সোনায় সোহাগা কাহিনি

জিয়া হাশান

ইন্দেরহাটের লঞ্চ জেটি। তারে ঘিরে নাও-ট্রলারের মৌচাক। তাতে মাঝি-মাল্লারা গলা ফোলায় – ‘ওই কালামইল্যা! তোগো নাওয়ের হোগা সোজা হর। পুটকির মইদ্যে গলোই হান্দাইছো ক্যান…’ ‘ল্যাওড়া চোষা হউরের পো! কামারকাডির চোদন এহানে দ্যাহাবি না। পারার রশি খুইল্যা দ্যাখ, এ্যাক বারিতে মাথা দুই ভাগ কইরা ফালামু…’

তবে সব হাঁকাহাঁকি রে মাটিচাপা দেয় হালের মাঝির গালে আলিম বেপারির থাপ্পড়। সে রাশভারী আওয়াজ দহিনা বাতাস ঘাড়ে তোলার আগে মোগো কান ছোঁয়। মোরা জেটিতে খাড়াইয়্যা নাও-ট্রলারের চাকে চোখ ফিরাই।

বেপারির নাওয়ের বুকবোঝাই মাল। কলার বহর আর বস্তায় বাঁধা আমড়ার জোট। সে আসছে জেয়ারে। সবার পাছার কোলে তার নাও। তাই চিইর‌্যা-ফাইড়্যা আগানের কসরত চালায়। সামনের দুই নাওয়ের ফাঁক দিয়া তার নাওয়ের গলুই হান্দায়। হালের মাঝি রে একবার ডাইন-বগল, একবার বাঁ-বগল দিয়া আগাইতে কয়। পরপর দুই নাও পাশ কাইয়্যা আগানোর পর একটু জিরোন্তি খায়। আগানের আর পথ কই? সামনের পথ নাও-ট্রলারে জগডুমুরি দশা।

গাঙের ঢেউয়ের অবিরাম ঘা-গুঁতায় নাও-ট্রলারের চাক নড়াচড়া খায়। তাতে সামনের পথ যেন একটু হাঁ হয়। ব্যস, বেপারি তখন হালের মাঝিরে আগাইতে কয় – ‘ডাইনের বগল দিয়া গলুই হান্দা।’ বেপারি নিজেও পাশের নাওয়ের ঢালি ধরে আগানোর চেষ্টায় হাত চালায়। দুকদম হয়তো আগায়। তারপর আর না। বেপারি

তখন মাঝির পানে ছোটে। গালে রাশভারী আওয়াজ আসন গাড়ে – ‘হারামজাদা! তোরে কইলাম ডাইন ধার দিয়া, তুই বাম দিয়া হান্দাইছো ক্যান? এহন আগাইবি কই, তোর মার ছামার মইদ্যে, অ্যাঁ?’

ঢাকার লঞ্চ ধরার লাইগা মোরা বিকাল ৫টায় জেটিতে হাজিরা দিছি। লাববাইক বইলা খাড়াইছি। মোগো লগে শফুরাও থাকে। এককোনায় জড়োসড়োয় খাড়া। মোরা তার পানে মোটেই মনোযোগের চাড় ফেলি না। কেননা, সে যে সামনের পথে, আরো আগের কাহিনিতে মোটাসোটা মোচড় মারবে, একেবারে আলাদা রাস্তায় মোড় ঘুরাইবে তা মোরা তখন বুঝতে পারি না। তয় মোরা খাড়াইয়্যা-খাড়াইয়্যা দহিন মুখে চাইয়্যা থাহি। গাঙের দিগন্তে চোখ রাখি, কখন সে আসে, মোগো কোলে লয়। রাতভর বিছানা-চাদরে আদরে-যতনে রাখে।

দূর থেকে তার শুরু। দিগন্তে তার প্রথম চোখ ফোটে – সাদাবিন্দু। তারপর পানি ভাইঙ্গা আগায়। মোরা দেখি তার মুখ, পেটের ফালি। তাতে লেখা ‘রাজদূত’। ব্যস, চাঞ্চল্য মোগো হাত-পায় ভর দেয়। গাট্টি-বস্তা, পোঁটলা-পুঁটলি হাতে লই। কেউ কেউ ‘লাস্ট টিরিপ’ ‘লাস্ট টিরিপ’ জিগির গাই।

তহন নাও-ট্রলারের আসর আচুক্কা ‘গ্যালো’ ‘গ্যালো’ কোরাস গায়। ‘ধর’ ‘ধর’ রব মাথা তোলে। মোরা ডাইনে ঘাড় ঘুরাই – কার ঘাড়ে সর্বনাশে পা দেয়। ডুবায় কার নাও। আরে একি! এ দেহি, আরামকাঠির হালিম বেপারির নাওয়ের ক্রান্তিকাল, মরো-মরো তার দশা।

বেপারির নাড়ি-নক্ষত্র মোগো হাতের মুঠায়­ – আছিল গাঁয়ের হাল-হালুডির কারবারি। চাষবাসে মশগুল। ভাইগো উৎপাতে তার দফারফা। দাদার কালের বাড়ি থাইকা উৎখাত। বছরখানেক আগে তাই গঞ্জে থিতু। তারপর বেপারিগিরিতে হাতেখড়ি। এসব কিছুকাল আগের কাহিনি। তাই ব্যবসার পথঘাট এখনো তার নখের আগায় হাসা-খেলা শুরু করেনি। আবার পুঁজি-পাট্টায় ভাটির খাসলত। নাওহানও ছোডো। তার গলা তামাইত আমড়ার বস্তা গেলা। ফলে ঢালিতে মুখ লাগায় গাঙের পানি।

