সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল

দেবেশ রায়

ছয়

এমন কি হওয়া সম্ভব? কল্পনাতেও? আফটার অল -।

সাধারণভাবে কী এমন অসম্ভব? ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর একেবারে ঘোষণা করে, দিনক্ষণ জানিয়ে, কিছু না লুকিয়ে, সারাদেশ থেকে করসেবকদের জড়ো করে, যুদ্ধে যেমন বিদেশি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করে অবিকল সে-রকম আক্রমণে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হলো না? তখন তো উত্তর প্রদেশে গণতান্ত্রিক এক সরকার, মানে সে-সরকার ভোটে জিতেছে, সে-সরকার

বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ,  সে-সরকার ষোলো আনা সাংবিধানিক। এটা যদি গৃহযুদ্ধ না হয়, তাহলে গৃহযুদ্ধ কী? সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের আধা সামরিক বাহিনী ছিল – সেগুলিও তো ষোলো আনা সাংবিধানিক।

কী হলো? বাবরি মসজিদ বাঁচাতে এই সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক বাহিনী একটা আঙুল তুলল, একটা লাঠিচার্জ হলো, একটা গুলি চলল? তখনকার প্রধানমন্ত্রী বললেন – ওরা কথা দিয়েছিল? কারা? যারা আক্রমণ করছিল, তারা? তাদের সঙ্গে কথা? আর, তার পরে? এ তো যে-কোনো পঞ্চায়েতেও ঠিক হয় – কেউ যদি কারো আল জোর করে ভেঙে থাকে, তাহলে আল বেঁধে দিতে হবে। বাবরি মসজিদ ভাঙা যদি অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক হয়েই থাকে – তাহলে পরদিন থেকে সংবিধানওয়ালারা ও গণতন্ত্রওয়ালারা মসজিদ তৈরি করতে লাগল না কেন?

সাধারণভাবে কী এমন অসম্ভব? তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী রামচন্দ্রনের স্ট্রোক হলো। তাঁকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হলো। ফিরে এলেন যখন, বেঁচে ছিলেন বটে কিন্তু বিছানায়। ডাক্তারি ভাষায় – প্রায়-কোমায়। চোখ খুলতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, হুইল চেয়ারেও বসানো যায় না প্রায়। কিন্তু তিনিই মুখ্যমন্ত্রী – নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। সমস্ত জাতি প্রতিদিন দম আটকে জানতে চাইছে – জয়ললিতার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে কী হয়নি। জয়ললিতার সঙ্গে তার সাংবিধানিক বা সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ সেটাই হয়ে দাঁড়াল গণতন্ত্রের প্রধানতম বিবেচনার বিষয় – জয়ললিতার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে কী হয়নি। জয়ললিতার সঙ্গে তাঁর রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছে কী হয়নি – সে প্রশ্ন ওঠেনি। দেখা হয়েছে?

সাধারণভাবে কী এমন অসম্ভব? সারা শরীরে গোপন ক্যামেরা বেঁধে মেরে ফেলা হতে পারে এমন ঝুঁকি নিয়ে দুই সাংবাদিক ছবি তুলে এলেন, সারা দুনিয়ার লোক দেখল – প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফার্নান্ডেজের স্ত্রীতুল্য সঙ্গিনী জয়া জেটলি অস্ত্র কেনার দালালি হিসেবে ব্রিফকেস ভরা টাকা নিচ্ছেন। শাসকদলের প্রেসিডেন্ট আবার ব্রিফকেস খুলে টাকা দেখে নিলেন। দু-চার মাসের জন্য পদত্যাগ করে তাঁরা আবার নিজের-নিজের পদে ফিরে এলেন। সেই সাংবাদিকরা কী করে বেঁচে আছেন – কে জানে? তাদের বেঁচে থাকাটা অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিকও।

সাধারণভাবে কী এমন অসম্ভব? গুজরাটের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সরকার আশঙ্কিত দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য নতুন আধা-সামরিক বাহিনী নিয়োগ করার বদলে এমনকী ট্রাফিক পুলিশও তুলে নিল। গণতন্ত্রের শুদ্ধতা রক্ষার যেসব ঠাট আছে – সেই কমিশনগুলি, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু, নারী –  তারা নিজেদের সরকারি রিপোর্টে গণহত্যার কথা বলল। বরোদার বেস্ট বেকারি হত্যাকান্ডের জন্য ২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়ে পুলিশ সাক্ষী ডাকল। তারা প্রত্যেকে এসে সাক্ষ্য দিলো – এরা দাঙ্গা করেনি। জজ-সাহেবের চোখের সামনে রোজ বিজেপির এক এমএলএ শ্রীবাস্তব, সাক্ষীদের কোর্টে নিয়ে আসত, আর ফিরিয়ে নিয়ে যেত। সাক্ষী-ভাগানো তো আইনত দন্ডনীয়। প্রত্যক্ষ্য-পরোক্ষ প্রমাণে তো দেখাই যাচ্ছিল, সাক্ষী ভাগানো হচ্ছে। জজ-সাহেব সাক্ষ্যের অভাবে মামলাই খারিজ করে দিলেন। পুলিশকে একটা কথাও বললেন না যে মামলা এত অপ্রস্ত্তত কেন। পুলিশকে আবার তদন্তের আদেশ দিলেন না। একবার কমিশনগুলির রিপোর্ট উলে�খ করলেন না। অথচ, সংবিধানের অন্যতম প্রধান ধর্ম রক্ষিত হলো – প্রকাশ্য নিরপেক্ষ বিচার।

