হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বx ও শওকত ওসমানের এস্রাজের ছড়

বুলবন ওসমান

 

পৃথিবী কখনো হিংসামুক্ত ছিল এমনটা বলা যাবে না। তবে এর পরিমাণের তারতম্য আছে বা ছিল। প্রাণী মাত্রের বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত খাদ্য। প্রাণ সৃষ্টির আগে গ্রহে তৈরি হয়েছে খাদ্য-উপকরণের সম্ভার। জন্মের পর খাদ্যাভাব হলে প্রজাতির বিলুপ্তি। প্রাণীভেদে খাদ্য গ্রহণের অমত্মর্বর্তীকালের আছে তারতম্য। সদ্যোজাত শিশু ও বয়স্ক মানুষের খাদ্য গ্রহণের সময়ের ভিন্নতা সহজেই নজরে পড়ে। হিংসার প্রাথমিক ধাপ এই খাদ্য পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে। পরবর্তীকালে বিবর্তনের ধারায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানসম্মান, গৌরব ও শ্রেণিকেন্দ্রিক হিংসার উন্মেষ। এই সত্তর-পঁচাত্তর বছরের জীবনে যে-অভিজ্ঞতা হলো তার আলোকে দেখতে পাই গত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যমত্ম রাজনৈতিক হানাহানি বাদে মানুষের মধ্যে হিংসার প্রকাশ ছিল অনেক কম। খুন ছিল বিরল ঘটনা। সেই সামমত্ম ও ঔপনিবেশিক সময়ে এ-দেশে সম্পদ ছিল সীমিত। সিংহভাগের বাঁচার মৌলিক উপাদানের  পর্যাপ্ততা ছিল না। তারপরও ছিল অসম্ভব সহ্যগুণ। মানুষের মধ্যে মায়া, মমতা, ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এই দারিদ্র্যপীড়িত দেশেই জন্মেছেন রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরম্নল, সুভাষচন্দ্র, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, সত্যেন, জগদীশ, প্রফুলস্ন প্রমুখ মানবিক ও বিজ্ঞানের দিকপাল। আধ্যাত্মিক জগতে গৌরাঙ্গ, রামকৃষ্ণ, নরেন ও অনুকূল ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্ব। এঁদের দীপ্তিতে বাংলায় ভাস্বর হয়েছেন কত সহস্র মানুষ। জীবনের সব ক্ষেত্রে। এঁদেরই আলোয় স্নাত শেখ আজিজুর রহমান ওরফে সাহিত্যিক শওকত ওসমানকে দেখতে পাই। বাংলায় তাঁর সাহিত্য ও চিমত্মাক্ষেত্রে দুজন মানুষ ছিলেন আদর্শ : এক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিতীয়জন কাজী নজরম্নল ইসলাম। তিনি প্রায়ই বলতেন : আমার আছেন এক ঠাকুর – তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর দ্বিতীয়জনের কথা অমন সোচ্চারভাবে বলতেন না, কিন্তু চিমত্মা ও কর্মে তা প্রকাশ পেত। তিনি অবশ্য নজরম্নলের একটা সমালোচনা প্রায়ই করতেন। বলতেন : দারিদ্র্য শুধু নজরম্নলকেই মহান করেছে। যেহেতু দারিদ্র্য সারা জীবন শওকত ওসমানের পিছু ছাড়েনি, তাই হয়তো এই উচ্চারণ। আজকে আমরা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে এই কথার সত্যতা পাই। হতদরিদ্র অবস্থা থেকে যাঁরা অনেক বড় হয়েছেন, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট কম। দারিদ্র্য সবকিছুতে একটা সীমারেখা টেনে দেয়। সম্রাট শাহজাহানের পক্ষেই কেবল তাজমহল বানানো সম্ভব। কলুটোলার  কোনো  ব্যবসাদারের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি দরজায় কড়া নাড়ছে। বাবা শওকত ওসমানের জন্মশতবার্ষিকী। হুগলির আরামবাগ মহকুমার খানাকুল থানার সবলসিংহপুর গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯১৭-র ২ জানুয়ারি। দাদা শেখ মহম্মদ এহিয়া – দাদি গুলেজান বেগম। দম্পতির প্রথম পুত্রসমত্মান। ওপরে ছিল এক বোন আনোয়ারা। বড়বোনের ইচ্ছা ছিল ভাইয়ের নাম রাখা হোক শওকত আলী, কিন্তু মা-বাবার পছন্দ আজিজুর রহমান। খাতাপত্রে তাই হলো। কিন্তু ছাপিয়ে গেল শওকত ওসমান। শেখ আজিজুর রহমান সাহিত্যচর্চা শুরম্ন করেন কবিতা দিয়ে। লিখতে শুরম্ন করে দেখেন আজিজুর রহমান নামে আর এক কবি আছেন। তাই নাম বদল। তখন তাঁর মনে পড়ে অকালপ্রয়াত বড়বোনের কথা। তাঁর ইচ্ছাকে রদবদল করে নাম গ্রহণ শওকত ওসমান। স্থায়ী হয়ে গেল এই নাম। চাপা পড়ে গেলে শেখ আজিজুর রহমান। আজ এই নামে তাঁকে কেউ চিনবে না।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শওকত ওসমান অপশন দিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে যোগ দেন। পুরো পরিবার থাকে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৫০ সালে দুই বাংলায় আবার বড় ধরনের দাঙ্গা বাধলে আমরা চট্টগ্রামে স্থানামত্মরিত হই। এই সময় থেকে তাঁর সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে থাকি। পশ্চিমবঙ্গে বাবার সঙ্গে একটানা থাকার সুযোগ তেমন করে হয়নি। কখনো তিনি থেকেছেন কলকাতায়, আমরা গ্রামে। আবার অল্প কিছুদিনের জন্য কলকাতা বা হাওড়া শহরে অবস্থান করেছি। ওই সময়টুকুর স্মৃতি তাই খুব বেশি নেই। সবই আবছা, খাপছাড়া।

