স্থপতি মাজহারুল ইসলাম

আমীর হোসেন

BADC

সর্বজনশ্রদ্ধেয় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আজ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও স্থাপত্যজগতে তাঁর অস্তিত্ব কোনোদিন মুছে যাওয়ার নয়।
স্থপতি ইসলামের কর্মতৎপরতা তাঁর জীবিকা অর্জনের পেশার মধ্যেই সীমিত না থেকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তা সমাজজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল বিস্তৃত।
প্রধানত একই পেশাভুক্ত হওয়ার কারণেই স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে কাছে এবং দূরে থেকে যেভাবে দেখেছি তারই স্মৃতিচারণের আলোকেই তাঁর প্রতি আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। সালটা ১৯৬২। বর্তমান বুয়েটে তখন সদ্য স্থাপত্য অনুষদ খোলা হয়েছে। ভর্তিচ্ছুদের কিছুটা প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। সেই সন্ধানেই পরোক্ষ পরিচয় স্থপতি ইসলামের সৃষ্টি আর্ট ইনস্টিটিউট এবং নভেরার বিমূর্ত ভাস্কর্য-ছড়ানো তদানীন্তন পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে, গতানুগতিকতার বাইরে এক নতুন স্থাপত্য সংজ্ঞায়।
স্থপতি ইসলামের সঙ্গে আমার সামনাসামনি পরিচয় ১৯৬৩-তে। অনেক কাজের ভিড়ে যখন তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আমাদের পড়াতে এলেন Climatology, তখন তিনি চল্লিশ-ঊর্ধ্বে। প্রজ্ঞাময়, আকর্ষণীয় চেহারার চিরতরুণ, সদ্য সরকারি চাকরি ছেড়ে স্বাধীন  পেশা-চর্চায় নেমেছেন। যথেষ্ট ব্যস্ত এবং ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। পরনে সাদা ট্রাউজার ও বুশ শার্ট। প্রতিবাদী অথচ কথা বলেন মার্জিত স্তরের স্বরেই – সোজা ও শুদ্ধ উচ্চারণে, অবশ্যই বাংলায় এবং লক্ষণীয়ভাবে অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দ পরিহার করে। সার্বিকভাবে নিঃসন্দেহে এক চুম্বক ব্যক্তিত্ব।
এরপর ১৯৬৭ সালের শেষভাগে স্থানীয়ভাবে স্নাতকপ্রাপ্তদের মধ্যে সর্বপ্রথম পূর্ণকালীন ভিত্তিতে তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘বাস্তুকলাবিদে’ যোগদানের মাধ্যমে তাঁকে দেখলাম কাছ থেকে, প্রধানত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত হয়ে। ততোদিনে স্থপতি ইসলাম এদেশের পেশাচর্চার ক্ষেত্রে তুঙ্গ অবস্থানে। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্ব তাঁর ওপর। NIPA, Science Laboratory, Eastern Federal Union ভবন, রূপপুর আণবিক শক্তি কেন্দ্র, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, পাঁচ পলিটেকনিক, আরো কত। তিনি তখন Institute of Architects Pakistan-এরও সভাপতি। আরো অনেক স্থপতি যোগ দিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ স্বনামধন্য।
