‘মাটির বেহালা’ নিয়ে কবি এক জাগে

 

কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং মার্কসবাদী চিন্তক কবি তরুণ সান্যালের জীবনাবসান হয়েছে গত ২৮ আগস্ট ২০১৭ কলকাতায়। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার পরজনা গ্রামে ১৯৩২ সালের ২৯ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক খ্যাতনামা কবি, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শোক প্রকাশ করেছেন। ২৯ আগস্ট প্রবল দুর্যোগের মধ্যেও বহুশত মানুষ রবীন্দ্রসংগীত এবং আন্তর্জাতিক সংগীত গেয়ে তাঁর শবানুগমন করেন। কলকাতার কাশিমিত্র শ্মশানঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে শ্রদ্ধা জানান। কবি শঙ্খ ঘোষ, চলচ্চিত্র-পরিচালক অপর্ণা সেন ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী ও চন্দন সেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশ থেকে কবি নির্মলেন্দু গুণ, চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল, কবি নূহ-উল-আলম লেনিন, বাংলাদেশ রিসার্চ ডেভেলপমেন্টের অধিকর্তা মোনায়েম সরকার, নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম শোকবার্তা প্রেরণ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকেও শোক প্রকাশ করা হয়।

তরুণ সান্যাল ছিলেন পশ্চিমবাংলার রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। কলকাতায় বাংলাদেশ দূতবাসের পক্ষ থেকেও প্রথম সচিব ইকবাল তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। কবি তরুণ সান্যাল ছিলেন পশ্চিমবাংলার শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সভাপতি। তিনি কলকাতার প্রগতিশীল সাপ্তাহিক পত্রিকা সপ্তাহর সঙ্গে যুক্ত হন পাঁচ দশকে। চোদ্দো বছর ধরে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি। আমার সৌভাগ্য, দুই ক্ষেত্রেই আমি তাঁর সহযোদ্ধা, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করে আমি তাঁর অনুজপ্রতিম। আমি আমার অগ্রজের স্মৃতি তর্পণ করছি এই লেখায় –

 

কবিতা কী?

সময়টা ১৯৭১ সাল। বেড়াতে বেরিয়েছি। ত্রিবান্দ্রম হয়ে যাব কন্যাকুমারী। সঙ্গে কলকাতার অনেকেই আছেন। আছে অবাঙালি বন্ধুরাও। সূর্যাস্ত হতে তখনো বাকি। অনেক মানুষ এসেছেন। মালয়ালম কথা বুঝি না। তামিল ভাষাও নয়। কিন্তু মানুষের কথায় যেন কী রকম ছন্দ আছে। কথার ছন্দের সঙ্গে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মিল। সমুদ্রের পাড়ে থাকা মানুষের কথায় যেন একটা ছন্দ থাকে। আমি আমার এই কথাগুলো হঠাৎই এক অবাঙালি বন্ধুকে বললাম। তিনি এই মন্তব্য শুনে হেসে বললেন, শুনেছি যে, বাঙালিরা যাঁরা কিছুটা লেখাপড়া জানেন, এমনি সবাই নাকি জীবনে একটা না একটা কবিতা লিখেছেন। ওর কথা শুনে আমি হেসে ফেলি, বলি, আমি নিজে জানি যে আমি কবিতা লিখতে পারি না। তাই লিখিনি। তবে কবিতা আমি পড়ি। আর কবিতা নিয়ে ভাবনা?

এ-নিয়ে অবশ্য আমি কিন্তু ওকে কিছু বলিনি। কবিতা নিয়ে আমার নিজের মতো একটি চিন্তা আছে। শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখলে মনে হতো কবিতা – যামিনী রায়, নন্দলালের অাঁকা ছবি দেখলে মনে হতো কবিতা, তেমনই উদ্বেলিত বিরাট মিছিলের সেস্নাগানের মধ্যেও যেন কবিতার ছন্দ। স্পার্টাকাসের লড়াই, হেনরির পাথর ভাঙা, আবার বছরের প্রথম বর্ষণ কিংবা জীবনে প্রথম প্রেমের আগমন কিংবা চৈতন্যদেবের পদযাত্রা, মে দিবসের লড়াই, ফরাসি বিপস্নব আর রুশ বিপস্নব, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, গান্ধীজির ডা–মার্চ, চীনের লংমার্চ, রাইখস্টাগে লাল পতাকা, চে গুয়েভারার স্বপ্ন আর অহল্যার জীবনদান এসবের মধ্যেও তো কবিতা নিহিত রয়েছে। ছাত্রজীবনে যখন খড়গপুরে নেহরুর বক্তৃতা শুনি আমার তখন মনে হয়েছে এটি কবিতা। এমনকি এসএ ডাঙ্গের বক্তৃতা শুনতে শুনতেও মনে হতো কবিতা। আবার ১৯৭১-এ আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনি ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখনও মনে হয়েছিল এটি কবিতা। যে-বক্তৃতা স্বপ্ন দেখায়, আবেগ সৃষ্টি করে তা তো কবিতাই। ক্ষুদিরামের মৃত্যুর পর ‘একবার বিদায় দে মা’ কবিতা থেকে গান। আবার অহল্যার মৃত্যুর পর সলিল চৌধুরীর লেখা ‘সেদিন সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল/ আরো এক রাত প্রজাপতিগুলি গুটিপোকা হয়েছিল’ এই লাইন তো মনে গেঁথেই  থাকে। আসলে সমাজের বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গ জীবন নিয়ে যেমন সামাজিক জীবন, আর এই দুই জীবনের মেলবন্ধন ঘটায় তো কবিতাই। ছন্দ আর শব্দ তার বাহন। শব্দকে বাহন করে শব্দকে ছাড়িয়ে যায়, এরই নাম তো কবিতা। তাই কবিকে বলা হয় ‘ইঞ্জিনিয়ার্স অব হিউম্যান সোল’। কথাটি বলেছিলেন খুব সম্ভবত জে ভি স্তালিন।

