খুশবন্ত সিংয়ের  একটি গল্প ও দুটি সাক্ষাৎকার

অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

ভারতীয় সাহিত্যজগৎ ও সাংবাদিকতার গ্র্যান্ড ওল্ডম্যান সর্দার খুশবন্ত সিং ২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু বছর আগে নিজের অবিচুয়ারি ও এপিটাফ লিখে রেখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা খুব কমই হয়ে থাকে, খুশবন্ত সিং নিজেকে নিয়ে তাই করেছেন। দীর্ঘায়ু সর্দার শতায়ু হতে হতে সেঞ্চুরি মিস করেছেন। নার্ভাস নাইনটি নাইনে এমন একটি দুর্মূল্য উইকেট পড়ে যাবে, খুশবন্ত-ভক্তদের কেউই তা চাইতেন না। ২০ মার্চ ২০১৪ তা ঘটে গেল।

নারী ও যৌনতার মিশেল দিয়ে এমনকি বার্ধক্যেও তিনি এত বেশি লিখেছেন যে, ‘ডার্টি ওল্ডম্যান’ খেতাবটি তাঁর বেলায় বেশ মানিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘ওভার রেটেড’ সাহিত্যিক বলায় মার খাওয়ার দশা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারি সমর্থন করে বিতর্কিত হয়েছেন, কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

জন্মশতবর্ষে খুশবন্ত সিংয়ের একটি ছোটগল্প ও দুটি সাক্ষাৎকারের অনুবাদ প্রকাশ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো।

মান্দলার মেমসাহেব

জন ডাইসন পাহাড়ের চূড়ায় নামলেন এবং চারদিকের দৃশ্য দেখে নিলেন। জঙ্গলের কেন্দ্রে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় লাল ইটের রেস্টহাউস। চারদিকে যেখানে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে  গাছ ও লতাগুল্মের উঁচু দেয়াল – লতাগাছগুলো শাখা-প্রশাখার মধ্যে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। যেদিক থেকে রাস্তা উপত্যকার দিকে নেমে গেছে সেখানটাই ফাঁকা। চোখ মেললে দেখা যায়, মাইলের পর মাইল উপত্যকা ঘন বনে ছেয়ে আছে।

মালামাল এর মধ্যে চলে এসেছে এবং বারান্দায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের কাছে নিজেদের পাছার ওপর বসে কুলিরা পালা করে মা টানছে। ওভারশিয়ার একটি লোহার চেয়ারে বসে তাদের সঙ্গে কথা বলছে।

সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের হুঁক্কা পার্টি শেষ হলে ওভারশিয়ার ডাইসনের সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে গেল। তাকে লক্ষ করে ডাইসন বললেন, ‘চমৎকার বাগান। কে এর পরিচর্যা করে?’

‘সাহেব, একজন বুড়ো মালি আছে, পঞ্চাশ বছর ধরে বুড়ো এখানে বাস করছে – এ-বাড়ি যদ্দিন ধরে আছে, তদ্দিন মালিও এখানে কাজ করে যাচ্ছে।’

ভিড় ঠেলে একজন হাড় জিরজিরে বুড়ো এগিয়ে এসে হাতজোড় করে জন ডাইসনের সামনে মাথা নুইয়ে তাকে সম্মান জানিয়ে বলল, ‘গরিবের দয়াল আমিই মালি। পনেরো বছর বয়স থেকে আমি এই বাগানের মালি। জিন মেমসাহেব আমাকে এখানে এনেছিলেন আর এখন আমার বয়স ষাট বছর। জিন মেমসাহেব এখানেই মারা গেছেন। আমার মৃত্যু হবে এখানেই।’

‘জিন মেমসাহেব?’ ওভারশিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানে কটনের স্ত্রী নাকি?’

‘না স্যার, কেউ তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। তিনি সমাজকর্মী শিক্ষক কিংবা মিশনারি – এ-ধরনের কিছু একটা ছিলেন। তিনি এই বাংলোটা বানিয়েছিলেন, বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল করেছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। কেউ কিছু জানত বলে মনে হয় না। সরকার এই বাংলোটার দখল নিয়ে এটাকে বন বিভাগের অফিসারদের রেস্টহাউস বানিয়ে ফেলল।’

কুলিদের চেঁচামেচিতে এই আলোচনা বাধা পেল। তারা পালকি চেয়ারে বসিয়ে মিসেস ডাইসন ও তার মেয়ে জেনিফারকে বহন করে নিয়ে আসছে।

বাড়িটির দিকে হাত নেড়ে ডাইসন বললেন, ‘ওল্ড মিশন স্কুল। জায়গাটা মন্দ নয়, তাই না?’

ডাইসন পরিবারের সদস্যরা নীরবে চারদিক দেখে নিচ্ছে। পড়ন্ত সূর্য এই বাংলো, লন, ফুলবাগান এবং লতাগুল্মঢাকা চন্দন বন সোনালি আলোর ছটায় রাঙিয়ে রেখেছে। শান্তি ও শান্তিময় পরিবেশ। উপত্যকায় নেমে আসা মর্মরধ্বনি সন্ধ্যার নিস্তব্ধতাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।

সূর্য ডোবার আগেই ওভারশিয়ার ও কুলিদের সবাই উপত্যকায় গ্রামের পথে চলে গেল। ডাইসনরা গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেয়ারারা হারিকেন-লণ্ঠনে আলো দিতে, ডিনার টেবিল ঠিকঠাক করতে এবং বিছানায় মশারি খাটাতে লেগে গেছে। মিসেস ডাইসন জেনিফারকে নিয়ে রুমগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছেন। বারান্দায় হাতাওয়ালা বড় বেতের চেয়ারে গায়ে টানা দিয়ে এলিয়ে পড়েছেন, পাইপ ধরিয়ে স্কচের হুকুম দিয়েছেন। তিনি দেখছেন অস্তগামী সূর্য মৌসুমি মেঘের রং বদলে দিচ্ছে – প্রথমে বার্নিশ করা সোনার রং, তারপর তামাটে লাল, কমলা, গোলাপি-সাদা এবং সবশেষে গোমরা ধূসর। গোধূলি রাতের ভেতর ডুবে যেতেই এই উষ্ণ অঞ্চলের জঙ্গলে নেমে এলো এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা। আঁধার গাঢ় হয়ে আসার ক-মিনিটের মধ্যেই পাখিরা স্থির হয়ে গেল। এখন জঙ্গলে এক ভিন্ন ধরনের সজীবতা – ব্যাঙ ডাকছে, শেয়াল ও হায়েনা ডাকছে। ডাইসন যেখানে বসে স্কচের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, সিগারেট ফুঁকছেন ঘাসের ওপর নেমে আসা জোনাকিরা প্রায় সেখানেই চলে এলো।

বেয়ারা জানাল, ডিনার তৈরি। ডাইনিং টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। বাতিদানে রাখা হারিকেনের বিবর্ণ হলদে আলো বয়স আর মৌসুমি বৃষ্টির কারণে রংহারানো দেয়ালের ধূসর প্লাস্টারের ওপর পড়ছে।

ডিনার টেবিলে তেমন কথা হয়নি। কেবল চেয়ার-প্লেট আর বিভিন্ন পদের খাবার নিয়ে আসছে-যাচ্ছে, প্লেট আর চামচের শব্দ নিপীড়নকারী নীরবতা ভাঙছে। জেনিফার বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যখন সে বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখছিল, বেয়ারা তখন ডাইনিং রুমে আসার আহবান জানালে তাতে বাধা পড়ে। শব্দ করে ছুরি আর কাঁটাচামচ রেখে জেনিফার উঠে পড়ে।

‘দেখো মা, দেয়ালে একটা ছবি।’

মিসেস ডাইসন কেঁপে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। সিলিং থেকে মেঝেতে চুঁইয়ে পড়া পানির লম্বা দাগ ডিস্টেম্পারের রং নষ্ট করে দিয়েছে।

বাতির মিটমিটে আলোর ওঠা-নামায় দেয়ালের ওপর সৃষ্টি হওয়া নকশাগুলোকে বদলে দিচ্ছে।

কর্কশকণ্ঠে মিসেস ডাইসন বললেন, ‘জেনিফার আমাকে ভয় দেখানো বন্ধ করে নিজের খাবার শেষ করো।’

ডিনারের বাকি সময়টুকুতে নীরবে খাবার গ্রহণ করা হলো। যখন কফি সার্ভ করা হলো জেনিফারকে ততক্ষণে বিছানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মিসেস ডাইসন আরো একবার দেয়ালের দিকে তাকালেন। দেয়ালে কিছুই নেই।

