সৈয়দ শামসুল হকের অমরত্ব : সাহিত্য এবং প্রেরণা

মোমিন মেহেদী
আমার প্রথম উপন্যাস ডিভোর্স উৎসর্গ করেছিলাম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। তিনি নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। আজ তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় অভিভাবককে হারালাম। প্রথম অভিভাবক কবি শামসুর রাহমানকে যখন হারিয়েছিলাম; দৈনিক আজকের কাগজের সুবর্ণসভায় এক দীর্ঘ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁকে হারানোর পর যেমন মনে হয়েছে, কাব্যজ জীবনের ডানা ভেঙে গেছে; এখনো সেই একই রকম মনে হচ্ছে। তবে বিদায়ের আলোর ঝরনাধারায় আমাদের জীবনকাব্য যেমন নতুন আলোয় আলোকিত হচ্ছে; একইভাবে বাংলাদেশে সমস্যার রাস্তা তৈরি হচ্ছে; হারাচ্ছি মেধাবী বাংলাদেশ গড়ার কারিগরদের।
সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের রাজনৈতিক অবদান সরাসরি না থাকলেও এ-কথা স্পষ্ট যে, তিনি নূরলদীনের সারাজীবন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন স্বাধীনতা-স্বাধিকারের চেতনায় অগ্রসর হতে। তিনি নিজস্ব স্বকীয়তায় অবারিত সম্ভাবনার বীজ বুনতে-বুনতে
উপহার দিয়েছেন – একদা এক রাজ্যে, বিরতিহীন উৎসব, অপর পুরুষ; জীবনযুদ্ধ থেকে তুলে আনা আগামীর আলোকিত স্বপ্নগাথা উপন্যাসগ্রন্থ নীল দংশন, স্তব্ধতার অনুবাদ, নিষিদ্ধ লোবান, খেলারাম খেলে যা, তাস, রক্তগোলাপ ইত্যাদি। সৈয়দ শামসুল হকের আলোচিত উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে গেরিলা। কথার আকাশে আলোকপাখি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্মৃতি মধুর, কি বিধুর, কি তিক্ত এভাবে আমি দেখি না। স্মৃতি স্মৃতিই। এখানে সব বলা আছে। আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে আমি যখন থেকে লিখতে শুরু করেছি সেই বারো-তেরো বছরে, এই লেখাটাই আমার কাছে মধুর স্মৃতি। আমি যখন চলে যাব তখন আমার এই স্মৃতিটাই উজ্জ্বল করে রেখে যেতে চাই। আমি যা করতে চেয়েছি তার কিছুটা হলেও করতে পেরেছি। এখনো করে যাচ্ছি। এখনো আমার মনে হয় আমি সেই প্রথম দিনের লেখক। প্রতিটি লেখার সময় আমার মনে হয় এই প্রথম শুরু করেছি। এটা আমার মধুর স্মৃতি। আমি যা করতে চেয়েছি, তা করে যাচ্ছি।’ এমন অনবদ্য কবিতাপুরুষ লিখেছেন, ‘আমি একটুখানি দাঁড়াব’। কবিতাটির পথ তৈরি হয়েছে এভাবে, ‘আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;/ শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;/ না, আমি থেকে যেতে আসিনি;/ এ আমার গন্তব্য নয়;/ আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই/ এখান থেকে চলে যাব।/ আমি চলে যাব/ তোমাদের এই শহরের ভেতর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি/ এর মার্চপাস্টের যে সমীকরণ/ এবং এর হেলিকপ্টারের যে চংক্রমণ,/ তার তল দিয়ে তড়িঘড়ি;/ আমি চলে যাব…’
কবিতার গায়ে নতুন ছোঁয়া দিয়েছেন আধুনিক মননের কবি বলেই। তার সেই ছোঁয়া পেয়ে বাংলা কবিতা এগিয়ে গেছে সুন্দরের সে-লক্ষ্যে, যে-লক্ষ্যটা সামনে রেখেই কবি জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, ওমর আলীসহ অনেকেই এগিয়ে গেছেন। জীবনের জলছবি আঁকতে-আঁকতে আরো দক্ষতা অর্জন করেছেন এই পৃথিবীতে। যেখানে নতুন করে গড়েছেন জীবনের ভিত। তাই সাহসে ভর করে লিখেছেন – ‘তোমাদের অ্যাপার্টমেন্ট আমার কষ্ট,/ তোমাদের উনোন আমার কষ্ট,/ তোমাদের ব্যাংক আমার কষ্ট,/ তোমাদের পরিষদ আমার কষ্ট,/ তোমাদের আয়না আমার কষ্ট,/ তোমাদের গেলাশ আমার কষ্ট/ তোমাদের রমণী আমার কষ্ট/ তোমাদের সন্তান আমার কষ্ট।/ আমি শুধু একটু সময় দাঁড়িয়ে দেখে যাব -/ এ সবের ভেতর দিয়েই তো আমার বাড়ি যাবার পথ/ আমি বাড়ি যাব,/ পৃথিবীতে সমস্ত বাড়ি যাবার পথেই আছে/ এরকম একেকটি শহর;/ আমি এক্ষণই এগিয়ে যাব।’
