সৈয়দ শামসুল হক : পটভূমি ও বিস্তার

মফিদুল হক
সৈয়দ শামসুল হকের জীবন ও কর্মধারার দিকে তাকালে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। এর বিস্তার এতো বিপুল, তাৎপর্য এতো গভীর যে, তা আমরা সম্যক বুঝে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। একাশি বছরের সৃষ্টিশীল জীবন তাঁর, কালব্যাধি মৃত্যু আসন্ন করে তুললেও সৃজনে কোনো বিরাম বা ছেদ টানতে তিনি রাজি ছিলেন না। হাসপাতালের রোগশয্যায় তিনি যখন তর্জনী তুলে আবৃত্তি করছিলেন কবিতা, মনে হচ্ছিল সৃষ্টি দিয়ে মৃত্যুকেই বুঝি তিনি অস্বীকার করতে চাইছেন। অবধারিত মৃত্যুকে অস্বীকার করে কার সাধ্য, কিন্তু সৃজনের শক্তিতে মানুষ যে পারে মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করতে সেই পরিচয় সৈয়দ হক রেখেছেন তাঁর জীবনাচারে। এক্ষণে তাঁর প্রয়াণের পর সাহিত্যকর্ম তাঁর হয়ে নিশ্চিতভাবে পালন করবে সেই ব্রত।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ববাংলায় একঝাঁক প্রতিভাবান নবীনের আবির্ভাব হয়েছিল, যাঁরা সৃজনের নতুন প্রবাহ তৈরি করে পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বিশাল আয়োজন চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং জন্ম দিয়েছিলেন নবজাগরণের। এই জাগরণের প্রাথমিক রূপ রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ছিল না, ছিল সাংস্কৃতিক এবং মূলত সাহিত্যিক, কিংবা বলা যেতে পারে ছিল সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক। পশ্চিমবাংলার আজকাল পত্রিকার ডাকসাইটে সাংবাদিক বাহারউদ্দিন একবার আমাকে বলেছিলেন যে, পূর্ববাংলায় পঞ্চাশের দশকে এক রেনেসাঁস বা নবজাগরণ ঘটে গেছে, যা আমরা এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। তিনি বলেন, সেই সময়ে যা-যা ঘটেছে তা বাংলার উনিশ শতকের রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
এই জাগরণকে আমরা আমাদের মতো চিহ্নিত করি এবং উৎস হিসেবে সঠিকভাবেই বিবেচনা করি ভাষা-আন্দোলনকে, আমরা বলি ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। তবে এই পরিক্রমণ উপরভাসাভাবে দেখা হয় বেশি, জোর পড়ে এর রাজনৈতিক দিকের ওপর, সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক মাত্রা তেমনভাবে তলিয়ে দেখা হয় না। ভাষা আন্দোলন যখন আমরা বলি, তখন কেবল যদি ভাষা নিয়ে আন্দোলন বোঝানো হয় তবে তো ভাষার যারা কারবারি, চিন্তাকে ভাষায় প্রকাশ, সৃজনের ভাষারূপদান, এসব সৃষ্টিশীল কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদের ভূমিকা হয়ে ওঠে মুখ্য। এখানে আমরা পাই অসাধারণ এক ক্যানভাস, যে-ক্যানভাসে অনেক রং, অনেক মুখ, অনেক সৃষ্টিশীল সাহিত্য, সেখানে আরো অনেকের সঙ্গে রয়েছেন প্রাঞ্জল এক ব্যক্তিসত্তা সৈয়দ শামসুল হক। ভাষা-আন্দোলন এই তরুণদের জন্য প্রেরণামূলক হয়েছিল, এ-আন্দোলন এমন এক সময় ঘটল যখন তাঁরা অনেকে একত্রে সাহিত্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে খুঁজছেন আত্মপ্রকাশের পথ, ভাষাকে অবলম্বন করে। কে কী লিখছেন সেটার মতো, কিংবা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে-ভাষা তাঁরা নির্মাণ করছিলেন, যে-ভাষাবোধ তৈরি করে চলেছিলেন, সেই প্রয়াস। বিগত বছরের ডিসেম্বরে ৮০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাহান্ন প্রসঙ্গে তাই সংগতভাবে সৈয়দ হক বলেছিলেন :
