অবগাহন

মোস্তফা তারিকুল আহসান

মায়ের চিঠি পেয়ে খোকা বাড়ি যাচ্ছে। 

হোস্টেলের কাউকে সে বলবে না মনে করে, ভাবে, শুধু সুপারকে বলবে। বারোটার দিকে ক্লাস থেকে আজ ফিরে এসে সে সুলাইমান পিয়নের হাতে মায়ের চিঠি পায়। পোস্টকার্ডে লেখা মায়ের চিঠি। তার মাইনর পাশ করা মায়ের বেশ মানানসই হাতের লেখা। খোকা মাকে বলতো রবীন্দ্রনাথের মতো হাতের লেখা। সে রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা দেখেছে রবীন্দ্র রচনাবলীতে। কিছু কবিতা ও গান কবির হাতের লেখা। মায়ের চিঠির  দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ে এই হাতের লেখা রবীন্দ্রনাথের মতো। হালকা হলুদ কার্ডে ধানের শিষ-আঁকানো আর তার বাঁপাশে পঞ্চাশ পয়সার একটা ডাকটিকিট।

খোকা দেখে – মা তার ঠিকানা লিখেছে নিজ হাতে, কোনো ভুল নেই, সেই বাঁকানো লেখা, মুক্তোর মতো যেন। মা লিখেছে, খোকা তোর ছুটি আছে কিনা জানি না, তবে তোকে অনেকদিন দেখি না, তাছাড়া শরীরটাও খুব ভালো নেই। কিছু বই পেয়েছি পড়ার জন্য, তুই এলে আনন্দ করে পড়তে পারব একসঙ্গে। দু-একদিনের মধ্যে বাড়ি চলে আয় খোকা। নিচে একটু ফাঁক করে লেখা – তোর  মা। খোকা বেশ  বুঝতে পারে, মা ইচ্ছে করে বইগুলোর নাম বলেনি। আর ঠিক কী কারণে বাড়ি যেতে হবে, তাও স্পষ্ট করে বলেনি। মা এরকমই, কোনো কথা যেন গুছিয়ে বলে না।

খোকা জামাকাপড় গোছাতে শুরু করে, একটা চামড়ার ব্যাগে সে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গোছাতে থাকে। জামাকাপড়, মোজা, পেস্ট, ব্রাশ দু-একটা বই। সুকান্তের কবিতাসমগ্র কেনা হয়েছিল, পড়া শেষ হয়নি এখনো, সেটা ও ব্যাগের মধ্যে ঢোকায়। মা কবিতা লেখে না, তবে কবিতা পড়তে ভীষণ পছন্দ করে। সুকান্ত মাও পড়তে পারবে নিশ্চয়। ছোটপাও পড়বে। তবে মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা বইটা তাঁকে অবশ্যই নিতে হবে। মা আর ছোটপা পড়লে নিশ্চয় পাগল হয়ে যাবে। খোকা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর জামাকাপড় পরতে থাকে, কী জামা পরবে এ নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। সে বরাবরই অগোছালো এবং পোশাকের ব্যাপারে উদাসীন। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে বা নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে মানানসই করার চেষ্টা সে কখনো করেনি। মা ও ছোটপা তাকে মাঝেমধ্যে সাজিয়ে দিত। সাজিয়ে দিত বলতে, চুল অাঁচড়ে দিত, জামাটি একটু টানটান করে দিত, কোন প্যান্টের সঙ্গে কোন শার্ট পরতে হবে ছোটপা ঠিক করে দিত। স্কুলে যেত দুজন একসঙ্গে, এক ছাতার তলায়। খোকার কোনো ছাতা ছিল না, বাবা ছাতা দিত না। ছাতা দিলেই সে হারিয়ে ফেলত পরের দিন। এখন এসব কথা ভাবলে কেমন যেন হাসি পায় খোকার। এখন সে নিজে নিজে চুল অাঁচড়ায়, এখনো ঠিকমতো গোঁফ ওঠেনি বলে গোঁফ কাটতে হয় না অন্যদের মতো। তবে সে কেন যেন কিছু জিনিস শিখে ফেলেছে হোস্টেলে থেকে। খোকা দ্রুত সব গুছিয়ে নেয়। ব্যাগের মধ্যে সব জিনিসপত্র ঢুকিয়ে ওর মনে পড়ে সুপারের কাছে যেতে হবে। দরোজা দিয়ে বের হবে, এমন সময় সে ফারুকের মুখোমুখি হয়। সে বলে, কী রে কবি, তুই কি কোথাও বের হচ্ছিস? ও বলে, হ্যাঁ, বাড়ি যাবো।

বাড়ি যাবো মানে? পরশু দিন আনিস স্যারের ফিজিক্স পরীক্ষা। না দিলে দেখিস কী হয়। আর কোনোদিন তার ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।

খোকা কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর উত্তর দেয়। সে তো জানি, কিন্তু মা যে চিঠি দিয়েছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। ফারুক বলে, খানিকটা যুক্তি দিয়ে বলে। এমনি তুই লেখালেখি করে যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছিস, পত্রিকায় তোর কবিতা-গল্প বের হচ্ছে, বেশ ভালো কথা। তবে সায়েন্সে পড়ে এত অনিয়মিত হলে ফেল করবি যে! খোকা কোনো উত্তর দেয় না। সে শুধু মায়ের মুখটা দেখতে পায়। সেখানে অন্য কিছু ভাবার মতো সুযোগ সে পায় না। মুখে বলে, এবারের মতো যাই। আর সহজে যাবো না। ফারুক ভেংচি কেটে বলে, আর যাবো না। মা বললেই তো বানরের মতো লাফাতে লাফাতে চলে যাবি।

ফারুক ঘরে ঢোকে আর খোকা ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বের হয়ে যায়।

