স্বচ্ছ মননের হাওয়া

সৌভিক রেজা

প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের (১৯৩২-২০১৬) কথা ভাবতে গেলেই কপিল ভট্টাচার্যের (১৯০৪-৮৯) কথা মনে না-পড়ে যায় না। এমন তো নয় যে, পিতার সূত্রেই পুত্রের পরিচয়টা বড় হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায়, কিংবা, পুত্রের সূত্রে পিতার পরিচয়টা বড় হয়ে ওঠে। না, তা নয়। বরং, বলা যায় যে, পিতা-পুত্র দুজনেই নিজের নিজের মতো করে যার-যার কাজের ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশে, কপিল ভট্টাচার্যের কথা খুব বেশি জানাশোনা না-থাকলেও নদ-নদী-বাঁধ – এসব কারণে এখন নতুন করে আবার তাঁকে আমাদের জেনে নিতে হচ্ছে; তাঁর বইপত্র-লেখালিখির কাছে যেতে হচ্ছে। অনেকটা নিজেদের একান্ত গরজেই। তাঁর বাংলা দেশের নদ-নদী পরিকল্পনা (প্রথম প্রকাশ ১৯৫৪) ছিল একটি ‘যুগান্তকারী গ্রন্থ’। উলেস্নখ করার মতো আরেকটি গ্রন্থ – স্বাধীন ভারতে নদ-নদী পরিকল্পনা (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬)। এই দুটো বই-ই বাংলাদেশ থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। নদীশাসন পরিকল্পনা, নদীতে বাঁধ-নির্মাণ – এসবের বিরুদ্ধে কপিল ভট্টাচার্য আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ‘একজন নদী-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কপিল ভট্টাচার্য সর্বদা উপলব্ধি করেছেন, নদী এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রাণ। এর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিন্ত করা সম্ভব।’ শেফালি মৈত্রকে লেখা এক চিঠিতে, পুত্র প্রদ্যুম্ন তাঁর পিতার বিষয়ে, বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের নদ-নদীর রীতি-নীতি নিয়ে তিনি (কপিল ভট্টাচার্য) দীর্ঘদিন ধরে কাজকর্ম করছেন। বন্যার বিষয়ে তাঁর অনেক ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য, দেশকে অনেক খেসারত দিতে হলো নদী-পরিকল্পনার শোচনীয় ব্যর্থতা এইভাবে হাড়ে-হাড়ে টের পাবার জন্য।’ পিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটুও বাড়িয়ে বলেননি প্রদ্যুম্ন!

 

দুই

অন্যদিকে, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য সম্পর্কে তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতিমা ঘোষ জানিয়েছেন, ‘নানা কারণেই প্রদ্যুম্ন থাকত একটু দূরে। …প্রদ্যুম্ন এম.এ. করেছিল তিনটে বিষয়ে – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর বাংলা, তারও পর ইংরেজি। সেদিনকার এক বিরাট ঘটনা ছিল ভারতকোষ। প্রদ্যুম্ন ছিল তার সহ-সম্পাদক। তারই গুণে সাহিত্য পরিষদে জড়ো হয়েছিল গোটা বিদ্বৎসমাজ। নিজে কথা বলত কম, মন দিয়ে শুনত অন্যদের কথা। সবাইকে অনুপ্রাণিত করার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ওর ছিল। পরে গবেষণা করেছে Centre for Studies in Social Sciences-এ আর ইংরেজি পড়িয়েছে নৈহাটি কলেজে। কথা যেমন কম বলে, লেখেও কম, কিন্তু অনেকদিন পর পর লেখা তাঁর কয়েকটি মাত্র প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত টীকাটিপ্পনী আশ্চর্য একটা স্মরণীয় বই। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, লোকসংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, সাহিত্য – সমস্ত একসঙ্গে মেলানো প্রাজ্ঞমনের লেখা।’ প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের প্রথম বই টীকাটিপ্পনী প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। যখন কিনা তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি বছর। এর পরে  ২০১৪ সালে বের হয়েছে আখ্যান ও সাহিত্য : তারাশঙ্করের মতো গ্রন্থ। তারও আগে তারাশঙ্করের শতবর্ষপূর্তিতে সম্পাদনা করেছিলেন, সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত, তারাশঙ্কর : ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য (২০০১)। সাহিত্যপত্রের সম্পাদনার ভার প্রদ্যুম্নের ওপরও বর্তায়। এই মানুষটির ওপর কবি বিষ্ণু দে ভরসা করতে পেরেছিলেন। তাতে যে কিছু ভুল করেছিলেন, সেটি মনে হয় না।

