হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস : কতিপয় শিল্পসূত্র

হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) উজ্জ্বল এক অভিনব কণ্ঠস্বর নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রবেশ করেন। নাগরিক মধ্যবিত্ত, তারুণ্য-শাসিত
আবেগে-আকাঙক্ষায় উচ্চকিত হুমায়ূন আহমেদ জীবনার্থ সন্ধানে স্বপ্নময় ভবিষ্যতে বিশ্বাসী ছিলেন। শুরু থেকেই তাঁর উপন্যাসের ভাষা ছিল সহজ-সরল, স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। গল্প বলার অসাধারণ এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তাঁর। এই গল্প বলার জাদুকরি শক্তিই তাঁকে দ্রম্নত খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠেন সময়ের শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় কথাশিল্পী। কাহিনি-বর্ণনায় টানটান উত্তেজনা, কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার বিন্যাস, চমকপ্রদ নাটকীয়তা, বৈচিত্র্যময় ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র সৃষ্টি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদকে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। স্বাধীনতা-উত্তর শহরকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের শিক্ষিত শ্রেণিই মূলত হুমায়ূন আহমেদের প্রধান পাঠক। স্মর্তব্য, কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণির লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ (‘রাহমান : ১৯৯৮’, হুমায়ূন ৫০, ভূমিকা) মুগ্ধ, বিহবল পাঠক শ্রেণি আপন আয়নায় নিজেদের ছবি ও যাপিত জীবনের চালচিত্র দেখে বিস্মিত হয়। নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও আকাঙক্ষার এমন শৈল্পিক রূপায়ণ হুমায়ূন আহমেদের আগে আর কেউ করতে পারেননি। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকের (১৯৭২) ভূমিকায় ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন :

মাসিক ‘মুখপত্রে’র প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম নন্দিত নরকে দেখেই আকৃষ্ট হলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। … পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।

সমকালীন পণ্ডিত আহমদ শরীফ তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন ভাবীকালের কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রতিভাকে। তাঁর ব্যবহৃত কিছু শব্দ – ‘নতুন জীবন দৃষ্টি’, ‘অভিনব রুচি’, ‘চেতনার নতুন আকাশ’, ‘কুশলী স্রষ্টা’, ‘সুনিপুণ শিল্পী’, ‘দক্ষ রূপকার’ আবির্ভাবকালে এসব শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ কেবল হুমায়ূন আহমেদের প্রদীপ্ত প্রতিভাকেই শনাক্ত করেনি, বিপুলভাবে অভিনন্দিত করা হয়েছে তাঁকে। প্রাজ্ঞ পণ্ডিত আহমদ শরীফের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং আশাবাদ ব্যর্থ হয়নি। উত্তরকালে হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠেন জীবনরসিক, রূপদক্ষ এক অসাধারণ কথাশিল্পী।

গল্প, কবিতা লিখে হাত মক্শো করার কোনো ব্যাপার ছিল না, হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি উপন্যাস লিখেই সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য-অভিযাত্রার সূচনাপর্ব সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী লিখেছেন :

উনিশ শ’ সত্তরে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। মোহসিন হলের ৫৬৪ নং কক্ষের বাসিন্দা। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পড়তেই তিনি উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। তৈরি হয়ে যায় তিনটে পা-ুলিপি। যার একটি ‘নন্দিত নরকে’। অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আহমদ ছফা পা-ুলিপিটি দেখে মুগ্ধ হন। তাগিদ দেন প্রকাশের। … বাহাত্তরের শুরুর দিকে আহমদ ছফা আবার এগিয়ে আসেন। … আহমদ ছফাই হুমায়ূনকে খান ব্রাদার্সে নিয়ে যান। তাঁর অনুরোধেই খান ব্রাদার্স ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

(‘সালেহ চৌধুরী : ২০১৪’, পৃ ৬০-৬১)

নন্দিত নরকে বাহাত্তরে প্রকাশিত হলেও এটি রচিত হয় সত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের কারণে প্রকাশে বিলম্ব ঘটে। এ-সময় হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর পুরো পরিবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ শহিদ হন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে। প্রাণ বাঁচাতে মা এবং ছোট ভাইবোনকে নিয়ে ছুটতে হয় নানা আশ্রয়ের সন্ধানে। হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান। সে অন্য প্রসঙ্গ, নন্দিত নরকে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বছরের সেরা উপন্যাস হিসেবে লেখক শিবির কর্তৃক পুরস্কারে ভূষিত হয়। হুমায়ূন আহমেদকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নন্দিত নরকের সাফল্য শঙ্খনীল কারাগার প্রকাশের পথ সুগম করে দেয়। প্রকাশের দিক থেকে শঙ্খনীল কারাগার দ্বিতীয় হলেও এটিই ছিল হুমায়ূন আহমেদ-রচিত প্রথম উপন্যাস। নতুন লেখকের আবির্ভাব পর্বে এমন দিগ্বিজয়ের মতো ঘটনা সাহিত্যের ইতিহাসে খুব একটা ঘটেনি। হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আশির দশকে টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। তাঁর নাটক কেবল দর্শকের দৃষ্টি কেড়েছে তা নয়, হৃদয়ও জয় করতে সমর্থ হয়। টেলিভিশন নাটকের ধারণাই পালটে যায় হুমায়ূন আহমেদের হাতে। নববইয়ের দশকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন এবং এখানেও যথারীতি চূড়াস্পর্শী সাফল্য অর্জন করেন। হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে এদেশের প্রকাশনাশিল্প জেগে ওঠে, পাঠক তৈরিতে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি হয়। হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি নতুন বইয়ের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে পাঠক অপেক্ষায় থাকতেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি ক্রমাগত লিখে গেছেন, পাঠক-তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণ-আখ্যান, ব্যক্তিগত রচনা, আত্মজীবনী, রস-রহস্য, কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্র, ছবি আঁকা, ছোটদের রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, হিমু, শুভ্র, মিসির আলি, রূপা, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস – বিচিত্র সৃষ্টিসম্ভারে তিনি আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক থেকে জননন্দিত কথাশিল্পী।

