অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কবে প্রথম আলাপ হয়েছিল আজ এতদিন পরে আর মনে পড়ে না। মনে হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের হলে আয়োজিত মকাইসের (মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স) একটি কনফারেন্সে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়। ওঁর বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়েছিলাম। মনে আছে সুললিত স্বচ্ছন্দ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। লাঞ্চ ব্রেকে আলাপ হলো ওঁর সঙ্গে। আমার স্বামী সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল অধ্যাপকের। এমন আপনার মতো করে, যেন কতদিনের পরিচয়, এমনভাবে কথা বললেন।
কনফারেন্সের শেষ দিনে আমি একটু আগে বেরিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে সম্ভাষণ, ‘চলে যাচ্ছেন আপনি?’ ফিরে দেখি আনিসুজ্জামান সাহেব সহাস্যে দাঁড়িয়ে। আমার একটু তাড়া আছে বলতে ওয়ালেট থেকে কার্ড বের করে দিলেন, বললেন, ‘ঢাকায় এলে নিশ্চয়ই দেখা করবেন।’ সেই-ই পরিচয়ের শুরু। ওঁর নামের সঙ্গে পরিচয়, ওঁর পাণ্ডিত্যের কথা জানা কিন্তু অনেক আগে থেকেই ছিল।
বলা হয়নি, আমার বন্ধু মালেকা বেগমের কাছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা বহুবার শুনেছি আগে। মালেকার গবেষণার সুপারভাইজার ছিলেন তিনি। এবং কেমনভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় ও কীভাবে সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হয়, নিবিষ্টভাবে মালেকাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। খুবই আকৃষ্ট হয়েছিলাম ওঁর এই পদ্ধতিতে। মালেকা আমাকে ওঁর লেখা মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বইটি এনে দিয়েছিলেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ চেনাজানা হলো আরেক কনফারেন্সে। সেবারে কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের বার্ষিক অধিবেশন ছিল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের তমলুক শহরে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমন্ত্রিত হয়েছিলেন মুখ্য বক্তা হিসেবে, সভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও সুপরিচিত ঐতিহাসিক অনিরুদ্ধ রায়। আনিসুজ্জামান সাহেব ও অনিরুদ্ধ রায় বহুদিনের বন্ধু। আনিস ও অনি বলে পরস্পরকে সম্বোধন করছিলেন দুজনে। একটি বড় গাড়িতে আমরা পাঁচজন কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিলাম। বড় উপভোগ্য হয়েছিল সেই যাত্রা। দুই বন্ধু এ ওঁর সঙ্গে পেছনে লেগে, ইংরেজিতে যাকে বলে লেগ-পুলিং এবং খুনসুটিতে আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। তমলুকে এক ভারি সুন্দর বড় বাংলোতে আমরা ছিলাম। সন্ধ্যায় আড্ডা বসল। মধ্যমণি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমাকে সেবার মধ্যযুগের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি করা হয়েছিল। গুরুদায়িত্বের ভারে আমি ভারাক্রান্ত, যে-প্রবন্ধ পাঠ করতে হবে তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। প্রবন্ধটি বারেবারে ঘষামাজা করছি। মনে আছে, একসময় আড্ডা থেকে উঠে গিয়ে আমি লাউঞ্জে এসে আবারো প্রবন্ধটি নিয়ে কাটাছেঁড়া করছি এমন সময় আনিসুজ্জামান সাহেব উঠে এলেন, বললেন, ‘দেখুন তো আমরা কেমন আসর জমিয়ে বসেছি আর আপনি একলা বসে কাজ করছেন।’ আমি অবাক এবং খুবই আপ্লুত হলাম। একজন ব্যক্তি আনন্দ থেকে বাদ পড়ে আছে এই ব্যাপার তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি।
পরের দিন ওঁর বক্তৃতা। এবারে বাংলায় শুনলাম। অসম্ভব সুন্দর বললেন। একটা বিষয় লক্ষ করেছিলাম, বক্তৃতায় তাঁর পরিমিতিবোধ, শব্দচয়ন অসাধারণ। সময়ের বাইরে যাননি। বরঞ্চ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করেছিলেন। আর সঠিক শব্দ নির্বাচনের বাক্যবন্ধে স্পষ্ট বক্তব্যে ভাষণ অনবদ্য হয়ে উঠেছিল।