তার দুই পাশে আবার ঘাড় উঁচা ইনজিনঅলা দুই ট্রলার আইসা খাড়ায়। তাগো চাপে বেপারির নাওয়ের নাভিশ্বাস। বার দুই উঁচা ঘাড়ের কাতানি খায়। বেপারি লগি-বৈঠায় তা ঠেকায়। কিন্তু রাজদূত আসার চাঞ্চল্যে কাতানি আরো গভীরে পা বাড়ায়। তা আর সইতে পারে না হাতের তালুর নাহান ছোডো নাও। তার বাঁঢালি গা এলায়। কাত হয়ে নামে। তখন গাঙের পানি চান্স পায় ষোলো আনা। তার সুবর্ণ সুযোগের দরজা খোলে। সঙ্গে সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়া আগায়। গলগল করে ঢালি বেয়ে বেপারির নাওয়ের প্যাডে জায়গা লয়। কয়েক মিনিটের মইদ্যে নাওয়ের খোল ঢেঁকুর তুলতে বাধ্য হয়। বুকভরা আমড়ার বস্তা নিয়া পানিতে টইটম্বুর নাও কতক্ষণ আর নাক উঁচা করে রাখে? এক সময় ঝুপ করে তলায়। গাং তখন খুশ দিলে তারে গর্ভে লয়। আম ও ছালা, নাও ও আমড়া-হারানো হাকিম বেপারির তখন কপাল চাপড়ানি। উঁচা স্বরে কোঁদাকুঁদি – মোগো মোনে দাগ কাইটা আগায় – ‘হালার টলার! পুটকির মইদ্যে শ্যালো ইনজিন হান্দাইয়্যা ঠাপ চোদাও। মোর নাওয়ের উফর ধোন উঠাইয়্যা দাও। আইজ তর চৌদ্দগুষ্টিরে…।’

ততক্ষণে রাজদূত পাছা ঘুরায়ে জেটির সামনে খাড়ায়। মোরা গাট্টি-বস্তা, পোঁটলা-পুঁটলি বগলদাবায়ে চরদখলের দক্ষতায় সিট দখলের প্রস্ত্ততি লই।

শফুরা তখন চোখ বড় করে। খোলা কিংবা ছইঅলা টাবুইর‌্যা নাও, ইদানীং পুচ্ছে ইঞ্জিনগোঁজা ট্রলার দেখায় যার চোখের সীমা। সে তো ঢাকাইয়্যা জলদানব দেখে চমকাবেই – ‘ও মা! কত্তো বড়! তালার উফর তালা। গাঙে ভাসা দালানকোডা।’

 

জেটির লগে রাজদূতের মিলনে কি জেটি কাতরায়? শীৎকারে মাতে? গা দোলায়? নাকি দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়ভেদী আর্তনাদ? কেননা এক লহমায় এতোগুলান পোলাপাইন, হোক না তারা ক্ষণিকের তরে আসা, তাগোরে ঘাড়ে-গর্দানে বিপুলা সতীনের কোলে তুলে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাতে এরকম গা-গতর দোলায়ে ঝনঝনে আওয়াজ বার হবারই কথা।

 

জেটিতে সিঁড়ি পড়লে মোরা হুড়মুড়ে মাতি। কার আগে কে উঠবে তার তান্ডব খেলি। মাসে মাসে না হলেও বছরে এক-দুবার, রোজা কোরবানির ঈদে, এ-কামে মোগো হাত সিদ্ধ। পথঘাট, কায়দা-কৌশল মুডায় পোড়া। কিন্তু শফুরা এগুলায় কখনো হাত চালায় নাই। এবারই তার প্রথম যাত্রা। তার বরং হাত চালানি চাল ধোয়ায়, মাছ কোটায় কিংবা বাড়ির উঠানে কদু-কুমড়ায় দুপয়সা কামাইয়ে। চান্স যদি চোখ মেলে তা অইলে হাঁস-মুরগি বেইচা আয়না-চিরুনি কেনায়।

তাই মোগো হুড়মুড়ির খেলায় সে মাতে না। সবার জেয়ারে পড়ে থাকে। মোরা তারে নজরেও রাখি না। তয় সিঁড়ি থাইকা আকমইল্যার গাঙে পড়া, রাজদূতের তলে চালান হওয়া ঠিকই দেহি। তার লাইগা হা-হুতাশে মাতা! ওমা! সেডা কি? মোরা না ধান-নদী-খালপাড়ের মানু! জলে পড়লে চোখে ভাসা কি মোগো মানায়?

মোগো কেউ কেউ জেটিতে, কেউ রাজদূতের কোলে, বিনয়কাডির আকমইল্যা তখন সিঁড়িতে। কিন্তু দুপা আগাইয়্যা থমকায় – অ্যাঁ, পেছন থাইকা কেডা টানে? পাঞ্জাবির পকেট ধইরা আটকায় কোন হালায়? পকেটে ভাড়ার ট্যাহা। বাবার কালের গাছ বেচা। পকেটমারে গ্যালে বিনামেঘে বজ্রপাত। মেঘনার মাঝ গাঙে কেরানি ছুইড়া মারবো। ঢাহার মুখ আর দেহা লাগবো না। কিন্তু এডা তো পকেটমার বোনা সদরঘাট না। ইন্দেরহাটের জেডি। এহানে পকেটে হাত চালায় কোন জাউর‌্যার পো, অ্যাঁ? আকমইল্যার আগানো হয় না। সিঁড়িতে থমকাইয়্যা খাড়ায়। তার একহাতে ফজিলার হাতে বানানো আমের আচার। খোয়া গেলে রথখোলার মোড়ে তার ভাইয়ের ঝুপড়ির দরজা বন্ধ। তহন খোলা আকাশের তলে কিংবা টার্মিনালে রাতযাপনের ফাঁড়া। আরেক হাতে কাপড়ের পোঁটলা। দুটো লুঙ্গি আর একজোড়া শার্ট। ফজিলার নিজের হাতে কাচা। হাতছাড়া হলে ছমাস এক কাপড়ে। আচার-পোঁটলায় হাতবন্দি আকমইল্যা তাই জামার খুঁট ছাড়াতে পেছনে হাত বাড়াতে পারে না। বরং ঘাড় ঘুরায় – দেহি কোন হালার পুত? কিন্তু কার হাতের মুঠায় খুঁট তা ঠাহরের আগেই জেটি থেকে ধাক্কার ঢেউ গড়ায়। প্রথমটা সহিসালামতে সামলায়। প্যাডেল-হাঁকানো পা বলে কথা। কিন্তু ‘এ্যাই, হালার পো হালা, সিঁড়িতে খাড়াইয়্যা কার ধোন চোষো, আগাও না ক্যানে’র দ্বিতীয় ঢেউয়ে পা সামনে ধায়। তবে তা এক তক্তার ক্ষীণদেহী সিঁড়ির সামনের ধাপে না পড়ে শূন্যে খাবি খায়। তার ডানপাশে পড়ে। ব্যস, এক কাতানিতে ঝুপ করে গাঙে। সঙ্গে সঙ্গে আম-ছালা, আচার-পোঁটলা সমেত ভাটা তারে কব্জায় নেয়। রাজদূতের তলে চালান করে। তার আগে একবার মাত্র তার মাথা তোলা মোরা দেহি। তারপর আর না। তবে একজন না একজন তো নজর দেয়-ই। তা না হলে বিশ্বসংসার চলে ক্যামনে? যে দেখে সে থাকে উপরে। সাত তবকে আল্লা-খোদার দরবারের তলে।

