বেলাল চৌধুরী : সন্ধানী পর্ব ও তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

‘অল্প বয়সেই পেকে গিয়েছিলাম বাড়িতে বইয়ের আলমারি আর সিন্দুকের বদৌলতে।’ – এই আত্মকথন মনোহর চমক দানে যিনি মনস্বী, চিন্তা ও কল্পনা বিন্যাসে বিশিষ্ট রথী, কী মজলিশি অন্তঃপ্রাণ মানুষ সেই বেলাল চৌধুরী। কেবল বই ও পত্রিকা পাঠ, দশদিগন্তের নির্যাস গ্রহণ এবং স্বীয় সাহিত্যচর্চা নয়, বাড়ি থেকে পালিয়ে কখনো জলে, কখনো ডাঙায় এই মানুষের ভুবনভ্রমণ, লৌকিক জীবনাচার তুমুল রসরঙ্গেরও বিষয় হয়েছে। বেলাল চৌধুরীর জীবনকালের দুটি পর্ব : কৈশোরোত্তর যুবা বয়সের সিংহভাগ কেটেছে আয়ু পোড়াতে ও সৃষ্টিতে বিচিত্র কলকাতায়। দ্বিতীয়ত, এসেছি নিজেরই দেশে – এমন নীরব উচ্চারণে গৃহস্থালি ও জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশের নীল আকাশের নিচে স্থায়ী অবস্থান। কলকাতায় জীবনযাপন, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সখ্য, সাহিত্য পত্রিকার সাময়িক সম্পাদনা থেকে খ- খ- লেখালেখি – এসব বেলাল চৌধুরীর নিজের এবং কলকাতার লেখকদের কলমে বিবৃত হয়েছে। বেলাল চৌধুরীর মজার জীবন পাঠ করে আমরা বুঝেছি মানুষটি ছিলেন মুগ্ধ করার মতো বোহেমিয়ান। তবে ঢাকার জীবনে বহুলাংশে তিনি ছিলেন স্থির ও কর্মিষ্ঠ। দুই বাংলার সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের মেলবন্ধনে বেলাল চৌধুরী আমাদের বরাবরেষু মধ্যবর্তীজন।

ঢাকায় বেলাল চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ সময় গেছে সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা সম্পাদনায়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সচিত্র সন্ধানী ও আশির দশকে ভারত বিচিত্রা পাঠযোগ্যতা পেয়েছে বেলাল চৌধুরীর দক্ষ সম্পাদনার কল্যাণে। হঠাৎ হঠাৎ পুরনো অভ্যাসে ভ্রমণের নেশায় দরজায় দরজায় উদ্দেশ্যহীন ঢুঁ মেরে কাজে গরহাজির থাকলেও সম্পাদনাকর্মে কমেনি তাঁর উৎকর্ষ ও গুরুত্ব। এ-যেন তাঁর শক্তির উৎস খুঁজে ফেরা।

বিভাগ-উত্তর কলকাতা থেকে বেরোনো উল্টোরথ, জলসা, প্রসাদ, কার্টুন পত্রিকা, সচিত্র ভারতের আদলে ১৯৫৬ সালের ২৩ জুন ঢাকায় প্রকাশিত হতে থাকে সচিত্র সন্ধানী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন দেশের আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির পত্রিকার জন্য তৎপর হন এই পত্রিকার আদি ও অকৃত্রিম সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ। তিনি বেলাল চৌধুরীকে নবপর্যায়ে সচিত্র সন্ধানীর কার্যনির্বাহীর দায়িত্ব দেন। বেলাল চৌধুরী তখন কলকাতা ছেড়ে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছেন। এই পত্রিকার সঙ্গে দূর এবং নিকট অতীতে যুক্ত প্রতিজন যে যেখানে ছড়িয়ে ছিলেন সবাই আবার জড়ো হন। ইতোমধ্যে নতুন নতুন লেখক যাঁরা উঠে এসেছেন তাঁরাও বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে এসে হাত মেলালেন। ডিমাই সাইজ থেকে এ-ফোর সাইজে বেলাল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে যখন সন্ধানী সাপ্তাহিক হলো তখন শুরু সচিত্র সন্ধানীর স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের সেরা লিখিয়ে, সেরা আঁকিয়েরা এর চতুষ্পার্শে।

