হুমায়ূন : এক আশ্চর্য প্রতিভার গল্

আনিসুল হক
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দুজন লেখকের নাম পাড়ব। একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আরেকজন সতীনাথ ভাদুড়ী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও হুমায়ূন আহমেদ দুজনেরই অতি অল্প বয়সের লেখা আশ্চর্য পরিমিত ও পরিণত। এরকম উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে এবং বাংলা সাহিত্যে নিশ্চয়ই আরো পাওয়া যাবে, কিন্তু আমি হুমায়ূন আহমেদের সহজাত প্রতিভার কথা বলতে গিয়ে মানিককেই বেছে নিচ্ছি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক হওয়ার গল্পটা এরকম :
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সদ্য আইএসসি পাস করেছেন। তারপর ভর্তি হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিএসসি পড়তে। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা চলছে। একজন সহপাঠী বললেন, নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে পত্রিকাওয়ালারা লেখা ছাপায় না।
আরেকজন সহপাঠীর লেখা গল্প বিভিন্ন কাগজ থেকে ফিরে এসেছে অমনোনীত হয়ে। তিনি সম্পাদকদের উদ্দেশে কটুকাটব্য করতে লাগলেন।
মানিক বললেন, ‘বাজে বকছ কেন? নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে কাগজওয়ালারা লেখা ছাপে না! এটা হতে পারে না। ভালো লেখা হলে ছাপবে না কেন?’
‘আমারটা ছাপে নি।’
‘তোমারটা ভালো হলে নিশ্চয়ই ছাপা হতো?’
‘মুরোদ থাকলে লিখে ছাপিয়ে দেখাও।’
‘ঠিক আছে। তাই হবে। আমি নিজে গল্প লিখব আর তিন মাসের মধ্যে কোনো বিখ্যাত কাগজে গল্প প্রকাশ করে দেখাব তোমাদের ধারণা কত ভুল।’
‘বাজি?’
‘বাজি।’ এই বাজি ধরেই মানিক লিখে ফেললেন তাঁর প্রথম গল্প অতসী মামী। তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে। জমা দিয়ে এলেন তখনকার বিখ্যাত মাসিকপত্র বিচিত্রায়।
সেই গল্প পড়ে পত্রিকার সম্পাদক নিজে চলে এলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডেরায়, লেখকের হাতে কুড়ি টাকা দিয়ে বললেন, ‘আরও একটা গল্প চাই।’ (তথ্য-উৎস : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ দে, মানিকবিচিত্রা, সাহিত্যম)

সেটা ১৯২৮ সালের কথা। তখন তার বয়স মাত্র ২০। ১৯২৯ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি লিখতে শুরু করেন উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য। এই উপন্যাসটি পড়লে আপনার মনেই হবে না যে লেখক এত তরুণ। এই উপন্যাসেই আছে সেই অমোঘ উক্তি : ‘কতকাল স্থায়ী হয় ভালবাসা? প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার। প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত না। প্রেমের জন্ম আর মৃত্যুর ব্যবধান বেশি নয়।’ এই কথা মাত্র ২১ বছর বয়সী একজন মানুষ বলতে পারে?
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ নন্দিত নরকে লিখেছিলেন ১৯৭০ সালে। তখন তিনিও ছাত্র এবং তার বয়স ২২। নন্দিত নরকে বই হিসেবে প্রথমে বেরোলেও শঙ্খনীল কারাগার লেখা হয়ে গিয়েছিল তারও আগে।
নন্দিত নরকে পড়তে গেলেও মনে হবে, অতো অল্প বয়সে একজন প্রায় কিশোর এই রকম একটা পরিমিত ও পরিণত উপন্যাস লিখলেন কী করে! বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।
অল্প বয়সে সাহিত্যচর্চা অনেক লেখকই করেছেন। তাদের অনেকেই সফল হয়েছেন প্রথম কাজটিতেই। কেউ বা কেবল তরুণ বয়সেই লিখেছেন, পরে আর লেখেননি। যেমন ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবো।
আমাদের হাতের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় যারা, তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর নাম নেওয়া যাবে। এঁদের প্রথম দিকের লেখাগুলোকে শ্রেষ্ঠ কিংবা প্রতিনিধিত্বশীল লেখা বলা বেশ মুশকিলই হবে। জীবনানন্দ দাশের ওপরে ছিল মোহিতলাল মজুমদার আর কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব, বুদ্ধদেব বসুর মর্মবাণীকে তার তপস্বী ও তরঙ্গিনী কিংবা মরচে পড়া পেরেকের গানের সঙ্গে তুলনাই করা যায় না।
কিন্তু মানিক ও হুমায়ূন দুজনেই প্রথম দিন থেকে প্রমাণ দিচ্ছিলেন যে, তারা জন্মেছেন প্রতিভা নিয়ে।
নন্দিত নরকে উপন্যাসে একটা খুনের ঘটনা ঘটে। মন্টু খুন করে মাস্টার সাহেবকে।
সেই বর্ণনা এত পরিমিত, লেখক সেখানে এত নির্লিপ্ত যে মনে হয় বরফের ছুরি চালাচ্ছেন একজন সার্জন।
‘বারোটার দিকে ফিরে এলেন মাস্টার কাকা। সঙ্গে শহর থেকে আনা বড় ডাক্তার। আর মন্টু দিনে-দুপুরে অনেক লোকজনের মধ্যে ফালা ফালা করে ফেলল মাস্টার কাকাকে একটা মাছ-কাটা বঁটি দিয়ে। পানের দোকান থেকে দৌড়ে এল দু তিনজন। একজন রিকশাওয়ালা রিকশা ফেলে ছুটে এল। ডাক্তার সাহেব চেঁচাতে লাগলেন, হেল্প! হেল্প!
