সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

আমিনুর রহমান সুলতান
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যজগতে প্রবেশ ঘটেছে বাস্তবের সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবনার বিপরীত স্রোতে ব্যক্তির অবচেতনের যে বাস্তব ‘আত্মচিন্তা’, তাকে কেন্দ্রে রেখে। একদা এক রাজ্যে (১৯৬১) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এভাবেই প্রতিভাত হয়েছে পাঠক-সমালোচকের কাছে। অথচ চল্লিশের দশকের সাম্যবাদী চেতনার যে-জগৎ, তাকে আত্মস্থ করেই সৈয়দ হকের সমকালের কবিবন্ধুরা সমাজ-রাজনীতিকে তাঁদের কবিতার প্রধান বিষয় করেছেন।
তবে খুব বেশিদিন বা ধারাবাহিক কাব্যযাত্রায় তাঁর কল্পজগতের এবং অবচেতনের ও আত্মচিন্তার ভাবনায় তিনি স্থিত থাকেননি। রাজনৈতিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তির যে-আকাক্সক্ষা, বিদ্রোহ সে-উপলব্ধির জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি নিজেকে।
তাঁর দ্বিতীয় কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাঁর কাব্যজগতের বিষয় অনন্যতা পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থের বিষয়ের তুলনায়।
অরণ্য কি থাকবে না তবে?
… … …
মানুষের ঋজুতার উপমা যে শালবৃক্ষ থাকবে না তবে?
পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞে ঢাকা শহর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নিরাপত্তাহীন ঢাকায় বাঙালির অস্তিত্ব চরম সংকটে পতিত হয়। সৈয়দ শামসুল হক অবরুদ্ধ শহরের চিত্র তুলে ধরেছেন ‘অবরুদ্ধ শহরে চতুর্থ মাস’ কবিতায় –
ক্রমাগত সৈনিকের পদশব্দ আমাকে জটিল কোনো যন্ত্রেরবিপুলতার সঙ্গে
গেঁথে চলে যায়
কথা কেউ বলে না
শব্দ কেউ করে না
বস্তুত ঠোঁটের কোনো কাজ নেই আতংকের তাপে ফেটে যাওয়া
ছাড়া
বস্তুত হাত কিংবা পায়ের কোনো কাজ নেই
হিমবাহ এই শহরের চাঙড় কোনক্রমে আঁকড়ে থাকা ছাড়া
… … …
আমি যেখানেই যাই এ শহরে অবেলায় ক্রমাগত বেলা পড়ে
যায়।
২৫ মার্চ রক্তাক্ত অধ্যায় সূচিত হবার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এদেশের মুক্তিকামী ছাত্র জনতা-কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক। গড়ে ওঠে গেরিলা বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল পর্যায়ক্রমে ভেঙে পড়ে। হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতি অবলম্বন করে গেরিলারা। গেরিলাদের নিয়ে সৈয়দ হক লেখেন ‘গেরিলা’ শিরোনামের কবিতা। কবি গেরিলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের কার্যক্রম ও তৎপরতাকে উপস্থাপন করেছেন। একজন গেরিলা প্রকৃতির ভেতর দিয়ে সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে নতুন বর্ষা রূপে, নতুন ফুলের ও নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে – কবিতায় তা ব্যক্ত। কবিতাটিতে তিনি যেভাবে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি সাজিয়েছেন তাতে লক্ষ করার বিষয় এই যে, কবিতাটিতে শব্দের গাঁথুনি দিয়ে যে-আঙ্গিক তৈরি হয়েছে তাতে একজন গেরিলারই প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত। কবিতাটি হুবহু তুলে ধরা হলো –
