স্মৃতির ছায়াপাত

 

শাহীন আখতার

\ ৪ \

 

অনিতা সেনের স্মৃতিকথা

তারপর লম্বা বিরতি দিয়ে আরো কখানা চিঠি আসে দাদার কাছ থেকে। একেকটার লেফাফায় সাঁটা একেক দেশের ডাকটিকিট। দাদারা যেন সদ্য শিং-গজানো বাছুর, এলোপাতাড়ি ঢুসা দিচ্ছিল আজ এ-জায়গায় তো কাল আরেক জায়গায়। একচলিস্নশ সালের শেষদিকে ব্যাংককে ওদের যোগাযোগ হয় ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ নামের একটি গুপ্ত দলের সঙ্গে। লিগ সম্ভবত বিখ্যাত গদর পার্টির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি শাখা বা অনুরূপ কোনো সংগঠন। দলের নামকরণে হিন্দুস্থানি ‘গদর’ শব্দটি নেওয়া হয়েছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে, ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে। যেমনটি পরে সুভাষ বসুও করেছিলেন – আজাদ হিন্দের তেরঙা পতাকার মধ্যিখানে মাইসুরের টিপু সুলতানের লম্ফমান ব্যাঘ্র।

প্রবাসী ভারতীয়দের তৈরি এ গদর পার্টির বেশিরভাগ সদস্যই ছিল শিখ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক। দাদার চিঠিতে লিগের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ছিল। ছিল গদর পার্টির সদস্যদের অতীতের দুর্ধর্ষ লড়াই আর আত্মত্যাগের কাহিনি। ১৯১৫ সালে পেশোয়ার থেকে সিঙ্গাপুর যে সেনা বিদ্রোহের পরিকল্পনা আঁটা হয়, তা ফাঁস হয়ে গেলে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় একে একে ফাঁসিতে ঝোলেন গদর পার্টির সদস্যরা। তখন প্রাণভিক্ষার কথা উঠলে গদর-নেতা কর্তার সিং বলেছিলেন, ‘কেন প্রাণভিক্ষা চাইব? আমার যদি একটার বেশি প্রাণ থাকত, সবকটিই উৎসর্গ করতাম দেশের জন্য।’ তাঁদের সেদিনের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পায় কেবল সিঙ্গাপুরে। তাও স্বল্প সময়ের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের মিত্র জাপান। জাপানি ক্রুজার এসে কেলস্নায় কামান দেগে দমন করে জমাদার চিসিত্ম খান, জমাদার আবদুল গনি ও সুবেদার দাউদ খানের নেতৃত্বে পঞ্চম লাইট ইনফ্যানট্রি ও ৩৬তম শিখ বাহিনীর পাঞ্জাবি মুসলমানদের বিদ্রোহ। তারপর একে একে তাঁদের আনা হয় কোর্ট মার্শালের আওতায়। সে এক অভিনব, নৃশংস শাসিত্মদান-প্রক্রিয়া। সংক্ষিপ্ত বিচার শেষে সিঙ্গাপুরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়ে। পোস্টারে লেখা – কেলস্নার প্রাচীরের ধারে বিচারের রায় পড়ে শোনানো হবে, সুনাগরিকরা যেন পরিখার অপর পাড় থেকে দেখতে পান। তা দেখাই বটে। মালয়, উর্দু ও ইংরেজিতে হুকুম পাঠ করা হলেও পরিখার এপাড় থেকে কিছু বোঝা গেল না। প্রতিটি ভাষায় হুকুম পাঠের পর প্রত্যক্ষদর্শীরা শুধু শুনতে পেলেন দৈববাণীর মতো অদৃশ্য কারো জলদগম্ভীর স্বর – দাস জাস্টিস ইজ ডান। বিদ্রোহীরা তখন সাদা পোশাকে উর্দি হাতে খুঁটির গায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের পেছনে কেলস্নার উঁচু দেয়াল। সামনে প্রায় শখানেক গোরা ফৌজ অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়ানো, বাকি অর্ধেক হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসা। সবাই রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করতে প্রস্ত্তত। দাস জাস্টিস… বলা শেষ হলে আরেকজন চেঁচিয়ে ওঠে – রেডি, ফায়ার! সঙ্গে সঙ্গে সবকটা রাইফেল একসঙ্গে গর্জে ওঠে।

বরাবরের মতো দাদার এ দীর্ঘ চিঠিখানা মায়ের নামেই এসেছিল। তখন আমার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা না থাকায় আমাকে লিখত না দাদা। লিখলেও আমার পড়ার আগ্রহ হতো কিনা সন্দেহ। বিগত দিনের এই বিপস্নবীদের আমরা তখন মিসগাইডেড, টেররিস্টই বলতাম। ঘৃণা না করলেও করুণাই করতাম বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার জন্য। আজ চিঠি পড়তে পড়তে ভাবি, দাদা কেন সেসব মানুষের শেষ পরিণতি চিঠিতে বিস্তারিত লিখতেন? মাকে প্রস্ত্তত করার জন্যই কি? মায়েরও নিশ্চয় চিঠি পড়ে ছেলের জন্য মনে শঙ্কা জাগত। অথচ মুখে বলতেন, ওই মুসলিম ছেলেটাই সর্বনাশের মূল। তাঁর নিরো কখনো অবাধ্য বা দুঃসাহসী ছিল না। ছোটবেলায় ভয়কাতুরেই ছিল বরং। স্টিমারে দিদার বাড়ি যেতে খোয়াই নদীর বড় বড় ঢেউ দেখে ভয়ে কেঁদে উঠত। আজমিরীগঞ্জের অন্ধকার রাতগুলো ছিল আরো বিভীষিকা। দাদা কেঁদে কেঁদে বলত – ‘মা আমাকে শিলং পাঠিয়ে দাও। তোমাকে, অনুকে (আমার ডাকনাম) ছাড়া বাবার কাছে দিব্যি ভালো থাকব। একটুও দুষ্টুমি করব না, মা। রোজ রাতে দুধ খাব। দাঁত মাজব।’ উঠোনের খুঁটি ধরে দাদার সেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না আমার একটু-আধটু মনে আছে। তাতে দিদা খুব বিরক্ত হতেন। ‘তোর পোয়াডা পুরি নি লো?’ মাকে তিরস্কার করে বলতেন তিনি, ‘এমন বিলবিলাইয়া কান্দে কা লো লীলাবতী?’ কিন্তু সে তো দাদার দুধদাঁত পড়ারও আগের কথা। তারপর গঙ্গা-যমুনায় কত জল গড়িয়েছে! এখন উদোর পি– বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন মা? এ নিয়ে একদিন বচসা বাধে আমাদের দুজনের। আমি বলি, ‘টেররিস্টদের লিস্টে তুমি কখনো মুসলিম নাম দেখেছ, বিশেষত বেঙ্গলে? যারা বোমা মেরে ফাঁসিতে ঝুলেছে বা দ্বীপান্তরে গেছে? কোন মুসলিম ছেলে গীতা বা চ-ী পাঠ করবে বাধ্যতামূলকভাবে? বা কালীমায়ের পুজো করবে? বা প্রাণ থাকতে সাড়া দেবে – ভুলিও না তুমি জন্ম হইতে মায়ের জন্য বলিপ্রাপ্ত – এমন ভাষায় লেখা শপথবাক্যে!’ স্বদেশিদের এ-ধরনের রিচুয়ালের খবর অজানা ছিল না মায়ের। শেষমেশ আমি বলি, ‘দেখো, দাদাই হয়তো ওর মুসলিম বন্ধুটিকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে।’

তখনো আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি হয়নি। এর যে সিংহভাগ ঊর্ধ্বতন অফিসারই মুসলিম, তা জানা যাবে আরো পরে।