চিৎকার শুনে বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম, বঁটি হাতে মন্টু দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তাকে জাপ্টে ধরে আছে কজন মিলে। রক্তের একটা মোটা ধারা গড়িয়ে চলেছে নালায়। মন্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
আমার মনে পড়ল হা¯œাহেনা গাছের নিচে মন্টু একটা সাপ মেরেছিল।’
এরপরে আমরা পাব মন্টুর সাপ মারার বর্ণনা। মন্টু যে একজন মানুষকে খুন করেছে, সেই-বর্ণনাটা প্রায় লুকিয়েই ফেলা হলো। পিটিয়ে সাপ মারার বর্ণনা থেকেই পাঠককে বাকিটা বুঝে নিতে হবে।
মন্টুর ফাঁসির পর তার লাশ নেবার জন্য খোকা তার বাবা, মা, বোনকে নিয়ে জেলখানায় যায়। সেইসব বর্ণনা অপূর্ব।
যদিও থিমটা হয়তো হুমায়ূন পেয়েছিলেন সতীনাথ ভাদুরীর জাগরী থেকে। সতীনাথ ভাদুরী যে হুমায়ূনের প্রিয় ঔপন্যাসিক এটা আমরা পরবর্তীকালে তাঁর লেখা থেকে জেনেছি।
কিন্তু হুমায়ূনের বর্ণনা হুমায়ূনের মতোই :
গাছের নিচে ঘন অন্ধকার। কী গাছ এটা? বেশ ঝাঁকড়া। অসংখ্য পাখি বাসা বেঁধেছে। তাদের সাড়াশব্দ পাচ্ছি। পেছনের বিস্তীর্ণ মাঠে ম্লান জোছনার আলো। কিছুক্ষণের ভিতরই চাঁদ ডুবে যাবে। জেলখানার সেন্ট্রি দুজন সিগারেট খাচ্ছে। দুটি আগুনের ফুলকি ওঠানামা করছে দেখতে পাচ্ছি।
২২ বছরের তরুণের লেখার মধ্যে এই মুনশিয়ানাকে কেবল সহজাত প্রতিভা বা জিনিয়াসের কারবার বলেই ব্যাখ্যা করা যায়। আর কোনো ব্যাখ্যাই আমি হুমায়ূনের প্রথম দিককার লেখা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে পারি না। যেমন পারি না মানিক সম্পর্কে ভাবতে বসে।
হুমায়ূন আহমেদের সেন্স অব হিউমারের কোনো তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের দিকপালের একটা অপূর্ব গুণ হলো হাস্যরস করবার ক্ষমতা। সেই গুণ হুমায়ূনে সুপ্রচুরভাবে ছিল। আর তাঁর ছিল চরিত্র তৈরির ক্ষমতা। চরিত্রগুলো তুলির অল্প টানে আঁকা, কিন্তু খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আর খুবই জীবন্ত।
প্রতিভা বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমি বলবো, না, এ রকম হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণের কথাটা বাজে। আত্মজ্ঞানের অভাব আর রহস্যাবরণের লোভ ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিভাবানরা কথাটা মেনে নেন। মাথা নিচু করে এই মূল সত্যটিকে মেনে নিতে হবে যে, কবিতা লেখাও কাজ, ছবি আঁকাও কাজ, গান করাও কাজ, চাকা ঘোরানোও কাজ, তাঁত চালানোও কাজ এবং কাজের দক্ষতা শুধু কাজেরই দক্ষতা।… প্রতিভা এই দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা। আর কিছু নয়।’
এইখানে মানিকের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমরা মিল পাচ্ছি সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দি জিনিয়াস ইন অল অব আস বইটির লেখক ডেভিড শেংকের কথার। তিনি বলছেন, জিন, জিনিয়াস, আইকিউ এইসব কথা ভুলে যান। সবারই আছে প্রতিভা। এবং সে-প্রতিভা মানুষের জিনে আছে সুপ্রচুর। শুধু সেই জিনটাকে শাণিত করে তুলতে হবে। আপনি যদি চেষ্টা করেন, আপনিও শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটসম্যান হতে পারবেন। তবে আপনাকে শচীন টেন্ডুলকারের মতো করে চেষ্টা করতে হবে, চর্চা করতে হবে, লক্ষ্য ঠিক রেখে এগোতে হবে।
