অতঃপর মাধো নাটক নিয়ে কোরিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে যেমন পুলক অনুভব করি, তেমনি দ্বিধাদ্বন্দ্বও কাজ করে। একটা নতুন দেশ দেখা, তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করার আনন্দটাই অন্যরকম। কিন্তু দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যখন পাসপোর্ট-ভিসাসহ নানারকম হ্যাপা এসে সামনে হাজির হয়, তখন কেমন জানি চিমসে যাই। গত সেপ্টেম্বরে কোরিয়া থেকে আমন্ত্রণ পেলাম সিউলে অনুষ্ঠিতব্য ১৮তম কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ডুও পারফর্মিং আর্টস ফেস্টিভালে অংশগ্রহণের। নাটক-সংশিস্নষ্ট অনেকেই জানেন, তারপরও বলি, গত ১৮ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ডুও পারফর্মিং আর্টস ফেস্টিভাল, যা সংক্ষেপে  ‘কিডপাফ’ নামে সমধিক পরিচিত। এই আয়োজনে প্রতিবছর বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন নাটকের দলকে উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো একটি নাটকের দল এ-উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পায় এবং আমাদের অভিনয়ের দিন ধার্য করা হয় ১ ডিসেম্বর। এই উৎসবের বিশেষত্ব হলো, উৎসবে প্রদর্শিত নাটকে অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা হতে হয় মাত্র দুজন। বাংলাদেশ থেকে ‘মেঠোপথ’ থিয়েটার তাদের নাটক অতঃপর মাধো নিয়ে এবারের উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পায়। শর্ত হলো তিনজনের বেশি সদস্য নেওয়া যাবে না। আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম। অতঃপর মাধো নাটকের অভিনয়শিল্পী দুজন। টেকনিক্যাল কাজের জন্য ন্যূনতম আরো দুজন দরকার হয়। আমার পক্ষে হয় লাইট, না হয় মিউজিক – কোনো একটা অপারেট করা সম্ভব। দুটি তো একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। আমরা জানতে পারলাম উৎসবে কলকাতা থেকে ড. আশিস গোস্বামীও যাবেন। তাই তাঁকে অনুরোধ করলাম, তিনি আমাদের সহযোগিতা করতে পারবেন কিনা শোয়ের দিন। তিনি রাজি হলেন। এবং ঠিক হলো একদিন আগে আমরা কলকাতায় যাব এবং সেখানে টেকনিক্যাল বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেব।  নিজেদের সবকিছু ঠিকঠাক করে আমরা কোরিয়ার ভিসার জন্য আগেভাগেই লাইনে দাঁড়ালাম। শুনেছিলাম কোরিয়ার ভিসা পেতে রিটার্ন টিকিটও করে নিতে হয়। আমরা যথাযথভাবে ভিসার আবেদন জমা দিলেও সাতদিনের মাথায় খুদে বার্তায় জানানো হয়, আমাদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। কী কারণে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না, তাও জানাতে অপারগতা প্রকাশ করল দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। ভীষণ ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। আয়োজকদের জানালাম। তারাও কিছু করতে পারছে না। তারা আবার নতুন করে আমন্ত্রণ-সংক্রান্ত সব কাগজ পাঠাল; কিন্তু এমবাসি জানিয়ে দিলো ছয় মাসের আগে আর ভিসার আবেদন করা যাবে না। কী বিপদ! প্রচুর টাকা খরচ করে বিমানের যাওয়া-আসার টিকিট কেনা হয়ে গেছে, আয়োজকরা আমাদের নাটকের নামসহ প্রচার শুরু করে দিয়েছে, আর আমরা কিনা ভিসাই পাচ্ছি না। নানাভাবে এমবাসিতে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হচ্ছি। ওরা কোনোরকম সাড়া দিচ্ছে না। অনন্যোপায় হয়ে আমাদের সংস্কৃতির অভিভাবক ও স্বজন
