ছোট গল্প

উনিশশো একাত্তরের ২৪শে মার্চ বেলা এগারোটার দিকে, এক ঘণ্টা পর মাথার ওপরে আসবে চৈত্রের সূর্য, মানুষের চলাফেরায় আতঙ্ক এবং স্বাধীন দেশ পাওয়ার স্বপ্ন, ফারহানা, পরনে ছিল তাঁতের শাড়ি, শান্তিনগর পোস্ট অফিসের বাক্সে এ-ফোর সাইজের কষি টানা কোড়া কাগজে, সাদা কাগজে লিখতে গেলে ওর লেখা লাইনের শেষে গিয়ে চলে যায় ওপরের দিকে, কখনো নিচে, নিজের লেখার…

উপজেলা পরিষদ থেকে সোনাখালি মাঠের প্রকৃত দূরত্ব সম্পর্কে জজসাহেবের আদৌ কোনো ধারণাই ছিল না। স্থানীয় মানুষজন বলে, দূর কোথায়! এই তো শহর থেকে বেরোলেই বসন্তপুর, তারপর সোজা উত্তরে যতদূর চোখ যায় সোনাখালি মাঠ। সেই বিরান মাঠের এক প্রান্তে খোদাবক্স সাঁইজির আখড়া। নিজের অফিসের পাইকপেয়াদা-সেরেস্তাদারও জানায় – না, সোনাখালি মাঠ এখান থেকে বিশেষ দূরে নয়। বড়জোর…

বিশ্বজিৎ ঘোষ কার চুড়ি? কে রেখে গেছে চুড়িটা? কেনই-বা রেখে গেল? ইচ্ছে করে রেখে গেল, নাকি নিতে ভুলে গেছে? ক্লান্ত শরীরে এসব ভাবতে ভাবতেই শুয়ে পড়লেন রহমান সাহেব। নরম বিছানা। রাত অনেক হলো, কিন্তু ঘুম আসছে না। ড্রয়ারে পাওয়া মনোরম সোনার চুড়িটা তাঁকে পেয়ে বসেছে। বাগানবাড়িটার চারদিক নিস্তব্ধতা আর নীরবতায় মগ্ন হয়ে আছে। কোথাও কোনো…

কুয়াশাঢাকা শীতের ভোরে হাঁটছেন তিনি। গায়ে-মোড়ানো চাদরটা বারবার পড়ে যাচ্ছিল শরীর থেকে। ডান হাতে লাঠি থাকার কারণে বাঁ-হাত দিয়ে চাদর ঠিক করার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। দাঁড়িয়ে পড়লেন লেকের ওপর দিয়ে চলাচলের ব্রিজের হাতল ধরে। এবার চাদরটা ঠিক করতে পারলেন। লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে আবার হাঁটতে গিয়েও থেমে তাকিয়ে রইলেন লেকের পানির দিকে। স্থির…

বৈশাখ মাসে লাফ দিয়ে খালটা পার হওয়া যায়, হাঁটুপানি। আসলে এটা কথার কথা, ভাটায় বুকপানি হলেও জোয়ারে একটু বেশিই, ঠাঁইহীন। রাখালগুলি যেমন বিল থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় মাথায় লুঙ্গি পেঁচিয়ে গরু নিয়ে সাঁতার দিতে পারে উলঙ্গ মেটে পাছা ডুবিয়ে ভাসিয়ে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে, তেমন ভেবেছিল সে, জীবনটা এইভাবেই ঠিক পেরিয়ে যাবে ভাবনা…

খায়রুন নেসার স্বামী ব্যবসায়ী। টাকা-পয়সার তেমন অভাব নেই। বেশ চমৎকার শাড়ি, গয়না কিনে ভালোই সময় কাটে তার। ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল-কলেজে পড়ে দুজনেই বিদেশে। খায়রুন নেসার আবার এক ভূতে পাওয়ার অভ্যাস আছে। সময় পেলেই লেখেন। খায়রুন নেসার নামের মতো লেখাগুলি অবশ্য অনাধুনিক নয়। বেশ চনমনে আধুনিক গল্প। মাঝে মাঝে নিবিড় কবিতা। বেশ সুখী মনে হয় যখন…

অন্ধ্রের শ্রীধর ইধাপালাপ্পাকে দেখে ভাবনাটা এসেছিল। একখানা রঙিন পোস্টকার্ডের একদিকে তেলেগু ভাষায় লেখা ওর মায়ের চিঠি এবং অন্যদিকে বিশ^কর্মার মূর্তির ছবি। আমার জানা ছিল না পরদিনই বিশ^কর্মার পুজো, পূর্বদিন দেখেছিলাম মাঝারি সাইজের একটা ম্যারো কিনে এনেছিল সিটি সেন্টার থেকে। যাকে ঠিক চালকুমড়ো বলে তা এখানে এই ক্যামব্রিজে মেলা ভার। লন্ডনে গেলে বাংলাদেশি দোকানগুলিতে প্রচুরই মেলে…

আজকের দুপুরটা একটু অন্যরকম লাগছে। যেন ঝিরিঝিরি হাওয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষও দুলছে। সাড়াশব্দহীন, একটুবা প্রগাঢ় রহস্যময়। জলাশয়ের বুকে ছোট ছোট ঢেউয়ের যেমন  কোনো শব্দ থাকে না, ঠিক এমনই একটা ক্ষীণ গতির কাছে বেমালুম বোকা বনে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছি। কী নেই, কিই-বা আছে … আমার কি চোখ টপকাচ্ছে? নাকি প্রকৃতির! নিজেকে নিজের ভেতর খুঁজে পাওয়ার অনিঃশেষ…

যত দূর চোখ যায়, তত দূর শুধু পানি আর পানি। দিগন্তে আকাশ আর পানির মিতালি, বিশাল জলরাশির আপন খেয়ালে ঢেউ ভাঙে ঢেউ হয়। আকাশে গাঢ় নীল, রোদের ঝিলিক ঢেউয়ের ঠোঁটে – চিকচিক করে ওঠে কখনো কখনো। কখনো বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে জলডাঙ্গা নদীর তীরে। এই রহস্যময় ঢেউগুলি নদীর তীরে আছড়ে পড়ে নাকি মহবত আলির বুকের…

চাঁদটাকে মাঠের ঠিক মাঝখানে এইভাবে গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে এতটাই ধাক্কা খায় যে তার তেমন অবাক হওয়ার কথাও আর মনে থাকে না। এতক্ষণ সে আকাশে চাঁদের অবস্থান দেখে দেখে দিক ঠিক করে পথ চলছিল। এই তো মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে সিগারেট ধরানোর জন্য চাঁদ আর রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটার দিকে…

মধ্যরাতে এরকম হয়, মধ্যরাতে জেগে ওঠে তনুজা, জেগে উঠে অন্ধকারের বিস্তারে নিজেকে হাতড়ে বেড়ায়। হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় আর মনে করতে পারে না, আসলে সে কী খুঁজে পেতে চাইছে, এই মধ্যরাতে সেটা খুঁজে পাওয়ার দরকারই বা কী! একরাশ ক্লান্তি নিয়ে তখন থমকে বসে সে। আর জানালার পর্দাটা দুলে উঠলে অবশেষে কেন যেন মনে হয়, তৃষ্ণা –…