স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

‘হাবিয়া দোজগ! হাবিয়া দোজগ! এর আজাবের শেষ আছে?’ নিজের হাতে চোখে ড্রপ দিতে দিতে বলেন নীহার বানু। সাবিনা বালিশ পেতে দিলে আপত্তি করেন না। চোখ বুজে শুয়ে পড়েন। এশার নামাজ পড়া বাকি, এখন ঘুমাবেন না নিশ্চয়! সাবিনাকে অপেক্ষা করতে হয় না। ‘বই পড়া, বাগান করা আর সেলাই-ফোঁড়াইয়ের নেশাটা ছিল বইলাই বাঁচছি।’ নীহার বানু

গাঁট-ফোলা-আঙুলে গালে গড়ানো অশ্রুকণা মুছে নিয়ে জড়ানো গলায় থেমে থেমে বলেন, ‘রাস্তায় রাস্তায় পাগল হইয়্যা ঘোরন লাগত না! ঘরে এমন নাখাস্তা শাশুড়ি যার!’

নাখাস্তা মানে ব-কলম, অসংস্কৃতই তো! সায়মা খাতুন শাক রান্না করতেন তেল ছাড়া। তা-ও পুকুরপাড় বা বাড়ির ধারের নালা, ডোবা থেকে তোলা বুনো শাক। তাতে পোকামাকড় থাকাটা বিচিত্র নয়। এক ধোয়া বা দুই ধোয়ার পর চুলায় বসিয়ে মোক্ষম মন্ত্র – ‘সীতায় রান্ধে, লক্ষ্মণে খায়, লোহার কাডি গড়গড়ায়।’ ব্যস, পোকামাকড়ের বংশ নাশ। কখনো ঘুমন্ত নাতি-নাতনির চারপাশে আঙুলের অদৃশ্য আঁক কেটে ‘দোহাই রামের, দোহাই লক্ষ্মণের, দোহাই সীতার’ বলে ঘরের দুয়ার টেনে উঠানে ধান শুকাতে চলে যেতেন। ব্যাপারটা বোঝামাত্র লক্ষ্মণরেখা ভেঙে ঢুকে পড়তেন নীহার বানু। বাচ্চার গায়ে ঘন ঘন ফুঁ দিতেন দোয়া ইউনুস পড়ে।

‘সেই মাছের পেটের দোয়াটা?’ সাবিনা গল্পের মাঝখানে জানতে চাইত। বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে না বলতেন নীহার বানু। কখনো তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাতেন কাফ্রিদের মতো মেয়ের মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলের দিকে। অবিকল সায়মা খাতুনের চুল, মুখের গড়নও সেই রকম ডিম্বাকৃতির। খোদা চাহে তো দাদির তাছির না পড়লেই হলো।

আইড্রপের বেশিটা মনে হয় নীহার বানুর চোখের বাইরেই পড়েছে। সাবিনা ড্রপার হাতে এগিয়ে গেলে তিনি মাথা নেড়ে আপত্তি জানান আর শাশুড়ির নিন্দামন্দ করে চলেন। সাবিনার অবাক লাগে, শাশুড়ি সায়মা খাতুন তাঁর ফুপুও বটে, হোক না দূরসম্পর্কের, মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন – প্রায় তিন যুগ আগে যিনি মারা গেছেন, তাঁকে নিয়ে দুটি ভালো কথাও বলা যায় না! তা না বলুক, নীহার বানু যে অতীতস্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন, তার জন্যও তো সাবিনাকে কম কসরত করতে হয় নাই। মায়ের বিদ্বেষপূর্ণ কথায় সায় দিয়ে ও মনে মনে রফা করে – পারিবারিক সোনালি ইতিহাসের পাতা ভরাতে অত ভালো কথার দরকার কী? সোনায় খাদ মেশাতেই হয়।

 

হাশমত বানু, নীহার বানু

গরিবের ঘোড়া রোগ – নীহার বানুর মা তিক্ত স্বরে বলতেন। ছনের ছানি দিয়ে ঘরে পানি পড়ে, খায় মাইট্টা থালায়, ছেলেকে ডাক্তারি পড়ায়! ছেলে ডাক্তারি পড়তে কলকাতা যাবে, সায়মা খাতুন দোয়া চাইতে আসে। আসলে দোয়া না, টাকা মাঙতে। ‘ভাইয়ো ভাই, আমার কী অইব ভাই!’ দূরসম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই হাজি চানের একবার হাত ধরে তো আরেকবার পায়ে পড়ে। এমন অভব্য আচরণেও হাজির মুখে বিগলিত হাসি। হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে সায়মা খাতুনকে মন শক্ত করতে বলেন। জোরে হাঁক দেন রান্নাঘরের দিকে ফিরে – ‘কই গো, পান-তামুক পাডাও জলদি! বাইত মেজবান আইছে।’ সিলিমে ফুঁ দিতে দিতে নোকর আসে। রসুইখানার বেড়ার আড়ালে নথ নাড়েন নীহার বানুর যুবতী মা – মেজবান না আরো কিছু। এরকম বেশরম, বেলাজ আত্মীয়! টাকা ধার নেয়, শোধ করে না। সবকিছুর একটা সীমা আছে। হাজির নিজেরও তো দুই মেয়ে এক ছেলে। যদিও ছেলে তিতুমীর ওরফে তিতা মিয়া সবে হামা দেয়, মেয়ে দুটি তো হাতে-পায়ে ডাঙর হচ্ছে। ওদের ভবিষ্যৎ ভাবা লাগবে না!

পাড়া-পড়শিরা বলত – হাজিরে তাবিজ করছে সায়মা খাতুন। সব তাবিজের গুণ।

এসব শুনতে শুনতে বড় হয় হাজি চানের দুই মেয়ে হাশমত বানু, নীহার বানু। হাশমত বানু ডাকের সুন্দরী – দুধে-আলতায় গায়ের রং। নীহার বানুর হাত-পায়ের গড়ন, চেহারা-ছবি ভালো হলেও রংটা চাপা। লোকে আড়ালে বলত – ছাই-গোলা টিক্কা। যা-ই হোক দুবোনেরই মাথা ভালো। রোজ দুবেলা মৌলভি সাহেবের কাছে ইসলামি শিক্ষার সবক নেয়। বেহেশতি জেওর আর কাসাসুল আম্বিয়া কিতাব দুটি তো পড়তে পড়তে কণ্ঠস্থই প্রায়। তা ছাড়া প্রাচীন উর্দু-ফারসি কবিদের ভাবসমৃদ্ধ কবিতা। বাড়ির ছোটখাটো লাইব্রেরিতে মুসলমান লেখকদের আনোয়ারা, জোহরা, বিষাদসিন্ধু, মহাশ্মশানের মতো জনপ্রিয় বাংলা বইয়ের সঙ্গে আছে সুন্নাত-আল জামাতসহ কলকাতা থেকে প্রকাশিত আরো কিছু পত্রপত্রিকা। তার ওপর নীহার বানুকে স্কুলেও পাঠানো হয়েছে। ওখানে অংক, জ্যামিতি, বিজ্ঞান শেখাবে। এভাবে যদি জ্ঞানের ভারে রূপের ঘাটতি চাপা পড়ে, বিয়ের বাজারে এসবের কানাকড়ি দাম নাই যদিও। অবশ্য নীহার বানুর তকদিরের ফয়সালা ততদিনে হয়ে গেছে, বান্দার অগোচরেই সম্ভবত।

