কিডনির কারবার
নাসিমা আনিস

এই গল্পটা আমার। আমি এর জন্মদাতা, গল্পবস্তু যৎকিঞ্চিৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। অবশ্য সেভাবে ধরলে,  কি-বা আমার কি-বা আপনার! হাত-পা, মাথামুণ্ডু, পাঁজর-কলিজা সবই উত্তরাধিকারসূত্রেই তো প্রাপ্ত। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চয়ই সবাই মানবে, মাথার ঘিলুটা খাটানোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা সকলের একান্ত নিজের। এখানে একবিন্দু কারো অংশীদারিত্ব নেই। হ্যাঁ, বিপদের ভাগটা নিয়ে যদি ভাবা যায় তবে তা অবশ্য নিজের ওপরই বর্তায়। আর কে না জানে, নো রিস্ক নো গেইন। সাহসই হলো সেই অবস্তু, যা থাকলে এবং জায়গামতো একবার দেখিয়ে ফেলতে পারলে কেল্লা ফতে। একবার ব্যাংকে ইংরেজিতে লেখা একটা কথা পড়েছিলাম, যতদূর মনে পড়ে লেখা ছিল ‘আইডিয়া থাকলেই আপনি টাকা কামাতে পারবেন; কিন্তু টাকা থাকলেই যে আইডিয়া পেয়ে যাবেন এমন নাও হতে পারে’। তারপর থেকে আমি আইডিয়াকে খুবই গুরুত্ব দিই এবং পেয়ে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আপনি বলছেন, বাবা একবার তো আইডিয়া দেখালে, দেখিয়ে এখন তোমার পরিবার ভিটাছাড়া হওয়ার উপক্রম, আবার কেন? কিন্তু এটুকু বলে আপনি পিঠটান দেবেন, তা তো হবে না! কেন এমন হলো, কে এর জন্য দায়ী, তা অন্তত বলে দিয়ে যান! আপনি সহনশীল অভিজ্ঞ মানুষ তাই অনুরোধ করতেই পারি, নিদেনপক্ষে আমি এখন কী করব সেটা বলবেন। বললে দুটো পয়সা গাঁট থেকে খসে পড়বে, কী পড়ার উপক্রম হবে তা তো নয়, তবে অন্তত কিছুটা সময় বেহুদা বেরিয়ে যাবেই আপনার। তো, সে-ভয়ে আর এগোবেন না, এই তো! তবে নিজের কাজে যান আমি কাগজ কয়টা পিজি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর মিটফোর্ডের দেয়ালে মেরে একটু আরাম করি। বলা ভালো, বড় মামিকে শুধু একটা মেসেজ দিয়েছি, ‘টাকা জোগাড় করে আমি বাড়ি ফিরব; তার আগে যেন মাকে ভিটাছাড়া না করে, মামাকে বলবেন বিষয়টা দেখতে’।
পোস্টারের লেখাটা আরেকটু বড় হলে ভালো হতো। হরফটা এত ছোট, নাহ্ ঠিকই আছে, যার দরকার সে ঠিক দেখে কল দেবে। ‘জরুরিভিত্তিতে একটি সুস্থ তাজা কিডনি বেচা হবে, রক্তের গ্র“প ‘বি’ পজেটিভ’। ‘বি’ পজেটিভ খুব কমন রক্তগ্র“প, গরু-ছাগলের গ্র“প। রক্ত সহজলভ্য হলে কী, কিডনি তো সহজ নয়! নিশ্চয়ই আজ রাত কি কাল দিনের মধ্যেই ফোন চলে আসবে। পকেটে ৪০ টাকা আছে। পাউরুটি খেয়ে এখনো দুটো দিন পার করে দেওয়া যাবে। তারপর রোগীর আত্মীয়রা নিজের গরজেই আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
উদ্যানে ঢুকতে আল্লাদি ভঙ্গিতে নাগলিঙ্গম নাম ঝুলানো মোটা গাছটা বাহারি ফুল নিয়ে কী যে ঢং! দরিদ্র চেহারার যুবক-যুবতী ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছে, দেখতে দেখতে বেঞ্চে বসি। পোশাকে কি চেহারায় ওদের প্রেমময় লাগে না বলে একটু কষ্ট-কষ্ট লাগে। এমন ঠাঠা রোদ, ছায়াতে বসে থাকলেও মুখে রোদের ভাপ লাগে, ঘাম শুষে নেয়। সৌদিতে অবশ্য এর চেয়ে বেশি রোদে মাঠে কাজ করেছি, সে টাকার জন্য। জীবনে একটা পয়সা কামাই করে দেখলাম না যখন, তখন মাসে ত্রিশ হাজার টাকা আর থাকা-খাওয়া ফ্রি চাকরি। কোম্পানির কাজ, গম ক্ষেতে কাজ করব। তিন বছরের কন্ট্রাক্ট, ইচ্ছা করলে সারাজীবন থাকা যায়। রোদ বেশি, তাই সন্ধ্যার পর রাত ১০টা পর্যন্ত ঠান্ডায় ঠান্ডায় কাজ। রাতে মাঠে কাজ, শুনতেই অভিনব লাগে। সঙ্গে বক্কর, কোম্পানির আত্মীয়, বিশ্বাসের ওপর বিশ্বাস – মা গো, এমন সুযোগ রোজ আইয়ে না গো!
