ছোট গল্প

  • উজানি মাছেদের বউজীবন

    পাপড়ি রহমান বাদলার মরশুম এলেই ঘোড়াউত্রার জলে যেন কী এক রহস্য খেলে যায়! এমনিতেই বছর-কাবারি তার ভাব-সাবের তেমন অদল-বদল নাই। আর দশটা নদ-নদী যেভাবে চলে-ফিরে, ঘাড় ঘুরিয়ে, কোমর বাঁকিয়ে অন্যপথে ধায় – ঘোড়াউত্রাও তেমনি চলে। সারা বৎসর তার তেমন চেত-বেধ নাই, শুধু বাদলার মরশুম এলেই ভিন্ন কথা। তখন আষাঢ়ে-জলধর আসমানে সামান্য উড়লো কী, তার ছায়া…

  • এই চরাচর

    প্রশান্ত মৃধা এইখানে চরাচর আসিয়া মিশিয়া গিয়াছে! সত্যি! একেবারে সত্যি কথা! যে-লোকটি অথবা যে-ছেলেটি কবির ঢঙে এই কথা বলে পরের বাক্যটির জন্যে একটু থামল, সে সত্যি কথাই বলেছে। শহরের ভেতরে এইটুকু জায়গা, কিছুদিন আগে দেওয়া নাম স্বাধীনতা উদ্যান। কার কার স্বাধীনতা এখানে রচিত কিংবা খর্ব হয় সেই হিসেব তোলা থাক। কারণ, এইখানে চরাচর এসে মিশেছে,…

  • অবেলার কামিনী

    ফিউরি খোন্দকার ‘পিঠ চুলকানোর জন্যও একজন মানুষ লাগে’, টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটু ম্লান হেসে বললো মুনা। তার কণ্ঠস্বর কেমন বিষাদগ্রস্ত মনে হলো জহিরের কাছে। এখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। দেয়ালঘড়িতে সাড়ে চারটা। সাধারণত তারা এতো সময় নিয়ে কথা বলে না। দুজনেরই সকালবেলা অফিস আছে। রাতের অন্ধকার আস্তে আস্তে ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে শীতল…

  • এক মিনিটের নীরবতা

    নলিনী বেরা স্নানাহারের পূর্বেই আমার শাকান্ন ভোজন হয়ে গিয়েছিল, তাই মধ্যাহ্ন-ভোজনে অভিরুচি ছিল না। কিন্তু একে ‘মহিমারঞ্জন’, তার ওপর ‘দাদা-বউদির হোটেল’ – অগত্যা যেতেই হলো। হরিদ্বার-ভ্রমণার্থীদের মুখে এতো শুনেছি ‘দাদা-বউদির হোটেল’ ‘মাসির হোটেল’ না ‘মাসি-পিসির হোটেল’-এর নাম যে, ‘বন্যানি চ তথান্যানি স্বাহারাণি’, আহার করি আর নাই করি – যেতেই হচ্ছে আমাকে! এছাড়াও তো আছে ‘গৌরীশঙ্কর…

  • বুনো বিলাস

    হামিদ কায়সার বাসর রাতেই হোঁচটটা খেয়েছিল শায়লা, জগলুলের মধ্যে অস্বাভাবিকত্বের একটা ক্ষীণ স্ফুরণ চোখে পড়েছিল ওর। কিন্তু এটা যে এতোটা প্রকট অথবা একসময় এতো সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে, ধারণা ছিল না সামান্যও। ভেবেছিল এ বুঝি নিছক খেয়াল। বাসরঘরে ওদের দুজনকে রেখে সবাই যখন বেরিয়ে গেল, ও প্রথামতো পা ছুঁয়ে সালাম করে স্বামীর সামনে দাঁড়াতেই, জগলুল…

  • শহরের পাতাঝরা বিকেলে

    ইমতিয়ার শামীম একবার এক বিকেলবেলায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে এই শহরে, তারপর তা থেমে গিয়ে হালকা প্রসন্ন রোদ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে-রোদের ওপর এমন এক ঝোড়ো হাওয়া পাক খেয়ে চলে যে, পাতাঝরা ফাল্গুনের বিষণ্ণ আকুলতা পথে পথে বলকে উঠতে থাকে। মনে হয় এখনই রাস্তায় নেমে আসবে এলোমেলো কিশোরের দল, যারা ঘুরে ঘুরে দেখে নেবে কোথায় কোন…

