সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শফিক হাসান
সালেহা চৌধুরী লিখছেন প্রায় ষাট বছর ধরে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, কলাম, কবিতাসহ বিচিত্র তাঁর লেখার ভুবন। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে স্বামীর সঙ্গে ব্রিটেনে পাড়ি জমান। তারপর সেখানেই গড়ে ওঠে সালেহা চৌধুরীর সেকেন্ড হোম। লন্ডনের একটি স্কুলে পড়াতেন। অবসরে যাওয়ার পর থেকে নিয়ম করে বছরের অর্ধেকটা সময় প্রবাসে আর বাকি অর্ধেকটা বাংলাদেশে বসবাস করছেন। বইমেলা তাঁকে টানে। তাই বইমেলার সময় দেশে থাকা চাই-ই।
নিজের জীবন, ফেলে আসা দিন, সৃষ্টিভুবনের নানা বিষয়ে কথা বলেছেন সালেহা চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিক হাসান।
ব্রিটেন-বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক আপনি। ব্রিটেনে যেতে হয়েছিল কেন?
আমার স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বিদেশে পড়াশোনার স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। সেটা ছিল পুরো পরিবারকে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার স্কলারশিপ। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের প্রভাষক। আমরা সকলে একসঙ্গে বিদেশে এক বছরের জন্য যাব বলে ছুটি নিলাম। তারপর পুত্র ও কন্যাসহ আমরা বিদেশে গেলাম। এক বছর পড়াশোনার পর তিনি একটি চাকরির অফার পান। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ওদেশে কাজ পেলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের। বললেন – কিছুদিন কাজ করার পর হাতে টাকা জমলে পুরো ইউরোপ ভালোমতো দেখে তারপর দেশে যাব। দেশের চাকরির ছুটি বাড়ানো হলো। কিন্তু আমাদের আর দেশে যাওয়া হলো না। ওখানেই আরো কিছুদিন থাকার কথা ভাবতে শুরু করলাম। সেই থাকা এখন তেপান্ন বছর।
প্রবাসে কঠিন জীবনযাপন করেও লিখেছেন শতাধিক বই। লিখেছেন ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য। অনুবাদও করেছেন প্রচুর। কীভাবে এত কর্মযজ্ঞ সম্ভব হলো?
বিদেশে যাওয়ার আগে দেশে নানা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতাম। দুটো বইও প্রকাশিত হয়েছিল। একটা ছোটগল্পের বই যখন নিঃসঙ্গ ও প্রবন্ধের বই সাহিত্য প্রসঙ্গে। ওদেশে গিয়ে লেখালেখি বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেমেয়ে ছোট, তাদের স্কুল, আমার চাকরি, বাড়িঘর সামলানো, বাড়ি কেনা সবকিছু নিয়ে এত ব্যস্ত, লিখব কখন? বাহাত্তর সালে ওদেশে গিয়েছি এরপর আঠারো বছর তেমন কিছু লেখা হয়নি। বই তো দূরের কথা। একবার আমার বড় ভাই চিঠি লিখলেন – একটা প্রিন্টিং মেশিন কিনেছি। বই দে। ছাপিয়ে দেব। এরপর আবার লিখতে শুরু করলাম। ১৯৯০ সালে একটি গল্পের বই বের হলো – উষ্ণতর প্রপাতে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে। আমিও শিখে গেছি কেমন করে নিজের জন্য একটু সময় বের করা যায়। সেই যে শুরু হলো তারপর ক্রমাগত লিখে চলেছি। বিরতিহীনভাবে। রাত জেগে, নিজের জন্য সময় বের করে। ওখানে স্কুলে কাজ করতাম। ছুটিছাটা পেতাম। জানি না কেমন করে এতগুলো বই হলো। সবকিছুই রহস্য।
মৌলিক লেখার পাশাপাশি আপনি অনুবাদও করেন। বহির্বিশ্বের সাহিত্যের রস আমরা কিছুটা পেয়েছি আপনার অনুবাদে। লেখক হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্যকে অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো দায় অনুভব করেছেন?