কিন্তু পৌঁছেই – পারমাণবিক বিদ্যুৎ তো সব জায়গায় যায় নাই মিয়া, দিনেই কর্ম। ভালো কইরা কাপড় পইরা মাঠে নাইম্যা পড়ো। এমন কাম দ্যাশে কত করছো মিয়া! কোম্পানির আত্মীয় বক্কর বলে। মানে প্রথম ধাক্কাটা বক্করের। ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই বলে কোম্পানির মালিক জেলে, ১০ হাজারে যদি কাজ করতে চাও তো অন্য কোম্পানিতে বন্দোবস্ত কইরা দেই। থাকা-খাওয়া নিজের। এক মাসের বেতন হাতে আসার আগেই এইসব। তারপর বাঙালির অকৃত্রিম বিদ্রোহ, একই লটে যাওয়া ৩২ জনের ১৩ জনের তিন মাস মানবেতর জেলজীবন এবং শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরত। একটা- দুইটা খুন করা কারো কারো কাছে প্রার্থনীয় ছিল। কত খুন করেছি মনে মনে, শুধু হাতের কাছে পাওয়া যায়নি বলে। আর কাকে যে খুন করব তা-ই তো জানি না। কোম্পানির আত্মীয় বলে যাকে সমীহ করেছি সেই বক্করও আমাদের দলে, জেলে, বেচারা কুবের, এত তাড়াতাড়ি তার মাতব্বরির সাম্রাজ্যের পতন হবে, সে কি জানত! খুন করলে এদেশে কী শাস্তি হয় সবার জানা। জুমার পর প্রকাশ্য দিবালোকে কতল! রোষের অনলে পুড়ে বদলা নিবোই বলে বোকার মতো ভুল মানুষকে পেটালাম এবং জেলে গেলাম। জেলে গিয়ে জানলাম, আমাদের যে ভাওতা দিয়ে এনেছে তার নাম এমএস, মোটেই সে জেলে যায়নি, গেছে আমেরিকায়। ‘নিশ্চয় হালায় সাদা চামড়ার লগে ফুর্তি মারতে গেছে। পাইলে হালার ফুর্তি টাইট্টা বিলাইরে বিলায় দিতাম’ – মন্তব্য কেংলা বেলালের। এখন আমরা জানি, এমএস বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে এনে অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বেশি টাকায় – এই তার ব্যবসা। এমএস কারো নাম হয়! হয়, মোফাখখারুল সাম্স। এত বড় নাম মুখে আসে! ‘খানকির পোলাগো নাম এমন সুন্দরই হয়’ বেলালেরই মন্তব্য। বাপের রাখা নাম, নাকি নিজের রাখা, কে জানে। দেশে ফিরে কী করব, কীভাবে ধার শোধ করব এই ভেবে যখন আত্মহত্যার পরিকল্পনা করি, তখনো সমস্যা; আত্মহত্যার উপকরণ নাই। বিষ, দড়ি, ছুরি, ব্লেড, কিচ্ছু নাই। পরনের লুঙ্গি গলায় পেঁচিয়ে মরার চেষ্টা করে হাসির পাত্র হয় ফরহাত মিয়া ওরফে ফরু। বেলালই সমাধান দেয় – এমন কইরা হইব না, ফেরত যাওয়ার সময় প্লেন থেইক্যা ঝাঁপ দিছ। শালাগো কাছ থেইক্যা ভাড়ার টাকাটা তো উশুল হইব! ফরহাত মিয়া প্লেন থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সময় কীভাবে জানালা খুলবে, আদৌ সেটা সে খুলতে সমর্থ হবে কিনা কিংবা খোলার সময় কেউ দেখে ফেললে কী হবে সেসব বিবেচনা না করে লুঙ্গি কাছা দেয় মনে মনে – কেন লুঙ্গি? আরে, জেলে আসার আগে পরনে লুঙ্গিই