হাজি চান স্বশিক্ষিত মানুষ। বাবা যে তালুক-মুলুক রেখে গেছেন, তা সংরক্ষণের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হয়েছেন এ-বিশ্বাসে যে, বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা ছাড়া গতি নাই। পুত্রতুল্য মোয়াজ্জেম হকের প্রতি যতটুকু দয়া-দাক্ষিণ্য এই সুবাদেই। সায়মা খাতুন চোখে আঙুল দিয়ে দুসরা সম্ভাবনার রাস্তাটাও একদিন দেখিয়ে দেয়।

সে দুটি মেয়েকে বড় হতে দেখেছে চোখের সামনে। বড় রূপবতীর দিকে হাত বাড়িয়ে ফায়দা নাই। খালি খালি হাত পোড়াবে। ছোট মেয়ে নীহার বানু হাতে তক্তি-খড়িমাটি আর সাদা শেমিজের ওপর ডুরি শাড়ি পেঁচিয়ে উঠানে পা রেখেছে স্কুলে যাবে বলে, তখন হাজি চানকে ইশারায় কিছু বোঝাতে চায় সায়মা খাতুন। তাতে কাজ না হলে ‘মাইয়া ডাঙর অইছে। ভাইয়ের মনো কী আছে আল্লাতালাই জানেন।’ কথাটা যেন আপন মনেই বলে সে। হাজি চান ত্বরায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন – মেয়ে বাহির বাড়ির ফটক দিয়ে বাতাসের বাড়ি খেতে খেতে বেরিয়ে যাচ্ছে। হাতে তক্তি, শরীরটাও আরেকটা তক্তি। মেয়ের গায়ে মাংস লাগবে কবে?

সেদিন স্কুল থেকে ফিরতেই নীহার বানুর হাতে তুলে দেওয়া হয় বড় কাঁসার গেলাসে গরম দুধ। দুধটুকু শেষ না হতে এক ছড়া সবরিকলা, দুটি হাঁসের ডিম। সায়মা খাতুন টাকা নিয়ে চলে গেছে। নীহার বানু সেদ্ধ ডিম দুটি শরা-চাপা দিয়ে, কলার ছড়াটা হাতে দোলাতে দোলাতে হাশমত বানুর কামরায় ঢোকে। ইচ্ছা স্কুলের গালগপ্পো করতে করতে কলাগুলি ভাগাভাগি করে খাবে দুবোন, খাঁচার টিয়া পাখিটাকেও খাওয়াবে। হাশমত বানু জানালার পাশে কুরসি টেনে বসে রুমালে ফুল তুলছিল, ছোট বোনকে দেখে মুচকি হাসে। কিন্তু কলা খেতে রাজি হয় না। জানালা দিয়ে উঠানে তাকাতে সায়মা খাতুনের কথা মনে পড়ে নীহার বানুর। ‘টাকা নিয়া আপদ বিদায় হইছে!’ ওর গলায় মায়ের মতো বিদ্বেষ। কথাটা না বোঝার ভান করে হাশমত বানু। কিন্তু সেলাইকর্মের কাঠের গোল ফ্রেমটা ততক্ষণে হাত থেকে কোলের ওপর নামিয়ে রেখেছে।

‘পরের ছেলে ডাক্তার অইব, আমাদের কী লাভ, বুবু?’

‘পরের ছেলে কারে কও, নীহার?’ জানালার পর্দাটা ঝপাৎ করে নামিয়ে হাশমত বানু চাপাস্বরে আরো বলে, ‘মোয়াজ্জেম ভাই তোমার হবু দামাদ!’ ভারী পর্দায় হাশমত বানুর কামরাটা অন্ধকার। তাঁর সুন্দর হাসিটা কালো মেঘে বিজলি চমকের মতো নীহার বানুর চোখের সামনে খেলে যায়। স্কুলে যেতে হয় না বলে হাশমত বানুর ভারি মজা। ঘরের অনেক গোপন কথার হদিস জানে। সারা দিন নাটক-নভেল পড়ে বানিয়েও বলে অনেক কিছু। ‘তোমার দামাদ! তোমার শাদি! রাঙা শুক্কুরবার!’ বলে মুখ ভেংচে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নীহার বানু। খাঁচার পাখির মুখে চটজলদি গলাকলা তুলে দিতে গিয়ে আঙুলে ঠোকর খায়। কাঁদতে কাঁদতে একটা মুখ চোখের জলে ভেসে ওঠে। কামানো দাড়ি, ছাঁটা গোঁফ। চুলে টেড়ি-কাটা। সাদা ধুতির কোঁচা ধরে খেতের আল দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে আসছে। পেছনে মুখের ওপর রংচটা ছাতি ধরা সায়মা খাতুন। ছয় মাস কলকাতা থেকে ছেলে বাবু হলেও মায়ের নাঙা পা, আর আব্রু বলতে একখান ভাঙা ছাতি। তবু এ-বাড়িতে সেদিন ওদের কদর ছিল। অজুর পানি। মুরগি-পোলাও। সুগন্ধি পান।

তারপর সায়মা খাতুনের জন্য মনে মনে অপেক্ষা করত নীহার বানু। কান টানলে যেমন মাথা আসে, সেইভাবে মায়ের সঙ্গে ছেলেও আসবে একদিন। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও সে বহুদূর – গোরাদের মুলুক। মাথার ওপর বোমারু বিমান আর মহামন্বন্তরেরও আরও বছরখানেক বাকি। তখন নীহার বানুর বয়স মাত্র নয়। হাশমত বানুর এগারো। তারপরও যাকে উপলক্ষ করে শাদি বা হবু দামাদ নিয়ে ওদের মাঝে খুনসুটি হতে পারত, সে গরহাজির। সায়মা খাতুন যেন আচমকা কর্পূরের মতো উবে গেছে।

 

১৯৪১ সালের বর্ষাকাল পর্যন্ত সায়মা খাতুন অন্ধকারেই ছিলেন। ছেলে চিঠি লিখলে বাবাকেই লিখে। পোস্টকার্ডের তলার দিকে ‘শ্রদ্ধেয় আম্মাজানকে আমার সালাম জানাইবেন’, ব্যস, এটুকু। চিঠিটা কাউকে দিয়ে বাজারের পোস্টাফিস থেকেই পড়িয়ে আনেন সাবিনার দাদা মেহের আলি। বাড়ি ফিরে পাখি পড়ার মতো বিবির কানের কাছে তা বয়ান করেন। তিন-চার মাস চিঠি না-আসা কিছু না, টাকায় টান পড়লে লেখে যখন। আগে সকালে ছাত্র পড়াত। এখন হয়তো বিকালেও পড়ায়। বাপ-মায়ের অভাবের সংসারের কথা ভেবে কষ্ট করছে ছেলেটা।

তারপর এক ঝুমবৃষ্টির দিন, আসমান-জমিন যখন একাকার। অনেক বছর বাদে, ছেলের দেশান্তরির খবর আসার দিনটির কথা যখন বলতেন, তখন চোখে পানি নিয়ে এভাবেই শুরু করতেন সায়মা খাতুন। গল্পটা যেন সিন্দুকে গচ্ছিত ধন-রতেœর মতো পুত্রবধূর জন্য তোলা ছিল। তারপর নাতি-নাতনির জন্য। নিজের রক্তের বংশধারাটাই তো সেদিন তিনি খোয়াতে বসেছিলেন। খবরটা শোনামাত্র মনে হয়েছিল – একমাত্র ছেলে যদি না ফেরে, সোয়ামি দুসরা শাদি করবে। কত কষ্টে গড়া সংসার! আরেকজন উড়ে এসে জুড়ে বসবে? তখন দুয়োরাণির মতো মনে হবে শয্যাটা কণ্টকের। তারপর কোলে-কাঁখে করে যেসব ছেলেপেলে মানুষ করবেন, তারাও দুশমনের বাড়া আরেকজনের। আদরের পুত্র তাঁরে কি জ্বালায় ফেলল এই বয়সে! তিনি ভাত-পানি ছেড়ে আপনমনে গুমরাতে থাকেন।