সত্তরের দশকে সচিত্র সন্ধানীর তোড়জোড় চলাকালে এক দশকের সুনাম এবং চরিত্র, অন্যদিকে সময়ের প্রয়োজনে নতুন আঙ্গিক, বিন্যাস এবং সময়োপযোগী সৃজনশীল রচনা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়। বেলাল চৌধুরীর ভাষ্য : ‘শুরুতেই আমার মাথায় ছিল পুরো ৬৪ পৃষ্ঠার একটা কাগজে যথাসম্ভব আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা। একমাত্র সৃজনশীল রচনা যেমন গল্প, কবিতা ছাড়া প্রচ্ছদ পরিচিতি থেকে সম্পাদকীয়, ভেতরের ফিচার, নিবন্ধ বা অন্যান্য বিভাগের রচনা এক সারূপ্যে সাজাব।’ প্রয়োজনবোধে লেখা ভাষার সাযুজ্যের জন্য পুনর্লিখন ও সম্পাদনা করা হয়েছে। যাঁরা নবপর্যায়ের সচিত্র সন্ধানীর মনোযোগী পাঠক তাঁরা লক্ষ করে বুঝেছেন বেলাল চৌধুরী এ-বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে সাফল্য আনতে পেরেছিলেন।

সন্ধানীর সঙ্গে সচিত্র বলে একটি অংশ ছিল। বেলাল চৌধুরীর অভিমত : ‘আমরা ঠিক করেছিলাম সম্ভাব্য সকল লেখায়

যে-সব ছবি ছাপাব সেগুলো যেন কোন অর্থেই নিষ্প্রাণ বা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামীকে সার বেঁধে গুলি করে বধ করবার

ভঙ্গিমা-অলা ছবি না হয়। ছবির নিচে আলোকচিত্র শিল্পীর কৃতিত্ব ও যোগ্যতার কদর চালু করা হ’ল। সর্বশেষ সন্ধানীর নামপত্রে লেখাটি কি রকম হবে এই নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কারণ নয়ে ধয়ে তার সঙ্গে আবার দন্ত্যন য়ে দীর্ঘ ঈ-কার সব মিলিয়ে এক মহা ধুন্ধুমার কা- মনে হ’ত; এটাকে দৃষ্টিনন্দনভাবে বাগে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে ভরসা ছিল সবেধন কাইয়ুম ভাই। সত্যি একটা চৌখুপি মতো জায়গার মধ্যে কাইয়ুম ভাই বেশ কায়দা করে সুষমভাবে সচিত্র সন্ধানী লিপিবদ্ধ করে দিলেন। একেই বোধ হয় বলে হাত যশ। সাক্ষাৎ এরিক গিল।’

স্বাধীনতা-উত্তরকালে উপরকাঠামোর অনুচিত অস্থির সময়ে একটি পত্রিকার কলেবরে ছাপার জন্য ছিল রকমারি বিষয়। আমোদের প্রসঙ্গসমূহ ছাপা হলে পরিষ্কার বোঝা যেত পত্রিকা-সম্পর্কিত জনের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁদের আড়ালের মনোভাব। প্রকৃতপক্ষে, ওই সময় থেকে বিনোদনের নামে লঘু বিষয়-আশয় যথেচ্ছ ছেপে পাঠকের পকেট হাতিয়ে নেওয়ারও সেরা ফন্দির শুরু। বেলাল চৌধুরী সচিত্র সন্ধানীতে দায়িত্ব পালনকালে ধন্য রুচি নির্মাণে মনোজগতের ক্রমোন্নতি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। সংস্কৃতির বিকাশের প্রয়োজনে বেরিয়ে এলো নতুন উদ্যোগ, নতুন নতুন বিভাগ। কতগুলো ফিচার, যেমন নগরবাসী সকলের কাছেই উপভোগ্য ও রমণীয় হতে পারে এমনসব লেখা নিয়ে ‘ঢাকা ডায়েরি’, গ্রামবাংলার খুঁটিনাটি নিয়ে ‘বিশাল বাংলা’, নারী আন্দোলনের বহু ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্য নিয়ে ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল’, ব্যক্তিবিশেষের স্বাতন্ত্র্য দাম্পত্য জীবন নিয়ে ‘অপরপক্ষ’, ফুটপাথের হকার, ছোট দোকানের ফটোস্ট্যাট-কর্মী, অফিসের কেরানি, স্বেচ্ছাসেবীর সুখ-দুঃখ, সংগ্রামী ও বর্ণময়

