হাসান আজিজুল হকের শিল্পীসত্তার স্বরূপ

চন্দন আনোয়ার

হাসান আজিজুল হক বিষয়-বিন্যাস ও  নির্মাণ-কৌশল প্রসঙ্গে কখনো রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণ করেননি। নিজের সময় ও পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ধরার চেষ্টা তাঁর বরাবর। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে নিয়েও পূর্বসূরিদের পথে হাঁটেননি। তিনি ষাটের দশকে নতুন আঙ্গিক-ধারার প্রথমসারির একজন ছিলেন। অবশ্য এ-ধারায় বেশিদিন স্থির থাকেননি। কারণ এই নতুন আঙ্গিক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো বড়ো ঘটনাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয় অথবা ধারণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এছাড়া ষাটের দশকের নতুন আঙ্গিক-ঘরানার লেখকদের মধ্যে বিষয় ও আঙ্গিককে স্বতন্ত্র করে দেখার প্রবণতা ছিল। এ-কারণেও এ-ধারার সাহিত্য পরিবর্তিত বাস্তবতায় আর মূল্যায়িত ও অনুসৃত হয়নি। বস্ত্তত, স্বেচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা সজ্ঞানে হাসান আজিজুল হক এই নতুন ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। যতটুকু হয়েছেন তা সম্পূর্ণ কালিক এবং এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বলে। প্রথম গল্প ‘শকুনে’ই তাঁর গল্পের বিষয় ও আঙ্গিক অবিচ্ছিন্ন এক সত্তায় মিলিয়ে যায়। পরে ক্রমশ তিনি আরো বিষয়ানুবর্তী হয়েছেন। বিষয়ই তাঁর গল্প-উপন্যাসের আঙ্গিক নির্ধারণ করে দিয়েছে। নির্মাণ-কৌশল নিয়ে আলাদাভাবে ভাবনার কোনো সুযোগ নেই। নতুন সময় ও জীবনকে নির্মাণ করতে গিয়ে শিল্পের আঙ্গিক উপাদান খোঁজা হয়নি তাঁর, বরং জীবন ও সময় পরিভ্রমণের ভেতর দিয়ে নতুন একটি শিল্প উঠে এসেছে। এই নতুন শিল্পরীতি চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের লেখকদের মতো বিষয়সর্বস্ব বর্ণনাত্মক কাহিনি নির্মাণের দিকে যেমন যায়নি, তেমনি ষাটের দশকের নতুন রীতির নামে শুধু আঙ্গিকসর্বস্ব গল্প লেখার ধারায় যায়নি। হাসান আজিজুল হক এই  দুইয়ের মধ্যে একটি অপূর্ব সমন্বয় করেছেন। নতুন নির্মাণ-কৌশল ব্যবহার করে নতুন বয়ান নির্মাণের চেষ্টা তাঁর ক্ষেত্রে কখনো অর্থহীন বা ব্যর্থ হয়ে যায়নি।

হাসান আজিজুল হকের আখ্যানবিশ্ব সময়ের বিচিত্র ও বহুস্তরের রূপান্তর এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে একটি পরিণতিতে এসে পৌঁছেছে। তাই চলমান বাস্তবতার প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেনি শুধু, প্রায়শ নতুন বিষয় হয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে লেখার পূর্বতন আঙ্গিকের পরিবর্তন এসেছে। নতুন বিষয়কে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের কারণে হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের বিষয় ও নির্মাণ-কৌশল পুনরাবৃত্তি-মুক্ত। বস্ত্তত, তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত প্রচলিত নিয়মকেই কথাসাহিত্যের বিষয় করেন। একটি গল্প বা উপন্যাসের বিষয়-বিন্যাস ও নির্মাণ-কৌশল তার আগেরটি থেকে প্রায় সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। এই দৃষ্টান্ত বাংলা কথাসাহিত্যে খুব বেশি নেই। এই দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের জন্য যে সাহস ও অভিজ্ঞতার নবায়ন দরকার এবং নিজেকেই নিজে প্রত্যাখ্যান করার মনোবল দরকার, তা অর্জন করেছিলেন বাস্তবজীবন থেকেই। তাঁর প্রতিটি গল্প-উপন্যাস নিরলস ও কঠোর শ্রম দাবি করে। প্রতিটি বাক্য ও শব্দ প্রয়োগে তিনি অত্যন্ত সতর্ক ও অনুসন্ধিৎসু। এই কারণে পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়কাল ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখক-জীবন অতিক্রম করেও মাত্র সত্তরটির মতো গল্প ও দুটি প্রকৃত উপন্যাস এবং দুটি ছোট উপন্যাস লিখেছেন। এই হিসাব অনেক কথাসাহিত্যিকের জন্য এক বছরই যথেষ্ট। তাঁর প্রতিটি লেখার একটি ভিশন থাকে, তাই প্রতিটি লেখাই তাঁর কাছে সংগ্রামের; প্রতিবারই একজন তরুণের মতো সাহস নিয়ে লিখতে বসেন। লিখতে বসেন খুব কম, লেখেন কম কিন্তু ভাবেন সারাক্ষণ। তিনি নিজেকে ‘সার্বক্ষণিক লেখক – ক্লান্তিহীন লেখক’ হিসেবে দাবি করেন।

