সৈয়দ হকের বন্ধুপ্রশস্তি

ইসমাইল সাদী

সাম্প্রদায়িক  রাজনীতির  ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যগোষ্ঠীও দুই ভাগে বিভাজিত হয়। এর এক ভাগ কলকাতাকে কেন্দ্র করে টিকে থাকে, অন্য ভাগ ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে। তাই অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যস্রষ্টারা  অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক মহানগর থেকে আরেক মহানগরে স্থানামত্মরিত হন। শুধু শরীরী স্থানামত্মর নয়, এই স্থানামত্মর ছিল চেতনাগত রূপামত্মরও। তাই ভাষাগত সাদৃশ্য বিদ্যমান সত্ত্বেও দুই মহানগরের সাহিত্যস্রষ্টাদের ভাষিক তারতম্য, চেতনাগত পার্থক্য, শব্দপ্রয়োগের ভিন্নতা প্রভৃতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন মহানগরকেন্দ্রিকতার সুবাদে, বিশেষকরে পূর্ববাংলার কবিরা নতুন কমিটমেন্ট নিয়ে স্বকীয় ভাবনাপ্রকাশে উজ্জীবিত হন। চলিস্নশের দশকের উপামত্ম ছুঁয়ে এই প্রাণপ্রবাহ পঞ্চাশের শুরম্নতে নতুনমাত্রায় বেগবান হয়। ভাষা-আন্দোলন সেই গতিবেগে সঞ্চার করে নবতর আবেগ ও চেতনা। শুরম্ন হয় এক নতুন অভিযাত্রা। বাংলা কবিতার সেই অভিযাত্রার নাম ‘বাংলাদেশের কবিতা’। কয়েকজন তরম্নণের নেতৃত্বে সূত্রপাত হওয়া সেই অভিযাত্রিক দলের একজন সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম ১৯৩৫)।

বর্তমান বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কবি-কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক সেই অভিযাত্রিক কুশীলবদের, বিশেষ করে সেই প্রজন্মের পরিম-লকে ভুলতে পারেননি, কখনো ভুলতে পারেন না। তাই চেতনার সংগ্রাম আর সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার তাড়নায় যূথবদ্ধ হওয়া সেসব স্রষ্টা-কবি-বন্ধু-সহযাত্রীকে নানামাত্রিক পঙ্ক্তিমালায় গাঁথতে চেয়েছেন তিনি। কবিতার পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে সুবিন্যসত্ম করতে চেয়েছেন তাঁদের প্রাতিস্বিক ভূমিকা। এর মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশের কবিতা অথবা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানকে চিরকালীন করে তোলার অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন সৈয়দ হক। সগোত্রবোধের মমতায় তাঁদের প্রতি কবির ভালোবাসা আর আবেগের পাশাপাশি চেতনাগত মেলবন্ধনের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কবির এই ঐক্যের প্রয়াস ‘শামসুর রাহমান, আপনার পঞ্চাশতম জন্মদিনে’, ‘নৌকোর চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী’, ‘মধুসূদনরূপে অমলেন্দু বিশ্বাসকে দেখে’, ‘ফয়েজ আহমদ বন্দী হবার পর’, ‘হাসান হাফিজুর রহমানের জন্যে’, ‘কমরেড ফরহাদ/ একটি শোকগাথা’, ‘টিএসসি সড়কদ্বীপে শয়ান আলমগীর কবিরকে’ প্রভৃতি কবিতার অবয়ব গঠনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। অবশ্য যাঁদের নিয়ে কবি সৈয়দ শামসুল হকের এই সৃজনপ্রয়াস, তাঁদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরীসহ সবাই লোকামত্মরিত হয়েছেন। বন্ধু-সহযাত্রী অগ্রজতুল্য কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) সম্পর্কে সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের মমত্মব্য : ‘শামসুর রাহমান আমাদের একমাত্র সম্পূর্ণ কবি। তিনি পৃথিবীর সেই বিরল কবিদেরই একজন, যিনি একটি জনগোষ্ঠীর রম্নচি গ’ড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, প্রত্যক্ষভাবে নিজে লিখে।’ এই ‘বিরলপ্রজ’ কবিকে নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের গর্ব ও শ্রদ্ধার শেষ নেই। সুদূর কুড়িগ্রাম থেকে মহানগর ঢাকায় আসা (১৯৪৮) বালক-কবি সৈয়দ শামসুল হক আর ঢাকার মাহুতটুলীতে জন্ম নেওয়া শামসুর রাহমানের কবিতায় হাতেখড়ি হয়েছিল প্রায় একসঙ্গেই, হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩)-সম্পাদিত একুশে ফেব্রম্নয়ারি সংকলনের মধ্য দিয়ে। এরপর সংগ্রামে-সান্নিধ্যে কেটেছে দীর্ঘ সময়। জাতির সংকটকালে তাঁরা সাধারণ মানুষের কাতারে নেমেছেন বিভিন্ন সময়ে। এমনই এক সময়ে শামসুর রাহমান পৌঁছে যান তাঁর জীবনের পঞ্চাশতম বসমেত্ম। একজন কবি বা যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের পঞ্চাশটি বছর অতিক্রম করা সবার কাছেই শুভ বার্তা।