 

দুই

ইন্দেরহাটের আগের ঘাট, কাউখালী থেকে আমি রাজদূতে সওয়ার। দোতলায় আগে থেকে বুক করা কেবিন। সিট দখলের লড়াই থেকে তাই মুক্তি। ঘাট ছাড়লে সামনের খোলা চাতালে বসি। রেলিং ঘেঁষে চেয়ার। সামনের ডান-বাঁ একনজরে একীভূত।

দূরে দুপারে সবুজ রেখা। আর সামনে দুদিকে দুহাত ছড়ানো প্রশস্ত নদীতে অজস্র জলের সমারোহ। তার বুকজোড়া মঞ্চে কচিকাঁচা ঢেউয়ের ছোটাছুটি। পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোয় ঝিলিমিলি নাচ। ঝড়ের গোলাপ বাগান না মানার মতো ছোট ছোট ঢেউয়ের ছন্দটারে তছনছ করে আগায় রাজদূত। চার হাত-পায়ে চুরমার করে ছোটে।

ঘণ্টাখানেক পর নজরে আসে ইন্দেরহাট। তার ছোট্ট জেটি – নদীর হাতের তেলোয় একখন্ড শোলা। তাতে পথসভায় বক্তার সামনে সঘন শ্রোতার মতো অপেক্ষমাণ যাত্রীদের আসর। পাছা ঘুরায়ে রাজদূত তাতে মুখ ছোঁয়াতেই তাদের বাঁধভাঙা হুড়মুড়। ওপর থেকে তাদের স্রোতে চোখ রাখি। দেখি, ভারি বয়সী এক লোক রেলিংবিহীন সিঁড়িতে সামনের এক জোয়ানমদ্দের পাঞ্জাবির খুঁট অাঁকড়ায়। জোয়ানের আর আগানো হয় না। থমক খায়। তাই বলে পেছনের হুড়মুড়ানি থেকে তার মাফ নাই। তার ধাক্কা তারে সিঁড়ি ফসকে নদীতে ফেলে। তবে বুড়ো শেষ মুহূর্তে খুঁট ছাড়ে। ফলে এ-যাত্রায় গাঙের খোরাক থেকে তার বাঁচোয়া। কিন্তু জোয়ানমদ্দরে উদ্ধারে কোনো আয়োজন না দেখে মনে পড়ে  – আরে ও তো ধান-নদী-খাল পারের মরদ। যারা ডাঙার চেয়ে গাঙে পাকাপোক্ত। রাজদূতের মতো পাঁচটা জলযান রে এক ডুবে পাড়ি দেওয়া তাদের হাতের মুঠায় হাসে খেলে।

ঠিক তাই, চেয়ার ছেড়ে রাজদূতের পেছনে তাকাই। জোয়ানমদ্দ তখন মাথা তোলে। তার এক হাতে কাপড়ের পোঁটলা যথারীতি। কিন্তু আরেক হাতের আচারের বাটি হাওয়া। তাতে বোধহয় টক-ঝালের বাহারি স্বাদের জমজমাট আসর আছিল। তাই ‘সন্ধ্যা’ চেটেপুটে খেয়ে নিছে।

রাজদূতের পিছন থেকে তখন আমার চোখ সামনে। ঠিক তখনই নজরে পড়ে মেয়েটা – আহ্! একেবারে কচি। নতুন ডাবের লেওর মতো সুস্বাদু যেনবা। গোলগাল প্রতিমার মতো মুখ। ফর্সার ওপর একপ্রস্ত বন্যতার প্রলেপ। তবে তা গভীরে হাত বাড়াতে পারেনি।  দু-এক ঘষাতেই হয়তো মুখজুড়ে দুধে-আলতা তার বিজয় কেতন ওড়াবে। গায়ে জড়ানো ডুরে ভেদ করা আমার চোখ দৌড়ে বেড়ায় তার দেহের এ-মাথা ও-মাথা। আহ্! জলখাওয়া ডগার মতো লকলকে সতেজ।  সিঁড়িতে মেয়েটির ভীরু পা। ততক্ষণে জেটির স্তিমিত ভিড় তারে দ্বিতীয় পা ফেলার আগে ভাবার সুযোগ দেয়। পেছন থেকে কেউ ধাক্কার জোগাড়ে যায় না। তাই সে ধীরপায়ে আগায়।

রেলিংয়ে ঝোকা আমার চোখ। মেয়েটির আগেপিছে কেউ নেই। সঙ্গী-সাথিবিহীন! প্রহরা ছাড়া অরক্ষিত মোহরের ঘড়া? সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে আদিগন্ত খোলা মাঠ বুক চেতায়। তাতে চোখ ধায় সুদূরে – ব্যস, এখন শুধু টোপ ফেলা। গেঁথে তোলার কাজ। তবে তাড়াহুড়ার কিছু নাই। সামনে অনেক সময়, পুরা একটা রাত। এ-সময় বন্দুকহাতে পুরা একটা দেশ, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ, লাতিন আমেরিকানও হতে পারে, তা দখল করা সম্ভব। আর এ তো গ্রামের সামান্য একটা মেয়ে। তাই আয়েশি ভঙ্গিরে ডেকে গায়ে তুলে সিগারেটে অগ্নিসংযোগে যাই।

