হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রনাথ

কুলদা রায়
এম এম আর জালাল

বঙ্গবঙ্গ-আইন বাতিল
ব্রিটিশের রাজা হিসেবে পঞ্চম জর্জের অভিষেক হয় ১৯১২ সালের ২২ জুন। এর আগে রানী মেরিসহ তিনি ভারত ভ্রমণে আসবেন – এ-খবরটা প্রকাশিত হওয়ায় বঙ্গে একটা ভাবের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। জানা গিয়েছিল, তিনি এসে বঙ্গভঙ্গ আইন বাতিলের ঘোষণাটি দেবেন।
৯ নভেম্বর ভারতের উদ্দেশে পঞ্চম জর্জ ইংলন্ড থেকে রওনা হন। ৭ ডিসেম্বর রাজকীয় শোভাযাত্রা সহকারে তিনি দিল্লির দরবারে পৌঁছান। ১২ ডিসেম্বর তিনি দিল্লির দরবারে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তার মধ্যে প্রধান তিনটি ঘোষণা হলো –
১) পূর্বতন বাংলা ও পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ থেকে যথাক্রমে বিহার ও আসামকে বিচ্ছিন্ন করে অখন্ড বাংলাপ্রদেশ গঠিত হবে।
২) বাংলা প্রদেশ প্রেসিডেন্সি স্তরে উন্নীত করে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের স্থানে গভর্নরের শাসনাধীনে আনা হবে।
৩) কলকাতার পরিবর্তে দিল্লি হবে ভারতের রাজধানী।
এ-ঘোষণার ফলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের আইনটি বাতিল হয়ে যায়। বাঙালিরা, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা, আনন্দিত হন। তাঁরা কলকাতায় ১৯১২ সালের ৫ জানুয়ারি পঞ্চম জর্জকে বিপুল সংবর্ধনা দেন। কিন্তু ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ায় বাংলার অবক্ষয়ের সূচনা হয়। বাংলার পরিবর্তে গুরুত্ব পায় উত্তর প্রদেশসহ দিল্লিসংলগ্ন প্রদেশসমূহ। আগে থেকেই বোম্বাই-আহমেদাবাদে বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। বাংলার চেয়ে ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল। কংগ্রসের রাজনীতিকরা এ-এলাকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করেছেন। তাঁরা ব্রিটিশ রাজত্বে বাংলাকে দুর্বল করতে চেয়েছেন। বাংলার রাজনীতিকরা বাংলার এ-অবক্ষয়ের পরিণতি কখনো ভেবে দেখেননি। তাঁরা সাময়িক লাভে আনন্দিত হয়েছিলেন। তাঁরা অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জের দিল্লি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২৫ জুন ১৯১২ সালের ভারত শাসন আইন পাশ হয়। মাদ্রাজের সে-সময়কার জনপ্রিয় গভর্নর লর্ড মাইকেল বাংলার গভর্নর হিসেবে ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল যোগদান করেন।

হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পটভূমি
এ সময়কালে বাংলায় আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে।
কংগ্রেসের ২১তম বার্ষিক সম্মেলনে প্রখ্যাত আইনজীবী ও ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের অন্যতম নেতা পন্ডিত মদনমোহন মালব্য ১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে কাশীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯১১ সালে মালব্য তাঁর পরিকল্পনা-অনুসারে কাশীতে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি আইনপেশা ছেড়ে দেন। হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে তিনি চাঁদা আদায় শুরু করেন।
১৯১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর গোখলে কর্তৃক উত্থাপিত প্রাথমিক শিক্ষা বিলের সমর্থনে কলকাতায় টাউন হলে ড. রাসবিহারী ঘোষের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাসবিহারী ঘোষের বাড়ি বর্ধমানে। তিনি প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর টাউন হলে কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থনে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে-সভাতেও রাসবিহারী ঘোষ সভাপতিত্ব করেন। প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানিয়েছেন, এ-সভাতে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা করার কথা ছিল। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেদিন সভায় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর ছোট মেয়ে মীরাকে ওইদিন তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতন থেকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আশু (চৌধুরী) আমাকে টেলিগ্রাফ করেছিলেন। কিন্তু পরশু থেকে অর্শের রক্তপাত আরম্ভ হয়ে আমাকে কাহিল করে ফেলেছে। এখন যদি রেলে করে কলিকাতায় যাতায়াত করি তাহলে আমাকে খুবই ভোগাবে সেই ভয়ে, ওদের সভায় যেতে পারলুম না।’
২৮ সেপ্টেম্বর বিপিনবিহারী গুপ্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে দেখা করেন। হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান তিনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেন, ‘ও-সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার আছে। আমার ইচ্ছা ছিল, সেদিন কলিকাতার সভায় উপস্থিত হইয়া আমার বক্তব্য কইব। কিন্তু শরীর অত্যন্ত খারাপ হওয়ার দরুণ আমি কলিকাতায় আসিতেই পারি নাই। কথাগুলি হয়ত অনেকের ভাল লাগিত না।’

‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধ
তাঁর এই ‘অনেকের ভাল লাগিত না কথাগুলি’ লিখেছেন ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধটি ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটের অন্যতম আন্ডার সেক্রেটারি অমল হোম তাঁদের সভায় পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন। সে-সময় ভারত সরকার এক সার্কুলার জারি করে। সার্কুলারে বলা হয়, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় লইয়া যে তুমুল বিতন্ডা চলিতেছিল তাহাতে কোনোভাবেই যোগদান করিতে পারিবেন না।’ এই সার্কুলার জারির ফলে ইনস্টিট্যুটের তৎকালীন সেক্রেটারি অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের পক্ষে এ-সভায় অংশ নেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তখন রিপন কলেজে প্রবন্ধটি পাঠের ব্যবস্থা করা হয়। এবং সরকারি চাকরিভুক্ত ব্যক্তিবর্গও যাতে এ-সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেন সেজন্য রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটির নামও বদলে দেন। ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের বদলে ‘জাতীয় স্বাতন্ত্র্য’ নামে লেখাটি পাঠ করেন। তবে বক্তব্য পাল্টাননি। ৩১ অক্টোবর বেঙ্গলি পত্রিকায় উক্ত সভার বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিল।
Babu Rabindranath Tagore read a more eloquent paper in Bengali, on ‘National Individuality’ in the course of which he made some cogent remarks regarding the proposed Hindu and Mohamedan Universities.

জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের ধারণা
প্রবন্ধটিতে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজকালকার দিনে পৃথিবী জুড়িয়া আনাগোনা মেলামেশা চলিতেছে। মানুষের নানা জাতি নানা উপলক্ষে পরস্পরের পরিচয় লাভ করিতেছে।’ অতএব ভিন্ন ভিন্ন জাতির স্বাতন্ত্র্য ঘুচে গেছে। তারা পরস্পরে মিলে যাচ্ছে। ‘বাহিরের দিকে দরজা যতই খুলিতেছে, প্রাচীর ততই ভাঙিতেছে, মানুষের জাতিগুলির স্বাতন্ত্র্যবোধ ততই যেন আরো প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এক সময় মনে হইত মিলিবার উপায় ছিল না বলিয়াই মানুষেরা পৃথক হইয়া আছে কিন্তু এখন মিলিবার বাধাসকল যথাসম্ভব দূর হইয়াও দেখা যাইতেছে পার্থক্য দূর হইতেছে না।’
এই বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের কয়েকটি দেশের উদাহরণ দিয়েছেন। ইউরোপে এক সময়ে অনেকগুলো রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে মিলেমিশে ছিল। কিন্তু সে-সময়ে তারা সকলেই স্বতন্ত্র হতে ব্যগ্র ছিল। নরওয়ে ও সুইডেন ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে আলাদা হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। তারা তাদের সাহিত্য এই স্বাতন্ত্র্যসৃষ্টির কাজে ব্যবহার করছিল। এভাবে বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, তুরস্কের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তারা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একান্ত মিলনেই যে সবলতা এবং বৃহৎ হইলেই যে মহৎ হওয়া যায় এ-কথা এখনকার কথা নয়। আসল কথা, পার্থক্য যেখানে সত্য, সেখানে সুবিধার খাতিরে, বড়ো দল বাঁধিবার প্রলোভনে তাহাকে চোখ বুজিয়া লোপ করিবার চেষ্টা করিলে সত্য তাহাতে সম্মতি দিতে চায় না। চাপা-দেওয়া পার্থক্য ভয়ানক একটা উৎপাদক পদার্থ, তাহা কোনো-না-কোনো সময়ে ধাক্কা পাইলে হঠাৎ ফাটিয়া এবং ফাটাইয়া একটা বিপ্লব বাধাইয়া তোলে। যাহারা বস্ত্তত পৃথক, তাহাদের পার্থক্যকে সম্মান করাই মিলনরক্ষার সদুপায়।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষ যখন নিজের পার্থক্যটা বুঝতে পারে তখন সে নিজেকে চিনতে পারে। নিজে বড়ো হতে চেষ্টা করে। নিজের এ-পার্থক্যকে যারা চিনতে পারে না, তারা বহু জাতির সঙ্গে মিলেমিশে যায়। তাদের নিজের ভেতরের ঐশ্বর্য্যকে মেরে ফেলে। এটা প্রাণের ধর্ম নয়। তাঁর মতে যে ছোট সেও যখনই আপনার সত্যকার স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে তখনই সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। ‘বস্ত্তত সে ছোট হইয়াও বাঁচিতে চায়, বড়ো হইয়া মরিতে চায় না।’
এই প্রবন্ধে স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য পৃথক হওয়ার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ সওয়াল করছেন। সেক্ষেত্রে মিলনের কী হবে?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মিলনটা হয় বহুর মধ্যে ঐক্য। কিন্তু বহুর মধ্যে মিলিত হওয়ার আগে এককের বিকাশটা সমভাবে হওয়া জরুরি। যদি সব এককের বিকাশে অসাম্য থাকে, সমবিকাশের সুযোগটি না থাকে, তাহলে সেই বহুর মিলন বহুবিধ সংকট তৈরি করে। নতুন নতুন ভাঙনের সৃষ্টি করে। প্রবল দুর্বলের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে। দুর্বলকে শোষণ করে প্রবল হয়ে ওঠে প্রবলতর। তখন দুর্বলের অস্তিত্বসংকট দেখা দেয়। এক্ষেত্রে প্রবল ও দুর্বলের মিলনের দরকার নেই। প্রবলের সঙ্গে দুর্বলের এই শক্তির বৈষম্যটা কমিয়ে আনার জন্য দুর্বলের স্বতন্ত্র হওয়াটা জরুরি। স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে প্রবলের সমান বিকাশ সাধন করতে হবে। বিকাশটা হবে অর্থে, বিত্তে, শিক্ষায়, বুদ্ধিতে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, দর্শনে।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, স্বতন্ত্র হয়ে নিজের বিকাশ সাধন করার জন্য ছোটকে নানাবিধ দুঃখ স্বীকার করতে হবে। নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার শিকার হতে হবে। একসময়ে আপনাকে বড়ো করে তুলতে পারবে। বড়ো হয়ে উঠলেই পরস্পরের মিলন সত্যিকারের মিলনের সামগ্রী হবে। কোনোধরনের শোষণ, অবহেলা, প্রতারণা, নির্যাতনের আশঙ্কা থাকবে না। একে যখন অন্যের সমান হয়ে উঠবে, তখন এই সমান একক বহুতে মিলবে। বহুর মধ্যে একের সৃষ্টি হবে। কারো কিছু হারানোর বেদনা থাকবে না। এ-ই রবীন্দ্রনাথের মিলন। এভাবেই প্রকৃত মিলন হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এ নহে যে, কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব; কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়াই মিলন হইবে। এই কাজটি কঠিন, কারণ, সেখানে কোনো প্রকার ফাঁকি চলে না। সেখানে পরস্পরকে পরস্পরের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়। সেটা সহজ নয়। এই কঠিন কাজটি সহজ করতে গেলেই বৃহত্তর মিলন সম্ভব।’
এরপর রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলন পর্বের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, এ-সময়ে দেখা গেল, দেশের মানুষের মধ্যে প্রকৃত সদ্ভাবটা নেই। তাদের মধ্যে ভেদ আছে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই ভেদ প্রবলতর। তাকে ফাঁকি দিয়ে অস্বীকার করা চলে না। এই ভেদরেখাটি মুছে ফেলার চেষ্টা না করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক করে তোলার চেষ্টা সে-সময়ে সফল হয়নি। সাময়িক সুবিধার জন্য হিন্দুরা যখন মুসলমানদের আন্দোলনে শামিল হতে ডেকেছে, মুসলমানরা হিন্দুদের এই আহবানকে সন্দেহের চোখে দেখেছে, তাদেরকে অবিশ্বাস করেছে। তারা জানে হিন্দুরা মুসলমানদের উপস্থিতিতে জলস্পর্শ করে না। এক্ষেত্রে এক হয়ে আন্দোলন করে লাভ কি! এই প্রশ্নে মুসলমানরা তাদের নিজেদের আলাদা করে দেখতে পেয়েছে। তারা নিজেদের আলাদা করে ভেবেছে। তারা আলাদা হতে চেয়েছে। এই আলাদা হওয়ার পিছনের কারণটি হলো, হিন্দুতে-মুসলমানে শুধু ধর্মেই নয়, অর্থ-বিত্ত-শিক্ষা-দীক্ষায় বড়ো ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এখানে হিন্দুরা প্রবল, মুসলমানরা দুর্বল। এই পার্থক্য রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র থেকে হিন্দু সকল সুবিধা নিয়েছে, তার আপন প্রতিবেশী মুসলমানকে এই সুবিধাপ্রদানের কোনো দায়িত্ব বোধ করেনি। তারা স্বার্থপরের মতো নিজেরা সব নিয়েছে। ফলে দু’সম্প্রদায়ের মধ্যেকার এই ভেদরেখাটি তখন এমন প্রবল হয়ে উঠেছে যে, তারা আর পরস্পরকে মেনে নিতে পারে নি। তারা পরস্পর পরস্পরকে ঘোরতর ঈর্ষা করে। দ্বেষ করে। এর দায় প্রবলতর হয়ে ওঠা হিন্দুদের উপরই বর্তায়। এ-কারণে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এই বৈষম্যটি দূর করিবার জন্য মুসলমান সকল বিষয়েই হিন্দুর চেয়ে বেশি দাবি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের এই দাবিতে আমাদের আন্তরিক সম্মতি থাকাই উচিত। পদ-মান-শিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উঠে, ইহা হিন্দুর পক্ষেই মঙ্গল।’
তিনি বলছেন, ‘নিজের গুণে ও শক্তিতেই আমরা নিজের স্থায়ী মঙ্গল সাধন করিতে পারি। যোগ্যতালাভ ছাড়া অধিকারলাভের অন্য কোনো পথ নাই। এই কথাটা বুঝিবার সময় যত অবিলম্বে ঘটে ততই শ্রেয়ঃ। অতএব অন্যের আনুকূল্যলাভের যদি কোনো স্বতন্ত্র সিধা রাস্তা মুসলমান আবিষ্কার করিয়া থাকে তবে সে পথে তাহাদের গতি অব্যাহত হউক। সেখানে তাহাদের প্রাপ্যের ভাগ আমাদের চেয়ে পরিমাণে বেশি হইতেছে বলিয়া অহরহ কলহ করিবার ক্ষুদ্রতা যেন আমাদের না থাকে। পদ-মানের রাস্তা মুসলমানের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে সুগম হওয়া উচিত। সে রাস্তার শেষ গম্যস্থানে পৌঁছাইতে তাহার কোনো বিলম্ব না হয় ইহাই যেন আমরা প্রসন্ন মনে কামনা করি।’