হাসান আজিজুল হক একটি লেখার সংগ্রামে একবারই অবতীর্ণ হন এবং সংগ্রামে জয়ের পরে অর্থাৎ লেখাটি শেষে আর সেই পুরনো লেখায় ফিরে যান না। নতুন আরেকটি লেখার সংগ্রামে তখন নিবিষ্ট থাকেন।

হাসান আজিজুল হকের লেখায় বাংলা কথাসাহিত্যের কাহিনির সরলরৈখিকতা ও কেন্দ্রিকতার ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যাত হয়। তাঁর গল্প-উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য ও গভীরতার নতুন আবেদন সৃষ্টি হয়। কথাবস্ত্তকে সম্পূর্ণ সংহতরূপে প্রকাশ করেন। শব্দ-প্রয়োগ, বাক্য-বিন্যাস, গদ্যের গতি, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগ শুধুই নান্দনিক বিষয় থাকেনি, বিষয়ের বাইরেও নতুন কোনো ব্যঞ্জনা অথবা মূল্য নির্ধারিত হয়।

হাসান আজিজুল হক প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ছোটগল্প লিখে গেছেন। কৈশোরে-তারুণ্যে উপন্যাস লেখার চেষ্টা ছিল বটে কিন্তু প্রথম প্রকৃত উপন্যাস লিখেছেন ষাটোর্ধ্ব বয়সে। ছোটগল্পের আঙ্গিকেই তাঁর লেখকসত্তার বিকাশ ঘটেছে। বস্ত্তত তিনি সাহিত্যের আঙ্গিক পার্থক্যকে স্বীকার করেন না। তিনি গল্প-উপন্যাস লেখাকে মূলত গদ্যলেখা হিসেবেই ভাবেন। যে সময় ও সমাজে তিনি জীবনযাপন করেন, সেই সময়, সমাজ ও সমাজের মানুষকে নিয়ে তাঁর বলার কথাগুলোকেই নিজের মতো সাজিয়ে উপস্থাপন করেন গদ্যে। এছাড়া বেঁচে থাকার রসদ সরবরাহ করে যে-সমাজ, সে-সমাজের একজন ভোক্তা হিসেবে লেখকের যে-ঋণ, লেখার মধ্য দিয়ে সে-ঋণ শোধ দেওয়ার একটি দায়বোধ কাজ করে। তাই লেখাকে তাঁর সাধ্যমতো একটি শ্রেষ্ঠ ‘কাজ’ হিসেবেই মনে করেন। তিনি মনে করেন, ‘লেখকের দায় তাই বড়ো অর্থে মানবজাতির কাছে – সুনির্দিষ্ট অর্থে আপন দেশ ও কালের কাছে। বিকারগ্রস্ত মানব-অস্তিত্বকে ঠিক জায়গায় আনার যে-কর্মযজ্ঞ তাতে অংশ নেওয়াই লেখকের কাজ।’ এক্ষেত্রে লেখক মার্কসবাদী সাহিত্য মূল্যায়নের প্রসঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত। সমসাময়িক সমাজ ও বাস্তবতার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন সাহিত্যের কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। শিল্প-সাহিত্যের নতুন আঙ্গিক নির্মাণ বাস্তবতার নিরিখে নয়, নতুন শিল্প-আঙ্গিক বা পুরনো আঙ্গিককে নবায়নের প্রয়োজনে – প্রকরণবাদীদের এ-ধারণাকেও তিনি অস্বীকার করেন। তাই হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য-বিচারে ‘আধেয়’ ও ‘আধারে’র মধ্যে কোনো একটিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফর্ম বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে না, বিষয় ফর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে – প্রচলিত এ-ধরনের বিতর্কও তাঁর লেখায় অকার্যকর।

