সৈয়দ হকের ‘ব্রহ্মপুত্র’

ইসমাইল সাদী
প্রভাষক ব্রহ্মপুত্র,
তুমি আমাকে মনে করিয়ে দাও তোমার জলজ কণ্ঠে
সেই দিনগুলোর কথা
যখন শস্যের উন্নত মাথাগুলো স্পর্শ করে চলে যেত চাঁদ ও রমণীরা,
যখন মানুষ ছিল প্রতিকৃতির চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য

ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় পলল মাটির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। বাংলাদেশের প্রধান কবিদের একজন তিনি। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার দিগন্তে ‘বাংলাদেশের কবিদের’ যে-যাত্রা শুরু হয়, সেখানে ‘শব্দের নতুন ব্যবহার’ করে একেক কবি একেক বিষয় ও পৃথক বুনন-কৌশলে নিজেদের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষ করে, বাংলা কবিতার মহাসড়কে যেসব কারণে ‘বাংলাদেশের কবিতা’ হিসেবে বাংলা কবিতার আরেক দিগন্ত উন্মোচিত হয় এই ভূখ-ের কবিদের হাতে, সেসব ঐতিহ্যিক চিহ্নের প্রায় সবই দৃঢ়ভাবে সন্নিবদ্ধ হয় সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) কবিতায়। আর ‘তেরোশত’ নদীর এই বাংলাদেশ মূলত ব্রহ্মপুত্র নদের মতো প্রবহমান বৃহদায়তনের নদ-নদীসমূহের জন্যেই সারাবিশ্বে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে অভিহিত।
বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য-আশ্রিত নানা শব্দবন্ধ সৈয়দ হকের কবিতাকে সমৃদ্ধ করলেও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ’, ‘মুজিবের নৌকো’, ‘নৌকোর গলুই’, ‘বৈশাখ’, ‘তেরোশত নদী’ প্রভৃতি শব্দ তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ মর্যাদায়। দেশপ্রেম যেমন তাঁর কবিতায় স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল, তেমনি দেশীয় সংস্কৃতি, ভাষা-আন্দোলনের আবেগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশীয় পুরাণ, শেকড়সন্ধানী কিংবদন্তিও তাঁর কবিতায় সবিশেষ স্থান করে নেয়। এ ছাড়া জাতিত্বের অস্তিত্ব-ঘনিষ্ঠ নানাবিধ বিষয়-আশয় তাঁর কবিতায় স্থান পায় কবি-কারিগরের নিখাদ কৌশলে। এতে তাঁর সৃষ্ট কবিতায় সামাজিক দায়বদ্ধ চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনায়াসে স্থান করে নেয় সমাজ ও দেশের সংকটচিত্র এবং জাতির সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপট। তবে প্রেম-বিরহ, মানবিক সংকট, নিসর্গের বহুমুখী প্রয়োগ ও নিরীক্ষাপ্রবণতা সত্ত্বেও দেশপ্রেম ও অস্তিত্বিক ঐতিহ্য তাঁর কাব্য-ক্যানভাসের বড় অংশ জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে।