দীর্ঘ জীবনে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য লিখেছেন খুবই কম। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘আমাদের চটজলদি রচনাশীলতার জগতে, পরিমাণ বা সংখ্যাই যেখানে গুরুত্বের নির্ধারক, সেখানে এই এক লেখক ছোট একটি প্রবন্ধ লিখবার জন্যেও সময় নেন বড়ো বেশি। অত সময় কোথায় আমাদের? অত তাড়া-ই বা দেয় কে!’ শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকেই জানতে পারি, কোজিন্ত্সেভের কিং লিয়র প্রদ্যুম্নকে মুগ্ধ করেছে শুনে এর রিভিউ লিখে দিতে বলেছিলেন কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক। পরিচিতজনদের বিস্মিত করে দিয়ে প্রদ্যুম্ন তাতে রাজি হয়ে যান। বিস্মিত, কেননা কোনো লেখায় তাঁকে প্ররোচিত করা খুব শক্ত। তারপর, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়। লেখাটি পাওয়া আর সম্ভব নয় বলে বুঝতেই পারেন সম্পাদক, হাল তো কখনো কখনো ছেড়েই দিতে হয় তাঁদের। কিন্তু না, কথা দিয়ে না রাখবার লোক নন প্রদ্যুম্ন। দুবছর পর সন্তর্পণে সম্পাদকসমীপে হাজির তিনি সেই লেখা নিয়ে : ‘কিং লিয়র, সিনেমার কবিতা’। এতটা সময় নিয়ে ওর এই লেখালিখির কারণ বিশেস্নষণ করতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘এমন না হয়ে অবশ্য উপায় ছিল না, কেননা লেখাটা প্রদ্যুম্নের কাছে বানানো জিনিস নয়, লেখাটা তাঁর জীবনযাপনেরই একটা প্রতিফলন।’ আবার, শেফালি মৈত্র তাঁকে লেখা প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র সম্পাদনার সূত্রে জানান, ‘প্রদ্যুম্নদার জানার ঔৎসুক্য ছিল অপরিসীম। ওঁকে দেখলেই ‘আবোল তাবোলের ওই কথাগুলি মনে আসত : ‘গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কী করে,/ রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে।’ তবে ওনার এই ‘দেখা’টা অবশ্যই পুঁথিপড়া বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেখা মানে চোখ দিয়ে দেখা, চেখে দেখা, মেখে দেখা, শুঁকে দেখা। শরীর  যতদিন সতেজ ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতেন, আর কেউ ঘুরে এলে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতেন। প্রতিটি সফরের আগে তাঁর প্রস্ত্ততিপর্বটাই ছিল রোমাঞ্চকর। যে-যে জায়গায় যাবেন স্থির করতেন। রীতিমতো লাইব্রেরিতে বসে গেজেট পড়ে স্থানগুলির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন। স্থানীয় খাদ্য-পানীয়ের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান করে তবেই রওনা দিতেন।’ অন্যদিকে, শেফালি মৈত্রকে লেখা এক চিঠিতে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য নিজের স্বভাব-সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নীরবতা অনেক সময় আমার সাড়া দেবার রীতি, ধরন।’ ওঁর লেখালিখির বেলায়ও সেই ধরনটাই হয়তো ওঁকে কম লিখতে প্ররোচিত করেছে। হয়তো নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল তাঁর। তবে, প্রদ্যুম্ন এটিও বুঝতেন, ‘নিজেকে বেশি গুটিয়ে নিলে ধসে যাবার এই আশংকা খুবই সত্যি। মানুষ তো সঞ্চারধর্মী; নিঃসঙ্গ এবং মৌন হয়ে যাওয়া তাই মনুষ্যত্ব থেকে সরে যাওয়ার-ই নামান্তর। কিন্তু এক-একটা সময় আসে, যখন মানুষকে পা-বদের মতো সাময়িক অজ্ঞাতবাসে যেতে-ই হয়, বিপদের – ক্ষতির – ঝুঁকি যা-ই হোক, যতোই হোক। এই অজ্ঞাতবাসের পর্ব কতোটা নিজেকে সংহত করার কাজে লাগাতে পারা যায়, সেটাই আসল কথা।’

 

তিন

আগেই আমরা জানিয়েছি, কপিল ভট্টাচার্যের বই আমাদের ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের বইয়ের জগতের জন্যেও আরেকটি সুখবরই বলা যায় যে, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের টীকাটিপ্পনী বইটিও সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের ‘ভূমিকা’য় প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘কিছুদিন ধরে ভাবছি, আমার এই প্রথম বইটার কী নাম দেব? টীকাটিপ্পনী? নামটা মনে ধরল। সমাজ আর সংস্কৃতির সম্পর্ক, ভিতরের সম্পর্ক, কী – এই খোঁজ থেকে লেখাগুলো ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বিষয়টির গোটা বিশেস্নষণ এখানে নেই। নেই কোনও একটি স্থির প্রসঙ্গ ঘিরে প্রদক্ষিণ। যা পাবেন : কখনো এ-বিন্দু, কখনো ও-বিন্দু ধরে খানিক দূর অবধি পথ খোঁজা, পথ চলা। একনাগাড়ে নয়। টুকরো টুকরো ওই চলার রেখাগুলিই লিখতে চেয়েছি; বৃত্ত নয়, বৃত্তান্ত তো নয়ই।’ এর সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘বইটা উলটে পালটে পরিহাসরসিক পাঠক হয়তো মুচকি হেসে বলবেন, টীকার বহরটা বেঢপ। ঠিকই। এ বিষয়ে আমার কৈফিয়ৎ এই : পুরো বইটাই হয়তো সারি সারি টীকা আর টিপ্পনী। কখনো কায়েমি মতের ওপর; কখনো আমার নিজেরই আগেকার মতের ওপর; কখনো-বা আমারই অলিখিত বইয়ের ওপর। ফোড়ন কাটা আর কী। সংলাপই বলুন, আর আলোচনাই বলুন, ব্যাপারটা রান্নার মতন : ফোড়ন লাগে।’ অনেকটা কৈফিয়তের মতোন করে

