অপনয়ন আনয়ন

জাফরিন গুলশান

অপনয়ন-২, কৃত্রিম কাচ, বৈদ্যুতিক মোটর ও ধাতব কাঠামো
অপনয়ন-২, কৃত্রিম কাচ, বৈদ্যুতিক মোটর ও ধাতব কাঠামো

একজন শিল্পীর কাজ কী হওয়া উচিত? এ-প্রশ্নের দার্শনিক মীমাংসা যুগ-যুগ ধরে অব্যাহত। তাই ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমার মধ্যে নির্ণেয় ভাগ্য হাতে আধা সামন্তীয় ও আধা ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে বাংলাদেশের বর্তমানে দাঁড়িয়ে ওই প্রশ্নের মৌলিক উত্তর অনুসন্ধান জটিলতর প্রক্রিয়া। জটিলতার অন্তর্গহিনের এক অবস্থা চিত্রণ ঘটেছে ঢালী আল মামুনের ‘Elimination, অপনয়ন’ শিরোনামের প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু এবং একক চিন্তার সামষ্টিকভাব সংশ্লেষণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে চারটি স্থাপনা ও ৪৪টি রেখা চিত্রকর্মের সমন্বয়ে এই প্রদর্শনীটিকে ব্যবচ্ছেদ করা যায় নানা উপায়ে।
ঢালী বলেন, প্রদর্শনীতে তিনি নির্দিষ্ট কোনো অর্থ উৎপাদন করতে চাননি। গণহত্যা বা জেনোসাইড, জাতীয়তাবোধের ইতি ও নেতিবাচক দিক নিয়ে ভেবেছেন এবং স্মৃতির অভিজ্ঞতায় ফেনোমেনা বা ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধিকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। কারণ, স্বাধীনতা সবসময় শক্তিশালী।
ঢালী আল মামুনের অভিজ্ঞতায় জেনোসাইড বা গণহত্যার যে বিবমিষাময় ভাষ্য তা প্রথমত উৎসারিত ও সম্পর্কিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে নির্বিচারে ঘটা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে। বিশেষত নারী শহীদদের স্মরণ।
অপনয়ন-২ স্থাপনাটি স্তূপীকৃত কাটা হাতের কম্পোজিশনে বৃত্তাকার বলয়। সচেতন আলোকসম্পাতে মেঝেতে আর অসংখ্য হাতের ছায়া দুই ধরনের বাস্তবতা নির্মাণ করে দর্শকের সামনে। শুরু হয় স্মৃতি হাতড়ে ফেরা অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপনয়ন-২-এর ফেনোমেনোলজিক্যাল সম্পর্কোন্নয়ন। নান্দনিক অভিজ্ঞতার সংজ্ঞায় সুখকর নয় এই কাটা হাতের স্তূপ। এই মানব-মানবীর মৃত শরীরে স্তূপ ’৭১-কে ইতিহাস থেকে বাস্তবে পুনরায় ডাক পাঠায় কারণ, গণহত্যার এই বীভৎসতার অভিজ্ঞতা এখনো বিদ্যমান দেশে-দেশে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে চলছে আন্তর্জাতিক গণহত্যা। কিছুদিন আগে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে প্রশ্নবিদ্ধ! প্রেক্ষাপট নির্মিত হতে চলা বাস্তবতার নিরিখে ঘটে চলে এলিমিনেশন বা বিয়োগ। বিস্মৃত স্মৃতিরা মনের অবচেতন স্তর থেকে সচেতন স্তরে এসে দৃশ্যকল্প তৈরি করে গ্যালারি কক্ষের সামগ্রিক বিষয় ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্কায়নের মধ্য দিয়ে। ঢালী আল মামুন মনোযোগী গ্যালারি স্পেস বা প্রদর্শনকক্ষের স্থান বিভাজনের নকশা নিয়ে। মেঝে, দেয়াল, ছাদ থেকে ঝুলন্ত বস্তু, এবং ছাদের দেয়ালও               ব্যবহার করেছেন বিবিধ বিষয়কেন্দ্রিক বস্তু স্থাপন করে যেমন, ফাইবার গ্লাস ও মেটালে কাস্টিং নেওয়া হাত, নাইলনের চুল, শুঁটকি মাছ, ব্যান্ডেজের কাপড়, শুকনো শাপলা ফুল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে।