এটা সত্যি, স্বাধীনচেতা বা ব্যক্তিত্বশীল কবির জন্য গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শামসুর রাহমানের পঞ্চাশতম জন্মদিন আমাদের জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনলেও তা স্বয়ং কবির জন্য মোটেও শুভ ছিল না। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ তখন উর্দিধারী শাসকের কবলে, যারা মুক্তচিমত্মার মানুষের জন্য বরাবরই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়; যারা ‘মানবের’ সত্মরে এসে কখনোই দাঁড়াতে পারে না। উপরন্তু স্বাপ্নিক কবি-শিল্পী, যাঁরা সাধারণের কাতারে বসে জাতির স্বপ্ন রচনা করেন কিংবা উন্মোচন করেন উর্দি-পরিহিতদের মুখোশ, তাঁদের ওপর খড়্গ নেমে আসে লেখনী চালানোর অপরাধে। তাই সৈয়দ শামসুল হক সুদূর প্যারিসে বসেও উপলব্ধি করেন নিখুঁতভাবে, ‘বাংলাদেশে আজ এবং এখনো একজন কবির চেয়ে বিপন্ন কে আর?’ এর পরও তিনি শামসুর রাহমানের উদ্দেশে বলেন :

তবু, আমি আজ প্যারিসের এই নক্ষত্রপ্রতিম মোড়ে,

বিজয় তোরণের সমাহিত অলিন্দে, সার সার প্রদীপের পাশ

দিয়ে যেতে যেতে,

প্রার্থনা করছি, বাংলার একজন কবিরই জন্মদিনে –

দীর্ঘ হোক আপনার জীবন, ত্বরান্বিত হোক মানবের স্বপ্নসমূহের

অনুবাদ।

 

শামসুর রাহমান নিজস্ব জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের আবেগকে কবিতায় ধরতে পারেন বলেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে জীবনঘনিষ্ঠ। কেননা, কবিতায় ‘মানবের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ’ করতে পারলেই কেবল তাতে মানুষের কণ্ঠধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কবিতার যাত্রা শুরম্ন হয় সাধারণ মানুষের কাতার থেকেই। কাব্যাভিযাত্রার সেই প্রারম্ভিক কালে ঐক্যবদ্ধভাবে পথচলা-বান্ধবকে সৈয়দ হক বাঁধতে চেয়েছেন সমকালীন প্রেক্ষাপটে, যা চিরকালীন মমত্ববোধে প্রকাশিত। কারণ, ‘সদ্যোজাত শিশুর কাছেও িআঁতুড়ঘরের চেয়ে/ গোরস্তান বরং নিকটে’; কিন্তু শামসুর রাহমানের ‘পায়ের চিহ্ন চলে যায়নি বাংলার মধ্যাহ্নের ধ্যান ছেড়ে’। কবিতাটিতে তাঁর সঙ্গে সৈয়দ হকের নানা স্মৃতি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে তাঁকে মূল্যায়ন করবে সে-বিষয়টিরও প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও ‘বড় কবি’ শামসুর রাহমানের পঞ্চাশতম জন্মদিনে সৈয়দ হক সস্ত্রীক ‘প্যারিসের পুরনো… রাজপ্রাসাদে পিকাসোর প্রদর্শনীতে’। কিন্তু শামসুর রাহমান বন্ধুত্বের চুড়ায় অধিষ্ঠিত; আবেগের দিক থেকে, বোঝাপড়ার নিরিখে, সৈয়দ হকের কাছে অনেক উচ্চাসনের এক কবি তিনি, যিনি সারা জীবন ‘মানবের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ’ ত্বরান্বিত করেছেন। তাই তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম কিংবা তাঁর না থাকার সময়ে কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে, তা নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের ভাবনার যেন অমত্ম নেই। কবিতার পঙ্ক্তিতে তাই তাঁর সংশয়মিশ্রিত জিজ্ঞাসা :