প্রশ্ন করা যায়, তাহলে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের শিল্পসূত্র কী? কেন তিনি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন? তাঁর উপন্যাস পাঠককে এমন মোহগ্রস্ত করে কেন? তাঁর যে-কোনো উপন্যাস পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের যেন নিস্তার নেই। এমন কী জাদু আছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা আজ খুবই জরুরি। কারণ, সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যে যা দেখা যায় তা হচ্ছে, সমালোচনার নামে নিন্দা, অথবা ব্যক্তিতুষ্টির প্রশংসা। সাহিত্যের মোড়ল সেজে কেউ কেউ কোনটা সাহিত্য, কোনটা সাহিত্য নয় কিংবা কোন লেখা শিল্পহীন, কালের বিচারে টিকে থাকবে না – এসব রায় ঘোষণা করেন।

আসলে সাহিত্য-শিল্পে আদালতের রায় ঘোষণার মতো কিছু নেই। সাহিত্যের ইতিহাস বড়ই নির্মম। সমকালে যে-লেখক ছিলেন অসফল ও অপ্রিয়, কালান্তরে তিনি হয়ে ওঠেন প্রবল প্রতাপশালী, মহাকালের মহীরুহ। যেমন জীবনানন্দ দাশ। আবার এমনও দেখা গেছে, সমকালে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, লোকের ঘরে ঘরে ছিল তাঁর বই; কিন্তু কালের র্যাঁদার টানে কোথায় হারিয়ে গেছেন সেই জনপ্রিয় লেখক! সাহিত্যের ইতিহাসে কোথাও তাঁর নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। একসময় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, রোমেনা আফাজ, আকবর হোসেন কম জনপ্রিয় ছিলেন না। সাহিত্যের ইতিহাসে আজ কোথায় তাঁদের অবস্থান? শুধু বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যেও এরকম প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।

উপন্যাস শিল্পবিপস্নবোত্তর যুগের গৌরবময় এক শিল্পাঙ্গিক। উপন্যাস মূলত বিমিশ্র ভাষিক শিল্প। জীবনের প্রকাশই উপন্যাসের প্রধান উদ্দেশ্য। জীবন যেহেতু বিচিত্র এবং বহু রকম, তাই আঙ্গিক এবং গঠনকৌশলের দিক থেকেও উপন্যাস বহুভুজ হতে বাধ্য।

সাহিত্যের ইতিহাসে গদ্যের আবির্ভাবের সঙ্গে উপন্যাসের উদ্ভব কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। কারণ, গদ্যের মধ্যেই শোনা গিয়েছিল বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। গদ্যই ধারণ করেছিল একই সঙ্গে অনেক মানুষের শ্রম্নতি ও চেতনা।

উপন্যাস গদ্যেরই সমত্মান। গদ্যের গর্ভেই উপন্যাসের ভ্রূণ অঙ্কুরিত ছিল। বোঝা যায়, যত দিন পর্যন্ত মানুষের পারস্পরিক জীবনের সম্পর্ক বোধগম্য ছিল, ততদিন উপন্যাসের জন্ম হয়নি। কিন্তু একটা সময় থেকে দেখা গেল, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো আর বোঝা যাচ্ছে না, তাদের মধ্যে দ্বিধা, সংশয়, সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সমষ্টি-চেতনা থেকে ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার পর মানুষ পরস্পরের কাছে অচেনা, অস্পষ্ট ও জটিল হয়ে উঠছে। সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবনের প্রয়াস থেকেই উপন্যাসের জন্ম হয়। আধুনিককালে উপন্যাস তাই মহাকাব্যের বিকল্প পাঠ হয়ে ওঠে।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার গল্প, কবিতা, নাটক প্রভৃতি থেকে প্রকরণগত ভিন্নতার কারণে উপন্যাসের একটি পৃথক, স্বতন্ত্র রূপ গড়ে ওঠে। শিল্পের অন্যান্য শাখার চেয়ে উপন্যাস জীবনের সবচেয়ে নিকটতম শিল্পমাধ্যম। কারণ পলস্নবিত কথা বিস্তারেই উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। দল-বিকশিত পদ্মফুলের মতো উপন্যাস অগ্রসর হতে হতে জীবনকেই আবিষ্কার করে, জীবনকেই স্পর্শ করে। অর্থহীন জীবনকে সার্থকতা দান করে উপন্যাস। উপন্যাস পাঠের মাধ্যমে মানব সম্পর্ক ও সংঘাত স্বসিত্মকর হয়ে ওঠে। উপন্যাসের পাঠ-অভিজ্ঞতা মানুষকে সমাজের সঙ্গে অভিযোজিত করে, মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। যন্ত্র যুগের একাকিত্ব, জটিলতা, পরাভব মেনে নিতে উপন্যাস পাঠের বিকল্প নেই।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো উপন্যাস তার প্রারম্ভিক প্রকরণ নিয়ে আপন স্বভাবের মধ্যে স্থির ও স্থায়ী হয়ে থাকেনি। পরিবর্তিত সমাজ ও সময়ের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের রূপ-রীতির পরিবর্তন ঘটেছে। তাই সাহিত্যের এই সর্বাধুনিক শিল্প-প্রকরণ উপন্যাসকে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা-সূত্রে আবদ্ধ করা যায় না। তবু ই এম ফস্টার, র‌্যাফল ফক্স, মিখাইল বাখতিন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবীপদ ভট্টাচার্য, রণেশ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায় প্রমুখ উপন্যাসকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসের শিল্পরূপের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করে লিখেছেন মূল্যবান গ্রন্থ। উপন্যাসতাত্ত্বিকেরা সার্থক উপন্যাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উলেস্নখ করেছেন। যেমন –