ওদেশে (ব্রিটেন) নানা বই পড়েছি। আর ভেবেছি এগুলো বাংলা অনুবাদ করে দেশের মানুষের কাছে পাঠাতে হবে। ছোটদের বই, বড়দের বই যখন যা ভালো মনে হয়েছে। তারপর মনে হলো, আমরা যে ভালো-মন্দ গল্প লিখতে পারি, সে-কথা পশ্চিমের কতজন জানে? শুরু করলাম এবার আমার গল্পগুলো ইংরেজি করে বই ছাপানোর কাজ। আমার বাংলা তিনশোরও বেশি গল্প থেকে সতেরোটি নিয়ে একটি বই করলাম। নাম দিলাম – কালেকটেড শর্ট স্টোরিজ। আর একটি উপন্যাস, জুশনারার গল্পর ইংরেজি অনুবাদ দ্য স্টোরি অফ জুশনারা। আরো দু-একটি করার ইচ্ছা আছে। আশা করছি অন্যান্য লেখকও অনুবাদ করে ছাপাবেন। তবে ওখানে না থাকলে ছাপানো একটু মুশকিল হতে পারে। মোজাফ্ফর হোসেনের দুটো বই ছাপা হয়েছে ইংরেজিতে। বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ। এমন কাজ আরো হবে আশা রাখি। আগেও দুটো-একটা হয়েছে। তাহমিমা আনামের মৌলিক কাজ আছে এবং আরো কজনের।
‘অনুবাদে বরবাদ’ বলে হতাশাজনক একটা বিষয় চালু আছে বিদ্বৎমহলে। এই ‘বরবাদ’টা আদতে কী? নিজে কী ধরনের ‘বরবাদ’ প্রত্যক্ষ করেছেন? দেশীয় অনুবাদের ভূমি কি এখন অনুর্বর?
আদতে অনুবাদের কাজটি সহজ নয়। এটা কি আক্ষরিক অনুবাদ, ভাবানুবাদ, নির্যাস অনুবাদ, না স্বাধীন অনুবাদ? যেমন গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথ ভাবানুবাদ করেছেন। আক্ষরিক নয়। এইভাবে আমাদের জেনে নিতে হবে ঠিক কীভাবে অনুবাদ করব। একটা কথা মনে রাখতে হবে, অনুবাদও সৃষ্টিশীল লেখা। সবসময় সহজ নয়। তারপরেও অনুবাদ হয়। আমরা এই অনুবাদের কারণে পুরো পৃথিবীকে জানি। কী হতো আজ, ইংরেজি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, ইতালি, পর্তুগিজ, আরবি, ফার্সি এসব যদি অনুবাদ না হতো। কাজেই অনুবাদ হবে এবং দিন দিন পৃথিবী অনুবাদে সমৃদ্ধ হবে। না বরবাদ নয়, সমৃদ্ধ। যদি জানা যায় আমার অনুবাদে স্বাধীনতা কতটুকু। তারপর আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রবাসী লেখকদের কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলেন, স্বদেশে থাকেন না বলে যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁদের লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। আপনার অভিজ্ঞতা কী?
প্রবাসে থাকা মানে আড়ালে থাকা। ফলে অনেক কিছুতেই একজন প্রবাসী অংশ নিতে পারেন না। মনে হয়, আমরা যে আছি সে-কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। এমন অভিজ্ঞতা আমারও আছে।
অনেক সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করেছেন। দেশের ও বিদেশের সম্পাদকদের নিয়ে তিক্ত-মধুর কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনার?