সেদিন আমার কথা শুনে নির্বাক তাকিয়ে ছিলেন মা। নিথর এক জোড়া সাদা ঠোঁট। চোখের তারায় জ্বলন্ত মোমের কাঁপা কাঁপা প্রতিবিম্ব। তখন আমি আর মা টেবিলে আধখানা মোম জ্বেলে রাতের খাবার সেরে মুখোমুখি বসে ছিলাম। সন্ধে থেকে লোডশেডিং। আমার খুব অস্থির লাগছিল। কেন বলতে গেলাম ওসব কথা? মনের কষ্টে মানুষ কত অন্যায্য কথাই তো বলে। বিশেষত মায়েরা। সান্তবনা পায় হয়তো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে। আমি তো এইমাত্র ওঁর সেই সান্তবনাস্থলটি ঘষে ঘষে সামনের সাদা দেয়ালের মতোই রিক্ত করে দিয়েছি। কিন্তু আমার অনুতাপ, মায়ের অসহায়তা শুধু ক্ষণিকের। বাতি চলে এলে পূর্বের মূর্তি ধারণ করলেন মা। আমিও রেগে গেলাম। তিনি তাঁর সিদ্ধামেত্ম অটল। আমৃত্যু শাপ-শাপান্ত করে গেলেন দাদার বন্ধু, নামহারা মুসলিম ছেলেটিকে।

তখন অবশ্য এসব বিষয়ে বেশিদূর ভাবার অবকাশ ছিল না আমার। আইএ পরীক্ষা দেব কি দেব না – দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। ফি জমা দেওয়া হয়ে গেছে। পার্টির নেতারা বললেন – কমরেড, পরীক্ষা দিয়ে কী হবে। রবীন্দ্রনাথেরও কোনো ডিগ্রি ছিল না। সুতরাং এসব লেখাপড়ার কোনো মূল্য নেই। তুমি মন দিয়ে দেশের কাজ করো বরং। আমিও ভাবলাম তাই তো, পরীক্ষা দিয়ে কী হবে? তখন মায়ের মুখটা মনে পড়ত। দাদাকে নিয়ে এত কষ্ট পাচ্ছেন মা, আমিও যদি পরীক্ষাটা না দিই! বাবার কথাও ভাবছিলাম। দাদা চলে যাওয়ার পর যেন মূক হয়ে গেছেন। আগের মতো প্র্যাকটিসে মন নেই। মক্কেলদের প্রায়ই দরজা থেকে ফিরিয়ে দেন। সারাক্ষণ কানে রেডিও। এভাবে নব ঘোরাতে ঘোরাতে একদিন সুভাষ বসুর ভাষণ শুনতে পান বার্লিন বেতারে। তারপর সিঙ্গাপুর বেতারে দাদার কণ্ঠ। বাংলা এবং ইংরেজিতে আজাদ হিন্দের পক্ষে প্রপাগান্ডা করছে দাদা। স্পষ্ট উচ্চারণ, ভরাট কণ্ঠস্বর – যা ছিল মায়ের আরাধ্য। সেসব অবশ্য আরো কিছু দিন পরের কথা। তবু এ-প্রসঙ্গে একটুখানি নিজের কথা বলি – আমি সেস্নাগান দিতাম তো খুব! আর সে কি গান – ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। গলার রগ ফুলিয়ে মেদিনী কাঁপিয়ে চেঁচানো। আমাকে জ্বালাময়ী বক্তৃতাও দিতে হতো যখন-তখন। এই করে করে গলাটা গেছে। এখন নিশিবকের ডাকের মতো ধারালো, কর্কশ পার্মানেন্টলি।

গলা যেমনই হোক, আমার সংগীতপ্রীতি বরাবরই প্রবল। হয়তো বদ্ধঘরে পার্টির জরুরি মিটিং চলছে, তখন যদি শুনি দূরে কোথাও গ্রামোফোনে গান বাজছে, আমার এদিকটা অফ। ‘এই এই হচ্ছে কী! মন কোন দিকে!’ আমাকে একদিন এক সমবয়সী কমরেড বললেন – ‘কমরেড আপনি বড় রোমান্টিক। এ লাইনে বেশিদিন টিকবেন না।’ আমি বললাম, ‘বাজে বকবেন না তো! যত দিন আছে প্রাণ…’ বলেই ঘুম। সারারাত ধরে পার্টির মিটিং চলছে। হে ভগবান! আমি না তার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম। দিত ধমক। ‘এই-এই ওঠো। যাও, চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে নোট লিখতে বসো জলদি।’

যাহোক শেষ পর্যন্ত আমি আইএ পরীক্ষাটা দিলাম। পুরো শীতকালটা শিলংয়ের বাড়িতে কাটালাম পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করে। তখন স্কুল-কলেজ ছুটি, কোর্ট-কাছারি বন্ধ। শৈলশহর বলে কথা! গাছের ডালে একটুখানি বরফ ঝুলতে দেখলে ত্রাহি ত্রাহি। খাসি বা নেপালি-ভুটিয়াদের কুছ পরোয়া নেই। বাঙালিবাবুরা পালাতে পারলেই বাঁচেন। বাবা-মা সাধারণত শীতটা কাটাতেন পুরীর সমুদ্রতীরে। স্কুলে পড়াকালে আমি আর দাদাও যেতাম সঙ্গে। তখন বিশাল লটবহরের সঙ্গে একটা স্পিরিট ল্যাম্প নিতেন মা। ওতেই রান্না হতো। ভাত-ডাল-পাপড়ভাজা-মাছের ঝোল। খুব সাধারণ খাবার-দাবার। সারারাত ট্রেন জার্নির পর পুরী স্টেশনে নেমে ফিটনে চেপে সোজা সমুদ্রের তীরঘেঁষা ভাড়াবাড়ি। কী করে যেন উড়ে বা মাদ্রাজি ঝি-চাকরও জুটে যেত সঙ্গে সঙ্গে। স্পিরিট ল্যাম্পে চায়ের জল ফোটানোর আগেই দরজায় খড়ের টুপি পরা নুলিয়া হাজির। পাহাড়ে জন্মালে কি, সমুদ্রে নাইতে আমার একটুও ভয় করত না। নুলিয়ার কোলে চড়ে জলে নামতাম যদিও। আরেকটু বড় হওয়ার পর, যখন রবারের টিউব আঁকড়ে ঢেউয়ের ওপর ভেসে থাকতাম, তখনো সঙ্গে নুলিয়া থাকত। আমার শাড়িপরা মা হাঁটুজলে নেমে, দ্রম্নত সরে যাওয়া ঢেউয়ের ফেনাটুকু পবিত্রজ্ঞানে মাথায় ছোঁয়াতেন, কপালে মাখতেন। আর ভিজে কাপড়ে বালুবেলা থেকে তারস্বরে চেঁচাতেন – বাবা যেন দাদাকে সাগরের গভীরে টেনে নিয়ে না যায়। আমার তখন শুশুকের মতো বাবাকে আর দাদাকে ঢেউয়ের চূড়ায় লাফিয়ে উঠতে দেখে ভীষণ হিংসে হতো। কবে আমি সাগরের ঢেউয়ে নাগরদোলার মতো দোল খাওয়ার মতো বড় হব। হব কী? বড় হলেই তো শাড়ি পরার ল্যাটা। পুরীতে কলকাতার বাঙালিদের এত দৌরাত্ম্য যে, মা আমাকে স্কার্ট-টপসও পরতে দিতেন না। বলতেন, ‘ওসব মেমগিরি এখানে চলবে না। দেখো না, তোমার বয়সী মেয়েরা কী পরে আছে!’ কুঁচি দেওয়া ফ্রক আর ইজেরই তখন আমার একমাত্র বসন – সমুদ্রে নামতাম যখন, তখন তো অবশ্যই, মায়ের হাত ধরে যখন সানসেট দেখতে বেরোতাম বা বেলাভূমির অস্থায়ী দোকানপাট থেকে কড়ি-শঙ্খ কিনতাম, তখনো। একবার সি-বিচের সান্ধ্য হাট থেকে শঙ্করমাছের লেজের চাবুক কিনেছিল দাদা। আমি ঘ্যান ঘ্যান জুড়ে দিলাম – আমারও ওরকম একখানা চাই। মা এক রকমের দুটি জিনিস ফিরে গিয়ে ঘরে সাজাতে নারাজ। আমাকে তাই তলোয়ার মাছের মাথার তলোয়ার কিনে দেওয়া হয়েছিল, যা ফেরার পথে ট্রেনেই ভেঙে ফেলি আমি। দাদার চাবুকটা এখনো ফায়ারপেস্নসের ওপরের তাকে মা-বাবার যুগল ছবির পাশে রক্ষিত আছে।

