স্বকীয় ও বহুমুখী চিন্তার শীলিত প্রকাশ

সালাহউদ্দীন আইয়ুব

 নির্বাচিত প্রবন্ধ
শামসুজ্জামান খান
বিজয় প্রকাশ
ঢাকা, ২০১১
৪০০ টাকা
 

শামসুজ্জামানের কথা তোলা মাত্র মনে পড়ে বর্ধমান হাউসের দোতলার একটি ঘর এবং তার ভেতর এইমাত্র ধূমপান-সেরে-আসা এক পরিতৃপ্ত প্রসন্ন মুখ। দু-একবার এদিক-ওদিকের কোনো কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছি হয়তো, কিন্তু দোতলার ওই কক্ষটি বাদ দিয়ে জামান ভাইয়ের কথা ভাবা যায় না। দেশ ছেড়ে আসার পর তিনি প্রথমে শিল্পকলা একাডেমী ও পরে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হয়েছিলেন বলে শুনেছি; কিন্তু বর্ধমান হাউসের ওই কামরা, এক অতিকায় টেবিল ও তার ওপর স্তূপাকার কাগজপত্র-ফাইল, একটি কালো ব্রিফকেস এবং সংলগ্ন চেয়ারে বসে থাকা দু-একটি চেনা-অচেনা মুখ; জামান ভাইয়ের প্রসঙ্গ উঠলে এই সাধারণ দৃশ্যপটই আমার মনে পড়ে। জামান ভাইকে তাঁর নিজের বড় চেয়ারটিতে আমি কখনো বসতে দেখিনি। মোটের ওপর এক লেইড-ব্যাক, মৃদুভাষী, প্রফুল্ল কিন্তু অনুচ্ছ্বসিত মানুষ হলেও, ভাবনা-বাহিত কোনো প্রসঙ্গ ওঠা মাত্র তাঁর চোখ ও চোয়ালের অন্তরালে স্নায়ুর আন্দোলন টের পেতাম।

নববইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলা বিভাগ থেকে পাশ করে আমি যখন লেখালেখি করে এদিক-ওদিক কখনো ঘুরে, এবং প্রায়ই উড়ে বেড়াচ্ছি, তখনই কোনো এক লেখার সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। কারো কারো কাছে তাঁর কথা শুনেছিলাম তো বটেই; কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও উত্তরকালীন অন্তরঙ্গতা কারো মধ্যস্থতায় ঘটেনি। সুন্দরমে একটি রিভিউ লেখার পর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বাংলা একাডেমীর কোনো একজনের কাছে আমার জন্যে একটি চেক রেখে যান। কোনো এক ভরদুপুরে তাঁর অফিসে ঢোকামাত্র জামান ভাই ওই টাকার সংবাদ দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে। জামান ভাইয়েরই উৎসাহে পরে সুন্দরমে অরিয়েন্টালিজম নিয়ে একটি লম্বা গদ্য লিখি।

তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক হলেও নববইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমার পেশাগত জীবনের সাময়িক অনিশ্চয়তা তাঁকে ভাবিত করে। ঠিক ওই সময়ে ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে ফোকলোর গবেষণার জন্যে তিনি একটি অনুদান পান এবং আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রকল্পে নিয়োগ করেন। এই সামান্য ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে আমার জীবন যে আমূল পরিবর্তিত হবে, সে-কথা আমাদের দুজনের পক্ষে জানা সম্ভবপর ছিল না।

জামান ভাইয়ের কারণে ফোকলোর গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত হলেও এবং সেই সূত্রে পরে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান ফোকলোর বিশেষজ্ঞ হেনরি গ্লাসির সঙ্গে পরিচয় ঘটলেও ফোকলোর সম্পর্কে সেসময়ে আমার কোনো উৎসাহ ছিল না। বাংলা বিভাগে পড়ার সময় ফোকলোর থেকে শতহস্ত দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। অনুৎসাহের কারণ নিয়ে বিশেষ ভেবে দেখিনি; জামান ভাই ব্যাখ্যা করে না দেখালে, ‘কারণ’ নিয়ে কোনোদিন হয়তো মাথাও ঘামাতাম না। তাঁর কথা হলো, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকেরা ফোকলোর নিয়ে চর্চা ও গবেষণা না করার ফলে এ-ক্ষেত্রটি কখনই আমার মতো তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। এ-ও বলেন যে, অন্তর্গত গুণ বা দোষের কারণে কোনো ‘বিষয়’ গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন হয় না। ‘বিষয়’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রতিভাবানের হস্তক্ষেপে; প্রতিভাহীনের হস্তক্ষেপে ঘটে তার উলটো। বাংলাদেশে ফোকলোর গবেষণায় সীমিত অর্জন, তাত্ত্বিক দারিদ্র্য ও বিপুল ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে তাঁর যুক্তি না মেনে উপায় নেই। ফোকলোরের কথা উঠলে কাদের নাম ও মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে একবার ভেবে দেখুন।