একটু অন্যরকম। তাঁরা লেখায় সুবিচার করতে চান। পছন্দ না হলে ফেরত পাঠান। বাংলা লেখা নিয়ে সমস্যা হয়নি তেমন। ইংরেজি লেখা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তবে তাঁদের কথাবার্তা অনেক শালীন। ফেলে রাখেন না। জানিয়ে দেন কী হবে বা কেন হবে না। হয়তো বললেন – লেখাটি সুন্দর। তবে মনে হয় আমার কাগজের জন্য সঠিক নয়। কিংবা – ফেরত পাঠানো মানে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হলো না। আরো পাঠান। আর পেলে তাঁরা প্রাপ্তি স্বীকার করেন। লেখাটি পেয়েছি বিবেচনায় আছে। অম্লমধুর সম্পর্ক। লেখক হিসেবে একজনের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে। ভালো-মন্দ! একই গল্প শুনতে চাই বইয়ের প্রকাশকদের ক্ষেত্রেও। প্রাপ্তি ও বঞ্চনার বিষয়াদি। লেখক-প্রকাশকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? সেটা কী অবস্থায়?আমাজন ডট কম থেকে আমার দুটা বই প্রকাশ হয়েছে। এখানে লেখকদের সব দায়িত্ব। তাঁরা লেখা ঠিক করবেন। ভালোমতো প্রুফ দেখবেন এবং ভুল কখনো পাঠাবেন না। যদি ভুল পাঠান ভুলই ছাপা হবে। তবে আমাজনের সুবিধা ভুলকে রাতারাতি ঠিক করা যায়। যেটা আমাদের দেশে সম্ভব নয়। অপেক্ষা করতে হয় পরের সংস্করণের জন্য। তবে যখন ভালো কোনো পাবলিশার প্রকাশ করেন তাঁদের দায়িত্ব বইটির ভালোমতো প্রুফ দেখা এবং আর যা যা দরকার। তবে সেখানে বড় পাবলিশার দিয়ে বই ছাপানো খুব সহজ নয়। আমার ধৈর্য কম। ফলে আমি আমাজন ডট কম থেকে দুটো বই প্রকাশ করেছি। ভালো কোনো পাবলিশার না পাওয়া পর্যন্ত আমাজন থেকেই বই করব। হঠাৎ একজন নামকরা পাবলিশার পেয়ে গেলে গল্প অন্যরকম হবে।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছেন ও উঠছেন তাঁরা কি বাংলা বই পড়েন, পড়তে পারেন? সৃজনশীল সাহিত্যের কতটুকু পাঠক তাঁরা?
নতুন প্রজন্ম খুব বেশি বাংলা বই পড়ে না। লন্ডনে এখন একটিও বাংলা বইয়ের দোকান নেই, যদিও আগে ছিল। এক এক করে সব চলে গেছে। বাংলা সাহিত্যচর্চা ও পড়াশোনা আমাদের পরে কী হবে বলা মুশকিল।
প্রয়াত লেখক রমা চৌধুরী মনে করতেন – মেয়েদের চাকরি করার মানে হচ্ছে ছেলেদের চাকরির বাজারে হানা দেওয়া। এই বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
আমি মনে করি মেয়েরা সমভাবে পুরুষের মতো কাজ করতে পারে। পুরুষের জগতে হানা দেওয়া নয়। এ তার অধিকার। তবে নারী যেহেতু মায়ের জাত, সংসার প্রতিপালনকে সে কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারে না। সংসার অবহেলা করেও নয়। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা জরুরি। কেবল সে প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাতবে – এটা ঠিক নয়। লন্ডনে যখন নারীদের বড় বড় গাড়ি চালাতে বা ট্রাক চালাতে দেখি অবাক হই। প্লেনও নারী চালায়। নারী আজ আর পিছিয়ে নেই। তবে এ-দৃশ্যও আমাকে ব্যথিত করে – মা কাজে গেছেন আর ছেলেমেয়েরা খুবই বিপন্ন অবস্থায় রাস্তায় খেলছে। কাজেই নারী কতটুকু কাজ করবে নির্ভর করে তার পারিবারিক অবস্থার ওপর।
প্রযুক্তি আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হয়েছে? প্রিন্ট পত্রিকার সমান্তরালে অনলাইন মাধ্যমগুলোকে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন?