সেবার গরুগাড়িতে করে পুরী থেকে কোনারক সূর্যমন্দির দেখতে যাই। দীর্ঘ কাঁচাপথ বালুতে ভর্তি। মা বাস্কেটে করে রুটি-মাখন, ফলমূল নিয়েছিলেন। আর ছিল ফ্লাস্কভর্তি সুগন্ধি দার্জিলিং টি। বালুতে সুজনি পেতে, ঝাউগাছের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় আমরা সেসব খাচ্ছিলাম। দাদা গরুগাড়িতে বসে পা দোলাতে দোলাতে কলা খাচ্ছিল – সে-অবস্থায় বাবাই হয়তো তুলেছিলেন ছবিটা তাঁর সদ্য কেনা জাইস আইকন ক্যামেরায়। দাদার মুখটা মুছে গেছে। তেল চুবচুবে চুলের মাঝখানের সিঁথিটা শুধু আবছাভাবে বোঝা যায়।

সেবার বাবা-মা-আমি পুরো শীতকালটা শিলংয়ে কাটালাম। আমি পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। দাদাকে নিয়ে মায়ের অহর্নিশ ভাবনা। কিছুতেই তাঁর অপেক্ষার প্রহর কাটে না। আগের মতো ঘরকন্নায় মন নেই। বাগানটা ফের আগাছায় ভরে গিয়েছিল। বাগানের ফুল-কুঁড়ি, লতাপাতার তিনিই তো জনক-জননী। তবু ওতে যেন সান্তবনা ছিল না। সময়-অসময় আমার পড়ার ঘরের দুয়ার ঠেলে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ঢুকে পড়তেন। পার্টির কত জরুরি কাজ ফেলে আমি পরীক্ষার পড়া করছি! তাঁর উপস্থিতিতে বিরক্ত হতাম খুব। তিনি বুঝতেনও তা। কথা বলতেন না। পত্রহীন গাছের ফাঁক দিয়ে শিলংপিকের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তখন আমার সামনে মেলা বইয়ের অক্ষরগুলো মিলিয়ে গিয়ে চোখের পর্দায় ভেসে উঠত বিশাল নীলসমুদ্র। যার নিঃসীম বুকে দোল খেয়ে চলেছে দাদাদের জাহাজ। ও ডেকে দাঁড়িয়ে তীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে দেশের সীমা মিলিয়ে যাচ্ছে দিগমেত্ম। ওর দুচোখে জল।

আমি তখন বাবা-মাকে পুরী পাঠানোর কথা ভেবেছিলাম। তাতে রাজি ছিলেন বাবা। মা বললেন, ‘না থাক, নিরোর চিঠি আসবে।’

সত্যি সত্যি আমার পরীক্ষার সময়টায় দাদার চিঠি এলো। তার আগে মালয়, সিঙ্গাপুর পতনের খবর চলে এসেছে। বাবা চিমিত্মত। তিনি কিছুটা স্বদেশিভাবাপন্ন হলেও ব্রিটিশের অনুগত প্রজা। থেকে থেকে বলছিলেন – সিঙ্গাপুর তো লৌহশহর, বিশ্বের সেরা নৌঘাঁটির একটি। সেটি হাতছাড়া হয়ে গেল! তাও প্রায় বিনাযুদ্ধে! গোটা বর্মাও তখন যায় যায়। কলকাতায় বোমা পড়েছে। ভারতবর্ষে জাপানিরা এই ঢুকল বলে।

চারদিক তখন হরষে-বিষাদে একাকার। তবে আনন্দটাই প্রবল। গণসাপোর্ট তো জাপানের দিকে। তা এজন্য যে, ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে মানুষ তখন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ফুটছিল। শিলংয়ের পথচলতি বাঙালি কিশোর-যুবকের মুখে তখন সেই বিখ্যাত ছড়া  – ‘সারেগামাপাধানি/ বোমা ফেলেছে জাপানি/ বোমার মধ্যে কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ।’ শোনা যাচ্ছিল – কলকাতা নিউমার্কেটের ফুলের দোকানগুলো খালি হয়ে যাবে জাপানিদের ফুলে ফুলে বরণ করতে।

তখন আমার কেমন জানি অস্বসিত্ম হচ্ছিল। আমরা ব্রিটিশদের তাড়াতে চাই ঠিকই, তার জন্য জাপান সাম্রাজ্যবাদকে তো সাপোর্ট করতে পারি না, সে শত্রুর শত্রু হলেও! ততদিনে পার্টি জাপানের মিত্র জার্মানির বিরুদ্ধে সোচ্চার। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার মাসছয় পর ফ্যাসিবিরোধী জনযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন কারাবন্দি নেতারা। বলছেন, বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়ার পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। তার জন্য মস্কো বা লেনিনগ্রাদে যাওয়ার দরকার নেই। ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলেই হবে। আগের মতো কথায় কথায় রাজকে আক্রমণ করে বিব্রত করা যাবে না। যুদ্ধবিরোধী পোস্টার নামিয়ে প্রতিটা দেয়ালে নতুন পোস্টার লাগাও, মিছিলে আওয়াজ তোলো – ‘চাল দাও, টাকা দাও, সেনাদলে ছেলে দাও।’ শিলংয়ের পার্টি জরুরি মিটিং ডেকে এ উলটো গীত শুনিয়ে দিলো। হাতে হাতে তুলে দিলো ‘স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও’ নামের প্রচারধর্মী পুসিত্মকাটি। বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরছিলাম – সোভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত, এ মানা যায় না। তা বলে ব্রিটিশরাজের গলা ধরে যুদ্ধ করব! তাহলে অর্ধশতাব্দীর রক্তপাত, জেল-জুলুম, দ্বীপান্তর, ক্ষুদিরাম-মাস্টারদাদের আত্মদান সবই তো বৃথা। সেলুলার জেলফেরত আমার সেই স্বদেশি মামা আজ বেঁচে থাকলে মনে বড় কষ্ট পেতেন।

আমি লোহার অঙ্কুশ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফায়ারপেস্নসের আগুন উসকে দিচ্ছি। কাছের সোফায় কম্বল মুড়ে বসে দাদার চিঠি পড়ছেন মা। ঘরে পেট্রমাক্সের আলো জ্বলছে। সে-সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন বাবা। মাথায় কান-ঢাকা উলের টুপি। হাতমোজা, পা-মোজা। এসেছেন কিন্তু দাদার জন্য নির্দিষ্ট পাশের কামরার অস্থায়ী চেম্বার থেকে। দাদা ফিরলে আইনের বই, ফাইলপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে­ – চোখ গরম করে বলে দিয়েছেন মা। তখনো মা চিঠি পড়ছেন। তাঁর পড়া হলে যাবে বাবার হাতে। সবশেষে আমার। ‘কী ছেলেমানুষি করছিস?’ বাবার ধমকে চমকে উঠলাম। ‘রাখ তো ডাণ্ডাটা!’ রেখে দিলাম ‘জয় আন্তর্জাতিক সর্বহারা’ বলে। বাবার চোখ মায়ের হাতে ধরা চিঠির দিকে। পারলে তখনই ছোবল মারেন। চিঠি পড়া শেষে মা ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের ধুয়ো ধরলেন, ‘এশিয়া ফর এশিয়ানস/ গো হোম হোয়াইটস’। মা এত খুশি যে, যেন জাপান নয়, দাদাই যুদ্ধে জিতেছে।