বাংলাদেশের প্রতিভাবান লেখকেরা ফোকলোরে অনাগ্রহী হওয়ার পরিণতি কী, তার একটা উদাহরণ দিই। বাংলা একাডেমীর ফোকলোর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও শিল্পকলা নিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একখানা গ্রন্থ রচনা করেন, যা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে (১৯৯৭) ও পরে বাংলা একাডেমী থেকে (২০০০) প্রকাশিত হয়। শুধু শিল্পকলা, সংস্কৃতি, কিংবা ফোকলোর নয়, বাংলাদেশ বিষয়ে এরকম বই যে বিদেশেও লেখা হয়নি, সেটা পশ্চিমে এ-নিয়ে যে কয়টি রিভিউ বেরিয়েছে, তা থেকেও পরিষ্কার। এখানে এটি কারো পড়া দূরে থাক, বইটির কথা কেউ শুনেছেন কি না সন্দেহ। না শোনাই স্বাভাবিক কেননা একদিকে বাংলা একাডেমীর পুস্তক মুদ্রণ ও প্রকাশন বহির্জগতের সংস্রবমুক্ত, বিশুদ্ধ, আন্ডারগ্রাউন্ডের ব্যাপার (গোয়েন্দা না লাগিয়ে যার হদিস পাওয়া অসম্ভব); অন্যদিকে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, ফোকলোর সম্পর্কে তাঁদের কিঞ্চিৎ উৎসাহ যদি থাকেও, এই এলাকায় গৌণ, মাঝারি ও অনুজ্জ্বলদের বিচরণের ফলে, সেই উৎসাহ বেশিদিন ধরে রাখা কঠিন।

শক্তিমান আধুনিকদের ভেতর একমাত্র বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ফোকলোর নিয়ে একখানা বই এবং কতিপয় অনবদ্য গদ্য লেখেন। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান নিয়ে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটো বইতে লোকশিল্পের বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় বিশ্লেষিত। কিন্তু তাঁর ওসব কাজ অভিনিবেশ সহযোগে কেউ পাঠ করেননি; তাঁর গদ্যের ইঙ্গিত, পশ্চিমের সমকালীন নানা জটিল চিন্তাস্রোতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, বাংলা শিল্প-সাহিত্যের পটভূমিকায় জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে একেবারেই ভিন্নভাবে হাজির করার প্রয়াস লোকজন খুব একটা বোঝেন কিনা আমার সংশয়।

দুই

অ্যালান ডান্ডেস, লাওরি হংকো, কিংবা হেনরি গ্লাসির মতো ফোকলোরবিদদের বাংলা একাডেমীতে আমন্ত্রণ করে আনার পেছনে শামসুজ্জামান খানের লক্ষ্য ছিল বাংলা ফোকলোরচর্চায় একটা পরিবর্তন আনা। তাঁর সময়ে একাডেমী থেকে হেনরি গ্লাসির গ্রন্থ ট্রাডিশনাল আর্ট অফ ঢাকা (২০০০) প্রকাশ এই ক্ষেত্রে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই অসাধারণ বইটির জন্যে ড. গ্লাসিকে এখনো বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট কেন দেয়নি, তা আমার বোধগম্য নয়।