ছিল। এক লুঙ্গিতে জেলে তিন মাস। তো লুঙ্গি কাছা দিতে দিতে তার বুকে বল আসবে। দেহুক শালারা, মরতে ভয় পায় না বীরবাঙালি, জেল তো বালের নাহাল! আল্লাহর দেশে মানুষরে এমন কইরা কষ্ট দিতে আনে, তুমি এর বিচার কইরো আল্লাহ … জানালা খুললে হু-হু হাওয়া ঢুকবে, বুক ভরে শ্বাস নেবে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ফরহাত মিয়া। ঝাঁপ দেওয়া এমন কোনো কঠিন কাম নয়, কত ঝাঁপ দিছি ছোটবেলা, কাঁটাভরা বাবলা গাছের মাথা থেইক্যা লাফায় পড়ছি টইটম্বুর বিলে, এমনি এমনি না তো, হালিমের মায়ের ডেকচির বেকটি পাইন্যা ভাত খাইতে দিবো এই শর্তে। তো বাংলাদেশের সীমানায় হলেই সবচেয়ে ভালো হয়। এমনিতেই ডেডবডি কেউ খুঁজে পাবে না, পাবে কোথাও একটা হাত, কোথাও একটা পা কিংবা মাথাটা। রশীদ বলছিল, ঝাঁপ মারার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের তোড়ে তোর সব ফালাফালা হইয়া যাইব। পুরা বডি লইয়া পড়তেই পারবি না। এমনকি মেঘের মইধ্যে পড়তে পারলে সারাজীবন সেখানেই ভাসবি, বরফের লগে গড়াগড়ি, কোলাকুলি, বরফ খাবি আর বরফ হাগবি, হাঃ হাঃ! রশীদ স্কুল শেষ করেনি, কোত্থেকে এমন আজগুবি বৈজ্ঞানিক খবর পায় কে জানে! আমি শুধরে দিই, ভাসবে না, পড়বে। মাধ্যাকর্ষণের জন্য প্রবল বেগে পৃথিবীর দিকে ছুইট্টা যাবে ফরহাত, যত উপর থাইক্যা পড়বে, তত বেশি ফোর্সে পড়বে, পইড়া ভেটকাইয়া যাবে। রশীদ আবার বলে, পড়লেও হাত-পা-মাথা একখানে থাকবো না। মানুষ ওর মেয়েমানুষ মার্কা হাত-পা নিয়া গবেষণা করবে। ‘মেয়েমানুষ’ শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গে জেলে কে কাকে কোথায় মেরে কী সুখ পেয়েছে, সে-কথা থামিয়ে দেয় রশীদ। বেলাল অন্তত বলে, দুই জাতের জন্য দুই রকম অনুভূতি। মানে মেয়েমানুষ হইলে ভাববে রেপ কেইস। কইরা টুকরা কইরা ফালায় দিছে। হায় আল্লাহ – আইজকাইল প্লেনেও এইসব হয়! মানে একখান হাত কি পা দেইখা একটু আদিরস পাইল, এই আর কি! পুরুষ বুঝলে অন্যরকম হবে একদম… শুয়োর মার্কা একটা ভাবনায় ডুব দিয়াই ভাইস্যা উঠবে… যা হোক। যাই হোক, রশীদের এক কথা, অঙ্গপ্রতঙ্গ একসঙ্গে থাকবে না। – তর্ক না করি, জেনেই পড়–ক! তবু সে নিজের দেশে পড়তে চায়, নিজের সীমানায় প্লেন থেকে ঝাঁপ দেবে। জীবিত অবস্থায় তার পক্ষে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব না।
কিডনিটা কত টাকায় বিক্রি হতে পারে, তিন-চারে হবে না! ধার শোধ করেও যেন হাতে লাখখানেক থাকে। যত কিডনি বেচার কথা ভাবি, তত নিজেকে প্রয়োজনীয় প্রয়োজনীয় বস্তু মনে হয়। লুঙ্গি ছিঁড়ে গলায় ফাঁস দিলে কিংবা প্লেন থেকে লাফিয়ে পড়লে বিশাল লস হয়ে যেত!