প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য জানিয়ে রাখেন, ‘টীকার বহর বাড়ল দুটো কারণে। প্রথমত, প্রমাণ দাখিলের তাগিদে। দ্বিতীয়ত, ভাবনার বড়ো রাসত্মার পাশাপাশি কিছু অলিগলিরও খোঁজ দেওয়ার গরজে।’ শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘বছর দেড়েক আগে বাংলা একটি প্রবন্ধের বই ছাপা হয়েছে : ‘টীকাটিপ্পনী’। …আমার মনে হয়েছিল বইটি বেরবার সঙ্গে সঙ্গে শহরে বেশ-একটা হৈচৈ হবে। হৈচৈ মানে কি কোনো উৎসব? তা নয় ঠিক। চিন্তাভাবনায় যাঁদের আগ্রহ আছে, ভালো লেখা পড়বার জন্য প্রতীক্ষা আছে যাঁদের, বাংলা প্রবন্ধে মৌলিক কিছুই লেখা হয় না বলে বিলাপ করেন যাঁরা, ভেবেছিলাম তাঁরা হয়তো বইটিকে নিয়ে কথা বলবেন, তর্ক তুলবেন, আর সেই সূত্রে বীজগর্ভ এই বইখানিকে ভালোবাসবেন। কিন্তু এখনো সেই আলোড়নটা দেখতে পাওয়া গেল না।’ কথাটি বোধকরি সর্বাংশে ঠিক নয়। তাহলে তো, বইটির কথা বাংলাদেশেও কারো-কারো কাছে এভাবে ছড়িয়ে যেত না। কিংবা, বাংলাদেশ থেকে বইটির পুনর্মুদ্রণ হবার কথাও নয়। তেমন একটা হইচই হয়তো হয়নি; কিন্তু এটা তো সত্যি যে, বাংলাদেশের পাঠক-সমাজ প্রদ্যুম্নর বইটিকে ভালোবেসে, আগ্রহের সঙ্গে পড়েছে। আর সেই খবর প্রদ্যুম্নের কাছে গিয়েও পৌঁছেছে। এটুকু ভেবে সান্তবনা পাওয়া যায় যে, ওঁর লেখার এই সঞ্চারধর্মিতার বৈশিষ্ট্যটি, প্রদ্যুম্নে অন্তত নিজের চোখে, দেখে যেতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ-সংস্করণের ভূমিকায় প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর পড়ুয়া মানুষ ভালোবেসে ‘টীকাটিপ্পনী’ (প্রথম সংস্করণ) পড়েছেন শুনে আমি অভিভূত। এখন, বাংলাদেশে ‘টীকাটিপ্পনী’ প্রকাশ হওয়ার মানে বড়ো এক পাঠকসমাজের মাঝে তার নতুন জন্ম ঘটা।’

 

চার

শঙ্খ ঘোষ যথার্থই বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রবন্ধের জগতে এই এক সর্বনাশ যে এখানে প–তদেরই সঙ্গে কথা বলেন প–তেরা, উৎসুক সন্ধিৎসু সাধারণ পাঠকদের সঙ্গে কথা বলবার মতো মানুষজন প্রায় নেই।’ একে তাঁর মনে হয়েছে – যেন এক ‘দমচাপা জ্ঞান’। এর বিপরীতে টীকাটিপ্পনী সম্পর্কে তিনি জানান, ‘সেই দমচাপা জ্ঞানের আবহাওয়ার মধ্যে এ বই একটা খোলা হাওয়ার মতো। লেখক এখানে পাঠকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগন, তাঁর গদ্যের প্রত্যেকটি শব্দকে প্রায় কবিতার যত্নে চয়ন করে আনেন, সেই চয়নের মধ্যে দিয়ে তাঁর তথ্য আর যুক্তি সুঠাম এক সরলতায় বয়ে যেতে থাকে, পাঠকও তাই অন্তর্গত এক সংলাপ শুরু করে দেন সহজে।’

 

পাঁচ

‘পটুয়া এবং সময়’ প্রবন্ধে প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘ঐতিহ্যের মূল্য ব্যবহারে। পটুয়াদের ঐতিহ্য যে কী দীপ্যমান চিত্রকলার জন্ম দিতে পারে, যামিনী রায়ের ছবিই তার অকাট্য প্রমাণ। ভবিষ্যতের কোনো শিল্পী যদি দেশজ ঐতিহ্যের জমির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন চিত্রকলার সিংহদ্বার খুলতে চান, পটুয়াদের ছবি তাঁর হাতে চাবিকাঠির কাজ করবে। শুধু ছবির রাজ্যেই কেন, শিল্পকলার আরও বহুতর ক্ষেত্রেও নতুন-নতুন প্রবর্তনা জোগাতে পারে পটুয়াদের কাজ। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি করে মনে হয় সিনেমার কথা। সিনেমার সঙ্গে আংশিক মিলও আছে জড়ানো পটের। দীর্ঘ পটে পর-পর বিন্যস্ত ছবিগুলো খুলে-খুলে দেখানো হয় ক্রমশ। এতে থেকে-থেকে একধরনের গতির দোলা লাগে ছবিতে, ছবি হয়ে ওঠে চলচ্ছবি, আর তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে গানের-বাহনে-চড়া গল্প। আমার তো মনে হয়, জড়ানো পটের চলচ্চিত্রায়ণ সম্ভব! শুধু তা-ই নয়, জড়ানো পট থেকে নানান উপাদান নিয়ে রূপকল্পের পরীক্ষা করা যায় চলচ্চিত্রের জমিতে। ভাবতে অবাক লাগে চলচ্চিত্রের বাইরে থেকে, চৈনিক বা জাপানি চিত্রলিপি থেকে আইজেনস্টাইন মন্তাজ আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের পর সিনেমা পেল শিল্পের মহিমা, পালটে গেল তার ইতিহাস।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১৪)। সেইসঙ্গে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্করেরও যে পটুয়ার ভুবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল – সেই তথ্য জানিয়ে রাখেন প্রদ্যুম্ন।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের আন্তিগোনের অনুবাদের আলোচনার সূত্র ধরে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘বিশ্বসাহিত্যের চিরায়ত নাটক হিশেবেই ‘আন্তিগোনে’র অনুবাদযোগ্যতা অসামান্য। তাছাড়া গ্রীক মননের ধর্মই ছিল, যা বিশেষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাকে নিঃসক্ত, তন্নতন্ন বিশেস্নষণ করে নির্বিশেষ ও সাধারণ নীতিতে পৌঁছানো। সর্বকাল ও সর্বজনকে স্পর্শ করার গুণ তাই অন্যান্য গ্রীক নাটকের মতন ‘আন্তিগোনে’র প্রকৃতিগত। তবে আন্তিগোনে যেন অন্য নাটকের তুলনায় আরও তীব্রভাবে সমকালকে ছুঁতে পারে। ব্রেশ্ট হয়তো এই জন্যেই আন্তিগোনের ‘টপিক্যালিটি’র কথা বলেছিলেন। বলা যায়, ফ্যাসিস্ট-বিরোধী প্রতিরোধ-আন্দোলনের সময় থেকে আন্তিগোনে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে। এই নাটক তখন ইওরোপে বারংবার অভিনীত হয়েছে, মনুষ্যত্বের হন্তারক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের অপরাভূত সংগ্রামের আলেখ্য হিশেবে। …কতকগুলো বিষয় আছে – যেমন মনুষ্যত্ব, মানুষের জীবন বা তার অন্তিম সৎকার – যার মূল্য পরম, চূড়ান্ত ও অলঙ্ঘনীয় : ‘আন্তিগোনে’ নাটকের এই প্রজ্ঞা সমকালকে বহু স্তরে স্পর্শ না করে পারে না।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৩০)। এই নাটকের অনুবাদের অনুবাদকের কবি-ব্যক্তিত্বের অভিক্ষক্ষপের ব্যাপারটি ঠিক মেনে নিতে পারেননি প্রাবন্ধিক। এ-সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘শেষ ওডের তরজমা রীতিমত সুখপাঠ্য ও কবিত্বঘন। সবটা উদ্ধৃত করি : ‘মানুষের কাছে প্রজ্ঞার চেয়ে মহত্তর/ আর কিছু নেই। বিধাতার বাণী সগৌরবে/ নিত্য ধ্বনিছে, সেইখানে মাথা নোয়াতে হবে।/ মুখর দম্ভ প্রভুর অনল এড়ালো কবে?/ মহানির্বাণে দর্প হরো,/ তার আগে তুমি বৃদ্ধরে করো জ্ঞানবৃদ্ধ, গোধূলিনভে।’ আমার আপত্তি ঐ শেষের ‘গোধূলিনভে’ শব্দবন্ধে। ইংরেজি অনুবাদগুলোয় এ-রকম কোনও শব্দ দেখিনি। সম্ভবত ওটা সংযোজন। অনুষঙ্গের টানে ‘গোধূলিনভে’ আমায় এখানে অস্বসিত্মকরভাবে অলোকরঞ্জনের কবিতার জগৎ মনে পড়িয়ে দেয়। তাই এটা শুধু সাধারণ সংযোজন নয়, এখানে কবি-ব্যক্তিত্বের অভিক্ষেপ ঘটেছে।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৩৯)