আধুনিক শৈলীবাদী লেখকদের অনেকেই নতুন ফর্ম বা টেকনিক ব্যবহার করতে গিয়ে অর্থহীন টেকনিক ব্যবহার করেন। এ-কথা হাসান আজিজুল হকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি শৈলীবাদী লেখক নন। প্রত্যেকটি বিষয়কে নতুন করে বলার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু নতুন ফর্ম বা টেকনিক ব্যবহারে তিনি একান্তই স্বয়ম্ভু। সময়ের পরিবর্তন ও সমাজ রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর সর্বদাই সচেতন ও সতর্কদৃষ্টি। তাই আত্মনির্মাণের পথ তৈরির কাজ কখনোই শেষ হয় না। প্রচলিত সাধারণ নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করে তাঁর ছোটগল্প বিচার করা যায় না। জীবনের যেহেতু পূর্বনির্ধারিত কোনো সংজ্ঞা নেই, তাই জীবন থেকে সংগৃহীত গল্প-উপন্যাসেরও পূর্বনির্ধারিত কোনো সংজ্ঞা তিনি মানেননি। বস্ত্তত জীবন কখনোই কোনো আদর্শ সরলরেখা মেনে চলে না, তেমনি আদর্শ গল্প-উপন্যাস লেখা কখনোই সম্ভব হয় না। বড়ো শিল্পী মাত্রই চেষ্টা করেন জীবনাদর্শের যতটা সম্ভব কাছে পৌঁছার। হাসান আজিজুল হকও সে-চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য নীতি বা আদর্শের কোনো উপদেশ বা যে-কোনো ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘সাহিত্যিক গির্জার ফাদারও নন, স্কুলের হেডমাস্টারও নন, কাজেই নীতিবুলি কপচানোর চাইতে মানুষ যা, সেভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করা প্রয়োজন।’ হাসান আজিজুল হক তাঁর লেখকজীবনে এই রীতিকেই মান্য করে আসছেন।

হাসান আজিজুল হকের শিল্পীসত্তায় বা মনোগঠনে গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বিরোধ নেই। সাধারণত, যাঁরা গল্প-লেখক, তাঁরা উপন্যাস লিখতে গিয়ে পূর্ণশক্তির ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ উপন্যাসে একটি সমগ্র জীবন বা জাতি বা অখন্ড একটি বিষয়ের খুঁটিনাটি ফুটে ওঠে সবিস্তারে। বিপরীতে, ছোটগল্পে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবকিছুই খন্ড ও বিশেষ এবং বিন্দুতে সিন্ধু ফুটে ওঠে রূপক-সাংকেতিকতায়। যে-কারণে কৃতী গল্পকার উপন্যাস লিখলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর উপন্যাসে গল্পেরই স্বাদ জন্মে, আবার কৃতী ঔপন্যাসিকের গল্পে-উপন্যাসেরই স্বাদ সৃষ্টি হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে গল্পকার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির কথা বলা যায়। হেমিংওয়ে বহু সমৃদ্ধ উপন্যাস লিখলেও মূলত গল্পকারই থেকে গেছেন। একইভাবে টমাস হার্ডির অনেক গল্পই উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত অনায়াসে। হার্ডির অনুরূপ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায় বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারাশঙ্করের ছোটগল্পের বিষয় ও নির্মাণ-কৌশলে উপন্যাসেরই কায়া। অনুরূপভাবে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের উপন্যাসেও ছোটগল্পের ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের ক্ষেত্রে এ-ব্যাখ্যা প্রযোজ্য হয় না। তাঁর অনেক গল্পে দুধরনের বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। তাঁর ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘বিধবাদের কথা’ – এ-ধরনের অনেক সৃষ্টিকেই ছোটগল্প ও উপন্যাস দুটি ভাগেই ফেলা যায়। তাঁর ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’ একটি গল্পধর্মী রচনা, কিন্তু গল্প নয়। স্মৃতিকথা দুটি – ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ ও ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ প্রায় উপন্যাস হয়ে উঠেছে। আবার ভাগ করে দেখলে স্মৃতিকথাদুটি কয়েকটি গল্পের সংকলন।

হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির উদ্দেশ্য মানুষের সমগ্র জীবনকে স্পর্শ করা, নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করা, যতটুকু সম্ভব সবকিছুর ওপরে মানুষকে স্থান দেওয়া। নিজের সমৃদ্ধি, সুন্দরভাবে বাঁচা আর অন্যদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলাই তাঁর লেখালেখির একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, একটি ভালো লেখা জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। সাহিত্য মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন করে। জীবনকে, পৃথিবীকে দেখার বা বিচার করার একান্ত নিজস্ব একটি দৃষ্টিকোণ তৈরি করে দিতে পারে; ভালোবাসা-ঘৃণা, গ্রহণ-প্রত্যাখ্যান, শত্রু-মিত্রের পার্থক্য নির্ধারণ করে দিতে পারে; সমাজের ভেতর-বাইরের প্রকৃত ছবি দেখিয়ে পরিবর্তনকে অপরিহার্য করে তুলতে পারে; সর্বোপরি, জীবনের পক্ষে মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাতে পারে। সম্পূর্ণ বিকৃত, নষ্ট, পচনশীল, ভোগ-উন্মত্ত একটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেখানে জান্তবভাবে বাঁচার উন্মাদনায় নেশাগ্রস্ত, সেই সমাজে একমাত্র লেখকই থাকেন নিষ্ঠাবান, স্বার্থহীন, আপসহীন, পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়ানো এক কঠিন ব্যক্তিত্ব।

ক্ষুধা-দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা খাঁটি লেখক হওয়ার জন্যে অনুকূল নয়। লেখককে প্রায়ই সামাজিক দায় কাঁধে তুলে নিতে হয়। সংস্কারের জন্য পথ দেখাতে হয়, ক্রোধ ও অসন্তোষ নিয়ে পথে নেমে আসতে হয়। যেখানে নববইভাগ মানুষই নিপীড়ন, বঞ্চনা আর শোষণের শিকার, আর বিপরীতে মুষ্টিমেয় কিছু লোক সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক, সেখানে হাসান আজিজুল হক পুরো সমাজটাকেই ব্যাধিগ্রস্ত বলে মনে করেন। বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে, ধর্ম-নৈতিকতার বাণী, তত্ত্ব-তথ্য-পরিসংখ্যান বা পরামর্শ প্রচারের চেয়ে মানুষের মুক্তির জন্য কাজটিই মুখ্য। সমাজ ও রাজনীতিসচেতন লেখক হাসান আজিজুল হক নিজের সমস্ত ক্রোধ ও অসন্তোষ একসঙ্গে নিয়ে লিখতে বসেন। লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থান সুনির্দিষ্ট, তাঁর সমস্ত ক্রোধ, অসন্তোষ, দাবি শোষিত মানুষের পক্ষে। তিনি তাঁর ক্রোধকে সামান্যও আড়াল করেননি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো একেবারে মানবিকতাবর্জিত পাষন্ডের মতো মধ্যবিত্তের মানসিকতাকে রক্তাক্ত করেননি হাসান আজিজুল হক। তবে তাঁর আঘাতের মধ্যেও সহানুভূতি বা সমবেদনা প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকে না। এছাড়া আঘাতের নতুন নতুন জায়গা তৈরি হচ্ছে, সেখানে আঘাতের ধরনটিও পালটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের গন্ডি ছোট হয়ে আসছে। মধ্যবিত্তের হাতে সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে উচ্চবিত্ত ও দুর্বৃত্তদের হাতে। এঁরা লেখকের আঘাতের ঊর্ধ্বে। তারাই রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা, বিচার-ক্ষমতা ও  গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী এবং দেশ ও জনগণের ভাগ্যনিয়ন্তা। তাদের কাছে সাহিত্য কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। মধ্যবিত্তের হাতে যেহেতু সমাজ, দেশ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু লেখকের ক্রোধ, আবেগ, দর্শন তাৎপর্যহীন। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ স্থবির হয়ে পড়েছে বলে বড়ো সাহিত্য ও মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির পথও রুদ্ধ হয়ে আসছে।