এখন আমি ল্যাপটপ ছাড়া লিখছি – এমনটা ভাবতে পারি না। এখন আর কলমে লেখা সম্ভব নয়। ল্যাপটপের কাছে আমি ঋণী। যত রকমের বই বেরুক না কেন, ভালো লাগে সেই বই যা চমৎকার মলাটে, লেখায় সমৃদ্ধ এবং নতুন বইয়ের চমৎকার গন্ধ মাখানো! তার মতো আর কী আছে! অনলাইন পত্রিকায় আমি বেশি লিখি না। একটি চমৎকার ম্যাগাজিনে লিখতেই আমি বেশি পছন্দ করি। তবে প্রচুর অনলাইন পত্রিকা আমাদের পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে কিছু ভালো কাজ থাকেই।
পাঠাভ্যাস কমছে। জাতি সংস্কৃতিবিমুখ হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাবৎ শিল্পকলার ভবিষ্যৎ কী?
বই পড়া কমে গেছে হয়তো। প্রতিবছর বইমেলা সে সত্য স্বীকার করে না। তবে ঈদে-পরবে জামার সঙ্গে নতুন বই থাকা প্রয়োজন। আমাদের ছেলেবেলায় বই ছাড়া আর কী ছিল? ছি বুড়ি আর কিতকিত বা গাদোল। ওপেনটি বায়োস্কোপ – এইসব। না হলে ঘরে বসে লুডু বা ক্যারম খেলা। এখন ফ্ল্যাটবাড়িতে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা সেটা মিস করে। কম্পিউটারে গেম একটি সাধারণ ঘটনা। এর মধ্যে বই পড়াও চলছে। অনেক বাচ্চাকে দেখেছি বই পড়তে। কোথাও কোথাও বই পড়া চলছে। আমি শিশুদের অনেক বই লিখেছি বা লিখছি। সেগুলোর কাটতিও ভালো।
চাকরিজীবন নিয়ে কোনো খেদ আছে? কী ধরনের চাকরি করতে পারলে আরো বেশি গর্ব অনুভব করতেন?
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার দিয়ে কাজ শুরু। ব্রিটেনে কিছু অড জব করার পরে স্কুলে চাকরি পাই। প্রায় পঁচিশ বছর আমি স্কুলে কাজ করে রিটায়ার করি। সেটা বেশ ভালো কাজ ছিল। কাজেই আমি সবসময় ভালো কাজই করেছি। এর সঙ্গে লেখালেখি তো আছেই। এখন রিটায়ার। লিখছি। বই বের হয়। মন ভালো লাগে। না, বড় কোনো চাকরির ইচ্ছা নেই।
প্রবাসের ক্ষত বা দুঃখ-কষ্ট প্রায় সব প্রবাসীরই থাকে। আপনারটা কেমন?
প্রথম কথা আবহাওয়া। কয়েক বছর যায় শীতের সঙ্গে সমঝোতা করতে। তারপর যায় আত্মীয়স্বজনকে না দেখার কষ্ট।
মা-বাবা দুই বোন-ভাই এক এক করে চলে গেলেন আর আমি থাকলাম লন্ডনে। এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে। ওখানে কেউ কারো বাড়িতে যায় না। আমার দুই পাশের দুই প্রতিবেশীর বাড়িতে কত দিন গিয়েছি? একদিন বা দুইদিন। বড় একা লাগে সময় সময়। আমার একটা লেখার জগৎ আছে, যা আমাকে কিছুটা আনন্দে রাখে। প্রবাস বা পরবাস সবসময় আনন্দের জায়গা নয়। এখন রিটায়ার করার পর প্রতিবছর দেশে আসি, আগে যা পারতাম না। ভালো লাগে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওরাও মাঝে মাঝে আসে। তবে ওরা পুরোপুরি ওদেশের, তেপান্ন বছরেও আমি যা হতে পারিনি। তারপরেও ওই দেশের জন্য একটা মায়া হয়ে গেছে।
ইংল্যান্ডের মানুষজন কেমন লাগে? যাদের ভাষা, রুচি, চিন্তা, আলাদা …