এই স্বাতন্ত্র্যবোধের পক্ষে বলে রবীন্দ্রনাথ থেমে থাকছেন না। তিনি স্বাতন্ত্র্যের একটা সীমাও বেধে দিচ্ছেন। তাঁর মতে, এই স্বাতন্ত্র্য বা নিজত্বকে বিকাশের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। বিকাশটা কি তাহলে নিজের মধ্যেই হবে? নিজের মধ্যেই গুপ্ত করে রাখতে হবে? অন্যের কাছে যাওয়ার নেই? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘তাহার নিজত্বকে কেবল তাহার নিজের কাছে চোখ বুজিয়া বড়ো করিয়া তুলিয়া তাহার কোনো তৃপ্তি নাই, তাহার নিজেকে কেবল নিজের ঘরে ঢাক পিটাইয়া ঘোষণা করিয়া তাহার কোনো গৌরব নাই। তাহার নিজত্বকে সমস্ত জগতের অলঙ্কার করিয়া তুলিবে তাহার অন্তরের মধ্যে এ-প্রেরণা আসিয়াছে।’
সেই প্রেরণায় নিজেকে সে স্বতন্ত্র করে দেবে বিশ্বের সঙ্গে যোগ সাধনের জন্য। নিজের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের শিক্ষাকেও গ্রহণ করবে। এভাবে এই নিজে তখন আর নিজের অল্প নিয়ে থাকবে না। তারা সমস্তকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নেবে। তখন অন্যের পাশে সমান তেজেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, নিজেকে প্রমাণ করেই নিজের অধিকারকে আদায় করতে পারবে। কেউ তাকে পিছনে ঠিলে ফেলে দিতে পারবে না। প্রবল আর দুর্বলের ভেদরেখা মুছে যাবে। তখন মানুষ সমানভাবে সবার সঙ্গে মিলতে পারবে। সবার সঙ্গে দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলবে। নিজেকে বিশ্বের সমান হয়ে উঠবে।
রাসবিহারী ঘোষের সভাপতিত্বে ১৯১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থকদের থেকে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের তাঁর বক্তব্য সন্তুষ্ট করবে না। আরও একটি কারণে তাঁদের তা ভাল লাগবে না। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে যাব। আগে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে আলাপ করে নেওয়া যাক।

হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় : পুরনো হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবন
হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনাটি মদনমোহন মালব্য কাশীর মহারাজা স্যার প্রভুনারায়ণ সিংহের উপস্থিতিতে তৈরি করেন। ১৯০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেটা লিখিত আকার তিনি কাশীর টাউন হলে পেশ করেন। সেখানে ভারতের সকল প্রদেশের উল্লেখযোগ্য শিক্ষাবিদ এবং প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। সনাতন ধর্মমহাসভার সম্মেলনে কুম্ভমেলার সময়ে জগদ্গুরু শ্রীশঙ্করাচার্যের গোবর্ধন মঠের কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিকল্পনাটি অনুমোদন করে। তিনটি পবিত্র নদী গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে পন্ডিত মালব্য স্নান করে এই হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি এই কাজে নেমে পড়ে দেখলেন, এটা খুব সহজ নয়। তিনি তাঁর অতি লাভজনক আইনপেশাটি ছেড়ে দেন ১৯১১ সালের জানুয়ারিতে। অ্যানি বেশান্ত কাশীতে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন ১৯০৭ সালে। ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে মালব্য ও বেশান্ত একসঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং দুজনের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার উদ্যোগকে যুক্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কাশীতে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে এবং তাঁরা একত্রে সে-ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাবেন।

হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল :
১. হিন্দু শাস্ত্র ও সংস্কৃত সাহিত্যকে প্রমোট করা। এর মাধ্যমে হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ও সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতার ভালো ও মহৎ দর্শনকে সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরা।
২. কলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষণ ও গবেষণাকে উৎসাহিত করা।
৩. দেশের নিজস্ব শিল্প ও নিজস্ব সম্পদের যথার্থ ব্যবহার ও বিকাশের স্বার্থে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতাকে কাজে লাগানো।
৪. ধর্ম এবং নৈতিকতার আলোকে যুবচরিত্র গঠন করা।
১৯১৫ সালের মধ্যে সরকার কর্তৃক ধার্য পঞ্চাশ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বিলটি সরকার পাশ করে। প্রচুর যাগযজ্ঞ ও পূজা-আর্চার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে রাজা, মহারাজা, জমিদার, সামন্ত, ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। নিম্নবর্গের মানুষের কোনো সুযোগ সেখানে ছিল না। যেখানে আর্য হিন্দু সংস্কৃতি বা ধর্মের পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ আছে, সেখানে মুসলমান বা খ্রিষ্টানদের কোনো সুযোগ নেই।
এই হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সারাদেশের মতো বঙ্গদেশেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদীরা একই সঙ্গে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে চায়, পাশাপাশি মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে।

রবীন্দ্রনাথের হিন্দু সম্প্রদায় বনাম হিন্দু সমাজ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে প্রশ্ন ররেছেন, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়টি কাদের জন্য হচ্ছে? এই হিন্দু কারা? এটি কোন হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়? তার অর্থ রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি নয়, অসংখ্য হিন্দু বলে ব্যাপার আছে। তিনি ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে একধরনের হিন্দুর বর্ণনা দিচ্ছেন, তারা পঞ্জিকার পাতায় সংক্রান্তির ছবির মতো স্নান-জপ-ব্রত-উপবাসে কৃশ ও জগতের সবকিছুর সংস্পর্শ পরিহার করে অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে থাকে। এদের জন্য হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হলে বিপদের আশঙ্কা আছে। এই উচ্চমার্গের হিন্দু একটি কূপমন্ডূক সাম্প্রদায়িক হিন্দু। তারা সমুদ্র পার হতে বাধা দেয়, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। তারা অন্য সম্প্রদায়কে গ্রহণ করতে পারে না। মুসলমানের ছোঁয়া দুধ বা খেজুরের রস বা গুড় খেলে সেই হিন্দু অপরাধবোধ করে না, কিন্তু জল খেলেই অপরাধবোধ করে। ইংরেজের প্রস্ত্তত মদ খেলে তাদের জাত যায় না, কিন্তু ভাত খেলেই জাত থাকে না। এ-প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগও তারা দিতে রাজি নয়। যদি কেউ করে বসে, তাহলে তাদের ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দেয়, তাদেরকে সমাজচ্যুত করে। এ-হিন্দু তার প্রতিবেশী মুসলমানদেরকে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ দিতে আগ্রহী নয়। তাকে কেবল সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার বলে ব্যবহার করতে চায়। নমশূদ্রকে পায়ের ধুলোর সমান গণ্য করে। সুতরাং এই প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুর জন্য আলাদা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় করার চেষ্টা হলে তা আরো বড়ো ধরনের হিংস্রতার জন্ম দিতে পারে।
