হরবোলার হৃদয়বৃত্তান্ত

রফিকুর রশীদ

শুরুটা ছিল তার পাতার বাঁশি দিয়ে।

আমি তো খুব কাছে থেকে দেখেছি তাকে, বলতে গেলে তার সব পরিবর্তনই ঘটেছে আমার চোখের সামনে, ফলে তাকে অবিশ্বাস করার মতো কিছুই খুঁজে পাইনি আমি। সেই ছোটবেলা থেকে বাঁশি বাজাতে দেখেছি। স্রেফ পাতার বাঁশি। গাছের পাতা জড়িয়ে ভাঁজ করে বিশেষ কৌশলে হাতের মুঠোয় পুরে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিলেই বেজে ওঠে – পৌঁ… পৌঁ…। বেজে ওঠে মানে সবার হাতেই বেজে উঠবে! অসম্ভব! আমি গোপনে এবং প্রকাশ্যে কতভাবে চেষ্টা করেছি, পারিনি। রাগে-দুঃখে বাঁশির পাতা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করেছি। নুরু হেসেছে। আমার দুর্দশা দেখে তার নাকি হাসি পায়। সে হাসে। আবার সবার চোখের অগোচরে আমার কাঁধে হাত রেখে কত সহজে প্রস্তাব রাখে  – চলো যাই কাজলাপাড়ে, বাঁশি ধরা শিখিয়ে দেব।

কাজলা আমাদের বাড়ির পাশের নদী। নামেই শুধু নদী। সেই কবে নদীচরিত্র হারিয়ে বৃদ্ধা নারীর মতো বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে নির্বিকার। তবু আমরা সেই নদীপাড়ে পুটুশ বনে যাই দিনের আলোয় কিংবা জোছনারাতে। নুরু আমাকে পাখির ডিম পেড়ে দেয়, ফড়িং কিংবা প্রজাপতি ধরে দেয়, তাই বলে বাঁশি বাজানোও শেখাবে! বয়সে দু-এক বছরের বড় হলেও সে আমার জোতদার পিতার এক পাল গরু চরানো রাখাল বই তো নয়! সেই রাস্তা ধরে মিয়াভাই আমাকে ডাকে, কখনো-বা নাম ধরেও ডাকে, কিন্তু সেটা বাড়ির বড়দের সামনে কিছুতেই নয়। প্রভু-ভৃত্যের এমন মাখামাখি কেই-বা পছন্দ করে। অগত্যা বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়েই আমরা কাজলাপাড়ে যাই, পাতার বাঁশি বাজানোর কৌশল শেখার চেষ্টা করি।

সেসব কৌশলের কিছুই আমার শেখা হয়নি। কিন্তু আমার বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখের সামনে নুরু ঠিকই পাতার বাঁশি বাজায়, পলিস্নগীতি-ভাওয়াইয়া গানের সুর তোলে; অবাক কা- হচ্ছে এক সময় আর বাঁশিও লাগে না তার, শুধু হাতের মুঠোয় মুখের ফুঁ দিয়েই বাঁশির মতো বাজিয়ে শোনায়। কিছুদিন পর দেখা গেল গানের সুর শুধু নয়, সে আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, ফেরদৌসী বেগমের কণ্ঠ নকল করে তাঁদের বিখ্যাত গানগুলো দিব্যি গেয়ে শোনাচ্ছে। হুবহু সেই কণ্ঠ, সেই সুর। নারী-পুরুষ কণ্ঠ দুই-ই সে নকল করতে পারে। একদিন আবদুল জববারের বিখ্যাত গান ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ও নামিয়ে

দিলো। এসব দেখে-শুনে কোনো মানুষের চোখ কপালে না উঠে পারে!