ভাষার জন্য শুধু রাজপথে রক্ত ঝরানোর বছর সেটি নয়, পাকিস্তানের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখা ও বাংলাকে আরবি-উর্দু শব্দে জর্জরিত করে এই ভাষাটিকেই বিনষ্ট করবার বিপরীতে আমরা ক’জনা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাংলাভাষাকেই আঁকড়ে ধরে যে লিখে চলেছিলাম, সেদিন আমাদের দুর্বলতম লেখাটিও যে ছিল রাজপথে রক্ত ঝরানোর চেয়েও অধিক সফল যুদ্ধ, বন্দুক নয় কলম হাতেই যে হয়ে উঠেছিলাম বাংলা মায়ের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা আমরা একেকজনা – আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যায় অশ্রুর প্লাবনে।
সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্টিশীলতার কালপর্ব যদি আমরা চিহ্নিত করি, কবে কখন প্রথম রচনার সূত্রপাত সেই বিবেচনায় নয়, কোন সময় থেকে সৃষ্টিশীল অভিযাত্রার শুরু সেই বিচারে, তবে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে ১৯৫২ সাল। এর অব্যবহিত পূর্বে আমরা লক্ষ করেছি ঢাকা শহরে একদল তরুণ, বলা যেতে পারে অনতিতরুণ, নবীন কিশোরই বুঝি, নানাভাবে খুঁজছেন সৃজনের গতিপথ, সেই সঙ্গে সৃজনের ভাষা। এই ভাষা নিছক আক্ষরিক অর্থে নয়, স্বাদেশিকতা অর্থেও প্রযোজ্য, যেমন বলা যায় চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রে, তারা ক্যানভাসে চড়াবেন কোন রং, আঁকবেন কোন ছবি কোন রীতিতে সেটাও তো চিত্রভাষার প্রশ্ন। তো এই সাহিত্যিক ও শিল্পীবৃত্তে সমবেত নবীনেরা জায়মান ঢাকা শহরে ছিলেন পরস্পরের পরিচিত, যে-পরিচয় থেকে গড়ে ওঠে সখ্য, সাহিত্যের ও শিল্পের পাঠগ্রহণ ও ভাববিনিময় হয় তাঁদের জীবনধারার অঙ্গাঙ্গি অংশ। অনেকানেক নাম এখানে উচ্চারণ করা যায়, তারপরেও দেখা যাবে অনুচ্চারিত রয়ে গেছে আরো কত-না নাম। চট করে বলার মতো নামও অনেক, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ফয়েজ আহমেদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, খালেদ চৌধুরী, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী এবং আরো কতজনা! সৈয়দ শামসুল হকও আছেন সেই বৃত্তে এবং সত্যি বটে, বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে তিনি ছিলেন না দেশে, চলচ্চিত্রের ভাষা শিখবেন বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন বোম্বাই, ফিরে এসেছিলেন অল্পকাল পরে, তবে বিপুল জীবনাভিজ্ঞতা ধারণ করে। বাহান্নর অভিযাত্রায় শরিক হতে তাই তাঁর কোনো বিলম্ব ঘটেনি, ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান যখন প্রকাশ করলেন একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন, আরো অনেকের সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাও সেখানে স্থান পেয়েছিল। ভাষা-আন্দোলনের সাহিত্যরূপ প্রদানের পাশাপাশি আরো নানাভাবে চলছিল সৃজনী আয়োজন। সংগীতে এর অসাধারণ প্রকাশ আমরা দেখি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচনা ও আলতাফ মাহমুদের সুরে সৃজিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানে কিংবা বাগেরহাটের অখ্যাত গীতিকার শামসুদ্দীন আহমদের রচনা ‘ওরে ও বাঙালি, ঢাকার শহর রক্তে রাঙাইলি’ লোকগীতিতে। নাটকে তাৎপর্যময় উত্থান ঘটে গেল লোকচক্ষুর অন্তরালে, কারা-অভ্যন্তরে মুনীর চৌধুরী রচিত কবর নাটকে অভিনয় করলেন কারাবন্দিরাই, বিশ্বনাটকের ইতিহাসে এমন উদাহরণ তো বিশেষ নেই। চিত্রকলার ক্ষেত্রে এর রূপায়ণ কিছুটা সময় নিয়েছিল, তবে বাংলাদেশের চারুকলার ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন বাহান্নর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণ শিল্প-শিক্ষার্থীরা, তখনো যাঁরা জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত চারুকলার বিদ্যাপীঠের পাঠ সমাপন করেননি। দেশ ছিল পাকিস্তানি শেকলে বাঁধা, তবে ভাষা, সংস্কৃতি, স্বদেশ ঘিরে ঘটছিল এক জাগরণ – যাকে নবজাগরণ বলতে দ্বিধান্বিত হওয়া সংগত হবে না।