জীবন নিয়ে ‘একদিন প্রতিদিন’, ভবিষ্যৎ প্রতিভাবানদের নিয়ে ‘তরুণ-তরুণী’, যাঁদের কথা এখানে ছাপা হয়েছে তাঁরা সবাই পরবর্তীকালে দেশে প্রতিষ্ঠিত ও বরেণ্য হয়েছেন। প্রতি সংখ্যায় নতুন প্রচ্ছদ, নিত্যনতুন কাহিনি সহজেই পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ প্রতি সংখ্যাতেই লেগে থাকত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পাঠকের চিঠির ভিড়। যোগ হয়েছিল পাঠকের অংশগ্রহণে জীবনের প্রথম প্রেম পূর্ণ করি মনে কামনার বিশদ ফিচার ‘নিকষিত হেম’। প্রতি লেখার যথাযথ অঙ্গসজ্জা, কখনো স্কেচ, সচিত্রীকরণে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী থেকে শ্রম নিংড়ে নিয়েছেন বেলাল চৌধুরী। সচিত্র সন্ধানী হাতে করলে টের পাওয়া যেত বাংলাদেশে এখন কোন ঋতু, গাছে গাছে কোন ফুল-ফল, কোন পাখি ডাকে, কে এখন ব্যতিক্রমী কবি ও ছোটগল্পের লেখক, কে এখন সেরা আঁকিয়ে, কোন নাট্যসংস্থার দীর্ঘ মহড়া শেষে মঞ্চস্থ হচ্ছে সমাজসচেতনমূলক নাটক, দেশ-বিদেশে কে এখন চলচ্চিত্রের গুরু, শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী, কে এখন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, পল্লিগীতি ভালো গাইছেন। তাঁদের নিয়ে সন্ধানী প্রচ্ছদ-প্রতিবেদন ছেপেছে। বেলাল চৌধুরী সজ্ঞান ছিলেন – কোনোক্রমে যেন সস্তা বিনোদনের স্রোতে সচিত্র সন্ধানী সাঁতার না কাটে। জনপ্রিয়, তাৎক্ষণিক মানসিক আরামের খোরাক ফেলে সন্ধানী বেছে নিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি যার নির্মল চরিত্র আছে এবং যা সুক্রিয়াশীল। শিল্প-সাহিত্য ও বিভিন্ন সৃষ্টিশীল বিষয়ের উন্নত, সময়জয়ী, সফল কাজ নিয়ে সচিত্র সন্ধানী যে প্রচ্ছদ-প্রতিবেদন রচনা করেছে সেখানে কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, স্থপতি, চিকিৎসক, সাংবাদিক, খেলোয়াড়সহ অনেক কৃতীজনও বিষয় হয়ে এসেছেন। বাংলা নববর্ষ, ভাষা-আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, বড় কলেবরে ঈদসংখ্যার সচিত্র সন্ধানী ইতিহাস বা গবেষণামূলক কাজে আজো বহু পাঠক সংরক্ষণ করছেন।

