মইনুল ইসলাম জাবের
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পবীক্ষণে বারবার মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর করা দুর্ভিক্ষের চিত্রাবলি। সে-সূত্রেই জয়নুল যেন পরিচিত হলেন বাংলার প্রলেতারিয়েতের শিল্পীরূপে। এ-কথা অনস্বীকার্য, জয়নুলের শিল্পসম্ভারের প্রায় পুরোটা জুড়েই সরাসরি প্রস্ফুটিত হয়েছে বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনচরিত – তাদেরই আনন্দ, বেদনা, সংগ্রাম। তাঁর তুলির আঁচড়ে ওই জীবনই প্রতিবিম্বিত। লোককলায় জয়নুলের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তবে তাঁর সমগ্র কাজে তার প্রভাব সরাসরি দৃশ্যমান নয়। এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল জয়নুলের শিল্প-নির্মাণের দুটি বিশেষ পর্যায়ে। প্রথমটি পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫০-৫৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ১৯৭২-৭৩ সালে। এ দু-কালেই জয়নুল বাংলার লোকজ উপকরণ, মূলত তাঁর বাড়ির কাছের কিশোরগঞ্জের টেপা পুতুল থেকে ধার করলেন সরলীকরণের রসদ। নানা কারণেই হয়তো জয়নুল এই নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারেননি। ওবে এই ছবিগুলোর শক্তিমান উপস্থিতি জানান দেয়, জয়নুল যদি আরো কিছু কাজ করে যেতে পারতেন, তবে হয়তো বাংলার শিল্প-ইতিহাসে এক অনন্য শিল্পপথের দিশা দিতে পারতেন।
শিল্প কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের স্মৃতি রোমন্থনে প্রায়ই একটি জীবনঘটনার স্মরণ করেন। যে-সময়ের কথা, সে-সময়ে কাইয়ুম চৌধুরী পাকিস্তান অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের শিল্প-নির্দেশক। জয়নুলের বাড়ির কাছেই তাঁর বাড়ি। প্রতি রোববার জয়নুলের বাড়িতে আড্ডায় শরিক হন তিনি। সে-আড্ডায় আরো থাকতেন জসীম উদ্দীন, মনসুরউদ্দীন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ প্রমুখ। এমন এক রোববার জয়নুলের বাড়ি গিয়ে কাইয়ুম দেখেন, রোয়াকে জয়নুল একা বসে। কাছে আসতেই জয়নুল ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তান অবজারভারের ম্যাগাজিন সেকশনের ইলাস্ট্রেশনগুলো কে করে? কাইয়ুম জানালেন, ওই ইলাস্ট্রেশনগুলোর শিল্পী তিনি নিজে। জয়নুল বললেন, এই যে নৌকার গলুইয়ে চোখ, নৌকার দেহে ঢেউ – এসব তুমি কই দেখলা? কাইয়ুমের উত্তর, সিলেট অঞ্চলে – ওরা ওখানে নৌকায় পিতলের চোখ বসায়। জয়নুল বললেন, তুমি এ দিয়ে কি ছবি আঁকতে পারো না? ঘাটে বাঁধা নৌকা, তাতে একটা চোখ – অনেকগুলো নৌকা, অনেকগুলো চোখ? তখনকার কাইয়ুম ছবি আঁকেন না অনেকদিন। জয়নুল যেন তাঁর চোখ খুলে দিলেন। কাইয়ুম চৌধুরীর লোকজকলার প্রতি যে ঝোঁক তার শুরুটা ঠিক এভাবেই ঘটালেন শিল্পীগুরু জয়নুল। জয়নুল আবেদিনের শিল্পকলার ওপর লেখায় এ-গল্পটির অবতারণার কারণ, জয়নুলের শিল্পদর্শনের মুখ্য রূপটিকে তুলে ধরা। সে-দর্শন একমাত্রিক কেবল নয়, সেখানে একদিকে দেশ ও দেশজ কৃষ্টির প্রতি তাঁর একান্ত অনুরাগ। আর অন্যদিকে শিল্পপথের পথিকদের বাংলার মাটির কাছে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস।
