অদল-বদল

কী  বলেন মশাই! মানুষ এমন কাজ করতে পারে?

– প্রেমিকাকে না পেলে মানুষ অনেক কিছুই পারে। মানুষ খুন তার কাছে তুচ্ছ।

– তাই বলে এক গোয়াল-গরু পুড়িয়ে মারবে?

– ব্যর্থ প্রেমিকের মাথায় খুন চাপলে মানুষও যা গরুও তা।

– প্রেমিকাকে পেল না বলে প্রেমিকার বাবার গোয়ালে আগুন দেবে? অবলা প্রাণীর এতে কী অপরাধ? মানুষ কখনো এমন কর্ম করতে পারে না।

– ধুর মশাই। আপনি ব্যাপারটা বুঝতেই চাচ্ছেন না। পারে পারে, মানুষ সব পারে। কী পারে না বলুন তো? এখন এটা করছে বলে অবাক হচ্ছেন, পরে হবেন করছে না বলে।

– মানে?

– আপনি দেখছি অনেক সহজ-সরল মশাই। কদিন বাদে দেখবেন আপনিই অবাক হবেন, যখন শুনবেন ধর্ষক ছেলেকে বাপ মেরেছে অথচ ছেলে বাপকে মারেনি। মাথা নিচু করে মার খেয়েছে। তখন আপনিই কপালে ভাঁজ ফেলে বলবেন, এটা কখনো হয়!

– আপনার কথায় বড় ধোঁয়াশা।

– তা ধোঁয়াশা মনে করলেই ধোঁয়াশা। শোনেন, মানুষকে অতটা সহজ হতে নেই। এই যে আমাকে দেখছেন না। কী মনে হয়? খুব ভালো মানুষ। ধোয়া তেঁতুলের আঁটি? আমার দ্বারা খারাপ কর্ম হতেই পারে না?

– না, তা নয়। তবে ডাকাতও মনে হয় না।

– এই তো ঠিক যা ভেবেছিলাম। প্রথম থেকেই মনে কেমন খটকা ছিল। আপনার মুখের গড়নের ওপারে আর একটা গড়ন আছে। আপনি অতটা সহজ নন। ধাক্কা দিয়ে কথাও বলেন দেখছি। শোনেন, সব মানুষের মধ্যেই দুইটা দিক থাকে; ভেতর আর বাহির। এই যে আপনি ভালো চেহারার মানুষটি, আপনার মুখ দেখে কি কেউ বলতে পারবে, আপনি এমন একটা কাণ্ড বাধানো মানুষ?

– মানে?

– না না চমকে উঠবেন না। একটু আগে তো সবই শুনলাম আপনার কথা। আপনি একজন হিন্দুঘরের ছেলে তার ওপর দুই ছেলের বাপ। এই বয়সে প্রেম করলেন মুসলমান এক মেয়ের সঙ্গে। তাও আবার অবিবাহিত কলেজে পড়া তরুণী। ধরা খেলেন, বিয়েও করলেন। তাকে সিঁদুর পরালেন, পূজা-অর্চনাও করালেন। একটা পুকুর, দুই বিঘা কাদরে জমিও লিখে দিলেন। আজ আবার সেই জমির মোকদ্দমা নিয়েই এই ভূমি অফিসে ছুটছেন। এখন আপনিই বলুন, আপনার মতো সহজ-সরল গড়নের মানুষটার মধ্যে অমন একটা ভয়ংকর মানুষ লুকিয়ে আছে, কেউ বিশ্বাস করবে?

– ভয়ংকর কি না জানি না দাদা, তবে পাপী। পাপের মাশুল এখন দিচ্ছি। না হলে এমন সর্বহারা হই?