এখানে জাগরণের আরেক মাত্রার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ভাষা-আন্দোলন কীভাবে এত প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠল সে-প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও কৃতী বাঙালি অমর্ত্য সেন স্বীয় উপলব্ধি মেলে ধরেছিলেন ঢাকায় প্রদত্ত একাধিক ভাষণে। তিনি মনে করেন, ১৯৫০ সালে মুসলিম লিগ সরকার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিধান গ্রহণ করলেও এর ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। পূর্ববাংলায় জমিদারদের বৃহদংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে কলকাতাপ্রবাসী। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের দ্বারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ছিল মুসলিম লিগের লক্ষ্য, আর অমর্ত্য সেন বলেছেন, এর মাধ্যমে পূর্ববাংলায় এক ধরনের ভূমি সংস্কার ঘটে গিয়েছিল এবং প্রজার স্বত্ব প্রসারের মাধ্যমে নতুন এক মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশের সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছিল, শিক্ষাগ্রহণে যাঁরা সম্পৃক্ত হচ্ছিলেন ব্যাপকভাবে। এই জনগোষ্ঠী সংগতভাবেই ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে তাদের বিকাশের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন এবং মাতৃভাষার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন বিপুলভাবে।
অন্যদিকে নতুন এই জাগরণের সাহিত্যিক শরিক ও সৈনিক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক শৈল্পিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলেন এর তাৎপর্য এবং লিখেছিলেন –
আমি এবং আমার প্রজন্ম অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের লেখক সকল বায়ান্নোর সন্তান। যখন আমরা লিখতে শুরু করেছিলাম তখন আমরা কেউ কিশোর কেউ-বা প্রথম যৌবনে। আমাদের সেই কোমল কাঁধেই ইতিহাস চাপিয়ে দিয়েছিল এক গুরুদায়িত্ব – সচেতনভাবে অনুভব করিনি এর ঐতিহাসিকতা বা ওজনের ঘনত্ব তখন, ধীরে সেটি বোধের মধ্যে আসে; ষাটের দশকে পৌঁছেই, আমরা বয়সের তুলনায় অনেক বেশি প্রাজ্ঞ ও পরিণত হয়ে উঠি – সাহিত্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ইতিহাস-চেতনায়, যে, একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বদেশ বস্তুত দুটি – তার রাষ্ট্র এবং তার ভাষা – ভাষায় রচিত সাহিত্য।
আফ্রিকার মুক্তি-আন্দোলনের নেতা আমিলকার কারবালের স্বরধ্বনি অনুসরণ করে বলা যায়, বাংলাভাষায় লেখাটাই তখন হয়ে উঠেছিল
An act of culture, an act of resistance.
ভাষা অবলম্বন করে সৃজনশীলতার সেই প্রয়াস প্রতিভাবান লেখকেরা বয়ে নিয়ে গেলেন অভাবিত ও অভূতপূর্ব স্তরে, তাঁদের লেখায়, লেখার জন্য অবলম্বন করা শব্দের পর শব্দের প্রবাহ তৈরি করল এমন এক বোধ, সৈয়দ হক যাকে বলেছেন ভাষাবোধ। এ এমন এক সময় যখন সাহিত্য ও শিল্পের আধুনিক মনন, নব-নিরীক্ষা, পাশ্চাত্যের হালফিল নন্দনতত্ত্বে অবগাহন সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যায় স্বাদেশিক বোধ। লেখকেরা উপলব্ধি করেন, যা-কিছু তাঁরা লেখেন না কেন, লিখতে হয় বাংলাভাষায় এবং সেই ভাষারূপের সঙ্গে দেশের মানুষ, তাদের মুখের ভাষা, ভাষার হাজার বছরের পরম্পরা এবং সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকারের রাষ্ট্রীয় প্রয়াস, ভাষার জন্য লড়াই সব এমনভাবে মিশে যায় যে, লেখক তা থেকে মুক্ত হতে পারেন না। মুক্ত হয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ভাষার কারবারি হওয়া পূর্ববাংলার লেখকদের, বিশেষভাবে সৃষ্টিশীল লেখকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে ভাষা তাঁদের মধ্যে সঞ্চার করে ভাষাবোধ, ভাষাবোধ তাঁদের যুক্ত করে স্বদেশের সঙ্গে, যে-কথা বারবার মেলে ধরেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এই ভাষাবোধ যেন আমরা না-হারিয়ে ফেলি, এ-কথা তিনি তরুণদের উদ্দেশে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করতে চেয়েছেন।