  • এক জীবন বহু গল্প

    মাসুদা ভাট্টি ওরা দুজনে হাঁটেন পার্কে। এখানেই পরিচয়। পরিচয়-পর্বটা খুব মজার। একদিন ভোরে, বেশ ভোরই বলতে হবে, তখনো কেউ আসেনি পার্কে। দু-একজন সবে আসতে শুরু করেছেন কি করেননি। রেবেকা ভাবছিলেন, এতো ভোরে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। যদিও তিনি ভয় পাচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছিলো না। এমনিই চারদিকে তাকাচ্ছিলেন শুধু। আর কাওসার ভাবছিলেন, যাক, আজকে একটু দ্রুত…

  • রক্তের আল্পনা

    রফিকুর রশীদ অফিসে বেরোনোর সময় হাতের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক না পেলে কার মেজাজ খারাপ না হয়! আলনায় জামা-পাজামা ঠিকই সাজানো আছে, কিন্তু গেঞ্জিটা কোথায়? দেয়ালঘড়িতে দশটার ঘণ্টা বাজে ঢং-ঢং। শফিউর রহমানের কপালের দুপাশের শিরা দাপায় দপ্দপ্ করে। দ্রুত হাতে পাজামার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে গজগজ করে ওঠেন – উহ্, আজো সেই দশটা! কোথায় একটু আগে বেরোবো…

  • কুঞ্জ ও কালনাগ

    রাশেদ রহমান কুঞ্জর গল্প বলবো বলে স্থির করেছি; যদি আপনারা শোনেন…। শুনতে চান? শুনুন তবে…। কুঞ্জ নিতান্তই সাধারণ এক মহিলা, যাকে নাকি সাপে খেয়েছে; যখন সে জীবিত ছিল; তখনো সে এমন কোনো মহিলা ছিল না – যাকে নিয়ে কোনো গল্প ফাঁদা যায়। ভরসা এটুকু যে, আপনারা কুঞ্জর গল্প শুনতে রাজি হয়েছেন। … আর, আমি আপনাদের…

  • কিরকমভাবে বেঁচে আছি

    হরিশংকর জলদাস পুত্র, যেদিন ভোর সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, তুমি তখন ঘুমিয়ে। সামনে তোমার পরীক্ষা, রাত জেগে পড়ো তুমি, গত রাতেও পড়েছ। একটু বেলা করে ঘুম থেকে  ওঠো তুমি। বেরোবার সময় ঘুমন্তই ছিলে। চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলে, ঠোঁটটা একটু ফাঁক করা, কম্বলটাও বুক পর্যন্ত নামানো। তুমি হয়তো জানো অথবা জানো না, সূর্যের আলো ফুটলেই…

  • মান্না দে

    শাহাদুজ্জামান মৃতরা কি পৃথিবীতে থাকে? না থাকে না। যেমন আমার নানা আলী হোসেন নেই; কিন্তু তিনি আমার চোখের নিচে ফুটে থাকেন প্রায়শই। তিনি আমার শৈশব দেখেছেন, দেখেছেন আমার কৈশোর ও প্রাথমিক তারুণ্য আর আমি দেখেছি কেবলই তাঁর বার্ধক্য। অথচ আমাদের পরস্পরের একটা আশ্চর্য রসায়ন ছিল। একটা জাদু ছিল তাঁর। তিনি আমাকে টানতেন। তাঁর আকর্ষণে সুযোগ…

  • এটাও একটা প্রেমের গল্প

    আনিসুল হক হিমেল আশরাফ এসএমএস করেছে। স্যার, আমি আপনার রুমে। আমি সম্পাদক সাহেবের সামনে বসে আছি। আমাদের অফিসের তিন তলায়। জরুরি মিটিং হচ্ছে। এর মধ্যে এই এসএমএস। আমি মোবাইল ফোনটা টেবিলের নিচে নামিয়ে সবার অগোচরে এসএমএস করি : ১০টা মিনিট বসো। আসতেছি। তারপর বেমালুম ভুলে যাই হিমেলের কথা। মিটিং থেকে বেরোই দেড় ঘণ্টা পরে। রুমে…