন তিনি রাজশাহী সরকারি হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৩৮ সালে ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান তখন রাজশাহী সরকারি কলেজে নবীন প্রভাষক। তিনি ২০০৩ সালে ওমদাতুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের যা-কিছু মূল্যবোধ, সবই অধ্যাপক ওমদাতুল ইসলামের মধ্যে পাওয়া যেত।’ ১৯৪০ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মাজহারুল ইসলাম বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিয়ারিং কলেজের পুরকৌশল বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে পুরকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিবপুরে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্লাস স্থগিত থাকে। ওই সময় ১৯৪২ সালে অযথা সময় নষ্ট না করে দায়িত্ববান, পিতার প্রথম সন্তান, মাজহারুল ইসলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
মাজহারুল ইসলাম নয় বছর বয়স পর্যন্ত কৃষ্ণনগরের সুন্দরপুর গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে বড় হন। নানার দ্বিতল বাড়িটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের আদলে, পুরু দেয়াল, খিলান, মধ্যবর্তী চত্বর (কোর্ট) এবং চত্বরের চারপাশে খিলানসহ বারান্দা, কাঠের খড়খড়ি, সিঁড়ি, ছাদ, চিলেকোঠা, ইত্যাদি উপাদানে সমৃদ্ধ। সবুজ প্রকৃতির বিপরীতে বিল্ডিংয়ের উপস্থিতি, জ্যামিতিক বিন্যাস, স্পেস, উচ্চতা, আলোছায়ার খেলা ইত্যাদি শিশু মাজহারুল ইসলামের মনে গভীর আবেগ সৃষ্টি করে, যা তাঁর অবচেতন মনে নিভৃতে লালিত হয়।
কৃষ্ণনগর স্কুলে পড়ার সময় বালক মাজহারুল ইসলাম পোড়ামাটির পাত্র তৈরি করা দেখার জন্য কুমারপাড়ায় যেতেন। সেখানে তিনি বাঁশ ও ছন দিয়ে কাঠামো বানিয়ে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করাও দেখেছেন। পরে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরে কালো ব্যাসল্ট্ পাথরে তৈরি হিন্দু-বৌদ্ধ দেব-দেবীর ভাস্কর্য ও রিলিফ দেখেন। মানুষের তৈরি শৈল্পিক বস্তু অবলোকন করে মাজহারুল ইসলাম ব্যাখ্যার অতীত এক অসাধারণ অনুভবে অবাক হতেন এবং এই ভাবে প্রকৃতির অনুসন্ধান ও সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রতি মানুষের গভীর আবেগ তাঁর নীরব উপলব্ধির জগতে সঞ্চারিত হয়।
রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়ার সময় তিনি কলেজ টিমে ফুটবল খেলতেন। মেধাবী ছাত্র ও ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর নাম ছিল। ফুটবল খেলার মাধ্যমে শরীরের ফিটনেস যেমন রক্ষা পায় তেমনি মন থাকে সতেজ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ছাত্রনেতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেঙ্গল রেনেসাঁস উৎসারিত আভিজাত্যমণ্ডিত কাব্যিক মানবতা, নেতাজী সুভাষ বোসের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শ, মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ ও অহিংসা এবং সর্বোপরি মার্কস ও লেনিনের সমাজতন্ত্রের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হন। একদিকে সাম্যবাদ ও অহিংসা অন্যদিকে শোষণমুক্ত সমাজ ও সব মানুষের উত্থানে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ তাঁর অবচেতন মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। মাজহারুল ইসলামের জীবনব্যাপী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ও চিন্তায় এসব প্রভাবের অভিব্যক্তি প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হয়।
অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে প্রায় তিন বছর স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র (রফিক ও তানভীর) তাঁর সান্নিধ্যবঞ্চিত হন। এই সময় তাঁর দুই পুত্রের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ঢাকায় ফিরে এসে স্থাপত্যচর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করায়, কর্মনিষ্ঠ মাজহারুল ইসলাম সংসারের প্রয়োজনে যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি। এই কারণে তাঁর সঙ্গে তাঁর দুই পুত্রের সৃষ্ট দূরত্ব কখনই সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। তবে তাঁর একমাত্র কন্যা (তৃতীয় ও কনিষ্ঠ সন্তান) ডালিয়ার বেলায় তেমনটি হয়নি। স্ত্রী সালমা ইসলাম পরম যতনে, ধৈর্যে ও ভালোবাসায় সংসারের ভারসাম্য অত্যন্ত অবিচল হস্তে রক্ষা করেছেন। সালমা ইসলাম (বেবী) তাঁর আপন খালাতো বোন, তাঁর মায়ের ছোট বোনের মেয়ে। তাঁরা সুন্দরপুরে একসঙ্গে বড় হয়েছেন। ১৯৪৬ সালে মাজহারুল ইসলাম পুরকৌশল বিষয়ে ডিগ্রি লাভের পরপরই তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সালমা ইসলামের নিরলস ও নিঃশর্ত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা মাজহারুল ইসলামকে মাজহারুল ইসলাম হয়ে উঠতে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে।
মাজহারুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান থানার কুয়েপাড়া গ্রামে। চট্টগ্রামের ভাষা আরাকানীয় প্রভাবের কারণে প্রমিত বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন ও দুর্বোধ্য। অন্যদিকে মায়ের বাড়ি কৃষ্ণনগরের ভাষা প্রমিত বাংলা ভাষার কাছাকাছি ও শ্রুতিমধুর। ছোটবেলা থেকেই মাজহারুল ইসলাম বাংলা ভাষার এই দুই প্রান্তিক রূপের সন্ধিক্ষণে থেকে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি চট্টগ্রামের ভাষা পরিহার করে কৃষ্ণনগরের বাংলা ভাষাকেই তাঁর নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁকে চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করতে কখনো দেখা যায়নি। অনেকেই এই কারণে তাঁকে পশ্চিম বাংলা থেকে আগত অভিবাসী মনে করেন। ভাষা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অবচেতন মনে মাজহারুল ইসলাম যা কিছু সুন্দর ও যা কিছু মঙ্গলময় তার প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে যখন স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন, তিনি তাঁর পুরকৌশলী পরিচয় সম্পূর্ণ পরিহার করে শুধু স্থপতি পরিচয় বজায় রাখেন। প্রকৌশলচর্চায় বিজ্ঞান ও সত্যের যোগ আছে; কিন্তু সমাজ, সংস্কৃতি ও মানবিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগ নেই, স্থাপত্যচর্চায় আছে। স্থাপত্য, মাজহারুল ইসলামের জন্য বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ, একই সঙ্গে শিল্পকলা ও মানবতাবাদ – এই দুই পরিমণ্ডলেই বিচরণের এক সীমাহীন সুযোগ সৃষ্টি করে।

তিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশাল এলাকাজুড়ে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ নগর পরিকল্পনাবিদ প্যাট্রিক গ্যাডিস এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ – এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত আয়তন থেকেও বড় বলে অবিহিত করেন। এই এলাকা রমনা ও নীলক্ষেতের অংশ। ১৮২৫ সালে ম্যাজিস্ট্রেট ডসের উদ্যোগে রমনার একটি অংশ রেসকোর্স ময়দানে রূপান্তরিত হয়। এবং রেসকোর্স ঘেঁসে একটি রাস্তা (বর্তমানে নজরুল এভিনিউ) মূল শহরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই রাস্তার পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় ১৯৫০ সালে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা শহর তখন ছিল বাগ-বাগিচায় ভরা। লালবাগ, সবুজবাগ, মালিবাগ, আরামবাগ, হাজারীবাগ, সেগুনবাগিচা, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান প্রভৃতি অসংখ্য নামেই তা বোধগম্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রমনা এলাকা ছিল সবুজের কেন্দ্রভূমি। ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা তখন ছিল চার লাখের সামান্য বেশি। চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ভবন ডিজাইন করার জন্য সি বি অ্যান্ড আই মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। কিন্তু ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। পুরো ব্যাপারটি ফাইলবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে।