আমরা তখন হাওড়া শহরে হার্ডফোর্ট লেনে থাকি, একবার বাবা কলকাতায় আমাকে সঙ্গে করে একটি বাজনার দোকানে ঢুকলেন। এস্রাজ দেখতে বললেন। বিক্রেতা ভদ্রলোক মাঝবয়সী। এক-একটা এস্রাজ আনেন আর বাজিয়ে দেখান। এরকম অদল-বদল করতে-করতে বাবা একটি অস্রাজ কিনলেন। কিনলেন একটা রজনের ছোট বাক্স। রজন দেখতে অনেকটা গ্রামে দেখা বাবলা-আঠার মতো। চৌকো করে কাটা। আলো পড়ে ঝকঝক করছে। আমি বাবার কাছে জানতে চাই এটা দিয়ে কী হবে।

তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এই যে ছড়টা দেখছ, এটা ঘোড়ার লেজের লোম দিয়ে তৈরি। এই আঠার ওপর ঘষে না নিলে ছড়টা সিস্নপ কাটবে। তারে ঘষতে গেলে ঘর্ষণ হবে না। তাই মাঝে-মাঝেই ছড়কে এই রজনের ওপর ঘষে নিতে হয়। ইংরেজিতে বলে রেজিন। ধুনো বা লোবানের মতোই এটা। শুধু আরো পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।