দুপুরে আমার প্রবন্ধপাঠ। দুরুদুরু বক্ষে দেখলাম প্রথম সারিতেই বসে আছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমার পুরো প্রবন্ধই শুনলেন। প্রশ্নও রেখেছিলেন। ভুল শুধরে দিলেন একটি, বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্যের সন ১৪৯১ বলে আমি ভুল করেছিলাম, তিনি সঠিক সনটি বলে দিলেন – ১৪৯৫। সেদিন সন্ধ্যায় আমার নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ। আর বক্তৃতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। নানা কথায়, অনিরুদ্ধবাবু এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সভা উজ্জ্বল করেছিলেন। এর ফাঁকে আমি আমার পিতৃপুরুষের আদিগ্রাম সোনারংয়ের কথা তুলেছিলাম। আর আমার মার প্রিয় বাসভূমি ঢাকার কথা উঠল। কথা প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম – আমার দাদামশাই, মায়ের বাবা, স্বামীবাগে ঢাকার বিখ্যাত গুহঠাকুরতা পরিবারের ‘অশ্রুকণা’ নামে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন। মার মুখের গল্পে অশ্রুকণা বাড়ির গোল বারান্দার, সন্ধ্যায় নিচের বাগান থেকে ভেসে আসা সদ্য ফোটা রজনীগন্ধার সুবাসের, বাগানের পেয়ারাগাছের কথা বহুবার শুনেছি। সেসব কথাই বলছিলাম উচ্ছ্বসিত হয়ে। হঠাৎ দেখি আনিসুজ্জামান মৃদু হাসছেন। এবং কী আশ্চর্য! জানা গেল সেই বাড়ি এখনো আছে এবং তাঁর শ্যালক বাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন। আমাকে কথা দিলেন আমি ঢাকায় গেলে আমাকে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন দেখাতে।
ঢাকা যাওয়া হলো ২০০৬-এ। ওঁর দেওয়া কার্ড হারিয়ে ফেলেছি, ভুলে গেছি অশ্রুকণার কথা। উঠেছি হোটেলে কিন্তু অধ্যাপক আখতার ইমামের দাবিতে ছয়দিনের বাসকালে প্রত্যেকদিনই সকাল বিকেল সন্ধ্যা, যে-কোনো সময়ই হোক না কেন ওঁর কাছে যেতেই হবে। ওদিকে হামিদাদিদি, অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের বাড়িতেও যাওয়া চাই শুধু একদিন নয় , একাধিক দিন। আমি যেখানে পড়াতাম সেই বেথুন কলেজের প্রাক্তনী দুজনেই। কলেজের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুজনেই কলকাতা এসেছিলেন আমন্ত্রণে। বিখ্যাত ও কৃতী প্রাক্তনী হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল ওঁদের। আমার ওপর ওঁদের দাবি তো মানতেই হবে। খুবই আনন্দে আছি। সেগুনবাগিচা থেকে বনানী ঘুরে বেড়াচ্ছি। আখতারদিদির বারণ সত্ত্বেও একদিন লালবাগ দেখে এলাম। এরই মধ্যে তাল তুললাম সোনারং যাব। আবারো আখতারদিদি বারণ করলেন, যেতে দেবেন না। তারপর নিজেই ‘পর্যটনে’র গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। যাওয়ার আগের দিন ওঁরই পরিচিত হবিবুল্লা সাহেব আমাদের খাওয়াতে নিয়ে গেছেন ঢাকা ক্লাবে। সেখানে দেখা হলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আর আমার অবধারিত মনে পড়ে গেল অশ্রুকণার কথা। বললাম, নিয়ে যাবেন না দেখাতে? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘ঠিক আছে ঘুরে আসুন, হবে নিশ্চয়ই।’ যেদিন সোনারং যাব সেই সকালে ফোনে বললেন, ‘আজ বিকেলে আপনার হোটেলে যাব, তুলে নেব আপনাদের।’ আমি তখন ভাবছি কতদূরে সোনারং গ্রাম, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া মরীচিকার মতো, ধরা কি যাবে? ফিরতে পারব কি? কে জানে কখন ফিরব! তবু সময় ঠিক হলো। এবং সেই সময়ের অনেক আগেই আমরা ফিরে এসেছিলাম। আনিসুজ্জামানও সঠিক সময়ে এলেন। গাড়িতে যেতে যেতে সোনারংয়ের গল্পে আমি উচ্ছ্বসিত। কী সুন্দর, সমৃদ্ধ গ্রাম, কি আপ্যায়ন, কি অভ্যর্থনা আমাদের জন্য, বারবার আমাকে ‘গ্রামের মেয়ে’ বলে উল্লেখে আমার উচ্ছ্বাস আর থামে না। ওঁর শ্যালকের বাড়ি, আমার ইপ্সিত অশ্রুকণাতে পৌঁছেও গল্পের শেষ নেই। এখানেও কি অভ্যর্থনা আর আতিথেয়তা। চায়ের নিমন্ত্রণ, কিন্তু আয়োজন ভোজের। পরিপূর্ণ দিনটি আমার স্মৃতিতে একটি নিটোল মুক্তোর মতো ধরা হয়ে রইল। একই দিনে আমার পিতৃকৃত্য আর মাতৃকৃত্য সম্পন্ন হলো। আর মাতৃকৃত্য সম্পন্নে প্রধান ভূমিকা নিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভোজের আসরে যখন আমি উচ্ছ্বসিত সোনারংয়ের গল্প করে যাচ্ছি, মনে আছে আবারো সেই মৃদু হাসিতে বলেছিলেন অধ্যাপক সাহেব – ‘সারা বাংলাদেশের ন্যাশনালিজম একরকম আর সোনারংয়ের ন্যাশনালিজম ওরই ভেতর আলাদা একরকম।’ কথাটা মনে গেঁথে রইল। কোনোদিন ভুলব না।
