ধারাবাহিক উপন্যাস
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক ৩০ বুড়ির চরে রাত তখন কাঁথার মতো পুরু, হালকা শীতের দিনে পুরনো কাঁথার মতোই আরামে জড়িয়ে ধরে আছে বুড়ির চরের কুটিরে কুটিরে মানুষের ঘুমশরীর। নারী তার শিশুসন্তানের মুখে স্তন গুঁজে দিয়ে অকাতর হয়ে আছে ঘুমে, স্বামীটি তার কতকাল বৃষ্টি নাই সেই দুঃস্বপ্নের তাড়কা মাছিগুলো তাড়িয়ে চলে, বাপোদাদার সমৃদ্ধকালের স্বপ্ন দেখার চেষ্টায় কেবলই…
-
সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল
দেবেশ রায় পাঁচ কলকাতার সেই কমবয়েসি মন্ত্রী ধরলেন ফোন। বাগনানের মন্ত্রীর কাছ থেকে খবর শুনে তিনি বললেন, ‘সে কী? আমি তো কিছুই জানি না। কিন্তু সিএমকে তো ফোন করা যাবে না। আমাদের গোলাপদাকে ডাকা যায়। দাঁড়ান, আমি রমাপদদাকে ফোন করছি।’ ‘উনি কি ধরবেন?’ ‘না। আমি পবিত্রদাকে বলছি ওঁকে ডেকে দিতে। নইলে তো উনিই বলবেন –…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ২৯ \ নখের আঁচড়ের মতো নদীর চিকন একটানা একটি রব চরাচরের ওপর দাগ কেটে চলে, আঁকের পর আঁক মকবুলের মনে তার মেয়েটির উদ্ভ্রান্ত মুখ রচনা করতে থাকে, নক্ষত্রের আগুন রেখায় যেন বিন্যস্ত হয়ে ওঠে প্রিয়লির মুখ, রাতের সম্মোহিত গভীরে নদী নয় প্রিয়লিরই কান্না শুনে ওঠে মকবুল। কতকাল সে মেয়েটিকে…
-
সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল
দেবেশ রায় চার ২৩ জুন শেষরাত থেকে চন্দ্র সাঁতরা আর নিমাই ঢালির মতৈক্যঘটিত আবহাওয়ার যে-পূর্বাভাসের ভয়ে চন্দ্র সাঁতরা খালের জলে ফেলে রাখা পাইপ উদ্ধার করতে চাইল ও একটু দরকষাকষি করেও নিমাই ঢালি জলে নেমে গিয়ে ডুবে গেল – মাঝখানে একবার উঠে সে সাঁতরাকে ক্ষ্যান্ত দিতে বলেছিল কি না ও সাঁতরাই তাকে আরো একবার জলে নামতে…
-
সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল
দেবেশ রায় তিন ১৭ জুন মঙ্গলবার থেকে তো কলকাতার জল বেরোতে শুরু করেছে, সে-ই ১১ আর ১২ তারিখের শেষ ও অষ্টম কালবৈশাখীর জল ও ১৪ থেকে মৌসুমি বায়ুর জল। জল বেরোনোর নানা জটিলতা আছে। সে-সব কথা না হয় থাক। কেষ্টপুর খাল দিয়ে যে-জল বেরোনোর সে-জল কেষ্টপুর খালে ঢুকে আর বেরোতে পারে না। কোনো দিনই পারে…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ২৮ \ নদী কেঁদে চলেছে, একটানা তার সিঁ সিঁ কান্নার শব্দ মকবুল হোসেনকে বধির করে দিতে থাকে। সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে, কেন নদী কাঁদছে। তার মনে হয় তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তারের জন্যে কাঁদছে। আধকোশার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। কেন তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আধকোশার উন্মত্ত খলখল পানিতে? এই…