সে-খুশির রং লেগেছে বাবারও মনে। ‘ইন্ডিয়া ফর ইন্ডিয়ানস’ মায়ের ওপর টেক্কা দিয়ে সেস্নাগান দিলেন বাবা। তিনি সিঙ্গাপুর পতনের পরদিন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর বেতার-ভাষণ পুরোটা কানে রেডিও লাগিয়ে শুনেছেন। তারপর মায়ের হাত থেকে চিঠি নিয়ে আমার দিকে চোখ টিপে মুচকি হাসলেন, ‘সর্বনাশ! একই ঘরে অক্ষশক্তি, মিত্রশক্তি! লড়াই বাধলে পালাব কোথায়। মার্চ মাসেও বাইরে কি প্রচ- ঠান্ডা!’

রাতের খাবারের পর বাবা-মা শুতে চলে গেলে আমি দাদার চিঠিখানি হাতে করে ফায়ারপেস্নসের পাশে বসি। ব্যাংকক থেকে মালয়ে পৌঁছেছে দাদা। ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের বেশকিছু অফিস খোলা হয়েছে কুয়ালালামপুরসহ মালয়ের বিভিন্ন শহরে। কাজ আর কাজ। জাপান-অধিকৃত মালয়ে রাবার পস্ন্যান্টের শ্রমিকসহ ভারতীয় অভিবাসী তো অগুনতি, লিগের প্রধান কাজ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তার জন্য জাপ-ভারত মৈত্রী লিফলেট ছেড়েছে জাপানের সেনা ব্যারাকে – কীভাবে ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলতে হবে, কোন ভাষায় মেয়েদের সম্ভাষণ করতে হবে, এসব তথ্য দিয়ে। এ-ব্যাপারে জাপানি ফৌজের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মিলেছে। ‘গানজি?’ অর্থাৎ তুমি গান্ধীর দলের লোক? এর জবাবে ‘হ্যাঁ’ শুনলে তারা খুশি হয়ে করমর্দন করেন। মেয়েদের মানসম্ভ্রম নিয়েও তাই ভাবনা নেই। যত দুর্ভোগ চীনে আর ইউরোশিয়ানদের। তাদের মেয়েরা জাপানিদের ধোঁকা দিতে আজকাল শাড়ি, দোপাট্টায় কুয়ালালামপুরের রাস্তায় বেরোচ্ছে।

চিঠিতে নেপোলিয়নের বিখ্যাত উদ্ধৃতি ঝেড়েছে দাদা – ‘যুদ্ধের সময় শত্রুর শত্রুই আমাদের মিত্র।’ কথাটা তখন আর নতুন নয় আমাদের কাছে। সুভাষ বসুর বেতার ভাষণগুলোতে নানা দৃষ্টান্ত ও ব্যাখ্যাসহ আকছার এই অজুহাত। গান্ধীর মতে, তা নৈতিক আপস। পার্টি বলত, হঠকারিতা। আরো কড়া ভাষায় ‘কুইসলিং’। হয়তো তাই। ‘হয়তো কেন? কমরেড আপনি বড্ড বেয়াড়া।’ হব হয়তো। ‘আবার হয়তো!’ আমার তখন কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। ঘরভরা কমরেডের সামনে কেঁদে ফেললে বলবে – ‘মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট!’ আমি মুখ ধুতে কুয়োতলায় চলে যাই। কে ঠিক – পার্টি না আমি? পার্টি চায় কুণ্ঠাহীন আনুগত্য, যেমনটি সেনাবাহিনীতে দেখা যায়। কোনো প্রশ্ন নয়, দ্বিধা নয়। অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ মেনে চলো। নিজেকেও আমি তখন ধিক্কার দিচ্ছিলাম – আমার স্বভাবটাই বা এত বেয়াড়া কেন। সবাই মানতে পারলে আমি কোন ছার। কোন অজুহাতে অমান্য করার অমন দুঃসাহস দেখাচ্ছি! তাদের বক্তব্য খ-ন করার মতো পেটে বিদ্যেও তো নেই। তাছাড়া হাতের কাছে তখন তথ্য-উপাত্তই বা কই। সবে ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের তৎপরতা শুরু হয়েছে। পরে ইন্দো-চীন, থাইল্যান্ড, মালয় সর্বত্র অফিস খোলে লিগ। এ অফিসগুলো প্রকারান্তরে জাতপাত, ভাষা, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে বেসামরিক ভারতীয়দের আপৎকালীন আশ্রয়স্থল। সবাই এক হাঁড়ির খাবার খায়। স্বপ্নও তাদের একটা – স্বদেশের স্বাধীনতা। যে-দেশ স্বচক্ষে দেখেনি, হৃদয়ে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, যুদ্ধে লড়েছে। মেয়েরা গায়ের গয়না খুলে দিয়ে শুধু মেয়েলি দায়িত্ব পালন করেনি, প্যান্ট-বুশশার্টে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে সমরে নেমেছে। রানি ঝাঁসি বাহিনীর মেয়েরা নাকি ব্রিটিশ সৈন্যদের বেয়নেট চার্জ করতে সর্বদা মুখিয়ে থাকত। সে এক অভূতপূর্ব জাগরণ। যা সম্ভব করেছিল হঠকারী এবং ‘কুইসলিং’ সুভাষ। আমি যখন কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে প্রাণপণে কান্না চাপছি, তখনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুভাষ বসুর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়নি। হঠাৎ হঠাৎ তাঁর গলা শোনা যায় সুদূর বার্লিন থেকে কাঁপা কাঁপা বেতার তরঙ্গে।

এবারে আগের কথায় ফিরে আসি। তখনো শীতকাল। আমি শিলংয়ের বাড়ির সোফায় বাবু হয়ে বসে রাত জেগে দাদার চিঠি পড়ছি। যদিও একদিন পর আমার ইংলিশ সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা। দাদা লিখেছে – জাপানিদের কাছে ব্রিটিশ বাহিনীর আত্মসমর্পণ দেখতে সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। মিত্রপক্ষের লক্ষাধিক ফৌজের অর্ধেকই ব্রিটিশ-ভারতের নাগরিক। আত্মসমর্পণের তারিখটা এখন সবার জানা – ১৭ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৪২ সাল। সেদিন সিঙ্গাপুরের ফারের পার্কে পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় সৈন্য অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ায়। তখনো তারা জানে না – আত্মসমর্পণের পর ভাগ্যে কী আছে। এই বিশাল বাহিনী নিয়েই কিছুদিন পর গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ। বছর দুই বাদে যারা নেতাজির নেতৃত্বে কোহিমার পতন ঘটায়, ইম্ফল দীর্ঘদিন অবরোধ করে রাখে। আমরা তখন শুধু জানতাম জাপানিরা আসছে। ইম্ফলের পরই তো ডিমাপুর। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীর, আসাম রাজ্যসহ পূর্ববাংলা চোখের পলকে গ্রাস করে নেবে। ব্রিটিশরাজের মিডিয়া সেন্সরের দাপটে আগুয়ান আজাদ হিন্দের নাম পর্যন্ত তখন শোনা যায়নি।