এসব নিয়ে যখন ভাবছি, তখন আমার ওই অবাঙালি বন্ধু হঠাৎ দূরে একজনকে দেখাল। সমুদ্রের কিনারায়, জলের ঝাপটা সয়ে একটি পাথরে গিয়ে উঠেছেন। পাথরে জল আছড়ে পড়ছে, সেই ঝাপটা তাঁর গায়েও লাগছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, পাথরও পিছল। বিপদ হতে পারে! বন্ধুটি বললেন, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কবি হবেন। দেখ, তবে চিৎকার করে ডেক না। আমি ছবি ওঠালাম। তারপর চিত্তদা (চিত্তপ্রিয় রায়) আর আমি তাঁর কাছাকাছি গেলাম। দেখলাম তরুণ সান্যাল। চিত্তদাই বললেন, তরুণ! সূর্যাস্ত এখান থেকেও দেখা যাবে। তরুণদার তন্ময়তা ভাঙল।

 

বক্তৃতার স্বপ্ন-বাস্তব ও কবিতা

কবি তরুণ সান্যালের মাটির বেহালা যখন পড়ি সেটা ১৯৬২-৬৩ সাল। সিপিআই পার্টি তখনো অবিভক্ত।

কবি তরুণ সান্যালকে তখনো আমি চোখে দেখিনি। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভাজন। পরিবারগুলোতে বিভাজন। বন্ধুত্বে বিভাজন, বিভাজন গণআন্দোলনে। তরুণদা সিপিআইয়ে। আমি তাঁকে দেখি খুব সম্ভবত ১৯৬৫-তে। বর্ধমান গিয়েছিলাম রিপোর্ট সংগ্রহ করতে। তখনো কালান্ত পত্রিকা দৈনিক হয়নি, সাপ্তাহিক। আমি তার তরুণ সাংবাদিক। মাটির বেহালার কবিকে দেখলাম ভাতারের রাস্তায় ঢুকে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে। সেই তরুণদাকে প্রথম দেখা। এরপর দৈনিক কালান্ত হওয়ার পর তিনি প্রায়শই কালান্তরে আসতেন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, গণআন্দোলনে একসঙ্গে কাজ, পত্রিকা প্রকাশনায় একসঙ্গে পরবর্তী সময় সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলন, ভাষা-সংস্কৃতির আন্দোলনে ক্রমশ আমি হয়ে উঠি তাঁর অনুজপ্রতিম। তিনি আমার অগ্রজ। তাঁর অসংখ্য বক্তৃতা শুনেছি আমি। কাব্য, দর্শন, সাহিত্য, অর্থনীতি, শিল্পকলা, ভাষা, তথ্য ও সংস্কৃতি, রাজনীতি, মার্কসবাদ; যা শুনেছি তাতেই মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর বক্তৃতায় যেমন পেয়েছি পুরনো পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও তার ইতিহাস, সমাজ প্রগতি, বিশ্বসাহিত্য শিল্পকলা! অসম্ভব স্মৃতিশক্তি; তাঁর ভাষণে যেমন প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্য-সম্ভারের উদ্ধৃতি, তেমনি আধুনিক সাহিত্যের উদাহরণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের রূপ এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক দর্শন মার্কসবাদের ব্যাখ্যা। তাৎক্ষণিক বক্তৃতাগুলোও তাঁর একদিকে যেমন শ্রম্নতিমধুর, অপরদিকে ভাবনার জগতে অগুনতি দরজা খুলে দেয়। মনের খোরাক জন্মায়। এ-বিষয়ে দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। সময়টা বোধহয় ১৯৭৬ সাল, সারা ভারত ক্ষেতমজুর সম্মেলন হচ্ছে, অশোকনগরে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খ্যাতনামা শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। মাঠে নিদেনপক্ষে হাজারদশেক মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেন। সেদিনের অনুষ্ঠান হবে রুমা গুহঠাকুরতার পরিচালনায় ‘ড্যানসেস অব ইন্ডিয়া’। দিনটি ছিল নজরুল ইসলামের জন্মদিন। স্থানীয় দুজন শিল্পীর নজরুলসংগীতের পর তরুণদা নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলবেন আধঘণ্টা। এরপর অন্য অনুষ্ঠান। যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু হলো। তরুণদা ভাষণ শুরু করেছেন। কিন্তু রুমা গুহঠাকুরতা তখনো এসে পৌঁছেননি। ইতোমধ্যে খবর এলো ওদের পৌঁছতে ঘণ্টাদেড়েক দেরি হবে। কারণ গাড়িবিভ্রাট, আমাদের হতভম্ব অবস্থা। তরুণদাকে সিস্নপ দেওয়া হলো। তরুণদা পাক্কা দুই ঘণ্টা দশ মিনিট বললেন নজরুল সম্বন্ধে। অগণিত শ্রোতা। একজনও নড়েননি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। তেমনি ঘটনা ঘটেছিল খড়গপুরে। খড়গপুর বইমেলায় কবি সম্মেলন। কবিরা সবাই গিয়ে পৌঁছেননি। কবি-সম্মেলনের আগে ‘কবিতা ও বিশ্বায়ন’ নিয়ে বক্তৃতার কথা বলা হলো। তরুণদা বললেন, দেড় ঘণ্টা। এ-এক অবিস্মরণীয় বক্তৃতা কাব্যের ওপরে। এই তো কয়েক বছর আগে বারাসতে শিল্পের সংজ্ঞা এবং ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে তিনি বহু মানুষের সামনে বক্তব্য রাখলেন ঘণ্টাদুয়েক।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের মেঘনাদ সাহা ভবনে কলেজ অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের ‘রিফ্রেসার কোর্সে’ ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ে মোট দু-ঘণ্টা ঊনপঞ্চাশ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। এই ভাষণে তিনি সারাবিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব, বিভিন্ন দেশের জাতিসত্তা, তাদের ধর্ম ও সাহিত্য-শিল্পের সম্পর্কে এক অনবদ্য বক্তব্য তুলে ধরলেন। এ-বিষয়ে আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও বলি। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমাদের অঞ্চলে আমার স্ত্রীর স্মরণে একটি বড় স্মরণসভা হয়। তরুণদাও এসেছেন। আমার অবস্থা দেখে আমার বন্ধু ও আত্মীয়রা তরুণদাকে অনুরোধ করেন ভারতীয় দর্শনে জীবন ও মৃত্যু বিষয়ে বলার জন্য। তিনি একটি অনবদ্য ভাষণ দেন। এটি পরে পুসিত্মকাকারে আমার মা প্রকাশ করেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁর এই বক্তৃতা আমাদের শোক ও বিহবলতা কাটাতে সাহায্য করেছিল। তরুণ সান্যালের ভাষণ সেদিন গানের মতো হয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। বক্তৃতা ও কবিতা সেদিন এক হয়েছিল।