ভারতীয় শিল্পকলার আদি ইতিহাসে বাংলার শিল্পীদের উপস্থিতি তেমন দৃশ্যমান নয়। পালযুগের পুঁথি আর কিছু ভাস্কর্য হয়তো বাংলার আদি শিল্পের একমাত্র রয়ে যাওয়া নিদর্শন। তবে ব্রিটিশদের হাত ধরে, অনেকটা উপনিবেশী মনোভাব থেকে তৈরি হওয়া কলকাতা আর্ট স্কুলই ভারতে আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে। এতে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত যোগ দিলেও পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সমাজের তেমন উপস্থিতি ছিল না। আবদুল মঈন এবং কাজী আবুল কাশেম ছাড়া কোনো মুসলিম শিল্পীর নাম বেশি একটা শোনা যায় না। এমনি একসময়ে ময়মনসিংহের মফস্বলী গন্ডি থেকে উঠে এসে কলকাতায় পুর-পরিবেশে থিতু হলেন শিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর জয়নুল আবেদিন।
কলকাতা আর্ট কলেজের শিল্পশিক্ষণ পদ্ধতি ব্রিটিশ স্কুলের আদলে ছিল। তাছাড়া তার লক্ষ্যও ছিল উপনিবেশের উপযোগী শিল্পসম্ভার রচনার কারিগর তৈরি করা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্প ও শিল্পীদের তেমন দেওয়া-নেওয়ার চল না থাকা এবং ইউরোপের সমসাময়িক শিল্প-আন্দোলনে ব্রিটিশ স্কুলের তেমন প্রভাব না থাকা – এ-কারণগুলো কলকাতার শিল্পশিক্ষণকে ‘ড্রইং উইথ লাইট অ্যান্ড শেডে’র বদলে ‘ড্রইং ইন লাইট অ্যান্ড শেডে’র ঘেরাটোপে বেঁধে দিয়েছিল। শিল্পের মূল সুর ছিল ‘রিয়ালিজমে’র ছকে আঁকা। আর বেশিরভাগ শিল্পীর দক্ষ কাজও ছিল ‘রোমান্টিক’ এবং ‘ন্যাচারালিস্টিক রিয়ালিস্টিক’। বিষয়বস্ত্ততে গ্রামজীবন, কর্মমুখর মানুষ এবং অল্প কিছু নৈসর্গিক দৃশ্য। কলকাতাকেন্দ্রিক এই শিল্পচর্চার বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল প্রাচ্যমুখী বেঙ্গল স্কুল – যার শুরুটি হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরে। তবে জয়নুল যখন ছাত্র, এ-অঞ্চলের তখনকার শিল্পচার্চাকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নেওয়া যায় – কলকাতার ব্রিটিশ শিক্ষাপুষ্ট রিয়ালিস্ট আর্ট, শান্তিনিকেতনভিত্তিক দেশজ রসে পুষ্ট ‘বেঙ্গল আর্ট’ আর এই দু-ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে এই দুই দর্শনের মিশ্রণে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে প্রয়াসী আর্ট। জয়নুলের প্রথমদিকের কাজে কলকাতার শিল্পশিক্ষণের বিশেষ প্রভাব ছিল, তবে তাঁর কাছে বেঙ্গল আর্টের প্রতি ভালোবাসার ছাপ তেমন ছিল না। সাধারণ মানুষের জীবনকে আঁকবেন, তাও হয়তো তিনি জানতেন, তবে কীভাবে আঁকবেন – সেটি তখন পর্যন্ত ঠাহর করতে পারেননি। এজন্যে হয়তো অপেক্ষা করতে হয়েছিল কলকাতার দুর্ভিক্ষের।