এটি ছিল মায়ের নামে আসা দাদার শেষ চিঠি। কত প্রাণোচ্ছল, জীবনের স্ফূর্তিতে ভরপুর! শিলংয়ের সেই হিমেল রাতে এর উষ্ণ পরশ আমি আজো অনুভব করি। শুনতে পাই ফারের পার্কে বিদ্রোহী মেজর মোহন সিংহের ব্রিটিশবিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতা আর পায়ের কাছে পিস্তল নামানো সৈনিকদের গগনবিদারী সেস্নাগান – ইনকিলাব জিন্দাবাদ। হাজার হাজার টুপি উড়ছে সিঙ্গাপুরের সামুদ্রিক নোনা বাতাসে।

তখনো পিছিয়েপড়া ভারতীয় সৈন্যরা মালয়ের গহিন জঙ্গলে। রাবার বাগান থেকে রোজই আহত, পঙ্গু, বুভুক্ষু সৈন্যদের স্ট্রেচারে করে আনতে হচ্ছে দাদাদের। তাদের জন্য খাবার চাই, ওষুধ চাই, বস্ত্র চাই। এসবের সাধ্যমতো জোগান দিচ্ছে মালয়ের অভিবাসী ভারতীয়রা। দাদার চিঠিতে রাবার বাগানের বর্ণনা পড়ে অবাক মানতে হয়। গাছের সারির মাঝখানের সরুপথ দিয়ে স্ট্রেচারে মুমূর্ষু সৈনিকদের টানতে টানতে বাগানের নিখুঁত জ্যামিতিক ছকটা চোখ ভরে দেখেছিল দাদা। ছাতার মতো মেলানো পত্ররাজির ফাঁক গলে লুটিয়েপড়া স্নিগ্ধ কৌণিক আলো, ঝিরঝিরে বাতাস, মাটির সোঁদা গন্ধ – কিছুই বাদ পড়েনি চিঠি থেকে। দাদা তো আমার মতো ঈশ্বর-অবিশ্বাসী কমিউনিস্ট নয়! তাই চিঠির ছত্রে ছত্রে ভগবানের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল।

আমি পড়াশেষে চিঠিখানা পেপারওয়েটে চাপা দিয়ে যখন উঠি, তখন রাতের শেষ প্রহর। কাঠের মেঝেতে পা টিপে টিপে নিজের ঘরে যাই। অন্ধকার হাতড়ে লেপের নিচে ঢুকে পড়ি। কাঠের পার্টিশনের ওপাশে বাবা-মা গভীর নিদ্রায়। একটা সুখী উষ্ণ হাওয়া বইছে গোটা বাড়ি জুড়ে। বাকি রাতটুকু আমি জেগেই কাটিয়ে দিই। এখানে আমার আর কী কাজ। পরীক্ষা শেষে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়ব, চলে যাব সুরমা উপত্যকায়।

 

সিন্দবাদের জাহাজ

সাবিনাকে গাঁয়ের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে দেখে বড়ভাই খোকার কথাই হয়তো লোকের মনে পড়ে। একজন অকালমৃত, আরেকজন ভাতারছাড়া। (সাবিনার বিবাহবিচ্ছেদটা ওরা মনে রেখেছে, পরের বিয়েটা নয়)। মাটি আর অঙ্গার। প্রথমজনের প্রতি হয়তো নিখাদ করুণা। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াদারির কথা ভেবে চোখে পানি চলে আসে। দ্বিতীয়জন সেই চোখে জ্বালা ধরিয়ে আগুনের হলকা ছড়াতে ছড়াতে যায়। ব্যাটা স্বভাবের উড়নচ-ী মেয়েমানুষ হলে যা হয়।

এই ভাবনাটা হয়তো সাবিনারই, যে মনে করে হাতের তালুর মতো গাঁয়ের লোকের নাড়িনক্ষত্র সব ওর চেনা, যা দীর্ঘদিন দূরে থাকায় ও ভুলে যেতেও পারত। কার্যত তা সম্ভব হয়নি নীহার বানুর কারসাজিতে। তিনি গাঁয়ের লোকের গিবত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্যের মুখে শুনতেন আর সাবিনার প্রতিটা বেসামাল কাজ-কারবার হিসাব করে সেইমতো চিঠি বা ফোনে তা উগরে দিতেন। চিঠির শেষে মন ভালো করা কবিতার উদ্ধৃতি থাকা সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত বাড়ি খেত সাবিনার। আর ফোনের বেলায় তিক্ততা আর অস্বসিত্ম নিয়ে ও প্রতিবারই রিসিভার নামিয়ে রাখত।

এই বয়সে তিক্ততা না থাকলেও অস্বসিত্মভাবটা মনে হয় রয়ে গেছে। তাই জোহরাদের বাড়ির মুখপাত থেকে ও সরে এসে বাঁক নেয় পুকুরপাড়ের দিকে। যে-পুকুরের পানিতে জোহরার সুন্দরী চাচি দিনভর ডোবাডুবি করতেন। তিনি কড়িকাঠে ফাঁস নিলে গাঁয়ের লোকেরা নাকি বলাবলি করছিল – কাজটা সে হিন্দুস্তানে বসে করলেই পারত। গাঁওটাও বাঁচত খুনের দুর্নাম থেকে। আসলে মোটা অঙ্কের ঘুষ না পেয়ে পুলিশ আত্মহত্যার স্থলে হত্যামামলা ঠুকে দেয়। চাচির স্বামী বিনাবিচারে দীর্ঘ হাজতবাসের সময় জন্ডিসে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন। ‘হায় রে, কার অপরাধে কে সাজা পায়! দুনিয়ার এই বিচার!’ সাবিনা গরমের ছুটিতে হোস্টেল থেকে বাড়ি এলে, নীহার বানুর জবানে শোনে জোহরার দাদার এ অমিত্মমকালীন খেদোক্তি।

জোহরাদের পুকুরের ভাঙা পাড় বেয়ে ফসলের মাঠে নামে সাবিনা। সবজি ক্ষিতের আইলে হোঁচট খেয়ে পড়ে উঠতে উঠতে ভাবে – সাধে কি লোকে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে হাঁটে! আইলগুলো তো কাটতে কাটতে সরু দড়ি বানিয়ে ফেলেছে। জমিন কম, মানুষ বেশি। তবু ভাগ্য ভালো যে, কেউ ওর পতন দেখতে পায়নি। তখনো বুকসমান ঢেঁড়সগাছের আড়ালের যুগলমূর্তি ওর নজরে পড়েনি। বাতাসে কীটনাশকের তীব্র দুর্গন্ধ। ক্ষিতের আইল ছাপিয়ে উপচেপড়া কচকচে সবুজ ঢেঁড়সের সত্মূপ। এমন বাহারি যে, বিষের গন্ধটা নাকে না লাগলে কাঁচা খেতে ইচ্ছা করত। তখনো ঢেঁড়স তোলা শেষ হয়নি, সাবিনাকে দেখামাত্র বউটা মাথা তোলে – ‘তুমি একলাই আইছো? রুক্কি কই?’

থমকে দাঁড়ায় সাবিনা। ও ভুলেই গেছিল গাঁয়ের লোকজন রোখসানাকে রুক্কি ডাকে। স্বামীটা ঢেঁড়সবোঝাই বাঁশের ঝাঁকাটা মাথায় তুলছে। বউকে বলছে – ‘রুক্কি কত বড় ডাক্তর জানস নি তুই? হেতি তোর ব্যান্ডিখেত দেখত আইব!’ এত বড় বোঝাটা মাথায়! সাবিনা পথ ছেড়ে পাশের চষা খেতে নেমে পড়লে লোকটা দাঁড়ায়, ‘আ গো আডো! আগে বাড়াও! আডতে আডতে কথা কই।’ কথা আর কী। পাগলা কুত্তায় কামড়ালে রুক্কি কবে নাভিমূলে সুই দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল, সেই কেচ্ছা। সাবিনা পিছিয়ে পড়ে। বউটা কেন রোখসানার কথা জানতে চাইল?