সাধারণভাবে গণতন্ত্রে  কিছুই অসম্ভব নয় – গণতন্ত্র বলতে কী বোঝা হচ্ছে তার ওপরই সব নির্ভর করে। ‘হাজার বছরের রাইখ’ বলে নাৎসি জার্মানি যে সংবিধান বানিয়েছিল ও সেই সংবিধানের সংগতি রেখে যেসব নতুন  আইন পাশ করিয়েছিল, তার বেশিরভাগই আমেরিকায় সংবিধান ও আইন থেকে নেওয়া।

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে কেন – সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে ঘিরে ফেলে কলকাতাকে, ইউটি করে ফেলা, ছিনিয়ে নেওয়ার মতো, দখল করার মতো? আবার, একই সঙ্গে তা সম্ভবও মনে হচ্ছে কেন – গণতন্ত্রের মধ্যেই সম্ভব মনে হচ্ছে কেন। সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী তো গণতন্ত্রের মধ্যেই পড়ে। বা, মধ্যেও পড়ে।

প্রথমটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছে কি এই কারণে যে, কেন্দ্রের সামরিক শক্তি, রাষ্ট্রের বাধ্য করার শক্তির পালটা-শক্তি যে-সমাবেশ ও যে-প্রতিরোধ তা পশ্চিমবঙ্গেও নেই? পশ্চিমবঙ্গের সরকার অন্যরকম বলে সেই সরকারের প্রতি যে-আনুগত্য ও যে-সহযোগিতা দাবি করা হয়, ও দেওয়া হয়, সে-আনুগত্য ও সহযোগিতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সরকার পর্যন্তই মাত্র গিয়ে থেমে যায় না। সে-আনুগত্য ও সহযোগিতা, বৃষ্টির জল যেমন চলে যায় মাটির ভেতরে, তেমনি বয়ে যায় এই সংবিধান ও ব্যবস্থা পর্যন্ত, এই গণতন্ত্র পর্যন্ত। অনুগত ও সহযোগী সেই  অভ্যাসে – এই ব্যবস্থাটিকে রক্ষার দায়ও চাপে। অনুগত ও সহযোগী সেই অভ্যাসে বিশ্বাস হয়ে যায় যে, পুঁজিই উদ্ধারকর্তা। অনুগত ও সহযোগী সেই অভ্যাসে বিশ্বাস হয়ে যায় যে, যতটা পারা যায় তার চাইতেও বেশি খেটে ও সেই খাটুনিতে মনপ্রাণ দিয়ে পুঁজি বাড়ানোটাই নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। অনুগত ও সহযোগী সেই অভ্যাসে আর মনে থাকে না, পুঁজির অর্থই পুঞ্জিত শ্রম, যে-শ্রমের দাম দেওয়া হয় না। অনুগত ও সহযোগী সেই অভ্যাসে প্রতিরোধের পেশল প্রস্ত্ততি আসবে কোত্থেকে? ওটা কোনো আপত্তি থেকে প্রশ্ন নয়, অনুপপত্তি থেকে প্রশ্ন। প্রক্রিয়াটা কি প্রতিরোধের সচেতনতা রচনার?

অথচ অনুগত ও সহযোগী সেই অভ্যাসে তো উলটো একটা প্রক্রিয়া চেতনাতে শিকড় চারিয়ে দেয় – দরকষাকষি করে লাভের লোভ ফাউয়ের লোভ, লেনদেনের লোভ।

তাতে যদি ইউটি প্রস্তাব লাভজনক হয়, তা মেনে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি ভারী হতে থাকে। কে, কেন, কী মূল্যে আমাকে এই লাভটা দিচ্ছে তা না জানলেও বা, জানলেও লাভের হিস্যা নেওয়ার কৌশল খোঁজা শুরু হয়ে যায়।

২৪ জুন, মঙ্গলবার দিলিস্ন থেকে শেষ ফ্লাইটে মুখ্যমন্ত্রী ফিরলেন।

কলকাতায় রাত ১১-১৫-তে। সেই ২৪ থেকেই চন্দ্র সাঁতরা ও নিমাই ঢালির আবহাওয়া-পূর্বাভাস শেষ হয়ে গেল। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ উত্তর কলকাতায় এমন বৃষ্টি ঘণ্টাখানেক হলো যে, ট্রামগুলো আটকে গেল, মিনিগুলো রুট বদলে ফেলল। সেই বৃষ্টি ভবানীপুর হয়ে বাঁয়ে বালিগঞ্জের দিকে ঘুরে আবার উলটোপথ ধরল এয়ারপোর্ট-বারাসতের দিকে। অথচ বৃষ্টিটা চাকুরিয়া ফ্লাইওভার পেরোয়নি। ওদিকে ঠান্ডা হাওয়া দিয়েছে, তবে বৃষ্টি হয়নি। দক্ষিণের লোকালগুলি শুকনো থেকে বৃষ্টির ভিতর ঢুকল।