শামসুর রাহমান, আপনার জন্যে কি স্মৃতিসত্মম্ভ স্থাপন করতে

কেউ জীবিত থাকবে অতঃপর এই বাংলাদেশে?

শামসুর রাহমান, এমন দিন কি তাহলে এসেই যাবে, যখন

সভায়

আপনার ওপরে পড়া হবে প্রবন্ধ, কিন্তু কেউ পড়বে না আপনার

কবিতা?

বস্ত্তত এমন দিনই কি আসন্ন, যখন বাংলাদেশে আর কোনো

সভাতেই

শ্রোতারা কিছুতেই শনাক্ত করতে পারবে না তাদের সমবেত

হবার কারণ?

 

শামসুর রাহমান সারা জীবন একজন দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে ‘মানবের স্বপ্নসমূহে’র অনুবাদ করে গেছেন। আর সৈয়দ হক-রাহমানদের আরেক সহচর-বান্ধব, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর শিল্পিত ভাবনা দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনকে, তিনি কাইয়ুম চৌধুরী। বাংলাদেশের সাহিত্য-আন্দোলনের প্রায় সমানবয়সী তাঁর শিল্পচর্চার বয়স। আবহমান গ্রাম-বাংলার নদী-নারী-নিসর্গ-ঐতিহ্যসহ সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের নানা দিক তাঁর শিল্পমাধ্যমের প্রধান উপজীব্য। এ ছাড়াও ‘বাংলাদেশ-যুগের’ কবি-সাহিত্যিকেরা যেমন মাটি ও শেকড়ের গহিনে ডুব দিয়ে স্বকীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে স্বভূমের সাহিত্যকর্ম নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন, তেমনি কাইয়ুম চৌধুরী আধুনিকতা, নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছেন। বলা যায়, এই অঙ্গনে ভেতরে-ভেতরে তিনি একধরনের বিপস্নব ঘটিয়ে দিয়েছেন। সেই কাইয়ুম চৌধুরী যখন নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘জলযান’, ‘নৌকো’ িআঁকেন, তখন তাতে অবশ্যই বিশেষত্ব যোগ হয়। প্রকৃতপক্ষে, শিল্পী ও কবি দুজনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের ভাবনাকে দুটি আলাদা ভাষায় কিংবা মাধ্যমে বিন্যসত্ম করেন। পার্থক্যটা শুধু তুলি আর কলমের নয়, মেধা আর মননেরও। তাই ‘নৌকোর চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী’ কবিতায় কবি আছেন সভ্যতার করাল গ্রাসে ‘বিলীয়মান’ নদী নিয়ে আর শিল্পী আছেন জলযান ‘নৌকো’কে নিয়ে :

আপনার বক্তব্য তো এই ছিল,

‘মানবের অন্যতম প্রধান নির্মাণ-জলযান।’

আর আমি বিপরীতে বলতাম,

বঙ্গদেশে মরে যাচ্ছে আজ সব নদী।’

…                     …                     …

আবার সকাল বেলা

দু’জনেই পরস্পর বিস্ময়ে দেখেছি

দু’জনেই দাঁড়িয়েছি সেই একই বিপুল রাস্তায় –

যার নাম কেউ বলে শিল্প, কেউ বলে দেয়ালে পোস্টার।

 

নদী ছাড়া নৌকার যেমন কোনো গতি নেই, তেমনি নৌকা ছাড়াও নদীর যেন কোনো সার্থকতা নেই। বরং ভেসে থাকা আর ভাসিয়ে রাখার মধ্যে রয়েছে একধরনের মেলবন্ধন; কবিতা আর চিত্রকর্মের মধ্যকার ঐকতানের মতোই তা অবিচ্ছেদ্য। এ দুইয়ের বিচ্ছেদ দুটোকেই যেন নিঃসহায় করে তোলে। কবির ভাষায়, ‘আপনার

