ছোট গল্প

  • কাগজের কফিন

    জয়দীপ দে কাজ ওই একটাই। সারাদিন বুকের ভেতরে কথার ওল পাকানো। তার ধারণা, পুরো জগৎসংসার তার বিপক্ষে চলে গেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগেই তাকে দোষীসাব্যস্ত করে ফেলেছে সবাই। মুখের ওপর যে যার দরজা ভিজিয়ে দিয়েছে। এখন তার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত নেই কারো। তারও যে কিছু বলার থাকতে পারে, তা কারো মাথায় নেই। মাথায় থাকলেও শোনার…

  • দামু নাপিত

    সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দামু নাপিতকে আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। সে কোথায় কোন গাছতলায় বসে কার দাড়ি চাঁছত, জানি না; তবে আমাদের বাড়ি আসত পনেরো-বিশ দিন বা মাসখানেক অন্তর-অন্তর। খাড়া-খাড়া কাঁচাপাকা চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, চোখদুটো লালচে মতন, দাঁতগুলো ক্ষয়া। বলতে নেই, সে দেখতে ছিল খুবই বিচ্ছিরি। অবশ্য নাপিত – যাকে আবার লোকে বলে : নাপ্তে, সে সুদর্শন…

  • গন্তব্য

    নীহারুল ইসলাম হুকারহাট বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা চড়ে নাককাটিতলা। দুনিয়ার যত শান্তি নাকি সেখানেই! অথচ হুকারহাট আর কতদূর, সেটাই বুঝতে পারছে না আমিরুদ্দি। যদিও বাসে উঠেই কন্ডাক্টরকে বলে রেখেছে, গন্তব্যে পৌঁছালে তাকে যেন নামিয়ে দেয়; কিন্তু বাসে খুব ভিড়। কন্ডাক্টর যাত্রীদের ভাড়া নিতে ব্যস্ত। তাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা কন্ডাক্টরের মনে না থাকে যদি! আমিরুদ্দির সন্দেহ হয়।…

  • ক্রাইসিস

    প্রবালকুমার বসু প্রথমটা বুঝতে পারেনি বিতান। ভেবেছিল গলায় ঘুমের রেশ লেগে থাকাটাই কারণ হবে হয়তো। সকাল থেকে দুজনকে ফোন করেছে। দুজনেই ওর খুব চেনা। নিয়ম মেনে প্রত্যেকদিন না হলেও প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। অথচ কেউই বিতানকে চিনতে পারেনি। ভালো করে চোখ-মুখ ধুয়ে এসে, জল খেয়ে বাসবীকে ফোন করল বিতান। বাসবী ওর কলিগ। পাশের টেবিলেই বসে।…

  • ধনবিজ্ঞানের শিক্ষকের খোঁজে

    দিলওয়ার হাসান এটা সেই সময়ের গল্প যখন অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর মাধ্যমে মফস্বলের ডিগ্রি কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পরিণত করা হয়েছিল। বড় শহরে গিয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না যাদের তাদের জন্য ওই ব্যবস্থা এক স্বর্ণযুগের সূচনা করে। ছোটবেলা থেকে আমার নিজের স্বপ্ন ছিল ইংরেজি সাহিত্য পড়ব অনার্স নিয়ে। আমার সেই স্বপ্ন…

  • একটি ভূতের বাড়ির আজগুবি গল্প

    মীনাক্ষী সেন আমার বাবাকে আমার মনেই নেই। অথবা যতটুকু মনে পড়ে তা মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে। একটা মানুষ, বিরল প্রতিভা, অতল স্নেহ, অসীম সাহস আর স্বপ্নময়। কিন্তু বাবা যে নেই আমার জীবনে, সেই বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে সত্য একটাই যে, মা-ই আমার জীবনে সবকিছু। আমাকে কোলে করেছে, বড় করেছে, গুনগুন করে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়েছে, গরাস মেখে…