এ-প্রসঙ্গে সে-কালের ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতাটাও একটু মনে করে নেওয়া দরকার। ভারতে মুসলমানদের আগমনের পর থেকেই এখানে যে সুফিবাদে পুষ্ট সাংস্কৃতিক ইসলামের উন্মেষ হয়েছিল, বৃহত্তর বঙ্গের মুসলিম সমাজে তার প্রভাব ছিল বটে। তবে প্রলেতারিয়েত বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে তার সরাসরি প্রভাব ছিল না বললেই চলে। অনেকটা ‘সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি’র মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান সমাজ যেমন পূজা-পার্বণেও পুতুল-পিঠা নিয়ে আমোদ করত, জারি-সারি গানে মাতোয়ারা হতো, তেমনি ছবি আঁকা আসলে ধর্মীয় দৃষ্টিতে কেমন কাজ – সে-নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করত। বিংশ শতকের শুরুতে বাংলার তথা সমগ্র ভারতে ‘মুসলমান’ হিসেবে একটি আলাদা জাতিতত্ত্বের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ধর্মীয় মুসলিম মানুষকে প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে। বাংলার মুসলিম সমাজ বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘অপরের ভাবতে’ এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিতে অন্ধভাবে নিজেকে সঁপে দিতে চাইল। কলকাতার শিল্প-পরিবেশে তখন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন গুটিকয়েকজন। তাঁদের কাজেও সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্ব ছিল প্রচ্ছন্ন। এমন পরিবেশে চিত্রকলার জগতে মুসলিম সমাজ থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারাটা ছিল এক অনন্য উদাহরণ – ভালো আঁকিয়ে হতে পারাটা তো প্রায় অসম্ভব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জয়নুল আবেদিন এ-পরিবেশে প্রবেশকালে কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষক আবদুল মঈন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না-নেওয়া শিল্পী কাজী আবুল কাশেমকে পেয়েছিলেন। তাঁরা দুজন ছিলেন জয়নুলের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিবেশের সঙ্গে মিলে যাওয়া অগ্রজ।
কলকাতার শিল্প-সাহিত্যের পরিমন্ডলে তখন অনেক তারকা। এঁদের শিল্পদীক্ষণ এবং দর্শন ছিল অনেকটাই শহুরে – কলকাতাকেন্দ্রিক গ্রামকে তাঁরা আঁকছেন, তবে তা শহরের চশমার ভেতর থেকে দেখে আঁকছেন। পূর্ববঙ্গের প্রায় দরিদ্র মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা জয়নুল আবেদিনের সমাজদর্শনের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব ছিল বইকি। জয়নুলের সমসাময়িককালেই কলকাতার শিল্প-সাহিত্যের পরিমন্ডলে আবির্ভূত হয়েছিলেন আববাসউদ্দীন, জসীম