‘স্বপ্ন’ ও ‘বনলতা সেন’

সনৎকুমার সাহা

বাংলা কবিতা যাঁরা খুঁটিয়ে পড়েন, তাঁদের অনেককে বলতে শুনি, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতাটির অনুসরণে লেখা। ‘স্বপ্ন’ আছে কল্পনা কাব্যগ্রন্থে। ১৮৯৭ সালের রচনা। কল্পনার প্রকাশকাল অবশ্য ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ। ছাপা অক্ষরে ‘বনলতা সেনে’র প্রথম আবির্ভাব ১৯৩৫ সালে। দেখা পাই বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায়। ১৯৪২ সালে ওই কবিতাভবন থেকে তাদের ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালায় ছেপে বেরোয় এটি সমেত মোট ষোলোটি কবিতা নিয়ে বনলতা সেন সংকলন। পরে জীবনানন্দের জীবদ্দশাতেই সিগনেট প্রেস থেকে ওই একই নামে প্রকাশিত হয় এর সুচারু পরিবর্ধিত সংস্করণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কবিতাটিই ছিল তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
‘স্বপ্ন’ ও ‘বনলতা সেনে’র আত্মপ্রকাশের মাঝখানে আটত্রিশ বছরের ব্যবধান। এটা কিন্তু কোনো সাধারণ নির্দেশক নয়। সময়ের অভিক্ষেপ সব জায়গায় সব পরিস্থিতিতে একই হারে হয় না। আনুষঙ্গিক বিষয়রাশি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কখনো তাকে তুমুল করে তোলে, কখনো বা তার ধীরলয় যেন নিজেকে আড়াল করাতেই উৎসাহ জোগায়। কাজেই, ঐকিক নিয়মে সময়ের হিসাব যুক্তিসিদ্ধ পরিণাম নিশ্চিত করে না। কখনো যুগের পর যুগ পেরিয়ে যায়; কার্যকারণ-সমীকরণ কিছুই পালটায় না। কখনো বা সময়ের গ্রন্থিমোচনে কালখন্ডের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশেই সব সমীকরণ এলোমেলো হয়ে যায়। আগের ধ্যানধারণা-রীতিনীতি অনেক কিছু তামাদি হয়ে পড়ে। নতুন করে ছক কষার তাগিদ ভেতর থেকে তৈরি হয়। যা-ই হোক, ওই আটত্রিশ বছরের বিস্তারে বাংলা মানুষের জীবনচর্চায় আমরা কিন্তু এমন কোনো চরম অবস্থার লক্ষণ সর্বতোভাবে ও প্রকটভাবে ফুটে উঠতে দেখিনি। স্থবিরতা যে মৌরসি পাট্টায় জাঁকিয়ে বসে থাকে, তা নয়; আবার হুড়মুড়িয়ে যে সবকিছু বদলে যায়, এমনও নয়। তা ছাড়া পরিবর্তনও যা যেমন ঘটে, তা অনেকটাই খাপছাড়া। গোটা সমাজদেহে সবখানে তা একইভাবে ছড়ায় না। ফলে শুরুর হালচাল-গণরুচি-আশা-নিরাশার সার্বিক রূপকাঠামোর বাঁধা-ছাদা এখানে-সেখানে কতকটা আলগা হয় সত্য, কিন্তু সমাজভূমিতে জনসমুদয়ের দৈনন্দিন তৎপরতার চেহারায় আপাতদৃষ্টে তার ছাপ ধরা পড়ে খুব কমই। তাই ভাবনা-চিন্তার নির্মাণকলায় – তার অঙ্গসংস্থানে ও সংবাহন ক্রিয়ায় – যদি পুরনো ধাঁচ বজায় থাকে, অথবা তার স্মৃতি রাজত্ব করে চলে, তবে তা অস্বাভাবিক মনে করার কোনো কারণ দেখি না। তাকে আত্মস্থ করেও সৃষ্টির আপন বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। ওই কালপর্বে অনেক সার্থক রচনাই তেমন।
অবশ্য সময়টা যে পুরোপুরি নিস্তরঙ্গ ছিল, এ-কথাটাও ঠিক নয়। যদিও ভেতর থেকে সমাজ যে তেমন বদলায় না, মানুষের কাজকর্মের ধরন-ধারণ প্রায় আগের মতোই থাকে, তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ওপর থেকে-বাইরে থেকে – ঘটনাপ্রবাহ আঘাত হেনেছে বারবার। এ-পর্বেও তার গতিপ্রকৃতি সাধারণভাবে কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। যেন দুঃস্বপ্ন থেকেই কোনো কোনো কান্ড হানা দেয় বাস্তবে। ১৯০৫-এ বাংলা ভাগ, ১৯১৪-১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ১৯৩০-এর দশকের বিশ্বমন্দা, এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে তার রুজি-রোজগারের, তার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-কল্পনার ওপর। কোথায় কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, এটা বোঝা বেশির ভাগ থেকে যায় তার আয়ত্তের বাইরে। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ধীরলয়ে যেখানে প্রায় আগের মতো চলে, সেখানে তার পরেও বাইরের অভিঘাতে দমকা হাওয়ায় ভাবনার জগতের রুদ্ধ কপাট বিকট শব্দে হাট হয়ে খুলে যায়। সবাই হয়তো সাড়া দেন না বা দিতে পারেন না। তেমন মনের প্রস্ত্ততি অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না। যাঁরা বেশি অনুভূতিপ্রবণ এবং যাঁদের চিন্তা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়-আশয়েই শুধু নিবিষ্ট থাকে না, এমন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কেবল আলোড়িত হন। তাঁদের কথায় ও কাজে তা ফুটে উঠতে থাকে, সব সময়ে কার্যকারণের সূত্রগুলো চিনিয়ে দিয়ে নয়। বাস্তবও তা করে না। সূত্রগুলো একে অন্যে দ্বন্দ্বে-কোলাহলে-সমঝোতায়-মিত্রতায় জড়াজড়ি করে থাকে-চলে। আগের বিশ্বাস-অবিশ্বাস-আচার-বিচার-অনুরাগ-বিরাগ, এগুলো বাতিল হয়ে যায় না। বাইরের ধাক্কাকে অনেকটাই তারা আত্মস্থ করে। কিছুটা বা তার সঙ্গে তাল মেলায়। সবকিছুর বিচিত্র প্রতিফলন ঘটে তেমন তেমন ব্যক্তি-মনের আয়নায়। পরে প্রতিধ্বনি জাগায় তা আরো অনেকের ভেতরেও।
পুরো সময়টা রবীন্দ্রনাথ নিজেও একই ঘাটে বাঁধা থাকেন না। তাঁর ভাবনা-কল্পনার গতিশীলতা নিশ্চিতভাবে ধরা পড়ে বলাকা (১৯১৫), পূরবী (১৯২৪) বা পুনশ্চের (১৯৩২) কবিতায়। আরো আগে বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনে (১৯০৫-১১) তিনি নিজেও শামিল হয়েছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। তারই প্রেরণায় লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় একগুচ্ছ দেশাত্মবোধক গান। এসবই ঘটেছে বাইরের তাড়নায়। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার অর্থ ও তাৎপর্যও খুঁজে চলেছেন তিনি একই সঙ্গে। তাতে সততায় ঘাটতি ছিল না এতটুকু। বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতন কর্মযজ্ঞে ঘটে তারই নির্ভেজাল প্রকাশ। তাই প্রায় চার দশক আগে কল্পনা কাব্যের যে কবিতা তিনি লিখেছিলেন, ১৯৩৫ সালে এসে ঠিক সেই রকম আরেকটা কবিতা লেখার কথা তাঁর মনে হয়নি। যদিও সার্বিকভাবে সমাজজীবনে কাজের চেহারা বদলায় না প্রায় কিছুই।