ট্রেনে উঠে জানালার ধারে খোকা বসে বসে আকাশ দেখে; এই এক তার মহানন্দের বিষয়। মেঘের যে কত রং সে ঠিক বলতে পারবে না। এখন সূর্যের আলোর প্রক্ষেপে নানা বর্ণ ধরে আছে মেঘ। কালিদাসের এক কাব্যের কথা বলেছিল মা একদিন তাকে। মায়ের পন্ডিতমশাই নাকি তাদের সংস্কৃত কাব্য থেকে পড়ে শোনাতেন। কালিদাসের মেঘদূত কাব্য, সেখানে নাকি মেঘ একটা চরিত্র। সেই মেঘ উড়ে যাচ্ছে দূত হয়ে। মা এমনভাবে বলত যে, খোকা কল্পনায় সে-দেশে চলে যেত। এখন এ-আষাঢ়ের মেঘদল কোথায় যাচ্ছে, কোন ইশারায় যাচ্ছে খোকা জানে না। সে যাচ্ছে মায়ের কাছে মেঘের দলের সঙ্গে। খোকার মনে হয়, মা কি কখনো কবিতা লিখত? বাবা তো গান গায় হেঁড়ে গলায়, তো মা কি বাবার সঙ্গে গান করত নাকি তার মতো করে বই পড়ত। খোকার মনে হয় মা কবিতা লিখত। দু-একটা লেখার খাতা মায়ের ছিল, সেটা বেশ লজ্জা নিয়ে মা একদিন বলেছিল; কিন্তু কী লেখা ছিল সেখানে? একদিন চাপাচাপি করলে মা তার খাতা বের করেছিল টিনের জংধরা বাক্স থেকে। সেই বাল্যকালে লেখা কয়েকটি গল্পের মতো রচনা। মা বলেছিল, তোর দুটো যমজ বোন ছিল – রঞ্জনা আরা সাহারা; তারা পড়ত ক্লাস থ্রিতে। একবার দেশে মহামারি আকারে বসন্ত হলো। প্রতিটি বাড়িতে মারা গেল দু-একজন করে। আমাদের বাড়িতে মারা গেল তোর এ দুবোন। এত সুন্দর দেখতে ছিল দুজন, ঠিক যেন পরি নেমে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তোর বাবা সেই প্রথম গান গাওয়া শিখল। শিখল মানে, আমি আগে কখনো তোর বাবাকে গান গাইতে শুনিনি। মেয়েদের পাল্লায় পড়ে তোর বাবা গান গাওয়া শুরু করল। তাদের বায়না তো থামে না। না গাইলে চিৎকার করে, কান্নাকাটি করে। তখন রেডিও  ছিল, তবে আমাদের ছিল না। তোর বাবা একটা কাঠের বিশাল বাক্সের মতো রেডিও কিনে আনল। ভারতের রেডিও সেন্টার থেকে গান বাজতে শুরু করল। তোর বাবার গান শোনা শুরু হলো আর মেয়েরা বাবার গান শোনা শুরু করল। মুশকিল হলো, মেয়েরা রেডিওর গান শোনে না। তারা শুনবে বাবার গান। কী যে ওদের পছনদ বলা যায় না। আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, তুমিও শুনতে? তুমিও কি গাইতে? আমার কথা শুনে মা খানিকটা লজ্জা পায়। বলে, কী যে বলিস, তোর মাথামুন্ডুর ঠিক নেই। দুই বোন বাবার সঙ্গে মাথা দোলায় আর গান শোনে। তোর বাবাও হয়ে গেল শিশুর মতো। এত রাগী লোক আমি জীবনেও দেখিনি। সেই মানুষটা মেয়েদের জন্য কেমন শিশু হয়ে গেল। আমার মাঝেমধ্যে হাসি পেত, আবার অবাকও লাগত। একদিন দেখি, তোর বাপ মুখে মুখে ছড়া কাটছে। আর একদিন দেখি, তোর বাবা কোত্থেকে পুঁথি এনে সুর করে পড়ছে আর দুবোন মাথা দোলাচ্ছে। সবচেয়ে বিপত্তি হলো, একদিন তোর মেজমামা এসে দেখল মেয়ে আর বাবার কান্ড। সে কী কাজে এসেছিল, দহলিজের কাছে আসতেই দেখে, তোর বাবা হেঁড়ে গলায় জগন্ময় মিত্রের গান গাচ্ছে আর তোর দুবোন যথারীতি মাথা দোলাচ্ছে। ‘এই কী গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে…’, ‘তুমি আজ কত দূরে, তুমি আজ কত দূরে’ এই গান দুটো সেদিন করছিল তোর বাবা। তোর বাবা আরো একটি গান করত। সেটা শচীন কর্তার গাওয়া – বিরহ বড় ভালো লাগে। এই গান গাওয়ার সময় একদিন আমি ওদের আসরে হাজির হয়েছি, তোর বাবা জানে না যে, আমি  পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। তোর বাবা বলছে, জানিস এ-গান লিখত শচীন  দেববর্মণের স্ত্রী মীরা দেববর্মণ। আর সুর দিতেন কর্তা নিজে, একটু নাকিসুরে গান করলেও তিনি বাংলা আধুনিক গানের প্রবাদপুরুষ। বলেই তোর বাবা, নাকিসুরে বিরহ বড় ভালো লাগে গাওয়া শুরু করল আর কখন রঞ্জনা, সাহারা আমাকে দেখে ফেলল। ওরা হো-হো করে হেসে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। তোর বাবা গান থামাল, বেশ লজ্জা পেল বোঝা গেল। আমি বুঝি না তোর বাবা কেন আমাকে দেখে লজ্জা পায়। অবশ্য দেখলাম গান তোর বাবা ভালোই গায়। আর ওইদিন যখন দ্বিতীয় গানটি চলছে, তোর মামা ঢুকে পড়ল ভেতরে। তোর বাবা গান থামাল ওকে দেখে। তখন তোর মামা বলল, জামিলভাই, এসব কী হচ্ছে, মেয়েদের কী শেখাচ্ছেন? তোর বাবা নাকি বলেছিল, আমি না হয় বেশি লেখাপড়া জানিনে, চাষা মানুষ, তা তুমি তো জানো, গান আমাদের প্রাণ জাগিয়ে তোলে। তাছাড়া ওরা আবদার করলে আমি কী করব? তোর মামা আসলে রাগ করেনি, তবে ধর্মীয় পরিবারে মেয়েদের ধর্মকর্ম না শিখিয়ে গান শেখানো ও পছন্দ করিনি। পরে পাড়ার লোকও এ নিয়ে কথা বলেছিল। তোর বাবা কাউকে পাত্তা দেয়নি। তার যুক্তি ছিল, আমি তো কারো ক্ষতি করছি না। সেই দুই বোন যখন মারা গেল বসন্তে, তখন তোর বাবা প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাস স্বাভাবিক আচরণ করত না। খাওয়া-দাওয়া করত না। ঘুমাত না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। রঞ্জনা আর সাহারা মারা যাওয়ার পর ওদের নিয়ে আমি প্রথম কলম ধরি। কী হয়েছে জানি না। তবে ওদের সম্পর্কে আমি যা ভাবতাম তাই লিখে রেখেছি।

