ছোট গল্প

  • উপহার

    বুলবন ওসমান   মেলামাইনের কোয়ার্টার প্লেটটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছে ফজল। থাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে। বাড়িটা শহরের মাঝখানে, খুব একটা অভিজাত এলাকা বলা যায় না, আবার চারিদিকে যোগাযোগের ব্যবস্থাটা ভালো বলে অনেক অভিজাত এলাকার চেয়ে সে পছন্দ করে এই সেগুনবাগিচা। কখন এখানে সেগুনগাছ ছিল কে জানে! তবে নামটি রয়ে গেছে। রমনা পার্কের পাশে টেনিস কমপ্লেক্সে বেশকটা গাছ…

  • মাজাম ওস্তাগারের পোলা

    মাহবুব রেজা আমি মোজাম ওস্তাগারের পোলা। আমার দাদায় আছিল ঢাকা শহরের সেরা ওস্তাগার গো মইদ্যে এক লম্বর। হের নাম হুরমত। হুরমত ওস্তাগার। হের নাম হুনে নাই পুরান ঢাকায় এমন আদম খুঁইজা পাওন যাইব না। বেকতে অই হেরে চিনে-জানে। খুব নাম-ডাক আছিল হের। আমার দাদারা চাইর-পাঁচ পুরুষ ধইরা ওস্তাগারির কাম করে। আদি ঢাকার বহুত দালাল-বাড়ি হেগো…

  • পার্থিব-অপার্থিব

    ইমতিয়ার শামীম তখনো দিনের আলো ফোটেনি, তবু তার চোখে আলো ফুটে ছিল দিনের মতো। সারারাত ধরে অন্য সবার সঙ্গে জেগে আছে সে, জেগে জেগে কী যে দেখছে বুঝতে পারছে না। ক্ষুধায় শরীর ভেঙে আসছে, ঘুম ঘুম লাগছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখ দুটো এক আর হচ্ছে না কিছুতেই। কেউ কেউ অবশ্য দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে…

  • সাক্ষ্য

    আহমাদ মোস্তফা কামাল ওমন, কাঁদো কেন? ও চোখ, কেন এত ভিজে ওঠো? – নিজেই নিজের মন আর চোখকে জিজ্ঞেস করেন আজিজুল হক। আর না করেইবা উপায় কী, ওরা যে কাজই করতে দিচ্ছে না, কোনো শাসনও মানছে না। অথচ দ্রুত কাজটি করে ফেলতে হবে, এই কবর তৈরি করার কাজটি, মুর্দাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি দাফন করার তাগিদ দিয়ে…

  • বেলি কেড্সের স্মৃতি

    প্রশান্ত মৃধা পুব-পশ্চিমে টানা খানজাহান আলী রোড, মেইন রোডে মিশে যেখানে শেষ, সেই নাগেরবাজারের আগে বামে ঢুকে যাওয়া রাস্তাটার নাম কাজী নজরুল ইসলাম রোড। শহরের পুরনো বাসিন্দারা কেউ বলে, এই রাস্তার কাজিবাড়িতে একদিন এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি, তাই এই নামকরণ। কেউ বলে, ওসব কিছুই না, এমনিতেই কাজী নজরুল ইসলামের নামে নাম, ওই কাজিরা কাজী নজরুলের কিছু…

  • বেহুলার দ্বিতীয় বাসর

    জাকির তালুকদার চাঁদ সদাগরের সাতমহলা বাড়িতে আজ সাজ-সাজ রব। যমলোক থেকে বেহুলা ফিরে এসেছে প্রাণাধিক পতি লখিন্দরকে সঙ্গে নিয়ে। ইন্দ্রের সভায় যখন পা দিয়েছিল বেহুলা, তার কোলে ছিল লখিন্দরের কঙ্কাল। আজ লখিন্দর ফিরে পেয়েছে তার জীবন, তার কন্দর্পকান্তি। লোহার বাসরঘরে যাকে একবার চোখের দেখা দেখেই মনপ্রাণ যার পায়ে সঁপে দিয়েছিল বেহুলা সুন্দরী, সেই সোয়ামির সঙ্গে…