পাতার বাঁশি বাজানোর কালে বেশ দু-চারটি ইতর প্রাণীর কণ্ঠ নকল করে নুরু সবাইকে চমকে দেয়। গরুর হা ম্বা, কুকুরের ঘেউ-ঘেউ কিংবা বেড়ালের মিউ-মিউ ধ্বনি সবাই শোনে, কিন্তু ওই প্রাণীগুলো কি সবসময় একই রকম অনুভূতি প্রকাশ করে, নাকি একই কথা বলে! ক্রোধে উন্মত্ত কুকুর শত্রম্নকে তাড়া করার সময় যে ধ্বনি উচ্চারণ করে, স্নেহে বিগলিত কুকুরমাতা সন্তানকে স্তন্যদানের সময় নিশ্চয় সেই একই ধ্বনি উচ্চারণ করে না। হোক ইতর প্রাণী, তবু তাদের ভিন্ন-ভিন্ন অনুভূতির মধ্যে পার্থক্যটুকুও শনাক্ত করে নুরু এবং তা হুবহু নকল করে শোনায়। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে কখনো-কখোনো সে প্রমাণ করেও দেখায়। ঠিক চ্যালেঞ্জ নয়, আমার মা একবারে আবদেরে গলায় নুরুকে বলে – ঘুঘুপাখি কি বিরান হয়ি গেল হা বাপ! গলায় গয়না-আঁকা ঘুঘু দেখিনি কদ্দিন!

তা বটে, মাঠে যথেচ্ছ পরিমাণ কীটনাশক ছিটানোর ফলে ঘুঘুসহ নানা পাখপাখালি বিরান হওয়ার পথে। আমাদের উঠোনে কিংবা ঝাঁকড়া গাছের ডালে পাখিদের আনাগোনা একেবারে কমে গেছে। নুরু একগাল হেসে বলল, ঘুঘু দ্যাখপেন নাকি ঘুঘুর ফাঁদ দ্যাখপেন চাচি-মা?

ফাঁদ আর কী দেখব! তুই আমাকে ঘুঘু দ্যাখা দিনি!

ব্যস। হাতের মুঠোয় বাঁকা ঠোঁট লাগিয়ে ঘুঘুর কণ্ঠে ডেকে ওঠে নুরু। আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘুঘুপাখি এসে উঠোন ভরে যায়। রান্নাঘর থেকে চাল এনে তাদের খেতে দেয় মা। ঘুঘুরা খুশিতে ডেকে ওঠে, ঘুঘুর ঘু …।

নুরুর এসব কা-কীর্তি দেখে কে না অবাক হয়! আমরা ছেলে-ছোকরার দল তো তার পেছনে লেগেই থাকি, নানাভাবে উত্ত্যক্ত করি। দিনের শেষে হাঁস-মুরগির ঘরে ফেরার সময় তখনো হয়তো হয়নি, অথচ আমরা আবদার করে বসি – নুরু মিয়া, দেখাও তোমার কেরামতি, হাঁস-মুরগি ডাকো দেখি!

নুরুর মুখে হাসির বিভা! বড়ই রহস্যময় সে হাসি।

আমরা অপরিসীম কৌতূহলে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে সে ঋষিবৎ ঔদাসীন্যে জানায়,

মাথা খারাপ! অবলা পশুপাখিকে জ্বালাতন কত্তি হয় না।

জবাব শুনে আমরা অবাক। আমার মা এগিয়ে এসে বলে,

জ্বালাতন কিসির বাপ! উরা কি খাঁচায় ওঠ্পে না?

এখনো বেলা ডুবিনি যে চাচি-মা!

তা হোক। তুমি ডাকো। আমি চাড্ডি খাতি দিই।

তারপর তো খাঁচায় ওঠ্পে!

অগত্যা নুরুকে রাজি হতেই হয়। হাতের মুঠোয় মুখ ঠেকিয়ে নানান রকম ধ্বনি তোলে। হাঁসের ডাক। মুরগির ডাক। নকল, তবু কত অবিকল। বিভ্রান্ত হাঁস-মুরগি ডাক শুনে ছুটে চলে আসে উঠোনে। থমকে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক কী যেন খোঁজে। আমার মা ওদের ভাষা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, দ্রুত হাতে চালের খুঁদ ছিটিয়ে দেয়, ধানের কুঁড়ো মাখিয়ে দেয় পরম মমতায়। তারপর আবার নুরুর সামনে দাঁড়িয়ে শুধায়,

সোলেমান নবীর নাম জানো তো নুরু?