ডুরে শাড়ি কোথায়? কোন গলির কোন মাঠে তার আশ্রয়? খুঁজে রাখা জরুরি। রাতে টোপ ফেলা, গেঁথে তোলা সহজ হবে। তাই সিগারেট শেষে নিচতলার পথ ধরি।

রাজদূতের দোতলার হাফ আর তিনতলার ফুল স্পেসে কেবিন। একটার গা-ঘেঁষে আরেকটা দাঁড়ানো। তাতে ফার্স্ট ক্লাস যাত্রীদের বাস। ব্রাহ্মণ-ঠাকুরদের গাঁ। নিচ আর দোতলার পেছনের হাফ ডেকযাত্রীদের। মানে নমঃশূদ্রদের এলাকা। ব্রাহ্মণ-ঠাকুরদের যেমন নমঃশূদ্রে গমনে, পেট বানানোতে বাধা নেই, তেমনি কেবিনঅলাদের ডেকে যাতায়াত অবাধ, বাধাবিপত্তিহীন। আবার নমঃশূদ্রদের ব্রাহ্মণ-ঠাকুরে গমনে যেমন শাস্তির বিধান, হয়তোবা মুন্ডুনাশ, তেমনি ডেকের যাত্রীদের কেবিনপাড়ায় পা ফেলায় হাজারো বিধিবিধান, শূলের খাড়া ঝোলানো।

ব্রাহ্মণের পৈতা, কেবিনের চাবি হাতের মুঠায় পুরে নিচে নামি। সেখানে নিজ নিজ বিছানা-বালিশ-কাঁথায় নমঃশূদ্রযাত্রীদের নিবিড় সমাবেশ। একজনের গা-ঘেঁষে আরেকজন। আর পেছনে, ঠিক  পেছনে নয়, রাজদূতের কোমর বরাবর আরেক যজ্ঞ। আমি হাঁ-হয়ে তা দেখি – দুপাশের খোলা রেলিংপথে আমড়ার বস্তা আর কলার কাঁদির উজানি স্রোত। ট্রলার-নৌকা থেকে তার গা তুলে রাজদূতের খোড়লে গা এলায়। কুলিদের হাতে হাতে সবুজ কাঁদি নাচে। একজন ছোড়ে আরেকজনের কাছে। সে পরের জনের হাতে। একসময় মুখ লুকায় গহবরে। আমড়ার বস্তা চলে ঘাড়ে চড়ে। নৌকা-ট্রলার থেকে ঘাড়ে উঠে সোজা অন্ধকার খোলের ভেতর। একসময় তাদের দৌরাত্ম্য চড়ে। গহবর উপচে পাটাতন দখলে ধায়। দু-গড়ানে সামনে বাজে বিছানা-কাঁথা। জোটবাঁধা আমড়ারা তাতে চড়ে। ব্যস, কাঁথার মালিক তখন চার হাত-পায়ে খামি দিয়া খাড়ায়। বিনাযুদ্ধে সে নখাগ্র ছাড়তে রাজি নয়, এতো আস্তো একটা সিট – কমপক্ষে সাড়ে তিন হাত স্পেস। তার কণ্ঠ চড়ে – ‘এ্যাই হালার পো হালারা! কাঁথা তোর বাপের, হের উফর মাল উডাইছো ক্যা?’

রাজদূতের কেরানি, হাতে মালের হিসাবের কাগজপত্র দেখে বুঝি, সে মীমাংসায় আগায়। একতরফা ফয়সালায় হাত চালায়। একটানে কাঁথারে বাতাসে ওড়ায় – ‘এ্যাই ওড! চুতমারানির পো! তুই কয় টাহা ভাড়া দ্যাছ? এ্যাই মালের ভাড়ায় তোর চৌদ্দগুষ্টি কেনা যায়। যা তোর কাঁথা লইয়্যা এহাইন্দা সর।’

যজ্ঞ থেকে চোখ ফেরাই। ডুরে শাড়ি খুঁজি। চোখ চার হাত-পায়ে হাতড়ায়। ঢালা বিছানার যাত্রীদের এ-মাথা ও-মাথা দৌড়ায়। কিন্তু বারবার চোখ হোঁচট খায় বোরকাঢাকা দেহে, নেকাবে মোড়া মুখে। ডুরে শাড়িতে তার আর থিতু হওয়া হয় না।

আর কোথায় খুঁজি? এতো বড় তিনতলা জাহাজ। অ্যাঁ! জাহাজ! এতো সাগরের কিনারেও হাঁটে না। ঢাকা থেকে হুলারহাট পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ। হ্যাঁ, তারপরও জাহাজই বটে। রিকশাঅলারা যেমন তাদের রুটি-রুজির হাতিয়াররে কয় গাড়ি। জাতে তোলার চেষ্টা আর কী। তেমনি রাজদূতের কেরানি-সুকানি মায় কেবিনবয়রাও ‘স্যার আধঘণ্টার মইদ্যে জাহাজ ছাড়বে’… ‘স্যার জাহাজ সকাল ৬টায় সদরঘাট পৌঁছবে’তে মুখ নাড়ায়।

এ-জাহাজের এত গলি-উপগলি, তার কোথায় যে ডুরে শাড়ি লুকানো? চোখের নাগাল, হাঁ-মুখের ভেতর থেকে শিকার ফসকাবে, হাওয়ায় মিলাবে তা কী করে মানি? তাহলে এতদিনের সাধ্য-সাধনা, খেলোয়াড়ি জীবন, সব তো ধুলায় গড়াগড়ি খাবে। হেসে কুটিকুটি হবে।