প্রথম কবিতার বই একদা এক রাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। সেই থেকে শুরু করে, সর্বশেষ যে-কবিতাটা, যা হয়তো মৃত্যুর আগের রাতেই লিখেছেন, এ পর্যন্ত নিজের উত্তরণকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘আমি নিজেকে সব সময় অতিক্রম করতে চেয়েছি। আর আমার কবিতা অনেক রকম এটা একাধিকবার বলেছিও। একটা তুলনা করা যেতে পারে একজন চিত্রকরের কাজের সঙ্গে। যেমন চিত্রকর নানা মাধ্যমে আঁকেন – কখনো পেনসিলে, কখনো জলরঙে, কখনো তেলরঙে, আবার অ্যাক্রিলিকে, এটা একেক ধরনের কাজ। কিন্তু জল ও তেলরঙের কাজ পাশাপাশি রাখলে মনেই হতে পারে সবগুলো ভিন্ন ধরনের কাজ। আমার কবিতারও এমন। একেকটা একেক রকম, একেকটা বিষয় আমি একেকভাবে বলার চেষ্টা করেছি। কবিতা হচ্ছে ভাষার সর্বোত্তম প্রকাশ, সবচেয়ে সংকেতময়। এই সংকেতগুলো এমন হয় যে, এলোমেলো বা উচ্ছৃঙ্খলভাবে থাকে কিন্তু কবিতার যে-যুক্তিপ্রবাহ তা যে-কোনো প্রবন্ধের চেয়ে অনেক বেশি নিপুণ, অনেক বেশি প্রত্যক্ষ করা যায়। আমি সেটাকে আমার প্রতিটি রচনায় ধরার চেষ্টা করেছি, কল্পনা-সংকেতের একটি অসাধারণ যুক্তির সিঁড়ি নির্মাণের চেষ্টা করেছি। ছন্দকে যেমন ব্যবহার করেছি, গদ্যছন্দকে তেমনি ব্যবহার করেছি। সম্ভবত আমার মতো গদ্যছন্দে এত আর কেউ লেখেননি। সেই প্রথম থেকেই, ১৯৫২-৫৩ সাল থেকে, গদ্যভঙ্গিটাকে প্রধান ভঙ্গি হিসেবে লিখেছি। আবার আমাদের ছন্দশাস্ত্রে যে-ছন্দগুলো সেগুলোতেও নিজের মতো করে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ছন্দের একটা ব্যাকরণ মেনেছি, শাস্ত্র মেনেছি। সেটা একেকজন কবির হাতে একেক রকম করে ব্যবহার হয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের পয়ার আর জীবনানন্দের পয়ার এক নয়, নজরুলের পয়ার এক নয়। আবার মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত জসীমউদদ্্ীনের একরকম আবার রবীন্দ্রনাথে আরেক রকম। এই আর এক রকমটা হয়ে যায় কবির নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, উচ্চারণ তথা বিভিন্ন কারণে। আমার যে-ছন্দে লেখা কবিতা সেখানেও আমি চেষ্টা করেছি একেবারে আপনার মতো করে ব্যবহার করার।’ এই
কথার সূত্র ধরে কবিতার রাজত্ব জয়ের কাব্যসেনা সৈয়দ শামসুল হকের একটি কবিতার উদ্ধৃতি টানছি। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমার এই অগ্রসর/ সে তোমাদের ভেতর দিয়েই অগ্রসর।/ রাতের পর রাত ভেঙে উৎকর্ণ জন্তুর মতো চলেছি/ চাঁদের নিচে পানির সন্ধানে,/ সমস্ত স্তব্ধতাকে মাকড়শার জালের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে/ গুহাবন্দি মানুষের মতো আমি চলেছি/ পানির শব্দ নির্ণয় করে।/ আমি এখনো জানি না তার শেষে অপেক্ষা করছে কিনা…’