তবে কবিতার আপন ভুবনে দেখা দেয় বড় রকমের তোলপাড়। সেখানেও প্ররোচনা প্রধানত বাইরের। পাশ্চাত্যে যে কবিতায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল, তা উত্তেজনা ছড়িয়েছিল বাংলার নতুন কবিদের ভেতরেও। য়োরোপ-আমেরিকায় ছিল শুরুতে স্থিতাবস্থার ক্লান্তি – একধরনের অনুর্বর অবসাদ, পরে, মহাযুদ্ধের তান্ডব ও মহামন্দার বিভীষিকা। কবিতা ধরতে চায় তাদের মূলভাব। রূপকল্পনায় ফুটিয়ে তুলতে চায় তাদের চৈতন্য-গ্রাহ্য অঙ্গসংগঠন। কর্কশ বাস্তবের সারাৎসারে মগ্ন থাকাতেই তার আগ্রহ। একই সঙ্গে সে খোঁজে প্রবহমান কালের প্রেক্ষাপটে মানবসত্তার স্থায়ী কোনো মূল্যমান, যা সর্বাংশে জাগতিক এবং যার দায়ভার বর্তায় পুরোপুরি তার নিজের ওপরেই। বহু ফাটলে বিদীর্ণ যে-প্রত্যক্ষের কর্মভূমি এবং অসংখ্য অন্যায়-অসংগতিতে পরিকীর্ণ যে ইতিহাস-পথ, তাদের ওপর নিরাসক্ত দৃষ্টি প্রসারিত করে তার দেখা পাওয়ার চেষ্টা পন্ডশ্রম বলেই মনে হয়। যে বিচ্ছিন্নতার ও বিষাদের, এমনকি বীতরাগের তা জন্ম দেয়, পাশ্চাত্যের কবিতা এই সময়ে তাদের এড়িয়ে যায় না, বরং তাদেরই উপজীব্য করে প্রত্যক্ষের মায়ায় ডুব দিয়ে তাদের তলদেশ পর্যন্ত ছুঁতে চায়। সম্পন্ন সুখানুভূতি সে আর দেয় না। দিতে পারে না।
তিরিশের দশকের বাংলায় যে আধুনিক কবিকুলের আবির্ভাব, এই প্রবল হাওয়ার ঝাপটা তাঁদের ওপরও এসে পড়ে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ভাবনার ওই ঘূর্ণিজালে সাগ্রহে ঢুকে পড়েন। ইংরেজি সাহিত্যে কবিতার পালাবদলের আন্দোলনে তখন প্রধান ঋত্বিক টিএস এলিয়ট। আমাদের নতুন কবিরাও নির্দ্বিধায় তাঁকে গুরু মেনে বসেন। অবশ্য প্রভাবের তারতম্য থাকে। যেমন : জীবনানন্দ এলিয়টের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়েও কেবল ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ কবিতায় রূপকলা ও গীতলতার সন্ধানে ইয়েটসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। প্রাচীনতার কিটস বা এডগার অ্যালান পোর ভাবাবেশও তিনি চেতনায় বহন করে চলেন। দু-একটি কথা এ নিয়ে একটু পরে বলা যাবে। এখানে শুধু মনে রাখি, ওই সময়ে বাংলায় যাঁরা কবিতাকে ভিন্ন ছাঁচে-ভিন্ন স্বাদে গড়ে তোলার আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরা ছিলেন অনেক বেশি বহির্মুখী। য়োরোপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলন থেকে তাঁরা প্রেরণা খুঁজতেন, নিজেদের যাপিত জীবনের পটভূমিতে তাকে বুনে দিতে চাইতেন। তাৎক্ষণিক অন্য একটা তাগিদও এর পেছনে ছিল। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্বকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না; আবার তাঁকে মেনে নিলে নিজেদের আত্মপ্রকাশের কোনো পথ তাঁরা খুঁজে পান না। অগত্যা শরণাপন্ন হন তাঁরা বাইরের পথপ্রদর্শকের। কিছুটা দো-অাঁশলা ভাব থেকে যায়। অন্তত শুরুতে। কিন্তু অতুল প্রতিভাবান যাঁরা, তাঁরা অচিরেই এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। বাংলা কবিতার মূলধারায় তাঁদেরই অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। কবিতা নিরবলম্ব ঝুলে থাকে না। বাংলার মানুষের ভাবনাবৃত্তে তারা ঢুকে পড়ে। রসদও জোগাড় করে সেখান থেকে। স্বপ্ন-বঞ্চনা ও স্বপ্ন-সাধনা – দুটোই রূপ পায় বাঙালি অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে। তবে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহুদূর ছড়ায়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আত্মপর বিভাজনরেখা মুছে যেতে বসে। তাতে যে বিভ্রাট ঘটে না বা বিভ্রান্তি জাগে না, এমন নয়। তাদের ছাপ শরীরে নিয়েই কবিতা এগিয়ে চলে। এবং তা বাংলা কবিতার বৃত্তেই থাকে। কূপমন্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তা ওই সময়। পরে অবশ্য নিচের টান তাকে আকাশচারী থাকতে দেয় না। মাটির কাছাকাছি যে গ্রাম্যতা, তার সংক্রমণও এড়ানো যায় না। তবে সবমিলিয়ে তিরিশের দশকে বাংলা কবিতা যে নতুন বাঁক নেয় এবং নতুন জীবন পায়, তা অস্বীকার করা যায় না। আর এটাও বলবার, ওই সময়ের ওই কবিতায় গ্রাম্যতা কোনো ছায়া ফেলে না।
তিরিশের কালপর্বের প্রধান কবিদের অন্যতম ছিলেন জীবনানন্দ। তবে তখনই তাঁর কবিতা সশ্রদ্ধ অভিনিবেশের বিষয় হয়ে ওঠেনি; বরং স্থূল অরসিক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের নির্বোধ আঘাতে তা লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে। তিনি নিজে হয়েছেন বিড়ম্বিত। তাঁর অপ্রতিরোধ্য প্রভাব নিঃশব্দে আকাশ ছেয়েছে তাঁর অকালমৃত্যুর (১৯৫৪) পর। রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। এটা বুঝতে এখানে সময় লেগেছে অনেক। তিনি যার আশায় দিন গুনেছেন, সেই ‘ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তনে’র লক্ষণ শেষ পর্যন্ত চোখে পড়েছে। তবে আগের রেশ পুরোপুরি কেটে যায়নি এখনো।
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আমাদের আলোচনার বিষয়টি। তিরিশের ‘আধুনিক’ কবিরা সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ খোঁজেন। বাংলা কবিতার সুস্বাস্থ্যের জন্যে, তাকে গতিশীল রাখার জন্যে এটার যে প্রয়োজন ছিল, তাতে আজ আর কেউ দ্বিমত করেন না। এই আধুনিক কবিতার এক সেরা কীর্তি – নিঃসন্দেহে অমরতার দাবিদার – জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। কিন্তু এই কবিতাই, বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতার অনুগামিনী। অথচ প্রায় চার দশক আগে লেখা ওই ‘স্বপ্নে’র খোলস ভেঙে রবীন্দ্রনাথ নিজেও চলে এসেছেন অনেকদূর। ধরা পড়ে নাকি এতে এক অন্তর্জাত স্ববিরোধ? আধুনিক কবিতা কি তাহলে সত্যিকারের স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠেনি? রবীন্দ্রনাথের প্রভাববলয় কেটে বেরিয়ে আসার কথা বললেও তাঁর বৃত্তে ফিরে গিয়েই কি মেলে সর্বোত্তম সিদ্ধি? প্রশ্নটি নিয়ে ভাববার আগে কবি ও কবিতার এই ধরনের ঋণ নিয়ে জীবনানন্দের নিজের কথা একটু শোনার চেষ্টা করি।
‘কবিতার কথা’য় তাঁর উপলব্ধির কথা জানাতে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘- তাদের (যারা কবি, তাদের) হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকিরণ তাদের সাহায্য করছে।’ দুটো বিষয় এখানে বিশেষভাবে মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত, কবিহৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা থাকার অপরিহার্যতা, এবং দ্বিতীয়ত, অতীত ও বর্তমানের সৃষ্টিপ্রভ কাব্যবিকিরণ থেকে প্রয়োজনমতো আলো শুষে নেওয়া। কবির কল্পনাপ্রতিভা একান্তই তাঁর। চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা তাকে বিশিষ্ট করে। ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে তাঁর বিনম্র স্বীকৃতি। এবং সেই সঙ্গে সমকালীন আলোর কণিকারাশি থেকে ভাবসম্পদ আহরণেও তাঁর অকুণ্ঠ আগ্রহ। ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভার সম্পর্ক নিয়ে টিএস এলিয়টও বলেছেন এমন কথা। জীবনানন্দ আরো বিশদ হয়েছেন পরের এক লেখায় (‘মাত্রাচেতনা’) – ‘- কবিমানসের প্রমত্ততা ও তার মহাভাবনার দৌরাত্ম্য তাকে যতই নিরবলম্ব ও অস্পষ্ট করে তুলতে চাক না কেন – পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মহাকবিই এই অস্বস্তি বোধ করেছে – … – তার অন্তরিন্দ্রিয়কে গঠন করে আসছে সে অনেক আগেকার যুগ থেকে – এমনই ভাবে, যে-কবিতা সৃষ্টি করার সময় সে তার নিজের আদর্শ উপায়কে যতটা স্বায়ত্ত মনে করুক না কেন, ততদূর স্বাধীন তা নয়। যে-সময়ে সে বাস করেছে, এবং যে-সময়ে বাস করেনি, যে-সমাজে সে কাল কাটাচ্ছে এবং যেখানে কাটায়নি, যে-ঐতিহ্যে সে আছে, এবং যেখানে সে নেই – এই সকলের কাছেই সে ঋণী। যদিও শিল্পসৃষ্টি করার সময় এই ঋণ কঠিন উত্তমর্ণের মতো তাকে আক্রমণ করতে আসে না, এবং এই জন্যে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল, তবুও ঋণ বিস্মরণের মানুষ কবি নয়, এ জিনিস ঋণও নয়, উপায় বরং – মর্মার্থী হয়ে বেঁচে থাকবার, কবির অনুচেতনায় এবং কখনো কখনো কল্পচেতনার ভেতর সঞ্চারিত থেকে তার প্রতিভাকে সাহায্য করছে তার বিশেষ অভিজ্ঞতাকে দূষিত না করেও যতদূর সম্ভব পরার্থপর করে তুলতে।’
জীবনানন্দের এই কথাতেই স্পষ্ট, তাঁর ধারণায় কবিতার স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তা আবশ্যিকভাবে তার অনন্যনির্ভরতা নয়। কবি চেতনার বলয় মৌলিকত্বেই নিঃশেষিত হয় না। যদিও চিন্তা ও অভিজ্ঞতা একান্তই তাঁর এবং তারা যে বোধের জন্ম দেয়, তাই ওই কবিতার প্রাণ। কিন্তু তা বিকশিত হয় চেতনার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। আপন-পর ভেদাভেদের রেখাগুলো সেখানে অবলুপ্ত। মুছে যায় স্থান ও কালের সীমানা-চৌহদ্দি। কবি তা থেকে আহরণ করেন তাঁর যজ্ঞের সমিধ। সবই আহুতি দেন কবিতার ওই বোধের সারাৎসারে রূপ ও রসের মায়া রচনায়। কবিতা স্বয়ং তিলোত্তমা হতে চায়। এবং চিন্ময়ী সর্বোত্তমাও। এই যে প্রবহমান চেতনায় ভাবনা ও দৃশ্যের উপকরণমালা, জীবনানন্দ অকুণ্ঠে তাদের আপন করে নেওয়ার কথা বলেন। এবং জানান, ‘ঋণ-বিস্মরণের মানুষ কবি নয়’, আবার এর সঙ্গে যোগ করেন, ‘এ জিনিস ঋণও নয় উপায় বরং – মর্মার্থী হয়ে বেঁচে থাকবার -।’ তা ‘কবির অনুচেতনার এবং কখনো কখনো কল্পচেতনার ভিতর সঞ্চারিত’ হয়, কিন্তু ‘তার বিশেষ অভিজ্ঞতাকে দূষিত’ করে না। এই সব ‘উপায়’ কবিতার আপনত্বকে, তার অন্তঃর্সার বিশেষতাকে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ করে না। যদি করে তবে তাতে কবিতার পতন ঘটে। তার প্রাণবায়ু লোপ পায়। তার পরেও সে ঘোরাফেরা করতে পারে। কিন্তু সে নকল সাজে, নকল চালে।
এই রকম ‘উপায়’কে কব্জা করে পঙ্খিরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে কবিতার মর্মমূলে হানা দিয়েছেন তিনি বারবার। অনায়াসে পেরিয়ে গেছেন কালের গন্ডি। সমাজ-সংসারের স্থান-চিহ্নিত বেষ্টনীও। কবি সে যেখানকার হোক, যখনকার হোক, ‘মর্মার্থী’ হয়ে তাঁর ভান্ডার থেকে মণি-রত্ন জোগাড় করতে তাঁর সংকোচ ছিল না। নাক গলিয়েছেন পুরাণ-ইতিহাসের কাহিনিভূমিতেও। কিন্তু তারা নিজেরা স্বয়ম্ভু হয়ে নিজেদের জাহির করেনি। কবিপ্রতিভার সহায় হয়েছে মাত্র। কবিতা একক মহিমায় পরমেশ্বরী হয়ে উঠেছে। এমনকি রূপসী বাংলার কবিতামালাও নির্ভেজাল বাঙালি ঐতিহ্যে মগ্ন থাকেনি। ইংরেজি কবিতার ঝরাপালক ভোল পালটে দিব্যি বাংলার নিসর্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে। তাতে কবিতার জাত যায়নি। বরং তার স্বরূপ প্রকৃত সত্তার আলোয় আরো উজ্জ্বল হয়ে খুলেছে। রবীন্দ্রনাথেরও সায় ছিল কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় এমন মাধুকরী বৃত্তিতে। ‘অনুকরণ চুরি, স্বীকরণ চুরি নয়’ – এ তাঁরই প্রবাদতুল্য উক্তি। তাঁর কবিতাতেও এর ছাপ পড়েছে অসংখ্য। যেমন : ‘ঝুলন’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলি –
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে,
গঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোৎস্নারাতে;
যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে
স্নেহের সাথে \
কিটসের Ode to a Nightingale-এর নিচের চরণগুলোর স্মৃতি জাগায় –
– for many a time
I have been half in love with easeful Death,
Call’d him soft names in many a mused rhyme,
To take into the air my quiet breath; –
কিন্তু ‘ঝুলনে’র কোনোভাবেই আত্মখন্ডন ঘটে না; তার আত্মপ্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। ভাবের ঘনত্ব কোথাও ফিকে হয় না; আবেগের অভিঘাতও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে না। কবির স্বাক্ষর, একক ও অমোঘ, গোটা কবিতায় নিশ্চিতভাবে চিনে নেওয়া যায়।
এখন সারকথা হলো, তিরিশের কবিরা, জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের প্রভাববলয়ে আর থাকতে চাননি। থাকেনওনি। তাতে বাংলা কবিতার ক্ষতি হয়নি; বরং তা নতুন প্রাণ পেয়েছে। অন্তত ওই সময়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বদলেছেন। চার দশক আগে যে-কথা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন, সেসব থেকে সরে এসেছেন অনেক। জীবনের সুস্থিতি বিপন্ন হয়েছে। বাস্তব প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বমুখর ও হিংস্র হয়ে উঠেছে। কবিকেও তাদের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। তাঁর ভাবের কল্পনায় ও ভাষার নির্মাণে তার অনিবার্য ছাপ পড়েছে। প্রশ্ন তাহলে, জীবনানন্দ কেন তার পরেও চার দশক আগের রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নমায়ার সহমর্মী হবেন? ‘মর্মার্থী’ হয়ে ‘উপায়ের’ খোঁজে তিনি তাতে ডুব দিতে পারেন ঠিকই। কিন্তু এতে কি তিনি নিজে আপন কাল ও আপন ভূমি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন না? নাকি এখানেই রয়েছে বৈপরীত্যের উপাদান? রবীন্দ্রনাথকে প্রারম্ভিক বিন্দু ধরে সেখান থেকে যে দূরত্ব তিনি রচনা করেন, তার ভাবরূপ ফুটিয়ে তুলে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠাই কি তাঁর লক্ষ্য – এবং এই প্রাণ অমৃতের অভিসারী? তিনি যে কবিহৃদয়ে ‘কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’র কথা বলেন, তার পরিচয় এক পূর্ণোদ্ভবা কবিতা-প্রতিমায় কি বিভাসিত হয় এখানে? উত্তর পাওয়ার চেষ্টায় এবার কবিতা দুটোর দিকেই আমরা নজর দিই। অবশ্য কবিতার মীমাংসা-অমীমাংসা বস্ত্তগত যুক্তিকাঠামোর সীমাকে অতিক্রম করে যায়, এবং সে কারণে সবসময়ে সংজ্ঞার্থেই অনিশ্চিত ও অসম্পূর্ণ, এই কথাটা মনে রাখি।