উদ্দীন – যাঁরা গাইলেন এবং লিখলেন বাংলার গ্রামের গান-কবিতা। এই ‘উদ্দীন’রা কলকাতার পুর-পরিবেশে প্রথমবারের মতো বাংলার গ্রামকে গ্রামীণ চোখে দেখানোর চেষ্টা করলেন। জয়নুলকে অবশ্য গ্রামজনতার শিল্পী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল কিছুকাল। চল্লিশের দুর্ভিক্ষে তিনি যেন তাঁর ভাষা খুঁজে পেলেন, অনেকটা অজান্তে। হয়তো দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকতে আঁকতেই জয়নুল তাঁর শিল্পদর্শনেরও ভিত্তি স্থাপন করলেন। হয়ে উঠলেন জনগণের শিল্পী – প্রলেতারিয়েতের শিল্পী – তবে তাতে ছিল না কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রভাব। উত্তরকালে জয়নুল এই শিল্পদর্শনেরই আধুনিকায়নে, সরলীকরণে ব্রতী হলেন। তখন তাঁর দর্শনের উপকরণ হয় পূর্ববঙ্গের লোকজ ঐতিহ্য।
দুর্ভিক্ষের চিত্র জয়নুলের সঙ্গে সঙ্গে এঁকেছিলেন অনেকেই। সোমনাথ হোর, চিত্তপ্রসাদ – এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট। সংখ্যার দিক থেকে এঁদের কাজও অনেক। তবে জয়নুলের সঙ্গে তাঁদের মূল পার্থক্য ছিল দর্শনে। এঁরা তখন কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মী। তাই তাঁদের কাজগুলোও ছিল রাজনৈতিক দর্শনে জারিত। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে জয়নুল এঁকেছিলেন তাঁর শিল্পী-সত্তার তাগিদে। তাঁর মোটা ব্রাশের খসখসে কালিপুষ্ট মানুষগুলোকে তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের ফেলে আসা স্বজন ভেবেছিলেন। এদের আঁকতে গিয়ে রোমান্টিক রিয়ালিজমের শিল্পশিক্ষায় শিক্ষিত জয়নুলকে তাই হতে হয়েছিল বাস্তববাদী। কষ্টকে তিনি কষ্ট হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন, তাঁর মনে কী চলছে তার চাইতে বড় ছিল সামনের ওই মানুষগুলো কী করছে, তা দেখানো। মলিন-ছিন্নবসনে অস্থিচর্মসার ভগ্নপ্রায় নর-নারীর বিবরণে ন্যূনতম রেখার টান তিনি দিয়েছেন। বিবরণে বিশদ না হয়ে হয়েছেন লক্ষ্যভেদী। জয়নুলের কাজে এই প্রথম পরিবর্তনের ছাপ চোখে পড়ল।
১৯৪৭-এর পাকিস্তান সৃষ্টি জয়নুলকে এ-বাংলার শিল্প-আন্দোলনের পুরোধায় পরিণত করল। সফল শিল্পী আবির্ভূত হলেন দক্ষ এবং সফল সংগঠক রূপে। যে-বঙ্গে খুলনার শংকরপাশার বিলুপ্ত আর্ট স্কুল ছাড়া কিছুই ছিল না, সেখানে তিনি গড়লেন আর্ট স্কুল। তবে আর্ট স্কুলের লক্ষ্য কী হবে? জয়নুল চাইলেন স্বাধীন শিল্পী তৈরির কারখানা হবে এই প্রতিষ্ঠান। পশ্চিম পাকিস্তানকে দেখাতে-জানাতে হবে পূর্ববঙ্গের শিল্পের বিশ্বমান রয়েছে। তিনি এও বুঝলেন, দেশের অন্তরের গভীরে যেতে হবে ভালো শিল্প তৈরি করতে হলে। কৃষ্টি-শেকড়কে চেনাতে শিল্পীছাত্রদের সামনে নিয়মিত হাজির করলেন আববাসউদ্দীন, জসীম উদ্দীন, কানাইলাল শীলকে। সংগ্রহ করতে শুরু করলেন বাংলার লোকজ নানা উপকরণ – শাড়ি, নকশিকাঁথা, সরা, পিঠার ছাঁচ, মাটির কিংবা কাঠের পুতুল – আর দেখাতে লাগলেন ছাত্র-শিক্ষকদের। জয়নুলের তৎকালীন শিল্পসৃষ্টিতে তখনো এই লোকজ উপকরণগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যবহার শুরু হয়নি – তবে তিনি যে-শেকড়ের সন্ধানে, নিজের শিল্পভাষা বিনির্মাণে ব্রতী, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল।