  • আবু সালেকের কনফেশান

    বুলবন ওসমান সামনে কোনো গির্জা নেই, ফাদারও নেই, আবু সালেক ক্রিশ্চানও নয়, করেনি কোনো অপরাধ বা পাপ যে তাকে কনফেশান করতে হবে। তবু ফজল যখন তাকে প্রশ্নটা করে বসে, তার মধ্যে অকারণ একটা অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। সেটা ঠিক অপরাধবোধ নয়, পাপবোধও নয়, তবু একটা ঊনতা মনকে  অস্বস্তিতে ভর দেয়। ব্যাপারটা যে কী, সে নিজেও…

  • অপঠিত পার্লবাক, প্রার্থনা ও বাজি

    নুশেরা তাজরীন আজকাল গুলশানের কথা বড় বেশি মনে পড়ে সন্ধ্যারাণীর। একটু খুঁটিয়ে দেখলে ঠিক গুলশান না, তার ঘরের তাকে রাখা কালচে-সবুজ মলাটের বইটার কথাই মনে পড়ে, প্রথম পাতায় নিউজপ্রিন্টের চোষকাগজে ফাউন্টেন পেনের নীল কালিতে শিরা-উপশিরা বের করা – ‘গুলশানকে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ক্ষুদ্র উপহার, ইতি কাজল’ – লেখাটাও তার চোখে ভাসে। বইটা সে পড়েনি, শুধু দেখেছিল;…

  • গোলাপ ও মোহনলাল

    আহমেদ মুনির মোহনলাল এই পাড়ায় থাকত। ১৭ বাই সি হলুদ চারতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। কিন্তু সে-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারে না। এখন সোবহান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করেন – ‘কোন মোহনলাল? পনেরো বছর ধরে এই বাড়িতে আমরাই থাকি। কই এমন নামে এখানে কেউ ছিল বলে শুনিনি তো।’ লিচুবাগানের গলিটা সরু…

  • নহ মাতা নহ কন্যা

    রফিকুর রশীদ কার্তিকের কুয়াশা এবার যেন আশ্বিনের গোড়াতেই ঘিরে ধরেছে চারিদিক। সন্ধ্যা ঘনিয়ে নামতে না নামতেই মিহি বরফকুচির মতো কুয়াশা পড়তে শুরু করে। সেই কুয়াশায় ভিজে ভিজে গ্রামের বউ-ঝিয়েরা আসে পূজামন্ডপে ঠাকুর দেখতে। প্রতিমা-দর্শনকে তারা বলে ঠাকুর দেখা। তাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। সারাদিনের ঘর-গেরস্থালি সামলানোর পর স্নানটান সেরে বেশ একটা স্নিগ্ধ পবিত্রতা অন্তরে ধারণ করে…

  • ফাঁদ

    আহমাদ মোস্তফা কামাল বউয়ের কাছে ক্রমাগত অপদস্থ হতে হতে একসময় জামানের মনে হতে থাকে – এই ভোগান্তির জন্য সে নিজেই দায়ী, কিংবা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপটুতা দায়ী। সিদ্ধান্তটি ছিল শায়লাকে বিয়ে করা। তার দূরদৃষ্টি নেই, ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সে-সম্পর্কেও কোনো আগাম ধারণা করতে অসমর্থ, ফলে বিয়ের আগে থেকে শায়লাকে চিনলেও এবং বহু ঘটনায় তার…

  • নিমগাছের নিচে ছয়জন

    আনোয়ারা সৈয়দ হক ছয়জনই দাঁড়িয়ে থাকে দাদার আমলের নিমগাছের নিচে। তারা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না, মাঝে মাঝেই ওঠবস করে, মাঝে মাঝে পায়চারি; অস্থিরতায় মাঝে মাঝেই নিজেদের হাতের আঙুল মটকায়, মটকানো আঙুলে মটমট শব্দ ওঠে, শব্দগুলো যেন হে আল্লা, আল্লাহু করে, প্রকৃতপক্ষে যাকে বিলাপ বলা যায়। তাদের বুকের ভেতরে যেন পাথরের ভার নেমে আসে, নিঃশ্বাস নিতে…