সচিত্র সন্ধানীতে মুদ্রিত লেখাগুলো আবশ্যক মলাটবন্দির উদ্দেশ্যে একই স্বপ্ন-আগ্রহ নিয়ে সন্ধানী প্রকাশনীর যাত্রা শুরু। নিশ্চিত দাবি করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য প্রকাশে এদেশে সন্ধানী প্রকাশনী পথিকৃৎ। জাতির শ্রেষ্ঠ কীর্তির প্রভাবে কবি-লেখকদের সাহিত্যের আয়ুষ্মান ও সফল অংশ গ্রন্থাকারে প্রকাশের কৃতিত্ব সন্ধানী প্রকাশনীর। এখানেও প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদকে সহযোগিতা করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী ও বেলাল চৌধুরী। গল্পকার ও কবির একক গল্প-কবিতার সমন্বয়ে সন্ধানী প্রকাশনী বের করেছে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য সিরিজ। এক এক করে বিজয় ও অর্জিত চেতনা যখন ক্ষয় হচ্ছে, নস্যাৎ হচ্ছে সুফল তখন মুক্তিযুদ্ধকে অক্ষরে বেঁধে রাখতে প্রথম একই বাক্সে মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও কবিতার দুই ভল্যুম রীতিমতো ছিল ঈর্ষা-জাগানো। সন্ধানী প্রকাশনীর হয়ে স্মরণীয় সম্পাদনা করেন সংবাদ সাময়িকীর তৎকালীন সম্পাদক, এখন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও কবিতার এমন একটা পাঠযোগ্য উজ্জ্বল সংকলনের লেখা নির্বাচনে বেলাল চৌধুরীর কণ্ঠে আবুল হাসনাতের ধৈর্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা শুনেছি। প্রায় দুই দশক পরে এসে বের হয় তাঁর একক কবিতার সংকলন। সযতœ পরিচর্যা, মুদ্রণ পরিপাট্যে, বিষয়ানুগ প্রচ্ছদে জাতির গৌরবগাথার সাহিত্য সিরিজে অন্যতম একটি প্রকাশনা বেলাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। গ্রন্থভুক্ত সব কবিতা অবশ্য একাত্তরের জীবনপণ লড়াই, লাখো প্রাণের মৃত্যু ও চরম মূল্য, বেয়নেটবিদ্ধ নয় মাসের দুঃসময় নিয়ে নয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের জায়মান অনিঃশেষ চেতনা, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের নিন্দা, অন্যায্য সামরিক শাসন, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-স্বৈরাচার বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়ের কবিতাও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও মানবতার জয়গান হয়ে নতুন কাব্যশৈলীতে রূপান্তরিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত চেতনার এমন সারাৎসার হচ্ছে বেলাল চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের কবিতা।

উনসত্তরের গণআন্দোলনে, সত্তরের নির্বাচনে, মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির কণ্ঠে অবিরাম উচ্চকিত হতো ‘জয়বাংলা’ সেøাগান। তুমুল আলোড়িত সেদিনের জাতির উত্থান স্মরণ করে বেলাল চৌধুরী ‘একদিন চিরদিন জয়বাংলা’ কবিতায় লিখেছেন : ‘জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন দুর্বার এক সংগ্রামের নাম/… জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী পুণ্য সলিলা বঙ্গভূমির জয়ধ্বনি/… জয়বাংলা আছে আজো বাঙালির নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে।’ পরবর্তীকালের ক্রমাগত আঘাত ও বিরুদ্ধ বিবিধ পরিবর্তন সত্ত্বেও জাতির মাভৈধ্বনি, বন্দনামুখর স্তবগান আছে, আগামীতেও থাকবে বলে ‘জয়বাংলা’য় বেলাল চৌধুরীর  দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা। পরিক্রমা : বাহান্ন থেকে উনসত্তর, একাত্তর হয়ে কাল নিরবধি, জাতীয় পতাকার সুদূরপ্রসারী কার্যকারিতা নিয়ে বেলাল চৌধুরী সতর্ক ও সজাগ – ‘ন’ কোটি মানুষের লক্ষ্য একটাই/ ছিনিয়ে আনতে হবে বিজয়/ এবারের লড়াই যে প্রাণপণ/ রাহুমুক্ত করতে হবে স্বদেশ-শতদল,/ প্রস্ফুটিত হবে পূর্ণ অবয়ব/ পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণ করে/ হাতে হাতে তুলে নিতে হবে/ সবুজের মাঝে রক্তিম সূর্য আঁকা স্বাধীন পতাকা ঝলমল।’ কোটি মানুষের আকাক্সক্ষা, মর্মে মর্মে মুক্তির সম্ভাবিত স্বাদ গাঢ় উপলব্ধ হয় বেলাল চৌধুরীর অন্তর্দেশে : ‘একটি পতাকা হতে পারে কত আনন্দের/ স্বাধীনতা শব্দটি কত অনাবিল; -/ মুক্ত হাওয়ায় পত পত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন দেশের/ সার্বভৌম, সুন্দর, দেশজ চেতনার রঙে রাঙা।’