তিনি এই হিন্দু সম্প্রদায়ের বাইরে আরেকটি হিন্দুর সন্ধান দিচ্ছেন। তাকে তিনি হিন্দু সম্প্রদায় না বলে বলছেন হিন্দু সমাজ। এই হিন্দু সমাজে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ই নয়, তাদের অঙ্গ বৌদ্ধ ও জৈনরা। এ-সমাজের অন্তর্গত মুসলমান ও খ্রিষ্টানরাও। এই হিন্দু সমাজ একদা হিন্দু সভ্যতা নির্মাণ করেছিল। ‘একদিন এই হিন্দু সভ্যতা সজীব ছিল, তখন সে সমুদ্র পার হইয়াছে, উপনিবেশ বাঁধিয়াছে, দিগ্বিজয় করিয়াছে, দিয়াছে এবং নিয়াছে; তখন তাহার শিল্প ছিল, বাণিজ্য ছিল, তাহার কর্মপ্রবাহ ব্যাপক ও বেগবান ছিল, তখন তাহার ইতিহাসে নব নব সত্যের অভ্যুত্থান, সমাজবিপ্লব ও ধর্মবিপ্লবের স্থান ছিল; তখন তাহার স্ত্রীসমাজেও বীরত্ব, বিদ্যা ও তপস্যা ছিল, তখন তাদের আচার-ব্যবহার চিরকালের মতো লোহার ছাঁচে ঢালাই করা ছিল না।’
এই হিন্দু সমাজের ছিল প্রাণের ধর্ম, বিকাশের ধর্ম, পরিবর্তনের ধর্ম, নিয়ত গ্রহণ-বর্জনের ধর্ম। এই হিন্দু সমাজ মুসলমান ও খ্রিষ্টানকেও তাদের সমাজের বাইরে নয়, অঙ্গ বলে নিতে সমর্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, এই হিন্দু সম্প্রদায়কে হিন্দু সমাজের দিকে ফেরানোর জন্য হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে আপত্তি নেই। কিন্তু কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় করার দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন না। সেটা করা হলে বড়োজোর একটা বড়োসড়ো টোল হবে। সেখানে শাস্ত্রপাঠ ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেই পুরাতন হিন্দু সমাজের মধ্যে যে-উদার ধারণাটা ছিল সে-ধারণাকে তিনি বড়ো করে তোলার পক্ষে। তাকে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক স্থবিরতা থেকে বের করে বিকাশের দিকে চালনা করলে, তারা বড়োর দিকে যাত্রা করবে। সবাইকে তার মতো করে গড়ে তুলতে সহযোগিতাই করবে, সবাইকে সমর্থ করে গ্রহণ করবে। তখন প্রকৃত মিলন হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় : চিত্তকে বাঁধে না মুক্ত করে
বিশ্ববিদ্যালয়কে এই বিকাশের দিকে চালনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে বুদ্ধি কাজ করে, সেখানে অসচেতন চিত্তকে সচেতন করে তোলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিশ্ববিদ্যার চেতনার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলে চেতনার পূর্বতন ক্ষুদ্রতা, জড়তা, সংকীর্ণতা ক্ষয় হয়ে যায়। চিত্ত বা মন বা বুদ্ধি নিজেই প্রশস্ত হয়ে ওঠে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় যে-নামেই হোক না কেন, যে-উদ্দেশ্যেই তৈরি হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় মনকে বেঁধে ফেলতে পারে না, মনকে চালিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের মধ্যে মহৎ মানুষের জন্ম ঘটিয়ে দেয়। সেটা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। এক্ষেত্রে কবির প্রস্তাব হলো, সেখানে কেবলমাত্র হিন্দু শাস্ত্র বা মুসলমান শাস্ত্র পড়ানো চলবে না, সেখানে বিশ্ববিদ্যার অনুষদগুলো থাকতে হবে। হিন্দু বা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বিশ্বকে স্থান দেওয়া হয়, তবে সেইসঙ্গে নিজের স্বাতন্ত্র্যকে স্থান দিলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না।
সে-সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করত। ভারতে আরো অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তাহলে হিন্দু বা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার হলো কেন? এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিকে দায়ী করছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা এতদিন পুরোপুরি পাশ্চাত্য শিক্ষা পাইতেছিলাম। এ শিক্ষা যখন এদেশে প্রথম আরম্ভ হইয়াছিল তখন সকল প্রকার প্রাচ্যবিদ্যার প্রতি তাহার অজ্ঞতা ছিল। তাহার পূর্ব মহলের সন্তানেরা পশ্চিম মহলের দিকের জানালা বন্ধ করিয়াছে এবং পশ্চিম মহলেরা পুবের হাওয়াকে জঙ্গলের অস্বাস্থ্যকর হাওয়া জ্ঞান করিয়া তাহার একটু আভাষেই কান পর্যন্ত মুড়ি দিয়া বসিয়াছে।’
তিনি শিক্ষাব্যবস্থার গলদটি আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন। আমাদের বিদ্যালয়ে কেবল আমাদেরই বিদ্যার উপযুক্ত স্থান নেই। একজন জার্মান ছাত্রের হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্র অধ্যয়নের যে-সুবিধা আছে, আমাদের সে-সুবিধা নেই। এই একমুখী পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের ক্ষতি করছে। এই বিদ্যা পাখিপড়ার মতো আওড়ালে রাস্তার লোকের ক্ষণকাল বিস্ময় ও কৌতুক উৎপাদন করবে। পৃথিবীতে তার কোনো লাভ নেই। ‘আমরা নিজের বাণী লাভ করিব। সমস্ত মানব আমাদের কাছে এই দাবি করিতেছে।’
অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পাঠ্যপুস্তকে মুসলমানদের মনীষীদেরও কথা থাকতে হবে। মুসলমানদের ধর্মের বাণীও থাকতে হবে। কেবল হিন্দুর বা খ্রিষ্টানের বাণী থাকলেই চলবে না। সেটা শুধু মুসলমানদের জানলেই হবে না, হিন্দুকেও জানতে হবে। কারণ নিজের শাস্ত্র পড়ে পন্ডিত হওয়ার দিন চলে গেছে। এখন জানতে হবে সকল শাস্ত্র, সকলের শাস্ত্র।
এই বক্তব্য হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতাদের সন্তুষ্ট করে না। তারা একদিকে কাশীতে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, পাশাপাশি তারা মুসলমানদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় হোক সেটা চায় না। রাসবিহারী ঘোষ এ-ঘরানারই লোক ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য রাসবিহারী ঘোষদের পক্ষে যায় না। তিনি সোজা বলে দিচ্ছেন, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হোক, আপত্তি নেই, একইভাবে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে হবে। তাকে বাধা দেওয়া চলবে না।

আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় : মুসলমান জাগরণের উদ্যোগ
সে-সময়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছিল। ‘দি ক্যাম্পেইন ফর এ মুসলিম ইউনিভার্সিটি ১৮৯৮-১৯২০’ গবেষণা-প্রবন্ধে গেইল মিনো ও ডেভিড লেলিভেল্ড লিখেছেন, মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনটি সর্বভারতীয় মুসলিম জাগরণের একটি উদ্যোগ ছিল। পাশাপাশি মুসলমানদের হৃত গৌরব বা শক্তি পুনরুদ্ধারেরও প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ১৮৯৮ সাল থেকে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি কমিশন ১৯০২ সালে এ-বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে রিপোর্ট দিয়েছিল। ১৯০৪ সালের একটি আইনের ফলে সে রিপোর্টের কার্যকরতা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯১১ সালে আবার মুসলমানদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকারি অনুমোদনলাভের চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯১২ সালে সরকার না করে দেয়। সে-সময়ে হিন্দুদের উদ্যোগে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকারের অনুমোদনের চেষ্টা করেছে। ১৯১৫ সালে সরকার হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন করে। ফলে তখন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে নতুন করে আবার সরকারের কাছে দেনদরবার করা হয় এবং ১৯২০ সালে সরকার অবশেষে তা অনুমোদন করে।
হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি হাজির করেন পন্ডিত মদনমোহন মালব্য ১৯০৫ সালে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি আরো আগে থেকে করা হয়েছিল। সেটা ১৮৯৮ সাল থেকে, করেছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ। তাঁর মৃত্যুর পরে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে মুসলমানরাই থাকবে – এ-নীতিতে এগিয়ে তৎকালীন ভারতের সকল প্রদেশ থেকে অর্থসংগ্রহ করা হয়। ১৮৯৮ সালে মৌলবী রফিউদ্দিন আহমদ একটি প্রবন্ধ লিখে জানান যে, এই মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল মুসলমানের শিক্ষার কেন্দ্র হবে। এটা আধুনিক মানের হবে, তবে তা হবে কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য। এটা হবে বিশ্বমানের, তবে তা অবশ্যই হবে ধর্মীয়। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের এ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা দেওয়া হবে। এখানকার শিক্ষা গ্রহণ করে তারা ইতিহাস, অর্থনীতি ও দর্শনশাস্ত্রে মনোযোগী হবে, তবে তারা কম গুরুত্ব দেবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে। যদিও পরে এ-পরিকল্পনায় বিজ্ঞান বিভাগ খোলার প্রস্তাবও গৃহীত হয়। চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। লক্ষ করে দেখুন, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনায় নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের কোনো অবস্থান নেই, নেই অন্য সম্প্রদায়ের লোকও। কেবলমাত্র এখানে পড়বে উচ্চবর্গের জমিদার, সামন্ত, ভূস্বামী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং সম্পন্ন মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা।
বিস্ময়কর হলো, সে-সময়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা পূর্ব বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক, সেটা চাননি। তাঁরা ভাবেন, ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সেখানে একটি মুসলিম কলেজ হতে পারে। কলেজ হলেও সেটা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকতে হবে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ববাংলার মুসলমানগণ ইংরেজ সরকার চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে মনে করেছিল। তবে স্যার সলিমুল্লাহ এবং বিশিষ্ট অভিজাত নেতারা এ-পরিবর্তনকে the mandate of the Emperor হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ১৯১২ সালে ভারতে লর্ড হার্ডিঞ্জ আসেন। জানুয়ারিতে একটি মুসলিম ডেপুটেশন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করেন। ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের স্বার্থ বিশেষভাবে লক্ষ রাখার জন্য প্রতি বছর ঢাকায় প্রাদেশিক গভর্নরের ক্যাম্প বসার আশ্বাস পাওয়া যায়। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় অধোগতি যাতে না হয়, তার জন্য ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা
১৯১২ সালে ২১ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন –
এক, পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান। তাঁরা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাঁদের জন্য ঢাকায় নয়, পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।
দুই, পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান। তাঁরা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০ হাজার জনের মধ্যে একজন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্রসংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে। পূর্ববঙ্গে প্রাইমারি এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশোনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যে সরকারি বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাইমারি বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় চাননি।
তিন, পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু। তাঁরা মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
ইতিহাস ঘেঁটে এ-বিষয়ে যা পাওয়া যায়, আসুন, একটু দেখা যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত উদীয়মান মুসলমানদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে। চবিবশ পরগণার জেলা মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন ১৯১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে। বলা হয়, এর ফলে সমগ্র প্রদেশের মুসলমানদের শিক্ষাগত স্বার্থে পক্ষপাতদুষ্ট প্রভাব পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি করবে। (সূত্র : দি মুসলিম পত্রিকা)।
পূর্বোল্লিখিত গবেষণাপত্রে গেইল মিনো ও ডেভিড লেলিভেলড লিখেছেন, মৌলানা মুহাম্মদ আলী কলকাতার দি কমরেড পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটির তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি লেখেন, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়েছে, সেই দাবি পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতাদের প্রত্যাহার করা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি আঞ্চলিক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে আলিগড়ে প্রস্তাবিত সর্বভারতীয় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিই বেশি যুক্তিসঙ্গত। প্রয়োজনে ঢাকায় পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি করা যেতে পারে। সে-কলেজটিও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবে। মৌলানা মুহাম্মদ আলী আশ্বস্ত করেন যে, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সকল মুসলমানদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করবে।
মৌলানা আকরম খাঁ আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা-সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দানের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্থা করবেন না। মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অপেক্ষা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ব্যারিস্টার আবদুর রসুল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য অর্থ ব্যয় না করে বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা ব্যয় করা উচিত। দি মুসলমানের মতে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান, ফলে বাংলার মুসলমানের বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং গরিব অথবা যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং দু-একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ ইত্যাদি স্থাপন করলে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার সম্ভব হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
কিন্তু ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম মুসলিম লিগ সর্বসম্মতিক্রমে ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তারা আশা করে, ওই কেন্দ্রীয় প্রস্তাব কার্যকর হলে পূর্ববাংলায় শিক্ষাবিস্তারে নতুন বেগের সঞ্চার হবে। ওই বছরেই সলিমুল্লাহ সরকারের নিকট বাংলার পূর্বাংশের মুসলমানদের জন্য পৃথক তহবিল সৃষ্টির একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু দি মুসলিম পত্রিকায় ওই দাবি সমর্থিত হয়নি। বলা হয়েছিল, ওই দাবি ‘শিক্ষাগত বিভাগ’ সৃষ্টি করে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করবে। ওই প্রস্তাবের পরিবর্তে সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিতে মুসলিম শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ‘স্পেশাল মহামেডান এডুকেশন অফিসার’ নিয়োগের দাবি করা হয়।