‘কিং লিয়র : সিনেমার কবিতা’ প্রবন্ধটি অসামান্য। এই নাটক-বিষয়ে প্রাবন্ধিক পাঠককে জানিয়ে রাখেন, ‘লোকজীবনের আবহমান অভিজ্ঞতা থেকে ছেঁকে-নেওয়া যে-সব সারসত্য আছে শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়র’ নাটকে, তার মধ্যে একটি হল :‘নাথিং উইল কাম অব নাথিং’। কিছুই শূন্যজ নয়; বিনা বীজে ধান হয় না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঐতিহ্য হচ্ছে সেই বীজ। ‘কিং লিয়র’ ফিল্মের পটভূমিতে রয়েছে রুশ দেশে শেক্সপিয়র-চর্চার বিশেষ ঐতিহ্য, যা থেকে বীজ নিয়ে বুনেছেন, অঢেল ধান ফলিয়েছেন কোজিন্ত্সেভ। শেক্সপিয়রের ঐতিহ্য বিশ্বমানবিক; তবু, শেক্সপিয়র-চর্চার ধারাবাহিক সঞ্চয়, নিজস্ব অন্তর্দেশের অবয়ব নিয়ে ধীরে-ধীরে উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠে
কোনো-কোনো সাংস্কৃতিক ভূখ–। শেক্সপিয়রের বিশ্বপটে তখন ফুটে ওঠে তার দেশজ রূপ। হয়তো একটা সমগ্র জাতির আত্মপরিচয়ের ছাপ পড়ে তার শেক্সপিয়র-চর্চার ওপর।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৪৫) নাটকের সমাজচিত্র সম্পর্কে প্রাবন্ধিকের চিন্তার যে-অভিক্ষেপ, তাতে শুধু শেকসপিয়রই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বিশাল পরিধি জুড়ে তাঁর পদচারণার নমুনা মেলে। প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘মূল নাটকে লিয়রের রাজত্বের যে সমাজচিত্র পাই, তা আবার শেক্সপিয়রের সমকালেরও ছবি। ফিল্মে কোজিন্ত্সেভ শেক্সপিয়রের সময়ের চালচিত্র এঁকেছেন প্রধানত টম/ এডগারের সংলাপ থেকে উপকরণ নিয়ে। প্রলাপ, বিলাপ, ভিক্ষা, খিসিত্ম, চাষীদের টুকরো-টুকরো গান – এইরকম পাঁচমিশেলি উপকরণ ছড়িয়ে আছে ওর সংলাপে। তবে, তার ধুয়ো হচ্ছে – কন্কনে ঠাণ্ডাতেও পরনের কাপড় নেই, চাল নেই, চুলো নেই, পেটের আগুনও নেবে না, ভিক্ষেও জোটে না – এই আক্ষেপ আর যাচ্ঞা।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৪৯-৫০) এই সিনেমার টুকরো-টাকরা বিষয়গুলোও প্রদ্যুম্নের নজর এড়ায়নি। তাঁর মতে, ‘বাঁশিওয়ালা ভাঁড় ‘কিং লিয়র’-এর অন্যতম কোরাস। এক-একজন মানুষ থাকে, তারা যেন বীণার তার। নিজেই বেজে উঠে, তারা অন্য তারকে সুরের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে কাঁপাতে থাকে। এই বাঁশিওয়ালা ভাঁড় সেই সংগীতের প্রতিমা। সে বাঁশি বাজায়; আবার সে নিজেই হয়ে ওঠে বাঁশি। সিনেমাকে কবিতায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় এই বাঁশিওয়ালা ভাঁড়ের ভূমিকা কম নয়।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৫৮)