অবিরাম
দক্ষিণ ভিয়েৎনাম
কম্বোডিয়া
বাংলাদেশ
অ্যাংগোলায়
মোজাম্বিকে তুমি
নিসর্গের ভেতর দিয়ে
সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যাও সারাদিন সারারাত যখন গ্রামগুলো
জনশূন্য চাতাল চিড় খাওয়া আর উপাসনার চত্বরগুলো ঝরাপাতায়
অনবরত ঢেকে যায় নিঃশ্বাসের শব্দের ভেতরে
তোমাদের চলাচল
যেন তুমি আমাদেরই দ্বিতীয়
শরীর কোনো এক রবীন্দ্রনাথের
গান সমস্ত কিছুর কেন্দ্রেই আছো
এবং ধ্বনিত করছ দুঃখের পাহাড়
আফ্রিকার এশিয়ার
নিসর্গে তুমি নতুন বৃক্ষ
নতুন বর্ষা নতুন ফুল
দিগন্তে নতুন মাস্তুল
পিতৃপুরুষের চিত্রিত দন্ড
দাউ দাউ নাপামের
মধ্যে তুমি হেঁটে যাও
উদ্যত একাকী
জনশূন্য জনপদে উজ্জ্বল এক চিতা
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরই উত্থিত রয়েছে আমাদের বাঙালির, বাংলাদেশের ইতিহাসবোধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অগ্রগতিতে আসে বাধা। আর তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় যে স্বৈরশাসক ও স্বৈরসময় এবং সাম্প্রদায়িকতা তারও বাস্তব সময়কে, শাসনকে দায়ী করেছেন কবি ‘একদা এক দেশ ছিল’ কবিতায়। উদাহরণ তুলে ধরছি,
একদা একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ নামে, সেই দেশে শ্রমিক ও শিল্পীরা
ভালোবাসার – কেবল একটি উন্নত ভালোবাসার প্রশিক্ষণ
পেয়েই উড়িয়ে
দিতে পারত স্বাধীনতার পতাকা এবং প্রাণ দিতে পারত মায়ের
স্তন্যপানের
মতো স্বাভাবিকতায়।

একদা একটি দেশ ছিল বাংলাদেশ নামে, সেই দেশে মালা
রূপান্তরিত হয়
শেকলে এবং পিতা পরিণত হয় ক্রীতদাসে – ইতিহাসের
প্রতিটি পাতায়
রাজাকার তার নাম লেখে এবং সেলাই করে দেয়া হয় দেশপ্রেমিকের চোখের পল্লব।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যজগতে একাত্তরের মার্চ বিশেষ জায়গা পেয়েছে। আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি বৃহত্তর জিজ্ঞাসার,
যে-জিজ্ঞাসার পরিণতি ইতিহাসের সত্যকে ধারণ করে আছে। এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সূচনার ভিত্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের শুভ সূচনার প্রতি সৈয়দ হক খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এজন্যেই তিনি ২০০৪ সালের ২১ মার্চ এসেও লেখেন ‘মার্চের গান’ কবিতা। কবিতার বিশেষ কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরছি,
মাস এটি মার্চ। ইংরেজি মার্চ। বাংলা কুচকাওয়াজ!
একে একে তেত্রিশটি বছর – আজও পথে শুনি সেই আওয়াজ।
বন্ধু, তাহলে মার্চেই চলো। রাজপথে নামা যাক।
… … …
আজও আমাদের শেষ নয় জেনে মুক্তির অন্বেষও!
একদিন তুমি ছিলে রাজপথে আজ কেন তুমি নেই
… … …
সাতই মার্চে রমনায় যাই পুরনো সে রেসকোর্সে।
জয় বাংলার কণ্ঠ মেলাই সাড়ে সাত কোটি জোরসে।
… … …
ছাব্বিশে শুনি সোনালি শব্দ : ‘স্বাধীনতা’, ভাসে ঈথারে।
গণহত্যার বিপরীতে জয় বাংলা-র ধ্বনি গিটারে।
… … …
মার্চের সেই পঁচিশ একদা আজও মার্চেই তবে কি?
দুঃশাসনের বিপরীতে আজ মুক্তিযোদ্ধা হবে কি?