‘জন, জায়গাটা আমার পছন্দ হয়নি।’

ডাইসন মন্থরগতিতে পাইপ ধরালেন, ম্যাচবাক্স দিয়ে তামাকটা পাইপে চেপে ধরলেন।

মিসেস ডাইসন আবার বললেন, ‘জন, জায়গাটা আমার পছন্দ হয়নি।’

‘তুমি তো ক্লান্ত। বরং তুমি বিছানায় চলে যাও।’

মিসেস ডাইসন বিছানায় গেলেন। কিছুক্ষণ পর তার স্বামী তাকে অনুসরণ করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে তিনি নাক ডাকতে শুরু করলেন।

মিসেস ডাইসন ঘুমোতে পারলেন না। মশারি টানানোর খুঁটিতে বালিশ ফেলে তাতে হেলান দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে-রাতে চাঁদ ছিল না, কিন্তু আকাশ ছিল স্বচ্ছ এবং বাগানে ছিল নক্ষত্রের আবছা আলো।

সবুজ লন পেরিয়ে বন উঁচু কালো দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে। ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গের ডাক, মাঝেমধ্যে পাখির তীক্ষ্ণ কিচিরমিচির, হায়েনার হাসি, শেয়ালের হুক্কাহুয়া জঙ্গলটাকে বিভিন্ন রকম ধ্বনিতে ভরে রেখেছে। এতে মিসেস ডাইসনের কপালে শীতল ঘাম জমে উঠল।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে জঙ্গলের চূড়ায় মলিন চাঁদ উঠল, বিবর্ণ আভা বাগানে ছড়িয়ে পড়ল। শিশিরঢাকা লনে সাদা রঙের জাল বিছানো।

আতঙ্কের অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে মিসেস ডাইসন একটু হাঁটাহাঁটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার খালি পায়ের নিচে ঘাস ঠান্ডা ও ভেজা। হাঁটতে হাঁটতে পেছন ফিরে দেখেন সাদা শিশির কেটে এগিয়ে আসায় পেছনে সবুজের লম্বা রেখা তৈরি হয়েছে। তিনি এমনভাবে মাথা ঝাঁকালেন যেন একটা বড় বোঝা ফেলে দিচ্ছেন; আর বেশ ক-বার গভীর নিশ্বাস নিলেন। তিনি সতেজ ও উল্লসিত বোধ করলেন।

মিসেস ডাইসন চন্দ্রালোকিত লনে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন। তরতাজা ভাব ফিরে এলে বিছানায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বারান্দা পর্যন্ত এসেই তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। তার কয়েক কদম সামনে থেকে ঘাসের ওপর পায়ের ছাপ ভেসে উঠতে থাকল। অদৃশ্য পায়ের পা ফেলার চিহ্ন বাগানের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। মার্গারেট ডাইসন জ্বরজ্বর অনুভব করলেন; হাঁটু দুর্বল হয়ে আসছে, একসময় তিনি পড়ে গেলেন।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, ভোর হয়-হয়। পাখির গানে পুরো গ্রামাঞ্চল সজীব হয়ে উঠেছে। ভীষণ ক্লান্ত মিসেস ডাইসন টেনে-টেনে নিজেকে বিছানায় নিয়ে এলেন।

বেয়ারা যখন চা নিয়ে এলো, বারান্দা দিয়ে রোদ ঢুকছে। ডাইসন সাহেব নাশতা সেরে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি। লনের আরো দূরপ্রান্তে ওভারশিয়ার ও কুলিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

সূর্য ডোবার কিছুক্ষণ আগে ডাইসন ফিরে এলেন। হুইস্কি ও সোডার আদেশ দিয়ে তিনি তার জুতো খোলার জন্য বেয়ারার দিকে পা বাড়িয়ে দিলেন। কয়েকটা হুইস্কি মেরে দেওয়ার পর তিনি আমুদে হয়ে উঠলেন।

‘আমরা ডিনারে কী খাচ্ছি? মুরগি-তরকারির গন্ধ আসছে। আমার ক্ষিধে পেয়েছে – খাবারের গন্ধ নিয়ে আসা বাতাসকে তো আর টলাতে পারছি না।’

ডাইসন পরিবার নীরবে ডিনার সারছে, তিনি খাবারটা খুব উপভোগ করছেন। লন ধরে হেঁটে একটি খেঁকশেয়াল প্রায় ডাইনিং রুমের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে হুক্কাহুয়া ডেকে উঠল। মিসেস ডাইসনের কাঁটাচামচ হাত থেকে পড়ে গেল। তার স্বামী মুখ খোলার আগেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং কর্কশ ফিসফিসানিতে বললেন, ‘জন, আমি এ-জায়গাটা পছন্দ করছি না।’

‘তোমার নার্ভগুলো ঠিক কাজ করছে না। এটা তো কেবল একটা খেঁকশেয়াল। আমি কটা গুলি করে মারব। এরা তোমাকে আর বিরক্ত করবে না। এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। কালরাতে তোমার ভালো ঘুম হয়েছে তো?’

‘হ্যাঁ, ধন্যবাদ।’

কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে জেনিফার বলল, ‘মা আমি তোমাকে লনে হাঁটতে দেখেছি।’

মিসেস ডাইসন বললেন, ‘তোমার ভাগের পুডিং শেষ করে বিছানায় যাও।’

‘কিন্তু মা, আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি সাদা গাউন পরেছিলে, আমি ঘুমোচ্ছি কিনা তুমি মশারির ভেতর তাকিয়ে দেখলে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি তোমাকে দেখেছি।’

মিসেস ডাইসন ফ্যাকাসে হয়ে উঠলেন।

‘বাজে কথা বলো না জেনিফার, ঘুমোতে যাও। আমার যে কোনো সাদা ড্রেসিং গাউন নেই এটা তো জানোই। মিসেস ডাইসন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, স্বামী এসে তার সঙ্গে যোগ দিলো।

‘তোমার কি রাতে ঘুম হয়নি?’

‘আমার মোটেও ঘুম হয়নি। কিন্তু জন, আমার তো কোনো সাদা গাউন নেই আর আমি জেনিফারকে বিছানায় দেখতে যাইনি।

‘ধ্যাৎ, ও বাজে বকছে। এসো জেনিফার, পুডিংটা শেষ করে তুমি বিছানায় চলে যাও। আমি বন্দুক নিয়ে এগুলোর মধ্যে একটা শেয়াল তো মারি। তুমি খেঁকশিয়ালের চামড়ায় তৈরি ফার কোট পছন্দ করবে?’ মেকি দরদ দিয়ে ডাইসন জিজ্ঞেস করলেন।

‘না, খেঁকশেয়াল আমার পছন্দ নয়।’

ডাইসন বন্দুক তুলে নিলেন, গুলি ভরলেন, বিছানার কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখলেন। তিনি পাইপ ধরালেন, যতক্ষণ না ঘুম আসে অবিরাম কথা বলে চললেন।

স্ত্রীকে বললেন, ‘যদি খেঁকশেয়ালের ডাক শুনতে পাও, আমাকে জাগিয়ে দিয়ো।’

‘ঠিক আছে সোনা।’

ক-মিনিটের মধ্যেই ডাইসন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লেন।

জেনিফারও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মিসেস ডাইসন বিছানায় শুয়ে দুচোখ খুলে মশারির ভেতর দিয়ে লন এবং জঙ্গলের সীমানায় বৃক্ষপ্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ধোঁয়াশে কুয়াশার ভেতর থেকে লম্বা সাদা ড্রেসিং গাউনের একজন নারীর অভ্যুদয় ঘটল। তার চুল দুটো বিনুনিতে বাঁধা, ঘাড়ের ওপর বিছানো। তার চেহারায় শনাক্ত করার মতো বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকলেও তার চোখ দুটোতে এক অমানবিক উজ্জ্বলতা। মিসেস ডাইসন শীতল হয়ে আতঙ্কে পাথরে পরিণত হলেন। তিনি চিৎকার করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু গলাচাপা গোঙানির শব্দ কেবল বের হলো। জন ডাইসন তখন অবিরাম নাক ডেকে চলেছেন। এই ছায়ামূর্তি মিসেস ডাইসনের দিকে চোখ রেখে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে। ছায়ামূর্তি যখন লনের মাঝামাঝি, ভোঁ-দৌড়ে একটি খেঁকশেয়াল এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। জন্তুটি মাথা উঁচিয়ে বড় করে ডাক দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই অন্যরা তার সঙ্গে কোরাসে যোগ দিলো।

মিসেস ডাইসন দেখলেন তার স্বর ও গোঙানি বদলে গিয়ে উন্মত্ত আর্তচিৎকারে পরিণত হয়েছে।

হঠাৎ চমকে জন ডাইসন জেগে উঠলেন এবং দ্রুত বন্দুকের দিকে ছুটলেন। কিন্তু স্থিত হয়ে শেয়ালের দিকে তাক করার আগেই ওরা অন্যদিকে ছুটে গেল। ডাইসন একটিকে লক্ষ করে বন্দুকের ব্যারেল খালি করে ফেললেন, কিন্তু লক্ষ্যটি তার গুলির আওতার বাইরে।

ডাইসন বিড়বিড় করে নিজেকে বোঝালেন, জারজটার গায়ে লাগাতে পারিনি।

পরদিন সকালে ডাইসনদের স্নায়ু বেশি খিচড়ে আছে। ডাইসন বললেন, ‘আমি দুঃখিত লক্ষ্মীসোনা, আমি তোমাকে গতরাতে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। আজ এগুলোকে অবশ্যই দেখে নেব।’

‘জন, তুমি কি আর কিছু দেখোনি?’