জয়নুল আবেদিনের চিরকালীন কাজের ধরনে পরিবর্তন এসেছিল সম্ভবত তাঁর ছাত্রদের বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর। ১৯৪৮-এ চারুকলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের চিত্রকলা-জগতের প্রথম ছাত্রছাত্রীদের আবির্ভাব ঘটে। এদের প্রত্যেকেই প্রায় চিত্রকলায় তাঁদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এদেশের চিত্রকলার ধরনটিকে তৈরি করার কাজটি করতে। এই ছাত্রদের অনেকেই কলেজ পাশ করার অব্যবহিত পরেই বিদেশে উচ্চতর শিল্প-প্রশিক্ষণার্থে পাড়ি জমান। প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমিনুল ইসলামের বিদেশ গমন এবং দেশে প্রত্যাবর্তন তাঁর কাজের ধরন পালটানোর জন্য যেমন দায়ী, তেমনি অন্য সতীর্থ এবং শিক্ষকদের কাছেও পরিবর্তন আনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কলকাতার আর্ট কলেজ আর শান্তিনিকেতনের বেঙ্গল স্কুলের বাইরে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র একটি আধুনিক বঙ্গীয় শিল্পভাষার নির্মিতি কীভাবে হবে, এ-প্রয়াসে রত তখন শিল্পী-ছাত্র সবাই। প্রথম প্রজন্মের ছাত্রদের ভারতের গন্ডি পেরোনোর ফলে আন্তর্জাতিকতার স্বাধীনতা যেন পাওয়া গেল। একে একে রশিদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর – এঁরা সবাই বিদেশমুখী হলেন। এঁদের ছবির ধরন পালটাল। অনেকেই বিদেশমুখী হলেন, পাশ্চাত্যের নানান ইজমে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাবলেন, এই হোক বাংলার আধুনিকতার ভাষা। কালের বিচারে এখন বোধহয়, এসব কাজের অনেকই শৈলীতে অনন্য হলেও ভাবে-ভাষায় অপূর্ণ, শেকড়ছেঁড়া। বিশ্বকে এই বাংলা কিছু দেবে তা নয়, যেন বিশ্বমাঝে স্থান করে নেওয়ার প্রচেষ্টাই এতে লক্ষণীয়।
বিদেশফেরতা শিল্পীদের মধ্যে রশিদ চৌধুরী ফিরে এসে দেশজ উপকরণ থেকে তাঁর কাজের জন্য রসদ সংগ্রহ করলেন। বাংলার ঐতিহ্যিক বিগ্রহশৈলী থেকে দশভুজা দুর্গা, রাধাকৃষ্ণ ও কালীমূর্তির উত্তোলিত হাতের নানামুখী বিন্যাস থেকে রশিদ তাঁর চিত্রতলের গড়নটি গড়লেন। ফরাসি শিল্পশিক্ষার ভাব তাতে ছিল, তবে তাতে ছিল বাংলার ঝাঁঝ। লোকজ উপকরণের সরাসরি প্রয়োগ তিনি করেননি – তবে শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কটি তিনি ঠিকই রেখেছেন।