পেস্নন থেকে নেমে সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত এনে দাঁড়-করানো তাঁর গাড়িতে উঠতেই মুখ্যমন্ত্রীর বাঁ-দিকটা ভিজে গেল – ছাঁটটা ওইদিক থেকে আসছিল।

‘প্রেসকে কি মিট করবেন স্যার, ওঁরা তো সেই সন্ধে থেকেই -। আপনি সন্ধে-নাগাদ ফিরবেন আন্দাজে…।’

‘নিশ্চয়ই। প্রেসকে মিট করে পার্টি অফিসে যাব।’

‘ইয়েস স্যার।’

মুখ্যমন্ত্রীর মুখটা স্বচ্ছই তো মনে হয়। মনে হয় খুব উদ্বেগ বা অনিশ্চয়তা লুকোতে পারেন না। খুব কঠিন কোনো প্রতিরোধের নেতৃত্ব কি ওঁর স্বাভাবিক স্বচ্ছতায় ধরা পড়ে? বরং জনসভা বা সমাবেশে ওঁর বক্তৃতায় যেন একটু আয়ত্ত-করা ভঙ্গি বা শব্দ এসে যায়। চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল, দৃষ্টি যেন একটু বেশি করে বর্তমানে, যা তিনি দেখতে চান, তার ওপর। তাতে তিনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারেন, যা তিনি দেখছেন না, তা তিনি দেখেননি। এমন দেখতে না-পাওয়া থেকে তিনি সরে আসছেন এমন দৃষ্টিতে, যেন যা তিনি দেখেন, তা-ও হয়তো তিনি দেখছেন না। কিন্তু এটা তাঁর পুরো আয়ত্ত হয়নি। হবেও না হয়তো। এর জন্য একটা ক্লান্তিবোধ ও/ বা সিনিসিজম দরকার। সেটা ওঁর ব্যক্তিত্বের বাইরের জিনিস মনে হয়। অথচ, উনি বেশ কঠিন করেই সীমা ছকে দিতে পারেন। আবার, কেউ-কেউ সে-সীমা আন্দাজ করে যদি নিজেদের দাঁড়ানোর জায়গা ঠিক করে নেয়, তাহলে তিনি নিজে খুব স্বচ্ছন্দে সে-সীমারেখা মুছে দিতে পারেন।

ভিআইপি লাউঞ্জ মুহূর্তে ঝলসে উঠল।

মুখ্যমন্ত্রী মাইকগুলির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, হাসিমুখে মুখ ঘোরালেন। তারপর বললেন, ‘আমার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দুবার সাক্ষাৎ ও কথা হয়েছে। ওঁরা আমাদের এই দাবি মেনে নিয়েছেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইলেকশনের প্রোগ্রাম তারিখসহ ঘোষণা করতে হবে।’

‘পুরো রাজ্যেই, স্যার?’

‘হ্যাঁ। পুরো রাজ্যেই। যাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভোট দিয়ে জানাতে পারেন যে, তাঁরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চান কী না। দিলিস্নতে এটাই আমি পরিষ্কার করতে চেয়েছি যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া চলবে না।’

একটা গুঞ্জন উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল, আবার উঠল। মুখ্যমন্ত্রী থেমে গেলেন। একজন প্রবীণ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন – ‘ভোটটা কি পুরো রাজ্যে হবে?’

‘হ্যাঁ। ভোট তো তাই হয়। অর্ধেক রাজ্যে আর ভোট হবে কী করে?’

আবার একটা গুঞ্জন উঠল। দু-তিনজন একসঙ্গে কথা বলে উঠে একসঙ্গেই থেমে গেল। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার, একটু আগেই দিলিস্ন থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে আমরা অবিলম্বে নির্বাচন সুপারিশ করে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করছি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ইউটির নির্বাচন করে বিধানসভা গঠন করে দিন।’

‘হ্যাঁ। তাই তো।’

‘আপনি বললেন স্যার পুরো রাজ্যেই ভোট হবে।’

‘পুরো রাজ্য মানে পুরো ইউটি। ইউটি বলাটা অভ্যেস হয়নি।’

‘আপনাদের পার্টি কি এটা মেনে নিয়েছে, স্যার।’

‘কেন? সেটা বলেনি দিলিস্নর খবরে? আমাকেই তো জিজ্ঞেস করল, আমিই তো বললাম। আমাদের সম্পাদকমন্ডলীর যে-কয়েকজন দিলিস্নতে ছিলেন, তাঁরা মিলে জানিয়েছেন – এটা এতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে পলিটব্যুরো না ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পলিটব্যুরোর মিটিং ডাকা হয়েছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের, মানে ইউটির বিধানসভা গঠনের দিকে কতোটা এগোল সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

‘মানে, আপনাদের পার্টি আপাতত মেনে নিয়েছে!’