১।     পস্নট বা আখ্যানভাগ

২।     কাহিনি বা ঘটনাংশ

৩।    চরিত্র-চিত্রণ

৪।     বিষয় বা জীবনদর্শন

৫।     ভাষা বা বর্ণনাভঙ্গি

গঠনরীতির এসব আবশ্যকীয় শর্তাবলি একটি উপন্যাসকে মহৎ ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করে সত্যি কিন্তু শর্তাবলির শক্ত দড়িতে বাঁধা পড়লে মহাকাব্যের মতো উপন্যাসেরও অপমৃত্যু ঘটত। জীবনের প্রকাশ যেমন বহু রকম, উপন্যাসও তাই পূর্বনির্ধারিত সব সংজ্ঞা-সূত্রকে অতিক্রম করে ক্রমচলিষ্ণু রূপাঙ্গিক নিয়ে বহুভুজ জীবনের কলস্বর হয়ে উঠেছে।

বাংলা উপন্যাসের দীঘল ঐতিহ্যকে অঙ্গীকার করেও পৃথক ভূখ- হিসেবে বাংলাদেশের উপন্যাসের একটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের উপন্যাসকে সমকালীন প্রতীচ্যের সাহিত্যতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা – স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম, ওরিয়েন্টালিজম, পোস্টমডার্নিজম, পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং ডিকনস্ট্রাকশন ডিসকোর্স থেকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশেষত, মিখাইল বাখতিনের (১৮৮৫-১৯৭৫) যুগান্তকারী উপন্যাসতত্ত্বের (ডায়ালোজিজম) আলোকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পাঠ করলে আমাদের সামনে খুলে যায় অনেকগুলো দরজা, বহু দিগন্ত। মিখাইল বাখতিন তাঁর The Dialogical Principle (১৯৮৪) গ্রন্থে বলেছেন, ‘জীবন যেহেতু সময় এবং পরিধির মধ্যে অবস্থান করে, তাই মানুষের কোনো উচ্চারণই একবাচনিক নয়, দ্বিবাচনিক।’ ব্যক্তি বা সত্তা তখনই অসিত্মত্ববান হয়ে ওঠে, যখন সে অপর সত্তার দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়। সত্তা এবং অপরতার পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় দ্বিবাচনিকতা। এভাবে ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তা, লেখকসত্তা ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সংলাপ মিলেমিশে উপন্যাসে যে-পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাকে বাখতিন বহুস্বরসংগতি বলে অভিহিত করেছেন। ‘সংলাপ’ বা উচ্চারণকে মিখাইল বাখতিন অসিত্মত্বের ঘোষক হিসেবে অভিহিত করে ‘ভাষাকে’ একটি দার্শনিক ভিত্তি দান করেছেন। বাখতিনের ডিসকোর্সের আলোকে দেখলে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাঠ আমাদের কাছে নতুন তাৎপর্য নির্মাণে সাহায্য করতে পারে।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মৌলিক শিল্পসূত্র হচ্ছে ভেতরের গল্পত্ব, story telling বা গল্প বলার অসাধারণ কৌশল। তাঁর উপন্যাসের ভেতরে একটা জমজমাট গল্প থাকে। গল্প ছাড়া উপন্যাস মূল্যহীন, অসাড়।

E M Forster Zuvi Aspects of the Novel (১৯২৭) গ্রন্থে বলেছেন, ‘উপন্যাসের মৌলিক বিষয় হচ্ছে এর গল্প। অর্থাৎ কাহিনি হচ্ছে উপন্যাসের মৌলিক উপাদান, যা না থাকলে এর অসিত্মত্বই থাকে না।’ (E M Forster : 1927, P 31) হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি উপন্যাসে থাকে সুন্দর, নিটোল একটি কাহিনি। উপন্যাসের কাহিনির প্রতি তাঁর যত্নশীল পরিচর্যা বিস্ময়কর। কাহিনি তিনি গড়ে তোলেন শরীরের মেরুদ–র মতো। আদি-মধ্য-অন্ত খ–ত কাহিনি হলেও কোন জায়গা থেকে তিনি কাহিনি শুরু করবেন, কোথায় গিয়ে সমাপ্তি টানবেন, ঔপন্যাসিক প্রবুদ্ধি দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জানেন, উপন্যাসে পাঠক গল্প শুনতে চায়, সে-গল্প হবে কৌতূহলোদ্দীপক। পাঠকের গল্পপিপাসু মন আকস্মিক ঘটনার প্রত্যাশী, যা তাঁর মনে কেবল উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখবে। এরপর কী ঘটবে? হুমায়ূন আহমেদ পাঠকমনের এ-জায়গাটায় খুব গুরুত্বের সঙ্গে শৈল্পিক পরিচর্যা করেছেন। অতি সূক্ষ্ম, সংক্ষিপ্ত সংলাপ কিংবা বাক্যের কুশলী প্রয়োগ করেন তিনি, যার মধ্যে তাঁর অপূর্ব উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। আবেগকে যথাযথভাবে সংযত, সংহত ও পরিশ্রম্নত করে কাহিনির অনুকূলে প্রবাহিত করে দেওয়ার শৈল্পিক দক্ষতাই হুমায়ূন আহমেদকে সাফল্যের তূরীয় স্তরে পৌঁছে দিয়েছে।