বাবার সেই এস্রাজটা পশ্চিমবঙ্গে তাঁকে বাজাতে দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। এবং এও মনে পড়ে না, ওটা কোথায় ছিল। শুধু ১৯৫০-৫১-র দিকের ঘটনা এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। চট্টগ্রামে আমাদের আবাসিক ভবনটির নাম ছিল রাধিকা ভবন, ঠিকানা : ৩৪ বি, চন্দনপুরা। বাড়িটা নওয়াব সিরাজুদ্দৌলা রোড থেকে সামান্য ভেতরে। দোতলা বাড়িটি এল প্যাটার্নের। বারান্দার কিছু অংশ পশ্চিম, কিছু দক্ষিণমুখী। দক্ষিণমুখী বারান্দার শেষ প্রামেত্ম পাটি বিছিয়ে বাবা আমাদের নিয়ে বসতেন। অন্যরা ছোট, তাই আমি বেশি ডাক পেতাম। রবীন্দ্রভক্ত বাবা প্রকাশিত প্রায় সব স্বরবিতান কিনেছেন। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী…’ গানটি স্থান পায় ৩ নং স্বরবিতানে। কবি গানটি লেখেন ৬৫ বছর বয়সে, বঙ্গাব্দ ১৩৩৩-এ – ফাল্গুন মাসে, ইংরেজি সাল ১৯২৭। বাবার বয়স তখন ১০-১১ বছর। গ্রামে, মাদ্রাসার পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তিনি যখন সমত্মানকে গানটি শেখাচ্ছেন তাঁর বয়স ৩০-৩১। আর পুত্রের বয়স ১০-১১। সংগীতে পিতা-পুত্র কারোরই কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। কিন্তু কলকাতায় শওকত ওসমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সলিল চৌধুরী, কলিম শরাফী প্রমুখ সংগীতশিল্পী। হেমমত্ম মুখার্জিও ছিলেন বাবার কাছের মানুষ। আইপিটিতে এঁদের সবাইকে একত্র করা হয়েছিল।

আগেই বলেছি শওকত ওসমানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত-শিক্ষা ছিল না এবং জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে আসা নিজ পুত্র-কন্যাগণের জন্যও রীতিনির্ভর সংগীত-শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে পারেননি। সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে আমার কণ্ঠ ছিল একরকম। আমার চেয়ে সুরেলা গলা ছিল সেজভাই ইয়াফেস ওসমানের। ইয়াফেস স্থপতি, বিগত আট বছর বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত। শৈশবে ওঁর কণ্ঠে বাবা সকালে প্রায়ই শুনতে চাইতেন রজনীকামেত্মর : তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে – গানটি।

আমার দুই বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শারমিন চট্টগ্রামে জন্ম এবং অতি অল্প বয়সে প্রয়াত হয়। ও চলে যাওয়ায় বোন লাইলী (আনফিসা) ছিল সবার আদরের, আর ওর কণ্ঠটি ছিল সংগীতোপযোগী। কিন্তু পারিবারিকভাবে আমরা ওকে সুযোগ করে দিতে পারিনি। এই ব্যাপারটি আমার মনে এখনো দুঃখ জাগায়। তবে আরো বড় মর্মবেদনার কারণ হলো, ২০১৪ সালের ৩ জুলাই ৬৫ বছর বয়সে লাইলী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না-ফেরার দেশে। টরন্টোতেই ওকে সমাহিত করা হয়।

 

বরিষ ধরা-মাঝে শামিত্মর বারি …

ওর গাওয়া এই রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করা আছে। গানটি শুনি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।

তো ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’র কথায় আসা যাক। এই গানটি লেখা হয় নটীর পূজা নাটকের জন্য। অর্থাৎ এটি নাটকের গান। গীতবিতানের তৃতীয় খ– জায়গা পায় – প্রকাশকাল ১৩৩৯ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৪২। কবি তখন প্রয়াত। পৃথিবী তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে লিপ্ত। দুটি মহাযুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে ঘটিত। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যেই দেহ রাখছেন। সভ্যতার সংকট তিনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু এর উত্তরণের চাবিকাঠি তাঁর হাতে ছিল না। যাদের হাতে ছিল তারা তো এর অন্বেষণ করে না… তাদের লোভ-লালসা এসবের মৌল কারণ।