সমাজজীবনের অন্তঃসারকে আত্মস্থ করেই যেহেতু কবিতার উদ্ভব, বিকাশ, সমৃদ্ধি ও ক্রমযাত্রা, সে-কারণে বিশেষ অবস্থায় ভৌগোলিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মানচিত্রগত বৈচিত্র্যের ফলে কবিতার স্বরূপও ভিন্ন হয়। সেরকম যুগের তাড়নাতেই কবি সৈয়দ হক বারবার ব্রহ্মপুত্রের কাছে ফিরে যান। ব্রহ্মপুত্রের অসীম শক্তিকে তিনি মানুষের পক্ষে স্থাপন করতে চান। কেননা, ব্রহ্মপুত্র বিশাল জনপদের সুখ-দুঃখের নিয়ন্তা – তা কবির কাছে যেমন, তেমনি এদেশের সাধারণ মানুষের কাছেও। আর প্রতীকীভাবে যে ব্রহ্মপুত্র নদকে কবি বারবার কবিতার পঙ্ক্তিতে ব্যবহার করেন, সেই ব্রহ্মপুত্র আসলে স্রেফ বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার বুক চিরে প্রবাহিত বৃহদাকারের পানির আধার নয়। প্রতীক-অলংকারের নিপুণ কুশলী শিল্পী সৈয়দ শামসুল হকের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্রহ্মপুত্র আরো ব্যাপকার্থে, আরো বিশাল পরিসরে ব্যবহৃত হয় তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ মননের গুণে।
এটা ঠিক, ব্রহ্মপুত্র নদ কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রবাহিত করে চলেছে নিজের সঞ্জীবনী ধারা; অপার মহিমায় সজীব রেখেছে সমতল, বাঁচিয়ে রেখেছে নিসর্গপ্রকৃতি। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হকের ব্রহ্মপুত্র শব্দটি তাঁর নির্মাণগুণে হয়ে ওঠে প্রাণিবাচক, জীবন্ত চরিত্রজাতির পথনির্দেশক।
মহৎ ব্রহ্মপুত্র, স্মৃতিধর ব্রহ্মপুত্র,
আমার পিতামহের কৃষি-প্রতিভার আবিষ্কারক ব্রহ্মপুত্র,
অতীত ও ভবিষ্যতব্যাপী বিষয়সমূহের জন্যে
আমি আর কোথায় বা যাবো? – আমার প্রজাতির নিকটতম
আত্মীয়,
কার কাছেই বা যাবো, তুমি ব্রহ্মপুত্র, তোমার কাছে ছাড়া?
‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ কবিতায় ব্রহ্মপুত্র শুধু একটি নদ নয়, বরং তা নানা ব্যক্তিবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত। প্রতিটি বিশেষণেই যেন কবি ব্রহ্মপুত্রকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার পদাধিকারী হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষেই কবি ব্রহ্মপুত্র নদকে ‘ব্রহ্মার পুত্র’ হিসেবে, তাঁর কাক্সিক্ষত ব্যক্তি হিসেবে, সর্বকর্মের কর্মীপুরুষ হিসেবে এমনভাবে বিনির্মাণ করেছেন, যেন তা তাঁর পূর্বপুরুষদেরও জনক হয়ে উঠেছে, যার অস্তিত্ব কবি নিজেও বহন করে চলেছেন। যুগ যুগ ধরে যে-ব্রহ্মপুত্র তার বুক আগলে বাঁচিয়ে রেখেছে অসংখ্য জনবসতিকে, সেই ব্রহ্মপুত্রই কবির প্রকাশকৌশলে হয়ে উঠেছে বাঙালির আশা-ভরসার একমাত্র আশ্রয় – মুক্তির দিকনির্দেশক।
আবার ফিরে এলাম আমি তোমারই সেই সন্নিধানে
যেখানে এখনো তুমি একবার গ্রীবা বাঁকিয়ে
দেখে নিচ্ছ আমাদের জনপদ,
যেখানে এখনো তুমি আকর্ষণ করছ আমাদের সব সড়ক।
এখনো তো তোমার স্রোতে ভাসমান অন্তত একটি নৌকো,
আর তার গলুইয়ে, সে আমার সর্বত্র এবং সব কিছুতে, তোমার চোখ।
… … …
মহর্ষি ব্রহ্মপুত্র, তুমি তো আমাদের প্রধান স্বর্ণকারও বটে,
নিরবধি বানিয়ে চলেছ লক্ষ লক্ষ ফেনিল হাঁসুলি ও বালা;