ই এম ফস্টারের মতে, ‘স্টোরি টেলিং’ হবে উপন্যাস গঠনের প্রধান মানদ-।’ সেদিক থেকে বিচার করলে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের শিল্পত্ব লুকিয়ে আছে তাঁর সুনিপুণ কাহিনি নির্মাণের মধ্যে।

কাহিনি বলতে আসলে কী বোঝায়?

কাহিনি হচ্ছে সময়ক্রম অনুসারে ঘটনাবলির বর্ণনা। অর্থাৎ প্রভাতের পর দুপুর, তারপর সন্ধ্যা – এই ধারাবাহিকতা থাকা। কাহিনিতে যা বলা হয়, তা হচ্ছে সময়ের অন্তর্গত জীবনের বর্ণনা। এই বর্ণনার মধ্যে একটা ‘বি-ন্যাস’ অর্থাৎ বিশেষভাবে বিন্যাস থাকতে হয়। কারণ ‘উপন্যাস’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘ন্যাস’ শব্দের সঙ্গে ‘উপ’ উপসর্গ যোগে। ঔপন্যাসিককে তাই ঘটনা বিন্যাসে বিশেষ মনোযোগী হতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কাহিনিতে একের পর এক ঘটনা এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যে, পাঠককে উৎকণ্ঠায় রেখে তার উদ্দীপ্ত কৌতূহলকে ব্যবহার করে অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটান তিনি। এই আশ্চর্য কৌশলই হুমায়ূন আহমেদের ‘স্টোরি টেলিং’য়ের চৌম্বক শক্তি।

এছাড়া ভাষাগত দিকটি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের প্রধান গৌরব হচ্ছে সাবলীল গদ্য। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও শুরু থেকেই হুমায়ূন আহমেদ ছোট ছোট বাক্যের স্বচ্ছন্দ গতিময় এক গদ্যভাষা রপ্ত করে নেন। নিরাভরণ, সহজ-সরল গদ্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও আমাদের এখানে সাহিত্যের ভাষা ছিল আরবি, ফার্সি, তৎসম, তদ্ভব শব্দের মিশেল। স্বাধীনতা-উত্তর সত্তরের দশকে হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস লিখতে এসে ওই প্রথাগত গদ্যের সড়কে পা বাড়াননি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তৈরি করলেন তাঁর উপন্যাসের কাহিনির উপযোগী এক গদ্যভাষা, যা শীলিত, পরিমার্জিত, সাবলীল, সজীব, প্রাণবন্ত নাগরিক গদ্যভাষা। অজটিল, পরিপাটি প্রসাদগুণ এ-ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেমন –

মা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন। দরজা খোলা, চোখে পড়ল মায়ের বিছানায় রাবেয়া শুয়ে আছে। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম, এবোরশন নাকি? কাকে দিয়ে কী করালেন? নাকি নিজে নিজে কিছু খাইয়ে দিয়েছেন? বাবা ধরা গলায় বললেন, খোকা তুই মাথায় একটু হাওয়া কর। আমি একজন বড় ডাক্তার নিয়ে আসি। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।

… আর কী আশ্চর্য! বেলা ন’টায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া। তখন চারদিকে শীতের ভোরের কী ঝকঝকে আলো।…

বারোটার দিকে ফিরে এলেন মাস্টার কাকা। সঙ্গে শহর থেকে আনা বড় ডাক্তার। আর মন্টু, দিনেদুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালাফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ কাটার বঁটি দিয়ে। পাশের দোকান থেকে দৌড়ে এলো দু-তিনজন। একজন রিকশাওয়ালা রিকশা ফেলে ছুটে এলো। ওভারশিয়ার কাকুর বড় ছেলে জসীম দৌড়ে এলো। ডাক্তার সাহেব চেঁচাতে লাগলেন ‘হেল্প! হেল্প!’ চিৎকার শুনে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম, বঁটি হাতে মন্টু দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে আছে কজন মিলে। রক্তের একটা মোটা ধারা গড়িয়ে চলছে নালায়। মন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দাদা ওকে আমি মেরে ফেলেছি।’

(নন্দিত নরকে, পৃ ৪৭-৪৯)

 

