অন্নপূর্ণা দেবী

দেবী অন্নপূর্ণার পূজার চতুর্থীতে চলে গেলেন অন্নপূর্ণা দেবী। অন্নপূর্ণা শঙ্কর। একানববই বছর বয়সে চলে গেলেন বটে, তবে এ-যাওয়া দেবী অন্নপূর্ণার মতোই ফিরে ফিরে আসার জন্য যাওয়া। যে-অমরত্ব ভারতীয় রাগসংগীতকে ছেয়ে আছে, সেই অমরত্বেই দীর্ঘদিন বসবাস এই দেবীর।

বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও মদিনা বিবির সমত্মান অন্নপূর্ণার জন্মকালে নাম হয়েছিল রোশেনারা। জন্ম ১৯২৭-এর ১৬ এপ্রিল, যা ছিল চৈতি পূর্ণিমার দিন। বাবা আলাউদ্দিন তখন মাইহাররাজ ব্রিজরাজ সিংহের সভাশিল্পী। রাজাই রোশেনারার নতুন নামকরণ করলেন অন্নপূর্ণা।

তিরিশের দশকে কী যে অলৌকিক সময় বাবার সেনিয়া মাইহার ঘরানার! গুরুর পায়ে পাশাপাশি বসে তালিম নিচ্ছেন ভারতীয় রাগসংগীতের সর্বকালের সেরা তিন যন্ত্রী। সরোদে সুপুত্র আলি আকবর, সেতারে ভবিষ্যতের জামাতা রবিশঙ্কর এবং সুরবাহারে কন্যা অন্নপূর্ণা। দাদা ও আগামী দিনের বর যখন বাবার কাছে তালিম নিচ্ছেন, তখনো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বা ঘরের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে যে কত কিছুই অকাতরে তুলে নিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা তা এক কথায় বিস্ময়কর। এ নিয়ে ছোট্ট দুটো ঘটনার উলেস্নখ করি।

প্রথমটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা, তিনি হয়তো আলি আকবর খাঁ সাহেবের কাছেই শুনেছিলেন। সেটা এরকম : কদিন আগে বাবার কাছে কী একটা অঙ্গ শিখেছিলেন, কিন্তু রেওয়াজের সময় সবটুকু মনে আনতে পারছিলেন না। জায়গাটা এসে দিব্যি ধরিয়ে দিলেন বোন। কী করে? না, ‘বাবা যখন তোকে এটা গেলাচ্ছিলেন, তখন বাইরে থেকে শুনে ফেলেছি!’

দ্বিতীয়টা এককালে আকাশবাণী কলকাতা ও পরে এইচএমভির কর্তাব্যক্তি বিমান ঘোষের কাছে শোনা। বললেন, ‘কদিন আগে জানো তো আলু (আলি আকবর) এসেছিল আমার ফ্ল্যাটে। বলল,  ‘তোমার কাছে অন্ন’র যে কৌশী কানাড়াটা আছে শোনাও তো।’ তারপর বসে এক ঘণ্টার টেপটা পরপর দুবার শুনে বলল, ‘যাক্, যা চাইছিলাম পেয়ে গেছি! কাজ হয়ে যাবে।’

এই হচ্ছেন অন্নপূর্ণা, ভারতীয় রাগসংগীতের রহস্যময়ী দেবী। কারণ স্বামী রবিশঙ্করের সেতারের সঙ্গে সুরবাহার নিয়ে ১৯৪৫-৪৬ থেকে ১৯৫৬ অবধি জোড়ে বাজালেও হঠাৎ একদিন বাজানো বন্ধ করে দিলেন এবং ১৯৬২ থেকে জনসমক্ষে একক বাজানোও বন্ধ। জীবনে রেকর্ড, অ্যালবাম করলেন না। যা যা টেপরেকর্ডিং ওঁর শুনতে পাই আমরা, সবই কনসার্ট থেকে গোপনে করা। এরকম এক রেকর্ডিং আমার কাছেও আছে ওঁর এবং রবিশঙ্করের দ্বৈতবাদনের। এবং না বলে পারছি না, সে-বাজনায় প–তজির চেয়েও বেশি টেনেছে ওঁর কাজ।