উল্লেখ্য, নানারকম সংকট থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে কবি সচেতনভাবে মাঝেমধ্যেই আবির্ভাব ঘটান ‘গতিশীল’ ‘ভাসমান’ ‘নৌকো’র। এটাকে একধরনের সংকেতও বলা যায়। তাই হয়তো তাঁর কবিতায় ‘নৌকো’ অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রযুক্ত হয়। আর তা বেশির ভাগ সময়ই ব্যবহৃত হয় বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক-চিহ্ন হিসেবে ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সৈয়দ শামসুল হক জাতীয় জীবনের এমন এক সংকটকালে কবিতাটি রচনা করেছেন, যখন দেশের ভবিষ্যৎ এক স্বৈরশাসকের কাছ থেকে আরেক স্বৈরশাসকের হাতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সচেতন ও সামাজিক দায়বদ্ধ কবি হিসেবে তিনি তেমনই একজন ব্যক্তিকে জনমানুষের প্রয়োজনে কল্পনা করেছেন, যিনি হবেন সর্বগুণে গুণান্বিত এবং যার গ্রহণযোগ্যতা হবে প্রশ্নাতীত। যুগে যুগে দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে নাট্যকার, ঔপন্যাসিকগণ চরিত্রের প্রয়োজনে ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিজেদের সৃষ্টিকর্মে অনুসরণযোগ্য করে বিনির্মাণ করে থাকেন মানুষকে সংকট-উত্তরণে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যে। সৈয়দ শামসুল হকের এই প্রয়াস সে-তুলনাতেও নতুনত্বের দাবিদার। কারণ তিনি বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যে স্বাধীনতা, যা অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে – সেই দৃষ্টান্তকে উচ্চকিত এবং আরো মহান করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এই কবিতার শরীরী ভাষায়। পাশাপাশি, সেই সময় (১৯৮০-৮২) সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের মহিমা যখন নানাভাবে আক্রান্ত, তখন তিনি তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচিহ্নবাহী ব্রহ্মপুত্র নদকে কবিতার অন্তরে সর্বজনীনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন তা আর কবির একার স্মৃতিসাক্ষ্য বহনকারী কেউ নয়, বরং তা আক্রান্ত সব মানুষেরই অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন :
দশ লক্ষ ধর্ষিতার আর্তনাদে যখন নষ্টমান আমার শ্রুতি,
তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে যখন প্লবমান আমার স্মৃতি,
তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে যখন বিলীয়মান আমার
সভ্যতা,
বলীবর্দের দ্বিখ-িত খুরে যখন কম্পমান আমার স্বপ্ন,
যখন এই বর্তমান,এই শ্রুতি, এই স্মৃতি এই সভ্যতা, এই স্বপ্ন
এত দীর্ঘকাল আমি একা আর বহন করতে পারছি না
শুধু এই নিজস্ব বিষয় (১৯৮২) কাব্যের এই কবিতাতেই নয়, ‘ব্রহ্মপুত্র’কে কবি তাঁর নানা কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তবে বেশিরভাগ সময়ই তা নদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ কবিতায় যেভাবে ব্রহ্মপুত্রকে তিনি কবিতার প্রাণবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করে বিচিত্র প্রাণবন্ত চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন, তা সম্ভবত বাংলাদেশের কবিতার দিগন্তে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। কেননা, ব্রহ্মপুত্রকে উদ্দেশ করে তিনি যখন বলেন, ‘আমার পিতামহের