ব্যবহৃত বস্তুর নাম অবশ্যই খুব ইতিবাচক নান্দনিক অভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করে না। অপনয়ন-৩-এ খড়ের গাদার মতো চুলের স্তূপ ও নিচে অসংখ্য পা। বৃত্তাবলয় আবারো। বৃত্ত হলো একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক আঙ্গিক। বৃত্ত হলো একটি পূর্ণাঙ্গ সীমানা নির্দেশ। অপনয়ন-৪-এ ছাদ থেকে মোটরচালিত উপায়ে কিছু বেণি করা চুল উঠছে-নামছে একটি নির্দিষ্ট মাপে এবং নিচে মেঝেতে চারটি হাত। এই প্রদর্শনীটিতে শিল্পী প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন। প্রজেক্ট আলোকসম্পাত, মোটরের ব্যবহারে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুর একক উপস্থাপন ও সামগ্রিক কম্পোজিশনে গতি তৈরি হয়েছে, আবার নাটকীয় আবহ তৈরি হয়েছে। এখানে একধরনের ফিকশন নির্মাণ হয়েছে। বিশ্লেষণাত্মক রূপ নিয়েছে কাব্যিক গুণাবলি। যেভাবে জটিলতর রূপ ধারণ করেছে দেশের জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি বহুমাত্রিক ‘বাদ’-এর বদান্যতা। প্রদর্শনীটিতে ব্যবহৃত রং হলো সাদা ও কালো। মূলত, সাদা ও কালোই এই প্রদর্শনীর মৌলিক কেন্দ্রবিন্দু। সাদা-কালোর অভিজ্ঞতার সংজ্ঞায় উপস্থাপিত হয় এ-প্রদর্শনীর দৃশ্যকল্প সংবেদনশীলতা এবং উপসংহার। অপনয়ন-১-এ বিখ্যাত স্প্যানিশ শিল্পী পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ ছবিটির খণ্ড-খণ্ড অংশ ব্যান্ডেজ কাপড়ের কয়েকটি তলের পর্দার ওপরে সঞ্চালনশীল প্রজেক্টরের মাধ্যমে। মানবতার চূড়ান্ত বিপর্যয়ের চলমান এই ক্ষত-বিখ্যাত রূপের আধাবিমূর্ত এক পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন।
দেয়ালে বিনির্মাণ ঘটেছে চারকোল মাধ্যমের ৪৪টি ড্রইং। মাছ, ঝুলিয়ে রাখা মৃত পশুর শরীর, কাগজ, আবর্জনার স্তূপ ইত্যাদি বিষয়বস্তু সম্পর্কিত হয়েছে স্থাপনাগুলোতে ব্যবহৃত একক বস্তুগুলোর সঙ্গে এবং সবমিলিয়ে যৌথতার সমন্বয়। শুকিয়ে যাওয়া শাপলা উল্লম্ব দিকনির্দেশে ঝুলন্ত অবস্থায় দর্শককে জাতীয়তা বোধের প্রশ্নে কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের ভাবনাকে উস্কে দেয়। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জের প্রেক্ষাপটে এ-শিল্প নিজ চরিত্রগুণে সমাজের ও ক্ষমতাবান কিংবা শোষক শ্রেণির চেতনায় হয়তো ক্রিয়া করবে হত্যাযজ্ঞ ও জীবনযজ্ঞের প্রশ্নে। মামুনের ভাষা তথাকথিত নান্দনিক নয়, কিন্তু তীব্রতা বিদ্যমান। স্থাপনা-শিল্পের চর্চায় মামুন খানিকটা জাপানিজ ‘হাইকু’ কবিতার মতো সংক্ষেপায়িত গল্প, বোধের ব্যাপকতা নিয়ে উপস্থিত। প্রদর্শনীটি কনটেক্সটের সঙ্গে সহজ বোধগুণসম্পন্ন, তিক্ত, অস্বস্তিকর এবং গুমোট। একবিংশ শতকের সভ্যতার যাপিত জীবনের মতো প্রদর্শনীটি ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।