মার্চেই জ্বলে চৈত্র-আগুন, ইতিহাস দেয় আবার ডাক ॥
একাত্তরের মার্চ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে কবির রচিত ধ্বংসস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯) কাব্যগ্রন্থেও। এ-গ্রন্থের ২৭টি কবিতার পটভূমি মূলত ১৮৫৭ সাল ও মীর্জা গালিবের বিধ্বংস দিল্লি। তবে বাংলাদেশের একাত্তরের মার্চ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রাসঙ্গিক রূপ নিয়ে এ-গ্রন্থের ‘অনিবার্য’ মিল খুঁজে পাই, কবিতাটি প্রতিভাত।
অবশ্য এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয়। পেশাগত কারণে কবি সৈয়দ হক ১৯৭১-এ দেশের বাইরে ছিলেন। তখন তিনি লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত।
আর এ-কারণে সিপাহি বিপ্লবের (১৮৫৭) কালে মীর্জা গালিবের নীরব থাকা নিয়ে যে-প্রশ্ন ওঠে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গালিবের নীরবতার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক কবি-শিল্পীর মতো কবি নিজেরও এক ধরনের নীরবতার মিল খুঁজে পান। এ-বিষয়ে সৈয়দ হক এই কাব্যগ্রন্থের গদ্যাংশে যে-মন্তব্য করেছেন তা উল্লেখযোগ্য, ‘মনে রাখা ভালো, কলম চালনায় পটু যিনি, তিনি যে তলোয়ার বন্দুক চালনাতে পটু হবেন এমন কোনো কথা নেই। চিন্তার সাহস আর অস্ত্রের সাহস এক কথা নয়। কবি-শিল্পীদের এই আপাত নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা আমরা একাত্তরে বাংলাদেশেও দেখেছি। কিন্তু তার অর্থ এটা ছিল না যে, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধ তাদের আলোড়িত করেনি। বরং এটাই তো দেখতে পাওয়া গেছে, একাত্তরের যুদ্ধে যারা যাননি, অবরুদ্ধ দেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেননি, পরবর্তীকালে তাঁদের অনেকেরই কলম থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ও কালজয়ী রচনা বেরিয়েছে, এমনকি তাদের ওই আপাত নিষ্ক্রিয়কালেই আসলে তাঁরা ছিলেন নিভৃতে সৃজনক্রিয়াশীল।’
প্রকৃত সত্যও তাই। মীর্জা গালিব ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে এক ধরনের নীরব থাকলেও অল্প কিছুদিন পর প্রকাশিত হয় তাঁর দাস্তাম্বু অর্থাৎ কুসুমগুচ্ছ (১৮৫৮)। এ-গ্রন্থে ‘বিপ্লবের কাল, কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও অবস্থানের কথা উঠে এসেছে।’
সৈয়দ শামসুল হকও সুদূর লন্ডনে অবস্থান করলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধোত্তর কালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত দেশচিন্তা তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে কবি ও নগর কাব্যগ্রন্থের গদ্যাংশটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কবির মন্তব্য স্মর্তব্য, ‘বিপ্লবকালের সঙ্গে ’৭১-এর বাংলাদেশেরও একটি বিপরীত মিল আমি দেখে উঠি। ১৮৫৭-য় বিপ্লবীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রথমে ও পরে যুদ্ধ করে, যুদ্ধে তাদের পরাজয় হলে অগ্রগামী ইংরেজ ফৌজের হাতে গণহত্যা শুরু হয় দিল্লিতে, সড়ক বুজে যায় মানুষের লাশে, দিল্লী পরিণত হয় ধ্বংসনগরীতে। আর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা নগরীতে গণহত্যা চালায়, সড়কে সড়কে লাশ পড়ে থাকে, ঢাকার দিকে দিকে তারা আগুন জ্বালিয়ে মহল্লার পর মহল্লা ভস্মীভূত করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ’৭১ সালের ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুকে চেতনাস্থলে রেখে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা চেতনার জন্মদাতা, মুক্তিযুদ্ধের হোতা। বিপরীতে সম্রাট বাহাদুর শাহ তাঁর নিজ চেতনাবলে বা কর্মদ্যোগে নয়, বরং তাঁর অনিচ্ছা ও অপ্রতিভতা সত্ত্বেও বিপ্লবী সিপাহীদের দ্বারা ঘোষিত এক নামসর্বস্ব সম্রাট ও নিতান্তই প্রতীকী এক নেতা। বাহাদুর শাহ গ্রেফতার হন ইংরেজের হাতে, বিচারে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তিনি নির্বাসিত হন রেঙ্গুনে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী, তিনি সগৌরবে ফিরে আসেন স্বদেশে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ পাকিস্তানমুক্ত হয়, ১৮৫৭-য় হিন্দুস্থান ইংরেজ শাসনের কাছে বন্দী হয়ে পড়ে।’