দোতলার হাফেও নমঃশূদ্রদের বাস। পেছনের দিকে তার সিঁড়ি। আমি তার পানে পা তুলি। এক পা নড়ে ঠিকঠাক, কিন্তু দ্বিতীয় পা পড়ার আগেই কানে আঘাত হানে আমার নাম – ‘হাফিজ! এ্যাই হাফিজ!’ না শোনার ভানরে পুঁজি করে সামনে পা ফেলি। এ্যাই বিজলযানে কে আমারে ডাকবে? অন্য কেউ হয়তোবা। কেননা, এ উর্বরা নাম ঘরে ঘরে জন্মে। সার-বীজের তোয়াক্কা না করে বাড়ে। তাই খোলা মাঠে হাঁকালে চারদিক থেকে গন্ডাখানেক হাত তোলে। আর এ তো জনসমাবেশ। এখানে নিশ্চয়ই ডজনখানেক মুখ ফেরাবে। আমার গা না করলেও চলবে। কিন্তু তৃতীয় কদম ফেলার আগেই পেছন থেকে ঘাড়ে হাত। তখন না থেমে আর উপায় কী? শুধু থামা নয়, ঘাড় ঘোরায়ে পেছনে তাকাতেও হয়। শেষে শুনি – ‘মুই কবির, বিএম কলেজের কবির।’

আধহাত লম্বা পরিচয় ঘোষণার পরও প্রথম ধাক্কাটা যায় অচেনার ওপর দিয়া। ঠিক চিনে উঠতে পারি না। অপলক চোখ তখন সহায়তার হাত বাড়ায়। হ্যাঁ, মনে পড়ছে – কলেজ হোস্টেলের রুমমেট। পাক্কা দুবছর এক রুমে বসবাস। বছরখানেক আগে ঢাকায় হঠাৎ রাস্তায় এবার দেখা হয়েছিল। তাও একঝলকে মনে পড়ে।

এদিকে কোথায় ওর বাড়ি। কলেজে থাকতেই তা জানা। ঢাকায় সাক্ষাতে আরো জানা হয়, এলাকার কলেজে মাস্টারি করে। আর বিএম-এর বেতন-ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে স্লোগান তোলার অভ্যাসটারে ‘জনসেবা’য় বজায় রাখার খবর। তা এখন দীর্ঘ বিরতির মাথায় সাক্ষাতের অনিবার্য প্রশ্ন ‘কী করছিস?’ ‘কোথায় আছিস?’ থেকে আমারে বাঁচায়।

কিন্তু মরণের খড়গ হয়ে ঝোলে – ওকি এ-যাত্রায় আবার ঢাকা যাচ্ছে? তাই রাজদূতে সওয়ার? তাহলে কম্মো কাবার, রাতটাই মাটি, স্রেফ ছাইভস্মে ঢলাঢলি। কেননা, আমার কেবিনে একটা বাড়তি সিট বুক চিতানো। সিঙ্গেল না পেয়ে ডাবল নিতে বাধ্য হইছি। ও তা জানলে আর কথা নাই। কলেজ হোস্টেলের দুবছরের অভ্যাস পুনরাবৃত্তিতে মাতবে। ডেকের পাত্তি গুটায়ে তিনতলায় চড়বে। বস্তি থেকে ফ্ল্যাটবাড়িতে ওঠার চান্স কে কবে ছাড়ে?

মীমাংসার আশায় তড়িঘড়ি মুখ খুলি – কই যাবি, ঢাকায়?

– না, মোগো কি নিত্ত নিত্ত ঢাকা যাওন পোষায়? আগের ঘাটে নামমু। শ্বশুড়বাড়ি। বউয়ের জরুরি তলব।

আহ্! মেঘমুক্ত আকাশ একপশলা বৃষ্টি ঝরায়। কি আরাম! কোমল পরশ। ওর আর এযাত্রায় ঢাকা যাওয়ার চান্স নাই। বউয়ের ডাক। তা রাজা-বাদশাহগো ফেলার মুরোদে কুলায় না। আর ও তো কোথাকার ইলুহারের কবির, দুপয়সার কলেজমাস্টার।

বিদায়ের আগে কবিরের জনসেবার অসুখ চুলবুলায়। আমারে সাথে টানে – ‘আয়, এদিগে আয়। জানাশোনার মইদ্যে কাইরে পাইলাম না। তোর ঘাড়েই চাপাই।’ পেছনের সিঁড়ির ওপাশে নিয়া আমারে দাঁড় করায়। সিঁড়ির আড়াল খাড়া থাকায় জায়গাটা এতক্ষণ চোখরে ফাঁকি দিছে। ঘুরে দাঁড়াতেই নজরে ধরা দেয় – আরে এ্যাই তো ডুরে শাড়ি। আঠারো ভাঁজে জড়োসড়ো। আমার বিস্ময়রে মিনারে চড়ায় কবির। ডুরে শাড়িরে দেখায়ে কয় – ‘অয় মোগো গেরামের মাইয়্যা। এ্যাকলা এ্যাকলা ঢাহা মেলা হরছে। তুই একটু দেহিস, হেল্প করিস।’

এ তো না চাইতেই জল। ঢিল ছোড়ার আগেই হাতের মুঠায় পাকা ফল। আমি তাই ঘাড় কাতাই। আমার পর কবিরের পালা মেয়েটার প্রতি – ‘এ্যাই শফুরা! এনারে চিইন্যা রাখ। কিছু লাগলে হের কাছে যাইস। হের কেবিন আছে, পনেরো নম্বর।’

শফুরার তখন ঘাড় কাতানো আর চোখ তুলে তাকানো একসঙ্গে হয়। আহ্! কী ডাগর চোখ। আমার মতো পাপীতাপী সে চোখের কতটুকু গভীরে আর পা দিতে পারে? তাই তড়িঘড়ি তুলে নিয়া কবিরের পানে ফিরি। ওর মুখ পাঠে নামি – ওকি শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া কিংবা বিড়ালের কাছে দুধ পাহারার জুতসই বাগধারা দুটো জানে? মনে হয় না, জানবে কী করে? ও তো বাংলার না, পলিটিক্যাল সায়েন্সের।

 