নুরু ভীষণ লজ্জা পায়। ঘাড়মাথা চুলকিয়ে নিতিবিতি করে বলে,

কী যে বোলেন চাচি-মা! কুথায় নবী পয়গম্বরের কতা! অপবিত্র মুখি তাদের নাম নিয়া চলে! হঠাৎ দাঁতের ফাঁকে জিভ কাটে নুরু, ওই নাম করলি আমি গুনাগার হয়ি যাব মা।

এই ঘটনার পর থেকে আমার মায়ের আচরণে একটু একটু  পরিবর্তন চোখে পড়ে। আশৈশব সে শুনে এসেছে সোলেমান নবীর কুদরতি ক্ষমতার কথা  – তিনি নাকি পশুপাখির ভাষা বুঝতেন; এখন নিজ বাড়ির রাখালের মধ্যে সেই অলৌকিক গুণের স্ফুরণ ঘটতে দেখে তো চমকে ওঠারই কথা! সেই সঙ্গে তার মনে পড়ে যায়, কোনো ধর্মসভায় নাকি কার কাছে যেন শুনেছিল  – যুগে-যুগে নবী পরগম্বর-অবতারদের অনেকেই নাকি রাখাল রূপে এসেছেন এই পৃথিবীতে; সেই কেচ্ছা মনে পড়তেই আমাদের অতিচেনা নুরুর দিকে সমীহভরা চোখে তাকায়, আবার অতি সঙ্গোপনে আমাকে নুরুর সঙ্গে মিশতে নিষেধও করে।

যদ্দূর মনে পড়ে, এ-জীবনে মায়ের নিষেধ মান্য করার চেয়ে অমান্য করাতেই অধিক আনন্দ পেয়েছি। এ-ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাছাড়া কোন অপরাধের জন্য নুরুর সঙ্গ আমাকে পরিহার করতে হবে সেটাই তো আমার স্পষ্ট নয়, অকারণে একটা আদেশ জারি করলেই হলো! নুরু কি আমাকে গরু চরানোর প্ররোচনা দেয়। বরং লেখাপড়া করতে না পারার জন্য সে দুঃখ করে, আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়, আমার বইয়ের পাতা উলটিয়ে ছবি দেখে, অতিশৈশবের বর্ণ পরিচয় ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, শক্ত শব্দের বানান ভেঙে-ভেঙে শিখিয়ে দিলে খুশি হয়; নুরুকে তো আমার ভালোই লাগে। তাকে আমি ত্যাগ করব কোন দোষে!

সত্যিকারের কথা বলতে কী, বেশ কয়েক বছর পর এই নুরুই আমাদের সবাইকে ত্যাগ করে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। আমি তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। নুরুও ঢের বড় হয়েছে। আমাদের বাড়ির বাঁধা মাইনের রাখাল-কৃষাণ আর নয়। কী জানি কোন অদৃশ্য শর্তে আমার জোতদার বাবা মাঠঘাট দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার ওপরে ছেড়ে দিয়েছে। দিনে-দিনে সে প্রায় বাড়ির ছেলের মর্যাদা অর্জন করেছে। অচিরেই সেই ছেলের বিয়েথা দিয়ে সংসারী করার ভাবনাও আমার মা ভাবছে বলে শুনতে পাই। এখানে এসে তার প্রবল আপত্তি।

কেন, আপত্তি কিসের?