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের শরণাপন্ন হলাম। বিস্তারিত সব খুলে বললাম। তিনি চেষ্টা করবেন বলে আশ^স্ত করলেন। কিন্তু আশ^স্ত হতে পারছিলাম না, কারণ ভিসা রিফিউজের পরও প্রায় মাসখানেক সময় কেটে গেছে। মন্ত্রী মহোদয়ও হতাশ হয়ে বললেন – আমি ওদের সঙ্গে বারদুয়েক কথা বলেছি, এখন যদি ওরা আমার কথা না রাখে কী করতে পারি। আমার ভ্রমণসঙ্গী দুজন চূড়ান্ত হতাশায় নিমগ্ন। আমার মধ্যেও যে হতাশা কাজ করেনি, তা নয়। তবে আমি শেষ পর্যন্ত হাল না ছাড়ার পক্ষে। ওদের বললাম, ধরে নাও আমাদের যাওয়া হচ্ছে না, তবে আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব।  শেষ পর্যন্ত আমরা ভিসা পেতে এবং কোরিয়া ভ্রমণে যেতে সমর্থ হয়েছিলাম আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয়জন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সহায়তায়। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আগেই বলেছি ১ ডিসেম্বর অতঃপর মাধো নাটকের প্রদর্শনীর তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল সিউলের হাইয়েহওয়া আর্ট স্পেসে। আয়োজকরা আমাদের ২৯ নভেম্বর সিউলে উপস্থিত থাকা এবং ৩০ নভেম্বর টেকনিক্যাল মহড়া করার কথাও জানিয়ে রেখেছেন আগের থেকে। অতঃপর মাধো নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক হওয়ার কারণে অভিনয়শিল্পী শারমিন সঞ্জিতা খানম পিয়া ও শামীমা আক্তার মুক্তাকে সঙ্গে নিয়ে কিডপাফে যোগ দেওয়ার জন্য ২৮ নভেম্বর সকালে আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। কলকাতা হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণটি সম্পর্কে আগেই বলেছি। তবে আরো একটি কারণ আছে। সেটাও বলা জরুরি। ১৯ নভেম্বর হাওড়ায় অতঃপর মাধো নাটকের একটি শো হয়েছিল। একই মঞ্চে সেদিন শ্রম্নতিনাটক পরিবেশন করেছিলেন আকাশবাণীর বেতারনাটকের প্রবাদপুরুষ জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু। সেখানেই অতঃপর মাধোর শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয়, আলাপ ও জানাশোনা। সেই সুবাদে ২৮ তারিখ দুপুরে ‘তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁরা। অতবড় মানুষ, তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাওয়ার ব্যাপারে আমার একটু সংকোচ বোধ হলেও তা উবে গিয়েছিল তাঁদের বাড়িতে পা রেখে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের আপ্যায়িত করলেন জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু। সেদিন বিকেল পর্যন্ত তাঁদের বাড়িতে আমরা আড্ডাও দিয়েছি
শিল্প-সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে। আড্ডার মধ্যে জগন্নাথ বসু খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন নতুন কোনো কাজ করা যায় কিনা দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে, যেখানে তিনি ও উর্মিমালা বসুও কাজ করতে পারবেন। জানি না এরকম কাজ করার সুযোগ হবে কিনা, তবে তাঁদের আগ্রহ ও অনুরোধে ব্যক্তিগতভাবে আমি সম্মানিত বোধ করেছি।