কথাটার মধ্যে অতিসরলীকরণ আছে। সব ব্যাটসম্যানই চেষ্টা করে, কিন্তু সবাই টেন্ডুলকার কিংবা ব্রায়ান লারা হয় না। কিন্তু চেষ্টা যে করতে হয়, সেটা আমরা জানি।
‘গল্প লেখার গল্প’ প্রবন্ধে মানিক লিখেছেন, ‘বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ’, ‘গোরা’, ‘চরিত্রহীন’ পড়া হয়ে গিয়েছে।… বড়ো ঈর্ষা হতো বই যাঁরা লেখেন তাঁদের ওপর।’
বারো-তেরো বছর বয়সে যিনি বিষবৃক্ষ, গোরা, চরিত্রহীন পড়ে ফেলেছেন, তিনিই তো লেখক হবেন।
প্রায় একই ঘটনা ঘটে হুমায়ূন আহমেদের বেলাতেও। তাঁদের বাড়িতে ছিল সাহিত্যিক পরিবেশ। হাতে লেখা পত্রিকা বেরোত। বাড়িতে বই ছিল প্রচুর। দেশি-বিদেশি বই। কাজেই হুমায়ূন পড়ার সুযোগ পেয়েছেন পর্যাপ্ত।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রথম বইয়ে তিনি গল্প খুঁজে পেলেন, ভাষা খুঁজে পেলেন, স্টাইল খুঁজে পেলেন। তাঁর ওই ছোট ছোট বাক্য তিনি আজীবন লিখবেন।
কাজেই আমি বারবার বলব, জোর দিয়ে বলব, হুমায়ূন আহমেদ আসলে একটা জন্মগত প্রতিভা। চেষ্টা করে কেউ হুমায়ূন হতে পারবে না।
সতীনাথ ভাদুরীর কথাটা এই লেখায় এসেছে। সতীনাথ একটা কথা বলেছিলেন, হুবহু উদ্ধৃতি নয়, স্মৃতি থেকে ভাবার্থটা বলি : লেখক প্রথম বইটা ভালো লিখে ফেলে, কারণ সেটা তিনি তাঁর নিজের মতো করে বলেন, পরে তিনি পাঠকের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করেন।
হুমায়ূনের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটল প্রায় উলটোটা আবার প্রায় একই রকম।
মানে হুমায়ূন প্রথম বইটাতেই তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করতে পেরেছিলেন, যেগুলো আবার পাঠক পছন্দও করে ফেলেছিল। ফলে তাঁকে আর পাঠকদের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করতে হয়নি। বরং পাঠককেই তিনি তাঁর সৃষ্টিশীল খেয়ালের কাছে নত করতে পেরেছিলেন, প্রায় মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পেরেছিলেন।
তাই তো দেখি, শেষের দিকে এসে তিনি চেষ্টা করছেন টাইম-পিস লেখার। জোছনা ও জননীর গল্প বা বাদশা নামদার বা মধ্যাহ্ন সেই চেষ্টারই ফসল। বহু পাঠক এসব বইয়ে মুগ্ধ হয়েছেন, কেউ কেউ বলেছেন, আগের মতো হচ্ছে না। কিন্তু হুমায়ূন যা করতে চেয়েছেন, তা-ই করেছেন।
ওরহান পামুক সম্প্রতি একটা বই লিখেছেন উপন্যাসের করণকৌশল নিয়ে। দি নাইভ অ্যান্ড সেন্টিমেন্টাল নভেলিস্ট। এই বইয়ে ওরহান পামুক শিলারের লেখা একটা প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, কবি দুই ধরনের হয়, নাইভ আর সেন্টিমেন্টালিস্ট। নাইভ কবি মনে যা আসে তা-ই লেখেন। আর সেন্টিমেন্টালিস্ট কবি প্রতিটি শব্দ লেখেন শব্দের ওজন বুঝে বুঝে। পামুক দেখিয়েছেন, একটা উপন্যাসে পরিবেশ তৈরি, ভূগোল তৈরি কত গুরুত্বপূর্ণ। তলস্তয়ের আন্না কারেনিনা থেকে তিনি দেখিয়েছেন, আন্না যখন ট্রেনে উঠেছে, সেই ট্রেনের কামরা ও জানালার প্রকৃতির বর্ণনা কত বিশদভাবে কেন দিচ্ছেন তলস্তয়।
কিন্তু দেবেশ রায় যেমনটা দুঃখ করেছিলেন, ‘উপন্যাস বলতে ডন কুইকসোট, টম জোনস, স্কারলেট অ্যান্ড ব্ল্যাক, হিউম্যান কমেডি, ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, ব্রাদার্স কারামোজভ, এদের দ্বারা নির্দিষ্ট আদর্শ বোঝায়। এ-উপন্যাসগুলোতে সমসাময়িক রাজনীতি আর ব্যক্তিমানুষের নিয়তি যেমন ওতপ্রোত, আমাদের ভাষায় তেমন উপন্যাসের অভাব’ (উপন্যাসচিন্তা, সময় ও সমকাল), সেই মাপকাঠিতে হুমায়ূনের বড় উপন্যাসগুলো  বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এবং আমার আশঙ্কা, হুমায়ূন বাংলাসাহিত্যে বড়মাপের উপন্যাসের যে-অভাবের কথা দেবেশ রায় উল্লেখ করেছেন, তা পূরণ করতে পারেননি।