 

সংবেদনশীল মন ও কবিতার চোখ

কন্যাকুমারীতে জলের মধ্যে গিয়ে পাহাড়ে উঠে অবাক হয়ে অস্তগামী সূর্য দেখা। অবাক হয়ে দেখার অভ্যাস তো তাঁর বারবার। সেই কোন শৈশবে মাত্র নয়-দশ বছর বয়সে পাবনা জেলার পরজনা গ্রামে গরুর গাড়ির চাকার শব্দ নিবিষ্ট মনে শুনতে শুনতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর ছোড়দা আর তাঁর বন্ধু শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে পেয়ে সন্ধ্যাবেলায় ধরে নিয়ে আসেন, আসার পথে বিপুল জ্যোৎস্নায় করতোয়ার ঝিলমিল করা জল আর নতুন সরষে ক্ষেতের ধারে ঝুপসি অন্ধকার ঘরের চাষিদের বাড়িতে মিটিমিটি টেমি জ্বলার ছবি কিশোর চোখ অবাক হয়ে দেখেছে। পরিণত বয়সে তরুণ সান্যাল এই স্মৃতির কথা লিখেছেন।

পরিণত বয়সেও তাদের একরকম কা- আছে। তরুণদা এবং তাঁর বন্ধু দীপেনদা (দীনেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) ভোররাতে উঠে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির বাড়ির সামনে বসে দিনের পর দিন তাঁর রেওয়াজ শুনতেন। উস্তাদের বাড়ির লোকেরা একবার তাঁদের ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। খাঁ সাহেব তাঁদের ডেকে শরবত খাওয়ান। তারপর বলেন, তাঁর যে-কোনো অনুষ্ঠানেই তারা অনায়াসে যেতে পারবে। আর যদি গান শিখতে চায় তাহলে তাঁর কাছে নাড়া বাঁধুক। এমনই এক কা- হয়েছিল সারারাত উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে গিয়ে। ভারতি সিনেমা হলে অনুষ্ঠান। তরুণদা, দীপেনদা আর তাঁর বন্ধুরা ভারতি সিনেমার উলটোদিকে গীতবিতানের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ভালো করে শোনা যাচ্ছে না। ভোর হওয়ার পর দেখলেন, কীভাবে উঠেছেন জানেন না। কিন্তু এখন নামবেন কী করে। গীতবিতানের লোকেরা এসে মই জোগাড় করে তাঁদের রক্ষা করেন।