ততদিনে আমাদের নুরুর নাম ডাক চারদিকে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে ‘নকল-নুরু’ হিসেবে। যে-কোনো কণ্ঠস্বর চমৎকারভাবে নকল করতে পারে এবং নকল কণ্ঠে  বিখ্যাত শিল্পীর গান গেয়ে শোনাতে পারে বলেই মানুষের মুখে-মুখে তার এই নামকরণ হয়ে যায়। খ্যাতির সঙ্গে বেশ স্বীকৃতিও আসতে শুরু করে। একবার ইউনিভার্সিটি থেকেই খবর পেলাম  – আমাদের নুরু নাকি কোন এক সার্কাস পার্টিতে ভিড়ে গেছে, তার ওই নকল কণ্ঠস্বর শোনানোর জন্য ভালো মাইনে দেবে। মাকে বলে গেছে শীতের দুমাস কাটিয়ে সে আবার ফিরে আসবে। আমি ভাবি, ফিরে এলেই হয়, আমাদের ভার্সিটির অডিটরিয়ামে তার একটা শো করাব। আমার মুখে সে অনেক গল্প শুনেছে ভার্সিটির, কত কিছু নিয়ে যে কৌতূহল তার সীমা-পরিসীমা নেই, সেই নুরু একবার বৃহৎ পরিম-লে বেড়িয়ে গেলে নিশ্চয় খুব খুশি হবে। আমার বন্ধুমহলে নুরুর বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়, তাকে নিয়ে একটা শো করানোর বিষয়ে সবাই একমত। এখন সে এলেই হয়।

আমার মায়ের অনুযোগের ধারা থেকে টের পাই, নুরু শিগগিরই বিয়ে করবে না। সার্কাস দলের ছুকরিদের সঙ্গে ঢলাঢলি করলে কি তার চরিত্রের ঠিক থাকে! তার আবার বিয়েথার কী দরকার!

নুরুর প্রতি অপত্যস্নেহের আধিক্যবশত মায়ের এই অনুযোগ, সে-কথা সহজেই বোঝা যায়। অথচ নুরু ঠিক একদিন সার্কাস দল থেকে বাড়ি ফিরে আসে। এখানে আসা ছাড়া জগৎ-সংসারে নিরাপদে এবং নিরুদ্বেগে দাঁড়ানোর আর কোনো জায়গা নেই। পিতৃমাতৃহীন অনাথ শৈশব থেকে এই বাড়িকেই তার ঠিকানা বলে জেনেছে। দুমাসের জন্য সার্কাস দলে গিয়ে তার চোখ-মুখ বেশ খুলেছে, প্যান্ট-শার্ট, জুতো-মোজা পরে বেশ ফুলবাবুর মতো ভাব হয়েছে, তাই বলে আপন ঠিকানা ভুলে যাবে সে! সার্কাস-ফেরত নকল-নুরুকে দেখতে আসে অনেক লোক। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নতুন শেখা সেই সব ক্রীড়া-কসরৎ দেখিয়ে অতিসহজেই সে সবার চোখে-মুখে তাক লাগিয়ে দেয়। আর খইফোটা উনুনের মতো তার মুখে কথার ফুলঝুরি তো ফুটতেই থাকে। উঁচু গলায় ঘোষণা দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়  – অল্পদিনেই সে ইন্ডিয়া চলে যাবে।

ইন্ডিয়া! ইন্ডিয়া কেন?

বেশ গুরুগম্ভীর চালে ঘাড়মাথা ঝাঁকায়। গোঁফের আড়ালে হাসে। তারপর বলে, মক্কা না গেলি হজ করা হয়!

এমন ঘোরপ্যাঁচের কথার মাথামু-ু অনেকেই বুঝতে পারে না। তারা পুরনো অভ্যাসমাফিক নকল-নুরুর কাছে দাবি জানায় ইতরপ্রাণীর নকল কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। কেউ বা সার্কাসের বাঘের গর্জন শুনতে চায়। সবাইকে অবাক করে আমার চাচাতো বোন আয়েশা হঠাৎ আবদার জানায়  – পাতার বাঁশি বাজাও না নুরু ভাই!