হাসান আজিজুল হকের মতে মানুষের প্রকৃত জীবনযাপন হারিয়ে গেছে। নিজের বেঁচে থাকা নিজের ইচ্ছার ওপরে নেই, একটা ছকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষকে চিন্তাবর্জিত শরীরসর্বস্ব এক বিশেষ প্রাণীতে রূপান্তর করে ফেলছে। কোনো কিছু ভাবার সুযোগ দিচ্ছে না। যা যা ভেবে বের করার কথা, তার সবই ভেবে রেখেছে, করে দিচ্ছে। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে জ্ঞান-বিজ্ঞান-বিনোদনের সমস্ত দুনিয়ার দরজা খুলে যায়। জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি, চিন্তনজগৎ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে ভোগ ও প্রযুক্তির ওপরে অতিমাত্রায় নির্ভরশীল মানুষ। মানুষের অস্তিত্ব এখন উপহাসতুল্য। তিনি বলেন :

এ রকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য করতেই আমার নিজের উপরে ধিক্কার জন্মে যায়। যদি গোটা বাংলাদেশের দিকে তাকাই, মানুষের দিকে তাকাই – মানুষকে ছোট করতে করতে আমরা কোথায় নিয়ে ফেলেছি? মানুষকেই যদি আমরা কীটানুকীটে পরিণত করি, তাহলে আমি কোন হিমালয়ের চূড়ায় উঠব?… মানুষ মানুষই না, মানুষের অস্তিতবই ঝুলছে! (‘ছড়ানো ছিটানো’)

হাসান আজিজুল হকের কাছে ‘বাস্তববাদী লেখক’, ‘জীবনবাদী লেখক’ অভিধাগুলো মূল্যহীন। কারণ, মানুষ মাত্রই বাস্তববাদী। লেখক ইচ্ছা করলেও অবাস্তববাদী হতে পারেন না, কারণ অভিজ্ঞতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাঁর নিজের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। শিল্প-সাহিত্য মাত্রই বাস্তব, না হয় প্রতিবাস্তব অবলম্বন করে নির্মিত। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বহির্বাস্তব ও অন্তর্বাস্তব বলে পরস্পর-সম্পর্কিত দুটি জগৎ আছে। দ্বিতীয় বাস্তব বা অন্তর্বাস্তবকে হাসান আজিজুল হক ‘লেখকের মনোজগৎ’ বা ‘লেখকের ভিতরের খুব অন্ধকার গোপন একটি প্রকোষ্ঠ’ বলে চিহ্নিত করেন। এই অন্ধকার কক্ষেই গচ্ছিত হয়ে আছে তাঁর নিজের ও পরিবারের অভিজ্ঞতা, সামাজিক অনেক কষ্ট, ক্ষোভ, ক্রোধ, দেশত্যাগের যন্ত্রণা ইত্যাদি। বাইরে থেকে সামান্য কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই অন্ধকার ঘরেই লেখকের নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন হয়। তাই শিল্পের জমিন বা আকাশ লেখকের ভেতর-বাইরের জগৎ জুড়ে বিস্তৃত। কিন্তু বাস্তবকে আশ্রয় করে হাসান আজিজুল হক কোনো মোহ সৃষ্টি করেননি। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার অনুবাদ করেন মাত্র। তাঁর অভিজ্ঞতার একটি জাল তৈরি হয়েছে, লিখতে বসে সেই জালেই জড়িয়ে-প্যাঁচিয়ে যান কেবল। অভিজ্ঞতার এই জাল বাস্তব বা প্রতিবাস্তব দুই-ই হতে পারে।