সন্ধ্যায় পার্ক থেকে বেরোনোর মুখে ফোন। হ্যালো বলতেই কেটে গেল। যাত্রাবাড়ীতে এক পরিচিতর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা এখন। আবার ফোনটা বেজে উঠল। মামির ফোন, হ, চিন্তা কইরেন না, সাত দিনের মইধ্যে টাকা ফেরত দিবে কোম্পানি, মায়রে কইয়েন। টাকা না দিয়া যাইব কই হালায়! বক্করের খোঁজ জানি না তো!
সময় লাগবে না করেও তিন দিন পর আজ সকালে ফোন পেয়ে হাসপাতাল এসেছি। বেসরকারি হাসপাতাল, বৃদ্ধ এক মহিলার কিডনি বদলানো হবে। আমাকে বারবার বলছে, অপরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলবা না। যে যা-ই বলুক, বলবা উনি আমার খালাম্মা লাগেন, খালাম্মাকে দেখশোন করতে আসছি। মহাবিপদ, খালাম্মা বলে শেষে কিডনিটা ফ্রি না নিয়া নেয়! আমি বলি, কিন্তু আমি তো কিডনি বেচতে আসছি, টাকা দিতে হবে! – দিবো দিবো, টাকা তো দিবোই কিন্তু তুমি বলবা উনি তোমার খালাম্মা, নইলে কিডনি বেচতে পারবা না। কিডনি কেনাবেচা বেআইনি। আমি বলি, ঠিক আছে, তিনি আমার খালাম্মা; কিন্তু টাকা ব্যাংকে না দেওয়া পর্যন্ত আমি কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হবো না। – ঠিক আছে। কিন্তু তোমার তো সব পরীক্ষা না করে বলা যাবে না যে, তোমার কিডনি আমার মায়ের শরীরে লাগবে। ধন্দে পড়ে যাই। পরীক্ষার নামে ভর্তি করে শেষে অজ্ঞান করে পেট ফেঁড়ে কিডনিটা নিয়ে যদি রাস্তায় ফেলে দেয়? গোটা মানুষটাই যেখানে হাপিস করে দেয় সেখানে সামান্য একখান কিডনির জন্য কি বলার থাকবে! একবারের জন্যই এই কথাগুলো মনে আসে, খালাম্মার ছেলে লোকটাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হয়।
আত্মীয়স্বজন মিছিল করে আসে খালাম্মাকে দেখতে, সবাই বলে ডায়লাইসিস করার দিন আপনেদের শেষ হয়ে আসছে, খুশির খবর, আচ্ছা, এই ছেলেটা দিবে! বেশ বেশ, একটা কিডনি দিয়েও মানুষ দিব্যি ৮০ বছর চালায়ে দিতে পারে। আমি চমকে উঠি, ৮০ বছর কে বাঁচত চায়, নাকি কিডনি দিলে পরমায়ু বেড়ে যায়! মুখে বলছে বটে কিন্তু চোখে করুণা নাকি ঘৃণা! আহা রে, গরিব মানুষ কিংবা ব্যাটা কসাই, শরীর থেকে কিডনি বেচতে আসছে! শরীর খাটিয়ে রোজগার করতে পারিস না ছেলে! কেউ কেউ মাদকাসক্ত মনে করে ঘুরেফিরে আমাকে পরখ করছে চোখে চোখ রেখে। বিবিধ দৃষ্টির সামনে নিজের দেহটাকে নিয়ে আজকাল খুব লজ্জা করে, মনে হয় দেহটা আমার না, আমাকে কিছুকাল ব্যবহার করতে দিয়েছিল; কিন্তু আমি মওকা পেয়ে মিসইউজ করছি। এইচএসসি পাশ করা একটা ছেলে তুই, কিছুই করতে পারলি না! শেষে কিনা বাপ-মার দেওয়া শরীরটা বেচতে চাস! মামি ফোন দেয়, ধরি না। মেসেজ করি, অপেক্ষা করো, টাকা নিয়া আসব। একটা মেসেজ লেখা আছে, প্রতিদিন একবার পাঠায় দেই।
পরীক্ষার রিপোর্ট খুব ভালো, আমার মায়ের না দেখা বোনটার সঙ্গে আমার সবকিছু হুবহু মিলে গেছে। ডাক্তাররা নাকি বলেছে, এতকিছু এত ভালোভাবে মিলে যাওয়া আমরা এর আগে পাইনি। প্রথমে ওরা বলে – আপাতত তোমার অ্যাকাউন্টে দুই দেই, বাকিটা অপারেশনের পর নাও। আমি বলি, না, যদি আমি মারা যাই তাহলে তো আর দিবেন না, পুরোটাই এখন দিবেন। খালার ছেলেটা বলে, এখন তো হাসপাতালে আমাকে তিন লাখ জমা দিতে হবে, আমার একদম হাত খালি ভাইয়া, এক লাখ পরে নাও? আমি বলি আমাকে একটু ভাবতে দেন। পরদিন ভেবে টেবে বলি, তিন লাখ এখন দিবেন, আমি যদি বাঁচি তো বাকি এক পরে দিয়েন। লোকটা খুশি হয়। মামিকে মেসেজ করি, অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিলাম, মায়ের ছবি দিয়ে মাকে নমিনি করে আমার ব্যাংকে টাকা রাখছি, আমি মারা গেলে মা ঢাকায় এসে এই টাকা নিয়ে ভিটা ছাড়ায় নিবে। বাঁচলে সাতদিন পর কথা বলব। আবার ফোন বন্ধ রাখি।