যে-মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে, রেজাল্ট বেরোলেই তিন মাইল দূরের কলেজে ভর্তি হবে, তার কেন বাঁশির সুর শোনার আহ্লাদ! নকল-নুরু সবার সব দাবি পূরণ করে অমস্নান বদনে, আয়েশার বেলায় এসে জানায়, সে আর বাঁশি বাজাবে না, তবে গান শোনাবে। হেমমেত্মর গান। হেমন্ত মুখার্জির গলা নকল করে সে গাইতে শুরু করে  – ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে তারে কেন গাইতে বলো…।’

যার জন্য নুরুর এই গান গাওয়া সেই আয়েশা গান শেষ হওয়ার আগেই সহসা ফুঁপিয়ে ওঠে এবং আমার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ জানায়, এ-গান আমার ভালো লাগছে না বড়মা। অন্য গান গাইতে বলো। মেয়ের কথা অবাক হয়ে শোনে আমার মা, কিন্তু নুরুকে সেদিন কিছুই বলে না। আরো দু-তিন দিন পর রাতের খাবার সামনে বেড়ে মা জিজ্ঞেস করে, হা বাপ নুরু, তুই ইন্ডিয়া যাবি কেন?

জবাব না দিয়ে ভাত খেতে থাকে নুরু। বেশ কয়েক গ্রাস খাবার পর নুরু বলে, ইন্ডিয়ায় গুরু আছে যে!

কিসের গুরু?

আমি যেসব জিনিস নকল করে শোনাই ও দেখাই, এসব আরো ভালো কইরি শিখতি হলি গুরু ধরতি হবে।

চমকে ওঠে আমার মা। দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে,

ওসব আর শিখতি হবে না। তুই আমার কাছেই থাক।

খাঁচায় আটকেপড়া পাখির মতো ডানা ঝাপটায় নুরু,

আমি তালি মিয়াভাইয়ের কাছে যাব।

আচ্ছা তাই যাস। সে আসুক আগে।

মিয়াভাই কবে বাড়ি আসবে চাচি-মা?

সামনে তার পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে তো একবার আসবেই।

আচ্ছা আসুক।

সেদিন মুখে আসুক বললেও নুরু প্রকৃতপক্ষে আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। অবশ্য কবুল করাই ভালো, পরীক্ষার আগে আমারও বাড়ি আসা হয়ে ওঠেনি। এসেছি পরীক্ষার পরপরই। ততদিন আমাদের নকল-নুরু সবার অলক্ষে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। আমার সরল মা তবু বিশ্বাস করে বসে অছে, নুরু হয়তো আমার কাছেই গেছে। আমার জন্য কদিন নাকি খুব ছটফট করছিল সে। তা হবেও হয়তো-বা। অন্তরের সেই ছটফটানি থেকে সে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। নুরুর হাতের চিঠি। ব্যাপারটা আমার কাছে যেমন কৌতূহলের, তেমন বিস্ময়ের। সামান্য অক্ষরজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনের সময় মানুষ এভাবে চিঠি লিখতেও পারে! নুরু বাংলা ভাষায় লেখা গদ্য-পদ্য বেশ ঝরঝর করে রিডিং পড়তে শিখেছে, সে আমি খুব ভালো করে জানি, কলম ধরে লিখতে গেলেই যত গোলমাল। তার হাতের আঁকাবাঁকা অক্ষর আমার খুব চেনা। বাক্য গঠনও খুবই কাঁচা। পুরো বাক্যপাঠের পর মনে-মনে জোড়াতালি দিয়ে তার এক প্রকার অর্থ দাঁড় করে নিতে হয়। বহু সাধ্য-সাধনায় আমিও সেই চিঠির মর্মোদ্ধার করি। খুব সাদামাটা কথায় সে জানাতে চেষ্টা করেছে  – বাড়ি ছেড়ে না গিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না। কেন তাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, সে-কথা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য কেউ যেন খুঁজে-খুঁজে হয়রান না হন। এমনকি আমিও যেন চেষ্টা না করি। কখনো সম্ভব হলে সে নাকি নিজে থেকেই বাড়ি ফিরে আসবে। কী একটা যেন  – শেষ কথা আমাকে জানাতে চেয়েও পারছে না বলে খুব দুঃখ তার। নুরুর লেখা সেই চিঠি আমি কতবার যে উলটেপালটে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। অথচ বহুদিন পর আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে – খামের ওপরের ঠিকানাটুকু সে নিজের হাতে লিখেনি। কেমন যেন মেয়েলি অক্ষর গঠন। অন্য কারো কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়েছে। এই অন্যটা যে কে, তা আর আমার খুঁচিয়ে বের করার ইচ্ছা হয়নি। নুরুর জন্য অনেকদিন আমার বুকের ভেতরে যন্ত্রণার বুদ্বুদ উঠেছে, নুরুর নাম ধরে মাকেও কাঁদতে দেখেছি, তবু আমি নুরুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি। এমনকি আমার চাচাতো বোন আয়েশা একদিন ছলোছলো চোখে আমার কাছে জানতে চায়  – নুরুভাই তা হলে তুমার কাছেও যায়নি মিয়াভাই! আমি চোখ তুলে আয়েশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি শুনেছি মাত্র, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি, কোনো উত্তর দিতে পারিনি।