ক্রন্দনময় নিখিলহৃদয় তাপদহনদীপ্ত,

বিষয়-বিষ-বিকার-জীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।

এই গানের উপরোক্ত দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটির চারটি শব্দ হাইফেন দ্বারা যুক্ত। এই কঠিন ভাব জন্মভূমির গ্রাম থেকে সদ্য উৎপাটিত দশ-এগারো বছরের এক বালক কী বুঝেছিল? তার ক্ষমতাই বা কী? শওকত ওসমান এই গানটি তার জ্যেষ্ঠপুত্রকে শেখানোর চেষ্টাই বা করেছিলেন কেন? যখন ভাবি অবাক হয়ে যাই। আর যাই হোক পুত্রকে তিনি মূর্খ মনে করেননি – বড় হলে জানবে… এই আপ্তবাক্যও উচ্চারণ করেননি। সহজ মর্যাদা দিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন পিতা ও শিক্ষকের ভূমিকা।

শামত্ম হে, মুক্ত হে, হে, অনমত্মপুণ্য

করম্নণাঘন ধরণীতল করো কলঙ্কশূন্য\

গানের এই চরণদুটি তিনি যখন স্বরলিপির দিকে চোখ রেখে থেমে-থেমে গাইতেন, দেখতাম চোখ-মুখে একের পর এক ভাব খেলা করছে। এস্রাজটা তাঁর ভালো রপ্ত হয়েছিল, না হয় স্বরলিপি দেখে গান তোলা অত সহজসাধ্য নয়।

রবীন্দ্রনাথ মানবিক ডাকে সাড়া দেন পূর্ববঙ্গে জমিদারি পরিদর্শন করতে এসে। দেবেন্দ্রনাথের বার্ধক্য তাঁকে ঠেলে দেয় আসমানদারি জীবন থেকে জমিনদারিতে। আর তাঁর জীবনের পূর্ণতা আসে এই ভূমিকা গ্রহণে। তিনি ব্রাহ্ম-ধর্মের সদস্য হলেও ক্রমশ মানবধর্মে রূপামত্মরিত হয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের তিনি সমানভাবে ভালোবাসতেন। বরং মুসলিমদের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব, সমাজে তাদের নিচুসত্মরে থাকার কারণে, নিচু দৃষ্টিতে দেখার কারণে।

নটীর পূজার এই গানটি তো প্রার্থনা-সংগীত। করম্নণা মাঙ্গা হচ্ছে অনমত্মপুণ্যের কাছে। কে এই অনমত্মপুণ্য? একই আকুতি দেখি লালন ফকিরের কণ্ঠে :

আমি অপার হয়ে বসে আছি

ওহে দয়াময় –

পারে লয়ে যাও আমায়।

কে এই দয়াময়?

ভাববাদী এই চিমত্মা তো আমাদের একটা আশ্রয়দান করে। কিন্তু যখন উপনিষদে মুনি-ঋষিদের চিমত্মা-ক্ষেত্রে অবগাহন করি, তখন সেই আশ্রয়চ্যুত হই। উপনিষদে এই পরমাত্মার চরিত্র যে ভিন্ন রূপ! তিনি যে নির্গুণ, নিরাকার, নির্বিকার। তাহলে কোথায় দাঁড়াব আমরা? কার কাছে প্রার্থনার হাত তুলব?

প্রথম জীবনে বাবার মধ্যেও এই দ্বৈতচরিত্র লক্ষ করেছি। মার্কসবাদে দীক্ষিত মানুষ যখন অনমত্মপুণ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন তখন দ্বৈতচরিত্রটি ফুটে ওঠে। তবে কি বাবার মধ্যে একজন বাউল অমত্মর্লীন ছিল? হয়তো ছিল। সারাজীবন তাঁকে স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে ধাবিত হতে দেখিনি। গাড়ি চড়তে খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু গাড়ি কেনার চেষ্টা করেননি। প্রথম জীবনে ছিলেন শৌখিন, পরবর্তীকালে অতি সরল জীবনযাপন।

হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী…

ভৈরবী রাগে বাঁধা গানটি সকালে গীত হবার কথা। কিন্তু সারাদিন কলেজের কাজ সেরে এসে তিনি সন্ধ্যায় বসতেন – এস্রাজ নিয়ে। সন্ধ্যারাতটা ভৈরবীর উদার-মন্ত্রে করম্নণাঘন হয়ে উঠত। কলঙ্কশূন্য পৃথ্বী গড়ার আহবান প্রমাণ করে, ইহলোক রম্নদ্ররসে পস্নাবিত। বৈশেষিক দর্শনে তো বলাই হয়েছে : অবিদ্যমানতা বার্তা দান করে বিদ্যামানতা যেমন, আকাশে তারা নেই, মানে তা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, কিন্তু আছে। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’র কথা –

নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী

করো ত্রাণ মহাপ্রাণ, আনো অমৃত বাণী,

বিকশিত করো প্রেমপদ্ম চিরমধু নিষ্যন্দ।

এখানে তব-টি কে? যার নূতন জন্ম চাচ্ছে সব প্রাণী? এটি পৃথ্বী। ত্রাণ চাওয়া হচ্ছে – মহাপ্রাণের কাছে। মহাপ্রাণ কে? সব প্রাণের আধার যিনি। আনবেন অমৃত বাণী। বিকশিত করবেন প্রেমপদ্ম। দানবীরকে ত্যাগের কঠিন দীক্ষা নিতে হবে। মহাভিক্ষু ভিক্ষা নেবেন সবার অহঙ্কার। শেষ ভুলে মানুষের মধ্যে জ্ঞান-সূর্যের উদয় হোক। সকল ভুবনে প্রাণ সঞ্চারিত হোক এবং অন্ধ লাভ করম্নক দৃষ্টি।

এসবই প্রার্থনার উপাদান। ৬৫ বছর বয়সেও রবি কবি-প্রার্থনার এই সূত্রটি থেকে মুক্ত হননি। যদিও ধরতে পেরেছেন ‘ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভজটিল বন্ধ’। শেষ জীবনের লেখায় এই সুরটি প্রধান হয়ে ওঠে সভ্যতা যে গ্রাস হয়ে যাচ্ছে খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসের পর নতুন সৃষ্টি পুনরায় গ্রাসিত হচ্ছে –

সমগ্র জগৎ জুড়ে লাভ-লোভ-লালসার প্রবল স্রোতে তাঁর প্রার্থনা যে জায়গামতো পৌঁছায়নি সেটা আমরা বুঝতে পারছি। প্রকৃতিতে পাশবশক্তি এত প্রবল যে, শুভবোধ বা ধর্মবোধ তৃতীয় লিঙ্গের ভূমিকায় পর্যবসিত। ইতিহাসের কোনো-কোনো সন্ধিক্ষণে পুণ্য জয়লাভ করেছে যেন পুনরায় পরাজিত হওয়ার  জন্য।

সোভিয়েত ইউনিয়ন দুনিয়ায় আলো জ্বেলেছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে এসে সে-প্রদীপ গেল নিভে। এলো িআঁধারের রাজত্ব। সাম্রাজ্যবাদ নামক ডায়নোসরটি লেজের আঘাতে সাজানো শহর, সাজানো দেশ, সাজানো জনপদ ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। সভ্যতা আজ অভিবাসী। দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষা চাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভক্ত শওকত ওসমানকে বর্তমান অবস্থাটি দেখে যেতে হয়নি। শওকত ওসমান সোভিয়েতের পতন দেখেছেন। অভিঘাতটি দেখার সময় পাননি। ১৯৯৮-এর ১৪ মে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমান বিশ্ব কবির কাব্য-চরণ অনুযায়ী ‘দেশ দেশ পরিল তিলক, রক্তকলুষ গস্নানি,’… কবির প্রার্থনা/ তব মঙ্গল শঙ্খ আনো, তব দক্ষিণ পাণি,/ তব শুভ সংগীত রসে তব সুন্দর ছন্দ।’ যে অদৃশ্য শুভশক্তির কাছে প্রার্থনা তিনি যদি নির্বিকার হন? পৃথিবীর সমসত্ম ধর্মপুসত্মক যে তাহলে অর্থশূন্য হয়ে পড়ে! মুনি-ঋষি ও বড় দার্শনিকদের কাছে এ এক বড় ধরনের সমস্যা। আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ পড়ি আরো জটিলতায়। আরো ধন্ধে। মহাবিশ্ব এক রহস্যাবৃত অস্তিত্ব। কে এর জট খুলতে পারবে? রিচার্ড ডকিন্স বা স্টিফেন হকিং হালে কি পানি পাবেন?