ওইদিন রাত ২টায় কলকাতা থেকে আমাদের কোরিয়া যাওয়ার ফ্লাইট। আমার সহযাত্রী চারজন খুব সহজে পাড় হয়ে গেলেও কলকাতা ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা আমাকে আটকে দিলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি একবার এই কক্ষে যান তো আর একবার  অন্য কক্ষে যান। শেষ পর্যন্ত এক বড় কর্মকর্তার কক্ষে আমার ডাক পড়ল। নানা রকম জেরা চালালেন তিনি। আমি ট্রানজিট হিসেবে ভারত ব্যবহার করছি সেটা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে কিনা এ নিয়ে তিনি বড়ই চিন্তিত। নানারকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে চললেন, সেইসঙ্গে আমার মোবাইল ফোনের ফটোগ্যালারিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। শেষে অবশ্য আমাকে অনুমতি প্রদান করলেন। এই নাট্যভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল বিচিত্র ও অনন্য অভিজ্ঞতায় ভরপুর। পদে পদে বাধা যেমন আমরা পেয়েছি, তেমনি উতরেও গিয়েছি। সবচেয়ে বড় যে-অভিজ্ঞতা তা হলো – কিডপাফে অংশগ্রহণের কারণে আমাদের বাংলা নাটক যেমন কোরিয়ার দর্শকদের সামনে প্রদর্শনের সুযোগ ঘটেছে, তেমনি আর্জেন্টিনার একটিসহ কোরিয়ার একাধিক নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের।

২৯ নভেম্বর কোরিয়ার ইনচন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন আমরা নামি, তখন স্থানীয় সময় বিকেল প্রায় তিনটা। বিশাল বিমানবন্দর। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে অবতরণ এলাকা থেকে বহির্গমন এলাকায় যেতে মেট্রোরেল ব্যবহার করতে হয়। এয়ারপোর্টের বাইরে আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ‘আইরিস’ নামে এক দোভাষিণী। বিশাল আকারের ঝকঝকে বিএমডবিস্নউ গাড়ি আমাদের নিয়ে ছুটে চলেছে হোটেলের অভিমুখে। দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে ক্ষুধায় আমাদের পেট তখন চোঁ-চোঁ করছে। আগে কখনো চোখে দেখিনি এমন গাড়িতে চড়েও সে খিদেকে সামলানো দায়। গাড়িতে বসে ঝাঁ-চকচকে অত্যাধুনিক সিউল শহর দেখছি আর ভাবছি – হে বঙ্গের ক্ষুদ্র নাট্যকর্মী কখন তোমার পেটে আহার জুটবে আর কী আহারই-বা জুটবে তা কি জানো? আসলেই জানি না। হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা প্রায় সোয়া ছয়টা বেজে গেল। মিষ্টিভাষিণী সুন্দরী দোভাষিণী মিষ্টি করে জানতে চাইল আমরা কি এখন নাটক দেখতে যাব, না কি ডিনার করতে যাব? ডিনার করতে গেলে নাটকটা দেখা হবে না, তাই আমরা পেটে খিদে নিয়েও নাটক দেখতে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলাম। নাট্যকর্মীদের পেটে ক্ষুধা থাকাটাই স্বাভাবিক; কিন্তু ভালো নাটক দেখতে পাওয়ার সুযোগটা আকস্মিক। এই আকস্মিক সুযোগ আমাদের ক্ষেত্রে খুব কম ঘটে বলেই আমরা একে হাতছাড়া করলাম না।  বমুন রো-র হোটেল ফারাওয়ে আমাদের নির্ধারিত কক্ষে ব্যাগ রেখে আমরা তৎক্ষণাৎ রওনা হলাম নাটক দেখতে। ওইদিন সন্ধ্যায় উৎসবে প্রদর্শিত হয় আর্জেন্টিনার নাটক মান্দ্রাগরা সার্কাস। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি নাটক। একজন নারী ও একজন পুরুষ এই নাটকটিতে অভিনয় করেন। তাঁরা গত নয় বছর ধরে এই নাটকটি নিয়ে পাঁচটি মহাদেশের অন্তত ৫০টি দেশে অসংখ্য প্রদর্শনী করে চলছেন। অসাধারণ প্রযোজনা মান্দ্রাগরা সার্কাস। দুজন অভিনয়শিল্পী পুরো দেড় ঘণ্টা তাঁদের অভিনয়শৈলী দিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে রাখলেন। ওঁদের কাজ আর দর্শকদের হাততালি দেখে আমরা একটু ভয় পেয়েই গেলাম। কারণ একদিন পরেই আমাদের নাটক। আমাদের বাংলা নাটক কি দর্শকরা বুঝতে পারবেন? ওঁরা কি আমাদের নাটক সেভাবে গ্রহণ করবেন? নাটকশেষে নৈশ-আহারে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী পানীয় দিয়ে শুরু হয় নৈশভোজ। কোরিয়ার খাদ্যাভাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় না থাকায় মূল ডিশ আসার আগেই স্টার্টার দিয়ে আমাদের পেট ভরে যায়। একের পর এক শামুক-ঝিনুকের বাহারি পদ আসছে; কিন্তু ততক্ষণে আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে বসে আছি। খাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, আমরা বাঙালিরা দ্রুত খাই আর খাওয়ার সময় কথা কম বলি। ওরা আস্তেধীরে খেতে খেতে কথা বলে। অনেক সময় নিয়ে খায়। আর খেতে খেতে পরবর্তী কাজের পরিকল্পনা গুছিয়ে নেয়।

পরের দিন দুপুর ১২টায় মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে আমরা মিলনায়তনে গেলাম। লাইট, সেট ঠিক করা এবং টেকনিক্যাল রিহার্সাল করাই আজ আমাদের কাজ। হলে ঢুকে আমরা বিস্মিত হয়েছি ওদের আয়োজন ও দায়িত্বশীলতা দেখে। অতঃপর মাধো নাটকে আমরা একটি জলচৌকি ব্যবহার করি। জলচৌকিটি নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর নয় বলে সেটার একটি ছবি তুলে আগেই ই-মেইলে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যথাসময়ে মঞ্চের ওপর ঠিক একই রকম একটি জলচৌকি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। একটিবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়নি জলচৌকিটি কোথায়। আমরা যেভাবে নাটকের কাজ করি তার থেকে ওদের কাজের ধরন আলাদা, পুরোপুরি পেশাদারি। দেশের ভেতরেও কোনো শোতে জলচৌকির দায়িত্ব যদি আমাদের কোনো নাট্যকর্মীকে দেওয়া হতো, তাহলেও হয়তো আমাকে বারকয়েক জিজ্ঞাসা করে বা তাড়া দিয়েই তবে জিনিসটি হাতে পাওয়া যেত। ওদের দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা, সততা প্রশংসার দাবি রাখে। আর ওদের কারিগরি দক্ষতা আর সামর্থ্য – সে তো আমাদের ভাবনার বাইরে।

ওইদিন সন্ধ্যায় আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল ওখানকার একটি নাটকের দলের মহড়া দেখার। হ্যামলেট কোলাজ নামের নাটকের পূর্ণাঙ্গ মহড়া দেখাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওদের মহড়াকক্ষে। হ্যামলেট কোলাজ নাটকটি ওফেলিয়ার পারসপেকটিভ থেকে নির্মাণ করেছে ওরা। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্নতর ইন্টারপ্রেটেশনের এ-নাটক অসাধারণ লেগেছে। আরো বেশি অবাক হয়েছি মহড়ায় তাদের একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা দেখে। প্রায় ২০-২২ শিল্পী মিলে মহড়া করছিলেন তাঁরা। মহড়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁদের একজনের মোবাইল ফোনও একটি বারের জন্য বেজে ওঠেনি কিংবা কেউ একটি বারের জন্যও মোবাইল ফোনটি হাতে তুলে নেননি। ওদের ব্যস্ত জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যেও কাজের সময় ওরা কতটা একনিষ্ঠ হলে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা মোবাইল ফোন অফ করে রাখতে পারে তা আমাদের পক্ষে ভাবাও কঠিন। এ-নাটকটি নিয়ে তারা একবার ভারত ভ্রমণ করে গেছে বলেই কিনা জানি না, তবে নাটকের শেষে লালনের গান ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ ব্যবহার আমাদের আরো বিমোহিত করেছে।

