স ম্পা দ কী য়
বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যচর্চার পথিকৃৎ মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে কালি ও কলমের এ-সংখ্যাটি প্রকাশিত হলো। তাঁরই একক প্রচেষ্টা, চর্চা ও সাধনায় এদেশের স্থাপত্য বোধে, মননে ও শৈল্পিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হয়েছে; স্থাপত্যচর্চার প্রসারও ঘটেছে। তাঁর সৃজন-কৌশলে, ভাবনায় ও জিজ্ঞাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উত্তরকালের স্থপতিরা নিজেদের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা তৈরি করেছেন।
পঞ্চাশের দশকে পাশ্চাত্যে স্থাপত্যবিদ্যায় উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের পর তিনি দেশে ফেরেন এবং এক্ষেত্রে নবীন বোধ সঞ্চার করেন। তাঁরই উদ্যোগ ও প্রযতেœ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যার পাঠ শুরু হয়। তিনি এ-সময়ে পাবলিক লাইব্রেরি এবং চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণে নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। এই দুটি ভবনের, বিশেষত চারুকলা ইনস্টিটিউটের, সামগ্রিক পরিকল্পনা ও অনুপম স্থাপত্যকর্মের সৌন্দর্যবিভা আজো অম্লান। ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণামুক্ত সম্পূর্ণ নতুন শৈলী ও ব্যবহারিক গুণ এবং দেশীয় উপকরণ ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে উজ্জ্বল এ-দুটি কাজ বুদ্ধিদীপ্তিমণ্ডিত মনোগ্রাহী স্থাপত্য-সৃজন বলে বিবেচিত হয়েছে।
ষাটের দশকে তিনি গড়ে তোলেন বাস্তুকলাবিদ। স্থাপত্যচর্চার এই নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটি দেশের নানা অঞ্চলে তাঁরই পরিকল্পিত যেসব ভবন নির্মাণ করে, তা হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই তাৎপর্যময় ভবন ও শিল্পকর্ম। এই সময়ে বাঙালিত্বের সাধনা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে স্বরূপ-জিজ্ঞাসা যে-জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছিল স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সেখানে এক বৃহৎ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আপিস এবং গৃহ হয়ে ওঠে শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের মিলন ও আশ্রয়ের অন্যতম স্থল। নানা সময়ে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে নাগরিকদের পক্ষ থেকে যে সহায়তা ও ত্রাণ তৎপরতা পরিচালিত হয়েছিল তাতে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির এই জাগরণ ও সহমর্মিতাবোধ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্মাণ করে। এই কৃতবিদ্য মানুষটি দেশের সকল সংকটকালে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় তিনি বাংলাদেশ সরকারকে নানাভাবে সহায়তা করেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমতগঠনে ভূমিকা রাখেন।
রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে জীবদ্দশায় তিনি যোগ্য সম্মান পাননি। এই কীর্তিমান মানুষটির সৃজনশীলতা, দেশচেতনা ও সমাজ-অঙ্গীকার কত উচ্চ পর্যায়ে ছিল সে-সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা ছিল না।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ও সমাজপরিবর্তনের আকাক্সক্ষায় সত্তরের দশকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। কিন্তু কোনো সৃজনশীল ও বিবেকবান মানুষের জন্য এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন স্বাচ্ছন্দ্যময় ও স্বস্তিকর হয়ে ওঠেনি। যে-আদর্শিক ভাবনা, অঙ্গীকার, দেশচেতনা ও সমাজ-পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা নিয়ে তিনি রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন, সেখানে কাক্সিক্ষত পরিবেশ না পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন।
তাঁর মৃত্যুতে এদেশের স্থাপত্যচর্চায়, সংস্কৃতিক্ষেত্রে এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজে যে-ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভবিষ্যতে এই সৃজনশীল মানুষের স্থাপত্য-ভাবনা ও পরিকল্পিত নগরায়ণ-সম্পর্কিত চিন্তা নিয়ে গবেষণা হবে এবং এদেশের ইতিহাসে তাঁর নামটি শ্রদ্ধা ও গৌরবের সঙ্গে লিখিত হবে।