রবীন্দ্রনাথ জাগতিক বিষয় নিয়ে যে-চিমত্মা করেছেন বাসত্মবে তার রূপ দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছেন ষোলোআনা। প্রায়োগিক দিকটিতে তিনি ছিলেন সদা-নিয়োজিত। এর মধ্যে তাঁর শিক্ষা-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান প্রথম সারিতে। এরপর গ্রামোন্নয়ন ও সমবায়-কৃষি ব্যাংক-ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধকল্পে তিনি যেভাবে নিয়োজিত হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে রাজনীতিতে সেভাবে ছিলেন না। কবি জনগণের জাগতিক চাহিদা মেটানোর জন্য নিজ পুত্রকে কৃষিবিদ্যা লাভের জন্য পাঠাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এই বিদ্যাপাঠের ব্যাপারে রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানি না। শওকত ওসমান সে-ক্ষেত্রে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে প্রায় ইচ্ছাপূরণ করতে দিয়েছেন। শুধু একটু বাঁক নিতে বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইচ্ছা ছিল পড়ব দর্শন – বাবা বললেন সমাজদর্শন বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়তে। তাঁর নির্দেশটি আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে। তিনি অর্থনীতিতে অনার্স পড়তে গিয়ে আর্থিক কারণে চলমান রাখতে পারেননি। পরে এমএ বাংলায় করেছেন। তাই সমাজদর্শন বা সমাজতত্ত্বের গুরম্নত্বটি তিনি ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন। সমাজতত্ত্ব বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠেছে। জীব-বিবর্তন থেকে শুরম্ন করে জেনেটিক্স সবই আছে পটভূমিতে। নৃতত্ত্বের ঘাটটি এর অমত্মর্ভুক্ত হওয়ায় মানবজীবনের সবকিছুই পড়ে এর আওতায়। ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান, মনসত্মত্ত্ব এর প্রধান কা-। যার ওপর এর অধিষ্ঠান।

১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেন : হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী…’ এই ২০১৬ সালেও তার পটভূমির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরই মধ্যে শওকত ওসমান শুদ্ধ-সংগীতের চর্চা করে গেছেন। আর রিলে রেসের দ-টি ধরিয়ে দিয়েছেন সমত্মানদের।

শুদ্ধ-সংগীতের নানান গঁৎ লেখা বাবার একটা খাতা ছিল। সাধারণ মার্বেল পেপারের কভার। নীল পটভূমিতে সাদা ফুটকি। তখন যে এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া যেত সেই ক্রাউন মাপের। পৃষ্ঠা খুবজোর ৪৮ বা ৫০। রম্নল টানা না সাদা ঠিক মনে করতে পারছি না। এতে রবীন্দ্রসংগীত থেকে শুরম্ন করে বাবার নিজের লেখা গান ও বিভিন্ন রাগ-সংগীতের গঁৎ ছিল। এমনকি ছিল কাফি রাগের লক্ষণগীতও। একমনে এস্রাজে হয়তো রাগ ঝিঁঝিট বাজাচ্ছেন – একহারা চেহারায় ঝাঁকড়াচুলো বাবাকে… মনে হতো যেন পিনাক-পাণি। তার টঙ্কার কানে রণন তুলত। অচেনা এক জগতে প্রবেশ করতাম। এর আগে তো সংগীতে কোনো তালিম হয়নি। এটি আমার কাছে তখন এক অচেনা জগৎ। শিক্ষক হলেন বাবা। শিহরণ ছিল, শঙ্কা ছিল না। ছিল অপার বিস্ময়।