তিন

রাজদূত আধঘণ্টা ইন্দেরহাটের জেটির সঙ্গসুখ ভোগ করে। তারপর পরের লাঙ বানারীপাড়ার পানে পা বাড়ায়। তার নিচতলায় নমঃশূদ্রপাড়ায় তখন জমজমটা জনসভা – ভাইসব!… ব্লাউজের বোতাম খুলতে খুলতে যাগো কম্মো কাবার, ধাতু বাইরাইয়্যা যায়, তাগো লাইগা মহৌষধ – শ্রীপুরের খাঁটি মলম। লাগাইবেন তো পাক্কা দশ মিনিট লাস্টিং। ভায়েগ্রা ফেল। কার লাগবে… এ্যাই যে এ্যাকভাই এ্যাকবার নিছিলেন, উপকার পাইছেন আবার নিলেন… লইয়্যা যান, বউয়ের লগে ঘুমাইয়্যা আরাম পাইবেন। গোপন অঙ্গে লাগাইবেন… পঁচিশ টাহা দাম, আইজকার লাইগা পাঁচ টাহা মাইনাস, বিশ টাহা বিশ টাহা ফাইনাল। কার লাগবে জাগায় বইয়্যা হাত তোলেন…

কোনার এক হাততুলুনিঅলা কানের কাছে কিছু কয়। তখন আবার ঘোষণা – এ্যাক সপ্তাহ লাগাইবেন। আর বাঁকা থাকবে না। রডের নাহান সোজা টানটান অইবো। বউ দেইখা কইবে ওমা, ওয়াও! আপনি কইবেন ওয়াও না খাড়া আলিফ…

জনসভা শেষে মোরা মোনাজাতের পার্টনার খুঁজতে গিয়া আকমইল্যা রে পাই। লঞ্চের ল্যাজের কাছে জবুথবু। গায়ের পিরান-লুঙ্গিতে পানি। তার ফোডার পাডাতনে দৌড়ঝাঁপ। ‘তোর অসুখ-বিসুখ নিমুনিয়ার ভয় নাই?’ কিন্তু বদলাবার সবেধন নীলমণি যে একপ্রস্ত, তারো একই দশা। পোঁটলায় গোঁজা। পানিতে গলা ডোবা। তাই বিকল্প উপায় – ‘বাতাসের তোড়ে গায়ে গায়ে হুকাইবে।’ অফিস-আদালতে ওর কোনো কাম নাই। প্যাডেল মাইরা প্যাড চালায়। ভেজা কাপুড়-চুপুড়ে ঢাকা যাবার আর্জেনিস্ডা কিসের? দুদিন পরে গেলে ক্ষতিডা কী? ‘তুই আইলি ক্যান, গাঙে পড়ছো, বাড়িতে ফিইরা যাইতি।’

– বাড়িতে পোলার মায় রামদা লইয়্যা কুঁদবে। না-মুরাইদ্যা মিনসে, ফিইরা আইছো ক্যা? আইজ তোর একদিন কি…

পোলার মা মানে তিন বিয়ানি বউ ফজিলা। ধান-নদী-খাল এলাকার মুখরা জাতের ফলন। নালি কেটে তারে গোলাজাত করার মতো হাতিয়ার আকমইল্যার টেপমারা মুখের নাই। অয় ভেদা মাছ টাইপের। মোরা কই আমড়াগাছের ঢেঁকি। ওল তোলাইন্যা আবাল।

তাই তারে বাদ দিয়া মোরা মোনাজাত ধরি। হালিতে-হালিতে ভাগ হইয়্যা সাহেব-বিবি-গোলামের লগে সহবাসে সময় কাটাই। তার একফাঁকে দেহি – ওপরঅলা মোগো পাড়া বেড়ায়। ব্রাহ্মণের পৈতা হাতে ঝুলাইয়্যা সিঁড়ির আড়ালে খাড়ায়। শফুরার লগে তার কিছু কথা হয়। সে কি তারে ডাকে – ‘লও, উপরে লও। খাট বিছানা কেবিন…’

রাজদূত একের পর এক ঘাটে মুখ লাগায়। তার প্যাড ফুলেফেঁপে ওঠে। ঈদের পরের ভরা মৌসুম। একেক ঘাটে একেক মাস। ন’মাসের পোয়াতি যখন-তখন হঠাৎ ‘নিলো নিলো’, ‘ধর ধর’ চিল্লানি। মেয়েলি গলার আর্তনাদ। মোগো মোনাজাত তছনছ। ঘাড় ঘুরাই – কী ব্যাপার, চেঁচামেচি কিসের? দেখি নজুর বউ মাসুমার বুক চাপড়ানি – ‘মোর নাকের ফুল, গলার হার…’

নজু মানে মেহনতকাঠির মেরাজ শেখের পোলা নজরুল ইসলাম। খাতা-কলমে এরকম আঁকা। সৎমায়ের মুখের ঘায়ে বছর চার আগে বাড়ি ছাড়ে। ঢাকার লঞ্চে পা দেয়। তারপর হাওয়া। কোনো খোঁজখবর নাই। বাড়িতে মিলাদ-মোনাজাত। আর দুবছর গেলে হয়তো গায়েবানা জানাজার আয়োজন অইতো। তবে তার আগে বাহরাইন থাইকা কল – ‘বাজান! মুই নজু, আগামী মাসে দ্যাশে ফিরমু।’ টানা তিন বছর বাহরাইনের গারমেন্সে গতর বিকাইয়্যা দেশে ফিরলে মেরাজ শেখ আগে থেকে গাঁথা লাজনম্র মালা পোলার গলায় জড়ান। আদেল হালদারের মেয়ে মাসুমার লগে গাঁটছড়া বাইন্ধ্যা দেন। এহন নাজু আবার ঢাকার পথে। দুদিন পর ফিরতি ফ্লাইট।

যে ঢাকা শহর তারে ছাপ্পড় ফাইড়া দিছে। গারমেন্সে চাকরি, ডলার-দিরহামে বেতনের চান্স। সে আজিব শহর নতুন বউরে না দেখাইলে, তার মাঠের নাহান চওড়া রাস্তা, আকাশে মাথা ছোঁয়া দালান-বাড়ি দেখাইয়্যা বউয়ের চোখ বড় করতে না পারলে যেন প্রেমডা দই বাঁধে না। জমজমাট হয় না। তাই মাসুমারে নিয়া নজুর যাত্রা।

মাসুমার আবার সিনামার নেশা। মাথার ওপর ঝোলানো কালো বাক্সে তার মনের নায়ক নাচে-গায়। মারপিটে ওস্তাদি দেখায়। আর যায় কই, মাসুমার চোখ আর সরে না। ঘুমকাতুরে সোয়ামির গায় হেলান দিয়া বসে। আশপাশ সব তখন হাওয়া। কোনো দিকে খেয়াল থাকে না।