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজ ফৌজদের হাতে দিল্লি নগরীতে যে ধ্বংস নেমে এসেছিল, হত্যাকা- সংঘটিত হবার পর নগরীর সড়কে লাখ-লাখ লাশ পড়ে ছিল, তার সঙ্গেই কবি সৈয়দ হক তুলনা করেছেন একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ঢাকা নগরীর ধ্বংসযজ্ঞের, গণহত্যার। কবির উচ্চারণ,
তিনিও স্তম্ভিত হন মীর্জা আসাদুল্লাহ খান
গালিব হঠাৎ একদিন –
যেদিন দিল্লীর বুকে আগ্রাসন নেমে আসে,
লক্ষ লাশ সড়কে সেদিন।

উনিশ শ’ একাত্তরে পঁচিশে মার্চের রাতে
আমাদের ঢাকাতে আগুন।
নির্বিচারে পথে পথে মৃত্যুর তা-ব নাট্যে
হানাদার করে চলে খুন।
‘অনিবার্য মিল খুঁজে পাই’ কবিতাটির রচনাকাল ২৮ আগস্ট ২০০৭।
এই কবিতার আগে ৫ মার্চ ২০০৭-এ লেখা ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার সাতই মার্চ’ কবিতাটিতে একাত্তরের মার্চের নতুন পথ নির্দেশের বাস্তব পরিণতির ইতিহাসকে নির্মাণ করেছেন কবি। কবি সৈয়দ হক মার্চের সংগ্রামী জীবনকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে দেখেছেন নতুন ইতিহাস সৃষ্টিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিভূমির নতুন ইতিহাসও এই সময়ে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সিদ্ধিও ঘটেছে মার্চে। দুঃসময়ে প্রেরণারও উৎসভূমি। কবিতাটির অংশবিশেষ নিম্নরূপ,
আমি এখনো সেই বজ্রধ্বনি প্রতিভার উচ্চারণে
প্রতিদিন যে বীরগাথা শুনতে পাই
তার সূচনা দুটি শব্দই হচ্ছে – মুক্তি আর স্বাধীনতা।

ধারালো এই হিমে আমরা সবুজ নেবো শরীরে,
জনসভায় বিশাল হবো আবার,
আর আমাদের হাতের সঙ্গে হতে থাকবে
জনকের স্বপ্নবাহুর গ্রন্থন আবারও;
এবং সেই তাঁরই করতলের মুদ্রা থেকে আবার
বেরিয়ে আসবে সেই সাদা পায়রাটি
যে একদিন মার্চের এক রৌদ্রজ্বলা উদ্যানের শীর্ষে উড়ে
পৌঁছে গিয়েছিলো লক্ষকোটির স্বপ্ন-নিলীমায়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি মুক্তি আসবে অর্থনৈতিক আর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুখোশ পরে সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন কবি-সাহিত্যিকরা। তাঁরা তাঁদের লেখনী ঠিকই চালিয়ে গেছেন।
একাত্তরের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। সৈয়দ হক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখলেন ‘কোনো শোকগাথা নয়’, ‘মুজিবের রক্তাক্ত বাংলায়’, ‘বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে’, ‘টুঙ্গিপাড়ায়’, ‘মুজিবের শাদা পায়রাটি’, ‘রোজ গার্ডেনে সেদিন শেখ মুজিব’ প্রভৃতি কবিতা। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা এসে যায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের বিস্তৃত পটভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সৈয়দ হক তাঁর একাধিক কবিতায় পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও কর্মধারার ঘটনাবিন্যাস এবং মুক্তিযুদ্ধের সুবিস্তৃত পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর অভিনব ও দুঃসাহসিক দায়বদ্ধতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। ‘রোজ গার্ডেনে সেদিন শেখ মুজিব’ কবিতাটি উদাহরণ হতে পারে এ-ক্ষেত্রে। কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলো,
জন্মসূত্রে টুঙ্গিপাড়ার, চেতনায় সমগ্র বাংলার,
পিতার সন্তান তিনি, কিন্তু একদিন
দেশটির পিতা হয়ে উঠবেন। জাতির জনক!