খবরটা শুনে মেহের আলি চটে গিয়েছিলেন অন্য কারণে। কত আশা ছেলে ডাক্তার হবে। বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। চাষার পো ডাক্তার! কুত্তার পেটে ঘি সয়! দিনচারেক পর তাঁরও ভাবান্তর ঘটে। ডাক্তারি পড়ার যা খরচ, গত দুই বছরেই বিস্তর ধারদেনা হয়ে গেছে। ধারেই টাকা দেন, তবু হাজির চোখ দুটি যেন রাঙা করমচা। ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তাই টাকা চাইতে নিজে না গিয়ে, ভাঙা ছাতি হাতে দিয়ে পাঠান বিবিকে। খোদা যা করে, মানুষের মঙ্গলের জন্যই করে। বর্মা সোনার দেশ। যে গেছে, তার ঘরবাড়ির চেহারা ফিরে গেছে। রাতে বিছানায় শুয়ে বিবিকে বলেনও সে কথা। ‘যাও, চারডা খাইয়্যা লও। কত আর না খাইয়্যা থাকবা!’ বলেই ঝমঝম বৃষ্টিতে কাঁথা মুড়ে ঘুম। সায়মা খাতুন মশারি তুলে খাবার ঘরে যান। এ-বছর ছনের চালে ছানি পড়ে নাই। বৃষ্টির পানিতে মেঝেটা ভেসে যাচ্ছে। ভাঙা বেড়া দিয়ে শিয়াল-কুকুর ঢোকে বলে ভাতের হাঁড়িটা শিকেয় তুলে রেখেছিলেন। আজ ভাতই শুধু। হাতে টাকা-কড়ি না থাকলেও ঘরে কিন্তু খাদ্যবস্তুর অভাব নাই। চাল-ডাল-আনাজ সবই তো নিজের খেতের। মৌসুমি ফল-ফলাদি, পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, খেজুরের গুড়, হাঁস-মুরগির ডিম – বেচতে গেলে পয়সা মেলে না, তাই খেয়ে-খাইয়ে খোদার নেয়ামতের শোকর করো। ছেলের খবরটা শোনা অবধি সায়মা খাতুনের হাত চলে না। আজ একখানা ডিম ভুনা করে নম নম করে সোয়ামির পাতে দিয়েছেন। মানুষটা তো এখন টাকার খোয়াব দেখছে। কত দূর রেঙ্গুন? নুন-কাঁচা মরিচে বাসি ভাত মাখতে মাখতে ছেলের জন্য মনটা যেন কেমন করে সায়মা খাতুনের। কলিকাত্তায় তো ভাত-মাছ-গরুর গোশ সবই মিলত। রেঙ্গুনে কি ভাত পাওয়া যায়?

যেদিন জাপানিদের বর্মা দখলের খবর আসে, সেদিন মেহের আলি হাট থেকে ফিরে হাতের কেরোসিনের শিশিটা উঠানের নাড়া-পাড়ায় উড়া মেরে আধোয়া পায়ে ঘরে ঢোকেন। অন্ধকার ঘর। সায়মা খাতুন এনামেলের চেরাগগুলি মোছামুছি করে দুয়ারের ধারে সাজিয়ে রেখেছিলেন। হাট থেকে কেরোসিন আনলে তখন তখন তেল ভরে জ্বালাবেন। মেহের আলির পায়ের ধাক্কায় তেলহীন চেরাগগুলি ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে। তখনো সায়মা খাতুন জানেন না যে, জাপান বর্মা দখল করে নিয়েছে। স্বামীর চ- মেজাজে ত্যক্ত হয়ে তিনি বকাবাদ্য জুড়ে দেন। তারপর বাড়ির রাখাল ছেলেটা নাড়া-পাড়া থেকে খালি কেরোসিনের শিশিটা কুড়িয়ে এনে হাতে দিলে শুধু হয় তাঁর বিলাপ-আলাপ – সেয়ান পোলা বৈদেশ যাওয়ায় তাঁর এত লানত। আন্ধার ঘরে ভাত টোকায় খেতে হয়। যদিও সে রাতে স্বামী-স্ত্রী কারোরই খাওয়া হয় নাই। হাট ফেরত লোকজন উঠান দিয়ে যেতে যেতে চাটগাঁ আর আসামে জাপানি বোমা পড়ার কথা বলাবলি করছিল, যা নিজের মাতমের কারণে সায়মা খাতুন শুনতে পান নাই।

বিকাল হলে সায়মা খাতুন পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াতেন পুকুরপাড়ে। রাস্তা দিয়ে কত রঙের মানুষ যায়! দেড় বছর হতে চলল ছেলে নিখোঁজ। মনিঅর্ডার তো না-ই, দু-চার লাইনের খতও আসে না। মোয়াজ্জেমের বর্মা যাওয়ার সংবাদটা দিয়েছিল বকশিবাড়ির ছেলে, কলকাতা প্রেসিডেন্সির ছাত্র জহর। জহর বকশি কি জানে মজু কেমন আছে? ’৪২-এর আগস্ট আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্কুল-কলেজ, কোর্ট-কাছারি বন্ধ। সায়মা খাতুন ছেলের খবর জানতে প্রায়ই রাখাল ছেলেটাকে বকশিবাড়ি পাঠান। ও রাস্তায় শুনে পুকুরপাড় দিয়ে সেøাগান দিতে দিতে আসে – ‘ইংরাজ ভারত ছাড়ো। কুইড ইন্ডা!’ মজুর খবর মেলে না। এক হাটের দিনে কলকাতায় জহর বকশির হাজতবাসের খবরটা চাউর হয়ে গেলে, মেহের আলি ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে সায়মা খাতুনকে বলেন – ‘মজুর মা, বিপদ খালি তোমার-আমার না। বকশির পোলা নিজে আইন পইড়্যা যহন আইন ভঙ্গ করছে, অবস্থা ঘোরতর।’

মেহের আলির একার বিপদ যা, তা হাজি চান। মোয়াজ্জেম হকের লাপাত্তার খবর খুব সম্ভব তাঁরও কানে গেছে। হাটবারে লোক মারফত খবরের পর খবর পাঠান। ছেলে ডাক্তারি পড়া ছাড়ল, বাপও কপর্দকশূন্য। কোন মুখে হাজির সামনে দাঁড়াবেন! ধান-চালের দাম চড়চড়িয়ে বাড়ছে। আরও বাড়বে শোনা যায়। এবার আমন ধান উঠলে গোলায় তুলবেন না, উঠানে থাকতেই ব্যাপারী ডেকে বেচে দিয়ে ঝনঝনিয়ে টাকা বাজাতে বাজাতে যাবেন হাজির বাড়ি। হাজির চোখের দিকে তাকাতে তখন ভয় কী, টাকা ধারের প্রয়োজন তো তাঁর ফুরিয়েছে। সমস্যা শুধু আমনের মৌসুমের আরো মাস দুই বাকি।