-
নদী কারো নয়
\ ২৭ \ মকবুল হোসেনের ঘুম ভেঙে যায়। রাত এখন কত? নির্ণয় তার নাই। কোথায় সে আছে তারও কোনো নির্ণয় নাই। প্রথমে সে মনে করে চাটগাঁয়ে বোধহয় আছে, সার্কিট হাউসের কামরায়, চাটগাঁয় সে এসেছে একটা সাহিত্যসভায় যোগ দিতে। পরমুহূর্তেই ঘোরটা ভেঙে যায় – এই চাটগাঁ থেকে ফিরেই তো সে বুয়ার কাছে জানতে পেয়েছিলো তার…
-
সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল
দেবেশ রায় দুই নতুন জলে মরণ সব জায়গাতেই ঘটতে পারে যেখানে বছরের দুটো-একটা ঋতু জুড়ে নতুন জলই নামতে থাকে, ঝরতে থাকে, পুরনো চেনাজলে ঘটে যায় নতুন বদল আর স্থলদেশ ও জলদেশের চোখ-সওয়া অবস্থান শুধু বদলায়ই তা নয়, বদলাতেই থাকে, একটা দেশের (স্পেস) ভিতর থেকে দেশমালা গুঁতিয়ে ওঠে, তলিয়ে যায়, ছিঁড়ে যায়, ভেসে যায়। আমাদের, বাঙালিদের,…
-
সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল
দেবেশ রায় সামান্য অপ্রাসঙ্গিক [এক-একটা লেখার সঙ্গে লেখকের এক-এক রকম সম্পর্ক তৈরি হয়। কখনো একটি বড় লেখা শুরু হওয়ার আগে দশ-বিশ বছর ধরে লেখকের সঙ্গে থেকে যায়, খায়দায়, ঘুমোয়, ঘোরেফেরে, ভুলে থাকে, চলে যায়, ফিরে আসে। তারপর কোনো একসময় আসে যখন গল্পটাকে নিজের ভিতর থেকে বের করে না-দিলে নিস্তার জোটে না। তখন শাদা কাগজ কালো…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ২৬ \ আমরা এতদূর এসে অবধি ধারাবাহিক একটি গল্পের জন্যে যদি এখনো অপেক্ষা করে থাকি তাহলে স্মিতমুখ হয়ে উঠব। দেখাই কি যাচ্ছে না যে, আমরা এখন গল্পের ভেতরেই বাস করছি? আমাদের চারদিকেই এখন গল্পের অণু, কণা ও পর্বত এবং সমুদ্র। সৃষ্টির আদিতে যেমন – জল, বিশাল জল, পরে সংক্ষুব্ধ সেই জল,…
-
একটি মেয়ে
আফসার আমেদ \ ২৭ \ রবি ব্যানার্জি সন্ধ্যার আগেই সেঁজুতিকে পৌঁছে দিলো আমরি হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌঁছতেই সেঁজুতি কেমন হারিয়ে গেল রবি ব্যানার্জির কাছ থেকে। রবি ব্যানার্জি কাছে নেই, দৃষ্টির সীমায় নেই। মানুষের ভিড় আছে। তার মধ্যে হারিয়ে গেছে। সেঁজুতিও যেন হারিয়ে গেছে। শ্লথপায়ে ওয়েটিং রুমের ভিড়ে চলাচল করল কিছুক্ষণ। যেন তার চোখের দৃষ্টি নেই। এক…
-
একটি মেয়ে
আফসার আমেদ ॥ ২৬ ॥ ফ্ল্যাটের গেটে ঢোকার মুখে সেঁজুতির দেখা রবি ব্যানার্জির সঙ্গে। রবি ব্যানার্জি থমকে দাঁড়ায়। ‘কী ব্যাপার, তুমি এতদিন পরে, কোথায় ছিলে?’ ‘এই কলকাতার বাইরে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম।’ ‘এখনই ফিরছ?’ ‘এখনই, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে এই নামলাম। – তো বউদি, হৃদয় আছে তো?’ ‘না, ওরা তো নেই। আমার সঙ্গে আর থাকতে…