এ-ফাঁকে মোগো একজনের চোখ তার গলায় হাঁটে। ঘোমটার কোনাকাঞ্চি দিয়া ঢোকে – এ নির্ঘাৎ খাঁটি। আরব দ্যাশ থাইকা আনা। তক্কে-তক্কে গোটা চাইর মোড় পাড় করে। শেষে বদরখালির বাঁক, তন্বী মাইয়্যার নাহান পাতলা, কিনারা কাছে। রাজদূত তাতে পা দিলে আর তর সয় না। ব্যস, মাসুমার গলা-কানে দুই হাতের ছোবল। দুল-হার হাতের মুঠায়। তারপর রেলিং টপকে গাঙে ঝাঁপ। চিৎকার মাতমে তার কান দিলে কী পোষায়? আঁধার রাইতে ডুবসাঁতারে তারে যে কূল ধরতে হবে।

তবে চেঁচামেচি-হট্টগোল শফুরারে আড়াল-আবডাল দেয়। তার ঘনছায়ায় সে আগায়। মোরা আড়চোখে দেহি ব্রাহ্মণপাড়ার সিঁড়িতে তার পা।

রাতে কেরানি টিকিট কাটতে এসে আকমইল্যারে ধরে – ‘খুতি খোল, ভাড়া দে।’ কিন্তু সে ভাড়া দেবে কোত্থেকে? পকেট খালি। গাঙের হাতে চুবানি খাইয়্যা লঞ্চে উইঠা জাগা পায় নাই। সবখানে মানুষ আর মানুষে সয়লাব। শেষে ল্যাজের দিকে ইনজিনের পাশে খাবারঘরের বগলে সে জবুথবু হয়।

সন্ধ্যা লাগার পর ক্যান্টিনে রান্নাবাড়ার ধুম পড়ে। খোলা তেলের চুলায় পাক। মসলা-পেঁয়াজ ঝলসানোর গন্ধ বাতাসে হাতপা ছড়ায়। হাওয়ায় ওড়ে। আকমইল্যার নাকে বারবার ঘা দেয়। তার খিদা মোচড় খায় – আহ! গোসতের সুর্রা, কী সোয়াদ, কতদিন খাই না…

কোন দুপুরে বাড়িতে খাইছে। ফজিলার হাতের ডিমের সালুন, পুঁইয়ের ডাঁটার হজম হওয়া সারা। সামনে পুরা রাত। রুটি-কলায় পেটরে বুঝ দেওয়ার কথা। ফজিলা তার লাইগা আলাদা তহবিল দিছে। বাপেরকালের সেরেজ গাছ বেচা টাহা। বাড়িতে চার মুখের খোরাকি রাইখা বাকিটা ভাগ – এ্যাইডা খাওনের ডাইন পকেটে রাহো, এ্যাইডা ভাড়ার টাহা, বাঁ পকেটে ভালোমতো গোঁজো।

কিন্তু মসলার ম-ম ঘ্রাণ সব তছনছ করে দেয়। দুহাতে ধরে আকমইল্যা রে ক্যান্টিনের চেয়ার-টেবিলে বসায়। তখনো যদি হুঁশ ফেরে, মাছ-সবজিতে থিতু থাকে। তা না একেবারে মুরগির গোসতে, বড় সাইজের রানে চড়ে। তখন আর কী, গোঁজা টাহায় হাত পড়ে। শেষে ক্যান্টিনের ম্যানেজারের হাতে হাসে খেলে। এহন ভাড়া দেয় কোত্থাইকা?

ভাড়া নাই তয় জাহাজে উঠছো ক্যান? হউরের পো, এ্যাইডা কি তোর বাপের জাহাজ? কেরানির মুখ থামে না। ডাক, আনসার ডাক। পাছার ওপর দুঘা দিয়া গাঙে ফালা। মেঘনায় ভাইসা যাক…

আনসারের প্রথম ঘায়ে কিছু হয় না। প্যাডেল মারা শরীর বইলা কথা। কিন্তু দ্বিতীয় ঘাতেই কম্মো কাবার। আকমইল্যার পুটকি আলগা হয়। লুঙ্গি-কাপুড়ে সয়লাব।

ক্যান্টিনঅলারা মুরগির ছদ্মবেশে কী খাওয়াইছে আল্লা মালুম। কেননা, প্যাকেট-প্যাকেট স্যালাইনও সামাল দিতে পারে নাই। আকমইল্যার পুরা রাইত গেছে বাথরুমে দৌড়াদৌড়িতে।

 

চার

কেবিনে বই খুলে শফুরার অপেক্ষায়। কালো লাইনে-লাইনে চোখ হাটে ঠিকই। কিন্তু কান খাড়া দরজায় – কখন শফুরা আসে, কড়া নাড়ে?

পত্র-পত্রিকায় আমার দু-একটা গল্প ছাপা হয়েছে। পাঠকের অভিযোগ গভীরতা নাই, ডিপনেসের অভাব। হালকা-পাতলা গড়ন। বন্ধুদের তাই উপদেশ – রুটসে যা। শৈশব-কৈশোরে ঘুরে আয়। সেখানেই তো গল্পের ভান্ডার। সোনার মোহর ছড়ানো-ছিটানো। খুঁজে খুঁড়ে নিয়া আয়। তারপর কাগজ-কলম নিয়া বয়। দেখবি সোনায় মোড়া লেখা, আমূলে গাঁথা গল্প বার হবে।

তাই গ্রামের বাড়িতে আসা। শৈশব-কৈশোরে হাঁটাহাঁটি। বাল্যসাথিদের কাছে ধরনা। এ্যাই বুড়া বয়সে তালপুকুর, ধানের ক্ষেতে দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু তারা নিজেরাই নিঃস্ব। খাঁ-খাঁয় তাদের জীবনযাপন। আমারে দেবে কী।

এদিকে ছুটির তো মা-বাপ আছে। নিয়ম মেনে তার চলতে হয়। তাই সাত দিন শেষে খালি হাতে, শূন্য তহবিলে আমার ফেরা।