কামরুল হাসান লোকজ উপকরণকে সরাসরি নিয়ে আসতে চাইলেন তাঁর কাছে। লক্ষ্মীসরায় রং, রূপ, আকার – এ সবকিছুই কামরুলের চিত্রতলের ভাষার অক্ষর হলো। যামিনী রায় বাংলার পটকে যেভাবে আধুনিক চোখে দেখাতে চেয়েছেন, কামরুল তারই ছান্দসিক রূপ দিয়েছেন। যামিনী রায়ের যেখানে শেষ, কামরুল হাসান যেন সেখানটিতেই শুরু করলেন।
জয়নুল-আন্দোলনের আরেক ছাত্র কাইয়ুম চৌধুরী, – যিনি ততদিনে গ্রাফিক ডিজাইনে বাংলাদেশকে আধুনিক করে তুলছিলেন, অনেকটা জয়নুলের প্রণোদনায়ই যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন নৌকার গলুইয়ের নকশায়, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে, জামদানির ডিজাইনে। কাইয়ুম চৌধুরী প্রেমে পড়লেন নকশায় : লোকজকলার লিরিক্যাল উপাদানগুলোকে লোকজ রঙে রাঙিয়ে ফর্ম তৈরি এবং বিন্যাসে ব্রতী হলেন তিনি। কাইয়ুম জামদানিকে তুলে আনলেন বইয়ের প্রচ্ছদপটে (জসীম উদ্দীনের জীবনস্মৃতি), নদীর নৌকার গলুইয়ে খুঁজে পেলেন অতি সরল চোখ আর ছবির তলে সেই ভাব-ভাষাকেই প্রকাশ করতে রত হলেন।
জয়নুলের ওপর তখন বিপুল চিত্রভাষাকে আধুনিকীকরণের দারুণ চাপ। তিনি সনাতনী? বিদেশফেরত শিল্পীদের নানা ইজমের ভিড়ে জয়নুল আবেদিনের কাজ কতটা আধুনিক? জয়নুলের সামনে তখন দুটি পথ – অন্যদের মতো বিমূর্তকলায় ব্রতী হওয়া, কিংবা বাংলার লোকজ উপকরণ থেকে সরলীকরণের পাঠ নেওয়া। বিমূর্তশিল্পে কিছুটা প্রবেশ করেও পরে পথ ঘোরালেন তিনি। কিশোরগঞ্জের হাতে টেপা পুতুল তাঁকে এনে দিলো স্বাধীনতা। জয়নুলও ততদিনে বিলাতফেরতা হয়েছেন। পাশ্চাত্যের শিল্প-আন্দোলনের রূপ তিনি সরাসরিই দেখতে পেয়েছেন। বিলেতে অবস্থান তাঁর নতুন ভাষা রূপ খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।
সম্ভবত জয়নুলের এই শিল্পবিবর্তনে মদিগ্লানির কাজের পরোক্ষ প্রভাব ছিল। মদিগ্লানির অসংখ্য লম্বা গলার নর-নরী প্রবলভাবে আফ্রিকীয় পুতুলের প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল। মদিগ্লানির এই কাজগুলোতে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড নয়, প্রধান ছিল ফোরগ্রাউন্ড। জয়নুল তাঁর পঞ্চাশের দশকের কাজে এই দুটি বিষয়কেই বেশি প্রধান্য দিলেন – কিশোরগঞ্জের পুতুল থেকে নিলেন আকার, গড়ন, সরলীকরণের পথ আর ব্যাকগ্রাউন্ডকে ছেড়ে দিয়ে ফোরগ্রাউন্ডকেই করলেন মুখ্য।
জয়নুল ১৯৫১-৫২ সালে অনেক এঁকেছেন বাংলার গ্রামজীবনের রূপ। এগুলোর বেশিরভাগই জলরঙে কিংবা গোয়াশে করা। মোটা কনট্যুর লাইনে আঁকা গ্রামীণ খেটে-খাওয়া মানুষ এ-ছবিগুলোর বিষয়। এ সময় থেকেই পাশ্চাত্যের কিউবিক জ্যামিতিক স্টাইলের সঙ্গে বাংলার লোককলাকে মেলানোর চেষ্টা করছিলেন জয়নুল। ছবিতে মূল বিষয় বাংলার নারী।