‘সে আপনারা যে যা বোঝেন। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই – আমাদের পার্টি গ্রহণ-বর্জন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে পলিটব্যুরোতে। পলিটব্যুরো ডাকা হয়েছে। তার আগেই পরবর্তী কী কী ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার নেয়, তার ভিতর দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট হবে।’

‘আর পশ্চিমবঙ্গ সরকর কি মেনে নিয়েছে?’

‘সেটা আগামীকাল বিকেলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। তার আগে অবিশ্যি বেলা ১২টায় ফ্রন্টের সভাতেই  স্থির হয়ে যাবে। গভর্মেন্ট এ-বিষয়ের সঙ্গে যতটা জড়িত, তাতে গ্রহণ-বর্জনের কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের হয় মানতে হবে, না-হয়তো সরকার থেকে সরে আসতে হবে।’

‘তাহলে এটা কি আপনি বলছেন স্যার যে, আপনার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করতেও পারে?’

‘তাই কি দাঁড়াল? এটা রাজনৈতিক স্তরে স্থির করতে হবে – গ্রহণ-বর্জন। সেখান থেকে তো কী করা হবে সেটা স্থির হবে।’

‘স্যার, তাহলে এই মুহূর্তে আপনি রাজ্যবাসীকে কী বলবেন, তাঁরা কি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আছেন, নাকি খন্ডিত পশ্চিমবঙ্গে আছেন?’

‘আমি এই শব্দগুলির কোনো একটিও ব্যবহার করব না। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেশভাগ, খন্ডিত-পশ্চিমবঙ্গ এসব খুব স্পর্শকাতর শব্দ। আর ঘটনাও এখানে সম্পূর্ণ অন্যরকম। এখানে একটা সংবিধানসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে – গ্রহণ-বর্জন আমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়, কিন্তু সরকারে থাকা না-থাকা আমাদের ওপর নির্ভরশীল সিদ্ধান্ত।’

‘র‌্যাটক্লিফের রোয়েদাদও তো স্যার, আমাদের গ্রহণ-বর্জনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। সেও তো স্যার আইন অনুযায়ীই হয়েছিল তাতে তো আমাদের উদ্বাস্ত্ত হওয়া আটকায়নি।

‘এই দুটো ঘটনা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।’

রাত ১১টার পরে এই তুমুল বৃষ্টিতে মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষমাণ মিডিয়াকে যা বলছিলেন তাতে নতুন কোনো খবর যে থাকবে না, তা মিডিয়া জানত। সেই সকালে মুখ্যমন্ত্রী দিলিস্ন পৌঁছুবার পর থেকে টিভি দেখিয়েছে – খবরের সঙ্গে বেশ বিস্তারিত। তাঁর বাড়িতে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সিএমের পাশে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে দর্শকদের এমন করে বললেন, ‘আরে, মন হো গিয়া আজ সুবেহকো চা চাওয়ালাকো সাথ পিইয়েগা। তো আ গয়া মেরে দোস্ত, পশ্চিম বঙ্গাল সে, গরমাগরম কচুরি লেকে। আপলোগ ভি পিইয়ে, হাম দোনো কী ভি পিনে দিজিয়ে।’ সিএম শুধুই হাসলেন, নমস্কার করলেন। এক-একজনের এমন হয় – স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের গড়ন লম্বাটে হওয়ায় তাঁর হাসিটা যতখানি ছড়িয়ে পড়তে পারত, ততোটা ছড়ায় না। তিনি হেসে কথা বললে মনে হয় অনেক কথা ভিতরে রেখে দিলেন।

দশ মিনিট পর তাঁরা বেরিয়ে আসতেই আবার মিডিয়া – ‘স্যার, চা নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, নইলে মাত্র দশ মিনিটে দুই গভর্মেন্টের কথা শেষ হয়ে গেল।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী – ‘আমি তো সিন্ধি উদ্বাস্ত্ত। আমাদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে। সেই ঘরওয়ালার হাভেলিতে দ্বিতীয়বার কখনো দাওয়াত নেবে না যে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েই দালের গন্ধ পাওনি। তার মানে গতরাতের সেঁকা পাঁপড় আজ সকালে গরম করে তোমাকে দিয়েছে। আর, সেই ঘরওয়ালার বাড়িতে এক-দাওয়াতেই দশবার যাবে যে কাল রাতের তৈরি, ঠান্ডা-করতে দেওয়া পায়েস সকালে তোমাকেই প্রথম চাখাল। তো, থ্যাঙ্কস টু মাই অ্যানসেস্টার্স, দি সিএম হ্যাজ প্রেসাসলি অ্যাগরিড টু গিভ আস হিজ কোম্পেনি ইন দি লাঞ্চ।’ মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। আরো হবে। আমি এখনই কিছু বলতে চাইছি না। বিকেলে নিশ্চয়ই বলব।’