 

দুই

না, লোকে যাকে নকল-নুরু বলে, আমাদের সেই নুরুর সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জীবনের  ধুলোবালির আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে তার চিরসবুজ মুখের আদল। অথচ কে জানত  – জীবনের মধ্যবেলা পেরিয়ে এসে আমার সেই বাল্য সহচর নুরুকে দেখতে হবে টেলিভিশনের পর্দায়! এখন সে আর নকল-নুরু নয়, বিনোদন ম্যাগাজিনের জনপ্রিয় উপস্থাপক তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘নুরুল ইসলাম হরবোলা’ এই নামে। নাম যা-ই হোক, আমার দুচোখের পাতা পড়ে না, বেশভূষার আড়ালের মানুষটিকে আমি ঠিকই চিনতে পারি, এ আমাদের হারানো নুরুই বটে। উপস্থাপকের দ্রুতলয়ের প্রশ্নের উত্তরে কেমন টকাস-টকাস করে কথা বলছে! চমৎকার উপস্থাপনার গুণেই হবে হয়তো, এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি বরাবরই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমার পক্ষে সব অনুষ্ঠান দেখা হয়ে ওঠে না, তবে মাসের এই বিশেষ দিনটিতে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে টিভির সামনে বসে আমার স্ত্রী। হরবোলার কা-কারখানা দেখে আমার ছেলেমেয়েরা হাসিতে গড়িয়ে পড়ে, তাদের মায়ের চোখে বিস্ময়ের স্তব্ধ ছায়া। এ সময় আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে  – দ্যাখো-দ্যাখো, লোকটার একই মুখে কত রকম ভাষা! আমিও অবাক হওয়ার ভান করি  – তাই তো! ভারি আশ্চর্য ব্যাপার!

উপস্থাপক তখন জানতে চাইছেন,

আপনার এ-বিদ্যা আপনি শিখলেন কোথায়?

নুরুর কী স্বতঃস্ফূর্ত জবাব,

প্রকৃতির কাছ থেকে।

বলেন কী! কোনো গুরু নেই আপনার?

হ্যাঁ, আছে। অনেক পরে গুরুর সন্ধান পেয়েছি।

কী নাম তার? কোথায় থাকেন?

দুহাত কপালে ঠেকিয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে গুরুর নাম উচ্চারণ করে,

শ্রী শুভেন্দু বিশ্বাস। জন্ম তাঁর এই বাংলাদেশেই, থাকেন তিনি কলকাতায়।

বাংলাদেশেই জন্ম?

হ্যাঁ। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে গড়াই নদীর পাড়ে জন্ম। দেশ ভাগের পর ওপারে চলে যান। কলকাতায় গিয়েই তিনি আসল গুরুদেবের সন্ধান পান।

আসল গুরুদেব! সেটা আবার কে?