‘সিনেমার দেশজ পথ’ প্রবন্ধটি ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া। ‘ঋত্বিক’ নামটাও অনেকটা জোরের সঙ্গেই উলেস্নখ করেছেন প্রদ্যুম্ন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই তৃতীয় বিশ্বের সিনেমার, এই বিপদসংকুল স্বর্গীয় আশ্চর্য সিনেমার, পথ কী? এর উত্তর, ঋত্বিক ঘটকের শিল্প : তাঁর সিনেমা। এর অন্যতর উত্তর, তাঁর এই বই। ‘চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু’ থেকে সিনেমার এই নতুন পথের হদিশ, কিছুবা দিক-নির্দেশ, জড়ো-করে-নেওয়া সম্ভবপর। ঋত্বিকের সিনেমা এবং তাঁর এই সম্পৃক্ত। তাঁর সিনেমা যেমন এই বইখানিকে বুঝতে সাহায্য করে, এই বইও তেমন আলো ফেলে তাঁর সিনেমার ওপর। জ্ঞানযোগীর তুরীয় তত্ত্বচর্চা নয়, এই বই। তত্ত্ব আছে ঠিকই; তবে, তার সঙ্গে মিশেছে নতুন সিনেমার জন্য যুঝে-যাওয়ার ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম আর রক্ত; এ হল, যাকে বিষ্ণু দে বলেন, ‘ধ্যান আর বাস্তবের খেয়া পারাপার।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৫৯) ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে আমার কোন শিল্পকর্ম করার অধিকার আছে, যদি না আমার দেশের এই সংকটকে কোন না কোন দিক থেকে উদ্ঘাটিত করে তুলতে পারি। আমার বেশিরভাগ ছবিই সেই সংকটকে ধরবার চেষ্টা মাত্র।’ ঋত্বিকের সেই কথাটি উদ্ধৃত করে প্রদ্যুম্ন জানান, ‘উল্কার মতন জ্বলে খাক-হয়ে-যাওয়া ঋত্বিকের জীবন-ইতিহাসে এই অন্বেষণ কী তীব্র, কী মর্মান্তিক! অবশ্য জানি, এই অন্বেষণের শিকড় আছে জাতীয় আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে, ইমানে। হয়তো এর উৎস রবীন্দ্রনাথের সেই স্বদেশী সমাজের সংকল্পে, গান্ধীজির ইউটোপিয়ায়।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৬০-৬১) ঋত্বিকের মধ্যে যে দেশ-সমাজ-মানুষের অন্বেষণের একটি নিরন্তর তাগিদ ছিল সেইটি প্রদ্যুম্নর নজর এড়ায়নি। তাঁর মতে, ‘অন্বেষণের এই তাড়নায় ঋত্বিক, একদিকে, দেশের সমকালের সংকটকে দুহাতের মুঠোর মধ্যে ধরবার চেষ্টা করেন; অন্যদিকে, দেশের আবহমান ঐতিহ্যকে প্রবিষ্ট করে নিতে চান নিজের শিরা-ধমনীর রক্তস্রোতের মধ্যে। শিল্পসৃষ্টির প্রত্যেক মুহূর্তে এই দুই বিপরীত বিন্দুতে সঞ্চরণ তাঁর অভীষ্ট।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৬১)

‘রাজনৈতিক উপন্যাস : স্বারূপ্যের সন্ধানে?’ প্রবন্ধটি তারাশঙ্করের গণদেবতাকে অবলম্বন করে রচিত। তারাশঙ্করের লেখায় রাজনৈতিক উপাদানের সূত্র খুঁজতে গিয়ে প্রদ্যুম্ন জানান, ‘তারাশঙ্করের লেখায় তো এই রাজনৈতিক আর সামাজিকের সাযুজ্য খুবই স্পষ্ট। তিনি ‘গণদেবতা’য় জাতীয় আন্দোলনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন একটি নির্দিষ্ট সামাজিক পরিম-লীতে। ঐকাত্ম্যনিবিড় এই সামাজিক পরিম-লীকে ইংরেজি পরিভাষায় বলে ‘কমিউনিটি’। বাঙলায় একে বলতে পারি : ‘কৌম’। আমার কথাটা আরও যথার্থ হয় যদি বলি : ‘গণদেবতা’য় এই কৌম, একাধারে, স্পষ্ট সামাজিক সত্তা রূপে এবং নিজের রাজনৈতিক নিয়তির নির্মাতা রূপে আবির্ভূত।’(টীকাটিপ্পনী, পৃ ৭২) নিজের এই বক্তব্যকে আরো-একটু বিশদ করে প্রদ্যুম্ন বলেন, ‘কৌম : আমাদের রাজনৈতিক উপন্যাস-চর্চায় এইটেই, বোধ করি, সেই মূল প্রত্যয় যা চাবিকাঠির কাজ করতে পারে। তারাশঙ্কর টের পেয়েছিলেন, কৌম ইতিহাসের বিষয় (অবজেক্ট) নয়, বিষয়ী (সাবজেক্ট)। এই প্রত্যক্ষণের জোরে তিনি ‘গণদেবতা’য় সৃষ্টি করতে পেরেছেন রাজনৈতিক উপন্যাসের একটি দেশজ প্রতিমান।’                 (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৭৩)