হাসান আজিজুল হকের জীবনযাপনের ভূগোল বিচিত্র। তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতার ভান্ডার অতিমাত্রায় সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে, যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবনে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা ও পরিণত বয়স থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীতে আছেন। একটি বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং উত্তরকালের চার দশকের বাংলাদেশের উত্থান-পতন ইত্যাদি ইতিহাসের বিস্তৃত পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখতে বসেন। নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন না। প্রথম গল্প ‘শকুন’ থেকেই লেখালেখির এই সহজ পথ ধরে এগোচ্ছেন।

হাসান আজিজুল হক কখনো আপন কাল, দেশ, সমাজ ও মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে অবক্ষয়িত কোনো দর্শন, বিদেশ থেকে আমদানি করা আত্মবোধশূন্য সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। আমাদের দেশ ও ঐতিহ্যের জন্য ভিত্তিহীন কোনো ‘ইজম’ বা সংজ্ঞা গ্রহণ করেননি। যা ঘটেনি বা ঘটার সম্ভাবনা নেই সেসব নিয়ে না লিখে আমাদের দেশ ও সমাজ যেমন আছে এবং যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেদিকটাই স্পষ্ট করেন তিনি। লেখকের প্রতিভা, চিন্তা, দায়-দায়িত্ব সমস্ত কিছুর সঙ্গে তাঁর দেশ, সমাজ ও মানুষের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। লেখক চেষ্টা করলেও এই সম্পর্ককে আড়াল করতে পারেন না। এই ঐতিহাসিক সম্পর্কই লেখকের চিন্তার জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। যাঁরা সাহিত্যকে বিশুদ্ধ শিল্পের আসনে বসিয়ে জনবিচ্ছিন্ন রাখেন, আনন্দ-বিনোদন বা গাল-গপ্পো-ফুর্তির বিষয় মনে করেন এবং ভাবেন, বাস্তব জীবনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক – হাসান আজিজুল হকের অবস্থান তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে ‘লেখকরা দেশবাসীর ভাড়াটে ভাঁড় নন যে, পাঠকদের শুধু আমোদ বিক্রি করবেন?’

হাসান আজিজুল হক সাহিত্যের ব্যবহারিক মূল্যের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেন অধিক। তাঁর কাছে, সাহিত্য প্রেরণানির্ভর নয়, প্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক কোনো বিষয় নয়, বাস্তব প্রয়োজননির্ভর। সমাজ-বিন্যাসের ওপরে সাহিত্যের ব্যবহারিক মূল্য নিহিত। বর্বর, অসভ্য বা ভয়াবহ সংকটে নিপতিত সমাজে সাহিত্যের ভূমিকা নিষ্প্রভ। হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘সংকট কাটিয়ে ওঠায় কোনো সাহায্য পাওয়া না গেলে সংকটের সময় সাহিত্যের মুখ চেয়ে থাকতে আমিও নারাজ।’ তাঁর মতে, সাহিত্য শতভাগ নিরপেক্ষ হতে পারে না। কারণ, সমাজের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক একমাত্রিক নয়। লেখকের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, রুচি-অরুচি যেমন তাঁর লেখায় থাকবে, তেমনি সমাজও দাবি খাটাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখক সাহিত্যে মার্কসবাদের প্রয়োগকে সমর্থন করেন। কারণ মার্কসবাদ নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সমাজ-বিপ্লবের বাস্তবভিত্তিক ও কর্মভিত্তিক নির্দেশনা। তথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী বা সমাজবিপ্লবী সাহিত্যিকের মতো তিনি তাঁর লেখায় ম্যাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলার বিপক্ষে। তিনি বরং ধীর-শান্তভাবে লক্ষ্যটাকে স্থির করেন, লড়াইয়ের ক্ষেত্র ও ধরনটিকে নির্দিষ্ট করেন, তারপর লড়াইয়ে নামেন। তাঁর কাছে প্রতিষ্ঠান শত্রু নয়, বিবেচ্যও নয়। তাঁর কাছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর একটা কিছু। বরং প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে তিনি বঞ্চিত মধ্যবিত্তের ঘ্যানঘ্যানি বা অভিযোগ বলে মনে করেন। তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রের লক্ষ্য নির্দিষ্ট, আঘাতের জায়গা নির্দিষ্ট, তারা লক্ষ্যে পৌঁছে অব্যর্থ আঘাত হানতে সমর্থ। এক্ষেত্রে, মার্কসবাদ লেখককে সহায়তা করে।