সাবিনা আর ব্যান্ডিক্ষিতে ফেরে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে – লোকটার বয়স কত ছিল, যখন ওকে কুকুরে কামড়ায়? সমাজসেবায় রোখসানার যতখানি সুখ্যাতি, পুরোটাই ইন্টার্নশিপের সময়ের। পরে এফসিপিএস পড়ার চাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিদেশেও কাটায় কিছুদিন। তারপর তো ক্যারিয়ার গড়তেই জীবনপাত। বাবা-মা অসুস্থ হলেও বাড়ি আসে না। গাড়ি পাঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে যায়। এক-দুবার অবশ্য এসেছিল। তা-ও এক বেলার জন্য। শেষবার নাকি গাঁয়ের চিকিৎসাপ্রার্থীদের ভিড়ের চাপ এড়াতে জোরে ছুটতে গিয়ে ওর গাড়ির চাকা ফেটে যায়। ব্যাপারটা নীহার বানুর পছন্দ হয়নি। সাবিনা জানে না – রোগীর চাপ নাকি গাড়ির চাকা ফাটা, কোনটা আম্মার অপছন্দ। তিনি তো অভাবের সংসারে বিনা ফিতে স্বামীকে রোগী দেখতে দিতেন। যে-ঘরে প্রিয় কবিতা বা আধ্যাত্মিক বাণীসংবলিত তাঁর সূচিকর্ম কাঠের ফ্রেমে ঝোলানো থাকত।

বিনা ফিতে রোখসানাও রোগী দেখে, সে আত্মীয়, বন্ধু, কখনো-সখনো গরিবলোকদের, ওর ধোপদুরস্ত এসি চেম্বারে। যার টাকা-পয়সার বিশেষ খাঁই নেই, স্বামীরও (ডেন্টিস্ট বলে) রোজগার দেদার, ছেলেমেয়ে দুটি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, নিজে মাঝরাত পর্যন্ত চেম্বারে কাটায়, সে পরোপকার করতেই পারে। তার জন্য সপ্তাহামেত্ম গাঁয়ে এসে রোগী দেখা এমন কী, যেখানে ঢাকা থেকে গাঁয়ের বাড়ি মাত্র আড়াই-তিন ঘণ্টার পথ!

তখনো দূরত্বটা এমনই ছিল। যদিও ফেরিতে দু-তিনটা নদী পার হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগত ঢের বেশি। ডিমের কুসুমরঙা হারিকেনের আলোয় দুবোন পড়তে বসেছে। সাবিনার পৌরনীতি বইয়ের নিচে দস্যু বনহুর। রোখসানা যতবার রোমান্স উপন্যাসটা সরাতে যায়, ততবার ও বিড়ালের মতো খামচি দেয়। নীহার বানুকে ডাকলে পিঠে এখন দমাদ্দম তাল পড়বে যে, শামিত্মপ্রিয় রোখসানার তা সহ্য হবে না। ইন্টারমেডিয়েটে উঠে বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে ছোট বোনটার প্রতি ওর স্নেহ আরো বেড়েছে। কিন্তু পাঠ্যবই পড়ার বেলায় আপস নেই। তাই সাবিনার খামচি খেয়েও শান্তস্বরে বলে – ‘তুমি জানো না সাবাহ, কই পইড়্যা রইছো। এখান থেকে যদি বাইর হইতে চাও, পরীক্ষার ভালো রেজাল্টের বিকল্প নাই।’

‘এটা কুয়া আর মানুষগুলা কুয়ার ব্যাঙ!’ বলে ফের দস্যু বনহুর পড়ায় মন দেয় সাবিনা।

সাঁইত্রিশ বছর পর, জহর বকশি আর মোয়াজ্জেম হকের সেই সংলাপটুকু হুবহু দুবোনের মুখে। তফাৎ কেবল রোখসানা-সাবিনার সামনে কলকাতা নেই, রাজধানী ঢাকা।

সেদিন বই বন্ধ করে রোখসানার সঙ্গে গলা মেলায় সাবিনা। ওদের দুর্ভাগ্য যে, এমন আনকা জায়গায় জন্মেছে। তার জন্য নীহার বানুকে দায়ী করে প্রথম – অত ভালো ভালো পাত্র থাকতে কেন বিয়ে করে এখানে এলেন। তারপর মোয়াজ্জেম হকের অপরিণামদর্শিতার কথা আসে। তিনি ডাক্তার হলে কি এঁদো পাড়াগাঁয়ে ওদের পড়ে থাকতে হতো! হাশমত খালার ছেলেমেয়েদের মতো দেশের নানা জায়গায় দু-তিন বছর করে কাটাতে পারত, তা থানা বা উপজেলা হলেও শহর তো। আববা যে ডাক্তার হতে পারলেন না, সেজন্য দায়ী কে? ‘জহর বকশি’ – বলেই জিব কাটে সাবিনা। কারণ এ-কথাটা মোয়াজ্জেম হকের সামনে বলে ওকে একবার নাকাল হতে হয়েছে। ‘বিষয়টা ছোট করে দেখা ঠিক না, সাবাহ।’ বিজ্ঞেরমতো কথা শুরু করে রোখসানা সতর্কভাবে খোলা দরজার দিকে তাকায়। ‘বলবো দায়ী কে? নাম না বললেও তুমি মনে হয় বুঝতে পারবা।’ বলে দরজাটা সে বন্ধ করে আসে – ‘যার নামে আববার ডিসপেনসারির নাম ছিল ‘নেতাজি ঔষধালয়’ সেই তিনি। বুঝলা কিছু?’

বুঝেও সাবিনা মুখ ঝামটে বলে ‘না, বুঝি নাই!’ রোখসানা কি ওকে দুধের শিশু ভাবে? খালি বোকা বোকা প্রশ্ন। দায়ী দায়ী খেলাটা পানসে লাগতে ও ফের দস্যু বনহুর খুলে বসে।

সেদিন গ্রামটাকে কুয়া বললেও পরীক্ষায় মাঝারি ফল করে সাবিনা। তা সত্ত্বেও কুয়া থেকে বেরিয়ে যায় বড়বোনের বাঁধানো সড়ক দিয়ে, যা ভালো রেজাল্টের রোলার চালিয়ে আগে থেকেই রোখসানা মসৃণ করে রেখেছিল। তারপর মর্জিমাফিক চলে একসময় পিছলে পড়ে সেই মহাসড়ক থেকে। বোনের মতো ক্যারিয়ারের স্বর্ণশিখরে সাবিনার পৌঁছানো হয়নি।