কৌমের কথা প্রদ্যুম্নর লেখায় নানাভাবে এসেছে। তারাশঙ্করের উপন্যাসে এই কৌমের কথা বলতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, ‘তারাশঙ্কর উপন্যাসের যে-স্বদেশী প্রতিমান সৃষ্টি করলেন, তাতে দেখা দিল নানান রূপান্তর। প্রথমত, নায়ক আর কৌমের সেই বিচ্ছেদ দেখি না, ‘গণদেবতা’র কাঠামোয়। ওরা নাড়ীতে-নাড়ীতে বাঁধা। চ-ীম-প সাধারণের বা সমূহের সম্পত্তি; ব্যক্তিগত নয়। এই আবহমানের প্রতিষ্ঠান গ্রামের মন্দিরও বটে, বিধান-সভাও বটে; তারাশঙ্করের ভাষায় ‘গ্রামের হৃৎপি-’। ধীরে-ধীরে চ-ীম-প হয়ে ওঠে কৌমের প্রতীক। এক অর্থে, চ-ীম-প এ উপন্যাসের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রকৃত নায়ক। দেবু ঘোষ তার মানুষী প্রতিরূপ। সে কৌমের মধ্যস্থ। সে কথা বলে, কাজ করে, কৌমেরই পক্ষ থেকে।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৭৪) সেইসঙ্গে গণদেবতা উপন্যাসের আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক। তাঁর মতে, ‘গণদেবতা’র আরও কোনো-কোনো লক্ষণের উলেস্নখ জরুরি। যেমন : ব্রতকথা, পুরাণ, চ-ীমঙ্গল, মনসামঙ্গল ইত্যাদি আমাদের বহু প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে নানান উপকরণ নিয়ে উপন্যাসের গড়নে একটি নতুন আয়তন তৈরি করে নিয়েছেন তারাশঙ্কর। আর, যে-জন্তুপ্রতিমা ‘গণদেবতা’র তাৎপর্যকে নানান মাত্রায় খুলে-খুলে দেয়, তারও শিকড় সম্ভবত দেশজ উপকথায়, জাতকের গল্পে, মঙ্গলকাব্যে। প্রাক-বুর্জোয়া অবিচ্ছিন্ন লোকমনের এইসব উপাদান দিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙলা উপন্যাসের এই নতুন কাঠামোর গ্র্যানিট স্তর।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৭৫-৭৬) আরো একটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন প্রদ্যুম্ন। তাঁর মতে, ‘স্বাধীনতার লড়াই তো আসলে ক্ষমতা-দখলেরই লড়াই। ‘গণদেবতা’য় একটি চাষী-গোষ্ঠীর ওপর এই স্বাধীনতা লড়াইয়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে : চাষীকেই প্রত্যক্ষণের কেন্দ্রে স্থাপন করে। মূলত এ অর্থে তো বটেই, কিন্তু শুধু এ-ই অর্থেই ‘গণদেবতা’ রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। এই যে মৌলিক মাত্রা, এরই সঙ্গে ওতপ্রোত আরও বহুতর রাজনৈতিক মাত্রা আছে, এই উপন্যাসের।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৭৬) ভবতোষ চট্টোপাধ্যায় তাঁর শরৎ সাহিত্যের স্বরূপ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘শরৎচন্দ্রের মানসলোকে দীপ্যমান ছিল কয়েকটি আদিরূপ… মহেশ্বর, অন্নপূর্ণা, উমা, যশোদা-গোপাল, কলঙ্কিনী রাধিকা।… এই… আদিরূপগুলি শরৎসাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র।’ এই কথার সূত্র ধরে প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘ভবতোষবাবুর এই আলোচনা বস্ত্তত চরিত্রকেন্দ্রিক। চরিত্র জিনিশটার যতই গুরুত্ব থাক, তা তো উপন্যাসের অংশ বৈ নয়? আর, পূর্ণ সর্বদাই অংশের চেয়ে বড়ো। অতএব, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের স্বরূপ বুঝতে গেলে, তার এই গোটা রূপটাকে লক্ষক্ষ্যর মধ্যে আনতে হবে।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৮১)। ভবতোষ চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তার বিপরীতে গিয়ে প্রদ্যুম্নর বক্তব্য হচ্ছে : ‘উপন্যাসের এই রক্তমাংসের রূপটাই যে তাঁর (শরৎচন্দ্র) সংবেদ্য অভিজ্ঞতা। আমাদের শরৎচর্চা অ্যানাটমির শুকনো কচকচি হয়ে যাবে, যদি-না তাঁর উপন্যাসের এই উষ্ণ, স্পন্দমান শরীরটাকে ছুঁতে পারি।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৮২)