সিএম তাঁর দলের সদর দফতরে যাচ্ছেন, পার্লামেন্টারি পার্টির অফিসে যাচ্ছেন, বাঙালি এমপিদের সঙ্গে কথা বলছেন – ‘বঙ্গভবনে’র লবিতে। তাতে শুধু ছবি, শুধু চলাফেরা, শুধু চেয়ারে ঘাড় এলিয়ে থাকা, শুধু প্রবেশ ও প্রস্থান। তা থেকে তো আর খবর বোঝায় না।

সারাদেশের লোকই তো দেখেছিলেন – কলকাতায়ও। ফলে কলকাতার মিডিয়া যেন সারাদিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই আছে, ২৪ জুন সারাদিন, খবরটা তৈরি-হওয়া দেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী সারাদিন তাঁর কলকাতার পার্টি অফিস ও রাইটার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন – কোথাও কোনো বিক্ষোভ সমাবেশ ঘটেছে কী না, জানতে। দু-একটি রাস্তা অবরোধ আর বর্ধমানে সকাল ৮টা নাগাদ একটা পঁয়তালিস্নশ মিনিট স্থায়ী ‘রেল রোকো’ ছাড়া কিছু ঘটেনি। গোলাপদা বললেন, ‘কোনো এক্সপেস্নাশন যে হয়নি, তাতে তো মনে হয় আরবান মিডল ক্লাসের আপার-ক্রাস্ট তো বটেই, এমনকী মিডল রেঞ্জও ওয়েলকাম করছে। সিএম ফিরলে সব জানা যাবে – এই অপেক্ষার সঙ্গেই তো অ্যাকসেপটেন্স জড়িয়ে আছে।’

‘আমরা কী পজিশন নিয়েছি সেটা না-জানলে আর রাজ্যের বিরোধী পক্ষ কী করে পজিশন নেবে। আমাদের লোকজন একটু হকচকিয়ে আছে। লাইনটা কী বুঝতে পারছে না। আমাদের কেউ-কেউ তো বলছেও, পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের এর চাইতে বড় সুযোগ আর আসেনি কখনো।’ যাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলা হয়, তেমন কিছু না ঘটায় সিএম আশ্বস্ত হয়েছিলেন।

‘তেমন করে ওঠেনি এখনো। আপনি যে সঙ্গে-সঙ্গে চলে গেছেন, এতেই লোকজন ড্যাম গস্ন্যাড।’

দুপুরে খাওয়ার শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিএমকে পাশে নিয়ে বললেন, ‘হোয়াটএভার ডিপরুটেড অ্যান্ড স্ট্রং পলিটিক্যাল ডিফারেন্সেস মে উই হ্যাভ অ্যান্ড আই ডু নট ওয়ান্ট টু আন্ডার এস্টিমেট দ্যাট, বাট হিয়ার অ্যান্ড নাও, উই আর জয়েন্টলি উইদইন দি সেম কনস্টিটিউশন্যাল ফ্রেম। আমরা মনে করি পশ্চিমবঙ্গকে একটু বেশি সাহায্য করা দরকার। একটু বেশি ও অন্যরকম। অন্যরকম – এই কারণে যে পশ্চিমবঙ্গ আর মহারাষ্ট্র এমন দুটি রাজ্য যেখানে পুরনো সব শিল্পের অস্থিচর্মকঙ্কাল পরিষ্কার করতে হবে। আমরা এই কাজটি করতে চাই – এই ইউটিটা তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ শিল্পাঞ্চলকে একটু আলগা করে নিয়ে ভবিষ্যতে যদি ইউটির লোকজন পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যেতে চান, ফিরে আসবেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব জোর দিয়ে তিনটি কথা বলে দেন, তাঁর পাঞ্জা মিডিয়ার দিকে তুলে ও এক-একটা কথা হয়ে গেলে একটা করে আঙুল ভেঙে।

‘ওয়ান – প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডিন্যান্স কোনো এমন বিধান নয় যা নিয়ে খেলা করা চলে। আমরা বহু চিন্তা করে এই বিধানের সঙ্গে যুক্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। পৌঁছুনোর চেষ্টা ও আন্তরিকতা ছিল বলেই পৌঁছেছি। এ-কারণে পৌঁছুইনি যে কোনো স্তরে – রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-মতৈক্য – যদি এই বিধান প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে আমরা সঙ্গে-সঙ্গে তা ফিরিয়ে নেব। টু – সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট ও ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্মেন্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতেই পারে না – গভার্ন্যান্স বা প্রশাসন নিয়ে যখন কথা। আমরা একই সাংবিধানিক ব্যবস্থার আবশ্যিক অঙ্গ। বোথ অফ আস আর ইনটিগ্রেটেড পার্টস অফ দি সেম কনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক। থ্রি – এই কলকাতা-ইউটি গঠনের সঙ্গে এর আগে ও সামান্য আগে গঠিত নতুন রাজ্য ও ইউটি গঠনের কোনো মিল নেই। ওগুলোতে এথনিক কোশ্চেন প্রধান ছিল, দোজ ওয়্যার দি ইস্যুজ অফ দি লাস্ট কোয়ার্টার অফ দি লাস্ট সেঞ্চুরি। নতুন শতকের মন্ত্র হচ্ছে – ডেভেলপমেন্ট দ্যাটস দি পোস্টমডার্ন থিম।’