তরুণ সান্যালের সংবেদনশীল মনের কথা তাঁর পরিচিতজনরা জানেন। কেউ তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য দাঁড়ালে তিনি তা করার চেষ্টা করেন। মানুষের অসুবিধাগুলোও বোঝার চেষ্টা করেন হৃদয় দিয়ে। পরিচিত কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য উৎকণ্ঠিত হন। কৈশোরে পাবনার গ্রামে দাদারা এক ভেড়া কিনে এনেছিলেন। সেটিকে কিশোর তরুণ ঘাস খাওয়াতেন। তারপর খালের ওই পারে জঙ্গলে তাকে কাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিশোর তরুণ পাগলের মতো সেখানে ছুটে যান। তখন ভেড়া বলি দেওয়ার জন্য খড়গ উঠছে। কিন্তু সে গিয়ে ভেড়া জড়িয়ে লাফিয়ে পড়ে। ভেড়াও বাঁচে। তরুণদাও বাঁচেন। তরুণদার মা আর ওই ভেড়াকে মারতে দেননি। এখনো তরুণদার বাড়িতে যেমন কুকুর থাকে যার গলায় বকলেস নেই, তেমনই রাস্তার কুকুর-বিড়ালও তাঁর আদরের। এই অবাক হয়ে দেখা সংবেদনশীল মন আর ভালোবাসা। এ-নিয়েই তো একজন মানুষ ভালোবাসার মানুষ হয়ে দাঁড়ায়।

অশ্বিনীকুমার সান্যাল ও হিরণ্ময়ী দেবীর ছোট ছেলে ছিলেন তরুণ সান্যাল। তাঁর বাবাকে বর্ধমান রাজের দেওয়ানি ও নানা কর্মসূত্রে বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর কৈশোর কেটেছে পাবনা-রাজশাহী, বর্ধমান ও বাঁকুড়ায়। গাছপালা, লতাপাতা, পশুপাখি, মানুষজন দেখতে দেখতে তাঁর কৈশোর কেটেছে চমৎকারভাবে। তরুণ বয়সের ছাত্রজীবন কাটল গয়েশপুর, বর্ধমান, কলকাতায়। গাছপালা-প্রকৃতি দেখার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে চলা শুরু হলো তাঁর। বাঁকুড়াতেই মাত্র দশ বছর বয়সে প্রথম মিছিলে হাঁটা শুরু করেছিলেন। আদিবাসীদের সঙ্গে, ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’র মিছিলে প্রথম হেঁটে যাওয়া জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর রোমাঞ্চকর স্মৃতি।

ছাত্রজীবনে ঈশ্বরসেত্মাত্র, স্তব, গীতা, চ-ী, উপনিষদ, সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভার যেমন তাঁকে আকর্ষণ করেছে, এরই সঙ্গে রবীন্দ্রকাব্য ও যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন, জসীমউদ্দীন তাঁকে আকৃষ্ট করে। ক্রমশ বিশ্বসাহিত্যের দরজাও তাঁর কাছে খুলে যায়, হোমার, গোর্কি, শেক্সপিয়র, তলস্তয়, নেরুদা, আরাগঁ, লোরকা, মায়াকভস্কি প্রমুখের সাহিত্যসম্ভার তাঁর কাছে বিশ্বজনকে তুলে ধরে।

তরুণ সান্যাল নিজেই এ-বিষয়ে লিখেছেন, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম পাঁচ-ছ বছর বয়স থেকে বছর এগারো-বারো পর্যন্ত মানুষ ভেতরে-বাইরে অভিজ্ঞতায় যা পায়, যে বাস্তব বিশ্বমানের গভীরে ঢুকে পড়ে, সেসব জনজাতির নির্জ্ঞানের সঙ্গে জাগরণের মধ্যেও নিদ্রা হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সারাজীবন ধরে সেই চিত্র-চিত্রকল্প হয়ে শিল্পে রূপ নিতে থাকে। এমন দেখা যায় যাত্রা-নাটক-বিবাহ-জন্ম-মৃত্যু কিংবা শোনাজানা ধরনের গান, স্তবস্ত্ততি সব সব। এই বয়সে মায়ের কাছেই তো সবাই শেখে। মা বলতে জননী মাও যেমন তেমন নৈসর্গিক প্রকৃতিও। এমনই স্থানীয় ভূগোল, ইতিহাস, গাছপালা, পশুপাখি, সাপ, কুমির, গো-সাপ, বনবেড়াল, পাখির ওড়াউড়ি, গ্রামের নদী থেকে জল ঢুকে পড়া, নদীর বাইচ, শুনতে পাওয়া হাটের গুঞ্জন, রাতে হুতোম পাখির ডাক – সব কিছুই। মানে জীবনকে যারা সদর্থক ও নঞর্থক, সব কিছু শিক্ষা দেয়।’ তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আগে শিক্ষাগুরু হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা মা-মাটি-প্রকৃতি আর মানবতার জন্য। তরুণদা সেভাবেই এগিয়েছেন। তবে তরুণ সান্যাল একজন উদার, সংবেদনশীল, রোমান্টিক মানুষ এই কি শুধু তাঁর পরিচয়?