– সর্বস্বই বটে। পিরিতের বউ গেল, সম্পদ গেল। আবাদি জমি গেল, পুকুরও গেল।

– কে জানত এমনটি হবে। ভাবলাম, মেয়েটি ধর্ম হারাল, বাপ-মা, আত্মীয়পরিজন হারাল; কিছু একটা তো নিয়ে থাকতে হবে। তাই ওগুলো দিয়েছিলাম।

– মেয়েটি বোধহয় অত কিছু চায়নি। আপনি একটু বেশিই দিয়েছিলেন মশাই।

– কী জানি, কী চেয়েছিল!

– আচ্ছা দাদা, আপনাদের শুরুর গল্পটা একটু বলবেন? শুনতে খুব ইচ্ছা করছে।

– সে অনেক কথা, থাক ওসব।

– অনেক হলে থাক। তবে আপনারা একসঙ্গে মিলতেন কী করে? মানে চাকুম চুকুম হতো কোথায়?

– সে আমার ফার্মেসিতেই হতো, মানে দোকানঘরে। মোড়ের বাজারে আমার একটা ফার্মেসি আছে।

– দোকানঘরে!

– দোকানঘরে, মানে তার চাতালে। আমার দোকানঘর ছিল দেড়তলা। মই দিয়ে ওপর তলাতে, মানে চাতালে ওঠা যেত। সেখানেই আমরা প্রায়দিন দুপুরের আগে ঠুস করে উঠে যেতাম।

– ঠুস করে উঠে যেতেন? এ যে বনবিড়াল কাহিনি।

– ঠিকই বলেছেন দাদা। অল্প আলো-আঁধারীতে বনবিড়ালই মনে হতো। প্রতিমার চোখ জ¦লজ¦ল করে জ¦লতো।

– আপনারটা আরো বেশি জ¦লতো।

– প্রতিমা অবশ্য তাই-ই বলতো।

– প্রতিমা কি আপনার দেওয়া নাম।

– হ্যাঁ। আগে ছিল শরিফা খাতুন।

– এমন প্রেম-কাহিনি এর আগে শুনিনি দাদা। দোকানঘরে প্রেম। তাও আবার চাতালে। নিচে গণেশ, ওপরে ধনেশ।

– ঠিক বলেছেন দাদা। পিলে চমকে দিলেন এতক্ষণে।

– কী বলেন? এত ঠুনকো তো আপনার পিলে নয়? মুসলমান মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে যার পিলে কাঁপে না, তার কি না আমার কথাতেই পিলে চমকালো।

– না মানে আপনি বললেন না, নিচে গণেশ, ওপরে ধনেশ। আপনার কথাতে এখন মনে হলো, আমরা চাতালের যে কোনাতে আকামটা করতাম, তার নিচেই ছিল গণেশ ঠাকুর।

– তাতে কী, আপনার প্রেমের গণেশ তো আর উল্টেনি? সে বোধহয় আপনাদের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসতো।

– গণেশ উল্টেনি বলছেন? যেখানে জীবনেরই গণেশ উল্টে গেল!

– এ আবার কেমন কথা।

– এটাই আসল কথা দাদা। একটা চার বিঘের আস্ত পুকুর লিখে দিলাম, ধানিজমি লিখে দিলাম দু-বিঘে।

– যা বাবা! জীবনই যেখানে লিখে দিলেন সেখানে অন্যকিছু তো কোন ছার। অবশ্য শরিফাও জীবন, ধর্ম সবই দিলো। তবে বড়ই রসিক আপনি। একটা ছোট্ট পুকুরের জন্য চার বিঘের পুকুর? এটা একটু বেমানান।

– ঠাট্টা করছেন? করুন। হাতি কাদায় পড়লে চামচিকেও টালা মারে।

– তা চামচিকে আমায় ভাবতেই পারেন। তবে আপনি হাতিই বটে। কলিজা আছে। না হলে একটা মেয়েকে ধর্ম বদলিয়ে বিয়ে করতে পারেন?