অবশ্যই একটু আলাদা। ওদের জীবনের মূল্যবোধ আমাদের মতো নয়। কে কী করে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কে কতটা দেশের নিয়মকানুন মেনে চলে সেটাই আসল। তারা ঠিকমতো ট্যাক্স দেয় কি না, প্রতিবেশীর জন্য ভালো কি না, নিজের জীবন ঠিকমতো চালায় কি না – সেইসব দিয়েই একজনের বিচার হয়। তারা কতটা পরিশীলিতভাবে কথা বলে সেগুলোও দেখা হয়। ওরা সবকিছু অনেক ভেবে বলে। হুট করে কিছু বলে না। কেউ কারো বাড়িতে গেলে ট্রে ভর্তি খাবার আনে না। ওরা মনে করে খাবারের সময় থাকে। ব্যক্তিগত কথা বলে না বেশি। কেউ প্রশ্নও করে না। এমনকি ‘আপনি কী করেন’ এমন প্রশ্নও করে না। যখন আমি দেখি একজন ‘বিন ম্যান’ বা ঝাড়ুদার মাস্টারমাইন্ডের মতো কঠিন কুইজ প্রোগ্রামে আসে অবাক হয়ে যাই। আমরা তো মনে করি, আমাদের সব জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালের ভেতর। একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। যেমন আমার বাগানের মালি, মিস্ত্রি, এমন কেউ।
বিদেশে থেকে দেশকে কতটুকু, কেমন অনুভব করা যায়?
বিদেশে গিয়ে দেশের জন্য মন কাঁদে। নানা কথা মনে হয়। সেই যে পুকুরপারের তালগাছগুলো কিংবা হাসনাহেনার ঝাড়, না হলে সেই রক্তগোলাপের ছোট বাগান – এমনি নানা তুচ্ছ কথা। রাত জেগে তারাখসা রাতের গল্প মনে পড়ে। মনে ফিরে ফিরে আসে নানা তুচ্ছ কথা। প্রিয় মুখগুলো মনে জেগে ওঠে। রাত নির্ঘুম কাটে। ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমারি কথা ভাবি হে বিরলে’ – মধুসূদনের এই কবিতার মতো সবকিছু। দূরে গেলে প্রেম বাড়ে। তাই তো আমার লেখায় বারবার চলে আসে দেশের নানা চালচিত্র। গল্প, উপন্যাস, কবিতায় ফিরে পাই নানা অনুভূতির সারাৎসার।
ব্রিটেনের পাঠাগার ব্যবস্থা কেমন লাগে, ওখানকার পাঠক কী পড়তে পছন্দ করেন? বইয়ের বিকিকিনি কেমন সেখানে? লেখকদের অবস্থা, অবস্থান তথা মর্যাদা কতটুকু?
পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার। আমার বাড়ির খুব কাছে চারটে পাঠাগার। সেখানে নানা বই। যদি কোনো বই সেখানে না থাকে অর্ডার করলে তা কিছুদিনের ভেতর চলে আসে। কত লাখ পাঠাগার যে সেখানে তা বলে শেষ হবে না। এক লাইব্রেরি কার্ড দিয়ে সব লাইব্রেরি থেকে আমি বই আনতে পারি।
একশ ভাগ লেখাপড়া জানা মানুষ। সকলেই বই পড়ে। বই বিক্রি হয় দেদার। যে যার পছন্দের বই পড়ে। বড় বড় লেখক সমাদৃত। কোনো লেখক একটি বই লিখেই বিখ্যাত। যেমন আরভিন্দ আদিগা বা খালেদ হোসেনির প্রথম বই তাঁদের খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আবার অনেকে অনেক বই লিখেও তেমন নাম করতে পারেননি। ঘটনা অনেকটা আমাদের দেশের মতো। প্রচুর বই অনুবাদ হয়।
লন্ডনের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন? গরিব দেশের ‘কালো’ চামড়ার বাংলাদেশি বলে কখনো অনিরাপত্তাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছেন?