নন্দিত নরকে উপন্যাসের মূল গল্প এটুকুই কিন্তু কাহিনিবর্ণনায়, ঘটনাবিন্যাসে হুমায়ূন আহমেদের পরিমিতিবোধ, নির্লিপ্ত পরিবীক্ষণ আশ্চর্য হওয়ার মতো। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র খোকা। খোকার আত্মকথনে উপন্যাসের পুরো কাহিনি বর্ণিত। উদ্ধৃতির মধ্যে রাবেয়ার নিঃশব্দ মৃত্যু এবং মাস্টার কাকাকে মন্টু মাছ কাটার বঁটি দিয়ে ‘ফালাফালা’ করে হত্যা করার মতো হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে দেখেও খোকা নির্বিকার থাকে। তার মধ্যে আবেগের কোনো আতিশয্য নেই, উত্তেজনার বিদ্যুৎচ্চমক নেই। বরং সব ঘটনার যেন সে নীরব দর্শক এবং সাক্ষী। চরম মুহূর্তেও আবেগকে সংহত করে প্রকাশ করার অনবদ্য গদ্যভাষা পাঠককে বিমোহিত করে। যেমন – ‘বেলা ন’টায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া তখন চারদিকে শীতের ভোরের কী ঝকঝকে আলো।’

মৃত্যুর বর্ণনা এত সংক্ষিপ্ত, নির্লিপ্ত হতে পারে, তা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এই যে সংক্ষিপ্ত কথন কিন্তু বিসত্মৃত ভাবের প্রকাশ, এই বৈশিষ্ট্যই তাঁর গদ্যভাষাকে দীপ্তি দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের হাতেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্য একটা জনমুখী চেহারা পেতে শুরু করে। যেমন –

‘দিনেদুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালাফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ কাটার বঁটি দিয়ে।’

এই বাক্যের শব্দগুচ্ছ ‘দিনেদুপুরে’, ‘ফালাফালা’, ‘মাছ কাটার বঁটি দিয়ে’ একান্তই নাগরিক মধ্যবিত্তের পরিপাটি ভাষা। সত্তরের দশকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক যে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, এই ভাষা সেই কলেস্নালিত জীবনেরই সজীব, প্রাণবন্ত ভাষা। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের গদ্যভাষা ছিল এরকম অকৃত্রিম, অনবদ্য, সাবলীল। সহজবোধ্য এ-ভাষার মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার রহস্য লুকিয়ে আছে।

বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী তার সম্পাদিত সবুজপত্রে (১৯১৪) যেমন উনিশ শতকের গুরুগম্ভীর সাধুভাষার গদ্যকে সরিয়ে চলিত ভাষা প্রচলনের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নতুন ঋতুর আগমন ঘটিয়েছিলেন, তেমনি হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর কথাসাহিত্যে একটা ঝরঝরে, চৌকস, দ্যুতিময় গদ্যভাষা নিয়ে হাজির হন, যা পাঠকের চোখে অনাস্বাদিত নতুনত্বের বিস্ময় ফুটিয়েছিল। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে লেখা বাদশা নামদার (২০১১) উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে এভাবে :

ফিনিক ফোটা জোছনাস্নাত রজনী। হুমায়ূনপত্নী হামিদা বানু অচেনা এক বৃক্ষে হেলান দিয়ে বসে আছেন। হুমায়ূন কোনো কারণ ছাড়াই বৃক্ষের চারপাশে ঘুরছেন।

সম্রাট একা আসেননি। তাঁর নিরাপত্তার জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে বৈরাম খাঁ এসেছেন। সেনাবাহিনী দৃষ্টির আড়ালে আছে।

হুমায়ূন বললেন, হামিদা আনন্দ পাচ্ছ?

হামিদা জবাব দিল না। ওই রাতেই তিনি খিলখিল করে হাসছিলেন। আজ তাঁর চোখভর্তি অশ্রম্ন।

হুমায়ূন হঠাৎ লক্ষ করলেন, হামিদা বানু যেখানে বসে আছে তার উল্টো দিকে দুটি কিশোরী মেয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। এদের তিনি চেনেন। একজন তাঁর কন্যা আকিকা বেগম। অন্যজন তার বান্ধবী। যার নাম মনে পড়ছে না। সম্রাট নিশ্চিত আফিমের নেশার কারণে হয়তো এ ধরনের বিভ্রম তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছে। এই মেয়ে এবং তার বান্ধবীকে তিনি রাজপ্রাসাদেও কয়েকবার দেখেছেন। হুমায়ূন তাদের দিকে কয়েক পা এগোতেই মেয়ে দুটি খিলখিল করে হেসে দৌড়ে পালাল। হামিদা বানু চমকে উঠে বললেন, কে হাসে? কে হাসে?

হুমায়ূন বললেন, কেউ হাসে না হামিদা। হিন্দুস্থানে এক বিচিত্র পাখি আছে, যখন সেই পাখি ডাকে, মনে হয় কিশোরী মেয়ে হাসছে। হিন্দুস্থান অতি অদ্ভুত দেশ।

হামিদা বানু বললেন, আপনি কি আমার হাত ধরে একটু বসবেন? হঠাৎ পাখির ডাক শুনে ভয় পেয়েছি।

হুমায়ূন স্ত্রীর পাশে এসে বসেছেন। তাঁদের গায়ে অবাক জোছনা গলে গলে পড়ছে। দুজনই অপেক্ষা করছেন হিন্দুস্থানের অদ্ভুত পাখির ডাক আরেকবার শোনার জন্য।