আধুনিক লেখকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের মতো মাইকেল-অনুরক্ত আর কেউ ছিলেন না। এই অনুরাগের কারণ সনেটে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা কাব্যনাটক রচনায় স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষতা কেবল নয়, যদিও সাহিত্যের এই দুই ফর্ম তাঁকে অনেকটা মাইকেল-সংলগ্ন করে তোলে, তবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মধ্যে তিনি খুব বড়ভাবে দেখতে পেয়েছিলেন ভাষায় ফেরা, যা তাঁর কাছে মনে হয়েছিল স্বদেশে ফেরার সমার্থক। বন্ধনীর মধ্যে মাইকেল যখন লেখেন (অবোধ আমি), ‘হে বঙ্গ, ভা-ারে তব বিবিধ রতন; – / তা সবে, (অবোধ আমি!), অবহেলা করি’, সেটা সৈয়দ শামসুল হকের কাছে অনেক বড় তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়। তিনি লিখেছেন :
কিসে তিনি অবোধ? এখানেও মাইকেলের আলোয় পাই একটি চেতনা, একটি বোধের চেতনা – ভাষাবোধ। ভাষার কোনো সৃজনশীলের পক্ষেই জরুরি এই ভাষাবোধ। এই বোধ আসলে সকল মানুষের জন্যেই – ইতিহাস ও দেশ সম্পর্কে বোধটিই হচ্ছে ভাষার প্রকৃত বোধ।
তাৎপর্যপূর্ণ আর যেটা তিনি বলেছেন তা হচ্ছে, এই ভাষাবোধ নিয়ে তিনি খুঁজে ফিরেছেন মানবছন্দ এবং তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মে মানবছন্দের প্রকাশ তিনি ঘটাতে চেয়েছেন। নান্দনিক প্রত্যয় হিসেবে মানবছন্দের উল্লেখ সৈয়দ শামসুল হকের জীবনবোধ ও জীবনদর্শনের এমন এক গভীরতা প্রকাশ করে, যা বুঝতে সচেষ্ট হলে আমরা খুঁজে পাব তাঁর সাহিত্য-উপলব্ধির সূত্র বা চাবিকাঠি। মানবছন্দ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন –
এতক্ষণে আমি কথাটি বলতে পারি – মানবের স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ, দুঃখ-আনন্দ, জয়-পরাজয়, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম-অপ্রেম, শ্রেয়োবোধ-গহ্বরপতন, এ সবই একটি মৌলিক স্পন্দনে ধৃত, কৃত, সম্ভাবিত। এই স্পন্দনের ছন্দই আমার আজীবন অন্বিষ্ট। এই ছন্দটিকেই রূপ দেবার জন্যে কখনো আমার কবিতা, কখনো কাব্যনাট্য, কখনো উপন্যাস বা চিত্র। এই স্পন্দনটিকেই আমি বলছি – মানব-ছন্দ।
এখন জানি, আমার সকল সৃষ্টির ভেতর দিয়ে আমি একটি কাজই করতে চাইছি – মানবছন্দ রচনা। যদি আমার রচনার কোনো মূল্য থাকে, তবে তা আছে ওই মানবছন্দ যতটুকু ধরা পড়েছে তার ভেতরেই। বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানুষকে এই তুলাদ-েই বিচার করতে হবে আমার সকল কাজকে।
চিকিৎসাশাস্ত্রে সৈয়দ হকের পিতার পাঠগ্রহণের খাতায় লেখা ছিল, চিকিৎসক হতে হলে প্রয়োজন সিংহের মতো হৃদয়, ঈগলের মতো চোখ আর নারীর মতো আঙুল। জীবনের দীর্ঘ পথ পার হয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে সৈয়দ হকের মনে হয়েছিল পিতার ‘ইচ্ছাকে অমান্য করে হয়েছি লেখক, অকস্মাৎ আবিষ্কার করেছি এক আশ্চর্য সন্নিপাত। – লেখক হওয়ার জন্যেও তো চাই সিংহের হৃদয়, ঈগলের চোখ, আর নারীর আঙুল। লেখকের হাত হবে জননীর মতো মমতার, দৃষ্টি ঈগলের মতো দূরপ্রসারী, আর সত্য উচ্চারণে সিংহের মতো অকুতোভয়।’

দুই