কথাটা তো সেই পাঁচের দশক থেকেই চরছিল। রবিশঙ্করের সঙ্গে সুরবাহার নিয়ে বসলে বেশি কদর পান অন্নপূর্ণা। তাতেই নাকি বর-বউয়ের মধ্যে খিঁচ ধরে, রবিশঙ্কর নাকি ঠাকুরঘরে নিয়ে অন্নপূর্ণাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান বাজানো ছেড়ে দেবেন। টিপিকাল অমিতাভ-জয়া অভিমান চলচ্চিত্র কেস।

বছর-আঠারো আগে এ-গল্পই রং চড়িয়ে বড় কাগজে কেউ একটা প্রতিবেদন লিখলে রবিশঙ্কর ফোন করে ওঁর প্রতিবাদ শোনান। সে-প্রতিবাদ প্রকাশও পায়। বলছিলেন, ‘বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই যে-গুজবের তার প্রতিবাদ করতেও লজ্জা হয়, শঙ্কর। অন্নপূর্ণা কি কখনো এমন কথা কাউকে বলেছে? বলতে পারে?’

অন্নপূর্ণা কী বলতে পারেন তার একটা ছোট্ট উদাহরণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দিতে পারি। ১৯৭৮-এ (দেশে তখন রাগ-অনুরাগ ধারাবাহিক হয়ে বেরোচ্ছে) স্ত্রীকে নিয়ে বোম্বাই গিয়েছিলাম। আমার অন্নপূর্ণাকে দেখার সাধ শুনে রবিশঙ্কর টাটা আর্টস ফাউন্ডেশনের তখনকার ডিরেক্টর ড. নারায়ণ মেননকে বলেন। অন্নপূর্ণা তখন টাটায় সেতার শেখান। তিনিই এক চিরকুট পাঠান অন্নপূর্ণাকে, যখন শিল্পী ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি রাজিও হন আমাকে সস্ত্রীক ওঁর ক্লাসে বসতে দিতে।

সে যে কী অপূর্ব ক্লাস নেওয়া বলে বোঝাতে পারব না। দেশ রাগ শেখাচ্ছিলেন, সেতার নিয়ে বসা তিন ছাত্রকে রবিশঙ্করের দেশীর কথা বললেন। ওঁকে উলেস্নখ করলেন ‘প–তজি প–তজি’ করে। পরে আমার সঙ্গে আলাপে যখন জানলেন রবিশঙ্করের আত্মজীবনী লেখার কাজে যুক্ত আছি, সবিস্ময়ে বললেন, ‘আপনি প–তজির মতো অত বড় মানুষের থেকে কত কী জানছেন, ওঁর জ্ঞানের কি শেষ আছে! আমি আপনাকে আর কী শোনাব?’

তাও তো বলতে পারিনি ওঁর সম্পর্কেই কত নিখুঁত সব বর্ণনা দিয়েছেন প–তজি ওঁর আত্মকথায়। তেমন কিছু নমুনা আজ তুলে ধরার দিন এলো। বললেন, ‘অন্নপূর্ণার বাজনা অবশ্যই অতিউন্নত স্তরের বাজনা। … লোকের সামনে বাজায় না বলে ওর যেটা তালিম, যেটা শিখেছে, জীবনে সেটা বজায় রাখতে পারে। ঠিক তালিম বাজায়। এবং ভগবানের একটা আশীর্বাদ যেন ওর সংগীতে, সব বড় ঘরের শিল্পীদেরই যেটা আসে না। কিন্তু যাদের আসে তারা তো যেন রক্তের ভেতর সংগীত নিয়েই জন্মায়। যেমন আলি আকবরভাইয়ের কথা ধরো। সেই ভাবটা চিরদিন সেই ছোট থেকেই ছিল।