কয়েকটি রাগ বাবার খুব প্রিয় ছিল : জৌনপুরি, পিলু, ভৈরবী, জয়জয়মত্মী, ঝিঁঝিট, মেঘ বাগেশ্রী, রাগেশ্রী, কাফি ইমন প্রভৃতি। তাঁর প্রায় নাটকে গান আছে। প্রথম জীবনে কবিতা দিয়ে শুরম্ন করা সাহিত্যক্ষেত্রে খুব সাহায্য করেছে, গানে নিজে সুর দেননি। কোনো ওস্তাদকে দিয়ে সুর করিয়েছেন। চট্টগ্রামে ওস্তাদ বিধুভূষণবাবু তাঁর কাঁকর মণি নাটকের গানে সুর দিয়েছিলেন। মনে পড়ে একটি গান ছিল জয়জয়মত্মী রাগে।

রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর একটা বিশেষ প্যাটার্ন তৈরি করেছিল। কিছুটা বাঁয়ে ঝুঁকে অক্ষরগুলো ছিল লম্বাটে। নজরম্নলের লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে নজরম্নলের লেখা ছিল সিধে। বাবা প্রথম থেকে তীক্ষন কলমে লিখতেন, বিশেষ করে সেফার্স কলমে… তাঁর হস্তাক্ষর ছিল সিধে এবং কিছুটা গোলাকৃতির। ছিল খুবই শিল্পসমৃদ্ধ। নানা রকম স্বাক্ষর করতেন। তির্যক ও আনুভূমিক। অক্ষরের রেখা ছিল বলিষ্ঠ অঙ্কননির্ভর।

বাবার সংগীতের খাতাটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট হওয়া ঘরের নানা দ্রব্যের মধ্যে একটি। খাতায় লেখা একটি সত্মবক এখনো মনে আছে, রবীন্দ্রগানের প্যারোডি।

‘পার হবো কি নাই হবো কে তার খবর রাখে

স্মরণ রাখি কেবল প্রচেষ্টাকে…’ রবীন্দ্রনাথের

… দূরের হাওয়া ডাক দিয়ে যায়,

সুরের পাগলাকে’… অনুসরণে।

দেশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্মরণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান হয়েছে – যেমন : শিল্পী জয়নুল আবেদিন-স্মৃতি রক্ষার্থে ময়মনসিংহে জয়নুল গ্যালারি। গ্যালারি স্থাপন করা হয়েছে নড়াইলে সুলতান-স্মৃতি রক্ষার্থে। কাজী নজরম্নল ইসলামকে নিয়ে ঢাকা ও ত্রিশালে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বেগম রোকেয়া আগেই জায়গা পেয়েছেন রংপুরে। দেরিতে হলেও শুভবুদ্ধি জাগ্রত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান হতে চলেছে। কিন্তু শতবর্ষ এসে গেলেও শওকত ওসমানকে নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ এখনো দেখছি না। যদিও সমাজ-পরিচালকদের কেউ-কেউ জীবৎকালেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবাসে নিজের নামফলক লাগানোর অনুমতি দিয়েছেন।

বাবার শতবর্ষের দিন যত এগিয়ে আসছে চোখের সামনে একটা দৃশ্য বারবার ভাসছে, চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার ‘রাধিকা ভবন’ নামে বাড়িটির দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী বারান্দায় মাদুর পেতে স্বরবিতানে চোখ রেখে এস্রাজে ছড় চালাচ্ছেন নবীন চেহারার এক মানুষের অবয়ব – তাঁর সামনে বসা বালকপুত্র যে বাবার নিচুস্বরে গাওয়া গানটি অনুকরণ করে তোলার চেষ্টা করছে… রবীন্দ্রসংগীতটি হলো :

হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;

ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ\

…       …      …

শামত্ম হে, মুক্ত হে, হে অনমত্মপুণ্য,

করম্নণাঘন, ধরণীতল কর’ কলঙ্কশূন্য।

শওকত ওসমানের সংগীতবিষয়ক ক্ষমতাটি আজো আমার কাছে এক রহস্য।