১৯৫৩ সালে অরেগন থেকে ফিরে এসে মাজহারুল ইসলাম স্থপতিদের জন্য কোনো পদ না থাকায়, সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সি বি অ্যান্ড আই মন্ত্রণালয়ে নতুন করে যোগ দেন। এই সময় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ভবন ডিজাইনের দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। চারু ও কারুকলা ভবনের জন্য নির্ধারিত সাইটের পশ্চিমে সড়ক এবং সড়কের পশ্চিম পাশে রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোড়দৌড়ের সঙ্গে জুয়া খেলা জড়িত থাকায় রেসখেলা বন্ধ করে দেন এবং রেসকোর্সটি একটি বিশাল খোলা সবুজ মাঠে পরিণত হয়। পরে জিয়াউর রহমানের সময় গাছ লাগিয়ে খোলা মাঠটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রূপান্তর  করা হয়।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সাইটের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করেন। সাইটে প্রতিটি গাছের অবস্থান ও গাছের পরিচয়সহ সার্ভে ম্যাপ তৈরির নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য একটি গাছও না কেটে ভবনটি নির্মাণ। ভবনের প্রয়োজনে গাছ কাটা যেতেই পারে – এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে সহকর্মীদের অনেকেই তখন ইসলামের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন। সাইটের ভেতর ১৫০ ফুট ব্যাসের একটি গোলাকার শুকনো পুকুর। পুকুর থেকে সাইট সংলগ্ন সড়কের দূরত্ব ২৮৫ ফুট। মাজহারুল ইসলাম এই ২৮৫ ফুট জায়গায় পুকুর ও  রাস্তা সংযোগ করে একটি এক্সিস বা করিডোর তৈরি করে ভবনটিকে তিনটি অংশে বিন্যাস করেন। গোলাকার পুকুর ঘেঁসে বৃত্তাকার অংশ, মাঝের সংযোগকারী আয়তাকার অংশ ও সম্মুখে পশ্চিমের রাস্তা থেকে প্রবেশপথে খোলামেলা অংশ। সব মিলিয়ে একটি জৈব আকার ধারণ করে। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প। গ্রাফিক্স ও কমার্শিয়াল আর্ট – এ পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদির ব্যবস্থা করে ভবনটি দ্বিতল করা হয়।
চারু ও কারুকলা ভবনে প্রবেশদ্বার বলে কিছু নেই। রাস্তা থেকে সরাসরি ভবনের খোলামেলা নিচতলায় প্রবেশ করা যায়। ছাদ আছে কিন্তু দেয়াল নেই। কিছু সারিবদ্ধ গোলাকার পিলার ছাদকে ধরে আছে। নিচু আয়তাকার মেঝে পাশের সবুজ ঘাসের সঙ্গে মিশে গেছে। গোলাকার পিলারগুলো চারপাশে অবস্থিত গাছের কাণ্ডগুলোর প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়। মানুষের তৈরি দালানের স্পেস এখানে বিনা বাধায় প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে এক প্রশান্তির ভাব সৃষ্টি করেছে। গ্রাম ও মফস্বল থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে যেন কলেজে প্রবেশ করতে ভয় না পায়। ভবনটির প্রবেশপথ তাদের জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে বরং সহজেই তাদের আপন করে বরণ করে নেয়। প্রবেশপথে খোলামেলা এ-অবস্থার সৃষ্টি করে  মাজহারুল ইসলাম আসলে সামন্তবাদকে ছুড়ে ফেলে সাম্যবাদ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ভবনে প্রবেশ করে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়ে দিনের আলোতে ঝলমল করা খোলা এক উড়ন্ত সিঁড়ি দোতলায় চলে গেছে। সিঁড়ির তিনদিকে সাধারণত দেয়াল থাকে। এখানে দেয়ালের কোনো চিহ্ন নেই। ভাস্কর্যের মতো এই খোলামেলা সিঁড়িটি আসলে শিল্পীদের শৈল্পিক স্বাধীনতার প্রতীক। স্বাধীন অভিব্যক্তি ছাড়া শিল্প