ক্যানভাস থেকে,/ নৌকোর গলুই থেকে,/ চিত্র আর চিত্রিতের ব্যবধান থেকে/ একদৃষ্টে চেয়ে আছে পঙ্খহীন এ চোখ;/ আমার কবিতা থেকে, কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের শরীর থেকে/  উচ্চারণ আর নীরবতার ভেতর থেকে/ এখনো তো বয়ে যাচ্ছে মৃত সব নদীর নিঃশ্বাস।’ বিষয় যদি অভিন্ন হয়, তখন প্রকাশমাধ্যম ভিন্ন হলেও দুই শিল্পের ভেতর ঐক্যের কারণে তা একসুরেই প্রতিভাসিত হয়। ঠিক তেমনভাবেই সমাপ্তি ঘটেছে আলোচ্য কবিতার। তাই কবি বলেছেন :

আমি কি বলতে পারি, কাইয়ুম? –

আমি যে নদীর কথা এতকাল বলেছি ভাষায়

আপনার গলুই সে নদীই দেখছে;

সে নদী এখন আর নেই দেশে, আছে

শুধু আছে পাটল পস্নাবন –

এবং কবিই সেই গলুইয়ের চোখ,

এবং কবিই সেই বাংলার মজ্জমান গ্রাম;

তাকেই চেনাতে গিয়ে আপনার এটুকু জীবন,

তাকেই চিনতে গিয়ে জলযান এই বেলা জলে ভাসালাম।

 

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর প্রতিভা বিকাশের কালে যেসব সৃজনশীল মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের কেউ শিল্পী, কেউ কবি, কেউ রাজনীতিক, কেউ-বা অভিনেতা; যাঁদের সবাই জীবদ্দশায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫-৮৭) তেমনই একজন, যিনি বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পকে সমৃদ্ধ করে গেছেন নিজে অভিনয় করে এবং বেশকিছু যাত্রাপালার নির্দেশনা দিয়ে। তাঁর অভিনীত যাত্রাপালার মধ্যে সিরাজউদ্দৌলা, মধুসূদন, লেনিন, জাহাঙ্গীর প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। কবি সৈয়দ শামসুল হক অমলেন্দু বিশ্বাস-অভিনীত মধুসূদন দেখার পর যে-কবিতাটি নির্মাণ করেন, তার নাম ‘মধুসূদনরূপে অমলেন্দু বিশ্বাসকে দেখে’। বাংলার প্রথম বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে নির্মিত ওই যাত্রাপালার মধুসূদন চরিত্রের বিনির্মাণ দেখে অমলেন্দু বিশ্বাসের উদ্দেশে সৈয়দ হক বলেছেন, ‘আমাদের সমুখেই রূপামত্মরিত হয়ে যায়/ আপনার মুখ/ বাঙলার উড়নচ– এক কবির চেহারায়;’। অমলেন্দু বিশ্বাসের যাত্রাভিনয়ের খ্যাতির খবর সমকালে প্রায় সবাই জানতেন। তাঁর অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং প্রধান চরিত্রগুলো জীবমত্ম হয়ে উঠত। তাই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটকালে কবি যেন অমলেন্দু বিশ্বাসের অভিনয়ের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনায় সিক্ত হতে চেয়েছেন। তাই তিনি বলেন :

অমল, আপনি আমাদের নিয়ে যান সেই পালাসমূহে

ব্যাধ যেখানে আবার শিকার করবে বরাহ

এবং কৃষ্ণ যেখানে সমসত্মই স্মরণ করিয়ে দেবে অর্জুনকে

এবং নিরাপদ যেখানে কন্যাদের জন্যে জনপদের পথ,

মধুসূদনের জন্যে বাংলাদেশ,

মুজিবের জন্যে তৃতীয় বিশ্ব

এবং আরো একজন লেনিনের জন্যে একবিংশ শতাব্দীর কাল।

 