পরের দিন অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর ছিল আমাদের নাটকের প্রদর্শনী। ছুটির দিন। বিকেল ৩টায় নাটক। নাটক শুরুর আগে দর্শকদের হাতে ইংরেজি ও কোরিয়ান ভাষায় নাটকের কাহিনিসংক্ষেপ তুলে দেওয়া হলো, যাতে তারা আমাদের সংলাপ না বুঝলেও অন্তত নাটকটি বুঝতে পারে সেজন্য। কোরিয়ার শোয়ের জন্য নাটকে আমরা সামান্য কিছু পরিবর্তন আনলাম। প্রযুক্তিগতভাবে ওরা অনেক দক্ষ। ওদের উঁচুমানের প্রযুক্তি আমাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে ভেবে আমরা আমাদের মতো করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই লাইট ও মিউজিক অপারেট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা জোর দিলাম শারীরিক ও সাত্ত্বিক অভিনয়ের প্রতি। শিল্পীরা তাঁদের সংলাপে মাঝে মাঝে দু-একটি কোরিয়ান শব্দ ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করার প্রস্ত্ততি নিলেন। অতঃপর মাধো নাটক শেষ হয় ‘ও আমার দেশের মাটি’ গান ও কোরিওগ্রাফি দিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো গানটির সঙ্গে কোরিওগ্রাফির একেবারে শেষ সময়ে শিল্পীরা বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করবেন। যাই হোক, দুরুদুরু বুকে শুরু করলেও নাটকশেষে দর্শকদের উচ্ছ্বাস আর হাততালি দেখে মনে হলো আমরা তাদের নিরাশ করিনি। বরং তারা যে আমাদের নাটকটি বেশ পছন্দ করেছে তার আরো প্রমাণ পেলাম নাটকশেষে ‘মিট দ্য ডিরেক্টর’ ও ‘কর্মশালা’ পর্বে নাটকটি নিয়ে তাদের নানা প্রশ্ন ও কৌতূহলে। আমাদের নাটক অতঃপর মাধো যে ওরা বেশ পছন্দ করেছে সে-ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেল পরের দিন সমাপনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে ডেকে আমাদের হাতে ‘স্পেশাল পারফরম্যান্স’ বুক অব অনার প্রদান করা এবং অনুভূতি জানিয়ে আমাকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়ার ঘটনায়।

নাটকশেষে দুই বাঙালি দর্শক আল আমীন জিতু ও বাঁধন কাজী আমাদের নিয়ে বের হলেন রাতের সিউল দেখাবেন বলে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের নিয়ে। পাঁচজনকে নিয়ে ট্যাক্সিতে ঘোরা মানে অনেক খরচের ব্যাপার। আবার বাস বা মেট্রোতে ঘুরতে হলে কার্ড লাগে। ওদের দুজনের কাছে কার্ড থাকলে কী হবে আমরা তিনজন যে কার্ডশূন্য। তাই বলে রণে ভঙ্গ দেওয়ার মানুষ নন জিতু ও বাঁধন। বাঙালির ফাঁক-ফোকর বের করা মেধা কাজে খাটিয়ে ওঁরা আমাদের নিয়ে গেলেন সিউল স্টেশনে। প্রশস্ত ও সুরম্য সিউল স্টেশন দেখে আমরা মুগ্ধ। আরো মুগ্ধ হলাম পুরো সিউল শহরের নিচের মেট্রো যোগাযোগের সুবিশাল ও সুবিস্ত‍ৃ নেটওয়ার্ক দেখে। ওপর থেকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, মাটির নিচেই রয়েছে মেট্রো যোগাযোগের এত সুন্দর ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে কাচে ঘেরা একটি ঘর। সেটা আসলে লিফ্ট ঘর। লিফটে চেপে তিন-চারতলা, কখনো-সখনো পাঁচ-সাততলা নিচে নেমে গেলেই মেট্রোরেলের স্টেশন। ঠিকমতো জানাশোনা না থাকলে গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে হয়। ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গী দুজন দীর্ঘদিন ধরে কোরিয়ায় অবস্থান করার সুবাদে ওদেশের ভাষা ও রাস্তাঘাট সম্পর্কে দারুণভাবে ওয়াকিবহাল। সেদিন  রাতের সিউলের আলোকোজ্জ্বল রাস্তাঘাট, ঝুলন্ত পার্ক দেখে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারিনি। ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান সম্পর্কে তাত্ত্বিক ধারণা জন্মেছিল। এবার সিউলের সুপ্রশস্ত ব্যস্ত রাজপথের ওপরে সুপ্রশস্ত ও সুদীর্ঘ ফুটওভার ব্রিজের ওপর নানারকম ফুল, গাছপালা, লতাগুল্ম, বিশ্রামের ব্যবস্থাসমেত ঝুলন্ত পার্কটি ভ্রমণ করে কিঞ্চিৎ হলেও ব্যবহারিক ধারণা পাওয়া গেল। পরের দিনও আমরা ঘুরে দেখলাম সিউল শহর।

বৃষ্টির কারণে প্রচণ্ড ঠান্ডায় একদিন আমাদের হোটেলে বন্দি জীবন যাপন করতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা তো হোটেলে আবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য কোরিয়ায় অবস্থান করছি না। কোরিয়া থেকে ফেরার আগের দিন অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বরের আবহাওয়াও আমাদের জন্য বাইরে বের হওয়ার অনুকূল ছিল না, কিন্তু আমরা আর ঘরে আটকে থাকলাম না। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ঐতিহ্যবাহী চ্যাঙ্গেওনগ্গাং রাজপ্রাসাদ (Changgyeonggung palace) দেখতে। বিশাল বিস্ত‍ৃত পরিসরের রাজপ্রাসাদের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কিন্ত ক্লান্ত হলে তো চলবে না। যতটুকু সময় হাতে আছে, তা কাজে লাগাতেই হবে, যতটুকু পারা যায় দেখে নিতে হবে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলাম সিউল টাওয়ারে। সে আর এক এলাহি কা-! ট্যাক্সি নিয়ে উঠে গেলাম চার-পাঁচতলার সমান উঁচু পাহাড়ে। সেখান থেকে সিঁড়ি বা লিফটে করে উঠতে হলো আরো তিনতলার সমান উঁচুতে। সেখান থেকে ক্যাবল কারে আরো ছয়-সাততলা ওপরে। সেখানে গিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত চত্বরে দেখা গেল রং-বেরঙের লাখো-কোটি তালা। প্রেমেপড়া যুবক-যুবতীরা নাকি অচ্ছেদ্য প্রেমাকাঙক্ষা থেকে এখানে এসে তাদের মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্য তালা লাগিয়ে যায়। আহা আমিও যদি একটা তালা লাগিয়ে আসতে পারতাম! যাই হোক, এই বয়সে সেটা আর শোভন নয়। বরং যেটা শোভন, তা হলো ওই বিশাল চত্বরে বসে কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত উপভোগ করা। বিশাল মুক্তমঞ্চ জুড়ে দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কোরিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক আয়োজন উপভোগ করার। প্রথমে আমরা ওদের বাদ্যগীত সহযোগে সার্কাসটিক পরিবেশনা উপভোগ করি। এরপর শুরু হয় ‘নামসান বঙ্গুসদিয়া’। এটি কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী একটি পারফরম্যান্স। কোরিয়ানদের শৌর্যবীর্য ও যোদ্ধাজাতির ঐতিহ্যধারী এই পরিবেশনা দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ। একসঙ্গে বেশ কজন পারফরমার বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে অস্ত্রহাতে যোদ্ধার বেশে এসে পুরো চত্বরে নানা রকম মনোমুগ্ধকর যুদ্ধকৌশল দেখিয়ে আমাদের বুঁদ করে রাখেন  প্রায় ৩০ মিনিট। এরপর আমরা যাই মূল সিউল টাওয়ারে। লিফটে করে আরো কত তলা ওপরে উঠেছিলাম বলতে পারব না, তবে টাওয়ারের ওপর থেকে যখন পুরো সিউল শহর দেখতে পাচ্ছিলাম, তখন এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি হলো।