বাহান্ন থেকে যাত্রা শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন থেকে যে বিপুল সাহিত্যভা-ার তৈরি করেছেন সৈয়দ শামসুল হক তা নানামুখী পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ দাবি করে, নানা দিক থেকে চলতে পারে এর ওপর আলোকসম্পাত। এ-আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সৈয়দ শামসুল হকের জীবনচরিত অনুধাবনে যেমন আমাদের ঘাটতি রয়েছে অনেক, তেমনি তাঁর সাহিত্যকীর্তির বহু স্তর ও বহু মাত্রা উপলব্ধির চেষ্টাও আমরা বিশেষ নিইনি। আমরা বড় বেশি খ- অনুরক্ত, সাহিত্যসাধকদেরও আমরা ভাগ করে নিই বিবিধ
খ–পরিচয়ে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গদ্যপ্রবন্ধ, নাটক, শিশু-কিশোর সাহিত্য, ছড়া, থ্রিলার ইত্যাদি কত-না শাখা-প্রশাখা আমরা শনাক্ত করি এবং সেই মতো তকমা সেঁটে দিই সাহিত্যসাধকের ললাটে, সেইভাবে চিনতে চাই খ-চারীকে। কিন্তু কেউ যখন এক খ- থেকে প্রসারিত হন আরেক ভূখ-ে তখন আমরা হতচকিত হই, ধন্ধও জাগে মনে। এমনি হতবিহ্বলতা ও সংশয় সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে
জেগে-ওঠা খুব স্বাভাবিক। সেই যৌবনে তিনি যখন বাগ্দেবীর আরাধনায় নিমজ্জিত হলেন তখন কবিকুলের মধ্যেই ছিল তাঁর অবস্থান, যদিও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল গল্পেরই সংকলন। প্রকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল সুযোগের, কিন্তু অপ্রকাশের ভার তো সুযোগের অপেক্ষা রাখে না, খাতার পাতা তিনি ভরিয়ে তোলেন বিচিত্র সৃষ্টি-সম্ভারে, মূলত কবিতায়, তবে সেইসঙ্গে গল্প-উপন্যাসও, যেমন এক উপন্যাস রুচিরার বোন স্বপ্না, লক্ষ্মীবাজারের কোনো বাড়িতে বসবাসরতা পঞ্চকন্যাকে ঘিরে রচিত, কিংবা কে জানে কোন অদৃশ্য সুতোর টানে বালক আরো লেখে নিশি হলো ভোর, গোয়ালন্দের স্টিমারে বাল্যবন্ধু পরিমলদের দেশত্যাগ নিয়ে।
তবে সেসব তো একেবারেই লেখালেখি নিয়ে মকশোর কাজ, বুঝিয়ে দেয় বালক চেয়েছিল লেখকই হতে, আর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথও তাঁর হয়েছে বিচিত্রগামী, সাহিত্যের সকল খ-েই তিনি রেখেছেন কৃতির স্বাক্ষর, তাঁকে খ-পরিচয়ে চিহ্নিত করা ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে তিনি কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিকও বটে, সেইসঙ্গে তাঁকে আমরা পেতে
থাকি নাট্যকার, প্রবন্ধকার, সাহিত্য-বিশ্লেষক, ভাষাবিদ, শিশু-কিশোর সাহিত্যিক, অনুবাদক, ছড়াকার ইত্যাদি রূপে। তাঁকে চিহ্নিতকরণের সমস্যার সুরাহাও মেলে তাঁর কাছ থেকে, যখন নিজেকে তিনি অভিহিত করেন সব্যসাচী লেখকরূপে। এমন লেখকের মূল্যায়নে তো সব্যসাচী সমালোচক বা বোদ্ধাও প্রয়োজন, সেটা পাওয়া আরো বড় সৌভাগ্যের বিষয়, যেমন প্রত্যাশা প্রায় যেন দুরাশা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের বিচার-বিবেচনা তো স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায়, সেটাও যে খুব মিলেছে তা নয়, ফলে সৈয়দ শামসুল হক নন্দিত হয়েছেন যতটা, আলোচিত হয়েছেন সে-তুলনায় বেশ কম। তবে আলোচিত হওয়ার অপেক্ষায় কিংবা না-হওয়ার বেদনায় কলম গুটিয়ে বসে থাকেননি সৈয়দ শামসুল হক, জীবনভর করে গেছেন সৃজনসাধনা, এমনকি যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, দেহ রোগজর্জর, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শরীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট, তখনো আকুতি বহন করছেন লেখালেখির, মুখে মুখে বয়ন করে গেছেন কবিতা, তৈরি করেছেন গল্প, আর হাহাকার করে ফিরেছেন দেশভাগ নিয়ে জীবনভর বাহিত বেদনা ও উপলব্ধির উপন্যাস সমাপনের, যে-দেশভাগ তাঁর লেখায় ছায়াপাত ঘটিয়েছিল একেবারে বাল্যে।