হাসপাতালে শুয়ে থাকি ফ্যানের নিচে, দু-একদিন পর অপারেশন। খালাম্মার ঘরে এসি চলে। মুখোমুখি ঘর, টের পাই। আমার কেবিনের সামনে লোকজন ঘোরাঘুরি করে। এর মধ্যে খালাম্মার অবস্থা একদিন খুব খারাপ হয়ে যায়। আমি ভাবি টাকাটা ফেরত দিতে হবে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। কিংবা কী জানি একটু মুক্তির আনন্দও কাজ করেছিল কিনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার তো কোনো গার্জিয়ান নেই, যদি শরীর থেকে আরো কিছু কেটে রাখে তো কে দেখবে! একবার মনে হয় হাসপাতালের কোনো কেবিনবয়কে ভাই পাতাই, বলি আমাকে একটু দেখ, মরে গেলে শুধু এই নাম্বারে ফোন দিয়ে জানায় দিও আমি মারা গেছি। আর এরা যেন বাকি টাকার বদলে আমার লাশটা বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সাতদিন পর মামিকে ফোন করব বলেছিলাম। তিন দিন শেষ। এখনো জানি না কবে অপারেশন। আবার অনেকগুলো পরীক্ষা করা হয়। পুরনো মেসেজটা আবার করি। ১০ দিন পর ফোন দিব, চিন্তার কোনো কারণ নাই। শুয়ে শুয়ে ভাবি, বৃদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওরা এত কষ্ট করছে। যদি সত্যি সুস্থ হয়ে না ওঠেন! আমার ঘাড়-মাথা গরম হয়ে যায়। না, নিশ্চয়ই তারা জেনেশুনেই সব করছে। এত টাকা, শ্রম কি বিফলে যেতে পারে!
রিসিপশনে মনোহারি গাঢ় সবুজ আর হালকা হলদে টাটকা কামরাঙার ছবি, সতর্কীকরণ, কামরাঙা কিডনির জন্য বিপজ্জনক, কিডনি রোগীর জন্য মহাবিপজ্জনক। মরণোত্তর কিডনি দিন, আপনজনকে কিডনি দিন, কিডনি বেচাকেনা আইনত …।  বাইরে নাকি খুব গরম, ভিতরেও। মানুষ হাঁসফাঁস করে। একটু বৃষ্টি চায়, পৃথিবী ঠান্ডা হওয়া দরকার। আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ার চেষ্টা করি, গ্রামের বেশিরভাগ ছেলে ভালো পড়ুয়া হয় না। বই পড়া শহুরে বিলাসিতা। তবু আমি পড়ার চেষ্টা করি। পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে ফেলি, পড়তে পড়তে কখনো উদার, কখনো উদাস হয়ে যাই। টের পাই, মাঝে মাঝে রোগীর লোকজন দূর থেকে দেখেই চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় যাকে আমি কিডনি দিচ্ছি তিনি কি আমাকে দোয়া করবেন, যেন আমি আর কোনো ধাপ্পাবাজের হাতে ধরা না খাই! মাঝে মাঝে মনে হয়, যে-লোকটা আমাকে পথে বসিয়েছে তাকে যদি আমি কিডনি দিব বলে ঠিক করতে পারতাম তাহলে খুব মজা হতো। যেদিন কিডনি দেওয়ার কথা থাকত সেদিন যে-করেই হোক আমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতাম। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সোজা মুন্সীগঞ্জ, ভবেরচর। হাওয়া হা-হা বিলে ছোটবেলার মতো ঘুড়ি ওড়াতাম। এমন মাঞ্জা দিতাম সুতায়, সবারটা কাটা পড়ত আমার সুতায়। এদিকে ভোকাট্টা হয়ে সেই লোকটার লোকজন আমার পিছনে ঘুরত! কী ভালো যে হতো!