সুকুমার রায়কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটির নাম – ‘অর্থ-অনর্থ’। আবোল তাবোলের শেষ কবিতাটিতে ছিল এরকম কয়েকটি লাইন : ‘আদিম কালের চাঁদিম হিম/ তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।/ ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,/ গানের পালা সাঙ্গ মোর।’ আর সেই লাইন-কয়েকটিকে সামনে রেখে প্রদ্যুম্ন লিখেছেন, ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।’ শেষ কবিতার এই আঁটো লাইনে সুকুমার রায় নিজেই যেন তাঁর স্বরচিত বিশ্বের পরিচয়লিপি লিখেছেন। একদিকে নিরর্থ (ননসেন্স), অন্যদিকে প্যাটার্ন – এই দুই বিপরীতের অবিরত টানাপোড়েন দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর শিল্পের বিশ্ব। মূলগত এই যে দ্বান্দ্বিক সংযোগ, এর পশ্চাদভূমিতে রয়েছে আরও নানান বিপরীতের ঐক্য-সংঘাত, যার চাপ আমরা লক্ষ্য করি তাঁর শিল্পের স্তরে-স্তরে। এক আজগুবি কল্পলোক আর এক আজগুবি বস্ত্তলোকের টানটান ভারসাম্যের ওপর উচ্ছ্রিত হয়ে ওঠে তাঁর সহাস্য, অসম্ভব ভুবন। এইসব কারণে তাঁর বিকীর্ণ রসিকতা বহুকৌণিক; একাধারে সরল আর তির্যক।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৮৩)। প্রতিতুলনায় এনেছেন লুইস ক্যারলের প্রসঙ্গ। প্রদ্যুম্নর মতে, ‘শব্দকে দিয়ে যথেচ্ছ অর্থ বওয়াতে চাইছে ক্যারলের (লুইস)… চরিত্র-পাত্র; অন্য পক্ষে, সুকুমার রায় চাইছেন শব্দের নির্দিষ্ট অর্থের নিষ্কাশন। যেখানে হাম্প্টি ডাম্প্টি ভাঙতে চাইছে অর্থের বেড়ি; সেখানে সুকুমার রায় ঘটাতে চাইছেন, শব্দের দাসত্ব থেকে মনের মুক্তি।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৮৫)। আরো খানিকটা অগ্রসর হয়ে প্রাবন্ধিক বলেন, ‘শব্দ থেকে নিষ্ক্রমণ নয়, শব্দকে আক্রমণ – নিরর্থক শব্দের বিরুদ্ধে সহাস্য জেহাদ – … এইটেই হল তার প্রধান লক্ষ্য। শব্দকে শব্দ দিয়ে ঘা মেরে হাসির ফুলকি জ্বালানোর এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারি : শব্দদ্বন্দ্ব। এই শব্দদ্বন্দ্ব বহু ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে নিরর্থ-কে নিরর্থ দিয়ে প্রত্যাঘাত  যেমন : (‘দ্রিঘাংচু’)।’ একজন লেখকের রচনার নেপথ্যে সবসময়ের জন্যে আত্মসচেতন মননের ক্রিয়া দেখতে চেয়েছেন প্রদ্যুম্ন। সুকুমার রায়ের বেলাতেও তার অন্যথা হয়নি। প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘তাঁর (সুকুমার রায়) সাহিত্যচর্চার মোট ফসল তো বহরে বা পরিমাণে খুব বেশি নয়; তবু এই নির্বহুল পরিসরের মধ্যেই, ঘুরে-ঘরে তিনি ফাঁপা শব্দের গ্যাস বেলুনকে সূচিবিদ্ধ করতে থাকেন যে আমরা টের পাই, এইটেই হয়ে উঠেছিল তাঁর দিনরাতের জরুরি ধ্যান-জ্ঞান-ক্রিয়া।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৮৬-৮৭)

‘রামমোহন রায় এবং বাঙলা গদ্য’ প্রবন্ধে প্রদ্যুম্ন জানাচ্ছেন, ‘বিতর্কে রামমোহনের স্ফূর্তি। আমৃত্যু তিনি ছিলেন তর্কে সব্যসাচী।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ৯৭)। শুধু এখানেই তার শেষ নয়। প্রদ্যুম্নর মতে, ‘বেদান্ত থেকে শুরু করে দৈনন্দিনের নানান সামাজিক সমস্যাকে রামমোহন গদ্যের প্রসঙ্গ করে তোলেন। অর্থাৎ বাঙলা গদ্যের বিষয়বস্ত্ততে এক নতুনতর বিসত্মার আর গভীরতা আনলেন তিনি।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১১১)। রামমোহনের কা-জ্ঞান যে তাঁর প্রমাজ্ঞানেরই আরেকটি স্তর, সেটি দেখাতে গিয়ে প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘রামমোহনের যুক্তিপ্রমাণ স্থাপনের রীতি ও নীতি হয়ে ওঠে তাঁর গদ্যের অন্তর্বিষয়। গদ্যকে তিনি করলেন দৃঢ় বিশেস্নষণের বাহন। শ্রুতি, ব্রহ্মসূত্র, অনুমান, প্রত্যক্ষ আর কা-জ্ঞান তাঁর কাছে গ্রাহ্য হল প্রমাণ অর্থাৎ প্রমাজ্ঞানে পৌঁছনোর উপায় হিশেবে।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১১১)

‘বিদ্যাসাগর এবং বেসরকারি সমাজ’ প্রবন্ধেও তিনি বিদ্যাসাগরের অনন্যতন্ত্রতার ওপর জোর দিয়েছেন; এবং রামমোহনের ক্ষেত্রে যে-কা-জ্ঞানের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের বেলাতেও সেই প্রখর কা-জ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। প্রদ্যুম্ন বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর-চারিত্র্যের অনন্যতন্ত্রতার ওপর রবীন্দ্রনাথ ঝোঁক দিয়েছেন। এক হিশেবে কথাটা তো ঠিকই। আসলে, তাঁর চারিত্র্যের বৈশিষ্ট্য হয়তো এই যে একদিকে তিনি অনন্যতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, অন্যদিকে সাধারণ্যের সঙ্গে তাঁর সহজ ঐকাত্ম ছিল। গোটা কৌমকে নিয়ে তিনি চলার চেষ্টা করেছেন অথচ কৌমের সমালোচনাও করেছেন। তাঁর জীবনচরিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সমাজের সাধারণ্যের ক্রমান্বয় সম্বন্ধ-তৈরির ইতিবৃত্ত। সে ইতিহাসে ভাঙাগড়াও আছে, চাপও আছে; কিন্তু অন্বয়-তৈরির সেই চেষ্টা দুর্মর। যে সাধারণ্যকে ‘কৌম’ বলছি, তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি বড়ো যোগসূত্র ছিল তাঁর ওই প্রখর কা-জ্ঞান।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১৬২) আর এরই সূত্র ধরে বিদ্যসাগরের মনন-চর্চার ব্যাপারটিও প্রদ্যুম্নের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাঁর মতে, ‘এই কা-জ্ঞান হয়তো বিদ্যাসাগরের স্বভাবগত ছিল; কিন্তু যা লক্ষণীয় তা হল : তিনি মননগত স্তরেও তার অনুশীলন করেছিলেন।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১৬২) শুধুই এটুকু নয়; প্রদ্যুম্ন আরো যোগ করেছেন, ‘তাঁর লেখা খুঁটিয়ে পড়লে বুঝতে পারি : বিদ্যসাগরের শাস্ত্রবিচার, আসলে, কা-জ্ঞানের আলোয় সাধারণ বুদ্ধির বিচার। তাঁর দেশাচার-সমালোচনা, মূলত, কা-জ্ঞানের মানদ– সাধারণ বুদ্ধির সমালোচনা। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, তাঁর শাস্ত্রব্যাখ্যা – এবং তাঁর আবিষ্কৃত শাস্ত্রবচন – ক্রমে ক্রমে… সাধারণ বুদ্ধির অংশ হয়ে উঠবে। এইজন্য তারানাথ তর্কবাচস্পতির মতন সংস্কৃতে শাস্ত্রবিচার করেননি, করেছিলেন বাঙলায়।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১৬৯)