এর কিছুদিন পর, নীহার বানুর মনে আছে – কচি বাছুরের দড়ি ধরে দেনা শোধ করতে আসে সায়মা খাতুন। সেদিন হাজি চানের মুখে আগের সেই হাসি নাই। সায়মা খাতুনকে উঠানে বসতে দেওয়া হয়েছে চেয়ারের বদলে আধলা পিঁড়িতে। অন্দর থেকে যেনতেনভাবে পান সেজে পাঠিয়েছেন হাজির বিবি। সায়মা খাতুনের অপরাধ – তাঁর ছেলে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে বর্মা পালিয়ে গেছে। ‘আমি তোমার দুশমন? আমি ব্রিটিশ?’ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপছেন হাজি। ‘আমারে তহন কওন যাইত না কথাডা? দেড় বচ্ছর পর আইছ কান্দুনি গাইতে!’ নীহার বানু তখন উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। বাবার ধমকাধমকি শুনে হাতের বই মাটিতে পড়ে যায়। কেঁদেও ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। পরীক্ষায় পাস করে কী হবে, লোকটা তো গায়েব হয়ে গেছে। বাড়িতে রেডিও থাকায় যুদ্ধের গতিবিধিও জানা ছিল। বর্মার পরই তো চাটগাঁ, তারপর কুমিল্লা। যুদ্ধ যে নাকের ডগায় – দুদিন আগেই কাগজে লাইন টেনে মাকে সে বুঝিয়েছে। হাশমত বানুর সঙ্গে তামাম বাড়ি ঘুরে ঘুরে আলোচনাও করেছে কোথায় কোথায় ট্রেঞ্চ কাটা যায়। এ আর পি (এয়ার রেইড প্রটেকশন) দপ্তর খোলা হয়েছে শুধু বড় বড় শহরগুলোতে। গাঁয়ের লোকদের নিজেকে নিজে রক্ষা করতে হবে। এখন নিজেকে রক্ষা করবে কেন নীহার বানু, যেখানে লোকটা বেঁচে থাকলেও যুদ্ধের আগুনের ঠিক মাঝখানে?

আঁচলে চোখ মুছে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায় নীহার বানু। উঠানে সায়মা খাতুন বা গলায় দড়ি-বাঁধা ফুটফুটে বাছুরটাও নাই। খুঁটির পাশে পানের পিক আর গরুর ন্যাদা পড়ে রয়েছে। হাজি চান দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে মাছের মতো ঠোঁট নাড়ছেন। বিবিকে পাশ দিয়ে ঢেঁকিঘরে যেতে দেখে যেন আপনমনেই বলেন – ‘যত নষ্টের গোড়া ওই বকশির পোলা, কী জানি নাম?’

‘জহর বকশি।’

হু! জহর বকশি। ওর তালে পড়েই তো মোয়াজ্জেম গেল কলিকাত্তায়। ঘরের কাছে ঢাকায় আছে মিটফোর্ড, ময়মনসিংহে লিটন মেডিক্যাল কলেজ। এর যে কোনো একটায় ভর্তি হলে চোখে চোখে রাখা যেত। না, ওকে যেতেই হবে শিয়ালদা ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল, যা ওর বেতরিবত বাপ-মা ঠিকভাবে উচ্চারণও করতে পারে না। হাজি চান তখন বাধা দিতে পারতেন, পড়ার খরচ ধারে দিচ্ছেন যখন। তিনি বেঁকে বসলে এলাকার হিঁদু জমিদার বা জোতদারের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা আনার সামর্থ ছিল মেহের আলির! যে ক’গন্ডা ফসলি জমি আছে, এর সঙ্গে বসতবাড়িটাও বন্ধক পড়ত। ঋণ সালিশি বোর্ড তো কাগজে-কলমে। মোয়াজ্জেম হকের সিদ্ধান্তে হাজি চান তখন না-রাজি আবার রাজি। ঢাকার নওয়াবের কাছ থেকে তালুক খরিদ করা বাবদে তাঁর আব্বার আমল হতে ঢাকায় চলাচল থাকলেও, কলিকাত্তা তো খোয়াব। সেই মহানগরীতে বসে রাজত্ব করছেন তাঁর প্রিয় নেতা এ কে ফজলুল হক। হিঁদুরা যাঁর পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে রয়েছে। ‘লাঙ্গল যার জমি তার। ঘাম যার দাম তার।’ হক সাহেবের কৃষক-প্রজা পার্টির এমনতর সেøাগান তো হাজি চানের পেটে লাথি মারার শামিল। যার জমি আছে লাঙ্গল নাই। শরীর আছে ঘাম নাই। খোদা সাক্ষী, তবু তিনি নেতার প্রতি মুহূর্তের জন্যও নাখোশ হন নাই। উল্টা মনকে বুঝ দিয়েছেন – জমিদার-নন্দন যদি জমির মায়া ছাড়তে পারেন, তিনি কোন ছার, আশপাশের দু-চার গাঁয়ের সামান্য এক তালুকদারই তো! হক সাহেবের ওপর হিঁদুদের চটার কারণ আর কিছু নয় – ওরা মুসলমানদের আর তখতে দেখতে চায় না। এ নাক-উঁচা মুনাফেকদের জ্ঞানগম্যি আজকাল থোড়াই পরোয়া করেন হাজি চান। হালে ওদের পত্রপত্রিকা বাড়ি-আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। মুসলমানের আলাদা স্বপ্নভূমির মানচিত্রটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

১৯৩৯ সালে মোয়াজ্জেম যখন কলিকাত্তা পড়তে যায়, তখন লাহোর প্রস্তাবের এক বছর বাকি। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর জমানা শুরু হয় নাই। তিনি বাড়িতে তাঁত বসিয়েছিলেন। যদিও মলমলের আচকানের ওপর কাঁধে ফেলা চাদরিটাই ছিল শুধু খদ্দরের। তখন জহর বকশির কুমন্ত্রণার কথা কানে গেলেও তেমন গা করেননি হাজি চান। ভেবেছিলেন হয়তো, খোদাতায়ালা যার উন্নতি চায়, স্বয়ং শয়তানও তাঁর সহায় হয়। ইয়াকুব নবীর পুত্ররা ইউসুফকে কুয়ায় ফেলে তাঁর মিসরের রাজা হওয়ার পথই প্রশস্ত করেছিল। এর জন্য অবশ্য ইমানের জোর থাকা চাই। নয়তো মহামানব গোপনে জুলেখার আঁচলে বাঁধা পড়তেন আর প্রকাশ্যে করতেন আজিজ মিসিরের গোলামগিরি। মোয়াজ্জেম তো সে রকমই করল। নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পায়ে ঠেলে কার পিছে শামিল হলো ও! ঢেঁকিঘর থেকে বিবিকে বেরিয়ে আসতে দেখে নড়েচড়ে বসেন হাজি চান। ‘কী করবা চাউলের গুঁড়া-টুড়া দিয়া? পিডা-চিঁড়া বানাইবা?’ বিবি নাকের নথ পর্যন্ত ঘোমটা টেনে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে, তিনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ান। ‘আগে আমার একখান কথার জবাব দেও চাই, জিন্দেগিতে হুনছ – হিন্দু ভালো চায় মুসলমানের?’