দুই
ভালো হতো, কবিতা দুটো পুরো এখানে পড়ে শোনাতে পারলে। কিন্তু তাতে একঘেয়েমি আসত। বলার কথাটাও হয়তো কবিতার টানে উদ্ভ্রান্ত হতো। আশার কথা, কবিতা দুটো অনেকেরই পড়া।
এখন যে খুব দুষ্প্রাপ্য তা-ও নয়। তাই তাদের সামনে রেখে কথাগুলো যাচাই করে নিতে কারো অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া প্রয়োজনমতো প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিও দেব। ভাবনার যোগসূত্র কিছুটা হলেও চিনে নিতে তা সহায় হতে পারে।
দূর-অতীতের এক জীবনমঞ্চে ‘স্বপ্ন’ কবিতার নির্মাণ। সরাসরি উল্লেখ নেই, কিন্তু চিত্রমায়া নির্দেশ করে কালিদাসের কালের। তাঁর কল্পপ্রতিমা স্থান ও কালে অবিকল থেকে রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভেসে আসে। পূর্ণতার অনুভব তার স্থির থাকে, স্থায়ী হয়। কালের ধারাবাহিকতার ছাপ তার ওপর কোনো দাগ কাটে না। তা ম্লান হয় না। পূর্ণতর বা ভিন্নতরও হয় না। কারণ, স্বয়ং তা তুলনাহীনা। সুন্দরী সর্বোত্তমা। ‘দূরে বহুদূরে স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে’ কবি খুঁজতে যান তাঁর ‘পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে’। খোঁজেন তিনি ‘শিপ্রানদীপারে’। স্থান ও কালের ছবি খুব স্পষ্ট করেই এখানে অাঁকা হয়ে যায়। তারপরেই পাই প্রিয়ার অবিনাশী রূপবিভঙ্গ। –
মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, করুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর জীবীবন্ধে বাঁধা,
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা-আধা।
উপকরণরাশি এখানে সবই কালিদাসের কাব্য থেকে আহরণ করা। কবিতার নির্মাণকলায় রবীন্দ্রনাথ সচেতন পরিকল্পনায় তাদের কাজে লাগান। কবিতা এতে সার্বিকভাবে কালিদাসের অনুসারী হয় না। তাঁর সুন্দরের ধ্যানরূপ ফুটিয়ে তোলায় তাকে ‘উপায়’ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন মাত্র। এই ব্যবহারের স্বাধীনতা তাঁর নিজস্ব। কবিতা তার স্বকীয়তা হারায় না। আমরা দেখেছি, কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় এরকম ঐতিহ্য-সংলগ্নতায় কবির মৌলিকতার বিচ্ছুরণ যে সংকুচিত হয় না, বরং কল্পনা ও চিন্তার সারবত্তায় তা আরো স্বয়ম্প্রভ হয়, এমন কথা জীবনানন্দও আমাদের শুনিয়েছিলেন।
আমরা পড়ি –
হেনকালে হাতে দীপশিখা
ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা।
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সোপানের ’পরে
সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো, সন্ধ্যাতারা করে।
অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস
ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস \
প্রকাশিত অধ্যচ্যুত-বসন-অন্তরে
চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে।
দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়
নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় \
কল্পনার রঙে যে-রূপের আবহ এখানে রচিত হয়, তা কিন্তু খুব সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। প্রেয়সী সুন্দরের তৃষ্ণা মেটায় তার ভাবলাবণ্যে, তার সাজসজ্জার মোহিনী মায়ায়। কোনোটিই অন্তর্জাত নয়, সবটাই বাইরের সংযোজন। দেহের কান্তিও প্রসাধননির্ভর। রোমান্টিক চেতনার অভিঘাত এই বর্ণনায় আমাদের কাছে তেমন ধরা পড়ে না। বরং কালিদাসের ক্ল্যাসিক চিত্রশোভা তার ছাপ রেখে চলে। ‘ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা’ – ওই ছাপ আরো নিশ্চিত করে। তার পরেও ‘ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস’ – তাকে ক্ল্যাসিক বৃত্তে ধরে রাখলেও তার সুরভি কেবলমাত্র সেখানেই আবদ্ধ রাখে না। বর্তমানের মানসপটেও তার বার্তা পাঠায়।
এরপরে পাই কবিকল্পনায় স্বপ্নপ্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার নিখুঁত বর্ণনা –
মোরে হেরি প্রিয়া
ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া
আইল সম্মুখে, মোর হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধালো শুধু সকরুণ অাঁখি,
‘হে বন্ধু, আছ ত ভালো?’ মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু, কথা আর নাহি।
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি! নাম দোঁহাকার
দুজনে ভাবিনু কত, মনে নাহি আর।
দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা পানে,
অঝোরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে \
সন্দেহ নেই, এই দৃশ্যানুভূতি বিশুদ্ধ আবেগঘন, – গভীর আবেদনময়। ‘হে বন্ধু, আছ ত ভালো?’ মুহূর্তে কালের ‘চিরচঞ্চল গতি’ স্তম্ভিত করে উদ্ভাসিত হয়। বাণী তার ‘গগনে গগনে লোকে লোকে’ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলে। আকাশে-বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে নিঃশেষিত হয় না। অতীতে-বর্তমানে সংযোগরেখা কাল্পনিক, কিন্তু প্রত্যক্ষের অনুভবের চেয়েও মৌলিক। তাই এ বাস্তব। এবং বাস্তব হয়েও চিরকালের সত্য। তারই প্রতিতুলনায় দিনান্তে-নিশান্তে বেজে চলে মর্ত-মানুষের অপূর্ণতার আক্ষেপ। বিশেষকালে শুধু নয়, সব কালেই। ‘তবহু ন তিরপতি ভেল’ – এ আর্তি সব যুগে সব মানুষের সবার। মেঘদূত তারই কাব্য। তার ছায়া যেন এখানে অদৃশ্যে ভেসে যায়। ‘দুজনে ভাবিনু কত চাহি দোঁহা পানে,/ অঝোরে ঝরিল অশ্রু নিস্পন্দ নয়ানে’ – না-পারার, না-পাওয়ার এই বেদনা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
তবু তারপরে, এই অনন্ত অপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে এক সান্ত মুহূর্তের ক্ষণিক মায়া চেতনায় গাঁথা হয়ে যায় –
নাহি জানি কখন কী ছলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণকরে, কুলায় প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো। মুখখানি তার
নতবৃন্ত পদ্ম-সম এ বক্ষে আমার
নামিয়া পড়িল ধীরে। ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস \
বর্তমান অতীতে স্থানান্তরিত হয়ে কল্পনায় এক স্থির বিন্দুর সত্যস্বরূপে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। যেন অলীকে-অলৌকিকে মিলে চৈতন্যের রুদ্ধ প্রকোষ্ঠ অনুভবের শুদ্ধ সারাৎসারে আলোকিত করে তোলে। কিন্তু এ মুহূর্তের বোধ। তারপরেই অন্ধকার। অন্তিম স্তবকে তাই –
রজনীর অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার।
দীপ দ্বারপাশে
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে।
শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে \
তবে এই স্তবক দ্ব্যর্থক। অন্ধকার নির্জ্ঞানের প্রতীক। তাতে স্বপ্ন-সমাপনের ইঙ্গিত। আবার তাতে চূড়ান্ত স্বপ্ন-মিলনের আভাসও যেন মেলে। কিন্তু তা নির্বাপিত হয় অন্ধকারেই। তাতে সাঙ্গ হয় স্মৃতিসত্তার সব আয়োজন। অবিমিশ্র তমিস্রা ছেয়ে ফেলে সবকিছু। আনন্দ না বিষাদ, কবিতার শেষকথা কি, নাকি তা আনন্দ-বিষাদের যুগলবন্দি – এ-প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায়। অবশ্য এই রহস্যময়তা কবিতাকে অনিঃশেষ করে। তার সম্মোহন আমাদের ছাড়ে না। আর এ-ও অস্বীকার করতে পারি না, বাস্তবতার প্রকাশ বহুরূপী, – বহুমুখী। ঐকান্তিক পরিণাম যে তাতে মিলবেই, এবং তা পরমার্থিক ও সর্বাত্মক, এমন দাবি অসংশয়ের করা যায় না।
আরো একটা বিষয় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই কবিতার দৃশ্যমালা এক সুসম্বদ্ধ কাহিনির অনুসারী। এ স্বপ্ন। কিন্তু কোনো অসংলগ্নতা এতে নেই। দৃশ্যপরম্পরা সুশৃঙ্খল। সম্পর্ক তাদের সরলরৈখিক। ক্ল্যাসিক নির্মাণকলার অবশেষ যেন। উথাল-পাথাল ভাবনা পূর্বনির্ধারিত ছকের বাইরে যায় না। অপ্রত্যাশিতের বা আকস্মিকতার আক্রমণে এ দীর্ণ হয় না। দৃশ্যমঞ্চ আগে থেকে তৈরি। স্বপ্নপ্রয়াণ সরাসরি তুলে দেয় সেখানে। স্থান ও কালের ওপর গতির প্রবাহ মনে কোনো দাগ কাটে না।

এবার আসি ‘বনলতা সেনে’। প্রথমেই লক্ষ করি, কালের মাত্রা, দূরে হোক বা নিকটেই হোক, এখানে স্থির নয়। তার মুক্ত প্রবাহের অনির্দিষ্ট ব্যাপ্তির সবটার ওপর যে কোনোখানে কবির মানস-অভিযান। এটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বুঝি তাঁর কথা থেকেই। যেমন, ‘- সময়-ও-সীমা-প্রসৃতির ভিতর সাহিত্যের পটভূমি বিমুক্ত দেখতে আমি ভালোবাসি।… কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। কাল বা সময় বৈনাশিক; কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলোকেই কেটে কেটে চলেছে, যা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়ের মতো।’ (‘উত্তররৈবিক বাংলাকাব্য’, ১৩৫২)। অথবা ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সংগতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো, কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি।’ (‘কবিতা প্রসঙ্গে’, ১৩৫৩) এই উপলব্ধি ‘বনলতা সেন’ কবিতার আয়োজনে তার পাখা ছড়ায়। শুধু বাইরের ধারাবাহিক ভাবকল্পনাতেই নয়, কবিতার অন্তরমূলেও তা বাসা বাঁধে। গতি ও স্থিতির দুর্লভ অন্বয়ের এক অত্যাশ্চর্য ভূমিতে এই কবিতা পরমা হয়ে দাঁড়ায়। ত্রিকাল তার সামনে স্তব্ধ হয়ে থাকে। মর্তে-ত্রিদিবে পিপাসিত চিত্তের অনাদ্যন্ত বাণী অতুল মহিমায় সে শুনিয়ে চলে। যদিও নিজে সে হয়ে ওঠে নতুন মূল্যে নতুন রূপে সুন্দরের সর্বোত্তমা কল্পপ্রতিমা।
কবিতার প্রথম স্তবকে পাই –
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
অনেকে বলেন, কিটসের ‘On first looking into Chapman’s Homer’-এর ভাবনা ও কথার ধাঁচ এখানে ছাপ ফেলেছে। সেই অনুপাতে ভেজাল ঢুকেছে জীবনানন্দের আত্মকথনে। এই অভিযোগ কিন্তু বিবেচনার যোগ্য নয়। অন্তত কবির ঐতিহ্য-সচেতনতা, তার স্বীকরণ ও তাঁর বিশেষ কাব্যিক অভিজ্ঞতাকে ‘দূষিত’ না করে মর্মার্থী হয়ে বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে তাকে কাজে লাগাতে যে মনোজাগতিক অনুরণনের অনুসারী থাকার কথা তিনি বলেন, তা যথার্থ বলে মেনে নিলে এমন সব প্রশ্নই গুরুত্ব হারায়। ‘বনলতা সেনে’র বহিরঙ্গে কিটসের কবিতাটির একটু-আধটু ছায়া পড়ে মাত্র। তার অন্তরাত্মা বেপথুমতি হয় না। কিটসের কবিতার সূত্রপাত, Much have I travell’d in the realms of gold – এই পদ দিয়ে। ‘বনলতা সেনে’ ক্রিয়ার কালে যে মৌলিক তফাত হয়ে যায় এবং তাতেই কবিতার প্রেক্ষাপট ও ভাবনারূপ যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মহাদেশের কোনো এক প্রাণবিন্দুতে লগ্ন হয়ে দূরের অতীতেও অবাধে প্রসারিত হয়, তা আমাদের সবার আগে খেয়াল করা উচিত বলে মনে হয়। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’ – এতে প্রত্যক্ষ বর্তমান থেকে ধূসর অতীত পর্যন্ত ঘটমানতা সক্রিয়। ক্রিয়ার কর্তার চৈতন্য ধারণ করে তার সমস্তটার প্রবাহ। অথচ সে একক সত্তা। মোটেই অস্বাভাবিক নয় এটা। তার ইতিহাসচেতনা, স্মৃতি ও কল্পনা বাস্তব করে তোলে সবটা। অথবা বলা যায়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গণনার জগৎকে ছাড়িয়ে বাস্তব আরো সত্য, আরো গভীরভাবে অনুভববেদ্য হয়ে ওঠে। সমস্তটার নির্যাস প্রতিফলিত হয় বর্তমানের আয়নায়। একক অভিজ্ঞতার মূল কান্ড তাকে ধরে রাখে। তাকে অর্থবহ করে, এই কবিতায় তা বাস্তবের উৎস থেকে যেখানে চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, সেখানে এক ‘ক্লান্তপ্রাণ’ মানবচৈতন্যের কাছে শান্তি ও নির্ভরতার সুন্দরতমা প্রতিমা হয়ে উৎসারিত হয়। দেশ ও কালে অবমুক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে মৃত্তিকাসংলগ্ন এক তুচ্ছ মানুষের শুদ্ধ অনুভবের কথা বলা হয়নি কিটসের ওই কবিতায়। তাই জীবনানন্দ ‘অনেক ঘুরেছি আমি’ বললেও সে ‘ঘোরা’ ‘Much have I travell’d’-এর সঙ্গে সমলয়ে আসে না। নিজের জন্যে ভিন্নতর এবং আমার মতে সুন্দরতর, কক্ষপথ রচনা করে। পরের স্তবকে তা আশ্চর্য সুষমায় পূর্ণতা পায়; পূর্ণতা পায় কাঙ্ক্ষিত প্রতিমার জীবনতাড়িত রূপের মায়ায়। স্থান ও কালের গতির দাক্ষিণ্য তাতে স্তব্ধ হয়ে থাকে –
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
এখানেও কেউ কেউ কিটসের ওই কবিতার দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পান। কিটসে আছে –
Then felt I like some watcher of the skies
When a new planet swims into his ken;
Or like stout Cortez when with eagle eyes
He star’d at the Pacific – and all his men
Look’d at each other with a wild surmise –
Silent, upon a peak in Darien.