কিন্তু তাঁর উপন্যাসিকাগুলো, যেগুলো সাহিত্যে একটা নতুন আঙ্গিক হিসেবেই তিনি দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছেন, সেগুলোর অনেকগুলোই উপন্যাসের এই সংজ্ঞানুযায়ী টিকে যাবে : ‘ঔপন্যাসিক ইতিহাসবিদ নন, ভবিষ্যতবক্তাও নন, তিনি হলেন   অস্তিত্বের পরিব্রাজক’ (মিলান কুন্ডেরা, দি আর্ট অব দি নভেল)। হুমায়ূনের নন্দিত নরকে বা শঙ্খনীল কারাগারে অস্তিত্বের চিরকালের সংকটকেই অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং সেগুলো পড়লে বোঝা যায় না, সেটা কোন কালের গল্প। তখন যে দেশে একটা গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে, দেশ মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে, তার কোনো উল্লেখও বইয়ের কোথাও নেই। সময় ও সমকাল ছাড়া তো উপন্যাস বাঁচে না, কবিরা হয়তো শাশ্বতকালের জন্য লিখতে পারেন, ঔপন্যাসিককে দেশকাল নিয়েই লিখতে হয় – যেমনটা ভেবেছেন দেবেশ রায়।
কিন্তু আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার কিংবা ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সিতে ওই সময়ে রাজনীতি আছে কি নেই, তা কি আদৌ প্রাসঙ্গিক? হুমায়ূন আহমেদ সম্ভবত তাঁর ছোট ছোট তীব্র কাজের জন্যই বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন পাবেন। সেগুলোয় রাজনীতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিমানুষের দ্বন্দ্বের কাহিনি অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও। আমরা জানি, ফিকশন দুই প্রকার। লিটেরারি ফিকশন আর পাল্প ফিকশন। ওয়ান হান্ড্রেড অব সলিচুড হলো সাহিত্যিক উপন্যাস। গোয়েন্দা গল্প, সায়েন্স ফিকশনকে পাল্প ফিকশন বলা হয়। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এসব প্রসঙ্গ হয়তো কেউ পারবেন, তা সত্ত্বেও আমি বলব, হুমায়ূন আহমেদের বহু আখ্যান যেমন নন্দিত নরকে বা শঙ্খনীল কারাগারে মানুষে অস্তিত্বকে পরিব্রাজন করা হয়েছে, মানুষের যাপিত জীবনকে নতুন ভঙ্গিমায় নতুন আঙ্গিকে অন্বেষণ করা হয়েছে, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, সৌন্দর্য নতুনভাবে প্রতিভাত হয়েছে – সেসব সত্যি অতুলনীয়। তাঁর জোছনা ও জননীর গল্প বা মধ্যাহ্নকে মহৎ প্রয়াস বলতে হবে, কিন্তু বড়মাপের উপন্যাসের ঘনত্ব এতে অনুপস্থিত, বিশেষ করে ডিটেইলের অভাব বেশ অনুভূত হয়! গল্প বলার অসাধারণ প্রতিভা সেই ঊনতাকে আড়াল করে রাখে অবশ্য। কিন্তু তাঁর ছোটগল্প, তাঁর উপন্যাসিকার অনেকগুলোই বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ হয়েই রইবে।
সাহিত্যিক অবদানের পাশাপাশি তাঁর সামাজিক অবদানের কোনো তুলনা নেই। তিনি আমাদের প্রকাশনা জগৎকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তিনি আমাদের টেলিভিশন  নাটকগুলোকে আনন্দপূর্ণ করে গেছেন এবং আমাদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন একাধিকবার। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে যে-শূন্যতা তৈরি হলো, তা সত্যি পূরণ হওয়ার নয়।