হাসান আজিজুল হকের মনোলোকে নির্মিতব্য গল্পটির বিষয় আকারহীনভাবে আবছা ছায়ার মতো ঘোরে। হঠাৎ কোনো একটি শব্দ বা একটি বাক্য বা একটি দৃশ্যকল্প আকারহীন বিষয় আকারের ভ্রূণে রূপান্তরিত হয়। ধীরে ধীরে একটি গল্পের কাঠামো তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনায় আকারহীন যে-বিষয়টি ছিল, বাস্তবের গল্পে তা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে নতুন একটি বিষয় চলে আসে। তবে লেখাটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্দিষ্ট না হলে এবং নিজের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ আয়ত্তে না হলে তিনি কখনো লিখতে বসেন না।

লেখক হিসেবে হাসান আজিজুল হক তাঁর নিজের একটি উপনিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন। উপনিবেশের চরিত্রদের অভিজ্ঞতা, জীবন-বিন্যাস, জীবনবীক্ষা, ভাষা, চলাফেরা মিলিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভুবনের স্রষ্টা হাসান আজিজুল হক। তাঁর রচনারীতি একান্তই তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে উঠেছে। তাঁর বয়ান-কৌশল ও শব্দ-প্রয়োগের কৌশল নিজস্ব ব্যাকরণ মেনে চলে। তাঁর সাহিত্যপাঠাংশ (text) বিচারে আকারবাদী (formalist) বা কাঠামোবাদী (structuralist) কোনো চিন্তা ফলপ্রসূ হয় না। কারণ প্রতিটি লেখাই নতুন ও সার্বভৌম অভিজ্ঞতাজাত। একই অভিজ্ঞতার একাধিক অনুবাদ হয়নি কোথাও। সমাজ ও জীবনের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাকে আরো জীবন্ত ও বাস্তব করতে নির্মাণ-কৌশলের নব নব নিরীক্ষা তাঁর শিল্পীসত্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পরিশীলন ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বাংলা ছোটগল্পের আঙ্গিককে এমন একটি রূপ দিয়েছেন যে, মানুষ ও সমাজের প্রায় সমস্ত অনুষঙ্গ, অসঙ্গতি ও অসমাপ্তকে ধারণ করতে সমর্থ। এই আঙ্গিকের অতিসংক্ষিপ্ত অবয়বে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের মতো মহাকাব্যিক ঘটনাবিন্যাসকে মহাকাব্যিক মাহাত্ম্য ও ব্যঞ্জনা নিয়েই উপস্থাপনে সমর্থ। তেমনি এই আঙ্গিকেই তাঁর গল্প উপন্যাসের মতো বহুস্বরিক (polyphony) হতে পারে। যেভাবে গল্পের বিষয়বিন্যাসে বহুস্বরসঙ্গতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন, ঠিক একইভাবে কাজে লাগিয়েছেন উপন্যাসে। উপন্যাসের জন্য আলাদা স্বর আবিষ্কার করতে হয়নি। লেখার কাজটিই মুখ্য, পাত্র নিতান্ত প্রয়োজনের বলে গ্রহণীয়। হাসান আজিজুল হকের অসাধারণ নৈপুণ্যগুণে গল্প ও উপন্যাসদুটির নির্মাণ-কৌশল মিলিয়ে অভিন্ন একটি নির্মাণ-কৌশল এবং একটি নিজস্ব জীবন-বোধি তৈরি হয়।