জামান ভাইয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ড. গ্লাসির নেতৃত্বে জাতীয় জাদুঘরে বাংলাদেশের সমকালীন ঐতিহ্যধারার কাজের একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সংগ্রহ স্থায়ী গ্যালারিতে স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এটি একটি বিপ্লবাত্মক কাজ। এজন্যে শামসুজ্জামান খান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু আমার ধারণা, এর গুরুত্ব অনুধাবনের জন্যে যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ ও বিকল্প শিল্পচিন্তার সঙ্গে পরিচয় দরকার, সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে তা দুঃখজনকভাবে বিরল। স্থায়ী গ্যালারিতে লোকশিল্পকে স্থায়ী আসন প্রদানের এই প্রয়াসের মধ্যে গ্লাসির শিল্পচিন্তার একটি গভীর বিশ্বাস পরিব্যক্ত। গ্লাসির দৃঢ় বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও ফোকলোরকে বাদ দিয়ে শিল্পের ধারাক্রম ও শিল্পের তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়। তিনি বলতে চান, কোনো কিছুর ‘পরিবর্তন’ তো গরুর চোখেও ধরা পড়ে, মূঢ়েরও অগম্য নয়; ইতিহাসের অনুধ্যানে প্রয়োজন হলো যা (আপাতদৃষ্টিতে) ‘পরিবর্তিত’ তার মধ্যে ‘অপরিবর্তিত’কে শনাক্ত করা; সেই অপরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করা; তার পরিণাম বিবেচনা করা। শিল্পের ভেতর, ইতিহাসের ভেতর, মূর্তি, কাঁথা ও কলসের ভেতর কী সেই শক্তি যা ‘পরিবর্তন’কে প্রতিরোধ করতে চায়? এই শক্তিকে তিনি বলেন ‘ঐতিহ্য’ অবিরলভাবে যা উপস্থিত যেমন ব্যালিমেননে, তেমনি বাংলাদেশে : ইতিহাসের গভীরে ‘ঐতিহ্য’ নামক এই শক্তির অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতির কারণে ইতিহাসে তিনি ‘পরিবর্তনে’র চেয়ে বেশি দেখেন ‘ধারাবাহিকতা’। সব শিল্পই হেনরি গ্লাসির কাছে ঐতিহ্যগত; সব ইতিহাস ধারাবাহিক। শিল্পের ব্যাখ্যায় কেবলই নতুনত্বের সন্ধান কিংবা ইতিহাসের আলোচনায় শুধু পরিবর্তনের জরিপে তাঁর উৎসাহ নেই। ক্লোদ লেভি-স্ত্রোস ও ফার্নান্দ ব্রদেল দ্বারা প্রভাবিত হলেও (প্রভাব তাঁর প্রথমদিককার কাজে সম্ভবত বেশি, পরের দিকে কম), হেনরি গ্লাসির ঐতিহ্যের ধারণা, শিল্পকলার বিশ্লেষণ এবং ইতিহাসতত্ত্ব ও তার প্রয়োগ যেমন মৌলিক তেমনি র‌্যাডিক্যাল। অন্যদিকে তুলনীয় গবেষকের নজির বিরল না হলেও হেনরি গ্লাসির মতো গদ্য লিখতে পারেন, ফোকলোরে ওরকম কেউ আগেও ছিল না, এখনো নেই।

বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চায় সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে গবেষণার এই স্বচ্ছন্দ সহবাস, এই বিরল বিরোধহীন অন্বয়ের সম্ভাবনা দেখতেন শামসুজ্জামান খান। সৃষ্টিশীল তরুণ প্রতিভার হস্তক্ষেপে ফোকলোরচর্চার আমূল রূপান্তর ও বৈপ্লবিক বদল ছিল তাঁর কাম্য। শুধু ফোকলোরচর্চার খাতিরে ফোকলোরচর্চায় তাঁর উৎসাহ আমি কোনোদিন দেখিনি। বর্ধমান হাউসের পরিচালকের ঘরটিতে সিগারেট ধরানোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক উদ্যোগী ফোকলোর গবেষকের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে দেখেছি; কে কোথায় কী নিয়ে ফোকলোরে কাজ করছে, তার কিছুই তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু আমি জানি ওসব সন্দর্ভ ও অভিসন্দর্ভের একটি ব্যাপক অংশকে তিনি তখনো যেমন এখনো তেমনি সমান অবাঞ্ছিত মনে করেন।