  • জনৈক স্তন্যপায়ী যিনি গল্প লেখেন

    শাহাদুজ্জামান স্তন্যপায়ীদের জন্য খেলা একটি জরুরি কর্মকান্ড। শরীরতত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন, বিবর্তনের ইতিহাসে খেলা স্তন্যপায়ীদের সারভাইভালের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। যাবতীয় স্তন্যপায়ীর জন্য শৈশবে খেলা বেঁচে থাকার, বেঁচে ওঠার একটা অপরিহার্য শর্ত। বাস্তবের নকল করে একটা কপট বাস্তব নিয়ে খেলা। বাঘ-শাবকরা একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কপট কামড় দেয়, যেন একে অন্যের শত্রু, যেন সে শত্রুর মোকাবেলা করছে। এ…

  • তাবিজনামা

    রাশেদ রহমান আমাদের বয়স কম, গ্রামে কতকিছু ঘটে; দিনেও ঘটে, রাতেও ঘটে; আমরা ওসব দেখেও দেখি না, কানেও তুলি না। ওসব দেখার বা শোনার সময় কই আমাদের! আমরা সাঁঝবেলা মা কিংবা দাদির বকুনি খেয়ে ঘরে না-ফেরা পর্যন্ত, সারাদিনমান ভীষণ ব্যস্ত থাকি। ডাংগুলি খেলা, বনে-বাদাড়ে রাজঘুঘুর বাসা খুঁজে বেড়ানো কিংবা দিগম্বর               হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া; সাঁতার…

  • শহর অথবা একটি গতানুগতিক গল্প

    নাসরীন জাহান দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে যাকে কোনোদিন মনে রাখার মতো একবিন্দু অসুস্থতা স্পর্শ করেনি, সে একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার স্ত্রী উঠোনটাকে ধোঁয়ার আখড়া বানিয়ে খড় দিয়ে ভাত জ্বাল দিচ্ছিল। চুলোর তিনটে ইটের একটা ঈষৎ নিচ হওয়াতে কাত হয়ে ছিল ডেকচি। সেটা সোজা করে বসানোর প্রচেষ্টা করতে করতেই চোখ গেল…

  • কবি

    আনিসুল হক কীরকম বৃষ্টি পড়ছে! চিলেকোঠার ঘরের জানালাটার ওপরে কোনো শেড নাই আর পাল্লার একটা কাচ ভাঙা। সেখানে সে লাগিয়ে রেখেছে একটা শক্ত কাগজের বোর্ড। কাগজটা ভিজে বাদামি হয়ে গেল। জানালা খোলাই ছিল। যা গরম পড়েছিল রাতে। এখন বৃষ্টির ছাঁট এসে তার বিছানায় পড়ছে। তার পায়ের কাছটায় লাগছে জলের ছিটে। পা জোড়া টেনে নিল। হাঁটু…

  • আর খিদে থাকার কথা না

    সুশান্ত মজুমদার হাড্ডি ঠাটে চামড়ার পাতলা খোসা প্যাঁচানো না থাকলে বুড়োকে কিছুতেই প্রাণী মনে হতো না। কোলবাঁকা এই কাঠোমোর চোয়াল চিমসে, মাতায় চুলের নামে আছে উস্কোখুস্কো আগাছা, দুই চোখের কোয়া ঘোলা, তক্ষকের পেটের মতো খরখরে ছবি মিলিয়ে বুড়োকে ইতর জন্তু বলেও শনাক্ত করা যায়। আশ্চর্য! বুড়োর সামর্থ্যের সব শাঁস ফুরালেও কানে সে কম শোনে না।…

  • চিত্তরঞ্জন অথবা যযাতির বৃত্তান্ত

    হরিশংকর জলদাস   ‘খেয়াল করেছ?’ ‘কী?’ ‘ছেলেটা কেমন করে দিন দিন বদলে যাচ্ছে।’ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু। স্ত্রীর কথায় চোখ তুলে তাকালেন। কিছুটা আন্দাজ করেছেন তিনি। তারপরও বললেন, ‘কার কথা বলছ?’ ‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ছেলে আমাদের ডজনখানেক।’ একটু করে হাসলেন সুপ্রভা দেবী। বললেন, ‘ছেলে তো আমাদের ওই একটাই, অর্ণব। তার কথাই তো…