সেদিনের ভাবনাটা ঠিক কি ভুল ছিল – সাবিনা জানে না। এখনো ও দুঃস্বপ্ন দেখে – গাঁয়ের কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ দিয়ে খালি পায়ে স্কুলে যাচ্ছে। ব্যবহার করছে চটের দরজার খাটা পায়খানা। তা সত্ত্বেও ফিরে আসার সুযোগ থাকলে ও হয়তো এ কুয়াতেই ফিরত এবং কোনোক্রমে এখনকার এ-গাঁয়ে নয়, যা আধা শহুরে কিম্ভূত চেহারায় নিজেকে মেলে ধরেছে। তখন গাঁয়ের বিশাল ফসলি মাঠের সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশার আড়ালে যেন এক মায়াবী দুনিয়া লুকানো ছিল। মনে হতো এই সেই চারণভূমি, যেখানে ইয়াকুব নবীর পুত্ররা মেষ চরাত। ছোটভাই ইউসুফের প্রতি ওদের রিরংসারও জন্ম এখানে। গাছের ছায়াময় ক্ষিতের কোণের গভীর গর্তটা, যা শীতের মৌসুমে শুকিয়ে গিয়ে বড় বড় কাঁটাগাছে ভরে উঠত, ওখানেই ইউসুফকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল তাঁর ভাইয়েরা। একদিন ধূসর ঘোড়ার পিঠে ইয়েমেনের বণিকদেরও সে-মাঠের কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে। তখনই ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসে। ইউসুফকে গর্ত থেকে তুলে নিতে বণিকদল আসছে – নীহার বানু পুকুরে অজু করতে যাচ্ছিলেন, সাবিনার মুখে এ অসম্ভব কথা শুনে দাঁড়িয়ে যান। একটু মনে হয় বিশ্বাসও করছিলেন। বা ভাবছিলেন হয়তো, দূর অতীতের সেই স্বপ্নপূরণের কাহিনি বর্তমানের দুনিয়ায় সত্যিকারে ফিরে আসাটা কত না আনন্দময়, যা বইয়ের পাতা থেকে বিকীর্ণ হয়ে তাঁর ছোট মেয়ের কচিমুখে অপার বিস্ময়ে ফুটে উঠেছে। না হলে তখনই বলতে পারতেন – ধূসর ঘোড়া দুটি পাশের গাঁয়ের জিন্দাপীরের থানের। ওরা লোকের মনে সমীহ জাগাতে বার্ষিক ওরসের জন্য ধান তুলতে ঘোড়া নিয়ে আসে। তাতে যারপরনাই কাজ হয়। বাড়ির দরজায় ঘোড়া থামলে কেউ একজন বেরিয়ে ঘোড়ার মুখ ধরেন। তার পেছনে আসে ধামা ভরা উঠানের মাড়াইয়ের ধান।

স্বপ্নের মতো আরেকটা দৃশ্য এখনো সাবিনার চোখে ভাসে। কুয়াশা-আচ্ছাদিত শীতের বিকাল। ফসলের মাঠের শেষ প্রামেত্মর খালটা তখন গাঙের মতো চওড়া ছিল। কাগজে-কলমে যার নাম ক্ষীরো নদী। বর্ষায় কানায় কানায় ভরে উঠত নদীটা। তখন শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আসা গাছ, ঝোপঝাড় প্রবল স্রোতের টানে ঘূর্ণি খেতে খেতে ভেসে যেত। দূরদূরান্ত থেকে রঙিন পাল উড়িয়ে আসত গুণটানা কারবারির নাও। মিষ্টিআলু, মাটির হাঁড়ি, বাসন-কোসন বেচে দিনামেত্ম নোঙর তুলে ফের ভেসে যেত। বেদে নৌকাগুলো এসে সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত না। বেলোয়ারি চুড়ি আর জড়িবুটির ব্যবসা ফেঁদে থাকত কিছুদিন। শীতের মৌসুমে নদীটা ক্ষীণতোয়া। তলায় জল থাকলেও ঢেউ নেই। ছোট ছোট নালায় বিভক্ত। মাঝে মাঝে ভেজা বালুর চরা। সেরকম এক চরায় দূর থেকে ঘন কুয়াশায় ভাসমান জাহাজের কঙ্কাল দেখার পর, সাবিনা অনেক দিন বিশ্বাস করেছে – এটা রেঙ্গুন থেকে আববার ফিরতি জাহাজ। যে-সময়টায় ওরা কলকাতাকে বলত আববার কলকাতা। ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজকে বলত আববার ক্যাম্পবেল। জাহাজটার আকৃতি নিয়ে সাবিনার মনে সন্দেহ ছিল না। এ একরকম মুখস্থই প্রায়। ও সিন্দবাদ নাবিকের সামুদ্রিক ঝড়ে আক্রান্ত পালছেঁড়া, ভাঙা মাস্ত্তলের জাহাজের ছবিটা পেনসিলের গোড়ায় ঘষে ঘষে কতবার আরব্য রজনীর পাতা থেকে নিজের রাফখাতায় তুলেছে! তবে এটি ঝড়ের কবলে পড়েনি। যুদ্ধের বছরদুই পর আববাকে রেঙ্গুন থেকে নিয়ে এসে ক্ষীরো নদীর চরায় আটকে গিয়েছিল। এক জায়গায় পড়ে থাকতে থাকতে কঙ্কালের দশা।

‘তোমার তো খুব বুদ্ধি! এর একটু-আধটু পড়াশোনার কাজে লাগাও!’ এ-উপদেশটা সাবিনাদের এক লজিংমাস্টারের, যার কাছে হোমওয়ার্ক করার চেয়ে গল্প করতেই ও বেশি ভালোবাসতো। তারপর একই জায়গায় রৌদ্রালোকে বাঁশের কাঠামোর মাছ ধরার ভ্যাল দেখেও কল্পনায় জাহাজটাকে বাঁচিয়ে রাখে সাবিনা। তাতে অতর্কিত আঘাত আসে কাশেম মিয়ার কাছ থেকে।

কাশেম মিয়াকে সাবিনার ভাইবোনেরা কাশেম মিয়া বলেই ডাকত। যদিও চাচা ডাকার জন্য দাদির আমল থেকে ওদেরকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষি কত মায়ের কোল খালি হয়েছে! সায়মা খাতুন বলতেন, আলস্নাহপাক অকৃতজ্ঞ বান্দাকে পছন্দ করেন না, তাঁর কোলে সে-সময়েই তো গাফুরুর রহিম ছেলে দিলেন, অপরের পেটের হলেও। তখন যে কী অভাব – বলে বোঝানো যাবে না। আস্ত চালের ভাত তো দূরের কথা, খুদের জাউও মেলে না। মোয়াজ্জেম হকের জাউ পছন্দ নয় বলে সায়মা খাতুন তখন খুদের ফেনাভাত রাঁধতেন। নিজেরা খেতে বসার আগে মজুকে স্মরণ করে, তা থেকে একহাতা গরুর ফ্যান খাওয়ার মাটির চাড়িতে রেখে আসতেন চুপিচুপি। তাই নিয়ে রাত থাকতেই মানুষ আর কুকুরে পাড়াপাড়ি। অসময়ে ঘুম ভেঙে বিরক্ত হতেন মেহের আলি। বিরক্তি চরমে উঠলে লাঠিহাতে বেরিয়েও যেতেন। একদিন সায়মা খাতুন দেখেন – সোয়ামি বেরিয়ে আর ফিরছেন না। এমন চ- মেজাজ, খুনখারাবিই কি করে বসল? বাচ্চার গলায় মিহি কান্না কানে আসতে তিনিও ঘরের বাইরে আসেন। তখন শরতের কাকভোর। কুয়াশার ফাঁকে একটু-আধটু আলো ফুটেছে। সেই আবছা আলোয় দেখেন – তার স্বামী যেন ঠাডা-পড়া মরদ, উঠানের কোণে পাত্থর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চাড়ির ধারে গাছের গুঁড়ির মতো একটা কিছু। পাশেই নড়াচড়া করছে ছোট্টমতো একটা কিলবিলে প্রাণী। সায়মা খাতুনকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফেরে মেহের আলির। ভাঙা গলায় বলেন – ‘বাত্তি আনো চাই!’