তিন

শামসুজ্জামান খানের চিন্তাধারার স্বকীয়তা ও বহুমুখিতা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত নির্বাচিত প্রবন্ধের প্রতিটি গদ্যে উদ্ভাসিত। এই স্বকীয়তা অবশ্য বইটির বিষয়সূচি দেখে বোঝার উপায় নেই। বিষয়সূচির ব্যাপকাংশ পরিচিত বটে কিন্তু এর বিষয়বস্ত্ত নতুন : বইয়ের প্রতিটি লেখায় নতুন ধরনের চিন্তার উপস্থিতি যেকোনো চিন্তাশীলকে উত্তেজিত করতে সমর্থ। যদিও নির্বাচিত প্রবন্ধের বাইরে তাঁর কাজের পরিমাণ বিপুল, তবু এ-বইটি হাতে না এলে তাঁর স্বকীয় চিন্তা, তাঁর সমস্ত বোধগম্য সংহতিসমেত, হয়তো আমার চোখে ধরা পড়ত না।

বইটি ওলটাতে গিয়ে তাঁর শহীদুল্লাহ-সম্পর্কিত লেখাটিতে আমার চোখ পড়ে। এটি আগে কোথাও পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। প্রবন্ধটি পড়ার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তাপ বোধ করার পাশাপাশি আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছি যে, বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে শামসুজ্জামান খানের চিন্তা বিশিষ্টভাবে স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য অনুধাবনের জন্যে আমি এক বৈঠকে বইটি পড়ে শেষ করি।

বাঙালি মুসলমানের চেতনার রূপ-রূপান্তর, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ শামসুজ্জামান খানের সকল অনুসন্ধানকে যেন অধিকার করে রাখে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক বিকাশের বৃত্তান্ত রচনা তাঁর লক্ষ্য নয়। ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী তিনি ইতিহাসনিবিড় ভাবুকতায়; হিস্টরির চেয়ে হিস্টরিওগ্রাফিতে তাঁর মনোযোগ। সেজন্যে এ-বইয়ের ইতিহাসনিবিড় গদ্যগুচ্ছে তিনি যা বলতে চান, ইতিহাসের বইপত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষীণ। এ-বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলমানের আধুনিকতার পুনর্ব্যাখ্যান জরুরি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জসীমউদ্দীন কিংবা মীর মশাররফ হোসেনকে যে আমরা ঠিকমতো বুঝিনি, তাঁর লেখা পড়ে আমি নিঃসন্দেহ।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আধুনিক বা সেক্যুলার ছিলেন কি না, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন হায়াৎ মামুদ। হায়াৎ মামুদের লেখাটি বেরোনোর পর আমি পড়েছিলাম; জিজ্ঞাসা পত্রিকায় শিবনারায়ণ রায় লেখাটির যে সমালোচনা লেখেন, তা-ও। শামসুজ্জামান খানের মতে, শহীদুল্লাহ নিয়ে এ-ধরনের প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার পরিচয়বাহী :

আমাদের সমাজ-বাস্তবতার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন এবং বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয়,  মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত বিবেচনার মধ্যে রেখে গোটা উপমহাদেশ, বিশেষত বাংলার রাষ্ট্রীয় জীবন ও রাজনীতির প্রতিক্রিয়া, অস্থিরতা ও স্থিতিহীনতা-পূর্ণ পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরনকে বোধের মধ্যে না আনতে পারলে একজন সচেতন ও সদাজাগ্রত বুদ্ধিজীবীর মানসিক দোলাচল ও পরস্পরবিরোধী কর্মকান্ডকে উপলব্ধি করা যায় না। এজন্যেই শহীদুল্লাহ-মূল্যায়নে তাঁর নেতিবাচক ও রক্ষণশীল দিকই বিভিন্নভাবে প্রাধান্য পেয়ে যায় (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃ ১৯১)।

ফালতু প্রশ্ন বাদ দিয়ে শহীদুল্লাহকে শামসুজ্জামান খান চিহ্নিত করেছেন ‘এক দ্রোহী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে। এই চিহ্নিতকরণ নতুন, বৈপ্লবিক : শহীদুল্লাহর মূল্যায়নের চেয়েও এর মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক টেক্সটকে নতুনভাবে পাঠ করার প্রত্যয় ব্যক্ত। ইতিহাস যে তিনি লিখতে বসেননি, তাতে সংশয় নেই। তিনি আগ্রহী ইতিহাসের অধিবিচারে : পরিচিত আখ্যানের নতুন ভাষ্য প্রস্তাব করবার কারণে তাঁকে আমরা সমকালীন চিন্তাশীলদের সহযাত্রী হিসেবে শনাক্ত করতে পারি। টুপি, দাড়ি, আলখেল্লার নিচে শহীদুল্লাহর বৈপ্লবিক চিন্তাশীলতার সঠিক রূপটি যে বিস্মৃত হয়েছি, খান সাহেব বেশ খোলাসা করেই তা বয়ান করেছেন। ‘অতি বাঙালি’ ও ‘অতি প্রগতিশীলতা’র ব্যাধি যে সত্যানুসন্ধানের অন্তরায়, তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি হায়াৎ মামুদের লেখাটির উল্লেখ করেন।