 

আমি তোমার ভালো চাই মোয়াজ্জেম

জহর বকশির নসিহত।

জানালার দিকে মুখ করা টেবিলে কলম ঠোকে জহর। প্রতীমা বিসর্জনের পালা চুকে গেলেও বকশির আত্মীয়দের হই-হল্লায় তখনো ভেতরবাড়ি গুলজার। মেয়েদের আলাপ-সালাপ আর হাসির গমক বাতাসে তরঙ্গ তুলে ছুটে আসে। মোয়াজ্জেম হকের মনে হয় – কিন্নরী যেন একেকটা। কথা কয়, হাসে এমন ঝনঝনিয়ে! সুরেলা হাসির জন্য সায়মা খাতুনের কী এমন বয়েস! অথচ ওদের বাড়িটা দিনমান যেন পানি। বাঁশঝাড়ে একটা কাঠঠোকরা থেকে থেকে ঠুক ঠুক করে সারা দুপুর। মেহের আলি জোয়াল কাঁধে জোড়া বলদ হাঁকিয়ে বাড়ি ফিরলে শোরগোল লেগে যায়। গরু আর মানুষের। ক্ষুধার্তের হাঁকাহাঁকি এসব। কান্না নয়, হাসি তো না-ই।

‘সারাক্ষণ কী ভাবো মিয়া?’ মোয়াজ্জেম হকের গিঁট-লাগা জোড়া ভুরুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে জহর। ‘আমি তোমার ভালো চাই মোয়াজ্জেম – নেও এইবার পড়া শুরু করো।’ ওরা তখন ইংরেজি ব্যাকরণ বই বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা খুলে বসেছে। প্রতিবারের মতো এবারও হিং টিং ছট। তা-ও কবিতাটার সেই অংশ, যেখানে গৌড়ীয় সাধু প্রহর গুনে রাজা হবুচন্দ্রের স্বপ্ন ব্যাখ্যা করছেন। জিবের আড়-ভাঙতে এ-আবৃত্তিটার জুড়ি নাই – জহর ব্যাখ্যা করে বলে। শব্দ নয়, যেন দাঁতের তলায় কেউ কঙ্কর-পাত্থর ভাঙছে। মোয়াজ্জেম হক নীরব শ্রোতা, আর মাতব্বরিটা জহরের বংশগত। সেইমতো উপদেশও ঝাড়ে কথার ফাঁকে ফাঁকে। কলকাতা যাবার প্রস্তুতিস্বরূপ সর্বপ্রথম দরকার, জহর বলে, ‘অ্যান্ট্রান্সে কত নম্বর পাইছ, সেইডা না। নম্বর তুমি পাইবাই, ক্লাসের সেরা ছাত্র যখন। ওরা দেখবে – শুদ্ধ উচ্চারণে তুমি কথা কইতে পারো কিনা।’

সেই প্রচেষ্টাই চলছে পূজার ছুটিতে জহর বকশির বাড়ি আসার কদিন পর থেকে।

ছোটবেলা থেকে মোয়াজ্জেম হক শুনে আসছে তার জিবের জড়তা মুসা নবীর মতো। সময় সময় যে নিজের কথা নিজেই বোঝে না। তাই নিয়েই খোদার সঙ্গে তকরার করতেন হজরত মুসা তুর পর্বতে। মোয়াজ্জেম হকেরও আজান দিতে অসুবিধা হয় না। এখনো দেয়, লজিং মৌলভি সাহেব যখন নিজের বাড়ি যান বা দাওয়াত সেরে ফিরতে যখন তাঁর দেরি হয়। ওটা ঠেকার কাজ। কোরআন তিলাওয়াত, তা কোনোভাবেই নয়। এখনো রোজার মাসে কোরআন খতম না দিলে ঈদের আনন্দই মাটি। কলকাতা গেলে এসব নিশ্চয় থাকবে না! আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হতে যাচ্ছে না যখন সে! কিন্তু বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণ! বাবা রে, মা-মা রে! ভুল ধরতে জহর বকশি ওস্তাদ। গত এক বছরে কলকাতার বুলি শুনে শুনে কানটা ওর তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু তালিম দিতে গিয়ে রাজ্যের বিপত্তি, বকশির নিজের জিবেরও আড় ভাঙেনি বলে। তা চাপা দিতে আবৃত্তি বাদ দিয়ে আগড়ম-বাগড়ম জুড়ে দেয়। এভাবে অর্ধেক দিন কাবার।

‘এ সময়ে মেট্রো সিনেমা হলের ম্যাটিনি শো ভাঙে।’ জানালা দিয়ে শরতের শেষ বেলার স্বর্ণচাঁপা রঙের রোদের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলে জহর। ‘বুঝলা মিয়া, দুপুরের শোতে টিকিট সস্তা। সিনেমা শেষে এক পয়সার কুলফি কিনে হাঁটা দেও। ঠিকই বাত্তি জ্বলার আগে ডাফ হোস্টেলে পৌঁছাই যাবা।’ মোয়াজ্জেম হক তাজ্জব – বকশি যদি কুলফিই খায়, বৈকালিক চা-সহযোগে সিগ্রেট ফোঁকাটা সারে কখন? কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে বলতে বাধে। দুবছরের সিনিয়র, তায় বড়মানুষের সন্তান। বয়স-মর্যাদা দুদিক থেকেই সরেস। বিকালে বইপড়া চোখের জন্য খারাপ – এ ছুতায় ওরা পুকুরঘাটে এলেও মোয়াজ্জেম জানে, বকশির সিগারেটের নেশাটা এখন চাগিয়ে উঠেছে। ঝপ করে অন্ধকার নামলে ঝোপের আড়ালে চলে যাবে। মজু ধরবে ওর বাড়ির পথ। তার আগে শানের ঘাটে বসে, দু-চার পদ চিনা-মোগলাই সিদ্ধ-নিষিদ্ধ খাবারের বয়ান দিয়ে বকশি চলে যায় সর্বভারতীয় হোস্টেলমেট আর কলেজের ইংরেজ, আধা-ইংরেজ অধ্যাপকদের গুণকীর্তনে। কত বর্ণের মানুষ, কত তাদের ধর্ম-ভাষা! মোয়াজ্জেম হক নীড়ে ফেরা পাখপাখালির বিচিত্র কলকাকলি শোনে। পুকুরে নানাজাতের মাছের ঘাই মুগ্ধ চোখে দেখে। খেতের কোণে, মরা খালে নিজের তৈরি মাছের খাটরিগুলির কথাও ভাবে। কিন্তু কোনোভাবেই মহানগরীর চেহারাটা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। ‘গেরামে থাইক্যা কলিকাত্তা শহর বোঝন যায়!’ পুকুরের পানিতে মাটির ঢেলা মেরে বকশি বলে, ‘মরো-বাঁচো, সেখানে তোমার যাইতেই হবে, মোয়াজ্জেম। নইলে জীবনই বৃথা।’

দুজনের এ প্রীতির সম্পর্কটা বড় অদ্ভুত। যার শুরু মাত্র কদিন আগে আরও অদ্ভুতভাবে।

মোয়াজ্জেম হক সেদিন খেতের কোণের খাটরি থেকে মাছ ধরছিল। রাস্তার ধারের খেত। পাশেই একটা পাকুড়গাছ। পাকুড়ের ছায়ায় কচুরিপানায় তলানো শীতল জলের ত্রিভুজাকৃতির খাটরি। তাতে বেশ কদিন আগে মান্দারের ডাল ফেলে কচুরিপানা ছাড়া হয়েছে। মোয়াজ্জেম খাটরির পানিতে নেমে ডালপালা সরায়। একটা একটা করে কচুরিপানা তুলে চোখের সামনে ধরে দেখে এর লম্বা দাড়ির মতো আঁশে কুঁচো চিংড়ি লটকে আছে কি না। তারপর পরনের ডুরি লুঙ্গিটা লেংটির মতো পাছা উদাম করে গোছ দিয়ে লেগে পড়ে এনামেলের বাটি দিয়ে পানি সেচতে। শরতের পড়ন্তবেলা। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। মেহনতে মোয়াজ্জেমের কপালের রগ বেয়ে ঘাম ঝরছে। কোমর সোজা করে হাতের চেটোতে ঘাম মুছতে মুছতে সে দেখে – জহর বকশি ধুতির কাছা দুলিয়ে সড়ক দিয়ে হেঁটে আসছে। স্কুলে তুখোর ছাত্র ছিল জহর। অ্যান্ট্রান্সে পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে কলকাতার সেরা কলেজে ভর্তি হয়েছে। তখনো অনেকটা দূরে জহর বকশি। মোয়াজ্জেম লুঙ্গির কাছা খুলে একটু ভদ্রভাবে ঊরু ঢেকে গোছ দিয়ে ফের লেগে পড়ে পানি সেচতে, যদিও ওর উদাম পাছার দিকে থোড়াই ফিরে তাকাত জহর! জহর বকশি রোজ এ সময়টায় বাজারে যায় চায়ের সঙ্গে সিগারেট ফুঁকতে। দুদিন আগেই খেতের বেগুন বেচে বাড়ি ফেরার সময় মোয়াজ্জেম ওকে দেখেছে – চা-দোকানের পেছনের আলো-আঁধারে একা দাঁড়িয়ে ধুমসে সিগারেট টানছে।