সামাজিক নিরাপত্তা অনেক ভালো। তবে মাঝে মাঝে নানা ঘটনা ঘটে। আমি কখনো গায়ের রঙের কারণে বিপদে পড়িনি। তবে অনেকে পড়েছে। আমি যে এলাকায় থাকি সেখানে মিলেমিশে আছি। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দু-এক জায়গায় ঘটেছে এবং ঘটে।
বিদেশে মানুষের অধিকারকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বদেশের সঙ্গে তুলনা করলে মন খারাপ হয় আপনার? দুই জায়গায় তুলনামূলকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, নাকি অবনতি?
আমি ব্রিটেনের কথা বলছি। পুরো বিদেশের কথা জানি না। শুনেছি, আমেরিকায় ঠিক ব্রিটেনের মতো সেবা পাওয়া যায় না। ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিধিব্যবস্থায় সব যে ব্রিটেনের মতো, তা নয়। বাংলাদেশে অনেক প্রবাসী যে এসে থাকতে চায় না তার কারণ এই ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের’ অভাব। নানা রকম সমস্যা বাংলাদেশে। বড় বড় হাসপাতাল সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে। অনেকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়। ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন ও আরো নানা দেশে। এ-ক্ষমতা সকলের নেই। তাই নানা কষ্ট।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে ব্রিটেনের হাসপাতাল অনেক ভালো।
প্রবাসজীবনের শুরুর দিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, আচরণগত কিংবা অন্য কোনো সমস্যায় পড়েছিলেন?
ভাষাগত সমস্যা ছিল। ধীরে ধীরে শিখেছি। ইংরেজি পড়তে পারা ও বলতে পারার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের শিখতে হয়েছে ওদেশের উপযুক্ত পোলাইট ইংরেজি। এখনো শিখছি। আমরা কথা বলি সরাসরি বা ডাইরেক্ট। ওনারা কথা বলেন একটু ভিন্নভাবে। আর প্লিজ না বলা গর্হিত অপরাধ। কেউ কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে না। শিখতে হয়েছে এইসব নানা কিছু। প্লিজ না বলে বিপদে পড়েছি। এখন আর তেমন ভুল হয় না। তেপান্ন বছর তো অনেক সময়।
লন্ডন বসবাসে সবচেয়ে বড় পাওয়া কী? অপ্রাপ্তি থাকলে সেটাও বলুন।
আমি আর এখন কুয়োর ব্যাঙ নই। আমার চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। মূল্যবোধের ধারণা বদলে গেছে। শিক্ষায় স্পুনফিডিং বা চামচে করে খাওয়ানো মহাঅপরাধ, সেটা জেনেছি। ‘এ লাউড টিচার অলওয়েজ গেটস এ লাউড ক্লাস’ সেটা মেনেছি। শিশুদেরও বড়দের মতো ট্রিট করতে হয় – সেটা জেনেছি। একটু হেসে কথা বলা অনেক সুন্দর – সেটা জেনেছি। বাড়ির চারপাশে অসংখ্য লাইব্রেরি থাকাতে বই পড়ার আনন্দ কি তা জেনেছি। জেনেছি রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিকের ভালো থাকার দায়িত্ব নিতে পারে। কীভাবে বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা যায়। সামান্য জিনিস উপহার পেলেও কত সুন্দরভাবে ভালোলাগার কথা বলা যায়। এমনি হাজারো জিনিস। আর জেনেছি, যেখানেই যাই আর যেখানেই থাকি, দেশকে ভোলা বা মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।
কোনো একজন প্রিয় বিদেশি ও একজন বিদেশিনী বন্ধুর গল্প বলুন। তাঁরা আপনার প্রিয়-অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন কীভাবে?