যে শহীদুল্লাহকে পূর্ববাংলার গভর্নর ফিরোজ খান নূন ‘ট্রেইটর’ বলে গাল দেন; যে শহীদুল্লাহ তবলীগ সমিতি ও ইশআতের ধর্মপ্রচার বাদ দিয়ে নিঃস্ব মানুষজনের প্রতিদিনকার ‘হাবিয়া দোজখ’ নেভানোর আহবান জানান; মাদ্রাসার তালেব-এলেমদের ওজিফা ও নফল নামাজের বাড়াবাড়িকে কটাক্ষ করে তার বদলে জ্ঞানচর্চায় নিযুক্ত হতে বলেন; পরহেজগার বান্দাদের জিকির-তসবি ছেড়ে ‘বিশ্বের সেবা’র মতো ‘ইবাদতে’ মশগুল হতে বলেন; কুমিল্লার এক শিক্ষক সম্মেলনের (১৯৫১) ভাষণে যিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার বাঙালীর ওপর বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা চাপালে, তা পূর্ব বাংলায় গণহত্যার শামিল হবে’ (পৃ ১৯৫)… তাঁর বাঙালিত্ব নিয়ে কথা তোলা লজ্জার বিষয়। সেই ১৯৪৮ সালেই কার্জন হলের এক সাহিত্যসভায় যে-শহীদুল্লাহ ‘হিন্দু-মুসলমান জিন্দাবাদ’ বলে ভাষণ শেষ করেছিলেন (পৃ ১৯৫), বাঙালি মুসলমানের আইডেনটিটি নিরূপণ ও বিকাশে তাঁর ভূমিকাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা আমাদের দরিদ্র ইতিহাসবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তির দীনতার সাক্ষ্যবাহী। শামসুজ্জামান খানের পর্যবেক্ষণ অব্যর্থ : বাংলাদেশে আজকে আমরা যে এইসব উদ্ভট তর্ক তুলতে পারছি, সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটির কল্পনা, শহীদুল্লাহর সেই ১৯৪৮-৫১ সালের লেখাজোখা ও  বক্তৃতা-ভাষণে আভাসিত।

বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিভিন্ন বৈপরীত্য ও অসংগতি কেন এক বৃহৎ জটিল সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার পরিণতি, শামসুজ্জামান খান এ-গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে তা ব্যাখ্যা করেন। বাঙালি মুসলমান কোনোদিনই যে ওরকম কেতাবি অর্থে আধুনিক ছিল না, এবং হওয়ার দরকারও নেই, একরম একটি সংবাদ তাঁর লেখাগুলো থেকে উদ্ধার করা যায়। এই অবলোকনের তাৎপর্য আছে। তাঁর কৈশোরে কবি জসীমউদ্দীন গ্রামে গিয়ে এক বৈঠকে বিলাতভ্রমণের গল্প শেষ করে একটি প্রাকৃতিক, কিন্তু অনুচ্চার্য, কর্মের জন্যে উসখুস করছিলেন : পল্লীকবির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে উল্লেখকে আমার মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলমানের আধুনিকতার এক ইঙ্গিতময় উৎপ্রেক্ষা।