আসলে ‘তেমনি দেখেছি তারে’ – এই সমান্তরাল দৃশ্য উপস্থাপনের ভাষিক ব্যঞ্জনাটুকু ছাড়া ‘বনলতা সেনে’ কিটসের কবিতাটির ভাবনা-কল্পনার সঙ্গে কোথাও কোনো আন্তরমিল নিশ্চিত ধরা পড়ে বলে মনে হয় না। আর ওই ভাষিক ব্যঞ্জনা এমন নির্বিশেষ যে, যে-কোনো কবির বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তার দেবোত্তর উপাদানের সংগ্রহের ভেতরেই তা গণ্য হওয়ার যোগ্য। ‘হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’ stout cortez-এর দর্পিত অবলোকনকে, অথবা তার সহযাত্রীদের wild surmise-কে ঠিক মনে করিয়ে দেয় না। এটাও যে কেউ অনুভব করবেন, ‘অন্ধকারে’ – এই শব্দবাণ যোগ করে জীবনানন্দ গোটা দৃশ্যপটের ভাবরূপ সম্পূর্ণ অন্যমুখে ঘুরিয়ে দেন। ‘বনলতা সেন’ ‘On first looking into Chapman’s Homer’ – থেকে দূরে সরে। তার কালোত্তীর্ণ ভাবলোক, অথচ কালচিহ্নিত প্রেক্ষাপট, তার কোমলতা, মাধুর্য, করুণা ও বিষাদ – এসব তাকে এক অনন্য মহিমায় তুলে নিয়ে যায়। সে ‘বনলতা সেন’, শুধু এই পরিচয় তার অক্ষয় থাকে। সম্মোহন তার এতটুকু কমে না। তবে কবিতার বহিরঙ্গে এখানে-সেখানে অন্য সৃষ্টিপ্রতিভার ভাব বা ছবির কাটছাঁটের ভাসমান ছাপ ফুটে ওঠা বিচিত্র নয়। জীবনানন্দ নিজেই এর সম্ভাবনার কথা অশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন। কবি-কল্পনায় এতে বৈকল্য ঘটে না; বরং মাহেন্দ্রযোগে তা আরো ফুল্ল হয়ে ওঠে।
কবিতার তৃতীয় ও অন্তিম স্তবক স্থান ও কালে ‘করা এবং হওয়া’র বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি সমস্তটা খুঁটিয়ে আনে। নিবদ্ধ ও একীভূত হয় কেবলমাত্র বনলতা সেনে। –
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল,
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
প্রথম স্তবকে পাই বর্তমানের প্রান্তরেখায় বসে চেতনার প্রশস্ত পথে হাজার বছর ধরে ক্রমাগত পথ হাঁটা। তাতেই অতীতের কোনো এক প্রক্ষিপ্ত পর্বে, যেখানে ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’, সেখানে ‘ক্লান্ত প্রাণ এক’ ওই মানুষকে ‘দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। ‘দিয়েছিল’ ক্রিয়া নির্দেশ করে, অতীতের স্মৃতি ফিরে আসে বর্তমানে। দ্বিতীয় স্তবকের কাল অতীতাশ্রয়ী বর্তমান। লোকটি বলে, ‘তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ আরো জানায়, ‘পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’। ‘কোথায় ছিলেন?’ – এই কথা ইঙ্গিত দেয় দুজনে দেখা কোনো নিকটতর বর্তমানে – হতে পারে, পুরাঘটিত। এই দেখা অন্ধকারে – এক অনিশ্চিত অস্পষ্টতায়। ‘পাখির নীড়ের মত চোখ’ তাতে প্রসিদ্ধ প্রগাঢ় নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের আশা জাগায়। তৃতীয় স্তবক বর্তমানে পা রেখে ভবিষ্যতের দিকে মুখ করা। তা দিনান্তের, – সমস্ত কাজের অবসানের – ছবি অাঁকে। তখন ‘পৃথিবীর সব রঙ নিভে যায়’, ‘পান্ডুলিপি করে আয়োজন’, ‘জীবনের সব লেনদেন’ ফুরায়’। আর ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’। এই অন্ধকার দ্বিতীয় স্তবকের মতো অনিশ্চিত নয়। তা থাকে, এবং তা সামনে প্রসারিত। কিন্তু একই সঙ্গে থাকে ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’। একি অন্ধকারের সমার্থক, নাকি তার প্রতিপক্ষ? প্রতিপক্ষ ভাবাটাই বেশি সংগত মনে হয়। তা না হলে ‘মুখোমুখি বসিবার’ কেন? আরো লক্ষণীয়, – তা হয়ে যায়নি, বরং হচ্ছে এবং হবে, – এই ভাবটাই মনে জাগায়। এ যেন আসন্ন ভবিষ্যতের অচঞ্চল প্রবাহের চিত্রসার।
সহজেই বোঝা যায়, এ-কবিতায় কালের প্রেক্ষাপট দুদিকে খোলা। চেতনার আকাশ বাধাবন্ধহীন। কিন্তু চেতনার মানুষটি এই কালের, এই বাস্তবতার। অথবা, যে-কোনো কালের, যে-কোনো বাস্তবতার, যেখানে তার অবস্থান নিশ্চিত। কালের মাত্রার প্রসারণে সংকোচনে আশ্চর্য সুষমা এই কবিতার কপালে অসামান্যের টীকা এঁকে দেয়। আজও তা ম্লান হয়নি এতটুকু। যে-কোনো মানদন্ডে ‘বনলতা সেন’ পৃথিবীর সেরা কবিতার তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে। এর অপার সৌন্দর্য নিয়ে নান্দনিক কলার অভিনবত্ব নিয়ে এখানে আমরা কোনো আলোচনায় যাচ্ছি না। ‘ফলেন পরিচিয়তে’ – কবিতাটি পড়লেই তাদের পরিচয় মিলবে। এবং আমাদের বিশ্বাস, যে-কোনো পাঠকের মনের ওপর তার দাগ অবিমোচ্য থেকে যাবে। আবার তাই আমরা আলোচনার প্রারম্ভিক জায়গায় ফিরে যাই। বোঝার চেষ্টা করি, ‘স্বপ্ন’ কবিতার সঙ্গে ‘বনলতা সেনে’র আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না। থাকলে তা কেমন?

অসম্ভব নয়, ‘স্বপ্ন’ কবিতার কোনো কোনো ছবি জীবনানন্দের চেতনায় জারিত হয়ে ভিন্ন রূপের আড়ালে ‘বনলতা সেনে’ কোথাও কোথাও সঞ্চারিত হয়েছে। আমরা তুলনীয় ভাবকল্পনাগুলো পাশাপাশি রেখে তাদের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করতে পারি। অবশ্যই একই ছবি আবার হুবহু ফিরে আসে না। যদি কিছু এসেই থাকে, তবে তা কবির মনোজগতে ব্যাখ্যার অতীত রাসায়নিক রূপান্তর-ক্রিয়া পেরিয়ে। কোনো গাণিতিক সিদ্ধান্ত এখানে খাড়া করা সম্ভব নয়। বড়জোর আমরা চিন্তার ও কল্পনার ছাড়া-ছাড়া টুকরোগুলো নাড়াচাড়া করতে পারি। এইভাবে দেখি, যেন একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে চলে আসে – ‘স্বপ্ন’ কবিতার ‘মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,/ কর্ণমূলে কুন্দকলি, করুবক মাথে,/ তনুদেহে রক্তাম্বর জীবীবন্ধে বাঁধা,/ চরণে নূপুরখানি বাজে আধা-আধা’। ও ‘বনলতা সেনে’ প্রবাদতুল্য উচ্চারণ, – ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য-’। ‘স্বপ্ন’তে ‘প্রিয়ার কপোতগুলি ফিরে এল ঘরে’ ‘বনলতা সেনে’ অনুরণিত হয়ে বাজে ‘সব পাখি ঘরে আসে-’। এ রকম ‘মোর মালবিকা’ হয়ে যায় ‘নাটোরের বনলতা সেন।’ ‘ফেনিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস’, অথবা ‘নীরবে শুধালো শুধু সকরুণ অাঁখি,/ ‘হে বন্ধু, আছ ত ভালো?’ – ভিন্ন পরিমন্ডলে অনুরূপ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, যখন শুনি, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এ ছাড়া আছে অন্ধকারের অনুষঙ্গ। ‘স্বপ্ন’ কবিতার শেষ স্তবকে পড়ি, ‘রজনীর অন্ধকার/ উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার’। আর, ‘বনলতা সেনে’র শেষ চরণে ছড়ায় অন্ধকারের অসীম ব্যাপ্তি, – ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
এসব থেকে জনশ্রুতি এই বিশ্বাসযোগ্যতা পেতে চায় যে দুটো কবিতা একই বৃত্তের, এবং একই বৃন্তের। চার দশক আগে রবীন্দ্রনাথ যে স্বপ্নসুন্দরীর কল্পনা করেছিলেন, চার দশক পরে জীবনানন্দ তারই পুনর্জন্ম ঘটান। পাঠক-মন বুঁদ হয়ে একই রকম মানসীপ্রতিমা রচনা করে চলে। মাঝখানের সময়টা বুঝি ‘ঘোর মিছে’। অথবা, ছলনা না হলেও তা চূড়ান্ত বিচারে নিরর্থক। সুন্দরের পূর্ণশিখা অচঞ্চল থেকে যায়। তা স্তিমিত হয় না। বিক্ষিপ্তও না। ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’, ঘাত-প্রতিঘাতে যতই তুমুল হয়ে উঠুক না কেন, বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত মানুষ যতই ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ুক না কেন, একমুখী অনুভবের অনিবার্য সম্পাতে ‘মালবিকা’ ঠিকই ‘বনলতা সেন’ হয়ে যায়। দ্বৈতাদ্বৈত অটুট থাকে।