জানালায় মেঘের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য খোকাকে বিহবল করে; সে জানে না, মেঘ তাকে কী বলতে চায়, কিংবা মেঘ দেখে তার কী মনে হয়। তবে সে জানে, এ-ট্রেনে অজস্র যাত্রীর ভিড়ে আষাঢ়ের মেঘ তাকে আলাদা করে রেখেছে। বাদামওয়ালা ‘বাদেম বাদেম’ করে চিৎকার করছে, ঝালমুড়ি মাখিয়ে বিক্রির জন্য চিৎকার করছে একটা ছেলে। ওর একটা পা প্রায় নষ্ট। সে কোনোরকমে হাঁটছে আর ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি বলে চিৎকার করছে। তেমন কেউ কিনছে বলে হয় না। খোকার কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করে না, তবু সে ছেলেটাকে সাহায্য করার জন্য এক টাকার ঝালমুড়ি কিনল। ছেলেটা ম্লানমুখে ওকে খাবার দিলো আর ম্ল­ানমুখেই টাকাটা নিল। খোকা লক্ষ করে, ওর মুখে কোনো সতেজতা নেই। তেরো-চোদ্দো বছরেই সে যে কেমন শুকিয়ে গেছে, সংসারের হাল ধরেছে হয়তোবা। অথবা তার হয়তো কেউ নেই। নিজের পেটের জন্যই সে এ-কাজ করছে। স্কুলে পড়ার সময় খোকা একটা ছেলের কাছে প্রতিদিন ছোলামুড়ি খেত। ছোলাভাজা আর মুড়ি একসঙ্গে এক ঠোঙায় করে আট আনা করে কিনত। কখনো সে আনত শুধু চানাচুর, কোনোদিন হয়তো শিঙাড়া। তবে ছোলামুড়ি আনত বেশিরভাগ সময়। সে-ছেলেটার তখন স্কুল যাওয়ার বয়স। সে কেন স্কুলে যায় না, সে-চিন্তা করেই খোকার খুব খারাপ লাগত। ওর বাবার নাম ছিল সন্তোষ, সে অ্যাক্সিডেন্ট করে বাড়িতে বসে থাকে। গোটা সংসারের দায়িত্ব ছিল ওইটুকু ছেলের ওপর। খোকা ওর কাছে সময় পেলে বসে যেত। নানা গল্প শুনত। সে রাজ্যের গল্প জানত। যখন ভিড় কম থাকত তখন খোকার সঙ্গে গল্প করত রামলাল। কীভাবে চানাচুর, শিঙাড়া, মুড়ি তৈরি করতে হয়, মাকে কীভাবে সাহায্য করে সে-গল্প। তার গল্পের ঝুড়িতে ছিল আরো অনেক গল্প। খোকা আজো ভেবে পায় না, এসব গল্প সে কোথায় পেত। সে একদিন তাকে এ-বিষয়ে জিগ্যেস করেছিল। সে উত্তরে বলেছিল, আমার বাবার তো কোনো কাজ নেই, চলতে-ফিরতে পারি না, তাই বসে বসে গল্প বানাই। আমার ছোট বোন আর আমি বসে বসে গল্প শুনি। আর মা খাবার বানায়, বানানো হলে আমি স্কুলে নিয়ে আসি। খোকা বলতে না চাইলেও মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল একদিন, তোমার স্কুলে যাতি ইচ্ছা করে না, আমাদের মতো? কোনো উত্তর না দিয়ে রামলাল চুপ করেছিল। সেই বিনম্র আর কষ্টকর মুখ খোকার আজো মনে আছে।

ট্রেন একটা স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে, খোকা জানালা দিয়ে তাকায়, দেখে লেখা আছে হরিণচড়া। বাহ্, সুন্দর নাম তো। সে আগেও হয়তো দেখেছে, তবে মনে নেই। হরিণচড়া মানে কী? কে রেখেছে নামটা? এখানে কি একসময় হরিণ পাওয়া যেত? তার সামনের লোকটা ট্রেনে ওঠা অবধি নাকডেকে ঘুমাচ্ছে, বিচিত্র তার নাকডাকার ভঙ্গি। বিরাট জোরে শব্দ তো হচ্ছেই আবার মুখের ভেতর থেকে থুথুও বের হচ্ছে। খোকা সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে পাশে বসা লোকটা যে ভয়ংকর বিরক্ত সেটা বোঝা যাচ্ছে। সে লোকটা ঘুমন্ত লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু লোকটার কোনোভাবেই ঘুম ভাঙছে না। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক উপায়ান্তর না পেয়ে উঠে চলে গেল। লোকটা এবার আরো জোরে নাক ডাকতে শুরু করল। খোকার মনে হয় লোকটা হয়তো কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি, তাই এভাবে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সবাই লোকটাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করল, কেউ মাতালও বলল; কিন্তু লোকটা কোনো প্রতিবাদও করল না। প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা হয়তো নেই। কোনো রকমে ট্রেনে উঠতে পেরেছে। আর ঘুম তাকে ছাড়ছে না। লোকটার জন্য খোকার খুব মায়া হয়। মায়ের জন্য আগেভাগে কিনে রাখা একটা চাদর সে ব্যাগে ঢুকিয়েছে কিনা, কিংবা ছোটপার জন্য কলমটা নিয়েছে কিনা সে ব্যাগ খুলে দেখতে থাকে। ব্যাগ খুলতেই পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা পথের পাঁচালী ও সীমাবদ্ধ উপন্যাস দুটি দেখতে পায়। আরো কয়েকটা বই তো ভেতরে আছে। মানিকের বইটা নিয়েছে কিনা মনে করতে পারে না। ব্যাগ খুললে কে কী ভাবে তাই ভেবে আবার ব্যাগ বন্ধ করে। এটা ওর একটা রোগের মতো, কোথাও গেলে মনে হয় কী যেন নেওয়া হয়নি। পরে দেখা যায় ঠিকই জিনিসটি ব্যাগের ভেতর আছে। মা ওর ব্যাগ ভালো করে গুছিয়ে দেওয়ার পরও ওর এমন মনে হয়।