শ্রী রবিন ভট্টাচার্য। আমি তাঁকে দেখেনি। শুনেছি তিনি বোলপুর-শামিত্মনিকেতনে নকল গলায় ডেকে-ডেকে পাখপাখালিদের বিভ্রান্ত করতেন। স্বয়ং কবিগুরু নাকি কাছে ডেকে তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন  – হরবোলা। হরেকরকম বোল।

অ। তাহলে এই জন্য আপনার নাম নুরুল ইসলাম হরবোলা?

জি, হরবোলা হচ্ছে কবিগুরুর দেওয়া নাম।

আপনি তাহলে কলকাতায় গিয়ে গুরুর কাছে শিক্ষা নিয়েছেন?

আমি মূর্খ মানুষ, শিক্ষা নেব কী করে? সামান্য গুরুসেবা করেছি মাত্র। আমার গুরু লেখাপড়া জানা মানুষ। হরবোলার কলাকৌশল নিয়ে বই লিখেছেন।

তাই নাকি! বই পড়েও শেখা যাবে এসব!

গুরুদেব তো তাই বলেন। তিনি একটা হরবোলার ইশ্কুল খুলবেন। সেইখানে আমাকে থাকতে বলেন। মূর্খ মানুষ সেখানে কী করবে বলুন দেখি!

আপনি এই গুরুদেবের সন্ধান পেলেন কেমন করে?

একগাল হাসি ছড়িয়ে নুরু জানায়,

শখের বশে কদিন ভিড়েছিলাম সার্কাস পার্টিতে। সেইখানে আমার কলাকৌশল দেখে কুমারখালীর এক সাংবাদিক শুভেন্দু বিশ্বাসের সন্ধান দেন। দুহাত কপালে তুলে বলে, আমার গুরুদেব তো মানুষ নন, দেবতা। তিনি সব উজাড় করে দিতে চান; কিন্তু আমি যে মূর্খ ! আমি সেসব নেব কী করে? নেবার মতো পাত্র আছে আমার?

উপস্থাপক একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন,

বারবার নিজেকে মূর্খ বলছেন কেন? আপনার শৈশব-কৈশোরের কথা বলুন।

অবলীলায় ঘোষণা করে নুরু,

আমি ছিলাম মাঠের রাখাল। লেখাপড়ার সুযোগ আর পেলাম কোথায়? ছিল এক মিয়াভাই, তার কাছেই সামান্য হাতেখড়ি। আমারই দোষে তাকে হারিয়েছি। লেখাপড়া হবে কেমন করে! ওই অক্ষর চিনি বানান করা পর্যন্তই।

এত কথা শুনতে-শুনতে আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আছে। কণ্ঠ রোধ করে দাঁড়ায় বাষ্পীয় পি-। বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠে অভিমান  – কে তোর মিয়াভাই? চাচি-মা কিংবা মিয়াভাইকে ভুলে গেলে তোর কি ক্ষতি!

উপস্থাপক এতক্ষণে হঠাৎ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থেকে সরে আসেন। জানতে চান, আপনার এই হরবোলা-জীবনের শুরু হয়েছিল কী দিয়ে?

পাতার বাঁশি দিয়ে। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে টের পাই  – ইচ্ছে করলে শব্দকে পালটে ফেলা যায়।

আজ কি আমরা একটুখানি পাতার বাঁশি বাজানো শুনব?

না। অনেক আগেই বাঁশি ছেড়ে দিয়েছি। অন্য কিছু বলুন।

পশুপাখির বিচিত্র ডাক আমরা শুনেছি আপনার কণ্ঠে, এই ডাক শুনে পশুপাখি কি কাছে আসে?