সব্যসাচীর সৃজন-দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার কাজ দুরূহ, সে-কথা আগেই বলা হয়েছে, আমরা এখানে কতক উদাহরণের সুবাদে নিতে পারি সেই পরিচয়। আমার খুব প্রিয় এক গ্রন্থ সৈয়দ শামসুল হকের কথা সামান্যই। শব্দ ও ভাষা নিয়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লোকপ্রিয় এই কলাম তিনি লিখেছেন সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস জুড়ে। রচনার কালদৈর্ঘ্য এজন্য উল্লিখিত হলো যে, জীবনের নানা ব্যস্ততা ও লেখালেখির নানা দাবি মেটানোর মধ্যেও এমন এক জটিল ও গবেষণার উপলব্ধিবহ রচনা তিনি একাদিক্রমে লিখে যেতে পেরেছেন পরম দক্ষতায়। ভাষা বিষয়ে কত যতœবান, অনুশীলননিষ্ঠ ও তত্ত্ব-তল্লাশি হলে এমনটা সম্ভব সেটা বোঝাও কষ্টকর। তো এই কথা সামান্যই থেকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বিশেষ এক ভুক্তি ‘সুপারি’, একেবারে সাধারণ এক ফল, যা লোকসাধারণের রসনা-রঞ্জরি হিসেবে সমাদৃত, তবে মানবিচারে নিম্নবর্গীয়। সুপারি শব্দ নিয়ে কত বিচিত্র কথারই-না অবতারণা করেছেন সৈয়দ হক, প্রসঙ্গ থেকে চলে গেছেন প্রসঙ্গান্তরে, আবার ফিরে এসেছেন মূল বিষয়ে। পাকিস্তানি জমানার শুরুতে যারা জবরদস্তিভাবে বাংলাভাষা সংস্কারের প্রয়াস নিয়েছিল, ‘আমাদের বাংলার জামা খুলে নিয়ে পিন্হাতে খায়েশ করলেন রোজানা বাতচিতের লেবাস’, তাদের জন্য ‘অগত্যা’ পত্রিকা দাওয়াই বাতলেছিল মাথায় সুপারি রেখে কাঠের খড়ম ঠুকে দেওয়ার। সুপারির এমন ব্যবহারের সূত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরিচয় দাখিল করলেন সৈয়দ হক, তারপর লিখলেন, ‘আমি সুপারির দেশের লোক, সুপারিকে আমরা বলতাম গুয়া। এখনো বলা হয়।’ এরপর তিনি চলে গেছেন বাংলা ভাষায় সুপারি শব্দের উৎসে, লিখেছেন কবিকঙ্কণে পাওয়া যাচ্ছে – ‘বহড়ার বদলে গুয়া, এ-থেকেই অনুমান হয় দেশি বহড়ার বিনিময়ে বিদেশের গুয়া সংগ্রহ করেছে বাঙালি। সুপারি যে বিদেশের, তার আরো জোরালো প্রমাণ লুকিয়ে আছে নামটির মধ্যেই। আরবদের জাহাজে সিংহল থেকে সমুদ্র-সফর করে সুপারি আসতো বাংলাদেশে, ওই সফর থেকে সফ্রি, সফ্রি থেকে আমাদের গালের মধ্যে সুপারি।’ সুপারির প্রাচীন দুই নাম তিনি উল্লেখ করেছেন, পূগ ও গুবাক। কাশীরাম দাসের মহাভারতের সেই উল্লেখ তিনি বিবৃত করেন রসালোভাবে। সেইসঙ্গে কৃত্তিবাসের রামায়ণের উদাহরণ হাজির করেন, ‘বসিতে আনিঞা দিল গুবাকের পাটি।’ তারপর আজকের গ্রাম-বিচ্ছিন্ন শহুরে পাঠকদের চিনিয়ে দিলেন সেই পাটি, লেখেন, ‘সুপারি ফলের কলি যখন ধরে, সেই কলি জড়িয়ে থাকে খেলনা নৌকার মতো হাতখানেক লম্বা একটি খোলা। আমাদের ওদেশে একে বলে ডোঙা, এদিকের মুখে শুনি খোসা, এই খোসা বা খোলা বা ডোঙাটি শুকিয়ে, তার গা থেকে আঁশ বের করে নরোম পাটি তৈরি করা যায়। একজনের বসার জন্য খুবই সম্মানের এ-আসন, এখনো আমাদের ওদেশে এর বুনোনও আছে, আদরও আছে।’
তার পরে তিনি গেছেন হালের উদাহরণে, চট্টগ্রামে শামসুন নাহার-হবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবনে বসে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় – বাতায়নপাশে গুবাক তরুর সারি। ভিন্নতর দৃষ্টি নিয়ে সৈয়দ হক লিখেছেন, ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক কবিতায় শব্দ ব্যবহারে নজরুলের সাহস, চমক, আবিষ্কার আর লাগসইতা দেখেছি বিস্ময় নিয়ে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত কবিতায় শব্দ প্রয়োগের এ-বিস্ময় একেবারেই নেই। এসব কবিতায় তিনি জানালার চাইতে বাতায়ন পথেই নিজেকে দেখেছেন।’ আমাদেরও বিস্ময় মানতে হয় সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যদৃষ্টি ও শিল্পবিচারের গভীরতার পরিচয় পেয়ে, নজরুল-বিচারে যা যোগ করতে পারে অন্যতর মাত্রা।
এরপর তিনি অবতারণা করেন হাস্যরসের, সাংবাদিকতা জগতের একনিষ্ঠ ও স্নেহপ্রবণ-অগ্রজ কাজী মোহাম্মদ ইদরিস রংপুরেরই সন্তান, তিনি পান-গুয়ার ভক্ত এবং সর্বদা থাকেন তাম্বুল রসে সিক্ত। তিনি সুপারিকে বলতেন সুপুরি। লেখকের পর্যবেক্ষণ,