স্থপতি ইসলামের সঙ্গে প্রায় আড়াই বছর সম্পৃক্ত থেকে তাঁকে দেখেছি, ব্যক্তি ইসলামের মতোই স্থাপত্যেও তিনি কি form, কি বিন্যাস, কি নির্মাণপদ্ধতি ও সামগ্রী নির্বাচন, কি নান্দনিকতায় সর্বত্রই শুদ্ধতা ও ব্যাকরণসম্মত পথের নিষ্ঠাবান অনুসারী। পেশাচর্চায় আপসহীন ও দ্বিধাহীন। প্রথমে প্রকৌশলী এবং পরে স্থপতি হয়েছেন – এমন পরিচিতজনের মধ্যে একমাত্র মাজহারুল ইসলামকেই দেখেছি কোনো পিছুটানে না ভুগতে – যাকে বলে পরিপূর্ণভাবে স্থপতি হয়ে ওঠা। সামান্যতম কাঠামো বিষয়েও তিনি স্মরণ করতেন প্রকৌশলী এসএম শহীদুল্লাহকে। আত্মসম্মানবোধ তাঁর প্রখর। সেটা শুধু নিজের জন্য নয়, সব পেশাজীবীর ক্ষেত্রেও।
কথাবার্তায় ও মতপ্রকাশে তিনি সরাসরি। কিছুটা চাঁছাছোলা। তাঁর এক সময়ের সহযোগী প্রয়াত কালাম সাহেব থেকে শোনা একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। আলীজান ইস্পাহানী এসেছেন তাঁর কাছে বাড়ির ডিজাইন করাতে। শোবার ঘরের পরিসর বড়সড় চান এ-কথা বোঝাতে উল্লেখ করে ফেলেছেন বোধ হয় 20 x 30। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের তাৎক্ষণিক বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা ‘ওখানে শোবেন, না ঘোড়দৌড় করাবেন?’ রসিক তিনি অবশ্যই।Wrong Number-এ ফোন এসেছে ফরহাত মঞ্জিলে, প্রশ্ন, ‘এটা কি Pak Tobacco?’ উত্তর, ‘না, এটা গাঁজার আড়ত হয়ে ওঠেনি এখনো।’ এটা আমার নিজের শোনা।
স্থপতি ইসলাম এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁকে আবিষ্কার করা যায় দুর্মুখের মুখেও। একবার এমনই এক দুর্মুখ এসে জানাল, ইসলাম সাহেবের বাস্তুকলাবিদ এখন ‘নৃত্যকলাবিদ’ হয়ে গেছে। তথ্যসন্ত্রাসে আসল ঘটনা উদ্ঘাটিত হলো এভাবে, ছায়ানটের স্থান-সংকট চলছিল, স্থপতি ইসলাম স্বভাবতই সাহায্যের হাত প্রসারিত করলেন তাঁর ফরহাত মঞ্জিলের দ্বার অবারিত করে। বাস্তুকলাবিদ থেকে ছায়ানটের নৃত্যগীতের সুর ও ছন্দ ভেসে গেল পরীবাগে। অতএব দুর্মুখের মতে, বাস্তুকলাবিদ নৃত্যকলাবিদ হয়ে গেল। মাজহারুল ইসলামের মহত্ত্ব ওখানেই।
বাস্তুকলাবিদ ছাড়ার এত বছর পরও আজো মনে পড়ে Design Development-এর কোনো কাজ নিয়ে তাঁর কাছে আলোচনায় এলে তা তাঁর মনমতো না হলে এই বুঝি তাঁর পরিচিত অভিব্যক্তিতে ডান হাতের তালু উলটে বলবেন, ‘এটা কি হলো কিছু?’
স্থাপত্য পেশাচর্চায় সচেতনতা ও সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টিতে স্থপতি ইসলামের অগ্রণী ভূমিকা, সেটা শুরু থেকে তাঁর অনুপস্থিতির মাঝে হলেও, আজো অব্যাহত। বিশ্বের স্থাপত্য-মানচিত্রে ঢাকার অবস্থান চিহ্নিত হতো কিনা সন্দেহ, যদি লুই কানকে স্থপতি নির্বাচনে স্থপতি ইসলামের প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক প্রকল্পে তাঁর পরামর্শলাভের দ্বার ছিল সর্বদাই অবারিত।
মূলত তিনি প্রতিবাদী। পেশা ছাড়াও সমাজজীবনে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশে তিনি সর্বদাই নিঃসংকোচ ছিলেন। এর খেসারতও গুনতে হয়েছে তাঁকে। ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হওয়ার কারণেই তিনি কর্মহীন থেকেছেন বহুদিন।
সবশেষে, এই দেশের স্থাপত্যপেশার অভিভাবক হিসেবে, সমাজের সর্বস্তরে সর্বকর্মে সুরুচি, শুদ্ধতা ও শুভবুদ্ধির কাণ্ডারি হিসেবে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের অবদান কোনোদিন ফুরোবে না। তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল পরম শ্রদ্ধা আর প্রাণঢালা আন্তরিক সম্মান।