পঞ্চাশের দশকের একটি তেলচিত্র ‘স্টিললাইফ’ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ছবিটি পাশ্চাত্যের ঢঙে আঁকা – একটি টেবিলে ফুলের টব – তাতে কিছু গাঁদাফুল আর তার সামনে মাটির পুতুল – ঘোড়া। স্টিললাইফের এই দুই উপাদান – গাঁদাফুল আর ঘোড়া ছাড়া সম্পূর্ণ ছবিটি দেখতে পুরোপুরি ইউরোপীয়। তবে যেটি প্রণিধানযোগ্য, সেটি হলো, জয়নুল এতে জানান দিলেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশেলে একটি নতুন শিল্পভাষার জন্ম তিনি দিতে চান – যা হবে সমসাময়িক; কিন্তু যার শেকড় প্রোথিত থাকবে বাংলার মাটিতে।
পঞ্চাশের দশকেরই ‘রমণীর মুখ’ শীর্ষক দুটি কাজ। একটি তেলচিত্র, যাতে রয়েছে পাশ্চাত্যের কিউবিক রীতিতে আঁকা নারীর মুখ। অন্যটি গোয়াশে করা কাজ, যেটি বাংলার পট থেকে উঠে আসা নারীর অবয়ব। দুটো ছবিই মোটা কনট্যুর লাইনে আঁকা। জয়নুলের নিরীক্ষণের এ দুটি বিশেষ নিদর্শন। তিনি বুঝে চাইছেন কীভাবে নতুন ভাব-ভাষায় ইউরোপীয় কিউবিজম আর বাংলার লোকজ উপাদানকে চিত্রতলে ধরে রাখা যায়।
১৯৫৩-তে আঁকা ছবিগুলোতে জয়নুল স্পষ্টভাবেই জানান দিলেন, লোকজ উপকরণকে তিনি তাঁর ছবিতে কীভাবে ব্যবহার করতে চান। ’৫৩-তেই আঁকা ‘প্রসাধনে’ দুই নারীর দৈহিক গড়ন, চোখের ইশারা, লম্বা কিন্তু স্থূল গলা, শাড়ির রং, পরার ধরন, শাড়ির পাটে আনুভূমিক সমান্তরাল রেখা আর দুই নারীকে ঘিরে ধরা মোটা কনট্যুর লাইনের ঘেরাটোপ। কিশোরগঞ্জের টেপা পুতুল থেকে জয়নুল নিলেন সরলীকরণের পাঠ। ব্যাকগ্রাউন্ডকে নিয়ে আর ভাবলেন না – ছবির ফোরগ্রাউন্ডই হলো মুখ্য।
১৯৫১-তে টেম্পেরায় আঁকা ‘মা ও শিশু’ অথবা ‘কলসি কাঁখে রমণী’ কাজগুলোতে জয়নুল লোকজ ফর্ম থেকে যেন জ্যামিতিক ঢং বের করে আনছিলেন। টেপা পুতুলের কপোল, চোখের আভাস, হাত-পায়ের গড়নের সঙ্গে লম্বা এবং মোটা গলা – এসবই চলে এলো জয়নুলের জলরঙে। ‘মা ও শিশু’ শীর্ষক কাজগুলোর বিষয়বিন্যাস এবং মায়ের কোলে শিশুর অবস্থান – এও তিনি নিলেন বাংলার পুতুল থেকেই। ১৯৫১তে করা এই কাজগুলো ১৯৫৩-তে এসে হলো আরো সবল – জয়নুলের জলরঙে করা ১৯৫৩-র ‘মা ও শিশু’তে নেই কোনো আড়ম্বর – অল্পকিছু লাইনে যেন তিনি তুলে আনলেন শাশ্বত ভালোবাসার রূপ।
টেপা পুতুলের সরলতার মূলে তার উপকরণগত সীমাবদ্ধতা এবং কারিগরের সময়-সংকীর্ণতা। যত দ্রুত, যত কম আয়েশে একটি নান্দনিক পুতুল বাজারে ছাড়া যায়, তা-ই মোক্ষ। জয়নুল এই সরলীকরণের সুরকে অন্যভাবে বাঁধলেন তাঁর চিত্রপটে। ১৯৫৩-তেই করা আরো অনেক ‘মা ও শিশু’তে জয়নুল ‘মা’ ও ‘শিশু’র স্থিতি নিয়ে খেললেন – কখনো কিউবিক হলেন তির্যক রেখার টানে; তবে আকার-গড়নে ধরে রাখলেন পুতুলের ছাপ।
এ সময়ে করা জয়নুলের আরো একটি অসামান্য গোয়াশের কাজ – ‘দুই বোন’, ১৯৫৩। জয়নুল যে শুরু করেছিলেন একজন রমণী দিয়ে – তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। গড়নগঠনে অকৃত্রিম লোকজ ছাপ, তবে বোঝা যায় জয়নুল এখন বিন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। ব্যাকগ্রাউন্ড এখনো সাধারণ, ফোরগ্রাউন্ডই মুখ্য। জয়নুল এরপর আঁকলেন ‘তিন রমণী’। বিন্যাসের প্রকরণে এমন অনেক নিরীক্ষা তিনি করলেন।