এ-সময়েই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসলমান ছাত্ররা তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত নানা সমস্যা-সমাধানের দাবিতে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছিল। ১৯১৪ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি ১০ হাজার মুসলমান ছাত্রের মধ্যে মাত্র একজন স্কুলস্তর অতিক্রম করে কলেজস্তরে উন্নীত হতো। দি মুসলিম পত্রিকায় মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষাবিস্তারের সাহায্যার্থে তাদের আনুপাতিক সরকারি অনুদান দাবি করা হলে মুসলমান ছাত্র-আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদানের ব্যবস্থার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত শিক্ষার পরিকল্পনাও পেশ করা হয়েছিল। তাছাড়া উচ্চবিত্ত মুসলমানদের জন্য ঢাকায় একটি কলেজ স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়। দি মুসলিম পত্রিকায় উচ্চবিত্তদের জন্য কলেজ স্থাপনের বিরোধিতা করা হয়। উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকেরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাদানে কোনোই অসুবিধা ভোগ করেন না বলেও যুক্তি দেখানো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি-সংক্রান্ত মতভেদের অবসান হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯১২ সালের ২৭ মে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির অন্য সদস্যবৃন্দ হলেন – ডি আর কুচলার, ড. রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দ রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ এ টি আর্চিবল্ড, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহিদ, মোহাম্মদ আলী (আলিগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ এইচ এইচ আর জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি ডব্লিউ পিক এবং সংস্কৃত কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য। ভারত সচিব ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন করেন। কিন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইমপিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহবান জানান। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমসফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। সে-কমিশনের ওপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন মাইকেল স্যাডলার।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (স্যাডলার কমিশন) ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। কিন্তু এ-কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করার নাথান কমিটির প্রস্তাব সমর্থন করেনি। ঢাকা কলেজের আইন বিভাগের সহ-অধ্যক্ষ ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিরূপে অভিহিত করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের কাঠামো তৈরি করে দেন। একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অধ্যাপক টি সি উইলিয়ামস আর্থিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা শহরের কলেজগুলোর পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরূপে গণ্য করার সুপারিশ করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত এলাকা বলে গণ্য করার কথাও বলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন তেরোটি সুপারিশ করে এবং কিছু রদবদলসহ তা ১৯২০ সালের ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয়। ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তাতে সম্মতি প্রদান করেন। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগ। তিনি ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরশেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন? শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদসৃষ্টির বিনিময়ে তাঁর বিরোধিতার অবসান করেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ব্যক্তিত্ব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যু ঘটলে, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এ-উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যদের মধ্যে আবুল কাসেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ জে হার্টগ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তিনি প্রথম ভাষণেই বলেন, ‘এটি কোন মুসলিম কিংবা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি সবার এবং প্রত্যেক মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’ প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকনিয়োগে তাঁকে সাহায্য করেন ডব্লিউ হোরনলে, স্যার নীলরতন সরকার, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নবাব স্যার শামসুল হুদা ও নবাবজাদা খান বাহাদুর কে এম আফজাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম আবাসিক হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। এ-হলের প্রথম প্রোভোস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রহমান। ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুল্লাহর নামানুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের’ ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষে এর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহে জগন্নাথ হলের প্রথম বার্ষিক সাহিত্যপত্র বাসন্তিকা ১৯২৩ সালের প্রথমে প্রকাশিত হয়। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের পর প্রভোস্ট হন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানায় বক্তৃতাদি প্রদানের জন্য। কবির সফরসঙ্গী হয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী, ভ্রাতুষ্পুত্র দিনেন্দ্রনাথ, হিরজিভাই, মরিস, চীনা অধ্যাপক লিম নো ছিয়াং এবং দুই ইতালিয়ান অধ্যাপক ফর্মিকি ও তুচ্চি।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ/ নারায়ণগঞ্জে বিপুল অভ্যর্থনা’ শিরোনামে।
গতকল্য রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় পৌঁছিয়াছেন, ঢাকায় অধিবাসীবৃন্দ তাঁহাকে বিপুল অভ্যর্থনা করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে বলিতে গেলে এইবারই রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম ঢাকায় আসিয়াছেন। ইতিপূর্বে তিনি ভালো করিয়া ঢাকা পরিদর্শন করেন নাই। স্থানীয় অভ্যর্থনা-সমিতি নারায়ণগঞ্জে বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণ করিয়াছিলেন। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন সেদিন জনসমুদ্রে পরিণত হইয়াছিল। স্টিমার ঘাটে আসিবার বহু পূর্ব হইতেই তথায় জনসমাগণ হইতে আরম্ভ হয়। দেখিতে দেখিতে এত লোক জড়ো হয় যে, কি ঘাটে, কি জেটিতে একটুকুও স্থান ছিল না। রবীন্দ্রনাথের স্টিমার ঘাটে পৌঁছিলে চতুর্দিক হইতে ঘন ঘন আনন্দধ্বনি উত্থিত হয়। কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করেন এবং স্টিমার হইতে নামাইয়া আনেন।… মোটরে চড়িয়া ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। ঢাকা শহরের পূর্ব সীমান্তে একদল স্কাউট, বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও শহরের বিশিষ্ট ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মোটর দৃষ্টিপথে প্রবিষ্ট হইবামাত্র ঘন ঘন জয়ধ্বনি উত্থিত হয়। তারপর ঢাকার নবাব বাহাদুরের হাউস বোট তুরাগে কবির বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়। তুরাগে যাওয়ার পথটি কলাগাছের চারা দিয়া সাজানো হইয়াছিল।