কৃষি-প্রতিভার আবিষ্কারক ব্রহ্মপুত্র’,/ কিংবা ‘মহর্ষি ব্রহ্মপুত্র, তুমি তো আমাদের প্রধান স্বর্ণকারও বটে’, তখন কবি আমাদের নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত করেন। এমনকি বাঙালির কোনো অর্জনই যেন ব্রহ্মপুত্রের সান্নিধ্য ছাড়া সম্ভব হয়নি – তিনি যেন সেই রকম আভাসই দেন এই বলে যে, ‘পেশীবহুল ব্রহ্মপুত্র, আমি আমার পিতামহেরই পৌত্র;/ প্রবল ব্রহ্মপুত্র, আমি আমার পিতামহীরই সুপে বর্ধিত;/ তাই, আমার এই মূর্চ্ছার ভেতরেও,/ তোমার ঐ চোখ স্বপ্ন দেখার এত নিকট বলে মনে হয়।’
ব্রহ্মপুত্রের প্রতি কবির এই পক্ষপাতিত্বের ভেতরে রয়েছে একধরনের নিরীক্ষাপ্রবণতাও। কারণ একটি শব্দকে বারবার বিভিন্ন উপায়ে, নানা রকম বিশেষণে, এমনকি পূর্বপুরুষের বংশধর হিসেবে, কখনো-বা ‘জনক ও চিকিৎসকের’ সঙ্গে তুলনা করে তা প্রাণের প্রতিরূপ হিসেবে উপস্থাপন করাটা বিরল দৃষ্টান্তেরই পরিচায়ক। যেমন : তুমি আমাকে আবার সেই দিনগুলোর কথা বলে দাও,
দয়াবান ব্রহ্মপুত্র,
যখন জনক ও চিকিৎসকের মতো তুমি তোমার ঔষধি জলে
নামিয়ে নিয়েছিলে পিতামহের শরীর থেকে সাপের বিষ –
বাস্তবিক অর্থেই শত শত বছর ধরে ব্রহ্মপুত্র তার সঞ্জীবনী ধারায় সিক্ত করেছে তার অববাহিকায় গড়ে-ওঠা জনগোষ্ঠীকে। সেটা
কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের জমিতে কখনো বন্যার সুবাদে পলি উপহার দিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে অথবা স্থায়ী জলের আধার হিসেবে শস্য কিংবা ফসলের প্রাণদায়ী হিসেবে। কিন্তু যখন তিনি বলেন, ‘সাপেরই তো রাজত্ব এখন; এখনো তো গোখরো, দুধরাজ আর বংক/ আমার অস্তিত্বের আল বেয়ে চলে, বড় শীতল,/ বড় নিঃশব্দে, বড় চিত্রিত ছদ্মবেশে;’ – তখন সমকালীন দেশীয় সংকটই যে কবিতার পঙ্ক্তিতে সন্নিবেশিত হয়েছে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই নিশ্চয়তা আরো বাড়ে, যখন তিনি আরো বেশি প্রতীকায়িত করে বলেন, ‘শীত যখন সরে যাবে, কুয়াশা যখন মরে যাবে,/ পথ যখন আবার প্রকাশিত হবে এবং ঘর ভরে উঠবে শস্যে ও পণ্যে/ তখনি তো আবার ওদের চলাচলের চিহ্ন আমরা দেখতে পাবো/ আমাদের চত্বরে, ক্ষেতে ও সড়কে।’
‘শীত’ ও ‘কুয়াশা’ যে প্রকৃতির স্থবিরতা বা রিক্ততার প্রতীক, তা দিয়ে কবি স্পষ্ট করে চিত্রিত করেছেন দেশ ও সমাজের তৎকালীন অবস্থা। ওই সংকটকালে কবি স্বাভাবিকভাবেই সমৃদ্ধ অতীত-ঐতিহ্যের কাছাকাছি গিয়ে তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও কবি কালের সাক্ষী হিসেবে ব্রহ্মপুত্রকেই অবলম্বন করেছেন। কারণ ‘স্মৃতিধর ব্রহ্মপুত্র’ই কেবল তাঁর নির্ভরযোগ্য ‘ব্যক্তি’, যাকে ‘প্রভাষক ব্রহ্মপুত্র’ সম্বোধনে সোনালি অতীতের ধারক হয়ে ওঠেন কবি। সমকালের সবকিছুতে কবি কৃত্রিম আচরণের যে-আস্ফালন দেখতে পেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে, তার বিপরীতে তিনি ওই ব্রহ্মপুত্রকেই অবলম্বন করেন। কারণ সেই অচল সময়েও প্রেরণালাভের মানসে শেকড়সন্ধানী কবির চোখ ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে তাকিয়ে থাকে সমৃদ্ধ অতীতের অবিচলতার দিকে। তাই কবির দাবি :