কিন্তু এ ধারণা আংশিক। এবং আংশিক বলেই বিপজ্জনক। যা পুরোপুরি ভুল, ধরা পড়লে তা উচ্ছেদ করা সহজ। আংশিক সত্য তার জায়গাটুকুতে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে। নানা উপকথাও ছড়ায়। তাকে নির্মূল করা যায় না। কারণ, সত্যের কণা একটু তাতে লেগে থাকে। নিষ্প্রভ করাও মুশকিল। তবে খোলা চোখে সবটুকু দেখলে আমরা এর আপেক্ষিক মূল্য ঠাহর করতে পারি।
আগেই দেখেছি জীবনানন্দ স্বয়ং বলেছেন, ‘ঋণ-বিস্মরণের মানুষ কবি নয়-’ এবং এই সঙ্গেই যোগ করেছেন, ‘এ জিনিস ঋণও নয়, উপায় বরং – মর্মার্থী হয়ে বেঁচে থাকবার।’ কবির প্রতিভাকে এ ‘সাহায্য’ করে; কিন্তু কবিপ্রতিভার বিকল্প কখনো হয়ে ওঠে না। তার যে বিশেষ অভিজ্ঞতা কবিতায় মূর্ত হয়, তাকে তা দূষিত করে না। বোঝা যায়, তিনি বলতে চান এ-কবিতার বাইরের উপাদান। তার প্রাণসম্পদ এ নয়। যদিও ওই প্রাণের পুষ্টিতে বা স্ফূর্তিতে এ রসদ জোগাতে পারে, যেমন : রসদ জোগায় স্থান ও কালের প্রবহমান পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা। অতএব, এতে কবিতা ভ্রষ্ট হয় না। তার বেঁচে থাকার, হয়ে ওঠার ‘উপায়ের’ ভেতর এ পড়ে; কিন্তু ওই পর্যন্তই। কবিতার আত্মঘোষণা তার নিজস্বতার গুণে। ওই উপায় তার সহায় হতে পারে, কিন্তু নিজে সে তার অধিকার দাবি করতে পারে না। যদি করে, এবং তা আদায় করে নেয়, তবে ওই কবিতা তার মর্যাদা হারায়। তাকে আর স্বমহিমায় গণ্য করা যায় না। ‘স্বপ্ন’ কবিতা ‘বনলতা সেনে’ তার প্রলম্বিত ছায়া যদি ফেলেও থাকে, তবু এমন কোনো দুর্ঘটনা কিছু ঘটে না। বরং একান্ত আপন অভিজ্ঞান নিয়ে ‘বনলতা সেন’ তার অন্তর্গূঢ় মাত্রা অবিরাম উন্মোচন করে চলে। কবিতার অনন্যতা তার আরো প্রসিদ্ধি লাভ করে।
অস্বীকার করা যায় না, ‘স্বপ্ন’ কবিতা থেকে ধ্বনির মায়া বা ছবির বার্তা কোথাও কোথাও অনুরণন তোলে ‘বনলতা সেনে’, কিন্তু এ-ঐতিহ্যের অঙ্গীকার মাত্র। আর কিছু নয়। উন্মার্গী বা উৎকেন্দ্রিক হয়ে কোনো কবিই সৃষ্টিশীল থাকতে পারেন না। ঐতিহ্যে পা রেখেই তাঁর জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে নিরন্তর অভিযান। তাতে যে মূল্যসংযোজন, সেইটিই তাঁর সৃষ্টি। তাঁর নিজস্বতার দাবি ওইটুকুই। যদিও ঐতিহ্যের উপাদান বুনে দিয়ে তিনি তার আকর্ষণ বাড়াতে পারেন। ভাবে, ভঙ্গিমায় অথবা এমনকি মনোভাবে ভিন্ন সুর জুড়ে দিয়ে তিনি তার রূপান্তরও ঘটাতে পারেন। সেখানে ঐতিহ্য তাঁর উপাদান, আবার একই সঙ্গে তাঁর চ্যালেঞ্জ। যেমন : মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যে। কবির মৌলিকত্ব ওই চ্যালেঞ্জের ভাষারূপ ভাবের উপযোগী করে গড়ে তোলায়। ‘স্বপ্ন’ কবিতার কোনো কোনো সুর বা কোনো কোনো অনুভবের স্মৃতি তাদের দৃশ্যকল্পনার আবেগসমেত ‘বনলতা সেনে’র কাব্য-শরীরের ওপর দিয়ে ভেসে গেলেও তা রবীন্দ্রবলয়ে ঢুকে পড়বে না, যদি মূল্যসংযোজনে তার বিশিষ্টতা সে নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ওই সংযোজন কতটা মহার্ঘ্য এবং দেশ ও কালের কতদূর চলমান, তার ওপর নির্ভর করে তার জীবনস্পন্দনের অর্থময়তা, তার রূপ-লাবণ্যের মহিমা।
আমরা খেয়াল না করে পারি না, কবি ‘বনলতা সেনে’ কালের এমন এক ব্যূহ রচনা করেন, যাতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যেন একসূত্রে গাঁথা। পাশাপাশি ঘটনা ও চিন্তা – দুটোই চলে সমান্তরাল। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কল্পনার পাখায় ভর করে দূরদূরান্তে চিন্তার বিস্তার। জীবনের ছক কিন্তু সীমিত। তাতেই মেলে ক্ষণিক শান্তির অবকাশ, মেলে নির্ভরতার আশ্রয়, আবার সবকিছুর অবসানে অমানিশার অনিবার্যতায় অন্তত মুখোমুখি বসে থাকার সমাহিত আশ্বাস। বোঝা যায়, দুটো কক্ষপথ এখানে সাজানো। আবার তারা পরস্পর অন্বিত। একটার ভাব সঞ্চালিত হয় অন্যটিতে। বিন্দু থেকে বিন্দুতে নয়। প্রবাহ থেকে প্রবাহে। এবং দুটো কক্ষপথেই গতি অবিরাম। তার পরেও সবটা ধরা বর্তমানের মুঠোয়। সমন্বিত চিত্রকল্পনার মদির-গভীর আয়োজনে কোথাও কোনো অসংগতি নেই, অনুভবে অসততা বা প্রকাশে চটকদারিত্বও নেই। গোটা কবিতা আত্মস্থ মহিমায় ঊর্ধ্বে মুখ তুলে চায়, যেমন চায় তার তুলনাহীনা নায়িকা বনলতা সেন। তুলনাহীনা, কিন্তু বাস্তববর্জিত নয়, প্রত্যক্ষ জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে তৃষ্ণার ও স্বপ্নের আকুলতা থেকে সে উঠে আসে। এইখানে সে তার সময়েরই প্রতীক এবং প্রতিনিধি। চার দশক আগের স্বপ্নমায়া, যা বাসা বাঁধে। উজ্জয়িনীর এলডোরাডোয়, তার গায়ে লেগে থাকে না।
‘স্বপ্ন’ কবিতা কিন্তু উৎক্ষিপ্ত হয় বর্তমান থেকে অতীতের এক নির্বাচিত কালবিন্দুতে। সময়ের বিপুল ব্যবধান রচিত হয় এখানেও। তবে তার উল্লম্ফন এক স্থিরবিন্দু থেকে আর এক স্থিরবিন্দুতে, যাকে বলে কমপ্যারেটিভ স্ট্যাটিক, এ ঠিক তাই। চেতনার গতিময়তা এখানে বিষয় নয়, বরং বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এক সুনির্দিষ্ট-সুকম্পিত স্বপ্নলোকে এর প্রস্থান। ইতিহাস তার সাক্ষী থাকে; দূরের মোহ তাকে আচ্ছন্ন করে। আক্ষরিক অর্থে এ স্বপ্নযাপন। এবং নায়িকার অবস্থান বর্তমানের বিপরীতে। সৌন্দর্যের-কামনার আদিরূপ যেন সে। কালিদাসের কাল থেকে সে বেরিয়ে এসে বাইরে পা ফেলে না। ওই কালে আপন ভুবনে সে থাকে। মিলতে হয় তার সঙ্গে সেখানে।
‘বনলতা সেন’ থেকে এই তফাতটা মৌলিক। এতে কবিতার ভাব-মেজাজ শুধু বদলেই যায় না, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দৃশ্যকলার ভিন্ন অর্থময়তা ধরা পড়ে। ‘বনলতা সেনে’র যে বহুমাত্রিক ব্যঞ্ছনা, তা এখানে ফোটে না। ফোটাবার চেষ্টা যে কবি করেছেন, তা-ও মনে হয় না। কবিতা দুটোর জাত আলাদা, এইটিই আমাদের মানতে হয়। ওপর ওপর যেসব মিল চোখে পড়ার মতো, ঐতিহ্যের অঙ্গীকার মেনে নিলে সেসব, অথবা সেরকম মিল যে-কোনো দুটো ভালো কবিতার বেলায় থাকতে পারে। এ ব্যাপারে জীবনানন্দের স্মরণীয় উক্তি আমরা দেখেছি। তাকে অযথার্থ মনে করার কোনো কারণ নেই। ‘ঋণ-বিস্মরণ’ না করেও কবি যে আত্মস্থ ও স্বয়ম্প্রভ হয়ে উঠতে পারেন, তার ইঙ্গিত তাতে পাই। সবাই মানবেন, তারই সুন্দরতম-সার্থকতম উদাহরণ তিনি মেলে ধরেন ‘বনলতা সেনে’।