ঐতিহাসিক চরিত্র কিংবা কাহিনি অথবা ঘটনা প্রকৃত অভিনয়ের গুণেই সাহিত্যের সত্যে পরিণত হয়। সৈয়দ শামসুল হক ‘মধুসূদনে’র রূপ ধারণ করা অমলেন্দু বিশ্বাসকে মূলত সেই প্রয়াসের নিখুঁত কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সাহিত্যিক-রাজনীতিক মধ্যরাতের অশ্বারোহীর রচয়িতা ফয়েজ আহমদ (১৯২৮-২০১২) স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরশাসকের আমলে গ্রেফতার হলে সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন ‘ফয়েজ আহমদ বন্দি হবার পর’। কবিতা সমাজের প্রাণের কথা বলে, দুঃশাসনের কথাও তুলে ধরে। ফয়েজ আহমদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে কবি বলেছেন, ‘মানুষ অধিকতর মানুষের দিকে দ্রম্নত অগ্রসর বলেই ফাঁসীর/ দড়িটা দু’হাতে ছিঁড়ে ফিরে আসে মানুষেরই মধ্যে ফের/ কবিতার মশাল শরীর।’ সুতরাং ‘হে রাজা’, সাড়ে দশ কোটি মানুষকে ‘সাড়ে দশ কোটি ব্যাঙাচি’ ভাবার কোনো কারণ নেই।

সৈয়দ হক কবিতা লিখেছেন ‘বাংলাদেশের কবিদের কবি’ হাসান হাফিজুর রহমানের প্রয়াণে শোকে বিহবল হয়ে। তাঁর ‘বান্ধব’ হাসান বাংলাদেশের কবিতার অগ্রপথিকদের একজন। মূলত তাঁর নেতৃত্বেই শুরম্ন হয় বাংলাদেশের পঞ্চাশের কবিদের শেকড়মুখী অভিযাত্রা। বলা যায়, পঞ্চাশের কবিদের কবিপ্রতিভার মুক্তি ঘটেছিল এই হাসানের জন্যেই। শুধু কলমসৈনিক নন, ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরম্ন করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সংঘটিত প্রায় সব আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অগ্রসেনানীর ভূমিকায়। এর প্রায় প্রতিটি সংগ্রামে সৈয়দ শামসুল হকও ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমানের সহযোদ্ধা। তাই, জাতির সংকটে-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই কবির মৃত্যু যেন সৈয়দ শামসুল হকের কাছে নিজ প্রজন্মের এক নক্ষত্রেরই পতন, ‘আম্মা তার নাম ধরে একবারও ডাকবে না আর?/ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে চিকচিক করে ওঠে বালি -/ নদীও কি কাঁদে?’ সৈয়দ হক হাসানের মৃত্যুতে তাঁরই বিখ্যাত ‘অমর একুশে’ কবিতার পঙ্ক্তি ‘আম্মা তার নাম ধরে একবারও ডাকবে না আর’ এবং ‘ফেরাউনের ঔদ্ধত্যের শেষ ক’টি দিনে মুখোমুখি আমরা’ উচ্চারণ করে কবিতাটির মহিমা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় হাতেখড়ি হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রম্নয়ারির মধ্য দিয়ে। সেই সংকলনের জন্যই প্রথম কবিতা লেখেন তিনি। হাসান হাফিজুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো কবিতায় সেই স্মৃতিচারণার পাশাপাশি তাঁর জন্য একধরনের আর্তনাদও যেন শোনা যায় সৈয়দ হকের কণ্ঠে :

এ বাংলায় কবিতা থাকবে না? তাই হয়?

পড়বেন সবশেষে শামসুর রাহমান, তার আগে অন্যান্য সকলে;

আমার কেবলি ভয়, বোধ হয়,

পকেটে কবিতা নেই, বারবার হাতড়ে দেখি,

এনেছি তো?

একদিন একুশেরই জন্যে লিখি প্রথম কবিতা

হাসানের সংকলনে।

হাসান? হাসান? আপনি কোথায়? হাফিজুর রহমান?