কোনো কাজ না পেয়ে খোকা পথের পাঁচালী বইটা বের করে। সাধারণত সে পথে বই পড়ে না, বরং মানুষ জনপদ নিসর্গ দেখে অসীম আগ্রহ নিয়ে। মেঘের দৃশ্য এখন আর নেই শুধু পাছপালা দেখা যায়, তাও একসময় আগের মতো আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে না। কেন থাকে না, খোকা বলতে পারবে না। স্কুলমাস্টার বিভূতিভূষণ অপুকে যেভাবে বর্ণনা করেছে খোকার কাছে তা অসাধারণ মনে হয়। সেখানে প্রকৃতি আলাদা সত্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পাশের লোকটা তার বই পড়া নিরীক্ষণ করে আর ভ্রূকুঞ্চন করে। ভাবখানা এমন যে, এত বই পড়ার ভাব দেখানোর কী আছে! তবে লোকটা কোনো মন্তব্য করে না। তবু ওর মনে হয় বই এখন না পড়াই ভালো। সে বইটা হাতে নিয়ে বসে থাকে। ভদ্রলোকের ডানপাশে স্ত্রী বসে আছে, তার কোলে চার-পাঁচ বছরের একটা ছেলে, সে এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল। এখন সে বিচিত্র কায়দায় গান শুরু করল। গানের কোনো অর্থ নেই, অপুর ছোটবেলার মতো। খোকার মনে হয়, আচ্ছা আমি যে রেলগাড়ি চড়ে যাচ্ছি, এই রেলগাড়ি দেখতে কি অপু-দুর্গা গ্রাম থেকে মাঠ পেরিয়ে মাঠের আল পেরিয়ে আসছে দৌড়াতে দৌড়াতে? আবার মনে করে, কী বোকার মতো ভাবছে। সেই কয়লার রেলগাড়ি বিকট শব্দ করে প্রচন্ড ধোঁয়া ছেড়ে ভুসভুস করে ছুটত, আর সে কবেকার কথা, তখন তো তার জন্মই হয়নি। তবু অপু-দুর্গাকে তার সমবয়সী মনে হয়। মনে হয় তারা বন্ধু আর কত জনমের চেনা। আরো ঘণ্টাখানেক তাকে থাকতে হবে ট্রেনে, ভাবতেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে, কখন পৌঁছাবে গ্রামে, মাকে দেখবে, টুনুর সঙ্গে ছোটপার সঙ্গে দেখা হবে, কত কথা হবে, টুনু তো টানতে টানতে নিয়ে যাবে মাঠে। আজ আর খেলা হবে না, যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে প্রায়। মা তখন রান্না করতে থাকবে, নাকি তার খোকা বাড়ি আসবে বলে, নাড়ু মাখিয়ে মুড়ি নিয়ে বসে আছে, টুনু বেশি নিয়ে নেবে বলে কি মা চিন্তা করবে। হয়তো মা বলবে  – যা তো খোকা, ছোটমামার প্রগতি লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে আয়। খোকা বলবে, মা তোমার দুদিনের বইয়ের জোগাড় করেই এনেছি। মা সবই পড়বে, তবে কেন জানি খোকার মনে হচ্ছে সীমাবদ্ধ উপন্যাসটি মায়ের পছন্দ হবে না।

ট্রেনের জানালায় আর রোদ নেই। বিকেলের ম্লান আলো এসে গাছের পাতার সঙ্গে লেগে ট্রেনের দুলুনিতে একটা নতুন ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে, রোদ পিছলে যাচ্ছে, বাতাস খেলা করছে রোদ নিয়ে, গাছের পাতা নিয়ে। কলাগাছের পাতায় দৃশ্যগুলো সবচেয়ে আলাদা মনে হচ্ছে। খোকা তাকিয়ে থাকে। গরুর পাল নিয়ে রাখালরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, গরুগুলো সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে একটি রাখাল। হল্লা করে ছুটে যাচ্ছে কিশোর ছেলের দল। ট্রেন থেকে নেমেই সে ভ্যানগাড়ি করে সোজা বাড়ি পৌঁছে যাবে। আরো বিশ মিনিট লাগবে। মায়ের সঙ্গে দুটো কথা বলে সোজা মাঠে যাবে। এখন তো ক্রিকেট চলছে না বৃষ্টির জন্য, চলছে ফুটবল। তাকে নেবে তো দলে? সে তো খুব ভালো খেলোয়াড় না। তাকে দলে নেবে কারণ সে সবসময় দলের সঙ্গে ছিল, তাদের টিম থেকে কখনো তাকে বাদ দেয়নি তাদের ক্যাপ্টেন রসুল। সে ক্রিকেট দলেরও ক্যাপ্টেন। দলে সে খুব ভালো খেলোয়াড় না হলেও কখনো রসুল তাকে বসিয়ে রাখেনি। কেন বসিয়ে রাখেনি, এ নিয়ে সে অনেক সময় ভেবেছে। তেমন কোনো জুতসই কারণ খুঁজে পায়নি। একটা কারণ হতে পারে, সে টুনুর ভাই। টুনু যেহেতু দলের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়, কাজেই তার ভাইকে নিতে হবে। না নিলেও হয়তো কেউ কিছু বলবে না। রসুল অবশ্য তাকে কবি বলে ডাকে মাঝে মাঝে। সে হিসেবে কি সে খোকাকে সম্মান দেখায়? হতে পারে আবার নাও হতে পারে। রসুল লেখাপড়ায় ভালো নয়। তবে ওর ব্যবহার ভালো। তবে অন্যের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে কি-না তা সে বলতে পারবে না। খোকার সঙ্গে করে না। কেন করে না? খোকা লেখাপড়ায় ভালো বলে? নাকি সে ঠান্ডা শান্তশিষ্ট বলে।

ভ্যানে করে যেতে যেতে খোকা তার বাড়ির ছবি দেখতে পায়। মাত্র পাঁচ মাস সে বাড়ির বাইরে, তাতেই মনে হচ্ছে কত যুগ যেন বাড়ির বাইরে। সে দেখতে পায়, টালি দিয়ে ছাওয়া তাদের আটচালা প্রধান ঘরটি, তার পূর্বপাশে লম্বা ঘরটিও সে দেখতে পাচ্ছে। দক্ষিণ দিকের বারান্দার সঙ্গে লাগানো একটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। এখন আর তেমন ফুল নেই। গোয়ালঘরের সামনে কামিনীগাছটিও সে দেখতে পায়। পাশে বাঁগাছটির ডালে অনেকগুলো ফুল। পেছনে কলার বাগান, সামনে উঠোন, উঠোনের শেষ মাথায় একটি টিউবওয়েল। তার ওপাশে বিরাট একটা পুকুর। পুকুরের ডানপাশে বিশাল বাঁশবাগান, বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে তাদের খেলার একটা পথ, প্রধানত পাখি শিকারের জন্য এ-পথেই টুনু আর খোকা জাহিদকাকুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত। মা-বাবা জানত না, দেখতে পেত না। পুকুরের ডানপাশে একটি সবজির ক্ষেত বাবার হাতে লাগানো, ক্ষেতের অনেক ফসল যেন খোকা এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে। প্রতিদিন পুকুরে মাছ ধরতে নামতে হবে। পানি বেশি থাকলে বড়ভাই নামবে, একটু কম হলে খোকা আর তার শেফালি আপা। বড়ভাই অবশ্য প্রায়শ নামতে চায় না। বললেই বলে, আমার লেখাপড়া আছে না? সে তখন বিএ পড়ে। মা অগত্যা আমাকে আর শেফালি আপাকে ধরে। কি শীত কি গ্রীষ্ম মা মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। মাংস রান্না হলেও মা মাছ খাবে। পুকুরে না পেলে বিলের মাছ কিনে আনবে অন্যদের বাড়ি থেকে।