 

মার্কসবাদে আস্থা ও হৃদয়বোধ

১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হলো। ১৯৪৩-এ বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হলো আর কমিউনিস্টদের সান্নিধ্যে পেতে শুরু করলেন তিনি, ক্রমশ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। ১৯৪৯-এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করলেন। এ-বছরেই ম্যাট্রিক পাশ করলেন। বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হলেন। ছাত্র ফেডারেশনেরও নেতা তিনি। এ-বছরেই কারাগারে আটক হলেন।

১৯৫০ সালে জেলে অনশন করলেন। জেলে বন্দি থাকায় এক বছর পড়াশোনা বন্ধ। ১৯৫২-তে আইএসসি পাশ। ১৯৫৪ সালে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করলেন। ১৯৫৬-তে অর্থনীতি নিয়ে এমএ পাশ করলেন। এই সময়কালেও কবিতার পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির কাজকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে করা শুরু করলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়, সক্রিয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আন্দোলনে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, শ্রেণি-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন সবকিছুর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের জন্য তাঁর গর্বও ছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা তো কেউ আমার প্রজন্মের অনেকের মতো অনশন, ধর্মঘট, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, জেলখানা এসব দেখিনি, বা দুঃখী পরাধীন স্বদেশের বিভাজনের কালে কৈশোর কাটায়নি। তবু আমার সময় ছিল ভারত ইতিহাসের এবং বিশ্ব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ সময়। আমি ভাগ্যদেবীর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে ওই সময়ে চমৎকার দুঃখী কৈশোরের বিষাদময় বিশ্ব পরতে পরতে খুলে ধরেছিলেন। এত হিংস্র পৃথিবী আগে কি ছিল কখনো? বেলসিন, অসোইৎসে, বুখেন ভাল্ড কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চিহ্নিত ইউরোপ, কাতিন ও গুলাপ গোরস্তান এবং হিরোশিমায় নরবলির মতো? বিজয় কেতন উড়িয়ে রাইখস্ট্যাগে লালফৌজ, ইংয়াসি পার হওয়া গণবাহিনী, ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধ, চে গুয়েভারার আন্তর্জাতিকতা এমন কি আমাদের গান্ধিজি – এসব নিয়ে যে মহিমা, আমাদের সামনে পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা দেখেনি।’

১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভাজন হয়। তিনি সিপিআই দলেই থাকেন। নতুন করে গণসংগ্রামের উদ্যোগ নেন। গ্রামে কৃষকদের মধ্যে কাজে নামেন, পরবর্তী সময়ে তাঁর কর্মকা- সীমিত হয় শহরাঞ্চলে। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়ালেন। মুক্তিযুদ্ধের অনুগামী লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করায় এবং সাহায্য করায় তাঁর যে-উদ্যোগ, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে। ওই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনীকেও সাহায্যে তাঁর উদ্যোগের কথা ওয়াকিবহাল মানুষমাত্রই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ১৯৮১ সালে সিপিআই দলের ভেতরে আবার বিতর্ক শুরু হলো। এসএ ডাঙ্গে ওই পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন। তরুণ সান্যাল এটি সমর্থন করতে পারলেন না। তিনিও ওই দল থেকে অপসারিত হলেন। রাজ্য বামফ্রন্ট শাসিত। শাসকদলের কাছে তিনি অচ্ছুত। সরকারও তাঁকে একপ্রকার অচ্ছুত করল, অথচ লক্ষণীয় বিষয় হলো, যারা দর্শনগতভাবেই মার্কসবাদবিরোধী, সুযোগ বুঝে তারাও হঠাৎ বামপন্থী হয়ে গেল। কিন্তু তরুণ সান্যাল নিজেকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করলেন। তিনি কবি এক জাগে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকার বদলে তো লিখেছেন, ‘১৯৪২-৪৩ সালে কমিউনিস্টদের কাছাকাছি আসি। তখন আমার বয়স নয়-দশ। তাঁরা ছিলেন স্বপ্নদর্শী, সর্বত্যাগী। মঠবাসী সন্ন্যাসীর মতো কমিউনে বাস করতেন। দিনান্তে ডাঁটা-চ্চচড়ি, মোটাভাত, যেদিন যেমন জুটত। প্রথম যৌবনে তাঁদের সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি। জেল খেটেছি। অনশন করেছি। লাঠি-গুলির মুখোমুখি হয়েছি। তখন ছিল চোখের মণির মতো, ধ্রম্নবতারার মতো। সোভিয়েত ইউনিয়নও। বয়স বাড়ল, অভিজ্ঞতা বাড়ল, দেখলাম ওই আন্দোলনের মধ্যেও চাকার মধ্যে চাকা আছে। দেখলাম বোনোজল এসে স্বচ্ছ জলেও কাদা মাখিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশেও একাধিকবার গিয়েছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সময়ের দ্রম্নত ধাবমান নদী যে ভদ্রাসনের তলা ছোবল বসাচ্ছিল, ধরতে পারিনি সে-সব। হঠাৎই এক সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সে ব্যবস্থা। মঠ, বাড়িঘর, সৈন্যবাহিনী, মিথাইল, অর্ডার অব লেনিনের তকমা। লেনিনের স্মৃতিসৌধ পাহারাদারদের গুজস্টেপ পদক্ষেপ, সব কিছু নিয়ে নিদারুণ কীর্তিনাশা স্রোত। তারপর দুনিয়াজুড়ে বাজারের অবাধ প্রতিযোগিতার নামে একচেটিয়া রমরমা। আমাদের দেশ ও রাজ্যেও মাথা ফেরানো শুরু হয়ে গেল।’