বিমুখ প্রামত্মর আজো, যান, দেখে যান।

 

যে শহিদ মিনারে ভাষা-আন্দোলনের সংগঠক হাসান হাফিজুর রহমানের প্রাণহীন দেহ শায়িত, সেই শহিদ মিনারই তো তাঁর প্রজন্মের চেতনাচিহ্নবাহী। এই শহিদ মিনারই তো বাঙালির সমসত্ম অধিকার আদায়ের প্রতীক। কেননা, এই শহিদ মিনারই বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। সৈয়দ হকের কণ্ঠে তাই পরম মমতায় উচ্চারিত হয় :

শহীদ মিনারে

অবনত মধ্যসত্মম্ভে

বাংলার জননী শুধু শোকে ভেঙে পড়ে, খুব বেশি দূরে নয় এ

মিনার থেকে

তাঁরই প্রিয় অক্ষরের খেলোয়াড় কবিদের দেখে।

আকাশে বিচ্ছিন্ন মুঠি দেবশিশুদের,

খাকি রঙের শকুন ওড়ে চক্রাকারে

মিনারের মাথার ওপরে।

 

কমরেড ফরহাদ – পঞ্চাশের প্রজন্মের আরেক অগ্রসেনানী। সৈয়দ শামসুল হকের বন্ধুতুল্য স্বজন একজন তিনি। কোনো বন্ধুত্ব কিংবা প্রত্যক্ষ জানাশোনা হয়তো ছিল না তাঁর সঙ্গে। কবি শুধু জানেন, ‘মানুষকে ভালোবাসে যারা, তাদের ভেতরে আছে ফরহাদ নামে একটি নাম।’ কিন্তু তিনি যখন প্রয়াত হন, তখন তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেন ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর সদস্য, দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মোহাম্মদ ফরহাদকে (১৯৩৮-৮৭); যেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষিপের অনুবাদ জানেন কবি। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে, মানুষের ভালো কাজ সম্পর্কে অবগত হতে যে সখ্যই একমাত্র উপায় নয়, তার একটি অনন্য দৃষ্টামত্ম ‘কমরেড ফরহাদ/ একটি শোকগাথা’ কবিতা। কমরেড ফরহাদ আন্দোলন-সংগ্রাম আর ত্যাগের অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছেন সারা জীবন ধরে। সেই মহিমান্বিত প্রাণ ফরহাদকে হারিয়ে কবি যেন জাতীয় একজন নায়ককেই হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ অন্য সবার মতো কবিও অনুধাবন করেছেন বড় সংকটকালেই (১৯৮৭) চলে গেছেন কমরেড ফরহাদের মতো আত্মত্যাগী-সংগ্রামশীল একজন মানুষ। তাঁর প্রয়োজনীয়তা বড় বেশি করে উপলব্ধি করেন সৈয়দ শামসুল হক। বলেন, ‘সূর্যের অসেত্মর আগে আমাদের কণ্ঠে তুলে নিতে হচ্ছে সূর্যাসেত্মর গান,/ সবচেয়ে প্রয়োজন যখন আপনাকে,/ আমাদের বলতে হচ্ছে, বিদায়, বিদায়।’ তাঁর এই বিদায়ে সৃষ্ট শূন্যতায় কবির হৃদয়ে যে-শোকগাথা ভর করেছিল, তারই কিছু শিল্পিত অভিব্যক্তি ঘটেছে আলোচ্য এই কবিতায় :

বিশ্বাস করম্নন, দূর থেকে দেখেছি কেবল আমি, আপনাকে

শুধু দূর থেকে,

রিকশায়, পুরানা পল্টনে, কখনো বা পায়ে হেঁটে,

পানাঢাকা, সবুজ পুকুর ঘেঁষে পথটিতে, একা

যেন কি নিয়ে ভাবিত বড়, অকালে কপালে ভাঁজ আপনার;