কাদার পাঁকে মাছের ঘাপানি শুরু হতে জহর বকশির কথা বিলকুল ভুলে যায় মোয়াজ্জেম। পূজার সময়টায় মাছের বাজার পড়তি যদিও, পর্যাপ্ত শিং-মাগুর আর শোলের মতো জিওল মাছ মিললে তার স্কুলের বেতনসহ সামনের পরীক্ষার ফি হয়তো উঠে যাবে। তবে এক খাটরির মাছে হবে না। আধা শুকা খালের জায়গায় জায়গায় সে আরও পাঁচ-ছয়টা খাটরি থিতিয়ে রেখেছে। কেউ বাগড়া না দিলেই হয়।

মোয়াজ্জেম হক কাদা থেকে শোল-মাগুর টেনে টেনে বাঁশের ডুলায় ফেলছে। কাদাতে তার সারা গা মাখামাখি। শিং মাছের মাথা চেপে ডুলায় ছেড়ে দিতে আচমকা পাকুড়ের তল থেকে ‘বাহ্’ ধ্বনি কানে আসে। ‘আমি ভাবলাম তুমি লেঞ্জায় ধরবা,’ গাছে হেলান দিয়ে বসে বলে জহর। ‘শিঙ্গিমাছের ঘাই খাইছ কোনোদিন?’ মোয়াজ্জেম মাথা নেড়ে ছোট্ট করে হাসে। কাদা হাতে আদাব জানালে বকশি কি-না-কি ভাবে! কথার মাঝখানে তা করাও যায় না। সহবত দেখাতে যে পাড়ে উঠবে তারও জো নাই। কাদার মাছ আরও গভীর কাদায় তলিয়ে যাবে। বকশির সঙ্গে খোশালাপের সময় কই তার! পায়ের তলায় কিলবিল করছে যে মাছটা, তা বাইন সম্ভবত। যার কড়কড়া ভুনা খেতে মোয়াজ্জেমের আব্বা খুব ভালোবাসেন। তার মানে একে পরীক্ষার ফি থেকে মাইনাস করতে হচ্ছে। শিং মাছ নয় বলেই মোয়াজ্জেম একে লেজে ধরে তোলে। তারপর মাথার ওপর বাঁই বাঁই ঘুরিয়ে ছুড়ে মারে খাটরির ধারের সেচা পানিতে, যেখানে আঁশ থেকে কুঁচো চিংড়ি বেছে খানিক আগে কচুরিপানা ফেলা হয়েছে।

‘ঢোঁড়া সাপ, বাপ রে বাপ!’ বকশি চোখের পলকে সড়কের আরেক ধারে লাফিয়ে পড়ে লজ্জাবতীর পাতা বুজিয়ে দেয়। পারলে তখনই ওপাশের শেওড়াগাছটায় চড়ে বসত। তার ধুতির কাছা খুলে গেছে। সেই বীরত্বের কাহিনি কলকাতার ডাফ হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। গল্পে মোয়াজ্জেমের লুঙ্গির কাছা খুলে যায়। আর সাপটা মাথার ওপর বাঁই বাঁই ঘোরায় জহর বকশি। মোয়াজ্জেমকে সেদিন মাথা নেড়ে তা কবুল করতে হয়েছিল। কেননা দূরের শহরে হলেও বকশির ছেলের মান রক্ষার দায় বংশানুক্রমে তার।

তখনো মোয়াজ্জেম হক মাছ ধরার মাঝপথে। জহর টলতে টলতে পাকুড়ের তলায় এসে জানায়, সাপের ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। এখন সিগারেট না ধরালেই নয়। এমন খোলা জায়গা – কে কখন চলে আসে। তাই মোয়াজ্জেম হকের পাহারা তার আবশ্যক। প্রস্তাবটা যত কা-জ্ঞানহীনই হোক, বকশির কথার বরখেরাপ করার হিম্মত তার আব্বা মেহের আলিরও নাই। মোয়াজ্জেম যখন পাড়ে ওঠে, তখন তার পা-জোড়া এমন কর্দমাক্ত যে, মনে হয় কাদা দিয়ে বুট বানিয়ে পড়েছে। হাত দুটিতে কাদার গ্লাভস। সে অবস্থায় গাঁয়ের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার চন্দ্রমল্লিক সেন পেছন থেকে আচমকা উজিয়ে উঠলে জহর আধখাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট মোয়াজ্জেমের হাতে চালান করে দেয়। হাতের কাদা ঝেড়ে সিগারেটটা নিতে একটু দেরিই হয়েছিল মোয়াজ্জেম হকের। ঠোঁটেও ছোঁয়ায় নাই। তা সত্ত্বেও মশারির দড়ি খুলে মাঝরাতে ধুম ধুম পাচনের বাড়ি। মাছ-ধরার ক্লান্তিতে সেদিন সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছিল মজু। বাপের পাচনের বাড়ি গায়ে পড়তে তড়াক করে অন্ধকারে নেমে গড়িয়ে চলে যায় চৌকির তলায়, যেখানে ঝুনা নারকেল-মিষ্টিকুমড়া আর এক রাজ্যের ধেড়ে ইঁদুরের সহবাসে কাটে সেই রাতটা।

জহর বকশি মেধাবী ছাত্র হলেও কৌশলী ছিল না। ধরাও পড়ল হাতে-নাতে। সিগারেট ফোঁকায় যত মজা, তার চেয়ে দুনা ছিল বাবা দাশু বকশির বিরাশি ওজনের থাপ্পড়টা। এক থাপ্পড়েই গাল ফুলে ঢোল। বাজারে যাওয়াও সেদিন থেকে বন্ধ। গেলেও, কার এমন বুকের পাটা যে, জহর বকশির কাছে চা-সিগারেট বিক্রি করবে, যেখানে খবর আছে বাপ ছেলের ওপর মহাখাপ্পা! কথাটা তো বাতাসের আগে তামাম মুলুক ছড়িয়ে পড়েছে।

দুদিন পর মোয়াজ্জেম হক স্কুল থেকে ফিরে শোনে, তার খোঁজে জহর এসেছিল। মেহের আলি আর কী বলবেন, যা শাসন করার ছেলেকে করা হয়ে গেছে। চন্দ্রমল্লিক সেনের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রখর – মজুর কথাটা খুব সম্ভব দাশু বকশির কানে তোলে নাই। আর তুলবেই কেন, মজুকে কাদামাখা হাতে সে তো সিগারেট টানতে দেখে নাই। তবে সঙ্গদোষে স্বভাব নষ্ট – কথাটা তাই আগাম বলে সতর্ক করে দিয়েছে ছেলের বাবাকে। মেহের আলি নিজে গাছে উঠে ডাব কেটে খেতে দেন জহরকে। হাতপাখা নিয়ে ব্যজন করতেও যান। ‘কী করেন, কী করেন? আপনে মোয়াজ্জেমের বাবা, আমার গুরুজন!’ বলে জহর পাটি ছেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। তাতে মেহের আলির রাগ-ক্ষোভ মোমের মতো গলে যায়।

‘পোলাডা অর বাপ-দাদার লাহান না।’ গরুঘরের ভাঙা বেড়া বাঁশের চাঁছা বেতে বুনে দিতে দিতে ছেলেকে বলেন মেহের আলি। এখন বেড়া না সারলে হালের বলদ জোড়া আগামী শীতে কষ্ট পাবে। বই-খাতা হাতে মোয়াজ্জেমকে মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহের আলি হাতের কাজ রেখে তাড়া দেন, ‘যা একবার দেহা কইর‌্যা আয়। কী জানি জরুরি কাম আছে কইল!’