‘আর কিছু? আর কী?’

‘সাদা পোশাকের একজন নারী। তুমি যখন গুলি করলে হেঁটে-হেঁটে সোজা আমাদের দিকে আসছিল।’

‘বাজে বকো না। দুঃখিত যে, শেয়ালটাকে সই করতে পারিনি। আর তুমি নিজে ধাতস্থ হও।’

‘কিন্তু জন আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে। প্রথম রাতে লনে আমি তার পায়ের ছাপ দেখেছি।’

মিসেস ডাইসন একটু দম নিলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এসো, দেখে যাও।’

তিনি স্বামীকে লনে নিয়ে গেলেন। তখনো ঘাস দুধেল সাদা, সূর্যের আলোতে চকচক করছে। ঘাসের ওপর পায়ের ছাপ। ডাইসন পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে করতে গাছগাছালিহীন একটি খালি জায়গায় এসে থামলেন। খোলা জায়গার ঠিক মাঝখানে একটি কবর, পুরনো জীর্ণ কবর – কোনো পাথর বসানো নেই, কোনো কিছু লেখাও নেই। এর চারদিকে শ্যাওলা গজিয়েছে। প্লাস্টারের ফাটল দিয়ে আগাছা ও ফার্নগাছ গজিয়েছে।

ডাইসন ভয় পেয়েছেন, কিন্তু নিজের স্বর বদল হতে দেননি। তিনি বললেন, ‘ধ্যাৎ, বড্ড বাজে। কথায় তা কেমন করে ফেলবে।’ যখন ওভারশিয়ার এলো, ডাইসন তাকে অফিস থেকে ডেকে পাঠিয়ে পেছনের দরজা বন্ধ করলেন।

‘সুন্দরলাল, এ-বাড়ি সম্পর্কে তুমি কী জানো?’

‘তেমন কিছু না স্যার’, তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘এ-নিয়ে গ্রামে অনেক কথা বলা হয়, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষেরা তা বিশ্বাস করে। বহু বছর কেউ এই বাড়ির দখল নেয়নি। এমনকি সরকার হুকুমদখল করে বাড়িটি নিয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় অফিসাররা এখানে থাকতে রাজি হননি। কিন্তু মালি প্রথম থেকে এখানেই আছে; মনে হয় বেশ সুখেই আছে।’

‘মালিকে ডেকে পাঠাও।’

সুন্দরলাল মালিকে ডেকে নিয়ে এলো।

‘সাহেব বাড়িটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। যা জানো সাহেবকে বলে দাও।’

হিন্দুস্তানি ভাষায় মালি বলল, ‘আপনি গরিবের দয়াল, শুনুন। মান্দলা থেকে এসে জিন মেমসাহেব এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। বাচ্চাদের একটা স্কুলও করেছিলেন। খাসজমির ওপর করা ছিল বলে এ নিয়ে অনেক বছরের আইন-আদালতের পর সরকার জিতে যায় এবং বাড়িটা দখল করে নেয়।’

ডাইসন জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিন মেমসাহেবের কী হলো?’

‘সাহেব তিনি এ-বাড়িতেই মারা যান। সরকার বাড়ি দখলে নেওয়ার পর বেগম সাহেব স্কুলটি বন্ধ করে দেন। তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৃষ্টির দিনে তিনি বাগানে হেঁটে বেড়াতেন, ম্যালেরিয়া বাধিয়ে বসলেন। বেশ ক-বার ম্যালেরিয়ায় ভোগার পর বেগম সাহেব মারা গেলেন। তখন কেবল তার মুসলমান বেয়ারা রিয়াজ আর আমিই উপস্থিত ছিলাম। সাহেবদের খবরটা জানাতে আমরা মান্দলা গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহেবদের কেউ তাকে চেনেন বলে মনে হলো না। আমরা বেগম সাহেবকে এই জঙ্গলে কবর দিলাম। রিয়াজ চলে গেছে মান্দলায়, বেয়ারা হিসেবে কাজ করছে। আর আমি এখানে সরকারের সঙ্গেই রয়ে গেলাম।’

‘তার মৃত্যুর পর কজন এ-বাড়িতে বসবাস করেছেন।’

‘সাহেব একজনও না। অফিসাররা এসেছেন, চলে গেছেন। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে – এ-বাড়িতে জিন মেমসাহেবের অভিশাপ রয়েছে। কিন্তু আমি তো পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় এখানেই বসবাস করছি, আমার কোনো ক্ষতি হয়নি।’

জন ডাইসন ওভারশিয়ার আর মালিকে বিদায় করে স্ত্রীর কাছে এলেন। নির্বিকারভাবে বললেন, ‘এখনই ওভারশিয়ার আর মালির সঙ্গে কথা বলে এলাম। এ-বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না – এ নিয়ে বহু গল্প চালু আছে। কিন্তু মালি তো এখানে পঞ্চাশ বছর ধরে বসবাস করছে। আমিও এখানেই থাকব আর চিরদিনের জন্য ভূতের ব্যাপারটার সুরাহা করব।’

 

সে-রাতে ডাইসন বন্দুকে গুলি ভরে নিলেন। বন্দুকের সেইফটি ক্যাচ খুলে ফেললেন। ডিনারের পর বেশ ক-কাপ কালো কফি খেলেন। বিছানার পাশে হারিকেন বাতি রেখে আলমারিতে খুঁজে পাওয়া ব্ল্যাকউডস ম্যাগাজিনের পুরনো কপির পাতা ওলটাতে লাগলেন।

ঘরে আলো জ্বলছে এবং স্বামী জেগে আছে – এতে আশ্বস্ত হওয়ায় বালিশে মাথা রাখার পরপরই মিসেস ডাইসন ঘুমিয়ে পড়লেন।

জন ডাইসন কিছুক্ষণ পাইপ টানলেন এবং পড়লেন। তারপর আলো কমিয়ে কেবল ধূমপান।

রাতটা আগের দু-রাতের চেয়ে বেশি অন্ধকার। আকাশে মেঘ, স্যাঁতসেঁতে বাতাস বৃষ্টির আভাস দিচ্ছে। মধ্যরাতের বেশ কিছু সময় পর বিদ্যুৎ চমকালো, বজ্রপাত হলো এবং বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল – একেবারে মুষলধারায়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে যেমন হয়। বাতাস বারান্দা হয়ে মশারির ভেতর পর্যন্ত হালকা শীতল ছটা ছড়িয়ে দিলো। বিজলি আর বজ্রপাতের মধ্যে মিসেস ডাইসন ও তার মেয়ে বেশ ঘুমিয়ে আছে। শীতল বৃষ্টি ও বাতাসের ছটায় জন ডাইসনেরও চোখ লেগে আসতে চাইছে। তিনি ঝিমুতে-ঝিমুতে বালিশে হেলান দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।

একটি খেঁকশেয়াল বারান্দার কাছাকাছি এসে ডাক দিয়ে উঠল। ঝাঁকুনি খেয়ে ডাইসন জেগে উঠলেন। ঠিক তখনই টিমটিম করে জ্বলে উঠে বাতিটা নিভে গেল। মশারির বাইরে তার পায়ের কাছে একটি মনুষ্যমূর্তি চোখে পড়ল। একজোড়া উজ্জ্বল চোখ তার ওপর দৃঢ় চাহনি ফেলেছে। হঠাৎ আলো ঝলসে উঠতে তিনি দেখলেন সাদা পোশাকের নারী, কাঁধের ওপর দুই বিনুনি। বিজলি চমকের পরপর বজ্রপাত তাকে কাঁপিয়ে সক্রিয় করে তুললো। আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে তিনি বিছানা থেকে লাফিয়ে বিছানার পাশের নারীমূর্তির ওপর থেকে বৃষ্টি না সরিয়ে বন্দুক খুঁজতে থাকলেন। বন্দুকের বাঁট ধরে হন্যে হয়ে ট্রিগার হাতড়ালেন।  গুলির দুটি জোর শব্দ শোনা গেল। ডাইসন লুটিয়ে পড়লেন, গুলি তার মুখেই বর্ষিত হয়েছে