‘অন্ধকারে’র উপস্থিতি ‘স্বপ্ন’ কবিতায় আছে, ‘বনলতা সেনে’ও আছে। কিন্তু ‘স্বপ্ন’তে ‘অন্ধকার’ বহুবিচিত্র – বহুরূপী কি না, এ প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে না। ‘বনলতা সেনে’ জাগে। ‘স্বপ্ন’তে ‘রজনীর অন্ধকার/ উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার’ – এখানে ‘অন্ধকার’ প্রবলভাবে প্রকৃতিসিদ্ধ বহির্জাগতিক রূপ। তা সরল একমাত্রিক। ঘটনার দ্ব্যর্থক সম্ভাবনার দিকে সে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারে, কিন্তু নিজে সে ঘটনায় সকর্মক হয় না, তার রূপ, রং বা বোধের প্রকাশের বাড়তি কোনো প্রভাব ফেলে না। আমাদের মনের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ওই ‘অন্ধকারে’র নির্বিশেষ একক বিস্তারের পরিপূর্ণতাতেই ফুটে ওঠে। অন্য কিছু এ বিষয়ে ভাবি না। কবিতায় ‘- অন্ধকার হর্ম্য ’পরে সন্ধ্যারশ্মিরেখা’র বর্ণনাও আছে। কিন্তু তা মনোমুগ্ধকর হলেও সর্বাংশে প্রাকৃতিক। পরিস্থিতি রচনায় সহায়ক মাত্র। ঘটনার অন্তরাত্মার প্রতিফলন তাতে হয় না। ওই অন্তরাত্মায় তা মেশেও না।
‘বনলতা সেনে’ অন্ধকারের উল্লেখ পাই চারবার – ‘১. আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে, ২. চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, ৩. তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, এবং ৪. থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ এই ‘অন্ধকার’ সব জায়গায় একই ছবি অাঁকে না। আমাদের চেতনায় তার রঙের তারতম্য ঘটে। কোথাও সে ঘন কালো, কোথাও বা হালকা ছায়া-ছায়া। সেই অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন তার বার্তা। কবিতার প্রাণকেন্দ্রে সে রক্ত-সঞ্চালন করে। হয়ে পড়ে বিচিত্র ভাবের বাহন।
‘আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে’তে ‘অন্ধকার’ চেতনায় স্থান ও কালের মিলিত ধারার দূরত্বকে ইতিহাসে জানা-অজানার প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। কল্পনা তার কঠিন খোলস ভাঙে। তাই বলা যায়, ‘সেখানে ছিলাম আমি।’ অনুভব করা যায় তার বাস্তবতাকে। ‘অন্ধকার’ তার অন্তর্জাত রূপের ও জীবনলীলার অবগুণ্ঠিত ছবির দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
‘অন্ধকারে’র দ্বিতীয় ব্যবহার এই কবিতার সবচেয়ে পরিচিত সর্বাধিক উচ্চারিত পদটিতে। ‘তার’ চুলের উপমায় এসেছে ‘অন্ধকার বিদিশার নিশা’। এই অন্ধকার ইন্দ্রিয়ঘন – যাকে বলে ‘ভোলাপচ্যুয়স’, তাই জাগিয়ে তোলে কিংবদন্তির বিদিশা নগরীর রাতের উন্মাদনার স্মৃতি। ব্যক্তিহৃদয়ে আবেগের ঢেউ তোলে তা অনিবার। প্রবল প্যাশন জড়িয়ে থাকে এখানে অন্ধকারের সঙ্গে। তাকেই মূর্ত করতে চায় কবিতা।
কিন্তু এই অন্ধকারের রূপ-রং বদলে যায়, যখন পরের ছবিতে দিশাহারা-হালভাঙা নাবিকের চোখে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর সবুজ ঘাসের দেশের মতো ওই নারীকে অন্ধকারে সে দেখে। ছবির কল্পনাতেই বোঝা যায়, এই অন্ধকার ছায়া-ছায়া, স্ফুটনোন্মুখ আলোর আভাস ধরা পড়ে তাতে। হতাশ ভেঙেপড়া এক মানুষের প্রতীক অতিদূর সমুদ্রের পর হালভাঙা দিশাহারা নাবিক। তার চোখে আশা জাগে যখন সে দেখতে পায়, সবুজ ঘাসের দেশ। সেই দেশ দারুচিনি বনের ছায়ায় ঢাকা। ওই ছায়াঢাকা যে অন্ধকার, যাতে সবই দেখা যায়, এবং যাতে আছে জীবনের আশ্বাস, সে রকম আবছা আলোয় নিরাপত্তার ও নির্ভরতার ভাব ফুটিয়ে ‘পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে’ এই নারী বলে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ স্পষ্টত, ‘অন্ধকার’ এখানে তার রূপ পালটায়। বোধের পাপড়িগুলো খুলে দিতে সে নিজেই আসরে নামে। ভোরের রাগ বা আসন্ন সন্ধ্যার রাগ যেমন, তেমন।
কবিতার শেষ স্তবকে ধরা দিতে থাকে অবসানের ছবি। ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’; ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’; আগেই দেখেছি, ‘পৃথিবীর সব রং মুছে’ যায়, যেহেতু ‘পান্ডুলিপি করে আয়োজন’; তখন ‘সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী’ – এবং, আবার বলি, ‘ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’; আর অবসানের, অথবা আসন্ন অবসানের প্রান্তরেখা থেকে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়, ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’। এই অন্ধকার অবিমিশ্র, নির্লেপ। থাকাটাই তার হওয়া, এবং সেই তার পরিচয়। এই সম্ভাবনার সামনে তখন বনলতা সেনের মুখোমুখি বসে থাকা। অন্ধকারের রহস্যময় ঘনত্ব গ্রাস করে সমস্ত পরিমন্ডল। বনলতা সেন কি তার হন্তা অথবা হত? নাকি তাকেও ছাড়িয়ে ‘নায়ম্ হন্তি ন হন্যতে?’ অন্ধকার ও বনলতা সেনের দ্বৈতাভাস এক সমে এসে থামে। কিন্তু অমীমাংসিত, ও অমীমাংসেয়, এই বাস্তবতার রেশ তার পরেও থেকে যায়। আমাদের পরিশুদ্ধ বোধের আচ্ছন্নতা কাটে না।
অন্ধকারের এই ভাবব্যঞ্জনা ‘স্বপ্ন’তে নেই। এবং এইখানেই ‘বনলতা সেন’ হয়ে ওঠে আশ্চর্য রকম নতুন, এবং আশ্চর্য রকম সারগর্ভা। বর্তমানের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে কালের প্রেক্ষাপট সমস্তটা তার চলমানতায় যে সে মুঠোর ভেতরে ধরে, এখানেও সে তুলনাহীনা। আর সুন্দরের নান্দনিক বোধের যে এতে প্রসারণ ঘটে, তাও আমাদের বিস্ময় জাগায়। প্রায় চার দশক আগের ‘স্বপ্নে’র জগৎ সে ছাড়িয়ে যায় অনেকদূর। প্রত্যক্ষ বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাত স্পন্দিত হয় তার হৃদয়ে। কবির ‘চিন্তা ও কল্পনাপ্রতিভা’ তাদের সুসমন্বিত করে। ‘বনলতা সেন’ পুনর্ভবা হয়। তারপরও ঐতিহ্যকে সে প্রত্যাখ্যান করে না। বিনয় তাকে পরিশীলিত করে। চার দশক ধরে বিশ্বপটে ঘটনার ঘনঘটার অপ্রত্যাশিত আয়োজন এই বাংলাতেও সংবেদনশীল মনের ওপর যে বিরতিহীন দাগ কেটে চলে, চেতনায় তা চোলাই করে তার আন্তরস্বরূপকে আশ্চর্য-অব্যর্থ বাক্-প্রতিমায় ফুটিয়ে তোলে এ কবিতা। ‘স্বপ্ন’ কবিতার স্থিরচিত্র এ থাকে না। তবে কবিতা প্রতীকোৎসারিত হয়। এবং কোনো-কোনো প্রতীক অব্যক্ত কর্মচঞ্চলতার চিত্রমায়া বহন করে। যেমন : ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’ অথবা, ‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’। ‘ইশারাই কবিতা’ – এ ধারণাই মূর্ত হয় যেন। কালের অস্থিরতার চৈতন্যশাসিত প্রতিনিধি হয়ে ওঠে এরা; যদিও ‘স্বপ্নে’র জগৎকে যে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, তা-ও নয়। তবে কবিতা যখন পাপড়ি মেলে, তখন তার দলগুলো আলাদা আলাদা আমরা দেখি না। সব মিলে তার ঐক্য ও একত্ব দুই-ই আমরা দেখি। সেই দেখাটাই পুরো দেখা। এবং তেমন দেখাতে পারাতেই কবিতার সার্থকতা। ‘বনলতা সেন’ এমন সার্থকতার সর্বোত্তম নিদর্শন। ‘স্বপ্ন’চিহ্ন তার শরীরে অাঁকা থাকলেও তাতে এর হেরফের হয় না।