মনেই হতে পারে কলকাতায় বহুদিন ছিলেন, সাংবাদিকতায় তাঁর হাতেখড়িই হয়েছিল কলকাতায়, সেই সূত্রে দাদাদের কাছ থেকে তিনি বোধহয় কলকাত্তাইয়া উচ্চারণটি পেয়েছিলেন – সুপুরি। আমার কিন্তু ধারণা ভিন্ন। তিনি পান-গুয়া খেতেন বলেই সুপারি খুব প্রয়োজনীয়ভাবেই তাঁর উচ্চারণে সুপুরি হয়ে যায়। পান-গুয়া চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ যখন বেশ রসস্থ, তখন সুপারি বলুন। দেখবেন, সুপারি বলতেই ঠোঁট ফাঁক হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। রস বেরিয়ে মুখ মাখামাখি হওয়ার জোগাড়। কিন্তু বলুন সুপুরি – ঠোঁট গুটিয়েই রইছে, রস একটুও পড়বার জো নেই – পান-গুয়ার রসালো মজাটিও মাটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এমনিভাবে তথ্য, তত্ত্ব, জিজ্ঞাসা ও বিচার-বিশ্লেষণের তরণি বাইতে বাইতে তিনি পৌঁছে যান উপসংহারে, অনতিদীর্ঘ রচনার ইতি-টানেন পরিবারের মায়েদের বৃত্তান্তে, শর্তা দিয়ে কাটা সুপারি থেকে তৈরি নকশার সৌন্দর্য উপভোগে এবং লেখেন, দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি, তবু এর শরণ নিতে হয়, সৈয়দ শামসুল হকের মায়ের প্রতি ভালোবাসা, জীবনের প্রতি অনুরাগ এবং জীবন-অবলোকন শক্তি বোঝার জন্য। তিনি লেখেন :
বাড়ির পেছনে একটা সুপারির গাছ লাগিয়েছিলাম সেই কবে। আমার মা কুড়িগ্রামের গিন্নি। সেই কোন কালে বিধবা হওয়ার পর তিনি পান-গুয়া ধরেছেন। ছেলের বাড়ির জমির সুপারি খাওয়াবো তাঁকে, গাছটা তাই লাগানো। গাছে সুপারি এলে জানালা দিয়ে তিনি দেখতেন। আমারও চোখে পড়ত – এই সবুজ পান্নার মতো সুপারি ধরেছে, এই সোনার ডিমের মতো রং ধরে উঠেছে, এই আকিক পাথরের মতো বাদামি হয়ে আসছে। এবার পেড়ে ফেলতে হয়। মা নিজের হাতে সুপারি বাছাই করতেন, রোদে দিতেন, শর্তা দিয়ে দুফালি করতেন। এখনো আমি মাঝখানে কাটা সুপারির বুকে নকশার তুল্য নকশা দেখি না আর কোনো ফলে। ছোট্ট, মাথা চ্যাপটা, বৃত্তের আধখানা, মাঝখানে সাদা শাঁস, দু’দিকে পাতার চিকন শিরের মতো সাদা আর খয়েরি রঙের শাঁস। একেবারে আংটিতে বাঁধিয়ে রাখার মতো। মা চলে গেলেন হঠাৎ করেই শীতের এক ভোরবেলা। তারপর থেকেই দেখি এক অবাক কা-। গাছটা ধাঁ-ধাঁ করে বেড়েই চলেছে। দোতলারও ছাদ ছাপিয়ে আজও সে বাড়ছেই। যেন তার সুপারিকে সে আকাশে আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেই এই তার পণ। সুপারি পেড়ে এখন আমি বুয়াদের বিলিয়ে দিই। আমার মাও তো সারাজীবন বুয়ার মতোই খেটে গেছেন সংসারে। যদি বেহেশ্ত থাকে, যদি তিনি বেহেশ্ত পানই, আমার বিশ্বাস সেখানেও তাঁকে বুয়ার জীবনই দেয়া হবে। বেহেশ্ত তো পুরুষের চোখেই ভাসে।
এমন যে-রচনা সেখানে আরো দেখি সুপ্ত রয়েছে দূর কুড়িগ্রাম ও শহর ঢাকার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমাহারের পরিচয়, বিশ শতকের বাংলায় গ্রাম ও শহরের মধ্যেকার সম্পর্কের অন্যতর মাত্রা। নগরায়ণ ক্রমশ পালটে দিচ্ছে জীবন, গ্রাম থেকে মানুষ উঠে আসছে শহরে, কুড়িগ্রাম গ্রাম নয় বটে, তবে মফস্বলের ছোট শহর, গ্রাম-সংলগ্ন তো বটেই, ঢাকা তার কাছে অনেক দূরবর্তী নগরী। কুড়িগ্রাম থেকে ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক এসেছিল শহরে শিক্ষার উন্নত সুযোগ গ্রহণের জন্য, লক্ষ্মীবাজারে অবস্থান করে পড়ছিল কলেজিয়েট স্কুলে। তারপরে কবিতা কীভাবে তাঁর জীবন আপ্লুত করে তুলল, শহর কীভাবে হলো জীবনবিকাশের অবলম্বন, সেসবের কত-না বৃত্তান্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখায়, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালায় রয়েছে এর উজ্জ্বল