সিএম ঠিক উলটো সুরে গাইলেন। উনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো এত অভিজ্ঞ ও স্মার্ট নন। বৃদ্ধের স্মার্টনেসের প্রসারক্ষমতা কখন বদলে যায়, তা আন্দাজও করা যায় না। বৃদ্ধ যদি অচেতনেও নিজের বার্ধক্য ভুলে স্মার্টনেসে ঝুঁকে পড়েন, সঙ্গে-সঙ্গে মনে হয়, একটু দেখাচ্ছেন যেন। সিএম শুরুতেই বললেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেবারে শেষে যে তৃতীয় পয়েন্টটি বলেছেন যে, এই ইউটি গঠন, এর পূর্ববর্তী নতুন-নতুন রাজ্য গঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও তার প্রধান চালকশক্তি ডেভেলপমেন্ট তা তাঁরা কতদূর সত্য প্রমাণ করতে পারেন, তার ওপর নির্ভর করে এই ব্যবস্থার সাফল্য-ব্যর্থতা ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এটা গ্রহণ করবে না বর্জন করবে সেই কর্মসূচি। আমি আপনাদের কাছে এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই – আমাদের পার্টি ও গভর্মেন্ট কখনো জনসাধারণ যা চান না, তাতে সম্মত হবে না।’ এই কথা বলতেই মুখ্যমন্ত্রী মাত করে দিলেন। তাঁকে অনেক আন্তরিক ও সৎ মনে হলো। আবার, তিনি যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তৃতীয় ও শেষ পয়েন্টটিই আগে ধরলেন তাতে যেন তাঁর বুদ্ধির তৎপরতাও ধরা পড়ল। একটু হেসে সিএম যোগ করলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা এখনো আমাদের কাছে স্বতঃসিদ্ধ নয়, আবার, আশা করি, স্বতঃবিরুদ্ধও নয়।’

‘ইজ নট ইয়েট অ্যাকসিওম্যাটিক, এগেইন, আই হোপ, ইজ নট এ কেস অফ সেল্ফ কনট্রাডিকশন।’ সিএম খুব ভালো কমিউনিকেটর নন কিন্তু চকিতে সেটা ঘটে গেল। ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বলেছেন, তাঁরা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ও অদ্বিতীয় ব্যবস্থা হিসেবেই এই আদেশ জারি করেছেন ও দ্যাট সাচ এ গ্রেভ ম্যাটার অ্যাজ প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডিন্যান্স ইজ নট এ স্মল মেজার দ্যাট ক্যান বি উইড্রন দি নেক্সট ডে ইফ দি কনসেনসাস ব্রেক্স ডাউন ইন এনি অফ দি পলিটিক্যাল অর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এরিয়াজ – সেটা আমরা খেয়ালে রাখব, উই টেক নোট অফ দ্যাট অ্যান্ড উইল লাইক হিম টু নোট’, হেসেই ফেললেন সিএম আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে সরাসরি তাকিয়েই বললেন, ‘স্টেট লাইক ওয়েস্ট বেঙ্গল মে প্রুভ টু বি টুউ এক্সপেন্সিভ অ্যান্ড এমব্যারাসিং এ টয় ইভন ইন দি হ্যান্ডস অফ সো পাওয়ারফুল এ ম্যান লাইক দি হোম মিনিস্টার।’ সকলে মিলে এতটাই হেসে উঠলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও, যে সিএম হাত তুলে জানিয়ে দিলেন, তিনি আর কিছু বলবেন না।

কলকাতার পার্টি অফিসের কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল, সারা রাজ্যে কোথাও অনভিপ্রেত কিছু ঘটেনি। পার্টি কী করতে চায় তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেকের সঙ্গে। মানুষ যা চায় তাই হবে – এ কথা বলার পর পার্টির স্থানীয় নেতাদের বেশিরভাগই ফোনে জানিয়েছেন, মানুষ ইউটি হওয়াতে খুশি। সে-খুশিতে অ্যান্টিলেফট ইমোশনটাই প্রধান – এদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে অন্তত।

দিলি�র পার্টি অফিসে এই কথাটিই ঠিক হলো। পাবলিক যখন চাইছে, তখন পার্টি মেনে নেবে। ইলেকশনে তাদের সঙ্গে কোনো পার্টি পেরে উঠবে না। এমনি হিসেবে দেখা যাচ্ছে – ইউটির অ্যাসেমবি�তে অন্ততপক্ষে ৫০টি আসন থাকবে, কলকাতার ২১ আর মিউনিসিপ্যালিটিগুলির ২৯। তার ভিতর ফ্রন্ট করপোরেশনে উইক।