লাল সুরকি দেওয়া রাস্তা থেকে খোকা নামে, আশপাশে কেউ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করে না। মাঠের মাঝখান দিয়ে এক দৌড়ে এসে বাড়ির উঠানে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়ায়। বাবা বাড়ি নেই সে বুঝতে পারে। এ-সময় বাবা বাড়ি থাকে না। টুনু চলে গেছে মাঠে। ছোটপাকে পাওয়া যাবে না। সে গেছে নিশ্চয় কোথাও ঘুরতে। শেফালি আপার তো বিয়ে হয়ে গেল কিছুদিন আগে। মা! মা! করে চিৎকার করে ডাকতে থাকে খোকা। মা ছিল রান্নাঘরে। মা বেরিয়ে আসার আগে বলে, আয় খোকা। মায়ের ডাকে তেমন কোনো জোর থাকে না কখনো। সে যে ঘন-ঘন অকারণে মা মা করে ডাকে, সে-বিষয়ে মা কখনো তাকে কিছু বলেনি। আজকের ডাকেও মা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আজো মায়ের কথায় কোনো জোর নেই। তার স্থির বিশ্বাস থেকেই তিনি সব করেন, লোকদেখানো কিছু করতে পারেন না। ডাক শোনার পর খোকা দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কতবড় হয়েছে খোকা, স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ছে, তবু সে মায়ের কাছে আগের ছোট খোকাই আছে। মা অাঁচল দিয়ে খোকার কপাল মুখ মুছে দেন, যেন তার খোকা কত কষ্ট করে বাড়ি ফিরে এসেছে। কপালে হাত বোলাতে  বোলাতে বলেন, কেমন আছিস, খোকা? পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো? তোকে আসতে বললাম হঠাৎ করে, তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

খোকা বলে, অসুবিধা হলে হবে, এ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিকই ভালো পরীক্ষা দেবো?

মা বলেন, বইটই এনেছিস কিছু?

: এনেছি, তবে তুমি হয়তো আগেই পড়েছ এগুলো।

: ঠিক আছে, পড়া থাকলে কী, আবার পড়ব, বই যত পড়ি নতুন নতুন স্বাদ লাগে।

খোকা ব্যাগ থেকে তিন-চারটে বই বের করে মায়ের হাতে দেয়। মা নাড়াচাড়া করে দেখে। খোকা বলে, মা আমি মাঠে যাবো, হয়তো আর খেলার সুযোগ পাব না, তবু সবার সঙ্গে দেখা করে আসি। ‘কিছু মুখে দিয়ে যা’ বলতে বলতেই খোকা পূর্ব দিক দিয়ে মাঠের দিকে দৌড় দিলো। মা বইগুলো খোকার ব্যাগে আপাতত রেখে দেয়। কারণ সাহেলি ফিরলে তার সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা হবে, কে কোন বই আগে পড়বে।

মাঠে তখন প্রবল উত্তেজনা, টুনুদের পক্ষ গোল খেয়ে প্রচন্ড বেগে রসুলদের গোল দেওয়ার চেষ্টা করছে। বারবার ওরা আক্রমণ করে আর রসুলরা প্রতিহত করে দেয়। আর বেশি সময় খেলা যাবে না, অাঁধার হয়ে আসছে। তবু এটুকু সময়ের মধ্যে একটা ভালো ফল করতে চায় টুনুরা। এক গোলে পিছিয়ে থেকে তারা মাঠ ছাড়বে, এটা ওরা মেনে নিতে পারে না। সাধারণত ওরা সবসময় জেতে, আর সেজন্য এটা অলিখিত রীতি হয়ে গেছে যে, টুনুদের দল বরাবর জিতবে। প্রধান স্ট্রাইকার সে, সে-ই প্রতিদিন গোল করে। আজ বোধহয় গোল দিতে পারল না। টুনুর দলে রহিম বল নিয়ে বিপরীত পক্ষের গোলপোস্টের দিকে প্রবল বেগে যেতেই একজন এসে তাকে রুখে দেয়। এমনভাবে রুখে দেয় যে, তার পায়ে প্রচন্ড আঘাত লাগে। সে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে মাঠে। টুনু খোকাকে দেখতে পায়নি এখনো, দেখলেও এখন দলে নেওয়ার সময় নেই। তবে রহিম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে একজন খোকাকে ডাকল। খোকা রাজি হলো না। এই সময় খুব জোরে বৃষ্টি নামল। কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠে জল জমে গেল, জল জমতেই থাকল। বৃষ্টি পড়তে থাকল মুষলধারে। খেলা চলতে থাকল, তবে খেলার চেয়ে বৃষ্টি নিয়েই সবাই মেতে থাকল। বৃষ্টির পানিতে মাঠ সয়লাব হয়ে গেল দেখতে দেখতে। সবাই আনন্দে লাফাতে থাকল। খেলা বন্ধ হলো, চলল হই-হুল্লোড়। খোকা নেমে গেল মাঠে। কে কোনদিকে দৌড়ায় বোঝা যায় না। এর-ওর গায়ে পানি ছিটায় আর বল মারে এলোপাতাড়ি। ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেল কেউ কেউ। রসুল এসে খোকাকে জিগ্যেস করল – কখন এলি, আজ তোর খেলা হলো না রে! আজ তো আমরা জিতলাম। টুনু এগিয়ে এলো, সে বলে, খবর কী তোর? যদিও খোকার দুবছরের ছোট, তবে তাদের মধ্যে কথা বলার শুরু থেকেই তুই-তুকারি চলে। আরো কজন এগিয়ে এলো। খেলা আর লাফালাফি শেষ। সবাই বৃষ্টিতে ভিজছে একসঙ্গে। কে একজন বলল, কী রে, তোদের দেখছি বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই। তখন রসুল বলল, হ্যাঁ, চল, বাড়ি যেতে হবে, না হলে আবার বকাবকি খেতে হবে। সবাই বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ধরে।