 

শিলা রেড্ডিকে দেওয়া ডার্টি

ওন্ডম্যানের সাক্ষাৎকার

২৮ নভেম্বর ২০১০ আউটলুক ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। খুশবন্ত সিংয়ের নয়াদিল্লির বাড়ির দরজার বাইরে লেখা আছে :

আপনাকে প্রত্যাশা করা না হলে অনুগ্রহ করে বেল  টিপবেন না।

যেহেতু মোলাকাত পূর্বনির্ধারিত, নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে পৌঁছলেও দশ মিনিট এদিক-ওদিক ঘুরে শিলা রেড্ডি ও তার সহযোগী বেল টিপলেন। সন্দিহান পরিচারক দরজা খুলে নিশ্চিত হতে চাইল যে তারা সঠিক বলছেন, তারা প্রত্যাশিত। পরিচারক ভিজিটিং কার্ড নিয়ে ভেতরে চলে গেল, ফিরে এসে আশ্বস্ত করল সরদার খুশবন্ত সিং দেখা দেবেন।

শিলা রেড্ডি :  ৯০ বছর বয়সী হিসেবে আপনাকে দারুণ ফিট দেখাচ্ছে।

খুশবন্ত সিং : নাইনটি প্লাস।

প্রশ্ন : কিন্তু কেমন করে ম্যানেজ করছেন!

খুশবন্ত : (হেসে) ধারণা নেই। আমি দীর্ঘজীবী বাবা-মা পেয়েছি।

প্রশ্ন : আপনার বাবা-মা?

খুশবন্ত : ৯০ এবং ৯৪ বছর। মা মারা গেলেন ৯৪ বছর বয়সে, বাবা ৯০-তে, হাতে তখন হুইস্কির গ্লাস ধরা। আমার ধারণা, দীর্ঘায়ু হওয়ার সেটাই রহস্য – দীর্ঘজীবী বাবা-মা পাওয়া। বাকিটা সুশৃঙ্খল জীবন।

প্রশ্ন : আপনি কোন ধরনের রুটিন মেনে চলেন?

খুশবন্ত : আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে। প্রার্থনায় বসে সময় নষ্ট করি না। সরাসরি কাজে চলে যাই… খবরের কাগজ পড়ি; তারপর সারাদিনই লেখালেখি ও পড়া। মাঝখানে দুপুরের খাবারের জন্য সংক্ষিপ্ত বিরতি। লাঞ্চ মানে একবাটি স্যুপ। আবার কাজ করতে বসি, একটু বিশ্রাম নিই, আবার কাজ করি – একেবারে সূর্য ডোবা পর্যন্ত।

প্রশ্ন : শুতে যান কখন?

খুশবন্ত : রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা। ১০টা পর্যন্ত পড়ি।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, প্রার্থনা করে সময় নষ্ট করেন না। আপনি কি ধর্ম পালনকারী শিখ নন?

খুশবন্ত : হ্যাঁ, আবেগের দিক আমি তা-ই (শিখ)। সকালে ও সন্ধ্যায় স্বর্ণমন্দির থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা কীর্তন যদি ভালো হয়, শুনি, কিন্তু বেসুরো হলে আমি সুইচ বন্ধ করে দিই।

প্রশ্ন : আপনি তো ধর্মপ্রাণ মানুষ নন?

খুশবন্ত : না। (তবে) আমি গঙ্গার প্রতি নিবেদিত। বছরে অন্তত একবার-দুবার আরতি দেখতে আমি হরিদ্বার গিয়ে থাকি। এই দৃশ্য আমার কাছে অনেক কিছু।

প্রশ্ন : শিখ হওয়ার কারণে আপনি পরিচিতি সংকটে নেই।

খুশবন্ত : তা ঠিক।

প্রশ্ন : ভারতের মতো দেশে যেখানে মানুষের মধ্যে এত বিভাজন, ধর্ম কিংবা গোত্রের পরিচিতি কি আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত?

খুশবন্ত : আমার মনে হয় আপনি যে কোনো একটির সঙ্গে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন, তাতে একধরনের মানসিক পরিতৃপ্তি মেলে। আমি খালসার বাহ্যিক নিয়ম, রীতিনীতি মেনে চলি। এতে বরং উপকারই হয়েছে – হিন্দু বলুন, শিখ বলুন সাংবাদিকদের মধ্যে ভিন্দ্রানওয়ালের জীবদ্দশায় তাকে বিরোধিতা করেছি একমাত্র আমিই; বলেছি, তিনি সন্ত নন, শয়তান। ১৫ বছর আমি পুলিশি নিরাপত্তায় জীবন কাটিয়েছি। কারণ আমি তাদের হিটলিস্টে ছিলাম। আমি খালিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছি, কারণ ভারতীয় শিখদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আমার কাছে আত্মঘাতী মনে হয়েছে। তারা আমার কথা শুনেছে। কারণ তারা জানে আমি তাদেরই একজন। আমি মনে করি, খালিস্তান প্রশ্নে আমি শিখদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান পালটে দিতে পেরেছি, আর এতেই আমি বিশাল পরিতৃপ্তি পেয়েছি।

প্রশ্ন : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার মতো যাঁরা উদারপন্থী সাংবাদিক তাঁদের আঞ্চলিক বা ধর্মীয় পরিচিতি থাকতে হবে, যাতে তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেন।

খুশবন্ত : হ্যাঁ, কিন্তু এটাও মনে রাখবেন, এর জন্য আমি অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব এমন নয়। অপারেশন ব্লু স্টারের পর একসময় আমি যখন আমাকে দেওয়া পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করলাম, কেউ কেউ আমার সমালোচনা করে  বললেন, ‘যখন শিখ না ভারতীয়, এটা বেছে নেওয়ার প্রশ্ন এলো তিনি বেছে নিলেন শিখ।’ আমি জোরগলায় এর প্রতিবাদ করি। আমি বলেছি, ‘আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো কারণ নেই। আপনি কি কোনো হিন্দুকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি হিন্দু না ভারতীয়? কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন দেশের প্রতি টান প্রকাশ করাতে এ ধরনের প্রশ্ন করার সাহস দেখাচ্ছেন।’ আমার  কখনো মনে হয়নি আমি এটা না ওটা, আমি দুটোই।

প্রশ্ন : আত্মজীবনীতে আপনি উল্লেখ করেছেন, যখন যুবক ছিলেন, কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন।

খুশবন্ত : আমি কখনো পার্টির কার্ডধারী সদস্য ছিলাম না। আমি কমিউনিস্টদের ভোট দিতাম – সে অর্থে আমি বামপন্থী।

প্রশ্ন : আপনি কি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন?

খুশবন্ত : না, সে অর্থে নয়। তবে আমি স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতাম। আমি কংগ্রেসের সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম, ততটা আকালি দলের সঙ্গে নয়। এটি একটি সাম্প্রদায়িক দল। আমি এখনো আকালিদের সমালোচনা করে যাচ্ছি।

প্রশ্ন : আপনি গান্ধীকে সম্মান করেন?

খুশবন্ত : খুব বেশি রকম, এখনো করি। আমি আজো মনে করি যখন কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যুতে সন্দিহান হয়ে উঠবেন, তখন এই সূত্রটি অবলম্বন করবেন,             ‘এ-পরিস্থিতিতে গান্ধী কী করতেন?’ আমি তাঁর খামখেয়ালিপনা নিষিদ্ধকরণের দাবি, কৌমার্য ডাক্তারের পরামর্শ না নেওয়া এসব সমর্থন করিনি। তবে সাধারণভাবে তিনি সবসময় ঠিক কাজটিই করেছেন। আমার কাছে তিনি যে-কোনো সন্ত বা আমার গুরুর চেয়েও বড়।

প্রশ্ন : আপনি কি কখনো নিজের জীবনে গান্ধীকে প্রভাব হিসেবে গ্রহণ করেছেন?