…         …         …

শাদা জামা ভালোবাসতেন,

শাদা সে তো সমসত্ম রঙের বাসা, শাদা তো মৃত্যুরও বটে,

সেই শাদা কাফনেই ঢাকা ছিল আপনার শেষ মুখ, এ-জীবনে

আর দেখব না,

আর দেখা হবে না সে মুখ

পল্টনের হলুদ বাড়িতে কিম্বা উত্তর বাংলার প্রামত্মরে,

জনতায়, কিম্বা কোনো মাঝরাতে বইয়ের পাতায় ডোবা সেই মুখ দেখব না আর।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির (১৯৩৮-৮৯) সৈয়দ শামসুল হকের মনন-চেতনা ও শিল্পসাধনার সহ-পথিক। পঞ্চাশের প্রজন্মের অগ্রসৈনিকদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। চলচ্চিত্রকার-কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের সঙ্গে যৌথভাবে স্টপ জেনোসাইড তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন এবং ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন আলমগীর কবির। এ ছাড়া  স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্পমানসম্পন্ন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর বেশির ভাগই দেশাত্মবোধক। হাসান হাফিজুর রহমান, কমরেড ফরহাদ প্রমুখের মতো আলমগীর কবিরের প্রয়াণেও শোকাহত সৈয়দ শামসুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সড়কদ্বীপে নেওয়া হয়েছিল আলমগীরের মৃতদেহ। বন্ধু-স্বজন হারানো কবির ভেতরে সেই সময়ের বেদনা-মিশ্রিত আবহই তাঁকে ‘টিএসসি সড়কদ্বীপে শয়ান আলমগীর কবিরকে’ কবিতা লিখতে তাড়িত করে। শোকে মুহ্যমান কবি তাই তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যাচ্ছো যাও।/ যেতে তো হবেই।/ আমরাও যাবো।’ এরপর কবির উপলব্ধিতে ধ্বনিত হয় জীবনের আরো গূঢ় সত্য, ‘যেতে তো হবেই বন্ধু, সবাইকে যেতে হয়।’ বান্ধবের জন্য কাতরতার পাশাপাশি কবির স্বগতোক্তিও প্রধান হয়ে উঠেছে গোটা কবিতায়। কবি যেন টিএসসির সড়কদ্বীপে শায়িত প্রাণহীন আলমগীর কবিরকে ডেকে কথা বলতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কর্মপ্রবাহের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই কবি বলতে পারেন :

পাশ ফিরে শুনে যাও, বান্ধব আমার,

তোমার নামের প্রতি অক্ষরের আকার এখন

আমাদের স্বপ্নসমূহের

একেকটি স্থির ফ্রেম ফিল্মের রীলে,

এখুনি সে রীল

আমাদের ল্যাবরেটরিতে

ঠিক এইখানে

বাম দিকে

প্রিন্ট হয়ে অবিরাম বেরোচ্ছে, বান্ধব।

 

জগতে যাঁরা কৃতী, তাঁদের কর্মের কারণেই তাঁরা টিকে থাকবেন। তাঁরা দৈহিকভাবে লোকামত্মরিত হলেও আসলে তাঁদের ‘বিদায়’ বলার কিছু নেই। কারণ তাঁরা ভক্ত ও বন্ধুদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনেকদিন। আলমগীর কবির সম্পর্কেও সৈয়দ হকের তেমনই প্রত্যাশা, ‘তোমার সমসত্ম কিছু/ চলমান/ বহমান/ ধাবমান হবে, বিদায় বলব না আমি -/ প্রকৃত বন্ধুর নেই প্রকৃত বিদায়।’

ভাষা-আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ফসল ফলানো পুরোধা ব্যক্তিরা, যাঁরা মূলত পঞ্চাশের প্রজন্ম হিসেবে খ্যাত, মানুষের ‘স্বপ্নসমূহের অনুবাদ’ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক শুধু তাঁর কবিতাতেই নয়, বিভিন্ন গদ্য রচনাতেও পঞ্চাশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের অবদান সম্পর্কে শিল্পিত আবেগ তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে, তাঁর পাঠকনন্দিত লেখা (পরে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত) ‘হৃৎকলমের টানে’তে তিনি বিভিন্নভাবে আত্মপ্রজন্মের কর্মপ্রবাহ এবং দেশমাতৃকার জন্য তাঁদের ভেতরের তাড়না সম্পর্কে লিখেছেন সরস গদ্যে। ভাষামাধ্যমের সফল শিল্পী সৈয়দ শামসুল হক সৃষ্টির আগুনে তাড়িত হয়েও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নন, বরং সুহৃদদের অবদান-চিহ্ন অত্যমত্ম উদারতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন উত্তর প্রজন্মের কাছে; বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নির্বাচনে সিদ্ধহসত্ম কবি সৈয়দ হকের এ আরেকটি দিগমত্ম। সচরাচর দেশপ্রেম, নিসর্গ, নর-নারীর প্রেম, নির্মোহ ভাবনা প্রভৃতি তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে উঠলেও সমাজ-প্রতিবেশ-স্বজনেরাও একধরনের প্রশস্তির সঙ্গে স্থান করে নেয় তাঁর কবিতায়।