টুনু আর খোকা এখন নিজেদের বাড়ি যাবে একসঙ্গে। বহুদিন পরে টুনুকে দেখল খোকা, কেমন যেন রোগা আর কালো কালো হয়ে গেছে। সে বলল, কী রে টুনু, তোকে রোগা আর কালো কালো লাগছে কেন? ও বলে, ধ্যাত, কী যে বলিস। তোর দেখার ভুল। বলেই সে মুচকি মুচকি হাসে। আবার বলে, হ্যাঁ, তোকে একটু ফর্সা লাগছে বটে। আর মনে হয় একটু মোটা হয়েছিস। খোকা বলে, না না, কী যে বলিস। কী করে মোটা হবো? যা রান্নাবান্না, তুই খেলে বমি করে দিতিস। এমনিতেই টুনুর খাওয়া নিয়ে বেশ কষ্টে থাকেন মা। বেশিরভাগ জিনিস সে খায় না। আর তার মর্জিমতো মাকে রান্না করতে হয়। তবু সে বলে, কেন ওখানে আর কেউ থাকে না, তুই শুধু একলাই খাস? খোকা কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। শুধু বলে, একদিন গিয়ে খেয়ে আসবি। তাহলে বুঝবি, খাওয়া কাকে বলে এবং কত প্রকার। টুনু আর খোকার কথার মাঝেখানে ছোটপা এসে যোগ দেয়, একটু পরে মাও আসে। বাবা এখনো বাড়ি ফেরেনি। বাবা নিশ্চয় বাজারে গেছে। খোকার কথা শুনতে পায় ছোটপা। সে বলে, কেন, কী কী খেতে দেয় তোদের? মাছ-মাংস-সবজি এসব দেয় না নাকি মধ্যপ্রাচ্যের খাবার?

খোকা বলে, মধ্যপ্রাচ্যের খাবার মানে কী? তুই কি মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিস কখনো?

: যাইনি, এমনি বললাম, তাছাড়া আরব্য রজনীতে পড়েছি না, কত রকমের খাবার, পানীয় সরাব, বেহেশতের ফলমূল।

: কী যা-তা বলিস?

: তাহলে, তোর খাবার সমস্যা কেন? তুই তো বহুদূর যাসনি। খুব হলে একশ বা সোয়াশ মাইল হবে।

মা চলে এলে ওদের অহেতুক কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। মাও খোকার দিকে তাকিয়ে বলে, তুই তো অনেক রোগা হয়ে গেছিস রে। মাঠে যাওয়ার আগে মা ঠিকমতো খোকাকে দেখতে পাননি বোধহয়। মায়ের কথা শুনে টুনু মুচকি দিয়ে হাসে, তার সঙ্গে, ছোটপাও হাসে। মা বলেন, তোরা হাসিস ক্যান, ব্যাপার কী? কেউ কিছু বলে না। প্রতিবার যখন কেউ কিছুদিন পর বাড়ি আসে, মা বলবে, তুই রোগা হয়ে গেছিস। এটা মায়ের একটা অভ্যাস। ওদের হাসি দেখে খোকার মনে হয়, মা কেন প্রতিবার বলেন এ-কথা।  বাস্তবিক তো তাকে রোগা লাগছে না। সে জানে, মা তাদের নিয়ে সব সময় চিন্তা করেন। তার সে-চিন্তার ছাপ পড়ে তার কথায়, তিনি চান তার সন্তানরা সবসময় যেন সুখী ও স্বাস্থ্যবান থাকেন।

ছোটপা কোনো ভূমিকা না করেই বলে ফেলে – আচ্ছা মা, তুমি সব সময় সবাইকে বাড়ি ফিরলে রোগা রোগা বলো কেন? সত্যি কি বুলু রোগা হয়ে গেছে? নাকি তুমি বানিয়ে বলছ?

মা বলেন, বানিয়ে বলব কেন, মনে হয় তাই বলি।

ছোটপা বলে, ভালো দেখলেও রোগা বলছ কেন?

মা বলেন, তোরা ব্যাপারটা বুঝবি না, আর আমিও ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তোরা বড় হ, মা হ, তখন হয়তো ব্যাপারটা বুঝবি।

মায়ের কথা শুনে টুনু ছোটপার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি  হাসে। ছোটপা লজ্জা পায়, সে আর কথা বাড়ায় না।