সিউল টাওয়ার ঘুরে দেখা শেষে সন্ধ্যায় আমরা চলে এলাম ওদের নাটকপাড়ায়। নাটকপাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেয়ে গেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। জানা ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ একবার সিউলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর একটা আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। ঠিক কোন জায়গায় আবক্ষ মূর্তি রয়েছে তা জানা ছিল না বলে আমাদের মনে একটু খেদ ছিল। আমাদের মনের খেদ দূর করতেই রবীন্দ্রনাথ যেন আমাদের পথের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় এসে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর আবক্ষ মূর্তিতে দেখতে পেয়ে কী যে আনন্দ পেলাম তা বলার মতো নয়। আমাদের অতঃপর মাধো নাটকটি তাঁর সাহিত্য ও কর্ম-অনুপ্রাণিত একটি নাটক। সেটি নিয়ে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ায় এসেছি। তাই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বললাম, গুরুদেব আপনার মাধোকে আশীর্বাদ করুন যেন সে পথচলাতে আনন্দ খুঁজে পায়।

যা হোক রবীন্দ্রনাথকে দেখার আনন্দ নিয়ে আমরা হাজির হলাম ‘অর্ক ন্যাশনাল থিয়েটার’ কমপেস্নক্স প্রাঙ্গণে। অনন্য স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এখানকার মুক্তমঞ্চ দেখে আমরা অভিভূত। আর আমাদের আক্কেলগুড়ুম হলো যখন জানতে পারলাম, ওই এক এলাকাতেই প্রায় একশ সত্তরটি থিয়েটার আছে আর পুরো সিউল শহরে রয়েছে প্রায় চার হাজার থিয়েটার। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের সুযোগ হয়েছিল   একটি কোরিয়ান দলের ফাইন্ডিং মি. ডেসটিনি নামের একটি নাটক দেখার। নাটকটি ভারতের প্রেক্ষাপটে রচিত। প্রেম, রোমান্স, ড্রামা, নাচ-গান মিলিয়ে একটি জমজমাট এবং উপভোগ্য নাটক। সামান্য দেখাশোনা থেকে কোনো তুলনামূলক আলোচনা করা ঠিক নয়, তারপরও স্বীকার করতে হয় যে, কোরিয়ার নাটক সাংঘাতিক রকম পেশাদারি। ওদের প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার আমাদের কল্পনারও বাইরে। ওদের সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ প্রশংসনীয়। আর একটা কথা না বললেই নয় – ওদের প্রায় প্রতিটি নাটকের দলের রয়েছে নিজস্ব মহড়াকক্ষ ও মিলনায়তন। এগুলোর প্রায় সবকটিই আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে। তবে একটা বিষয়ে একটু না বললেই নয়। ওদের জীবনযাত্রার তুলনায় ওদের থিয়েটার চর্চার জায়গাগুলো যদিও কেমন একটু অনুজ্জ্বল; তবে আমাদের জীবনযাত্রার তুলনায় আমাদের থিয়েটার যেমন একেবারেই অনুজ্জ্বল, তেমন নয়। আর ওদের দেশে থিয়েটারে যেটুকু পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়, সেটা সামান্য হলেও আমাদের দেশের মতো একবারে শূন্য নয়।

সবশেষে বলতে হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার সবকিছু এত গোছানো ও সযত্নে সংরক্ষিত, যা আমরা ভাবতেই পারি না। সব যেন ছবির মতো ঝকঝকে, চকচকে, গোছানো। কোনো মলিনতা নেই। মানুষগুলো সাহায্যপ্রবণ ও সৎ। ভাষার সমস্যা থাকলেও মানুষগুলোর মধ্যে কোনো ভণিতা নেই। সব মিলিয়ে সিউল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করে রাখবে।