২৫ জুনের কাগজে মুখ্যমন্ত্রীর উক্তি বলে এই সব হেডলাইন বেরোল – ‘অবিলম্বে কলকাতা ইউটির বিধানসভা ভোট’, ‘কেন্দ্র ইউটির বিধানসভা গঠনের দিকে কতটা এগোয় আগে পরিষ্কার হোক’, ‘গ্রহণ-বর্জন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি’, ‘না-হয় তো সরকার থেকে সরে আসতে হবে’, ‘সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত’, ‘দেশভাগের ঘটনা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়’, ‘জনসাধারণ যা চান না, তাতে সম্মত হব না’, ‘পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে কেন্দ্রের সদিচ্ছা প্রমাণিত নয়’, ‘পশ্চিমবঙ্গ খেলনা নয়।’

একটি কাগজে ‘ইউটি বলা অভ্যেস হয়নি’ বলে একটা বক্স ছিল। আরেকটি কাগজে, ‘মধ্যরাতের মেঘদূত’ বলে একটি লেখায় বৃষ্টি ও মুখ্যমন্ত্রীর ভিজে যাওয়া নিয়ে দুশো শব্দের একটা লেখা ছিল।

দুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল, ইউটি হচ্ছে, তার বিধানসভা নির্বাচন হবে আগস্টে। দু-চারদিনের মধ্যেই নোটিফিকেশন বেরোবে। আসনগুলি নতুন করে চিহ্নিত হবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এটা চায়। প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলও চায়। পশ্চিমবঙ্গের শাসক ফ্রন্টের হিসেব হচ্ছে – বর্তমান করপোরেশন এলাকায় তারা সংখ্যায় কম, তবে একেবারে গা ঘেঁষে কম। মিউনিসিপ্যালিটিভুক্ত এলাকায় তারা সংখ্যায় বেশি। বিরোধীদের কোনো ফ্রন্ট নেই। প্রধান বিরোধী দলের অবস্থা খুব খারাপ। শাসক ফ্রন্টের কাছাকাছিও কেউ আসতে পারবে না। তার মানে দুটো রাজ্য, দুটো বিধানসভা, দুটো মন্ত্রিসভা, দুটো সরকার। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলগুলির হিসেব নানারকম – ইউটি এলাকায় বিরোধীদের মোট ভোট শাসক ফ্রন্টের চাইতে বেশি, যদিও সে-ভোট নানা দলে ছড়ানো। কলকাতা করপোরেশন বিরোধীদলের হাতে। ইউটি-দখল অনেকটা সম্ভবপর কর্মসূচি। বিরোধীদের ফ্রন্ট না থাকলেও, ভোটের জন্য বোঝাপড়া হতেই পারে এই এক শাসক-ফ্রন্টের ওপর লোকজন একেবারে তিতিবিরক্ত। বিরোধীরা জিতে যাবে। তার মানে গোটা বাংলা না-হলেও অর্ধেক বাংলায় আলাদা সরকার, আলাদা বিধানসভা, আলাদা মন্ত্রিসভা।

কোনো পক্ষই এটা বলেনি যে, তারা ইউটির বিরোধিতা করছে বলে ভোটে দাঁড়াচ্ছে।

বিরোধীদল বলতে শুরু করল – এটা তাদের প্রস্তাবিত বেঙ্গল-প্যাকেজের অংশ ও কেন্দ্ররাজ্যে একই ফ্রন্টভুক্ত সরকার না থাকলে ইউটি হলেও কেন্দ্র টাকা দেবে না।

শাসকদল একটা জটিল যুক্তিকে সহজ করে নিল – ‘বাংলা ভাগ রুখব, একই সরকার গড়ব।’ ‘লোকের মাঝে মল খসালি, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার লোভে দিলিস্ন থেকে ইউটি আনলি?’

সেবার, সেই দু-হাজার ডট ডট সালের প্রত্যায়ন বায়ু ফিরে গেল পূর্বনির্দিষ্ট তারিখে, ১৬ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৩টে ৭-এ গঙ্গার ছেলেটাকে কুকুর ডাকিয়ে। তার আগে কলকাতা ইউটির বিধানসভা ভোট হয়ে গেছে, ফলও বেরিয়েছে, সরকারও একটা তৈরি হয়েছে। তাতে অনেকরকম ঘটনাই ঘটেছে ও এখনো ঘটছে। সেসব যথাকালে বলা যাবে। যে-মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ দিয়ে এ-পুরাণের শুরু সেই বায়ুর ফিরে-যাওয়াটুকু না বললে তো ছুটের ছুঁত লেগে যাবে।