খুশবন্ত : হ্যাঁ, মেজাজে কখনো বেসামাল হয়ে উঠিনি। যদি বিষ ঢালতে হয় আমি তা আমার লেখার মাধ্যমে করেছি, কিন্তু সামনাসামনি কারো বিরুদ্ধে নয়। আমার মেজাজ কখনো বিগড়ে যায়নি, আমি গালাগালের ভাষা কখনো ব্যবহার করিনি। আমার লেখায় অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছি। আমি যাদের পছন্দ করিনি, আমার মনে হয় মূলত গান্ধীর প্রভাবে তাদের ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়িনি। যখন কারো মেজাজ বিগড়ে যায়, তার যৌক্তিকতাও হারিয়ে যায়।

প্রশণ : আপনি তো আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।

খুশবন্ত : আমি তেমন ওকালতি প্র্যাকটিস করিনি। ফলে আমার স্কুল ও কলেজ জীবনে যা পড়িনি, তা পড়ার অঢেল সময় পেয়ে যাই। খারাপ ছাত্র হওয়ার কারণে আমি টেনেটুনে পরীক্ষায় পাশ করতাম এবং মোটেও বইপত্রের ধার ধারতাম না। সারাদিনই খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যখন পড়তে শুরু করি সাহিত্য ও লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। প্রথম দিকে আমি যে মামলাগুলো করেছি তা আমার প্রথম দিককার গল্পের রশদ জুগিয়েছে।

প্রশ্ন : যুবক হিসেবে আপনি ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, ছাত্র হিসেবে নির্বিকার, কোনোরকমে পরীক্ষা পাশ করেছেন। তারপরও আপনি কীভাবে এত সুশৃঙ্খল মানুষ হয়ে উঠলেন?

খুশবন্ত : এটা কেমন করে ঘটেছে আমি বলতে পারব না। আইন পাশ করার পর আমি যে চাকরি করেছি তা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি কূটনৈতিক চাকরি পেলাম। সেখানেও আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমি দেখলাম, একজন কূটনীতিবিদের কাজ মূলত মানুষের সঙ্গে মেশা আর তাদের মনোরঞ্জন করা। দিনশেষে তার নিজস্ব আর কিছু নেই। কাজেই আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমার এটা করার সাহস ছিল – কারণ ততদিনে ম্যাগাজিনে আমার গল্প বেরোতে শুরু করেছে। আমার মনে তখন মথিত হচ্ছে ভারতভাগের অভিজ্ঞতা। তারপর আমার প্রথম উপন্যাস ট্রেন টু পাকিস্তান প্রকাশিত হলো।

প্রশ্ন : আপনি অল্পের জন্য আইসিএস মিস করেছেন?

খুশবন্ত : তা ঠিক।

প্রশ্ন : এর জন্য কোনো অনুতাপ হয়?

খুশবন্ত : ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি যে চান্স পাইনি। পেলেও এরা আমাকে এক সময় চাকরি থেকে বের করে দিত।

প্রশ্ন : আপনার ওপর বন্ধুদের যে-আস্থা তাদের অনেক বিষয় কাগজে ছাপিয়ে আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

খুশবন্ত : আমার ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধু নেই। বন্ধুদের জন্য সময় দরকার – একজনের সঙ্গে অন্যজনের ভাববিনিময়, বসা, গল্প করা – কিন্তু আমার যে সে-সময় নেই। বন্ধুরা আমার কর্মপরিকল্পনায় অকারণে হস্তক্ষেপ করবে। গপ্পো করতে আসা লোকদের ওপর আমি বিরক্ত হই। আমি মানি, আমার মধ্যে ক্ষমাশীলতা নেই। কেউ যদি একবার আমার প্রতি রূঢ় আচরণ করে, এটা পুষিয়ে দিতে তারা যত চেষ্টাই করুন না কেন, আমি আর পুরনো সম্পর্কে ফিরে যেতে পারি না। আর তারা যখন আমাকে বাদ দিয়ে দেয়, আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।

প্রশ্ন : তাহলে আপনি নিঃসঙ্গ?

খুশবন্ত : হ্যাঁ, আমি তাই।

প্রশ্ন : সকল ভালো লেখককেই কি নিঃসঙ্গ হতে হয়?

খুশবন্ত : হ্যাঁ। আমি নিঃসঙ্গ, আবার কখনো সঙ্গীবিহীন নই। আমার চারপাশে সবসময়ই অনেক বই। বিগত বছরগুলোতে আমি পরিকল্পিতভাবে আমার বাড়িতে যাকে বলে সন্ন্যাসব্রত পালন করে যাচ্ছি – অবশ্য আরামদায়ক কোনো কিছুর ঘাটতি নেই এতে। নেহায়েত বাধ্য হয়ে যেতে না হলে আমি কখনো বাইরে যাই না, কোনো পার্টিতেও না।

প্রশ্ন : আপনার আত্মজীবনীতে বলেছেন, শিখ ধর্ম ও শিখ ইতিহাস নিয়ে আপনি যা লিখেছেন আপনার কর্মকান্ডের মধ্যে এটাই সবচেয়ে পরিতৃপ্তিকর। কিন্তু বিনোদনমূলক লেখালেখির জন্য আপনি এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকতার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। খ্যাতির জন্য এ ধরনের তৃপ্তিকর কর্মকান্ড থেকে সরে আসায় আপনি কি অনুতপ্ত নন?

খুশবন্ত : আমি দু-ধরনের কাজই করি। সবসময়ই আমার কোনো না কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। আমি শিখ ইতিহাস গ্রন্থের দুই খন্ড কেবল আপডেট করেছি। মৃত্যু ও মৃত্যুদশা নিয়ে আমার অভিমত সংবলিত ডেথ অ্যাট ডোরস্টেপ মাত্র বাজারে এসেছে – এতে কারো কারো অভিমত, আমি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গ্রহণ করেছি, যেমন দালাই লামা কিং ওসু; আমার লেখা কয়েকটি অবিচুয়ারিও রয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি তাহলে সিরিয়াস ধরনের লেখা ছেড়ে দেননি?

খুশবন্ত : না। আমি কিন্তু সিরিয়াস ধরনের মানুষ নই। তাছাড়া আমার কোনো লেখার জন্য আমি বিশিষ্টতা দাবিও করিনি। তবে আমি প্রচুর লিখতে পারি। আজেবাজে যা-ই লিখি ছাপা হয়, কাজেই বই বেরোতেই থাকে।

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় কাজ কোনটি?

খুশবন্ত : একটি পথপ্রদর্শক কাজ হচ্ছে আমার হিস্ট্রি অব শিখস এবং শিখদের ধর্মপুস্তকের অনুবাদ। আমি উর্দু থেকে অনেক অনুবাদও করেছি। ইকবাল ছিলেন আমার প্রিয় কবি। আমি তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতার অনুবাদ করেছি। এখন এর একাদশ মুদ্রণ বিক্রি হচ্ছে।

প্রশ্ন : সাংবাদিক হিসেবে আপনার এই বিশাল সাফল্যের কারণ কী?

খুশবন্ত : অবিচলিত কঠোর পরিশ্রম। পঞ্চাশ বছরে আমি কখনো কোনোদিন লেখার ডেডলাইন মিস করিনি।

প্রশ্ন : আপনার আত্মজীবনী থেকে এটা স্পষ্ট, আপনি             নারী-সম্মোহনকারী নন, মাতালও নন।

খুশবন্ত : কিছুটা সেক্স উপভোগ করেছি। আমি স্কচ পছন্দ করি, কিন্তু কখনো মাতাল হইনি।

প্রশ্ন : আপনি কি এখনো তিনটি লার্জ পেগ টেনে থাকেন?

খুশবন্ত : না, দুটো। তবে দুটোই বেশ বড়।

প্রশ্ন : আপনার যে-কোনো কাহিনিতে সেক্স একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পেয়ে থাকে।

খুশবন্ত : সকল মানুষের জীবনেই সেক্স একটি সত্যিকার আগ্রহের বিষয়, কাজেই এটা নিয়ে টীকা-টিপ্পনীর কী আছে। এটা মজার বিষয়, এটা আগ্রহোদ্দীপক, এর অনেক মাত্রা।

প্রশ্ন : আপনি নিজেকে যৌক্তিক মানুষ বলে থাকেন। তারপরও আপনি যখন সম্পাদক দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলিতে (বর্তমানে প্রকাশনা রহিত), ভাগ্যগণনার কলাম নিয়মিত চালিয়েছেন।

খুশবন্ত : কারণ, যখন এটা বাদ দেওয়া হয়েছিল এর            প্রচার সংখ্যাও পড়ে গিয়েছিল। আমরা আগে ইংল্যান্ড থেকে লেখাটা আনাতাম। আমি বললাম, যেখানে ভারতীয়রা এ-বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ, ভারতীয়দের কেন কাজে লাগাচ্ছি না। আমি পুনাতে একজনকে পেলাম। কিন্তু তিনি যখন আবিষ্কার করলেন আমরা ইংরেজ সাহেবকে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিয়েছি, তিনি লিখতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমি নিজেই তিন মাস কলামটা চালিয়েছি।

প্রশ্ন : আপনি বানিয়ে বানিয়ে এসব লিখেছেন। এটা কারো নজরে পড়েনি?