তবু আছি। থাকব। স্পেনের শহিদ তরুণ কবি কর্নফোর্ড বলেছিলেন।

‘কমিউনিজম ছিল আমাদের জাগরণের স্বপ্ন।’ আমাদের, আমার প্রজন্মেরও। যে-যেখান থেকেই লিখুন না কেন, আমাদের ভাবনা সময়কে ভাবিয়েছে। সময় ভাবনাকেও। আছি। ছেড়ে যাইনি। যাবও না। দলীয় নই। তবু আছি। ‘খড়ের কার্তিকের একমেটে দোমেটে’ শীর্ষক তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখায় সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন, ‘মনে মনে কেন বাস্তবেই বহু দেশ, বহু গ্রাম জনপদ এমনকি বিদেশেও গেলাম। যা চেয়েছিলাম মনে মনে, ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরিত সমাজ। সেটি গড়তেই পারলাম না। এ এক বিষাদ সন্ন্যাস। আর সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে, তার কোনো পরিমাপ নেই বাহিরের দেশকালে। অন্তর মিশালে তবে তাঁর অন্তরের পরিচয়। সেই অন্তরময়ের সাধনাই তো কমিউনিষ্ট সাধনা। ভালবাসার ঈশ্বরের মত করেই কমিউনিজমও পেতে হয়। সব কমিউনিষ্ট কি কমিউনিজম পায়?’

তরুণ সান্যালের এই চিন্তাগুলোকে বিশেস্নষণ করে তাঁকে একজন সৎ আদর্শবাদী মানবমুখী সমাজবাদে বিশ্বাসী সংবেদনশীল কমিউনিস্ট হয়তো বলা যায়। কিন্তু শুধু এটুকু বলাই কি যথেষ্ট?

 

সংবেদনশীল মন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য

কবি তরুণ সান্যাল তাঁর সংবেদনশীল ও মানবিক মন নিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সে-সময়ে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা লেখক, শিল্পী, শিক্ষাবিদদের ত্রাণের জন্য উদ্যোগ নেন। ওই সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভাপতি করে যে-সহায়ক ত্রাণ কমিটি তৈরি হয়েছিল তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তরুণ সান্যাল ও দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণদা তখন ওগেলভি হোস্টেলের সুপার এবং স্কটিশচার্চ কলেজের অধ্যাপক। বাংলাদেশের বহু ছাত্রকে তিনি হোস্টেলে আশ্রয় দেন। এ-কাজের জন্য একসময় তিনি তাঁর স্ত্রীর গয়নাও বন্ধক দিয়েছেন। তাঁর নিজের বাড়িতে থাকতেন সাহিত্যিক শওকত ওসমান। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জোগানের কাজেও তিনি উদ্যোগী ছিলেন। আবার বাংলাদেশের শিল্পীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করাতেও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর সবসময় একটি সংবেদনশীল মন ছিল। এই মন নিয়ে তিনি সবাইকে সাহায্য করেছেন। অতিসম্প্রতি পশ্চিমবাংলার সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়ের কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী থেকে অপর্ণা সেন – সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সংহতি আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। বারবার সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় কৃষকদের পাশে তিনি ছুটে গিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মী বুদ্ধিজীবী মঞ্চ। ওই সময় তার বিখ্যাত কবিতা ‘তাপসি মালিকের জন্য একটি ব্যালাড’।

বাজারে ডঙ্কা কে কবে শঙ্কা মিছিল কম্ভু শাঁখে

কোটি কোটি হাত বিশ্বের সাথ নতুন জমানা ডাকে

বুলেটে লাথিতে কে জিতিবে কবে

জানি মানুষেরই জয় হতে হবে,

দ্যাখো ইতিহাস হতেছে প্রকাশ সিঙ্গুরে পথের বাঁকে

 

কবিতার জন্ম ও কাব্যগ্রন্থ

প্রকৃতি ও মানুষ তরুণ সান্যালের মনে কবিতার গুঞ্জন ওঠায়। ১৯৪৪ সালে বারো বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম কবিতা লেখেন। ছাপার অক্ষরে কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। এরপর তিনি এ-বিষয়ে আর পেছনে তাকাননি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মাটির বেহালা প্রকাশিত হয় যখন, সে-বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই সুধীজনের মধ্যে আলোড়ন তোলে। ১৯৫১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশটি। এছাড়া কাব্যনাট্য বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি, যাতে একুশটি কাব্যনাট্য রয়েছে।

বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গ জীবনের মেলবন্ধনের সেতু শব্দ আর ছন্দ। সেই শব্দ আর ছন্দের মিলন কবিতায় কেমন ঘটে? এক-একজন কবি তাকে একেকভাবে প্রয়োগ করেন। বর্তমান সময়ে বাংলা কাব্যে প্রবাদপ্রতিম কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ৬৫তম জন্মদিবস উপলক্ষে আমরা তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। সেই সভার সভাপতি বাংলার প্রথিতযশা ও প্রণম্য সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘সুভাষ পদ্য এবং গদ্য যাই লেখে তাতেই তাঁর নিজস্ব ছন্দ থাকে। তাঁর লেখা ছন্দকে অনুসরণ করে না, কার্যত ছন্দই তাঁর লেখাকে অনুসরণ করে।’ আর সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমরা সুরকাররা কবিতার ছন্দকে সুরে এগিয়ে নিই। অর্থাৎ গানের সুর কবিতার ছন্দের ওপর প্রভাব ফেলে। সুভাষদার কবিতা ছন্দের ওপর প্রভাব ফেলে। সুভাষদার কবিতার ছন্দ আসলে সুরের মাতববরিকে স্বীকার করে না। তাঁর কবিতার ছন্দ সুরের ওপর প্রভাব ফেলে।’