গঙ্গা ঠিকে কাজ করে কলকাতা ইউটি হয়ে গেছে যে-অঞ্চল, তারই একটি মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায়। সেই এলাকাকে স্যাটেলাইট টাউনশিপও বলা হয়। গঙ্গা থাকে সেই মিউনিসিপ্যাল এলাকাতেই, তবে টাউনশিপের বাইরে। হেঁটেই চলে আসতে পারে গঙ্গা – তাই এই একটি বস্নকের একটি রাস্তাতেই ছটি বাড়িতে সে কাজ নিয়েছে। কাপড়কাচা, বাসনমাজা, ঘর ঝাড়ামোছা – এই তিনটি কাজ গঙ্গার। দুটি বাড়িতে কাপড়কাচা নেই। বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে গঙ্গা বাড়ি ফিরতে পারে।

গঙ্গা খাড়া মানুষ, কাঁধের হাড় চওড়া, হাতগুলোও লম্বা, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যখন দৌড়ে যায় গঙ্গা, তখন বোঝা যায় সাধারণ চাপা শাড়ি তার একটু খাটোই হয়। গঙ্গার মুখের গড়নটা একটু হেড়ো, একটু কোনাচে, চিবুকটা একটু তীক্ষ্ণ, যেন পুরো নামার আগেই বাঁক নিয়েছে। তার ওপর চ্যাপ্টা নাকের নিচে একটু চওড়া কিন্তু চাপা ঠোঁট। এইসব মিলিয়ে গঙ্গাকে একটু বয়স্ক লাগে, অন্তত তার একটি চার বছরের ছেলে থাকার চাইতে বয়স্ক।

তাদের থাকার জায়গাটা নিচু – শেষ হওয়ার আগে আকাশ ভেঙে জল পড়ছে, রাস্তায় জল তো জমেইছে, আজ রাতেও বৃষ্টি হলে কাল রাতে ঘরেও ঢুকতে পারে। ছেলেটাকে একটু শুকনো রাখার জন্যই গঙ্গা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এখানে রাস্তাতেও জল নেই, বৃষ্টি এলে কোনো ছাদের তলায় ছেলে দাঁড়িয়ে যায় – সবাই তো চেনে, গঙ্গার ছেলে। ছেলেও রাস্তার কুকুরগুলির সঙ্গে খেলে, নানা সাইজের, নানা বয়সের, নানা রঙের কুকুরগুলির সঙ্গে। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি ছুটে যেতে যেতে গঙ্গা ছেলেকে রুটি ধরিয়ে ও কুকুরগুলোকে রুটি ছিটিয়ে যায়। কুকুরগুলো ছেলের হাত থেকে খেয়ে নেবে। কুকুরগুলোর জন্যেই গঙ্গা একটু নিশ্চিন্তও থাকে। ওদের ডাকাডাকি থেকে বোঝা যায় – ছেলে ঠিকই আছে। গঙ্গার ছেলে এখনো চারে পড়েনি – সবে কথা বলা ধরেছে। যা শোনে, তা-ই বলতে চায় এখন, তবে বেশিরভাগই আওয়াজ নানা রকম, সব আওয়াজ কথা হয়ে ওঠে না।

বিকেল ৩টে ৭-এ যে সরকারি বর্ষা সেবার শেষ হলো, সন্ধ্যার আবহাওয়ার খবরে সেটা দেখা গেল। যেমন করে শতরঞ্জি গোটানো হয়, তেমনি করে টিভিতে মেঘ গুটিয়ে গেল আর মেঘের তলা থেকে কাশফুলের সাদা ক্ষেত বেরিয়ে বাতাসে দুলতে লাগল। যিনি একটা পয়েন্টার হাতে মেঘ-বৃষ্টি বোঝাচ্ছিলেন, তিনিই বললেন বিকেল ৩টে ৭ মিনিটে প্রত্যায়ন বায়ু পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে। সেই অতিক্রমণটা টিভিতে এমন দেখাল, যেন বাতাসের পা আছে।

সাড়ে ৩টের পর গঙ্গা রায় চৌধুরীর ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তাই-ই বেরোয় রোজ। একটা সিরিয়াল সে বাড়ি-ফেরার আগে দেখে নেয়, রায় চৌধুরী-ডাক্তারবাবুর বাড়িতে।

সেদিন, সেই ১৬ সেপ্টেম্বর, বেরিয়ে, ছেলে তুলতে গিয়ে গঙ্গা দাঁড়িয়ে দেখে, তার ছেলের কথা ফুটেছে ও কুকুরগুলো তার সঙ্গে কথা বলছে।

‘ঘেউ ঘে-এ-এ-উ’

‘হাঁ-আঁ-ই-কুঁ-উ-উ’

‘ঘে – উ’

‘ঘে-উ’

‘উ উ উ উ উ’

‘ঘে – এ – উ’

অত লম্বা রাস্তায় ও দু হাতে বড়-বড় বাড়িঘরের সারিতে গঙ্গা ছাড়া আর কেউ ছিল না। গঙ্গা ছেলেকে অমন কথা বলতে দেখে বাঁ-হাতের পাতায় ঠোঁট ঢেকে একা-একা হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর কুকুরদের ভিতর থেকে ছেলেকে তুলে বুকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। কুকুরগুলোও কথা বলতে-বলতে পায়ে-পায়ে তাকে এগিয়ে দেয়। (চলবে)