বারান্দায় দুটো বাল্ব জ্বলছে। পাড়ার সাত-আটজন ছেলেময়ে খোকাদের বাড়িতে পড়ে। এ-পাড়ায় ওদের বাড়িতে শুধু বিদ্যুৎ আছে। তাও বেশিক্ষণ থাকে না। তাই হারিকেনের ব্যবস্থাও থাকে। ছেলেমেয়েরা লম্বা বারান্দায় মাদুর পেতে বসে পড়ে। মা তাড়া দেয় খোকা, টুনু আর ছোটমেয়েকে। টুনু এখনো স্কুলে, ছোটপা কলেজে তবে ফাইনাল ইয়ারে। সে থাকে শহরে বড় ভাইয়ের বাসায়। এখন ওর ক্লাস হচ্ছে না, তাই মাসখানেক বাড়িতে থাকবে। ছেলেমেয়েরা নিজেরা পড়ে। কোনো সমস্যা হলে মা ওদের দেখিয়ে দেয়। খোকা যখন বাড়ি ছিল, তখন ও দেখাত। বাবা অবশ্য দেখান না। তবে ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ছে এতে তার কোনো আপত্তি নেই। কারণ বহুদিন থেকেই এ-নিয়মটা চলছে। সবাই এখানে পড়ে বই-খাতা রেখে যায়। আবার স্কুল যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার রাতে খেয়ে যায়। যারা টুনু আর খোকার খুব ঘনিষ্ঠ তারা খেয়ে যায়। মা জানে, প্রতিদিন কয়েকজন করে খাবে। সে-ব্যবস্থাও মা করে রাখেন। বারান্দায় লাইন দিয়ে সবাই বসে যায়, যে যার মতো চিৎকার করে পড়া শুরু করে। একটা বিষয় ভাবতে খোকার খুব অবাক লাগে। বাবার মতো রাগী মানুষ এত চিৎকার- চেঁচামেচিতে কিছুই বলে না কেন? দুপুরে যেদিন বাবা ঘুমায় কাউকে কথা পর্যন্ত বলতে দেয় না। সেই বাবা ক্লান্ত হয়ে বসে থাকে, বসে বসে জাল বোনে পুকুরে মাছ ধরার জন্য। খোকা আর ছোটপা মায়ের কাছে ছোট খাটটার ওপর বসে। তারা এখন নতুন পাওয়া বই নিয়ে কথা বলবে। ছোটপা বলে – এই বুলু, কী বই নিয়ে এসেছিস বের কর। ‘এই রে, বইগুলো তোকে তো দেখানোই হয়নি’ বলেই সে উঠে গিয়ে ঘর থেকে বইগুলো নিয়ে আসে। মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা বইটা মা এবং ছোটপার খুব পছন্দ হয়। তবে শংকরের সীমাবদ্ধ কারো পছন্দ হয় না। আর পথের পাঁচালী সবার পছন্দ, তবে তারা দুজন আগেই এটা পড়ে ফেলেছে। তবে মানিকের বইটা কে আগে পড়বে তাই নিয়ে মা ও ছোটপার মধ্যে খানিকটা কথা চলে। দুজনই চায় বইটা আগে পড়তে। খোকা বইটা ছোটপার হাতে তুলে দেয় এবং বলে, তোর পরে মা পড়বে, তারপর আমি। মায়ের আপত্তি ছিল সেটা বোঝা যায়, তবে মেয়ের সঙ্গে জেদ করে না। মা হয়তো ভাবে, মেয়ের সঙ্গে জেদ করলে সবাই কী ভাববে। তাছাড়া ওরা তো সব সময় বাড়ি থাকে না। মায়ের খুব সুবিধে, শুধু রান্নার সময় বাদ দিয়ে মা প্রায় সারাদিন পড়ে। দুপুরে খাওয়ার পর মা পড়তে বসে। তখন বাড়ি প্রায় নির্জন, অনেকে ঘুমায় বিশেষত বাবা ঘুমিয়ে পড়ে। আর বাবার অভ্যেস হলো, তার ঘুমের সময় কোনো শব্দ করা যাবে না। খোকা আর টুনু তো সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বনবাদাড়ে টো-টো করে  ঘুরে বেড়ায়। ওরা ভাত খাওয়ার পর অপেক্ষা করে কখন বাবা ঘুমাবে, সেজন্য বাবা ঘুমালে তারা সটকে পড়ে। তাদের নেতা জাহিদকাকুর সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়ে। সাধারণত পাখি শিকার তাদের উদ্দেশ্য, তবে কদাচিৎ তারা পাখি মারতে পারে । মূলত ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই তাদের আসল। আর এর সঙ্গে দুনিয়া দেখার আনন্দ তারা বুঝে নিয়েছে। মা এই ফাঁকে বসে বসে বই পড়ে। সেটা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায়। এর ফাঁকে বসে বসে একটা হালকা ঘুমও হয়ে যায়। এই ঢুলুনি পর্বটা বেশ মজার। মা ঢুলতে ঢুলতে প্রায়শ সামনের দিকে কাত হয়ে পড়ে। আবার উঠে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বইপড়া শুরু করে। অনবরত এ-ঘুম এবং জাগরণের পর্ব চলে আধঘণ্টার মতো। বাবা জেগে থাকলে মাঝে মাঝে বলেন, এই তোর মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দে। আরেকটা বালিশ দে মাথার নিচে। মা বলেন, আমি ঘুমাচ্ছি তোমাকে কে বলল? বাবা বলেন, কে বলবে আবার, আমি তো নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বই পড়ার চেয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে নিয়ে তো বই পড়া যায় নাকি? তারপর মা সত্যি সত্যি আর ঘুমের দিকে যায় না। তখন পড়া চলতে থাকে একটানা। বাবা ঘুম থেকে উঠে বলবেন, খোকার মা, আমি তো বের হবো, তোমার বই পড়া এবার বাদ দেওয়া যায় না? আর ঘুমাতে ঘুমাতে বইপড়া লাগবে না। মা কোনো উত্তর দেয় না, তখন মা বইয়ের জগতে। বাইরের কোনো কিছুতে তার মনোযোগ থাকে না। বাবা আবার বললে মা শুধু বলেন, আচ্ছা। বাবা বলেন, কী আচ্ছা, আমি তো বাজারে যাবো, কী কী আনতে হবে, বলো। মা বলেন, আনো তোমার সুবিধামতো। বাবা আর কথা বাড়ান না, তিনি বুঝতে পারেন, খোকার মাকে আর পাওয়া যাবে না। আগে তিনি রাগ করতেন, এখন আর করেন না, ভাবেন, মানুষটা বই পড়ে যদি একটু আনন্দ পায় তাহলে পাক। সংসারের ঘানি টানতে টানতে আনন্দ তো বিদায় হয়েছে বহু আগে। তাছাড়া নিজেও তিনি একসময় বই পড়তেন, গান করতেন। এখন আর সময় পান না; কিন্তু মনের খেদ ঠিক রয়ে গেছে। মানুষ জীবনে কী নিয়ে বাঁচে? তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন। এ নিয়ে খোকার মায়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে অনেকবার, যা তাকে সামান্য আনন্দ দেয় তা-ই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। বাঁচিয়ে রাখে মানে, মানসিকভাবে বাঁচিয়ে রাখে। সেজন্য তিনি খোকার মাকে খুব বেশি বিরক্ত করেন না।

ছোটপা মানিকের বইটা নিয়ে পড়া শুরু করে দেয়। মা পড়তে থাকে পথের পাঁচালী। খোকা জানে, সে যতই বলুক মা এখন সীমাবদ্ধ পড়বে না। পরে পড়তে পারে। সে ভাবে, সে আগে পড়বে, পরে এ-সম্পর্কে বললে মা তখন পড়তে পারে। চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝে ছোটপা আর মা ঠিকই উপন্যাস পড়ে চলে। খোকার একটু অসুবিধা হতো প্রথম প্রথম, এখন মোটামুটি সয়ে গেছে। খোকার সমস্যা অন্যরকম। সে বই পড়তে গিয়ে খুব এগোতে পারে না। কারণ সে পড়তে পড়তে নিজেই ওই বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, নিজেই নতুন লেখার সূত্র পেয়ে যায়। তখন মাথার মধ্যে নতুন লেখার পরিকল্পনা চলে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় সেটা হারিয়ে যায়। হারিয়ে যেতে যেতে দু-একটা বিষয় তাকে বেশ আপ্লুত করে ফেলে, সেগুলো মাথার ভেতর থেকে হারিয়ে যায় না। সেগুলো দীর্ঘদিন জমে থাকতে থাকতে একদিন বের হয় লেখা হিসেবে, যদিও এখন সে কম লেখে। তবু মাথার মধ্যে থাকে অনেক লেখা। মাথার মধ্যে থাকা লেখা নিয়ে সে ভাবে, সেই লেখাই তাকে ভাবায়, আবার নতুন নতুন বই পড়ার সময় নতুন বিষয় মাথায় যোগ হয়। জমা লেখার মধ্যে কোনটা লেখা হবে আর কোনটা লেখা হবে না, সে-কথা খোকা বলতে পারে না। খোকা মাঝে মাঝে ভাবে, সে কি সত্যি লেখক? কিছু কবিতা, ছড়া আর কয়েকটি গল্প লিখলেই কি একজন লেখক হয়ে যায়?