প্রত্যেক কবির কবিতায় তাঁদের স্বকীয়তা যেমন থাকে, ছন্দকে ব্যবহারও করেন তাঁরা তাঁদের মতো। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, রাম বসু, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত থেকে বর্তমান প্রজন্মের কবিরা পর্যন্ত। তরুণ সান্যালের কবিতায় ছন্দের ব্যবহার হয়েছে। তাঁর ওপর কোন কবির প্রভাবই বা বেশি? এ-নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাও হয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুস্নাত দাশ-সম্পাদিত প্রসঙ্গ একালের বাংলা কবিতা শীর্ষক গ্রন্থে গত ষাট বছরে চোদ্দোজন প্রখ্যাত বাঙালি কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে তরুণ সান্যালের কাব্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ড. শুভঙ্কর ঘোষ বলেছেন, ‘তরুণ সান্যালের সম্পদ হল ছন্দোবোধ, ছন্দো ব্যবহারের ব্যাপক সাফল্য। মাটির বেহালার এবং পরবর্তীকালে কলার ও ছন্দের প্রতি আকর্ষণ বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে। বিষ্ণু দে এ পথের অগ্রদূত। কিন্তু মিশ্রবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে একটি প্রবহমান দৃশ্যকে যে নিখুঁত ধরা যায় একথা তিনি মানেন। বর্ণপরিচয় তার চমৎকার দৃষ্টান্ত, পরবর্তীকালে হালকাচালে পদ্যছন্দে স্বরবৃত্তে বা মাত্রাবৃত্তে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। যেমন ‘কায়া নৌকায়’। ‘যেমন উদ্ভিদ’ কাব্যে এই কবি গদ্যভঙ্গিতে মিশ্রবৃত্তের বা অক্ষরবৃত্তের পরীক্ষায় মনোযোগী হয়েছেন। এখানে ছন্দের বিন্যাস ভাবা যায় না। ভাব অনুযায়ী ছন্দ রচিত হয়। তিনি জানেন ছন্দ, কাব্যশব্দ, চিত্রকল্প, শব্দের স্ফীত আইডিয়া বা শব্দের মধ্যে বুদ্ধির নৃত্যভঙ্গিমা যাই হোক না কেন এসব তো কবিতার প্রতিসারি গড়ে তোলার উপকরণ মাত্র।’

আর কবিতা নিয়ে তরুণদা কী ভাবেন? তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘নিজের দার্শনিক অবস্থান থেকে সরে না গিয়ে আমি যেমনটি সাহিত্য শিল্প বুঝেছি তেমনি লিখেছি। দায়বদ্ধতা দায়বদ্ধতা করে হাঁকডাক করিনি। কবিতা কখনই দর্শন নয়। কবিতা কঠিন দর্শনকে তরল বা শিশুপাচ্য করে পরিবেশন বা শিশুশিক্ষার বিষয় নয়। কবির মধ্যে থাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বপ্রপঞ্চ। সে দর্শন দিয়ে বুঝতেও চায় হয়তো কিন্তু কবিতা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস খাদ্য গ্রহণের মতো দর্শন নিরপেক্ষ, কেননা আমি তো বিশ্বাস করি কবিতা আবেগগত অভিজ্ঞতাগুলির সংগঠন।’ (‘মানুষের মুখ ও নানা কথা’)

তরুণদার অনেক কবিতাতেই থাকে মিথ বা পুরাণের চিত্রকল্প। এ-বিষয়ে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো পুরাণ প্রতীক বালক বয়সেই তাঁকে নাড়া দিত। ক্রমশ তিনি বোঝেন ভারতীয় মানসের বাঙালির শিকড় এত পুরনো যুগ পর্যন্ত শক্ত মাটিতে প্রোথিত যে এই পুরনো প্রতিমার সূত্র ধরে বর্তমানকে চিনতে শিখি। তাঁর মতে, কবির কাজ শব্দকে বাহন করে শব্দকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শুধু তো যাওয়া নয়, অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে আরেক জগৎ নির্মাণ করা।

৩৬ বছর বয়সে ভাতারে মাটির বেহালার কবিকে টুলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে দেখেছি। যতদিন সুস্থ ছিলেন তিনি বক্তৃতা করেছেন। অনেক সময় মনে হয়েছে তাঁর বক্তৃতাও যেন কবিতা। শরীর ভগ্ন। কিন্তু এ নিয়েই তিনি হেঁটে গেলেন শহরে, গ্রামে, মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুবাদে দীর্ঘ ৪০ বছর অধ্যাপনা করেছেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু শৈশব থেকে পৃথিবীর পাঠশালায় যে-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর প্রজ্ঞা নিয়ে সেই পাঠশালাতেই ছুটে গেছেন। এরই মাঝে কখনো নিমগ্ন ভেবেছেন, আবিষ্ট হয়ে ভাবেন, তাঁর কাব্যনাট্যে আধুনিককালে সঙ্গে মিশে যায় গ্রিক মিথ আর মহাভারত। তরুণদার মতে, কবির কাজ হলো, ‘শব্দকে বাহন করে শব্দকে ছাড়িয়ে যাওয়া। শুধু যাওয়া নয়, অভিজ্ঞতার জগতের ঊর্ধ্বে আর এক জগৎ নির্মাণ করা। কবিতা নিজেই এর রূপক অলংকার, এক মেটাফর। কবিতার মধ্যেই অস্পষ্ট অবয়ব দেখে আরেক মেটাফরের।’