পথিমধ্যে শফুরারে পাওয়া। ও এলে রাতটা ভরবে। ফার্স্ট শর্টটা তড়িঘড়ি। সেকেন্ডটা থেকে টাইম। তার আগায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নিশ্চয়ই দিনে পা দেবে। রাজদূত সদরঘাটে মুখ লাগাবে।

কিন্তু শফুরা আসবে তো? টোপ ফেলতে, একেবারে মুখের আগায় ধরতে একবার নিচে গেছিলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়া চমকাই – আরে এ কি! কোথায় বিকাল-সন্ধ্যার সেই প্রাণচাঞ্চল্য, সিট দখলের লড়াই। কাঁথা-চাদর বিছানোর হাঁকাহাঁকি। এ যে পরাজিত বাহিনীর যুদ্ধময়দান। সারি-সারি লাশের স্তূপ। কারো গায়ে কারো পা। বগলতলায় হাত। একজনের দেহের ওপর আরেকজনের গা। কারো কি প্রাণ আছে? আহত দু-চারজন? নাকি গাঙের ফ্রেশ হাওয়ায় সবাই গভীর ঘুমের দেশে হাবুডুবু?

হ্যাঁ, ওই তো কোনার দিকে, রেলিং ঘেঁষে, আলো-ছায়ায় চাদরের তলে দুটি দেহের অবয়ব। তাদের নড়াচড়া, প্রাণের প্রমাণ। তবে উপরিভাগের তুলনায় নিচের ভাগে ঘোরতর চাঞ্চল্য, উত্থান-পতন। তাদের জাত কী? বুক তোলা আর বুক ছাড়া, নাকি দুটো একই জাতের বুকবিহীন? তা বোঝার আগে কেরানি-সুকানি-বয়দের নজরে পড়ে – ‘ওই চাদইরের তলে গিট্টু লাগছে গিট্টু। নুন দে নুন।’

শফুরা দূরের সিঁড়ির তলায়। কিন্তু আমার আগানোর পথ কই। গায়ে-গায়ে শোয়া মানুষজন। ছিলাপথের ওপর তাদের হাত-পা ছড়ানো। শেষে এর পায়ের কাছে, ওর হাতের ফাঁকে বকের মতো লম্বা পা ফেলে তবেই আগানো সম্ভব হয়। শফুরার সামনে গিয়া মোক্ষম টোপ ধরি – কেবিনে খাবার দিছে, মুরগির গোস্ত, মাছের প্যাডি, ডালের চ্চড়ি…

কেবিনের কড়া নড়লে দ্রুত উঠি – শফুরা তাহলে আধার গিলছে, তলা থেকে উঠে আসছে। বই রেখে দরজা খুলি – ধ্যাৎ শালার শুঁটকি পাছার কেরানি। ভাড়া নিতে আসার আর টাইম পাইলো না।

রাত আরো গভীরে পা দিলে শফুরা আসে। খেতে বসে মাছের কাঁটা ছড়াতে গিয়ে মুখ খোলে – কবির স্যারে জানে না। হেরে কইবেন না। মুই বাড়ি থাইকা পালাইয়্যা আইছি।

অ্যাঁ, সোনায় সোহাগা কাহিনি! খাওয়া রেখে শফুরার দিকে মুখ তুলি – এ যে হাঁড়িকাঠে মাথা পাতা আসামি। বাঁচালেই কেনা গোলাম। হাতের পুতুল। তখন যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যবহারের সুযোগ।

কিন্তু পালালো ক্যান? এ্যাই বয়সী মেয়ে, তাদের পালানোর কারণের অভাব কী? মনের মানুষের লগে বাপ-মায় বিয়া দিতে চায় না। বুড়া-ধুরা একটার গলায় ঝুলাইতে চায়। কিংবা সৎমায়ের মুখে ঝাঁটা, আরো কত কী। অতোশতো হিসাবের কী দরকার। উদ্ধার তারপর হাতের পুতুল বানানো বলে কথা।

তাই তড়িঘড়ি কোমর বেঁধে নামি। তার মাথার ওপর থেকে খড়গ নামাই – কিচ্ছু ভাইবো না। আমি আছি।

শফুরা হাঁড়িকাঠ থেকে মাথা তুলে আমার আরো গা-ঘেঁষে দাঁড়ায় – ঢাহায় মোর কেউ নাই। কাউরে চিনি না। আফনে মোরে বাঁচান…।

খাওয়া শেষ করে হাত ধুই। ব্যস, এখন সামনে তকেতকে মসৃণপথ। পা দিলেই বাধাবিপত্তিহীন গন্তব্য।

কিন্তু কীভাবে আগাই, কোন রথে চড়ি? বহুদিন আগে এক জমিদারের অদ্ভুত খেয়ালিপনার গল্প পড়েছিলাম। শহরের ওপরমহলে তার যাতায়াত। সেরা তন্বী-তরুণীদের সঙ্গে তার ওঠবস। কিন্তু তিনি তাদের কাউরে নিতেন না। বরং ঘরে ফেরার পথে রাস্তা থেকে কাউরে তুলতেন। বাসায় এনে দলাইমলাইয়ে ধুয়েমুছে তারপর বিছানায়।

সে-পথ কী ধরবো। ওই তো সামনেই ফার্স্টক্লাসের প্রশস্ত প্রসাধনকক্ষ। তাতে সাবান-শ্যাম্পু সব মওজুদ। ওর যা চেহারা-সুরত তাতে বেশি দলাইমলাইয়ের দরকার পড়বে না। এক ধোয়াতেই ফকফকায় হাসবে।

নাহ্! এতো কিছুর কী দরকার। হালিখানেক বছর আমার সঙ্গে সংসার শেষে চলে যাবার সময় মিলির বাতলে দেওয়া পথই তো সহজ, ঝুটঝামেলাহীন – ‘তোমরা পুরুষজাত! চিনতে বাকি নাই। তোমাদের কী চাই – একটা ফুটা। আর কিছুর কী দরকার।’ শাড়িপরা শফুরার নিশ্চয়ই তার অভাব হবে না।