প্রভাষক ব্রহ্মপুত্র,
তুমি আমাকে মনে করিয়ে দাও তোমার জলজ কণ্ঠে
সেই দিনগুলোর কথা
যখন শস্যের উন্নত মাথাগুলো স্পর্শ করে চলে যেত চাঁদ ও
রমণীরা,
যখন মানুষ ছিল প্রতিকৃতির চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য
এবং বস্তু ছিল প্রতিফলনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহারযোগ্য,
যখন আমাদের প্রত্যেকেরই ছিল অক্ষত দু’টি করে হাত,
সেই কথা বলো; সেই দিনগুলোর কথা।
শুধু তা-ই নয়, ‘রচয়িতা ব্রহ্মপুত্রে’র কাছেও কবির আবদারের শেষ নেই। ‘ব্রহ্মার পুত্র’-সদৃশ শক্তির আধার হিসেবে কল্পিত ব্রহ্মপুত্র নদ কবির কাছে একজন ‘প্রবর্তক’ও। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার নির্মাতা হিসেবে যে-ব্রহ্মপুত্র চিহ্নিত হয়েছে কবির কাছে, তা মূলত কবির অস্তিত্বচেতনার আড়ম্বরপূর্ণ সৃষ্টি, যা স্বদেশপ্রেমের ঔজ্জ্বল্যেই বিকাশ লাভ করেছে। তাই ‘বন্ধু ব্রহ্মপুত্র’ বলে ‘ভাসমান তোমার নৌকোর গলুইয়ে সেই চোখ’ দিয়ে দেশ ও জাতির সংকটকালে ‘মুমূর্ষু ব্রহ্মপুত্র’কে যখন তিনি আবিষ্কার করেন, তখনো টিকে থাকার জন্য ‘অন্তত একটি নৌকো’ ‘ভাসমান’ থাকে। এর পরও, ব্রহ্মপুত্রের সেই ‘মুমূর্ষু’ অবস্থাতেও, কবি অতীতচারিতার তৃপ্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি। বরং তিনি বলেছেন, ‘এখনি তো সেই দিনগুলোর কথা তুমি আমাকে বলবে,/ এখনি তো তুমি আমাকে আবার আমার বিষয় বুঝিয়ে দেবে -।’ কারণ নাড়ি এবং নীড় দুইয়ের ভেতরে প্রোথিত সৈয়দ শামসুল হকের অস্তিত্বচেতনা সব সময় তাড়িত হয় শেকড়ের টানে।
তবে নিজস্ব বিষয়ের ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ শুধু নয়, সৈয়দ শামসুল হকের সমগ্র কবিতাকর্মে ব্রহ্মপুত্র নদের নাম দেশের নামের মতোই মমতাপ্লুত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র তাঁর কাছে স্রষ্টার সমান ক্ষমতাধর, যে সৃষ্টিশীল এবং আদিকাল থেকে এদেশের উত্থান-পতনের সাক্ষ্য বহন করে বর্তমানে বিলীয়মান হয়ে পড়েছে। আর তাই সৈয়দ শামসুল হক এতে ব্যক্তিচিত্তে বিধৃত তাঁর জীবনচেতনার সামাজিক ঐতিহ্যনির্ভর উপাদান নিয়ে ‘শিল্পসংগত সচেতন অভিব্যক্তি’ ঘটিয়েছেন। কারণ তাঁর শিল্পচেতনা ‘অবশ্যই সমকালের দ্বন্দ্বমুখর ও বিবর্তনচঞ্চল জীবনপ্রবাহ থেকে অর্জিত, এবং কবিতায় তা সমকালের পাঠক-সমাজের উদ্দেশেই নিবেদিত।’ তাই কবিতায় ব্যক্তি-কবির যে-আকুতি ব্যক্ত হয়েছে, তা যে গোটা জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে নিবেদিত, তাতে সন্দেহ নেই। 