অ্যাকাডেমিক লোকজন বহুকাল ধরে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস নিয়ে লেখাজোখা করে এসেছেন বলে কেউ বইটির বিষয়সূচিতে সনাতনী গন্ধ পাবেন কি না তা ভেবে কথাগুলো তুললাম। শামসুজ্জামান খানের কৃতিত্ব হলো সনাতন বিষয়ের ফ্রেম বদলে ফেলা : আলোকপাতের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটানো। স্বভাবতই তাঁর পদ্ধতি তুলনামূলক : বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যা ঘটেছে, পৃথিবীর অন্য জায়গার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যে তার তুলনা সম্ভবপর, তা তিনি দক্ষতার সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অপ্রাপ্তবয়স্ক চরমতার পরিপন্থী; অনেক কিছু জেনে, অনেক অভিজ্ঞতার সমাবেশে, বহুদিক থেকে সফল একটি জীবনযাপন করে এসে যে তিনি কথা বলছেন, প্রতিটি লেখায় তার নজির দেখি। ইতিহাসের বড় ঘটনার বৃত্তান্তে তিনি পরিচিত বীর ও লোকপ্রিয় নায়কের পাশাপাশি মার্জিনাল মুখ ও বেগানা চরিত্রের উল্লেখে দ্বিধা করেননি। স্যার সৈয়দ আহমদের কথা বলতে গিয়ে টিপু পাগলা ও দুদু মিয়ার কথা ভোলেননি; চৈতন্যদেবের উল্লেখের পর আহমদউল্লাহ মাইজভান্ডারীর কথা মনে করিয়ে দেন; সামাজিক জাগরণে স্কুল-কলেজের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে ‘পতুয়া সাহিত্যে’র কথা বিস্মৃত হননি; চন্ডীদাসের বহুশ্রুত পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করবার সময় চট করে মনে করিয়ে দেন নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কবি জালাল খাঁর অজেয়, লোকায়ত উচ্চারণ, ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে?’ (পৃ ১৯); বেগম রোকেয়া কিংবা শামসুন্নাহার মাহমুদের কথা যখন এসেছে, তখন সমান দরদ নিয়ে উচ্চারণ করেছেন লীলা নাগের নাম, বলেছেন তাঁর দীপালি সংঘের কথা – নারীশিক্ষার দীপালোক নিয়ে, দীপাধারপ্রতিম যে সংঘ বিশ ও তিরিশের দশকে, আমাদেরই ঢাকা শহরে, চারখানা বালিকা বিদ্যালয়কে আলোকিত করে তুলেছিল।

প্রথম জীবনে সাহিত্য অধ্যাপনার পর উত্তরকাল বর্ণাঢ্য প্রশাসনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ভরপুর এক সপ্রতিভ, ছিমছাম আখ্যানের মতো শামসুজ্জামান খানের জীবন। যাঁরা তাঁকে আমার চেয়েও অনেক বেশি কাছ থেকে দেখেছেন, যাঁরা তাঁর অনুজ, যাঁরা সতীর্থ, তাঁদের কাছ থেকে তাঁর জীবনের অন্যান্য প্রান্ত সম্পর্কে অনেক কথা জানা যাবে। তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের হলেও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার বয়স দুবছরের বেশি নয়। নববইয়ের মাঝামাঝি দেশ ছাড়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি; ফোনেও কথা হয় মাত্র একবার। কিন্তু, তবু, তাঁর লেখা পড়তে পড়তে আমার বারবারই মনে পড়ছে তাঁর শালীন, সম্ভ্রান্ত, অনুচ্ছ্বসিত কিন্তু প্রীতিকর, খোশমেজাজ ব্যক্তিত্বের কথা। তাঁর এই ব্যক্তিত্বের ছাপ ভাবনায় পড়েছে, নাকি ভাবনার ছাপ ব্যক্তিত্বে ব্যঞ্জিত, তা বলা মুশকিল। তবে তাঁর লেখার মধ্যে অভিব্যক্ত শীলিত ভাববৃত্তিতে আমরা যা পাই, তাকে বলতে পারি ভার্চুয়াসিটি। বাঙালির ভবিষ্যতে বিশ্বাসী ও আস্থাশীল শামসুজ্জামান খান এমন এক সমন্বিত সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখেন, যার উন্মেষ ঘটেছিল, তাঁর মতে, তেরো- চৌদ্দ শতকের সুলতানি আমলে বাংলায়। এই স্বপ্নের ভেতরে অন্তর্লীন, আমি মনে করি, এক প্রাজ্ঞ ফোকলোরবিদের পরিণত মানসলোক; যিনি বলতে চান : বহমান বাঙালি ঐতিহ্যের সমন্বয়বাদী ধারার পুনরুত্থান ও পুনরুজ্জীবন অপরিহার্যই শুধু নয়, সেই বহুস্তর সাংস্কৃতিক প্রজেক্টে আমাদের অংশগ্রহণ, লিপ্ততা ও গুণাগুণের মাপকাঠিতে নির্ধারিত হবে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্য ও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।