এই সম্ভাবনার রামধনু নিয়ে এগিয়ে গেছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রতিটি লেখা। কবিতার পাশাপাশি পথ হেঁটেছেন চিত্রনাট্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এমনকি কলামেও। সাহিত্যের সবটুকু আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ করেছেন তিনি। চিত্রনাট্যের কথা তিনি কখনো গা ছেড়ে দিয়ে ভাবেননি। ভেবেছেন, প্রত্যয়ের সঙ্গে। যে-কারণে একটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সেই পায়ের আওয়াজ যখনই অন্যায় আর অপরাধের রামরাজত্ব তৈরির চেষ্টা চলেছে, তখনই পাওয়া গেছে। সম্ভাবনার-সমাধানের-উন্নয়নের পায়ের আওয়াজ জীবনভর শুনিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। যে-কারণে নিজের মতো করে বুনেছেন জীবনের মালা, গড়েছেন নিবেদিত জীবন। হয়তো এ-কারণেই তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যারা আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন তাদের ভালোবাসায় আমি প্লাবিত ও অভিভূত। একটি কবিতায় ‘তোমাদের জন্ম হয়, তোমাদের জন্মদিন আসে, আমাদের জন্ম নেই, জন্মদিন আসে না’। যাদের জন্মদিন নেই, সারাজীবন তাদের কথা বলার চেষ্টা করেছি। সামান্য ও সাধারণ মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমার জন্মভূমিকে ভিত্তি ধরে তার সঙ্গে অন্য অনেক বিষয়কে যোগ করেছি। আশি বছর পার করেছি, এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এটা আমার এক ধরনের অহংকার। সেটা লেখায় এবং নিজের অস্তিত্বে। এখনো অনেক লেখার বীজ মাথায় আসে। কিছু শেষ করলে নতুনভাবে এসে হাজির হয়। আপনাদের সবাইকে নিয়ে সহস্র বছর বেঁচে থাকতে চাই। আমি একা নই, আপনারাও থাকবেন। মানুষ চলে গেলেও তার দীর্ঘছায়া এই মাটিতে থেকে যায়। মানুষ চলে যায়, তার কাজ থেকে যায়। মানুষ চলে যায়, তার স্বপ্ন থেকে যায়। অনাগত ভবিষ্যৎ ও সাধারণ মানুষের জীবনের মধ্যে আমি বেঁচে থাকতে চাই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি আশাবাদী, আমাকে কেউ হতাশ করতে পারেনি। অনুতাপ স্পর্শ করতে পারেনি। এই দেশ এই মানুষ এই স্বপ্ন এই মাটি থেকে যেন কখনো বিচ্যুত না হই। কখনো যেন আমাদের সন্তানদের এই মাটি থেকে বিচ্যুত না করি। শহিদদের রক্তস্নাত এই বাংলার মাটি-মানুষকে ধরেই যেন বেঁচে থাকতে পারি।’
প্রত্যাশা আর প্রত্যয়ের রাজত্ব তিনি নির্মাণ করেছিলেন শৈশব-কৈশোরের কষ্ট আর হতাশাযুক্ত জীবন থেকে। আর তারই সূত্র ধরে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, জীবন-দর্শন আর লেখনীর পুরোটা জুড়েই তিনি নিবেদিত থাকায় আমাদের মাঝে বেঁচে যাবেন নিশ্চিত। কেন বেঁচে যাবেন? কারণ তিনি স্বাধীনতার পক্ষের ছিলেন, প্রচুর পড়েছেন-লিখেছেন এবং শিখেছেন। তাঁর শেখার পাল্লা এতটাই ভারি যে, যখনই কিছু লিখেছেন, কিছু বলেছেন; তখনই তা জনগণের মনে রেখাপাত করেছে। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণকারী সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক কষ্ট করে হলেও সব্যসাচী বিষয়টিকে জীবনে আঁকড়ে ছিলেন বরাবর। হয়তো এ-কারণেই ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ তথা সাহিত্যের সব শাখায় সমান অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলাদেশের একমাত্র সব্যসাচী লেখক। এত-এত আশ্চর্যজনক সৈয়দ হকের আরো একটি বড় দিক হলো, তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে। সাংবাদিক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে লেখালেখিকেই মূল উপজীব্য হিসেবে নিয়েছেন। ২৯ বছর বয়সে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৮৪ সালে। জলেশ্বরীর কবি-জলেশ্বরীর মায়ায় আলোছায়ায় তাঁর সবটুকু অর্জন রেখে গেছেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের জন্য। তাঁরা অন্তত তাঁকে মনে রাখবে – বাংলাদেশকে ভালোবেসে সময়ের তারকা বনে যাওয়া প্রিয় কবি সৈয়দ হকের বর্ণাঢ্য কলেবরের জীবনকে। 