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়েছিল ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ তারিখের বিকেল চারটেয় মিউনিসিপ্যালিটি এবং পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ঢাকার নর্থব্রুক হলে। সমস্ত হলটি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং বাইরেও গণজমায়েত হয়েছিল। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারগণ মানপত্রে লেখেন –
হে জাতীয়তার দার্শনিক প্রচারক। হিন্দু-মুসলমানের স্থায়ী মিলন কেবল সাহিত্য ও শিক্ষার ভিতর দিয়াই সম্ভবপর। বর্তমান বিরোধ ও অনৈক্য সমাধানের এই গুহ্য মন্ত্র তুমি বহু পূর্ব হইতেই প্রচার করিয়া আসিতেছ। জাতির প্রতি অত্যাচারে নিজকে লাঞ্ছিত মনে করিয়া তুমি রাজদত্ত দুর্লভ সম্মান ঘৃণায় পরিত্যাগ করিয়াছ; দেশবাসীর নিগ্রহহেতু কানাডার নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া আত্মসম্মানবোধ ও দেশনেতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছ।
এরপরই ঢাকা জনসাধারণের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র পাঠ করা হয়। সেখানেও নাইট উপাধিত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে একটি লিখিত বক্তব্য দেন।
করোনেশন পার্কে বিকেল ৫.৩০-এ কবিকে আরেকটি সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উপস্থিত ছিল দশ হাজার লোক। ঢাকা রেটপেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন মানপত্রে বলেন যে –
লর্ড কার্জন বাহাদুরের শাসনকালে বঙ্গবিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ যখন পশ্চিবঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল তখন সেই কূটনীতির বিরুদ্ধে আপনি কাব্যে ও সংগীতে যে ভীষণ সংগ্রাম ঘোষণা করিয়াছিলেন তাহাও আজ স্মরণপথে উদিত হইতেছে।
নবাব বাহাদুর খাজে হাবিবুল্লাহর সভাপতিতে হিন্দু মোসলেম সেবাশ্রমের পক্ষ থেকে মানপত্র দেওয়া হয়।
১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শন করেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর দুপুর আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে উপস্থিত হন। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী সংঘ তাঁকে একটি কাব্যাভিনন্দন প্রদান করে।
এখানেই বিকেলে মুসলিম হলে ছাত্র সংসদ সংবর্ধনার বিপুল আয়োজন করে। ছাত্রসংসদ কবিকে আজীবন সদস্যপদরূপে গ্রহণ করে। মুসলিম হলে সংবর্ধনা সম্পর্কে আবুল ফজলের স্মৃতিচারণ –
‘কবি যখন ঢুকলেন, হলঘরের প্রবেশপথ থেকেই কবির উপর শুরু হয়েছে পুষ্পবৃষ্টি।’ মুসলিম হল ছাত্রবৃন্দ মানপত্রে বলেন যে, ‘বিধাতা বড় দয়া করিয়া, প্রাণহীন ভারতের দুর্দিনে তোমার মতো বিরাট-প্রাণ মহাপুরুষকে দান করিয়াছেন। তোমার প্রাণ মুক্ত, বিশ্বময়। সেখানে হিন্দু নাই, মুসলমান নাই, খৃষ্টান নাই, আছে মানুষ। একদিকে তুমি মানুষকে নানা কর্মধারায় জাগ্রত করিয়াছ, অন্যদিকে সেই অসীম স্রষ্টার দিকে মনকে আকৃষ্ট করিয়াছ। ‘কর্ম ও ধ্যান’ উভয়ের সামঞ্জস্যসাধনই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। ইসলামের এই সারবার্তা তোমার ছন্দে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। তোমার এই ছন্দ আমাদিগকে প্রতিদিন বিশ্বের কল্যাণ সাধনে ও মানুষের সেবায় উদ্বেধিত করুক।
রবীন্দ্রনাথ সংবর্ধনার উত্তরে বলেন, প্রাচীনকালে আমাদের দেশে রাজারা দিগ্বিজয় করে ফিরলে তাঁদের ওপর পুষ্পবৃষ্টি অর্পণ করা হতো। আমি কি আমার দেশের জন্য তেমন কিছু জয় করে এনেছি যার জন্য আজ আমাকেও পুষ্প বর্ষণ করে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে। ভারতের বুকে এত জাতি, এত ধর্ম স্থান লাভ করেছে, তার অর্থ আছে। ভারতের হাওয়ায় এমন শক্তি আছে যার বলে সকল সম্প্রদায় এখানে আসন লাভ করতে পেরেছে। ভারতের ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ও পরস্পরের বিচ্ছেদ দেখে নিতান্ত দুঃখিত, মর্মাহত, লজ্জিত হই। ধর্মে ধর্মে বিরোধ হতে পারে না। কারণ ধর্ম হলো মিলনের সেতু আর অধর্ম বিরোধের। যখন ধর্মে বিকার উপস্থিত হয় তখনই বিচ্ছেদ প্রবল হয়ে ওঠে। শুধু হিন্দু-মুসলমানে প্রভেদ নয়, সমাজের মধ্যে ভেদের অন্ত নেই। যখন মানুষ মানুষকে অপমান করে, তখন সে দুর্গতি-দারিদ্রে্যর চরম সীমায় উপনীত হয়।
আমি আমার সমাজের জন্য লজ্জিত হয়েছি। বিচ্ছেদের রক্তপ্লাবনে মানব-সমাজের প্রতি স্তর কলুষিত হয়েছে। এই সমস্যা ভারতে বহুদিন থেকে আছে। বিরোধের প্রাচীর তুলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। শুভবুদ্ধির আলোক বিকীর্ণ হোক। তবেই আমাদের চিত্ত মুক্ত হবে।
সন্ধ্যায় কার্জন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষণ দেন। ভাষণের বিষয় ছিল – ‘দি মিনিং অফ আর্ট’। ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি (২৭ ও ২৮ মাঘ) অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। ১৩ ফেব্রুয়ারি (১ ফাল্গুন) রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল – ‘দ্য রুল অফ দ্য জায়ান্ট’। আগে উল্লেখ করা হয়েছে, অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হলে ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। ১৫ ফেব্রুয়ারি (৩ ফাল্পুন) বিদায়ী দিনে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে হল বার্ষিকী ‘বাসন্তিকা’র জন্য একটি গান লিখে দেন।
একটি বিষয় লক্ষ করা যায়, কবির এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানগুলি বিপুল জনসাধারণ, ছাত্র, নেতৃবৃন্দের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে মুখরিত। হিন্দু-মুসলিম জাতি-সম্প্রদায়-ভেদে সকলেই অংশ নিয়েছেন।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সাম্মানিক ডি লিট্ উপাধিতে ভূষিত করে। স্থির ছিল, কবি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত সম্মান গ্রহণ করবেন। কিন্তু শরীরের কারণে ঢাকা যেতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে উপাধিটি প্রদান করেন।

রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-বিরোধিতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, একরম একটা কথা আমাদের দেশে মাঝে মাঝে প্রচারিত হয়। কিন্তু যখন এই অভিযোগটি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে করা হয় – সেখানে কোনো সূত্র সেসব লেখায় পাওয়া যায় না। আমরা এ-পরিসরে দুটো অভিযোগ অনুসন্ধান করে দেখেছি। দুটো অভিযোগই অসত্য।
১. দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ১ জুলাই ২০১১ সংখ্যায় আলী নিয়ামত নামে একজন লেখক লিখেছেন – ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ড. রাসবিহারী ঘোষ, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।
আগেই বলা হয়েছে, ড. রাসবিহারী ঘোষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ফারাক ছিল। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হোক কাশীতে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিটিকে যুক্তিসংগতভাবে সমর্থন করেন।
২. ২০০০ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) একটি তথ্য জানান যে, ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।’ এম এ মতিনের অভিযোগ – রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে, ওইদিন রবীন্দ্রনাথ কোথায় ছিলেন? কী করেছিলেন?