স্বাধীনতা-উত্তর অরাজকতা, বরবাদ ও অনিষ্টের রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে বেলাল চৌধুরীর মর্মাহত পঙ্ক্তি : ‘তারপর খবর এলো, অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। … বাগবাগিচা ক্ষেতখামার নষ্ট হয়ে গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো চাষাবাদ। কথা বললে শোনা যায় না।’ ক্রমাগত হীনাবস্থা, প্রখর সূর্যের নিচে মধ্যাহ্নের অন্ধকার, শকুনিদের মাংসাশী অভিবাদন, গণতন্ত্রের টুঁটি খুবলে নেওয়া দুরবস্থার মধ্যে সর্বসাধারণের ত্রাতা লড়াকু বান্ধব নিয়ে কবির সজ্ঞান প্রতিক্রিয়া : ‘উত্তরাঞ্চলে মাথাচাড়া দিয়েছে গৃহযুদ্ধ/ কারা প্রাচীরের অন্তরালে আছেন সুদীর্ঘকাল/ মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা বীর যোদ্ধা।’ সমকালীন জ্বলন্ত দুর্দশা তাই বিবৃত হয়েছে কবির কবিতায় : ‘অন্ন নেই আমাদের আমরা নিরন্ন/ বস্ত্র নেই বিবস্ত্র, বোধ নেই নির্বোধ/ দৃষ্টি নেই দৃষ্টিহীন, আশ্রয় নেই নিরাশ্রয়/ ভূমি নেই ভূমিহীন – এক কথায় পায়ের নীচে মাটি নেই।’

কাব্যগ্রন্থে আছে অক্ষরে সাজানো মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘মানব মহান’, ‘আবহমান বাংলা ও বাঙালির’, ‘পিতৃপুরুষ’, ‘চিরশুভ্র’ মোট পাঁচটি কবিতা। বেলাল চৌধুরী লিখেছেন : ‘চিরকাল চিরদিন/ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ/ অনির্বাণ অনিঃশেষ/ চিরশুভ্র অমলিন। চিরসবুজ চিরসজীব/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’ বঙ্গবন্ধু মানে জাতির পতাকা, কোটি বাঙালির হৃৎপি-ের ছলকে ওঠা রক্তের জাগরণ মানে শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের ক্লিষ্ট মলিন অবয়ব দেখে মূঢ় মুখে ভাষাদানের দুঃসহ কাজে ব্রতী বঙ্গবন্ধুর সফল প্রকৃতি নিয়ে বেলাল চৌধুরীর কবিতা : ‘সারাদেশে যিনি, সারা জাতির যিনি, শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘদেহী মানুষটি তিনি/ দোষে-গুণে নিখাদ বাঙালি, নীলিমার মতোই উদার অসীম অমেয়/ কোনো লাভালাভ ক্ষয়ক্ষতি লোভ পক্ষপাত টলাতে পারে না তাঁকে।’ বাংলাদেশের এমন ইতিহাস প্রণেতা, বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশের রক্তসিন্ধু অভ্যুদয়ের কর্ণধার, যাঁর ভেতর দিয়ে আমরা দেখেছি মুক্তির স্বপ্ন সেই বঙ্গবন্ধুকে পঁচাত্তর সালে কতিপয় চক্রান্তকারী, মুক্তিযুদ্ধে পরাস্ত বিপথগামী শক্তি মিলিতভাবে হত্যা করলে বেলাল চৌধুরী চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর মহিমার ঔজ্জ্বল্য কবিতায় ধারণ করেছেন : ‘একদিন যাঁর বজ্রকণ্ঠে হাঁকে/ ফুঁসে উঠেছিল সব ক’টি নদী,/ একদিন যাঁর একটি মাত্র অঙ্গুলি হেলনে/ গর্জে উঠেছিল আসমুদ্র হিমাচল,/ যিনি বিজয়ের ডাক দিয়েছিলেন/ সমুদ্রের সমস্ত ধ্বনিকে একত্র করে/ আকাশ-পাতাল মেদিনী কাঁপিয়ে/ পূঞ্জীভূত জয়বাংলা ধ্বনিতে…।’ কবির আত্মোপলব্ধির সঙ্গে অনায়াসে পাঠকও শরিক হন : ‘অগণিত মানুষের হৃদয়ে যাঁর অধিষ্ঠান/ কার সাধ্য সে ভিৎ টলায়, এতই কী সহজ!’ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বেলাল চৌধুরীর কবিতায় সমার্থক উচ্চারণ। সমাজের অতীত তরঙ্গ ও দেশজ ঐতিহ্যের সাহায্যে বেলাল চৌধুরীর স্বকীয় কাব্যাদর্শ নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু যেন একই দেহে দুটি আত্মা।