– সত্যি কথা বলতে কী, সে যখন পূজার ডালা সাজিয়ে মন্দিরে যেত, তখন মনেই হতো না কদিন আগে সে বোরখা পরত, নামাজ পরত। সিঁদুর পরে যখন আমার বাইকের পেছনে বসিয়ে আমরা দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াতাম, সবাই অবাক হয়ে তাকাত। আমি তখন ঋত্বিক হয়ে ধুলা উড়িয়ে টান দিতাম।

– ধুলা তো উড়াবেনই। যার পেছনে ঐশ^র্য বা ক্যাটরিনা। এ যে প্রতিমা পিছনে বসিয়ে প্রতিমা দেখতে বের হওয়া। তা প্রতিমার হাত আপনার কাঁধে থাকত নাকি বগলের তল দিয়ে আঁকড়ে থাকত? নিশ্চয় বগলের তল দিয়ে থাকত?

– নুন ছিটাতে ভালোই পারেন আপনি। তবে মিথ্যা বলব না দাদা, তার বুকের ডান অংশ আমার পিঠে এমনভাবে ঠেসে থাকত, এখনো আনমনে সেখানে হাত দিলে যেন বুঝতে পারি। শিরশির করে ওঠে সারা শরীর।

– আপনার কথা শুনে আমারই তো গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।

– তাহলেই বুঝুন, জমি, পুকুর লিখে দিয়ে ভুলটা আমি কী করেছি?

– তাহলে ফেরত নেওয়ার জন্য এখন উঠেপড়ে লেগেছেন কেন?

– লাগব না মানে? সে যে নাই, চলে গেছে?

– কী বলছেন মশাই! এটা তো শুরুতে বলেননি?

– তা আর বলতে দিলেন কই। শোনার চেয়ে ছটফটানিই আপনার বেশি।

– এ দোষ আমার আছে। অনেকেই বলে। এবার তাড়াতাড়ি বলুন। প্রতিমা কি আবার শরিফা হয়ে গেল?

– শরিফা না সখিনা হয়েছে জানি না দাদা। সে এক মুসলমান ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে।

– মানে যেই লাউ সেই কদু? ছেলেটা কি আপনার পাশের বাড়ির?

– না দাদা, সে বগুড়ার।

– বগুড়ার! তার সঙ্গে মিলল কী করে?

– যারা পারে তারা সবখানেই পারে। যেমন আমার সঙ্গে পেরেছে। অবশ্য এই ক্ষেত্রে নিজেকেও দোষ দিই আমি।

– মানে?

– হ্যাঁ দাদা, বিশ হাজার টাকার একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলাম। সেটা নিয়েই পড়ে থাকত সারাক্ষণ।

– তাহলে বিশ হাজার টাকার মোবাইলই আপনার বিষ মেরেছে। তা আপনি কিছু টের পাননি?

– আমি আসলে খেয়ালই করিনি। ভেবেছিলাম সব হারানো মেয়ে মোবাইল নিয়ে যদি কিছু আনন্দে থাকে থাকুক না।

– তা জমির ব্যাপারে কিছু আগালো?

– নায়েব মশাই তো আশ^াস দিয়ে রেখেছে। কিছু একটা করবেন। একটা চুক্তিও হয়েছে। এক লাখ টাকা আগাম দিয়েও ফেলেছি।

– আমার মনে হয় না কিছু করতে পারবেন?

– ওভাবে বলবেন না দাদা।

– ছি ছি, কাঁদবেন না। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। অমন জমি কত যাবে-আসবে।

– আমি জমির জন্য কাঁদিনি দাদা।

– তাহলে প্রতিমার জন্য?

– নাহ্, ওই মুখপুড়ির জন্য কাঁদব কেন? কাঁদছি নিজের জন্য।

– এবার চলেন উঠি। স্যারদের মিটিং বোধহয় শেষ হলো।

– না দাদা, আপনিই যান। আমি আরো কিছুক্ষণ বসে

থাকব। তলা ফাটা শিব নদের ধারে আর কিছুক্ষণ থাকি। নদীতে পানি না থাকলেও বাতাসটা বেশ ঠান্ডা।

– আচ্ছা, যা বোঝেন।