রাজা যায় রাজা আসে। প্রজাও যায়, নতুন প্রজাও আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ক্ষুধার্ত সময় সব কিছু গিলে ফেলে, তবে ‘গল্প’ গিলতে পারে না। গল্প থেকে যায়।

 

হুমায়ূন আহমেদের গদ্যভাষার এই সহজাত প্রাঞ্জলতা, তাঁকে সহজেই পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে। সচল, ফুরফুরে প্রাঞ্জল ভাষা, ছোট ছোট বাক্যের মধ্য দিয়ে তাঁর উপন্যাসের কাহিনি তরতরিয়ে এগিয়ে যায়। পাঠকের মনের ভেতর পৌঁছে যায় অনায়াসে। পড়ার প্রতিটি মুহূর্তে পাঠকের মনে এক ধরনের রম্য উৎসাহ আর চনমনে অনুভূতি কাজ করে। রম্যতার আমেজ, প্রচুর হিউমারই তাঁর উপন্যাসকে জনপ্রিয় করেছে। আমার ধারণা, অফুরন্ত কৌতুকরস, বিরতিহীন বিনোদনের রম্যতা গুণই হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার প্রধান উৎস।

আবদুলস্নাহ আবু সায়ীদ তাঁর ‘জনপ্রিয় লেখকরা কি অলেখক?’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

বাংলা সাহিত্যে অনেক জনপ্রিয় লেখক এসেছেন কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের সমান জনপ্রিয় কেউ হননি। এ ব্যাপারে তাঁর সাফল্য একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি দাবি করে। তাঁর যে কোনো বই বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায় চলিস্নশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কপি। আমাদের সাহিত্যের হতদরিদ্র প্রেক্ষাপটে এই সংখ্যা সত্যি অবিশ্বাস্য।…

হুমায়ূন আহমেদ কেবল বাংলাদেশ নয়, বাংলা সাহিত্যের এযাবৎকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক, পাঠকপ্রিয়তা বা বইয়ের কাটতির দিক থেকে তাঁর অবস্থান আজ তুঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, এমন বিপুল, জননন্দিত লেখক হওয়ার পরও প্রায় কোনো ভালো লেখক বা পাঠক তাঁকে ‘লেখক’ মনে করেন না। খুবই সাধারণ মাপের লেখক মনে করেন। মনে করেন এমন গড়পড়তা লেখক, যিনি কিছুদিনের মধ্যেই সাহিত্যের জগৎ থেকে পুরোপুরি অবলুপ্ত হয়ে যাবেন। কেন এমনটা হবে? তাহলে জনপ্রিয়তার গুণ আর লেখকের গুণ আলাদা?

(‘আবু সায়ীদ : ২০১৩’, পৃ ১৮)

আবদুলস্নাহ আবু সায়ীদ বিদগ্ধ, গভীরতাস্পর্শী একজন লেখক। তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে বিশেস্নষণ করে দেখিয়েছেন, ‘জনপ্রিয় সাহিত্য’ এবং ‘কালজয়ী স্মরণীয় সাহিত্যে’র মধ্যে পার্থক্য আসলে কী? ওই দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার সারৎসার হচ্ছে – একজন লেখক ‘জনপ্রিয়’ হন দুটি কারণে। এক. বড় লেখকদের সমৃদ্ধ উপলব্ধি জগৎ তাঁদের ভেতর থাকে না বলে। দুই. তাঁদের মধ্যে শিল্পের উচ্চতর সম্পন্নতা থাকে না বলে। অর্থাৎ জনপ্রিয় লেখকদের লেখা পড়তে সুখকর, পড়লে আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু তাঁদের লেখা অমত্মঃসারশূন্য, জলো, স্থায়িত্ব বলে তাতে কিছু থাকে না। বিনোদনের মচমচে স্বাদ, যার অপ্রতিহত আকর্ষণে পাঠককে তাঁর কাছে টেনে নিয়ে যায়, ঝাঁজালো সম্মোহনে আচ্ছন্ন করে রাখে। রোমান্টিক প্রেম, চটুল গল্পের ফাঁদে ফেলে বা সুড়সুড়ি লাগা যৌনতার প্রলেপ দিয়েও কেউ কেউ সাহিত্যের বাজারে জনপ্রিয় হতে পারেন।

অন্যদিকে নন্দনতাত্ত্বিকরা শিল্পের যে-দেহকান্তির কথা কল্পনা করেছেন, তার নাম হচ্ছে অনিন্দ্যসুন্দর। জীবনোপলব্ধি, অন্তর্দৃষ্টি, শিল্পবোধ, যা পাঠকের হৃদয়ে আনন্দ-আবেগ জাগিয়ে তুলতে না পারলে, তা শিল্পের পর্যায়ে উঠে আসে না। যে-নয়টি রসের কথা নন্দনতাত্ত্বিকরা বলেছেন, কোনো লেখার মধ্যে যে-কোনো একটি একাধিক রস সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়ে পাঠকের হৃদয়ে আনন্দময় অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারলেই তা শিল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হয়। শিল্পের সেই সোনালি দরজা, যার ভেতর দিয়ে শিল্পী তাঁর বক্তব্যকে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিতে পারেন, রসসিক্ত করে পরিবেশন করতে পারেন, তিনিই শিল্পী। শেক্সপিয়ার, সফোক্লিস, ইবসেন, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, বিভূতি, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ শিল্পের সেই উঁচু শিখরকে স্পর্শ করতে পেরেছেন বলেই তাঁরা আজ পর্যন্ত মানুষের কাছে নন্দিত, সম্মোহিত। এর কারণ তাঁদের লেখার ভেতরকার অসাধারণ শিল্পশক্তি, যা চিরায়ত, কালোত্তীর্ণ। শিল্পে যার নাম লাবণ্য, দ্যুতিময় বৈভব বলে।

হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা দোষ না গুণ?