১৯৫৩ সালে করা এ-কাজগুলোর মধ্যে বহুজন সমাদৃত ও আলোচিত ‘পাইন্যার মা’। গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ঋজু রমণী; আলতা রঙে তাঁর হাত-পায়ের কনট্যুর আঁকা, লম্বা-মোটা গলা কালো শাড়িতে ঢাকা। আর তার শাড়িতে পুতুল থেকে উঠে আসা সারি সারি আনুভূমিক রেখা। এ সময়ের অন্য কাজগুলোর মধ্যে অনন্য ‘পরিবার’ (জলরং, ১৯৫৩), ‘বেদে’ (টেম্পেরা, ১৯৫৩), ‘গুণটানা’ (গোয়াশ, ১৯৫৫)। জয়নুল যেন গ্রামীণ পরিবেশ ও তার খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনকে সেই মানুষদেরই লালিত লোকজ শিল্প দিয়ে আঁকতে চাইলেন।
বাংলার প্রতিদিনকার নিপাট নিরহঙ্কার গ্রামীণ মানুষের খেটে খাওয়া জীবনকেই জয়নুল আঁকতে চেয়েছেন চিরকাল। কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি দুস্থ মানবতাকে অহেতুক গৌরবান্বিত করতে চাননি (রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কিংবা অবণী সেনের কাজের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দর্শন)। লোকজকলাধর্মী নিরীক্ষণ হয়তো জয়নুলকে সেই স্বাধীনতা দিতে পারছিল না। তাই হয়তো তিনি আবার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর চিরকালীন শিল্পপদ্ধতিতে – দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায় যে-শৈলীর প্রথম প্রকাশ। পরবর্তীকালে ১৯৬৬-৬৮ সালে কিছু বিমূর্তধর্মী কাজও জয়নুল করেছিলেন। তারপর আবার ফিরেছিলেন তাঁর পুরনো ঢঙে। সে-সময়ের বিখ্যাত ‘নবান্ন’ (১৯৭০), ‘মনপুরা সিরিজ’ (১৯৭০) এই সাক্ষ্যই দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে জয়নুল আবার লোকজকলানির্ভর কাজ শুরু করেছিলেন। গ্রামজীবনের চিরকালীন রূপকে ফুটিয়ে তুলতে হয়তো ভেবেছিলেন লোকজ ঢংকে আবার কাছে টানবেন। ‘দুই বেদে রমণী’ (১৯৭২), ‘আয়না হাতে কনে’ (১৯৭২) তাঁর শেষকালে আঁকা এমনধর্মী কাজ। তবে মৃত্যুর পূর্বকালে (১৯৭৪-৭৫) জয়নুল আবার আগের মতোই তাঁর লাইন ড্রইংয়ে ধরতে চাইলেন প্রকৃতি ও মানবের রূপ – লোকজ উপকরণের আর ব্যবহার হলো না। জয়নুলের স্বাভাবিক শৈল্পিক তাড়নার সঙ্গে বিমূর্ত কলা যেন মিলত না। লোকজ শিল্প ভেঙে যে-সরলীকরণের প্রয়াস তিনি চালিয়েছিলেন, তার অল্পকিছু অনন্য উদাহরণ জানান দেয় এই নিরীক্ষণের ক্ষমতা ছিল অসামান্য। তবে হয়তো এই নিরীক্ষণের অনেকটা ‘ফর্মুলাবদ্ধ’ প্রকৃতি জয়নুলকে অন্য পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে। তবে লোকজ শিল্পের প্রতি অপরিসীম টান তাঁকে বারবার এ-নিরীক্ষণে ফেরাতেও চেয়েছে। দুঃখের বিষয়, জয়নুল এই নিরীক্ষণ বহুদিন ধরে করলেন না – হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পসম্ভারের অনন্য-আধুনিক উদাহরণ হতো এই কাজগুলো। জয়নুল তার আভাসমাত্র রেখে গেলেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.