একজন ইংরেজের সাহায্যের কথা বলতে আমার প্রথমেই মনে পড়ছে উইলিয়াম রাদিচের কথা। তিনি আমাকে নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমার একটি বাংলা বই পড়ার পর থেকেই তিনি কেন জানি না ভেবেছিলেন আমি সাহায্য পেলে হয়তো ভালো কিছু করতে পারি। আমার ইংরেজি কবিতার বইয়ের নাম ইট গ্রোজ ইন মাই হার্ট তাঁর রাখা। এরপর তিনি সে-বইয়ের একটি চমৎকার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। একজন জুশনারার গল্প ও শেষ মারবেলা নামে দুটো বাংলা উপন্যাস পড়ার পর তিনি বই দুটোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলেন। একজন জুশনারার গল্প অনুবাদ হয়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে, শেষ মারবেলা অনুবাদ হচ্ছে। দুঃখের বিষয়, রাদিচে আর আমাদের পৃথিবীতে নেই। মনে হয় আমি একজন স্বজন হারিয়েছি। এছাড়াও নানা সাহায্য পেয়েছি আরো নানা জনের কাছ থেকে। সাহায্য না পেলে তো ওদেশে টিকে থাকতে পারতাম না।
আপনার প্রিয় জায়গা কোনটি? কেন প্রিয়?
ব্রিটেনের অনেক জায়গাই আমার প্রিয়। তবে যদি বলি একেবারে প্রিয়তম জায়গা, সেটা লেক ডিস্ট্রিক্ট। ঝলমলে রূপসী ওই অঞ্চল আমার কাছে তুলনাহীন। ওখানে সাতদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে যে উপন্যাসের খসড়া ডায়েরির পাতায় তুলে এনেছিলাম তার নামই শেষ মারবেলা। রূপসী এ-জায়গায় থাকতেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বিয়াট্রিস পটার প্রমুখ। এখানে এলে মনে হয় নিসর্গ জীবন্ত। সে আমাদের জীবনের অংশ। এছাড়া স্কটল্যান্ডও আমার ভালো লাগে। লন্ডনের বাইরে অনেক জায়গা সত্যিই মনোরম, মনোহর। মানুষ ও নিসর্গের মেলবন্ধনে কিছু জায়গা সত্যিই হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে। আমরা আসলে নিসর্গেরই অংশ।
লন্ডনের পার্কগুলো খুব সুন্দর। হাইড পার্ক, গ্রিনিচ পার্ক আমার খুব প্রিয়।
আপনার প্রিয় থিয়েটার কী?
আমি আন্ড্রুলয়েড ওয়েবারের থিয়েটার দেখতে ভালোবাসি। তাঁর প্রায় সব থিয়েটারই আমার দেখা। সেসব মিউজিক্যাল বা গান দিয়ে তৈরি। মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখতে ভালো লাগে। কাউকে না পেলে একা চলে যাই। চৌধুরী সাহেব বেঁচে থাকতে তার সঙ্গে দু-একটা দেখেছি। তেরো বছর হলো তিনি নেই। এখন একাই যাই। কখনো মেয়ে যায় সঙ্গে।
প্রায় দেড় দশক ধরে সঙ্গীহীন জীবন আপনার। একাকিত্ব কেমন লাগে? নিঃসঙ্গতা কি আপনার শিল্পযাপনে কোনো ব্যঞ্জনা যুক্ত করতে পেরেছে?
আমি তো অনেকদিন থেকে লেখালেখিকে সঙ্গী করেছি। ল্যাপটপের বুকে লিখে চলেছি নানা কিছু। একটু হাঁটাহাঁটি করি। মাঠে গিয়ে বসি। একটা ছোট বাগান করি।
ছেলেমেয়েরা এলে কথা হয়। ফেসবুক ব্যবহার করি। দেশে বছরে একবার যাই – শীতে। এই ‘একার জীবনে’ দু-একজন অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন আমি রাজি হইনি। এই তো বেশ আছি। নিজের সঙ্গ, সবচেয়ে ভালো সঙ্গ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরীর মতো বিদ্বান মানুষকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। কেমন ছিল তাঁদের পাঠদান, জীবনবোধ, দর্শন?