সুশোভন সরকারের বিখ্যাত গ্রন্থ টুওয়ার্ডস মার্ক্সের আলোচনা – ‘মার্ক্সের দিকে’। প্রদ্যুম্ন  ভট্টাচার্য এই গ্রন্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘আজকের এই সংকট, মার্ক্সবাদেরও সংকট। শেষ বয়সে জাঁ পল সার্ত্র যেমন বলেছেন, মার্ক্সবাদী সংস্কৃতি একটি ভিতরের সংকটে আচ্ছন্ন আজ। ঠিক এতটা কবুল না-করলেও, এ-কথা বোধ করি, সুশোভন সরকারও মানেন। এই সংকটে তিনি পথ আর গন্তব্য স্পষ্ট করতে চাইছেন, প্রধানত ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে। রাজনীতি, নৃতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি বা দর্শনের যা কিছু আলোচনা এই বইয়ে আছে, সর্বত্রই তার মূলসূত্র হচ্ছে : ইতিহাস। ইতিহাসকে তিনি দেখেছেন সমকালীন সংকটের বীক্ষণ-বিন্দু থেকে; আর, এই সময়ের সংকটকে তিনি দেখেছেন ইতিহাসের পটভূমিতে। ইতিহাসই তাঁর কাছে সময়ের চাবি।’ (টীকাটিপ্পনী, পৃ ১৮০)। প্রদ্যুম্নর কথার এই সূত্রে আমাদের মনে পড়ে যায়, সুশোভন সরকারেরই একটি বই আছে, যার নাম – ইতিহাসের ধারা (প্রথম প্রকাশ ১৯৪৪)। প্রথমে লিখেছিলেন ‘অমিত সেন’ – এই ছদ্মনামে। সুশোভন সরকারের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে : ইতিহাস; আর প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য জোর দিয়েছিলেন ‘সত্যের পরিসীমা’র ওপর। গত শতকের আশির দশকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘যে-কোনও বোধ, বক্তব্য বা ব্যবহার মার্ক্সবাদসম্মত কিনা, তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন : সেইটে সত্যি কি-না। যা সত্য, তা মার্ক্সবাদ হবারও সম্ভাবনা। মার্ক্সবাদ সত্যে শামিল; কিন্তু সত্যের পরিসীমা মার্ক্সবাদের চেয়ে বিসত্মীর্ণ।’ আর এভাবেই তিনি মার্কসবাদকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।

 

ছয়

আমাদের সাম্প্রতিক সমালোচনার গতিপ্রকৃতি দেখে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের সাম্প্রতিক সমালোচনার একটি দুর্লক্ষণ এই যে এর বেশিরভাগটাই লিখেছেন সেই লেখকরা, যাঁরা সাহিত্যিক নন, সাহিত্যের মাস্টার। জানি, প–তজনের সমালোচনার একটা সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যায়তনে বড়োবাজারের
বিষ-হাওয়া ঢুকে পড়ে বিদ্যা আর সাহিত্যের প্রতি নির্লোভ ভালোবাসার শিকড়টাই নষ্ট করে দিচ্ছে। শিক্ষকবৃত্তির নানান আপতিক গরজ, দায় আর ধান্দা এখন এই মাস্টারি সমালোচনার প্রবর্তনা। এইসব তাড়নায় ভূরিপরিমাণ যা উৎপন্ন হচ্ছে, তাতে না-আছে বোধ, না-আছে বৈদগ্ধ্য।’ কথাটা শুনে অনেকেই দুঃখিত হবেন; কিন্তু এটি গভীরভাবে সত্যি। আনন্দের বিষয় এই, সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের এই বইটিতে তথাকথিত ‘মাস্টারি সমালোচনার প্রবর্তনা’ নেই। এই বই সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘মনে হতে পারে যে এ বই খুললে হয়তো সত্মূপ করা পা–ত্যের এক জটিল আবর্তের মধ্যে গিয়ে পৌঁছব কোনো অন্ধকার করে দেওয়া তত্ত্বভারে। বস্ত্তত, এইখানেই এ বইয়ের সবচেয়ে বড়ো মুক্তির স্বাদ : বিদ্যা এখানে সহজেই প্রজ্ঞা হয়ে ওঠে, তত্ত্ব এখানে স্বচ্ছন্দ এক জীবনদৃষ্টি।’ আমরাও যখন সেটিই মনে করি, তখন শুধু-শুধু কথা বাড়িয়ে কাজ কি! r