ঘরে তেল থাকলেই তো বাত্তি জ্বলবে। খালি হাতে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নেন সায়মা খাতুন। গাছের গুঁড়িটা যে মানুষ, কাছ থেকে তা স্পষ্ট হলেও মরা না জিন্দা ঠাহর হয় না। স্বামীকে তা বলতে, মেহের আলি লোকটার গায়ে হাত ঠেকিয়ে মাথা নাড়েন – ‘ঠান্ডা বরফ! হাইঞ্জা রাইতেই মরছে মনে হয়।’ তখন রাস্তাঘাটে মরার ছড়াছড়ি। কোথাকার মানুষ কোথায় যেতে যেতে মরে। সরকারি লঙ্গরখানাও তো তাঁদের বাড়ি থেকে মাইলপাঁচেক দূর, যেখানে কলাপাতায় ফ্যানভাতের লপসি বিলায়। বাপটা হয়তো ওখানেই যাচ্ছিল বছরদুয়েকের আধমরা কঙ্কালসার ছেলেকে নিয়ে। খোদার কী কুদরত, নিজে মরে বাচ্চাটাকে থুয়ে গেছে তাঁর উঠানে। এসব সায়মা খাতুন পরে ভেবেছেন। তখন মেহের আলি ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদের দিকে হাঁটা দিলে, তিনি বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ঘরে ঢুকে কেওয়ার তুলে দেন।

দুপুর পর্যন্ত মড়াটা উঠানে পড়ে থাকে। গাঁওটা তো বিরান তখন। যারা আছে, তারা অনাহারে ধুঁকছে। কাপড়লতার অভাবে ঘর থেকেও বেরোয় না বিশেষ। বেরোলেও তা খাল-বিলে কচু-ঘেঁচুর সন্ধানে। উঠানটা তাই ফাঁকাই ছিল। রাখাল ছেলেটাকে পুকুর থেকে ঘড়া দিয়ে পানি আনতে বলে মেহের আলি মুর্দার গোসল দিতে বসেন। আগে গোসলটা হোক, গোরস্তানে নেওয়ার লোক খোদাই জোটাবেন। শরীরের একমাত্র বসন কোমরে জড়ানো ত্যানাটা সরিয়ে মেহের আলি তাজ্জব – মর্দলোক, অথচ খতনা হয় নাই! এর মানে কী? গা কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর। বিধর্মীর মুর্দা, গোসলের দোয়া-দুরুদ পড়লে জিব খসে পড়বে। মেহের আলি ত্যানাটা জায়গামতো বিছিয়ে দিয়ে চটজলদি উঠে পড়েন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবরটা হিন্দুপাড়ায় জানানো দরকার।

সায়মা খাতুন কি আগে থেকেই সে রকম কিছু আঁচ করেছিলেন? সেই ভোর থেকে তাঁর ঘরের দুয়ারে খিল। একবার শুধু বার্লি জ্বাল দিতে উঠে গিয়ে ফের এসে বসেছেন মুমূর্ষু বাচ্চাটার শিয়রে। খবরটা স্বামীর মুখে শুনে তাঁর চোখের পাতাও কাঁপল না। বিড়বিড়িয়ে শুধু বললেন – বিধর্মী ফেরাউনের প্রাসাদে বড় হন নাই মুসা নবী, যে ছিল আবার আজন্মের দুশমন! এ-ছেলে আগে বাঁচুক, বড় হয়ে কী হয় দেখা যাবে। এ দ– বাচ্চার খবরটা গোপন রাখা জরুরি।

সেমতোই ব্যবস্থা হয়েছিল। বিকেল নাগাদ ডোম এসে লাশটা নিয়ে যায়।

গল্পটা শোনার পর সাবিনা ভেবেছে, দাদির শাহনামা পড়া থাকলে তিনি হয়তো নিজেকে পক্ষীমাতা সিমুর্গ ভাবতেন। যার হেফাজতে মহাবীর রুস্তমের পিতা জাল বড় হয়েছিল। পাখির খাঁচায়, পাখির শিকার করা খাবার খেয়ে মনুষ্য সন্তত্মানের বেড়ে ওঠা আরো দুর্ধর্ষ। সিমুর্গ জালের নাম রেখেছিল দাস্তান। সায়মা খাতুন বাচ্চাটার নাম রাখেন কাশেম।

১৯৪৮ সালের ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে কাশেম মিয়ার বয়স প্রায় সাত। এর মধ্যে দুরন্তপনায় গাঁয়ের সেরা আর বানোয়াট কথা বলায় মিথ্যুক হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছে। সায়মা খাতুন মনে করতেন – দিলে দয়ামায়া নাই, তাই কথা শোনে না, চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলে। ‘এক গাছের ছাল আরেক গাছে জোড়া লয় না।’ এ ছিল সাত বছর বয়সের কাশেম মিয়া সম্পর্কে মেহের আলির শেষ কথা। সেই ছেলে যখন বাজারের ব্যাগ রাস্তায় ফেলে, চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে, ‘ভাইজান আইছে গো, ভাইজান আইছে। আমি হ্যারে বাস থাইক্যা নামতে দেখছি।’ কেউ তা বিশ্বাস করে না। উলটা মালাউনের বাচ্চা, জাউরা বলে গাল দেয়। বাড়িতে খবরটা পৌঁছে দিয়েও সে বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। মেহের আলির জেরা – ‘বাজারের থইল্যা গেছে কই? তোরে না তালমিছরি আনতে পাডাইলাম! আমি বলে কাশির চোডে রাইতে ঘুমাইতাম পারি না, বাস থাইক্যা ভাইজান নামছে! তুই হেরে চিনস, মিথ্যুক কোথাকার!’

‘মিথ্যুক! মিথ্যুক!’ ছাবিবশ বছর পর সাবিনার মুখেও একই অপবাদ, যখন ক্ষীরো নদীর চরায় মোয়াজ্জেম হকের জাহাজ নোঙর করার গল্পটা উলটে দিতে কাশেম মিয়া ফের বাসের গল্প ফাঁদে। বকা খেয়েও তার মুখে সেদিনের বিজয়ীর হাসি। সায়মা খাতুন আজ বেঁচে নেই, খোদা তাঁরে বেহশতবাসী করুন, তখন মেহের আলির রোষানল থেকে তিনিই কাশেম মিয়াকে বাঁচিয়েছিলেন। খানিক পর তো তার পক্ষের জোরালো সাক্ষী সশরীরে বাড়ির উঠানে হাজির অচেনা ভাইজান, মোয়াজ্জেম হক।

সিন্দবাদের ঝড়-ঝঞ্ঝা-আক্রান্ত জাহাজের আদলে গড়া কল্পনার জাহাজটা বেহাত হয়ে গেলেও সাবিনার বাবার সমুদ্রপথে রেঙ্গুন পাড়ি দেওয়াটা মিথ্যা নয়। মিথ্যা নয় পর্বত-অরণ্যে তাঁর মরণপণ লড়াই। মোয়াজ্জেম হক বলতেন – তখন বাঁচলে গাজি মরলে শহিদ, বাঁচা-মরা দুটিরই অর্থ ছিল।

 

‘আ গো, তোমার মনে এত রং, আমার নাই। কী করবা বাপের বীরত্বের কাহিনি দিয়া?’

‘লিখব আম্মা!’ কাগজপত্র ডাইনিং টেবিলের এক পাশে বিছিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে সাবিনা।

‘হু, এতো দিন বাদে বাপেরে নিয়া লেখার কথা মনে অইছে! সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।’

নীহার বানু বদ্ধঘরে ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকারে হাঁটছেন। মনে হয় রাগত চেহারার খাঁচাবন্দি বাঘ। আসলে কিন্তু বাতে কাবু। গরমপানির বোতল নিয়ে এতক্ষণে তাঁর শুয়ে পড়ার কথা। মনের জেদ বজায় রাখতে বার্ধক্যজনিত রোগের ওপর টেক্কা দিয়ে হাঁটছেন বা রাতের খাবারের পর সঙ্গে সঙ্গে শুতে নেই – সেই নিয়মের বশবর্তী হয়ে হয়তো।

সাবিনা পেনসিলের গোড়াটা ডাইনিং টেবিলে ঠুক ঠুক করে অস্থিরভাবে। এ বিষণ্ণ বাড়িটার যেন অতীতমুখী অদৃশ্য একটা জানালা আছে, যা ও খোলা রাখতে চায়। ওটা দিয়ে ধোঁয়া জড়ানো বারুদগন্ধময় হাওয়া ঢুকলেও ক্ষতি নেই। তাই তো আসার কথা আরাকান বা ইম্ফলের পাহাড় থেকে। সঙ্গে মুমূর্ষুর কাতরানি আর গুলির শব্দ। r (চলবে)