আমরা অনেক ভাগ্যবান। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, মুহম্মদ আবদুল হাই, নীলিমা ইব্রাহিম, আনিসুজ্জামান স্যারদের পেয়েছিলাম। মুনীর চৌধুরীর ম্যাকবেথ পড়ানো এখনো কানে বাজে। ঝমঝম করে চালে বৃষ্টি পড়ছে আর স্যার উদাত্ত গলায় বলছেন – আউট আউট ব্রিফ ক্যানডেল, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। যেদিন স্যার বলতেন – আজ আমি প্রস্তুত হয়ে আসিনি – সেদিনটি হতো সবচেয়ে মজার। নানা গল্পে ভরে উঠত ক্লাস। আনিসুজ্জামানের ‘লো কি তে’ পড়ানো মনে পড়ে। কত কী যে শিখেছি তাঁর কাছে। নীলিমা আপা পড়াতেন এবং মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে চায়ের আসরে ডাকতেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী পড়াতেন রবীন্দ্রনাথ। আর মুহম্মদ আবদুল হাই ধ্বনিতত্ত্ব। সব মনে আছে। মুহম্মদ আবদুল হাই স্যারের মৃত্যু বড় কঠিন হয়ে বেজেছিল প্রাণে।
নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটি উপন্যাস উৎসর্গ করেছিলেন আপনাকে। আরো কোন কোন সাহিত্যিক বই উৎসর্গ করেছেন? আপনি নিজে উৎসর্গ করেছেন কাদের? স্মরণীয় কিছু উৎসর্গপত্রের কথা বলবেন কি?
হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বই উৎসর্গ করেছিলেন। আবিদ আজাদ, মীনাক্ষী সিনহা, ঝর্না রহমান, ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, আহসান হাবীব, শফিক হাসান, আহমেদ আজাদ, উইলিয়াম রাদিচেসহ অনেকেই করেছেন। আমিও উৎসর্গ করেছি অনেককে। হুমায়ূন আহমেদ, আয়েশা ফয়েজ, আহসান হাবীব, বাবা, মা, ভাইবোন এবং আরো অনেককে। যাঁকে ভালো লাগে – বই উৎসর্গ করে ভালো লাগা জানাই। ওই যে সেই কবিতা – ‘আমার খামার নেই/ নেই কোনো শস্যকণা/ আছে শুধু একটি আকাশ/ তারি কিছু আলো নীল/ হে সুদূরতমা ভালোবেসে তোমাকে দিলাম।’
এখন কী লিখছেন? আর কী কী লেখা (মৌলিক ও অনুবাদকর্ম) শেষ করে যেতে চান?
এই টুকটাক গল্প। প্রবন্ধ। তিন-চারটে বই বেরুবে বইমেলাতে। ইচ্ছা আমার প্রিয় ইংরেজি কবিতা অনুবাদ করব। এবং
ইংরেজি-বাংলা পাশাপাশি রেখে একটি বই করব। কত সব ভালোলাগা ইংরেজি কবিতা আছে। ইয়েটস, ডিলান টমাস, এলিয়ট, ব্রাউনিং, শেলি, কিটস, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ আরো কত কে। দেখি, বিশ-তিরিশটা কবিতা বেছে নিয়ে বাংলা করব। ‘হোয়েন ইউ আর ওল্ড অ্যান্ড ফুল অফ সিøপ’ ঠিক তখনই।
জীবনে কী চেয়েছেন আর কী পেয়েছেন? বড় কোনো প্রাপ্তি আছে কি, কিংবা অপ্রাপ্তি? লেখক হবো ভেবেছিলাম – সেটা হয়েছি। স্বীকৃতি পেয়েছি। ইংরেজিতেও লিখবো ভেবেছিলাম – সেটাও লিখেছি। তবে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফলে মনে হয়েছে – এই সময়ে আমি যদি দেশে থাকতাম তাহলে কী হতো। আমার আরো কিছু লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারলে ভালো লাগত। রবীন্দ্রনাথ যেমন ইয়েটসকে পেয়েছিলেন, তেমন কোনো বন্ধু পেলে বেশ হতো। রাদিচে চলে গেছেন। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। কে এখন আমার প্রাণের বন্ধু হবেন!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.