মেসেজের দশদিনের পাঁচদিন বাকি থাকতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকি। এর মধ্যে আমার ব্যাংকের কাগজপত্র এক কেবিনবয়ের কাছে গচ্ছিত রেখেছি। মা জানে আমার অ্যাকাউন্ট, তো এবার সব ঠিকঠাক। ওটিতে এত ঠান্ডা, আমার শীত লাগে মাঘ মাসের রাতের মতো। ওটির ড্রেসে শুয়ে আছি। ন্যাংটা ন্যাংটা লাগা ছাড়া অনুভূতিতে তেমন কিছু কাজ করছে না। চারিদিকে যন্ত্রপাতি, তালের শাসের মতো ঝুলে থাকা বাতি আর অদূরে আরো একজন শুয়ে আছেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার খালাম্মা। আমার মায়ের না দেখা বোন। আমি কাকে যেন বলি, আমাকে অজ্ঞান করবেন? উত্তর দেয় না। যেন উত্তর না দেওয়াই নিয়ম। নার্সগুলো দূরে দূরে। দেখে মনে হয় এরা প্রেতাত্মা, মমতাহীন।
মাথার কাছে ঘড়ি থাকলে বুঝতে পারতাম কয়টা বাজে। হয়তো ঘড়ি আছে, আমি তো চোখই খুলতে পারছি না। দুপুরের আগে ঢুকেছি, এখন কি বিকাল? নাকি রাত হয়ে গেছে? নাকি সকাল? কিন্তু চোখ না খুলেই আমি বুঝতে পারি, আসলে এখনো দুপুর, অপারেশন এখনো শেষ হয়নি। খ্যাঁচখ্যাঁচ কাটাকাটি চলছে, ফিসফিস কথা চলছে। আমি চোখ বন্ধ করেই অনুভব করি, একটা লোক আমার মাথার কাছে, সে কথা বলছে না। আমার মনে হচ্ছে সব মনোযোগ আমার প্রতি, মূল রোগী তাদের কোনো বিষয়ই না। আমার কিডনিটাই তাদের সবচেয়ে আরাধ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু। যাকে দেওয়া হবে তাকে নিয়ে কোনো কথা নেই, সে ফালতু বুড়ি একটা। ছেলেরা আদেখলাপনা করলেই কি তাকে এমন একটা তরতাজা কিডনি দিতে হবে নাকি! পেটটা খানিক কেটে সেলাই করে দাও হে, ছেলেরা সান্ত্বনা নিয়ে থাকুক। আমি ঠিক শুনছি, হ্যাঁ, এমএসের কপালটা ভালো। এমন তরতাজা কিডনিটা সে পেল এত তাড়াতাড়ি। শালারা টাকা দিয়ে সব কিনে নেয়। স্যার ওপরে অপেক্ষা করছেন এমএসের পেট ফেঁড়ে। বিদেশ থেকে নামি ডাক্তারও উড়ে এসেছেন এ-কাজের জন্য। আমার কণ্ঠ রুদ্ধ, আমার সারাশরীর অবশ। ওরা শুধু কিডনি কেন, বুড়োটার যা-যা অকেজো আমার যুবক তাজাদেহ থেকে এক-এক করে সব নিতে পারে, এমনকি আমার পুংলিঙ্গটা পর্যন্ত। এমএসের জন্য পুরো বডিটা নিলেও আমার কিচ্ছু করার নেই। অভিভাবকহীন আমি। এমএস কি ১০ লাখ টাকা দিয়ে ডাক্তারদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে কিডনিটা? নাকি আরো বেশি দামে! হায়, এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীরা! আমি পাব মোটে চার, যদি বেঁচে বের হতে পারি! বাকি ছয় ডাক্তাররা! এমএসের ভবিষ্যৎ আছে। দেশে-বিদেশে তার ব্যবসা। চাইলে দেশের রাজনীতিও সে হ্যান্ডল করতে পারে। কিংবা কে জানে এখনই তা করছে কিনা! বুড়িটার আর আমার আছেটা কি! বুড়িটা মানে, আমার মায়ের না দেখা বোন। আমার আর তার মধ্যে পার্থক্য কী, বাঁচলেও চলে, মরলেও চলে।