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ বাংলা কাব্যে যে-ঘরানা সৃষ্টি করেছেন, তরুণ সান্যাল সেই ঘরানারই কবি। তাঁর নিজস্ব ঢঙে।

তরুণদার হৃদয়ে কবিতা। তাই পঁচাশি বছর বয়সেও তিনি বলেন, ‘বুকের বাঁদিকে তুমি এ-বয়েসে রয়েছো কবিতা।’

আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক স্মরণসভায় তরুণদা তাঁর ভাষণে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’র কথা উল্লেখ করেছিলেন। শূদ্রাণী মাতা ইতরার গর্ভে জন্মে ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান ঐতরেয়েকে তাঁর পিতা বেদ পড়াতে রাজি হননি। কারণ তাঁর জন্ম শূদ্রের গর্ভে। ইতরা মা তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাধবীর কাছে চল্। সংস্কৃতে মাধবী অর্থাৎ পৃথিবী। ঐতরেয় পৃথিবী দেখেছিলেন নদী, সমুদ্র, পাহাড়, মানুষ, জনপদ প্রভৃতি। সত্যকে জেনেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত লিখেছিলেন, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, যা না পড়লে বেদ পড়া সম্পন্ন হয় না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে রাজপুত্র রোহিতের গল্প আছে। জীবন কাকে বলে, মৃত্যু কাকে বলে এই জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি সারা পৃথিবী ঘুরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জীবন-মৃত্যুর দেবতা তাঁকে বলেন, জীবনের আরেকটি অংশই তো মৃত্যু। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন কলিকাল, যখন চোখ মেলে তখন দ্বাপর যুগ, আর যখন চলতে থাকে, হাঁটছে হাঁটছেই তখনই হলো সত্য যুগ, অতএব জীবনকে জানতে মাধবীর কাছে চল। জীবন-মৃত্যুর রহস্য সে জানতে পারে যার দুটো পা কখনো ঘুমোয় না। আমার যেন মনে হয়েছে, রাজপুত্র রোহিতের মতো অথবা ঐতরেয়ের মতোই তরুণদা মাধবীর কাছে গিয়েছেন। অনেকদিন আগে বর্ধমানের এক গ্রামে, চায়ের দোকানে এক বৃদ্ধ কৃষকের সঙ্গে তরুণদার অনেকক্ষণ গল্প হয়েছিল। ওই বৃদ্ধ কৃষক তরুণদাকে তাঁর ভাষায় যা বলেছিল, তা সংক্ষিপ্ত কথা হলো, মানুষ সবসময় বদলায় তার অভিজ্ঞতায়। মানুষের ধন আছে দুরকম। খাল ধন আর অ-খাল ধন। যে ধন খেয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় তা হলো খাল ধন। আর অ-খাল ধন হলো অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, শিক্ষা। মানুষের সন্তান হয় নানা প্রকারের। দেহ থেকে হয়, বাহু থেকে হয়, জ্ঞান থেকে হয়, জীবনের নানা অংশ থেকে হয়।
কৃষকটি বলেছিল, আমার দেহ আছে, সেটি মারা যাবে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা? যা টিকে থাকবে আমার সন্তান, প্রতিবেশী বন্ধু এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে। তাই অভিজ্ঞতার তো মরণ নেই। তার মধ্যেই আবার মানুষের জীবন বেঁচে থাকে।

তরুণদার শরীর যখন অনেকটা ভেঙে গিয়েছে। অনেক সময় লাঠি হাতে করেই তাঁকে হাঁটতে হয়েছে। সেই সময় বুকের বাঁদিকে কবিতাকে নিয়ে তিনি হেঁটেছেন। রাজপুত্র রোহিতের মতো মাধবীর কাছে যান। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। পথ চলাতেই ছিল তাঁর আনন্দ। চলাটাই অর্জন। প্রগতি দর্শনে তাঁর আস্থা। মানুষ এবং সৃজনশক্তি, প্রকৃতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ। তিনি হাঁক দিয়ে বলেন, ‘যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি যাই/ রোদ শুয়ে যায় পশ্চিমে ঐ লাল/ এ চৌমাথায় আসছে হয়তো কেউ/ আমি দাঁড়িয়ে থাকব না হে কাল।’

তিনি দৃঢ় প্রত্যয়েই বলেন –

‘আমি ফের জন্ম নেবো এই ভেবে/ আবার আগুনে যাবো আবার বন্যায় যাবো/ আবার আরেকবার/ তরুণীর চোখ কালো বিদ্যুৎ চমকাবো।’

তরুণদার প্রথম সাড়াজাগানো বই মাটির বেহালা। জীবনের শেষদিকে তাঁর সাড়া জাগানো বই কবি এক জাগে। শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেও মাটির বেহালা নিয়ে মাধবীর কাছে জেগে আছেন কবি তরুণ সান্যাল।