খুশবন্ত : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : এটা কি সত্য আপনি বাহাইদের গোরস্তানে সমাহিত হতে চেয়েছেন?

খুশবন্ত : আমি চাই না, আমাকে দাহ করা হোক। আমার কবর পছন্দ। আমি এভাবে কাঠের অপচয় করাটার ব্যাপারে আস্থাশীল নই; আমি মনে করি, মানুষের উচিত নিজেকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। মুসলমান আমাকে তাদের কবরস্থানে গ্রহণ করবে না, খ্রিষ্টানরা তাদের সিমেট্রিতে আমাকে গ্রহণ করবে না। বাহাইরা বলেছে, তাদের কবরস্থান আছে, তবে তাদের শেষকৃত্যের রীতি মেনে কবর দেবে। আমি বলেছি, তোমাদের যা খুশি করতে পারো।

প্রশ্ন : আপনি মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত নন, তাই না?

খুশবন্ত : মৃত্যুর আগের ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি ভীত – যন্ত্রণা, জ্বালা, আমাকে হাসপাতালে রাখা। কেউ আপনার নিতম্বের নিচে বেড-প্যান বসাবে – আমি এসব থেকে মুক্তি চাইব।

প্রশ্ন : কুড়ি বছর আগে মিসেস গান্ধী নিহত হওয়ার পর দিল্লিতে শিখদের হত্যা করা হয়েছে। আর আজ প্রধানমন্ত্রী একজন শিখ, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিবিদ একজন শিখ, চিফ অব আর্মি স্টাফ একজন শিখ।

খুশবন্ত : রাজ কারেগা খালসা – তবে এটা কৃপাণের আঘাতে নয়, বল পয়েন্টের লিখনীতে। এটা অবশ্যই স্মরণীয় পরিবর্তন।

প্রশ্ন : এটা ভারত সম্পর্কেও ধারণা দেয়, তাই না? এরকম ঘটনা যে ভারতে ঘটতে পারে, এটাই বিস্ময়কর।

খুশবন্ত : ঠিক বলেছ।

 

খুশবন্ত সিংয়ের ইন্দিরা গান্ধী

আম্বেরি শ দেওয়ানজি ও তিনজন সহযোগী সাংবাদিক ২০০৪ সালে খুশবন্ত সিংয়ের এ-সাক্ষাৎকারটি নেন। রেডিফ ইন্টারভিউ হিসেবে ২৭ অক্টোবর ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়।

প্রশ্ন : কুড়ি বছর পর আপনি যখন পেছনে ফিরে তাকান ইন্দিরা গান্ধীকে কীভাবে দেখেন?

খুশবন্ত : ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে দুটি বিষয় বিবেচ্য : একটি রাজনীতিবিদ হিসেবে, অন্যটি মানুষ হিসেবে। রাজনীতিবিদ হিসেবে কেমন, সবার জানা; কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন, তা তাঁর পরিবারের সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মচারী ছাড়া কারো জানার কথা নয়। বাকি সব বানোয়াট এবং অনুমাননির্ভর।

প্রশ্ন : আপনি তাকে কীভাবে চেনেন?

খুশবন্ত : আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম দেখা, তখনো বিয়ে করেননি, কাশ্মির যাওয়ার পথে লাহোর এসেছেন এবং যে-বন্ধুরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তিনি তাদের সঙ্গে থেকেছেন। আমাদের বাড়িতে তাঁর একটা ছবি আছে। খুব লাজুক, তেমন কথা বলেন না। তারপর যখন তাঁর সঙ্গে দেখা, তিনি তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। তিনি একটি সভার সভানেত্রী ছিলেন, আর আমি মাদাম কামার ওপর বক্তৃতা করছিলাম। তারপর তিনি (লাল বাহাদুর) শাস্ত্রী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হলেন। নিউইয়র্ক টাইমস ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে একটি নিবন্ধ রচনার দায়িত্ব আমাকে দিলো।

তাঁর সম্পর্কে একটি বিরূপ নিবন্ধ রচিত হলো। কারণ আমি জনগণের মুখের কথা উদ্ধৃত করে লিখেছি, তাঁর পক্ষে দেশ চালানো সম্ভব নয়। কোনো মহিলা কখনো ভারতের নেতৃত্ব দেননি। আমাদের রাজিয়া সুলতানা থাকতে পারে, কিন্তু ও পর্যন্তই। আমি লিখেছি, নেহরুর কন্যা হওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো যোগ্যতা নেই; বাস্তবতা হচ্ছে, বাবার হাত ধরে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়া তাঁর কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই।

প্রশ্ন : কিন্তু তিনি তো প্রধানমন্ত্রী হলেন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সময় ক্ষমতায় থাকলেন?

খুশবন্ত : আসল ঘটনা হচ্ছে (লাল বাহাদুর) শাস্ত্রীর পর জনগণ গুলজারি লাল নন্দা কিংবা মোরারজি দেশাইকে চাচ্ছিলেন না, কাজেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন। যে কজন তাঁকে এ-পদের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু এ কজন তাঁর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক প্রকৃতি এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ভেতরই যে একটি শক্তি রয়েছে, সে হিসাব করতে পারেননি।

তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই মোরারজি দেশাই এবং কাম্বরাজের মতো অন্যদের ঠেলে শেষপ্রান্তে পাঠিয়ে দিতে সমর্থ হলেন। তিনি খানিকটা একনায়কের মতো শাসন করতে লাগলেন। তখন মানুষ বলতে শুরু করেন, মন্ত্রিপরিষদে পুরুষ আছেন একজনই, আর সব হিজড়া। আসলে তিনি মন্ত্রীদের সে-পর্যায়েই নামিয়ে এনেছিলেন।

প্রশ্ন : ইন্দিরা গান্ধীর শাসন আপনি কীভাবে দেখছেন?

খুশবন্ত : তাঁর শাসনে আকর্ষণীয় তেমন কিছু নেই। সমালোচনা সহ্য করার শক্তি তাঁর ছিল না। কিছু মানুষকে তিনি তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ মনে করে তাঁদের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন, তাঁদের একজন জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি সত্যিই ভালো ও সৎ মানুষ। জয়প্রকাশ নারায়ণকে তিনি দেশ পরিচালনার নেতৃত্বশক্তির প্রতি হুমকি মনে করতেন; তখন তাঁর শাসন নিয়ে মানুষের মোহ কেটে যাচ্ছিল। আরো সমস্যা ছিল – খরা ও হুমকি এবং এর সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতা হিসেবে অভ্যুদয়।

তাঁর রাজত্বে দুর্নীতি ভয়াবহ রকম বেড়ে যায়। দুর্নীতির ব্যাপারে তিনি বরং সহনশীল ছিলেন। এটা তাঁর ঋণাত্মক দিক। তিনি জানতেন, তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী বড় ধরনের দুর্নীতিবাজ। ব্যাপারটা যতক্ষণ তাঁর সঙ্গে মানিয়ে গেছে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এদিকে তিনি যতক্ষণ মানিয়ে নিতে পেরেছেন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী – সহ্য করেছেন, আবার না মিললে একই অভিযোগে তাঁকে অব্যাহতিও দিয়েছেন। দুর্নীতি নিয়ে তাঁর কোনো কঠোর মনোভাব ছিল না। তাঁর আমলে দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে।

শিক্ষিত ও পরিশীলিত মানুষের সঙ্গে তিনি অস্বস্তিবোধ করতেন। ফলে যশপাল কাপুর, তাঁর অফিসের স্টেনোগ্রাফার আর. কে. ধাওয়ান এবং তাঁর পাশে ঘুরঘুর করা মোহাম্মদ ইউনুসের মতো মানুষের উত্থান ঘটেছে। আমি বিশ্বাস করি এর কারণ – ইন্দিরা গান্ধীর সত্যিকারের শিক্ষা ছিল না। তিনি  শান্তিনিকেতন গেলেন, তারপর বিদেশে ব্যাডমিন্টন স্কুলে, তারপর অক্সফোর্ডে। তিনি কোথাও পরীক্ষায় পাশ করেননি। কোনো ডিগ্রিও জোগাড় করতে পারেননি। শিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ায় তাঁর মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা জন্মে বলে আমার ধারণা। যখন তিনি তাঁর অসুস্থ মা কমলাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড যান, ফারসি ভাষা শেখেন।

পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা থাকলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং নিষ্কলুষ রেকর্ডের অধিকারী মানুষের সঙ্গে তিনি একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। দু-নম্বরি মানুষজনের সঙ্গে তিনি স্বস্তিবোধ করতেন।

প্রশ্ন : তার যে-নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে তা ভারতকে কেমন করে প্রভাবিত করেছে?