‘আগে তো হাত-মুখ ধুউক। মিন্নত কইরা আইছে পোলাডা!’ মায়ের কথামতো ঘরে বই-খাতা রেখে পুকুরঘাটে যায় মোয়াজ্জেম। ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে। আজ কি ষষ্ঠী? বকশি বাড়ি যাওয়ার জন্য সামনের  হাটবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। হাটের দিন বাজারের টি-স্টলে বসে গুলতানি না মারলে পড়তি জমিদার দাশু বকশির পেটের ভাত হজম হয় না। তার ওপর তিনি দু-দুবারের পঞ্চায়েত চেয়ারম্যান। খুচরা সালিশ-দরবার সারতে সারতে ওইখানেই রাতের তৃতীয় প্রহর। তারপর ঘোড়া-টানা ছেকড়া গাড়িতে যখন বাড়ি ফেরেন, ততক্ষণে গাঁয়ের লোক একঘুম দিয়ে উঠেছে, পাখপাখালি আড়মোড়া ভাঙছে গাছে গাছে।

পরের হাটবারে মোয়াজ্জেম হক যখন লুঙ্গির ওপর বেনিয়ান চাপিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন বেলা ভাটিতে। সন্ধ্যা লাগার আগে বকশিদের কাছারি ভাঙে না। এখনো হয়তো চৌকির ঢালা ফরাসে কর্মচারীরা উবু হয়ে লেখাপত্র করছে। খোলা বারান্দার ইজিচেয়ারে দাশু বকশি। মুখে ঝকঝকে ফুরসির নল। চোখদুটি কাছারির ধারের রাস্তায় নিবদ্ধ। ‘কেডা যায় রে গাডা দিয়া?’ তাঁর বাজখাই গলায় হাঁক শুনে কত পথচারী যে কাপড় নষ্ট করে!

সেদিন মোয়াজ্জেম হক বড় সতর্ক। কিছুতেই দাশু বকশির নজরে পড়া যাবে না। মারের চোটে জহর হয়তো ওর নামটাও বিড়িখোরের দলে ভিড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে অবশ্য পরদিনই কাছারিতে ডাক পড়ত মেহের আলির। তবু সাবধানের মার নেই। মোয়াজ্জেম ঘুরপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যায় জ্যোতি ঠাকুরের পুকুরের পাড়। ঠাকুর-তনয়া সুরবালার কচি গলার চেঁচানি অগ্রাহ্য করে শিউলিগাছ ঝাঁকিয়ে ফুল কুড়িয়ে বেনিয়ানের জেবে ভরে। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে নদীর ধারের মালোপাড়ায় দিকে এগোয়। পাড়ার বাতাসটা গাবের পানি আর আলকাতরার গন্ধে মাখামাখি। তাতে শিউলির গন্ধটা যেন পালিয়ে বাঁচে। বাঁশের আড়ার মেলা জালে মালোদের ছোট ছোট কুঁড়ে দেখা যায় না। দেখা গেলেও মনে হয় এগুলো জালে আটকা পড়া ভিনজাতের মাছ। এমন একটা জাল থাকলে – মোয়াজ্জেম হক ভাবে, পানির টান ধরার জন্য ওকে অপেক্ষা করতে হতো না, সারা বছর খালে-বিলে মাছ ধরতে পারত। তাতে অবশ্য পড়াশোনাও লাটে উঠত। তা সত্ত্বেও নয়া জালের দর মুলামুলি করে সে খানিক। যেন দামে বনে নাই, সেই রকম মুখ করে শীলবাড়ির খালপাড় দিয়ে যখন যায়, তখন নাঙা পায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি কাটা চুলের সুড়সুড়ি লাগে। সে সময় শম্ভু শীলের বিধবা পিসি মান্দারের সারির ফাঁক দিয়ে ডাকাডাকি জুড়ে দিলে মোয়াজ্জেমকে ফিরে তাকাতেই হয়। শম্ভুর মাথামোড়া পিসিটা যেন গাছ-পাথর, সে জন্মাবধি একই রকম দেখে আসছে। এর মধ্যে কলেরায় ছোট ভাই-ভাইয়ের বউ নিকাশ হয়ে গেল, বুড়িটাকে যমও এড়িয়ে চলে। কথাটা অবশ্য মোয়াজ্জেমের প্রাক্তন ক্লাসমেট শম্ভুর। বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তির পর ন্যাড়া মাথায় স্কুলে এসে প্রথম দিনই সে বলেছিল কথাটা। তারপর তো পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পৈত্রিক পেশায় নাম লেখাতে হয় শম্ভুকে। শম্ভুর পিসির পান খাওয়ার আমন্ত্রণে, নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর মাঝখান থেকে মাথা নাড়ে মোয়াজ্জেম। খাল পেরিয়ে বারুইদের পাটখড়ির বেড়ায় ঘেরা পানের বরজের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় – পানটা খেলেই পারত। জিবটা তো জুতার চামড়ার মতো শুকনা খরখরে। বকশিবাড়ি যত কাছিয়ে আসে, বুকের ধড়ফড়ানিও বেড়ে যায়। জহর বকশিকে কাছারিঘরের জানালার শিক ধরে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেও তার মুখ দিয়ে কথা সরে না। জহর যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল। হাতছানি দিয়ে মোয়াজ্জেমকে দাঁড়াতে বলে ত্বরায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

বকশি নিজের বাড়ি কয়েদ খাটছে নাকি – পরনে ডোরাকাটা হাফপ্যান্ট-হাফশার্ট! পুকুরপাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জহরের দিকে আড়চোখে তাকায় মোয়াজ্জেম হক। শানের ঘাটে মুখোমুখি যখন দুজন, তখনো স্ব-স্ব পিতৃহস্তে লাঞ্ছনা নিয়ে কথা বলে না। আবছা অন্ধকারে পুকুরের ছোট ছোট তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে জহর। চোখ দুটি শান্ত, বিষাদময়। সেদিনের খাটরির ধারের টগবগা যুবা পুরুষটি যেন সে নয়, অন্য কেউ ছিল। হাফপ্যান্ট, হাফশার্টে এখন জহরকে আরও কচি দেখায়। যদিও মুখটা চিন্তাক্লিষ্ট বৃদ্ধের। মোয়াজ্জেম হকের অস্থির লাগে। পুকুরঘাটে মুখোমুখি বসে থাকার জন্যই কি বকশি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে? ওর কাছে সময়ের দাম না থাকলেও মোয়াজ্জেমের আছে। সে এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থী। মাগরিবের আজান পড়তে জহর যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে – ‘লেখাপড়ার বিকল্প নাই, মোয়াজ্জেম। সামনে তোমার এন্ট্রান্স পরীক্ষা। যদি ভালো রেজাল্ট করতে পারো, তোমার সামনে দুয়ার খুলে যাবে।’