বিশিষ্ট সাংবাদিক, হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলির সম্পাদক, তাঁর নিত্য সহচর সালেহ চৌধুরীর মতে, আদতে সাহিত্যের আলোচনায় ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক এবং এই দ্ব্যর্থতা পরস্পরবিরোধী। এক অর্থে সস্তা নিম্নরুচির পরিচায়ক, অন্য অর্থে পাঠকনন্দিত। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা এই দ্বিতীয় ইতিবাচক অর্থে সত্য।

(‘সালেহ চৌধুরী : ২০১৪’, পৃ ৬৩)

কোন শক্তির গুণে হুমায়ূন আহমেদ এমন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন? বিদগ্ধ সমালোচক, প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ একবার পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তের থেকে ত্রিশ বছরের অপরিণত কিশোর-তরুণ-তরুণীরাই হুমায়ূন আহমেদের প্রধান পাঠক। তারা মাতালের মতো, পাগলের মতো, উন্মাদ মৌমাছিদের মতো বইমেলায় ছুটে যায়। দীর্ঘ লাইন ধরে অটোগ্রাফ নেয়, হুমায়ূন আহমেদের বই কেনে।’ এই মাতাল পাঠকদের একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল – ‘তোমরা হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে কেন? উত্তরে ওই তরুণ, বিপুল পাঠকগোষ্ঠী জবাব দিয়েছিল – ‘তাঁর লেখা ভালো লাগে। পড়লে আনন্দ পাই। জীবন নতুনভাবে তুলে ধরে আমাদের সামনে। জীবনকে নতুন করে দেখায়। আমাদের প্রসারিত করে। মনকে বড় করে।’ তরুণ-তরুণীদের উত্তরের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখার একটা সরল মূল্যায়ন আছে।

তথাকথিত সাহিত্যের বিদগ্ধ এবং রুচিশীল পাঠকদের তিনি হয়তো তৃপ্ত করতে পারেননি, কিন্তু দেশের বিপুল ও সাধারণ পাঠকশ্রেণির মনকে আনন্দে, সজীবতায় উজ্জীবিত করতে পেরেছেন, এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে? আমার মনে হয় ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। আসলে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মূলত পাঠকপ্রিয় লেখক। তাঁর লেখায় যদি পাঠকদের ‘প্রিয়’ কিছু না থাকত তবে মানুষ নিজের পকেটের নগদ টাকা খরচ করে তাঁর বই কিনত না। তিনি ব্যাপক পাঠক চিত্তকে জয় করে নিয়েছেন তাঁর লেখার অসাধারণ প্রসাদগুণ দিয়ে। নিজস্ব শ্রম, সাধনা ও নিষ্ঠা দিয়ে অর্জন করেছেন সাফল্যের অভিজ্ঞানপত্র। তাঁর স্মৃতিকথনমূলক রচনা থেকে জানা যায় তাঁর আশৈশব সাহিত্যপ্রীতি ও পাঠাভ্যাসের কথা। এছাড়া পিতার বদলির চাকরিসূত্রে ছোটবেলা থেকে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, জীবন ও জগৎ পর্যবেক্ষণের অনন্য সুযোগ পেয়েছেন। সুতরাং সাহিত্যে আবির্ভাবের পূর্বে তাঁর প্রস্তুতি পর্ব ছিল বেশ দীর্ঘ এবং সম্পন্ন এক প্রস্তুতি। হুমায়ূন আহমেদের মেধা এবং প্রতিভার কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। তাঁর শিক্ষাজীবনের কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট এবং বিচিত্র, বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল কর্মকা–র মধ্যেই তা বিধৃত। তাঁর শিল্পসিদ্ধির কারুকার্যময় রস-রহস্যজগতে যে-কেউ একবার প্রবেশ করলেই মুগ্ধ, বিহবল হবেনই।

যদিও, ‘বাজারি লেখক’, ‘তুচ্ছ লেখক’ বলে সমকালে অনেকে তাঁকে নিন্দা-মন্দ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘ফাউন্টেনপেন’ (২০১১) আত্মজীবনীমূলক রচনায় জুতসই জবাব দিয়ে গেছেন –

বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধির লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশির ভাগের ধারণা, তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।…

কালজয়ী এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা –

কালজয়ী : কেমন আছেন?

আমি : জি ভালো।

কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?

আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি।

যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বসিত্মতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লিখতে পারি।

কালজয়ী : (গম্ভীর)

আমি : আপনি কি মহান কোনো লেখায় হাত দিয়েছেন?

কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।

… টেলিফোন এসেছে। কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ। হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছেন।

কে শুয়েছেন?