খুশবন্ত : তাঁর নিরাপত্তাহীনতার কারণেই তিনি গণতন্ত্র নামের প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর অনুগত সমর্থকদের দিয়ে পার্লামেন্ট ভরে ফেলেন – যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্য বেশি গুরুতবপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি অনুগত জজদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি দিয়েছেন, জনপ্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছেন।

মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ায় তিনি ছিলেন ওস্তাদ। তিনি কাউকে কাউকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। যখন দেখতেন এই লোকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন তখন তাঁকে কোনো জ্যেষ্ঠ পদে না বসিয়ে তার ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগীকে সেখানে বসাতেন। তিনি জানতেন, এতে দুজনের মধ্যে বিরোধ বাধবেই।

সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভিপি সিং। তার বড় ভাই (সান্তা বক্স সিং) বিশ্বাস করতেন তাকে মন্ত্রী বানানো হবে। কিন্তু তা না করে দুই ভাইয়ের মধ্যে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ভিপি সিংকে বেছে নিলেন। এতে দুই ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা বাড়ল। তিনি দক্ষ হিসাব শেষে ভাইদের পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টি করে ও জিইয়ে রেখে সংসার ভাঙার কাজটি করলেন। যে-খেলা তিনি খেলেছেন, শেষ পর্যন্ত তা দেশের জন্য মঙ্গল ডেকে আনেনি।

প্রশ্ন : ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে বড় অর্জন কী?

খুশবন্ত : তাঁর জীবনের মহত্তম মুহূর্ত, শ্রেষ্ঠতম বিজয় তাঁর সকল মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে পাকিস্তানের আক্কেলগুড়ুম করে (একাত্তরে) বাংলাদেশ সংকট মোকাবেলা করা।

ভারতে ঢুকেপড়া শরণার্থীর জোয়ার নিয়ে দেশটি যখন ভয়ংকর খাদ্যসংকটে, তিনি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন, কী ঘটেছে তা জানাতে দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া কারো সমর্থন পাননি। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে ছিল। যখন তিনি বুঝতে পারলেন সংকট শিখরে পৌঁছেছে, তিনি বিচক্ষণতার প্রমাণ দিলেন। যেমন যখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করা হলো, আমাদের জানা আছে, ভারতীয়দের প্রচেষ্টাতেই জাহাজটি লাহোরে নেমেছে। তারপর সেখানে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর উপস্থিতিতে জাহাজটি উড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর নির্বুদ্ধিতা প্রতিষ্ঠিত হলো। ঘটনাটি ভারতের হাতে প্রয়োজনীয় একটি ছুঁতো তুলে দিলো। যেহেতু যুদ্ধ এগিয়ে আসছে, ভারতের ওপর দিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের (এখন বাংলাদেশ) মধ্যে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার দরকার ছিল। ফলে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ ভারতের চারপাশ ঘুরে শ্রীলংকায় নেমে তেল ভরে দুই অংশের মধ্যে চলাচল করতে থাকে। আমি মনে করি, তাঁর পরামর্শেই ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে। সে-সময়ে (তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট) জেনারেল ইয়াহিয়া কী ঘটছে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা দিলেন, আমার মনে হয় ভারতীয় বাহিনী তখন বাংলাদেশের একশ মাইল ভেতরে। এক পক্ষকালেরও কম সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী শহর রক্ষার পরিকল্পনা করল, কিন্তু ভারতীয় বাহিনী শহরগুলো পাশ কাটিয়ে সরাসরি ঢাকার দিকে এগিয়ে গেল। যে-কোনো মানদন্ডে এটা অত্যন্ত দক্ষ একটা পরিকল্পনা, ভারতরত্ন খেতাব তাঁর প্রাপ্য ছিল বলেই পেয়েছেন।

প্রশ্ন : কিন্তু শিখরে ওঠার সমস্যা হচ্ছে ওখান থেকে পড়ে যেতে পারেন। তারপর আমরা পেলাম জরুরি অবস্থা।

খুশবন্ত : হ্যাঁ, এটা সত্য। কিন্তু যখন জরুরি অবস্থার কথা আসে, বিরোধী দলের আচরণও ছিল ন্যক্কারজনক। কোনো সন্দেহ নেই, দেশ তখন নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে পড়ছে – স্কুল খুলছে না, কলেজ বন্ধ, বড় বড় মিছিল, দাঙ্গা। নয়াদিল্লিতে জয়প্রকাশ নারায়ণ যখন বিশাল র‌্যালি করলেন, তিনি বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীদের বললেন, এমপিদের ঘেরাও করো, তাদের অফিস করতে বাধা দাও। সে-সময়ে গুজরাটে এমনই ঘটছিল (নবনির্মাণ দাঙ্গায় পার্লামেন্ট অবরুদ্ধ ছিল), তিনি দিল্লিতে একই কাজ করার আহবান জানালেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেন তাঁদের কাজে যোগ দিতে না পারেন। আরো খারাপ কাজ করলেন – পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে আহবান জানালেন, তারা যেন এমপিদের পতন ঘটিয়ে দেয়।

যে-কোনো গণতন্ত্রে প্রতিবাদেরও একটা সীমা আছে, কিন্তু তা সীমা ছাড়িয়ে গেল। অন্য নেতারা ইন্দিরার ভগ্নদশা দেখে ভাবছিলেন, তিনি নিজে থেকেই তাঁর ধ্বংস ডেকে আনবেন।

আমি জয়প্রকাশ নারায়ণকে জানতাম এবং খুব পছন্দ করতাম। আমি তাঁকে চিঠিতে জানাই, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদের সীমা তিনি লঙ্ঘন করছেন। তিনি একটি দীর্ঘ জবাব লিখেন, আমি তা ইলাসট্রেটেড উইকলিতে প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু কিছু ঘটার আগেই এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় হয়ে গেল। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন। আমি বিশ্বাস করি, তিনি ঠিক কাজটিই করছেন, তাঁর হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

প্রশ্ন : এত বছর পরেও কি আপনি মনে করেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা যুক্তিযুক্ত ছিল?

খুশবন্ত : আমি এখনো বিশ্বাস করি, যখন তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, তখন এটা করার সংগত কারণ ও অধিকার তাঁর ছিল। বিরোধীদলীয় নেতারা সে-সময়ে বেপরোয়া, দায়িত্বহীন এবং দেশবিরোধী আচরণ করতে থাকেন। তাঁরা নৈরাজ্যের সমারোহ উপভোগ করছিলেন।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে, স্কুল খোলে, কলেজে ক্লাস শুরু হয়, সময়মতো ট্রেন ছাড়ে; দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় দেশজুড়ে এক ধরনের কৃতজ্ঞতার আবহ বিরাজ করে। এতে অবশ্যই জনগণের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা সমীচীন হবে না বলে জানাই। তাঁকে বলি, আমার মতো যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছেন, তাঁরা আর কেউ বিশ্বাস করবেন না – তাঁরা বলছেন, আমরা কিছুই করতে পারব না, অন্যথায় আমাদের কারাগারে পাঠানো হবে। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স ইন্দিরা গান্ধীকে ভুলপথে পরিচালিত করে তাঁকে ধারণা দিলো যে, তিনি দারুণ জনপ্রিয় এবং নির্বাচন দিলেই তিনি জিতে যাবেন। এটা বিশ্বাস করে তিনি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নিলেন। যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তিনি জেনে বিস্মিত হলেন যে, তিনি দেশবাসীর ঘৃণা সঞ্চয় করেছেন এবং নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।

প্রশ্ন : আগের প্রশ্নের জবাবে আপনি বলেছেন যখন ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, দেশে স্বস্তি ফিরে আসে। তারপরও তিনি নির্বাচনে হেরে গেলেন। তাহলে সমস্যাটি কোথায়?

খুশবন্ত : সমস্যা আমার মতে, ক্ষমতার অপব্যবহার।

প্রশণ : তাতে সঞ্জয় গান্ধীও রয়েছেন?