… … …
ইতিহাস জানে সত্য, রক্তই বহেছে।
ত্রিশ লক্ষের রক্তে লাল হয়ে আছে আজো মাটি।
যেন রোজ গার্ডেনের সেদিনের রক্ত-গোলাপেরা
নিজস্ব বাগান ছেড়ে সারা দেশে ব্যাপ্ত হয়ে যায়।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে এক নতুন তাৎপর্যে উপহার দেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী বাঙালির অমোঘমন্ত্র উচ্চারণ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকের মধ্যে সার্বিক মুক্তি-আন্দোলনের পরিণতির সূচনা হয়েছিল। পথ নির্দেশিত হয়েছিল সংগ্রামী বাঙালির জন্য। মুক্তি ও স্বাধীনতা – এ দুটো কেবল শব্দ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চূড়ান্ত পরিণতি ও বাংলাদেশের ইতিহাস পর্বেরও সূচনা। এ-কারণেই ২০০৭ সালে এসেও কবি সৈয়দ হক উচ্চারণ করেন –
বাঙালির সংকল্প ও সংগ্রহের অসীমতায় এখনো তো
সেই পায়রারই উড্ডয়ন,
এবং এখনো তো সেই পায়রারই দুটি ডানায়
অনবরত লিখিত হয়ে চলেছে :
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
যদি একবার উচ্চারণ করে উঠি আজও ওই দুটি পংক্তি,
দু’কূল ছাপিয়ে উঠবে তেরোশত নদী,
আমাদের বধিরতা ছিন্ন করে
ইতিহাস গেয়ে উঠবে নতুন এক বীরগাথার গান।
এক্ষেত্রে ‘মুজিবের শাদা পায়রাটি’ কবিতাও উল্লেখযোগ্য,
আমাদের হাতের সঙ্গে আবার হতে থাকবে
মানুষেরই হাতের গ্রন্থন –
করতল ও হাতের ওই মুদ্রা থেকেই বেরিয়ে আসবে
সেই শাদা পায়রাটি আবার,
মুজিবের হাত থেকে
একদিন যে উড়েছিলো বাংলার আকাশে
এবং অনূদিত হয়েছিলো অক্ষয় দুটি শব্দে –
মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে ও বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়। আমাদের অস্তিত্ব-সংকটে ফিরে যেতে হয় একাত্তরের প্রেক্ষাপটে। পৃথিবীর বুকে নতুন করে একটি জাতি ও একটি দেশের উত্থান নবতর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছিল একাত্তরই। এজন্যেই সৈয়দ হক ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় যে-উচ্চারণ করেছেন তা বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষেরই আত্মোপলব্ধি –
আমি যে এসেছি জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
… … …
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের –
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি – এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি –
চোখ নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি। 