বদরুদ্দিন ওমর।

সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়ালে। উনি বলেছেন আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নেই।

এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম ‘কোয়ান্টাম রসায়ন’। সম্ভবত উনার চোখ এড়িয়ে গেছে।

…এখন শিক্ষা বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সবকিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটক-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদের প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতে আমি লিখে দিতাম, ‘এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।’

(‘হুমায়ূন : ২০১১’, পৃ ১১-১২)

হুমায়ূন আহমেদের শিল্পসত্তার ধরন বোঝাতেই উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি ব্যবহার করলাম। তাঁর কথাসাহিত্যে গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায় চরিত্র সৃজনের মধ্যে। লেখালেখির প্রথমদিকে তিনি পরিবারনির্ভর কাহিনির ভিত্তিতে উপন্যাস রচনা করলেও ক্রমশ তিনি উপন্যাসের বিষয় এবং পটভূমির পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনের পাশাপাশি তিনি লোকজীবন, লোকসংস্কৃতিতে, গভীরভাবে মনোযোগী হন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট অঞ্চলের সমাজজীবন তাঁর রচনায় নানাভাবে উঠে এসেছে। ভাটি অঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক মানসের জমিদার, বাউল, ফকির, গাতক, দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামীণ তাঁর লেখায় বিশেষভাবে স্থান করে নেয়। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার আঞ্চলিক ভাষা-বুলি, নান্দাইল, নীলগঞ্জ, গফরগাঁও, পাকুন্দিয়া, গৌরীপুর প্রভৃতি গ্রাম, স্থানের নাম হুমায়ূন আহমেদের লেখায় শৈল্পিক স্থাপত্য লাভ করেছে।

কাহিনি-সৃজন এবং কাহিনি-বর্ণনায় হুমায়ূন আহমেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পসিদ্ধির কথা সর্বজন স্বীকৃত। আশির দশকের শেষের দিকে এসে তিনি কাহিনিনির্ভর উপন্যাস রচনা থেকে সরে এসে চরিত্রনির্ভর উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এ-সময়ে তিনি টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। টেলিভিশন নাটকেও অভূতপূর্ব সফলতা, খ্যাতি, জনপ্রিয়তা অর্জিত হয়।

উপন্যাস লিখতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যের প্রথাগত প্রচলিত পথে হাঁটেননি। নিজেই উদ্ভাবন করেন উপন্যাস রচনার নিজস্ব শিল্পকৌশল। হুমায়ূন আহমেদ-অনুসৃত উপন্যাসের শিল্পরীতিগুলো হচ্ছে –

১। আত্মকথন রীতি বা উত্তম পুরুষে বর্ণিত রীতি।

২। চরিত্র কথনরীতি।

৩। বর্ণনামূলক রীতি

৪। নাট্যগঠন রীতি।

ঘটনাপ্রধান, পরিবারভিত্তিক উপন্যাসগুলোতে হুমায়ূন আহমেদ আত্মকথন বা উত্তমপুরুষে বর্ণিত রীতিকে ব্যবহার করেছেন। যেমন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি,       কোথাও কেউ নেই ইত্যাদি। চরিত্রকথনরীতির উপন্যাসগুলোতে তিনি সংলাপের মাধ্যমে যেমন চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলেন, তেমনি ঘটনাপ্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যান। চরিত্রের নাটকীয় মোড় পরিবর্তন ও কাহিনির সফল পরিণতি দান করতে এ-পদ্ধতির জুড়ি নেই।

মিসির আলি এবং হিমু চরিত্র সিরিজের উপন্যাসগুলোতে হুমায়ূন আহমেদ এই চরিত্রকথনরীতির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বর্ণনামূলক রীতির উপন্যাসেও হুমায়ূন আহমেদ অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। বর্ণনার ধরাবাঁধা পথে তিনি হাঁটেননি। কাহিনি বর্ণনার প্রথাবদ্ধ পথে চলার বাধ্যবাধকতা না থাকায় পাঠক নিজের কল্পনাকে অবাধে মেশানোর সুযোগ পান বলে পাঠক নিজেই একাত্ম হয়ে ওঠেন। এ-ধারার উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে জোছনা ও জননীর গল্প, বাদশা নামদার, দেয়াল, মধ্যাহ্ন ইত্যাদি। নাট্যগঠনরীতির উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সংলাপের পথ ধরে পৌঁছে যান চরিত্রের গভীরে। উঠে আসে আবেগ আর অনুভূতির চিরন্তন সত্যগুলো। মানবজীবনের চিরন্তন সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকারে ঘেরা জীবনের আত্মোন্মোচন ঘটে এ-পদ্ধতিতে। কথাসাহিত্যের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে চরিত্র সৃষ্টির ওপর। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হয়, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা কথাসাহিত্যে বেশকিছু অবিস্মরণীয় চরিত্র উপহার দিয়েছেন। হিমু, মিসির আলি, শুভ্র, রূপা – কালজয়ী, প্রভাবসঞ্চারী অমর চরিত্র। তাঁর উপন্যাসের আঙ্গিক-প্রকরণের নিরীক্ষাও কম নয়। যে-আঙ্গিকেই তিনি সাহিত্য রচনা করেন না কেন, আগাগোড়াই তাঁর সাহিত্য দ্যুতিময়। কোনো লেখকেরই সব রচনা সেরা হয় না, সমান মর্যাদা পায় না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বৈশিষ্ট্য, তাঁর সব ধরনের লেখার মধ্যে একটা সাধারণ মান বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন। এভাবে যুগের সব অভিজ্ঞানকে আত্মস্থ করে তিনি হয়ে ওঠেন সমকালের আশ্চর্য এক কথক। r