খুশবন্ত : যখন সঞ্জয়ের কথা বলা হয়… তাঁর কোনো বৈধতা ছিল না। তিনি কেবল প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। তিনি যা করতে চেয়েছেন তা সঠিক। এতসব পারিবারিক প্রোপাগান্ডা কাজে আসেনি, সঞ্জয় তাঁর কাজকে দিলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। শুরু হলো বস্তি উচ্ছেদ, জনগণ মামলা আদালতে নিয়ে গেল, মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকল। তিনি বললেন, বস্তি উচ্ছেদ করো; কিন্তু বস্তিবাসীকে বিকল্প আবাসন দাও। বিকল্প ব্যবস্থা করার কাজ চলছিল। পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সঞ্জয় সম্পর্কে যা প্রচারিত হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। সিনেমার লাইন থেকে, গ্রাম থেকে নারী ও পুরুষ ধরে এনে (লাইগেশন ও ভেসেক্টমি করানো)… এর এক-দশমাংশ সত্যি হতে পারে; কিন্তু এসব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল আর তিনি তার জন্য মূল্য দিলেন। জরুরি অবস্থাকে দৈত্য বানিয়ে ফেলা হলো।

প্রশ্ন : কিন্তু জরুরি অবস্থার দানবীয় চিত্র উপস্থাপিত হওয়ার কারণও নিশ্চয়ই রয়েছে?

খুশবন্ত : ইন্দিরা অনেককে কারাবন্দি করেছেন, এমনকি পঁচাশি বছরের বৃদ্ধকেও। যে-ই মুখ খুলেছে তাকেই জেলে পাঠানো হয়েছে। এটা যে কেবল ইন্দিরার বিরুদ্ধে বললে তা নয়। সঞ্জয়, তার স্ত্রী মানেকা, তার শাশুড়ি, মোহাম্মদ ইউনুস – কারো বিরুদ্ধে কিছু বললেই নির্ঘাত কারাবাস।

প্রশ্ন : কিন্তু জরুরি অবস্থা আর ড্রাকোনিয়ান আইন বহাল থাকলে এমনই তো হওয়ার কথা।

খুশবন্ত : তা সত্যি, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তা অনুধাবন করেননি।

প্রশ্ন : সংকট শুরু হয়েছে জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে, না এটা দীর্ঘদিন বহাল রাখার কারণে?

খুশবন্ত : আমি মনে করি, জরুরি অবস্থা স্বল্পমেয়াদি হতে পারত। যখন তিনি বুঝতে পারলেন জরুরি অবস্থার অপব্যবহার হচ্ছে তাঁর পাশের বহুলোক এর অপব্যবহার করছেন, তাঁর বাস্তবে ফিরে আসা উচিত ছিল। জয়পুরের মহারানী গায়ত্রী দেবী, গোয়ালিয়রের মহারানী বিজয়া রাজ সিন্ধিয়াকে জেলে পকেটমার আর বেশ্যাদের সঙ্গে রেখে তাঁর চরিত্রের প্রতিহিংসাপরায়ণ দিকটি উন্মোচিত করেছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, এ-কারণে অনেক শত্রুর সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর গোটা পরিবারের বিরুদ্ধে ঘৃণা সঞ্চারিত হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন না, জাস্টিস সিনহা তাঁর বিরুদ্ধে যে-রায় দিয়েছেন তাতেই তাঁর গদি ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল?

খুশবন্ত : এটি একটি দ্ব্যর্থক রায় : তিনি পার্লামেন্টে বসতে পারবেন, কিন্তু ভোট দিতে পারবেন না। (ননি) পাল্কিওয়ালা, তাঁর আইনজীবী বললেন, আপিলে জিতে যাবেন। তিনি বললেন, এটা অনেকটা রাস্তায় গাড়ি চলাচলের তুচ্ছ অপরাধের জন্য কারাবন্দি করে রাখার মতো। ততদিনে তিনি নার্ভাস হয়ে পড়েন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মতো মানুষ আর সঞ্জয় গান্ধী জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি যা করেছেন, যদি তা না করতেন তিনি আরো বড় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারতেন।

ইমার্জেন্সি ঘোষণার পর পাল্কিওয়ালা ইন্দিরার হয়ে মামলা লড়তে অস্বীকার করলেন। মিসেস গান্ধীর লোকেরা পাল্কিওয়ালাকে হেনস্তা করলেন, টাটা কোম্পানির অনেক বোর্ড থেকে তাঁকে সরিয়ে দিলেন। এ-ধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজ চলতেই থাকে – আর তা কেবল সারাক্ষণ শত্রুই তৈরি করে; এটা তাঁদের না করলেও চলত।

প্রশ্ন : কিন্তু তারপর তো তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। এটা কি জনতা পার্টির অদক্ষতার কারণে, নাকি জনগণ বলেছে, তোমাদের অনেক শাস্তি দিয়েছি, এখন তোমাদের ফেরত চাই। নাকি দুটোর সমন্বয় ঘটেছে?

খুশবন্ত : আমার মনে হয় ঠিকই বলেছেন, ততদিন তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও তিক্ততা প্রশমিত হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোরারজি দেশাই এবং চরণ সিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন। লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ইন্দিরা তাঁদের চেয়ে অনেক ভালো ছিলেন।

প্রশ্ন : কিন্তু গদিতে তাঁর পরবর্তী ক-বছর আরো বেশি খারাপ ছিল; আগে লক্ষ্য সাধনের যে-শক্তি তাঁর ছিল, তখন আর তা নেই।

খুশবন্ত : আমার মনে হয় সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু এর কারণ (জানুয়ারি ১৯৮০ তিনি ক্ষমতাসীন হলেন, ছ-মাস পর সঞ্জয়ের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু)। সঞ্জয় তাঁর ওপর খবরদারি করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইন্দিরার নোঙর ছিঁড়ে গেল। তিনি বড় ছেলে রাজীবকে উপেক্ষা করে (তিনি তাঁকে মনে করতেন বুদ্ধু, বুদ্ধির ঘাটতিসম্পন্ন মানুষ) সঞ্জয়কে প্রধানমন্ত্রীর পদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর তিনি দোনোমনো হয়ে পড়েন, মনস্থির করতে পারছিলেন না, নার্ভাস ব্রেকডাউনের কবলে পড়েন… রাতে ঘুমাতে পারতেন না, চোখের নিচে গভীর কালি পড়ে। আমার মনে হয়, এ রকম মানসিক অবস্থার মধ্যে তিনি আনাড়ির মতো অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনার আদেশ দেন।

প্রশ্ন : অপারেশন ব্লু-স্টার করে তিনি ভুল করেছেন বলে আপনি মনে করেন?

খুশবন্ত : আমি মনে করি তিনি বিপথে পরিচালিত হয়েছেন। তিনি নিজের বিবেচনা শক্তি প্রয়োগ করলে ভালো করতেন। তাঁর কোনো পূর্ববিদ্বেষ ছিল না – মুসলমানদের বিরুদ্ধে না, শিখদের বিরুদ্ধেও না। তিনি অনেকের সঙ্গে আলাপ করতেন, বিভিন্নজনের কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী পরামর্শ পেতেন। তিনি (প্রেসিডেন্ট) জৈল সিংহকে বিশ্বাস করতেন না। কারণ তিনি দুদিকেই চাল মারছিলেন, কখনো কখনো (পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী) দরবার সিংয়ের বিরুদ্ধে (জাধায়েল সিং) ভিন্দ্রানওয়ালেকে সমর্থন দিয়েছেন।

তিনি সেনাবাহিনীর সহায়তা চাইলেন; আমি নিশ্চিত, তারা (সেনাবাহিনী) তাঁকে যাই বলে থাকুক, ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল অরুণ বৈদ্য এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে. এস. সুন্দরজি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, একবার সৈন্যরা স্বর্ণমন্দির ঘেরাও করে ভেতরে গেলে কোনো লড়াই বাধবে না এবং ভিন্দ্রানওয়ালে আত্মসমর্পণ করবেন। আমি জানি তাঁরা আরো বলেছিলেন, অপারেশন দু-ঘণ্টার বেশি চলবে না। এর সবটাই ছিল ভুল হিসাব।

ভিন্দ্রানওয়ালে একজন ঠগ, ধর্মোন্মাদ, উন্মত্ততার মধ্যে লড়াই করে যাবেন। দু-ঘণ্টার বদলে লড়াই দুদিন দুরাত ধরে চলল। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটল। আমি জানি, দুই বা তিনদিন পর তিনি যখন মন্দিরে গেলেন, সরোবরে ভাসমান লাশ দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তখনো রক্তের দাগ লেগে ছিল, তা মুছে ফেলা হচ্ছে। তাই তিনি মেজর জেনারেল কে. এস. ব্রারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কী?’

যখন তাঁকে বলা হয়, কোনো লড়াই হবে না, তিনি তা বিশ্বাস করেছিলেন।