মূল্যহীন। ১৯৫৫ সালে যখন ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় তখন ভবনটির সম্মুখভাগের খোলামেলা জায়গাটি দেখে মনে হতো যেন রেসকোর্স ময়দানের একটা অংশ ঢুকে পড়েছে। চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ব্যাপারটি গ্রামীণ। ঢাকা শহরের এই অংশের পরিবেশ ওই সময় গ্রামীণ ছিল, ধীরগতিতে নগরায়ণ হচ্ছে। ভবনটির প্রবেশমুখের অংশটি বাদে বাকি অংশ ততটা খোলা নয়। ভবনটির খোলামেলা অবস্থা থেকে কম খোলা বা কিছুটা বদ্ধ জায়গায় উপনীত হওয়া যেন ঢাকা শহরের গ্রামীণ অবস্থা থেকে নাগরিক অবস্থায় উত্তরণের প্রতীকী ব্যঞ্জনা।
কলেজ ভবনটি সহজ-সরল অথচ প্রযুক্তিগতভাবে সমকালীন। বিমহীন ফ্ল্যাট ছাদ বাংলাদেশে এই প্রথম ব্যবহৃত হয়। বিম না থাকায় ভবনটির সম্মুখ অংশ হালকা ও ভাসমান মনে হয়। দোতলায় সারিবদ্ধ কাঠের লুভার কাঠামোর আয়তাকার গঠনকে স্পষ্ট করে অথচ হালকা-ভাসমান ভাব বজায় রাখে। ভবনের এই খোলামেলা ভাসমান অবস্থান ছাত্রছাত্রীদের মেদহীন মুক্তচিন্তার প্রতি অনুপ্রাণিত করে। এ-ভবনের প্ল্যান সরল ও বক্ররেখার সমন্বয়ে রচিত, যা শিল্পকলার শিক্ষার্থীদের ফরম ও আকারের শুদ্ধতা অনুধাবনে সাহায্য করে। এই ভবনে পলেস্তারাবিহীন পোড়ামাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রথম ইটের দেয়ালের কর্কশ সৌন্দর্য ব্যক্ত করেন মাজহারুল ইসলাম। পরে ষাটের দশকে লুই আই কান শেরেবাংলা নগরের স্থাপত্যে, একই ধরনের পলেস্তারাবিহীন লাল ইটের দেয়াল মৌলিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। স্টুডিওগুলোতে দিনের পরোক্ষ আলোর প্রয়োজনে বড় বড় কাচের জানালা ও বাতাস চলাচলের জন্য ক্রস ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ও বারান্দায় ছিদ্রযুক্ত রেলিং ও কাঠের লুভার বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রতি লক্ষ রেখে করা এবং এসবের সাহায্যে একটি আধুনিক বাংলা স্থাপত্য-ভাষা তিনি অতি সংবেদনশীলভাবে রচনা করেন। চারু ও কারুকলা ভবনের স্থাপত্য ডিজাইন ও সামগ্রিক পরিবেশ তিনি এমনভাবে সৃষ্টি করেন যেন তা একটি সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে।
মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্যকে শুধু ব্যবহারিক শিল্প হিসেবে গণ্য করেননি। তিনি স্থাপত্যকে সাধারণ মানুষের সুন্দর ও সভ্য জীবনে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। বুর্জোয়া স্থাপত্যরীতি পরিহার করে দেশজ সহজলভ্য নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে, সব ধরনের অলংকরণ ও সজ্জা (অপ্রয়োজনীয় বিধায়) সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে, নির্মাণসামগ্রীর নিজস্ব সৌন্দর্য ব্যক্ত করে, কুসংস্কারমুক্ত এক স্বচ্ছ ও খোলামেলা স্থাপত্য রচনা করে তিনি সর্বসাধারণের পক্ষে অবস্থান নেন। মাজহারুল ইসলামের তীক্ষè মেধা ও সৃজনক্ষমতার কারণে তাঁর স্থাপত্য সহজ-সরল হওয়া সত্ত্বেও এক ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যা শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালির জয়গানের অভিব্যক্তি। তাঁর স্থাপত্য যেন দরিদ্রকে টেনে তোলে আর উচ্চবিত্তকে খর্ব করে সবাইকে শিক্ষিত রুচিশীল মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের সদস্যকরণের ঘোষণাপত্র।
চারু ও কারুকলা ভবন ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় তিন দশক ধরে নিরলস পরিশ্রম করে বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যকে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেন। জীবনের শেষ তিন দশক স্থাপত্য কর্মহীন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব আজও বজায় আছে। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি ছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ, মৃত্যুর পর তা আরো বোধগম্য হবে।