প্রতিফলন। গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে তাঁর যাত্রা, নগরকে আলিঙ্গন করবার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জীবনে অধিষ্ঠান, এখানে সৈয়দ হকের সঙ্গে আরো অনেক লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকের মিল আমরা খুঁজে পাব, কিন্তু পরিণত বয়সে, সাহিত্যের রাজমুকুট মাথায় ধারণ করে তিনি আবার ফিরলেন কুড়িগ্রামে, সাহিত্যিক সেই প্রত্যাবর্তন তাঁর জীবনে কতভাবেই না পল্লবিত হয়ে উঠল, কত-রকম ইশারা ও চিহ্নই না রেখে গেল। কসমোপলিটান এই মানুষটি তো নগরকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠেছেন, সৃষ্টিশীলতার বহুমুখী প্রকাশে সক্রিয় থেকেছেন। নিজেকে তিনি সজ্জিত করতে চেয়েছেন নাগরিক রূপে, তাঁর সেই চেষ্টার এক বাহারি অবয়বও ছিল; কিন্তু অন্তরের গভীরতম প্রদেশে কুড়িগ্রাম কখনো তাঁকে ছেড়ে যায়নি, নগর-বন্দনার অমন তাৎপর্যময় দীর্ঘ কবিতাতেও তাই হঠাৎ ঝলসে ওঠে কুড়িগ্রাম, কালো কফি, নিয়নের আলো, ডাবলিন ঢাকার একাকার হয়ে যাওয়া, নিসর্গের টেকনিকালার, সব ছাপিয়ে পাই সেই বালককে, গ্রাম থেকে একদা যে যাত্রা করেছিল শহরের দিকে, বিশ শতকের
সমাজ-অভিজ্ঞতার যা অন্যতম প্রধান প্রবণতা, তিনি লেখেন, ‘তুমি নীল সুটকেশে বয়ে এনেছিলে/ কুড়িগ্রাম থেকে তার ক্রুদ্ধ ধরলার/ একটি কল্লোল আর আকন্দের পাতা/ আর শ্যামলের ছবি।’
নীল স্যুটকেসে বয়ে আনা সামগ্রী থেকে লেখকের মুক্তি আর ঘটে না, যদিও তিনি চলে গিয়েছিলেন বহুদূর। ১৯৬৯ সালের
গণ-অভ্যুত্থানের স্বল্পকাল পর ভূতগ্রস্থের মতো লেখা এই কবিতায় বাংলা ও বাংলাদেশ জেগে ওঠে বারবার, যদিও পৃথক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তখনো মানুষের অন্তরে পাখা মেলেনি, কিন্তু কবির অনুভবে তা যেন বাস্তব হয়ে ওঠার আকুতি প্রকাশ করে। তারপর সৈয়দ শামসুল হকের যাত্রা ঢাকা থেকে লন্ডনে, দীর্ঘ প্রবাস জীবন সাঙ্গ করে অন্যতর আরেক মানুষ ফিরে আসেন ঢাকায়, স্থিত হন মেট্রোপলিটান নগরীতে; কিন্তু কুড়িগ্রামের ডাক, দুরন্ত ধরলার অভিঘাত থেকে মুক্ত হতে পারেন না, অজান্তেই বুঝি নাগরিক আইডেনটিটি ক্রমে তাঁর কাছে গৌণ হতে থাকে, নানাভাবে ঘটে এর প্রকাশ, বড়ভাবে আমরা দেখি জলেশ্বরীর গল্প-উপন্যাস-কথকতায়। এমনকি অমন যে তত্ত্ব-তালাশি রচনা কথা সামান্যই, সুপারি নিয়ে আলোচনাতেও বারবার তিনি বলেন, ‘আমাদের ওদেশে’ এবং ‘এদিকে’, ‘এদেশে’, পদ্মা নদী পেরিয়ে যে-ঢাকায় তিনি এসেছেন, নিজে যেমন বরণ করেছেন নগরকে, তেমনি নগরও তাঁকে আলিঙ্গন করেছে সাদরে, তারপরেও কোথাও যেন রয়ে যায় বিচ্ছিন্নতা, বিযুক্তি, এ-দেশ এবং আমাদের ও-দেশ।
মনে হতে পারে, এভাবে খ–বিখ- হয়ে পড়ে মানুষ, দেশের ভেতরে জেগে থাকে আরেক দেশ, অবহেলিত, দূরবর্তী, পরিত্যক্ত; দ্বিখ-িত সত্তা নিয়ে চলেন কবি। তবে খ-কে বরণ করে অখ-ের সাধনার মধ্যেই বুঝি মেলে জীবনের সমীকরণ, কিংবা বলা যায় সমীকরণ হয়তো কখনো মিলবে না, কিন্তু মিলনের সেই সাধনা করে যেতে হবে জীবনভর। আর তাই বিযুক্তির বেদনায় ছিন্নভিন্ন সত্তা নিয়ে হলেও টগবগে তরুণ কবি লিখতে পারেন বৈশাখের অমোঘ পঙ্ক্তিমালা, উচ্চারণ করেন, ‘পিঙ্গল জটায়/ স্রোতের প্রপাত নিয়ে হেঁটে যাবো আমি,/ স্মৃতির সাগরে। জন্মে জন্মে বারবার/ কবি হয়ে ফিরে আসব আমি বাংলায়।’
ফিরে তিনি এসেছেন বাংলায়, মেট্রোপলিস থেকে ফিরলেন বিশটি গ্রামসমষ্টি নিয়ে গড়ে-ওঠা শহর কুড়িগ্রামে, বাংলারই নিবিড় আশ্রয়ে। নগরীকে তিনি জানালেন বিদায়, শেষশয্যা পাতলেন কুড়িগ্রামে, জীবনচক্র কী অসাধারণভাবেই-না সমাপন করলেন তিনি, রয়ে গেলেন বাংলার মাটি, জল, হাওয়া ও চোখের পাতার সঙ্গে মিশে, পেছনে পড়ে রইল গোটা পৃথিবী, কবিতার মানবভুবন, যা ছিল তাঁর মানসভুবন। 