খুব সুরে, খুব মিষ্টি হাত; এবং মেয়ে বলেই যে হয় তা নয়, তবে মহিলাসুলভ একটা নমনীয়তা, কমনীয়তা, রসে-ভরা হাত। এবং বাবার যে অঙ্গটা ও বাজায় সেটা নিখুঁত বাজায়; কারণ লোকজনের সামনে বাজালে মানুষকে যে কমপ্রোমাইজ করতে হয়, সেটা তো ওকে করতে হয়নি। লোককে খুশি করতে হয়নি এটা-ওটা করে। এবং সেটা করেওনি। সেই অসম্ভবটাই ও করতে পেরেছে; সেটা ওর বাজনায় আছেও। ওর সুরবাহারকে যে পিওর, বিশুদ্ধ সুরবাহার বলা হয়, সেটা সত্যি। অন্তত আমি তো তাই বলব।

আমি তো ওর সঙ্গে জোড়ে বাজাতাম, একসঙ্গে, বছরের পর বছর। আমরা ওইভাবেই তালিম পেতাম, একসঙ্গে শিখতাম। একসঙ্গেই বাজাচ্ছি, যন্ত্র সুরবাহারই বাজছে, কিন্তু তার ভেতরে বীণের অংশই প্রধান। সুরবাহারে বীণের অঙ্গটাই প্রধান হয়।

অন্নপূর্ণা কেন নিজেকে প্রকাশ করে না? দেখো, শঙ্কর, এর আমি  চট করে কী উত্তর দেবো? এটা তো খুব পার্সোনাল বিষয়। তবে মনে হচ্ছে অন্নপূর্ণা অন্যকে শেখানোটাই বড় করে দেখে। তাই তো মনে হয়। দুঃখের বিষয় যে, ও কখনো বাইরে বাজায় না। বড় জলসায় না হোক, অন্তত ছোটখাটো জলসাতেও কখনো কখনো বাজালে সত্যিকারের সমঝদার ও রসিক শ্রোতাদের সৌভাগ্য হতো ওকে শোনার।’

ছেলেবেলা থেকে রসিক শ্রোতা যারা অন্নপূর্ণাকে শুনেছেন তাদের মুখে অন্নপূর্ণার গুণগান শুনে আসছি। পরে কপালগুণে ওঁর কিছু রেকর্ডিং শুনে বুঝেছি তিনি সাক্ষাৎ সরস্বতী এবং যে-হারে তিনি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, বাহাদুর খাঁ, নিখিল হলদিপুরার মতো কৃতী শিষ্যদের অকাতরে সংগীতরূপ অন্ন বিতরণ করেন তাতে তো সার্থকনামাও – অন্নপূর্ণা।

রাগ-অনুরাগ রচনার রেকর্ডিংয়ের সময় লন্ডনে থেকেই অন্নপূর্ণার কথা পাড়তাম রবিশঙ্করের কাছে। তিনি প্রথম প্রথম একটু উন্মনা হতেন, পরে একদিন গড়গড় করে বলা শুরু করলেন। বুঝলাম ছাপ্পান্ন সাল থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকলেও একুশ বছর ধরে প্রেম ধিকিধিকি জ্বলছে ভেতরে। তাই তখনকার সঙ্গিনী কমলাকে বিয়ে করেননি অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চান না বলে।

শেষে ১৯৮২-তে যখন বিচ্ছেদ হলোই এবং অন্নপূর্ণা স্বামীরই ছাত্র রুশি পান্ডিয়াকে বিয়ে করলেন, তখন রবিশঙ্কর মনোগতভাবে যে খুব স্বাধীন হতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন রবিশঙ্করকে খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে বুঝতে পারছিলাম দুই সুদূর দম্পতি আরো ঘোরতরভাবে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন।

বেশ কিছুকাল ধরে যে-গভীর আকাঙক্ষাটা পোষণ করে চলছিলাম রবিশঙ্করের রাগ-অনুরাগের মতো অন্নপূর্ণা শঙ্করেরও একটা ‘রাগ-অনুরাগিণী’ (নামটাও ভেবে রেখেছিলাম) রেকর্ড করব, তা হারিয়ে গেল। ওই বিচ্ছেদ ঘটে। রবিশঙ্করও স্বসিত্ম পেতেন অন্নপূর্ণা মন খুলে আত্মকথন করলে।

দেবী অন্নপূর্ণা রহস্যময়ীই থেকে গেলেন।