এ আর নতুন কী। স্কুলের প-িত স্যার, মৌলভি স্যারের মুখেও হরদম এই উপদেশ। সামনের দুয়ারটা কী, যা খুলে যাবে? বকশিদের প্রতিষ্ঠিত গাঁয়ের পাঠশালায় মাস্টারির চাকরিই তো! যেখানে ছাত্রের চেয়ে ছাগল চড়ে বেশি। শিক্ষকরা মাইনে পায় না। তাই ধানের মৌসুমে ছালা নিয়ে ঘোরে ছাত্রের বাড়ি বাড়ি। মোয়াজ্জেম হকের উঠি উঠি ভাব দেখে জহর অবশেষে তূণ থেকে বাণ ছোড়ে, ‘তুমি কলিকাত্তা গেলে বোজতে পারবা, মোয়াজ্জেম, এত দিন কোন গর্তে ছিলা। ছি এহানে মানুষ থাকে!’ শেষ বাক্যটা বলার সময় বকশির গলার জোরে ভড়কে গিয়ে ফের ঘাটের সিঁড়িতে বসে পড়ে মোয়াজ্জেম। ওর নিজেরও সমানতালে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে – না এইহানে মানুষ থাকে না। এইডা কুয়া আর মানুষগুলা কুয়ার ব্যাঙ।

সেদিন ঘাটে বসেই আগামী এক মাসের কর্মপন্থা ঠিক হয়। মোয়াজ্জেম হক তুলনামূলকভাবে ইংরেজিতে কাঁচা যখন, পূজার ছুটির বাকি সময়টায় ও এখানে ইংরেজি গ্রামার পড়তে আসবে। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা বকশিদের লাইব্রেরিতেই আছে, তাই কবিতা আবৃত্তির ভাবনা নেই। ওতে জিবের আড়ষ্টতা ভেঙে শুদ্ধ বাংলা সড়গড় হবে।

সেইমতো চলছিল। ইংরেজি শেখায় অগ্রগতি হলেও বিপত্তি বাধে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে। মোয়াজ্জেম হকের মনে হয় কবিতা বাছাই ঠিক হয় নাই। ওরা সোনার তরী দিয়ে শুরু করতে পারত। ‘ওইটা আরও কঠিন’ – জহর বলে। বাঘা বাঘা প-িতেরা নাকি এর অর্থ বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বয়ং কবিও খামোশ।

বকশি যখন বলছে, তারপর আর কথা কী। কবিতা বাছাইয়ের টকরা-টকরির ইতি ঘটলেও জহরের পেটভর্তি কথা, বলতেও পারে অনর্গল। কলকাতার টোপ গিলিয়ে একদিন সে আসে স্বরাজ প্রসঙ্গে। ‘তোমরা মুসলিমরা স্বরাজের জন্য কিছু করছ, হিন্দু জমিদারদের পিছে লাগা ছাড়া!’ তত দিনে মোয়াজ্জেমেরও জবান ফুটেছে – ‘কেন সিপাহি বিদ্রোহ, ওহাবি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা!’

‘এ তো গত শতাব্দীর। হালের জমানার কথা কও।’

হালের জমানার লড়াই তো জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজার। দাশু বকশির বিরুদ্ধে তার আব্বা মেহের আলির। সেসব শুনতে কি জহর বকশি রাজি? তত দিনে কলকাতায় পড়ার ইচ্ছাটা এমন প্রবল হয়ে উঠেছে যে, মোয়াজ্জেম সতর্ক হয়ে ভাবে, জহরকে খেপানো ঠিক হবে না এখন।

তারপরেও জহরকে কখনো খেপাতে যায়নি মোয়াজ্জেম। শিয়ালদা থেকে মানিকতলা এমন কী দূর। তবু মাস দুয়েকের মধ্যে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদ মানে বেলেঘাটার এঁদো মেসবাড়ি থেকে অভিজাত ডাফ হোস্টেলে গতায়ত যায় বন্ধ হয়ে। জহরের বড়লোকি চাল আর কংগ্রেসি বোল শুনে শুনে মোয়াজ্জেম হক হয়তো তত দিনে অতিষ্ঠ। তা ছাড়া, সাবিনা ভাবে, কলকাতা নগরীতে তখন কত মত, কত পথ। নানা রকম রাজনৈতিক গুঞ্জন, তর্কাতর্কি। কংগ্রেস দলেও বিভক্তি। তাতে অবশ্য পড়াশোনার প্রথম বছরটায় ওর বাবা কতখানি সাড়া দিতে পেরেছিলেন সন্দেহ।

ডাক্তারি পড়া সব সময়ই ব্যয়বহুল। মোয়াজ্জেম হকের জন্য বাড়ি থেকে খুব সামান্যই টাকা যেত। বৃত্তি আর দুবেলা টিউশনিই তখন সম্বল। যে মেসবাড়িতে থাকত সে, ওখানে পড়ার চেয়ার-টেবিল ছিল না। খাপরা ঘরের টিমটিমে আলোয় পা গুটিয়ে মেঝেতে বসে পড়তে হতো। পাশের উদলা ড্রেন থেকে দুর্গন্ধের সঙ্গে উঠে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে মশা-মাছি। তখন ডাফ হোস্টেল আর বেলেঘাটার মেসবাড়ি – গাঁয়ের সেই আকাশ-পাতাল ফারাকটাই হয়তো মনে করিয়ে দিত। তা ছাড়া, সাবিনা ভাবে, আব্বা হয়তো গাঁয়ের জমিদার-পুত্রের বোঝা আর বইতে পারছিলেন না। আজাদি চাইছিলেন পূর্ব জীবনের নিগড় হতে।

এ কে ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। বছর গড়ায়। বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সাড়াশব্দ নাই। তাতে মোয়াজ্জেম হকের নিরাশ হওয়ারই কথা। সে এলএমএফ ডাক্তার হলে কী, বাবা মেহের আলি তো জোড়হাত করা দাশু বকশিরই প্রজা। তখন জহরের কথাগুলো হয়তো মনে পড়ত – ‘তোমরা মুসলিমরা স্বরাজের জন্য কী করছ? হিন্দু জমিদারদের পিছে লাগা ছাড়া?’

জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হচ্ছে না যখন, ইংরেজ হটিয়ে স্বরাজ কায়েমের কথাই তো এখন ভাবা উচিত।

ঠিক সে সময়ে সুভাষ বসুর কাছ থেকে ডাক আসে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের। যদিও প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের বিপক্ষে সুভাষচন্দ্র বসুর অবস্থান, মোয়াজ্জেম হক হয়তো নিজের সঙ্গে তখন রফা করেছিলেন – সদ্য কংগ্রেস দল থেকে বহিষ্কৃত তাঁর তুল্য জনপ্রিয় নেতা সর্বভারতে তখন কে! এমন নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে রাতারাতি দেশপ্রেমিক বনে যাওয়ার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, যা আবার ডানপন্থী কংগ্রেসি জহরের ওপর টেক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্টই। নাকি ইসলামিয়া কলেজে মোয়াজ্জেম হকের কিছু ইয়ারদোস্ত ছিল, যারা ছিলেন আন্দোলনের সামনের সারিতে? তেমন কেউ থেকে থাকলেও সে অজ্ঞাত, অনামা। অনিতা সেনের স্মৃতিকথার সুবাদে সাবিনার সামনে চলে আসে মোয়াজ্জেম হকের ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসমেট নিরোদচন্দ্র সেন। দুজনের সম্পর্কটা আর যা-ই হোক জমিদার-রায়তের ছিল না। জহর যদি নিজের অজান্তে মোয়াজ্জেমকে হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়ে থাকে, নিরোদ তাকে জড়িয়ে নিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, নিরোদচন্দ্র সেন তার পূর্ব জীবনের তিক্ত স্মৃতির শরিক নয়। তার কাছে গাঁয়ের শাপলা ফোটা ঝিল, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষিরোনদীর গল্প রং চড়িয়েও বলা যায়।   (চলবে)