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে একটি চিঠি লিখেছেন জগদানন্দ রায়কে। জগদানন্দ রায় বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক, রবীন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের গৃহশিক্ষক ও শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, ১৫ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ‘কয়দিন এখানে এসে সুস্থ বোধ করছিলুম। মনে করেছিলুম সেদিন যে-ধাক্কাটা খেয়েছিলুম সেটা কিছুই নয়। সুস্থ হয়ে উঠলেই অসুখটাকে মিথ্যা বলে মনে হয়। আবার আজ দেখি সকাল বেলায় মাথাটা রীতিমতো টলমল করচে। কাল বুধবার ছিল বলে, কাল সন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের নিয়ে একটু আলোচনা করছিলুম – এইটুকুতেই আমার মাথা যখন কাবু হয়ে পড়ল তখন বুঝতে পারচি নিতান্ত উড়িয়ে দিলে চলবে না।’ (বিশ্বভারতী পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৬, পৃ ২৫৩)।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী গ্রন্থের ষষ্ঠ খন্ডে জানাচ্ছেন, এদিনই তিনি একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম – ‘স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’। এই কবিতাটি গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ৪ সংখ্যক কবিতা। এরপর বাকি ১৫ দিনে শিলাইদহে থেকে রবীন্দ্রনাথ আরো ১৭টি কবিতা বা গান লেখেন। এর মধ্যে একটি গান – ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’। ১৪ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ। রচনার স্থান শিলাইদহ। ২৬ চৈত্র ১৩১৮ (এপ্রিল ৮, ১৯১২) বঙ্গাব্দেও তিনি শিলাইদহে। সেখান থেকে লিখেছেন – ‘এবার আমায় ভাসিয়ে দিতে হবে আমার’। এপ্রিল ১২, ১৯১২ তারিখে লিখেছেন – ‘এবার তোরা আমার যাবার বেলাতে’। তথ্য বলছে – সে-সময়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় নয়, শিলাইদহে ছিলেন।
তাহলে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কেন গেলেন? কখন গেলেন? তার একটু হদিস নেওয়া যেতে পারে।
প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনীর ষষ্ঠ খন্ডে এ-বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে –
১৯ মার্চ ১৯১২ (৬ চৈত্র, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে কলকাতা থেকে সিটি অব প্যারিস জাহাজে রবীন্দ্রনাথের ইংলন্ড যাত্রার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। সঙ্গী মেয়ো হাসপাতালের ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। কবিকে বিদায় জানানোর জন্য বহু ব্যক্তি সেদিন জাহাজঘাটায় উপস্থিত। কবির জিনিসপত্রও জাহাজে উঠে গেছে আগের দিন।… কিন্তু ‘খবর এলো যে, কবি অসুস্থ; আসতে পারবেন না। ওই গরমে উপর্যুপরি নিমন্ত্রণ-অভ্যর্থনাদির আদর-অত্যাচারে রওনা হ’বার দিন ভোরে প্রস্ত্তত হতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে যান। ডাক্তাররা বললেন, তাঁর এ-যাত্রা কোনোমতেই সমীচীন হতে পারে না। রইলেন তিনি; আর ক্যাবিনে একা রাজত্ব করে, তাঁর বাক্স-পেটরা নিয়ে চল্লুম আমি একলা।’ এটা লিখেছেন ডা. মৈত্র।
রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখছেন –
জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যার আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়া-দাওয়া নয়, সেইসঙ্গে বাল্মিকীপ্রতিভা অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দিনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হল। আমরা ঘরে ফিরলাম রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে হল। জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হল না।
আকস্মিকভাবে যাত্রা পন্ড হয়ে যাওয়ায় খুব বেদনা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ২১ মার্চ ১৯১২ (৮ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন –
আমার কপাল মন্দ – কপালের ভিতরে যে পদার্থ আছে, তারও গলদ আছে – নইলে ঠিক জাহাজে ওঠার মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দন্ড সেদিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে। এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নড়াচড়া প্রভৃতি সজীব প্রাণীমাত্রেরই অধিকার আছে, আমার পক্ষে তা একেবারে নিষিদ্ধ।
২৪ মার্চ ১৯১২ (১১ চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) বিশ্রামের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা হন। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহিতে লেখা আছে, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীযুক্ত রথীন্দ্র বাবু মহাশয় ও শ্রীমতি বধুমাতাঠাকুরাণী সিলাইদহ গমনের ব্যয় ৩৭৯ নং ভাউচার ১১ চৈত্র ১৫।। ৩।. পরদিন সোমবার ১২ চৈত্র ২৫ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ মৌচাক পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের ভগ্নী কাদম্বিনী দত্তকে (১২৮৫-১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এক চিঠিতে লেখেন – ‘এখনো মাথার পরিশ্রম নিষেধ। শিলাইদহে নির্জ্জনে পালাইয়া আসিয়াছি।’
কোথায় কলকাতার গড়ের মাঠ আর কোথায় শিলাইদহ! তাহলে ২৮ মার্চ ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কি করে শিলাইদহ থেকে অসুস্থ শরীরে কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সভায় উপস্থিত ছিলেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন জানাচ্ছেন – রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের (২৮-২৯ জুন ২০১১) আলোচনায় আসে। অধ্যাপক ফকরুল আলমের কথার অংশ থেকে লিখছি; ‘রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন; কিন্তু চারপাঁচ বছর পর তার পুরনো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন।… অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন।… যারা ইতিহাসকে এক জায়গায় রেখে দেয় তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, তারা সত্যকে বিকৃত করে।…’ (কার্যবিবরণী, পৃ ১৭৮)।

সূত্র :
১. ‘A University in the Making’, Eastern Bengal Notes and Queries, Second Series, 1 (১৯২০), H.E. Stepleton.
২. ‘The Campaign for a Muslim University, 1898-1920’, Gail Minault and David Lelyveld.
৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, সম্পাদক রফিকুল ইসলাম।
৪. রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল, ষষ্ঠ খন্ড।
৫. রবীন্দ্রজীবনকথা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। 