একগাল হেসে সে জানায়,

তাহলে স্টুডিওর বাইরে আসুন। ঢাকা শহরের কাকেদের ডেকে আনি।

এরপর সত্যি-সত্যি স্টুডিওর বাইরে ধারণ করা দৃশ্য দেখানো হয়। নুরুল ইসলাম হরবোলা মুখের সঙ্গে হাত ঠেকিয়ে কা-কা ধ্বনি উচ্চারণ করতেই উড়ে আসে রাজ্যের যত কাক। কর্কশ কা-কা রবে কান পাতা দায়। অগত্য উপস্থাপক অনুরোধ জানান  – তাড়ান ওদের তাড়ান।

আবার বিচিত্র ধ্বনিতে নুরু তাড়িয়ে দেয় কাকদের।

নুরুর কণ্ঠের ধ্বনিতে কী তাৎপর্য পরিস্ফুট হয় কে জানে, কাকেরা আবার কা-কা রব তুলে উড়ে যায়, শিলকড়ইয়ের ডালে বসে দোল খায়, ডাস্টবিনে বসে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় আবর্জনায়।

কাকদের হামলা থেকে সদ্য উদ্ধার পাওয়া উপস্থাপক পাঞ্জাবির কোনা ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফছুতরো হয়ে নুরুল ইসলাম হরবোলার দিকে তাকান, ঠোঁটের কোণে একটুখানি সলজ্জ হাসি ঝুলিয়ে বলেন,

আপনার এই নকল ডাকেরই এমন শক্তি!

হরবোলার তো সবই নকল।

সবই নকল?

হ্যাঁ, এক সময় তো আমাকে সবাই ‘নকল-নুরু’ বলেই ডাকত!

তাই নাকি!

তবে আর বলেছি কী! এই যে আমার মাথার চুল, নকল চুল। চোখদুটো অপারেশন করানো, মানেই নকল চোখ। মুখের দাঁত, সেও নকল, বাঁধানো দাঁত, মানেই নকল হাসি। আর বুকের মধ্যে হার্ট আছে, সেখানে পেসমেকার বসানো সারা। কাজেই ওই হার্টও নকল। তাহলে আর বাকি থাকল কী!

উপস্থাপকও মোটেই রসিকতায় কম যান না। তিনি এবার সোজা দর্শকের দিকে দুহাত নেড়ে বলেন  – প্রিয় দর্শকবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন হার্ট মানে শুধু হৃৎপি- নয়, হার্ট মানে হৃদয়ও। আমাদের বিশ্বাস  – নুরুল ইসলাম হরবোলার হৃদয়টা নিশ্চয় নকল নয়।

অনুষ্ঠানের যবনিকা টানার প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন উপস্থাপক। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিনি হরবোলা-শিল্পী নুরুল ইসলামের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে তার দীর্ঘায়ু কমানো করেন; অভিনন্দন জানান। কিন্তু আমাদের নকল-নুরু সহসা তখন হৃদয়বৃত্তান্ত মেলে ধরে। কেমন অবলীলায় সে সবাইকে জানিয়ে দেয়   – অনেক বছর আগে বর্ষণমুখর এক গ্রামীণ সন্ধ্যায় তার হৃদয় হারিয়ে যায়। সেই হৃদয়টা মোটেই নকল ছিল না, সেটা ছিল টকটকে লাল জবার মতো। হৃদয় হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পর সে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে জানতে পেরেছি, যাকে হৃদয় দিয়ে তার এমন ফতুর হওয়া, সেও নাকি নিঃসংশয় হতে পারেনি  – নকল-নুরুর হৃদয়টা আসল ছিল কিনা!

ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে অনুষ্ঠানের সময়সীমা একেবারে শেষ প্রামেত্ম। ফলে সব আয়োজন গুটাতেই হয় উপস্থাপককে। কোথা থেকে এত আস্থা খুঁজে পান তিনিই জানেন, গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে দর্শকদের জানিয়ে দেন  – আমরা বিশ্বাস করি, হরবোলা নুরুল ইসলামের সেদিনের হারানো হৃদয়টা ছিল আসল ও অকৃত্রিম হৃদয়। সবাই সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন। শুভরাত্রি।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে ধীরে-ধীরে ফেড হয়ে আসে দৃশ্য এবং শব্দ। ঝাপসা হয়ে আসা টিভি পর্দাতেই আমি খুঁজি সেই মুখ, যে আমাদের নকল-নুরুর আসল হৃদয়টাকে চিনতে পারেনি। আমি কি চিনি তাকে, সেই নারীকে? r