বহুবার দেখা হয়েছে এরপর, কখনো ঢাকায়, কখনো কলকাতায়। আনিসুজ্জামান, আনিসদা হয়ে গেছেন কখন! আমার স্বামী প্রথম থেকেই আনিসদা বলতেন, কলকাতার অন্তরঙ্গ সকলের কাছেই তিনি আনিসদা। আমি একটু সংকোচ বোধ করতাম। অতবড় অধ্যাপক, পণ্ডিত মানুষ তায় বন্ধু মালেকার সুপারভাইজার! অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখতে গেলাম গুলশানের বাড়িতে। তার আগে ক্যালকাটা ক্লাবে একটি রাতের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল, সেখানে প্রথম বেবীদির সঙ্গে আলাপ হলো। এমন চমৎকার মানুষ! আমার ছেলের বিয়েতে আসতে পারেননি, পরে কলকাতায় যখন এলেন আমাদের বাড়িতে এলেন। রাতের খাওয়া খেয়ে গেলেন। উপহার দিলেন ওঁর লেখা দুটি বই। সে-বছরই তিনি ভারত সরকার-প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার পেলেন। আমার পুত্র খুবই উত্তেজিত এমন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়ে; আরো একটি উপভোগ্য সুন্দর সন্ধ্যা সঞ্চিত হয়ে রইল মনের ভেতরে। ঢাকা ক্লাবের দুপুরের লাঞ্চে মালেকার সঙ্গে আমরাও – তিনি আমন্ত্রণ করেছিলেন। এরই মধ্যে ২০১৭-তে কলকাতায় দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার পেলেন তিনি। খুবই অসুস্থ ছিলেন। হুইলচেয়ারে নিয়ে আসা হয়েছিল। অল্প সামান্য কথা হয়েছিল। পুরস্কারপ্রাপ্তির পর সামান্যই বললেন। কিন্তু যেটুকু বললেন মনে রয়ে যাওয়ার মতো।
শেষবার দেখা হয়েছিল কলকাতায় ২০১৮-তে। বেবীদিও ছিলেন। উঠেছিলেন গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের অতিথিনিবাসে। আমরা একসঙ্গে মার্কোপোলো রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। ওনাদের অতিথি নিবাসের কাছেই। একাধিকবার খেয়েছি ওখানে ওঁকে নিয়ে। ওঁর পছন্দের জায়গা ছিল মার্কোপোলো। শরীর ভালো ছিল না। খানিক অবসন্ন লাগছিল ওঁকে। খুবই অল্প খেলেন। বেবীদি বিবেকানন্দের একটি বই দিলেন আমাকে, বললেন, ‘আমার খুব ভালো লাগে পড়তে, মন শান্ত হয়, তুমি পড়ো, আমি আবার কিনে নেবো।’ সেই শেষ দেখা।
২০১৯ সালে আমার একটি বই পাঠিয়েছিলাম, ঢাকায় একজন পরিচিত যাচ্ছিলেন তাঁর হাত দিয়ে, মালেকার সঙ্গে দেখা করবেন তিনি, মালেকাকে বলেছিলাম একটু পৌঁছে দিতে। কিছুদিন পরে ফোন করে জানালেন ভালো লেগেছে লেখা। আরো বললেন, বইটিতে স্বামীবাগের উল্লেখ আছে। ওই শেষ কথা।
খুব যে ঘনঘন দেখা হতো ওঁর সঙ্গে তা নয়। ব্যস্ত থাকতেন। সবসময় যোগাযোগ হতো, তাও নয়, তবু কলকাতায় এলে সময় পেলে ফোন করতেন। নামকরা বিখ্যাত ব্যক্তিরা ঘিরে রাখতেন তাঁকে। সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমাদেরও মনে রাখতেন। আমি, আমরা ঢাকায় গিয়েছি কম। তবু শেষের দিকে যতবারই গেছি দেখা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে একসঙ্গে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জমানের বেশভূষায় অনন্যতা ছিল। নিজস্ব পোশাকে বিশিষ্ট ছিলেন তিনি। আবার স্যুট-জ্যাকেটেও দেখেছি তাঁকে, বিশেষ অন্যরকম লাগত।
পরিহাসপ্রিয়, বাকনিপুণ, মার্জিত ও পরিশীলিত, মনস্বী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। পৃথিবীতে এ-ধরনের মানুষ ক্রমশই বিরল হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু বড় নিষ্ঠুর, বড় অবধারিত। একজন মানুষের মৃত্যু মানে অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা একনিমিষে হারিয়ে যাওয়া। আর আনিসুজ্জামানের মতো জ্ঞানী, পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ মানুষের মৃত্যু যেন একটি গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো। কতকিছু সঞ্চিত ছিল তাঁর মনে, তাঁর ভাবনায়। অকস্মাৎ সব হারিয়ে গেল। লেখা রেখে গেছেন। তাঁর চিন্তা প্রকাশিত আছে অমূল্য বইগুলিতে। তবু আফসোস থেকে যায়, আরো তো কিছু পাওয়া যেত তাঁর কাছ থেকে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.