খোকা মনে করে, সে কি টলস্টয় বা রবীন্দ্রনাথের মতো নিজের ভুবন তৈরি করতে পারবে কখনো? আবার ভাবে, এসব না ভাবাই ভালো। কারণ যা সে লিখতে পারছে, তা-ই লিখে যাক, পরে দেখা যাবে কী হয়। কিন্তু লেখক হিসেবে তার কি কোনো সত্তা তৈরি হয়েছে? সেসব নিয়েও সে মাঝে মাঝে ভাবে। তবে লিখতে লিখতে যে একদিন তার আলাদা সত্তা তৈরি হবে সেটা সে বোঝে। এখন সে যখন তাড়না পাচ্ছে এবং না লিখে পারছে না, তখন তাকে লিখতে হবে।

মা, ছোটপা বুঁদ হয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে পড়ছে। টুনুও পড়ছে ওর স্কুলের পড়া। বাবা খোকাকে ডাকে।  বাড়িতে আসা অবধি তার সঙ্গে বাবার কথা হয়নি। সে কি বাবাকে অবহেলা করছে? নাকি বাবাই তাকে অবহেলা করছে। হঠাৎ ওর এরকম মনে হলো কেন, সে তাই নিয়ে এখন ভাবতে থাকে। বাবা তাকে ডাকতে দেখেই ওর এসব কথা মনে হলো। সে বাবার কাছে গিয়ে বসে। বাবা খোকার মাথায় হাত রেখে বলে। খোকা, বাবার কথা একবারও মনে হয় না? খোকা যেন খানিকটা হতবিহবল হয়ে পড়ে। একটু আগে যা সে চিন্তা করছিল, বাবা ঠিক তাই তাকে জিজ্ঞেস করলেন। খোকার মুখ খানিকটা শুকিয়ে যায় যেন। সে বলে, না না বাবা, তুমি তো সারাদিন বাড়িতে ছিলে না। বাবা বলেন, তা ঠিক, তবে বাড়িতে ফিরেও তো তোমার পাত্তা নেই। আমার খোকা কি অনেক বড় হয়ে গেছে? বাবার সঙ্গে কথা বলতে তার কি সংকোচ লাগে? কথাগুলো অভিযোগের মতো শোনালেও অভিযোগ কিনা খোকা প্রথমত বুঝতে পারে না। সে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। তার মনে পড়ে বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা। মায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেশি, সেটা ঠিক তবে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ছোটপাকে বাবা বেশি ভালোবাসে সেটা সবাই জানে। সেখানে বাবা একেবারে অন্ধ। রাগী বাবা, যে বাবাকে আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি সেই বাবা ছোটপার সামনে একেবারে শিশু। বাবা ছোটপার সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন কী ভীষণ অন্যায় তিনি করে ফেলেছেন। মা মাঝে দেখে হেসে ফেলেন। আমরা হাসতে পারি না। তবে ছোটপাকে বাবা  ভয় পান সেটা আমরা সবাই জানি; বাবা তা স্বীকারও করেন। আর খোকা সেভেনে পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত বাবার কাছে ঘুমাত। তার সব ঝামেলা বাবা হাসিমুখে সহ্য করতো। সেজন্য টুনুর চেয়ে বাবা খোকাকে বেশি ভালোবাসে বলে মনে হতো সবার। সে রাতে বাথরুমে যেতে পারত না, বাবা তাকে প্রতিবার নিয়ে যেত। বিছানায় প্রস্রাব করা তার একটা নিয়মিত কর্ম ছিল। বাবা সেটাও হাসিমনে মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি তার গোসল পর্যন্ত বাবা করিয়ে দিতেন। সারাদিন টুনুর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে খোকা রাতে ভাত খেতে না খেতেই ঘুমিয়ে পড়লে বাবা ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের খাটে শুইয়ে দিতেন। বাবা খোকার সব প্রয়োজন বোঝেন, খোকা না বলতেই বাবা ওর সব জিনিসপত্র কিনে দেন।

বাবা মাথায় হাত বোলাতেই আর অভিযোগ-মাখা কথা বলতেই খোকার চোখ ছলছল করে ওঠে। বাবা মাথায় হাত রেখেই বলতে থাকেন, মন খারাপ করেছ, বোকা ছেলে, আমি তো তোমার সঙ্গে মজা করেছি। বাবা বোঝেন, এই নরম ছেলেটার সঙ্গে আর দু-একটা কথা বললেই সে কেঁদে ফেলবে। বাবা আর কথা বাড়ান না। শুধু বলেন, তোমার ওখানে কেমন চলছে? হলের খাবার-দাবার ভালো?  খোকা বুঝতে পারে, বাবা তাকে শান্ত করার জন্য অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছেন। সে মোটামুটি জবাব দেয়। তবে তার মনের ভেতরে একটা ক্ষত থেকে যায়। একটা কথা ঠিক যে, বাবার সঙ্গে তার দেখা হয়নি,  সে খোঁজও নেয়নি বাবার। কারো কাছে জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি বাবা বাড়ি এসেছেন, সেটাও তো ঘণ্টাখানেক হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে খোকা বাবার সঙ্গে কথা বলেনি, সে বাবার একবার খোঁজখবরও নেয়নি। এটা বাবা হয়তো পর্যবেক্ষণ করেছেন। খোকার খুব খারাপ লাগে। সে বুঝতে পারে না, কীভাবে বাবাকে সে বোঝাবে। বাবা কষ্ট পেয়েছেন নিশ্চিত; কিন্তু এখন এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বাবা আরো কষ্ট পাবেন। সে মনে মনে ভাবে, অন্য যে কোনো সময় বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে সে বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করবে।

সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেলে খোকা তার পড়ার ঘরটাতে ঢোকে। সে বাড়ি না থাকলেও তার এ-ঘরটাতে এখনো কেউ থাকে না। পড়েও না। সবসময় বন্ধ থাকে। মা পরিষ্কার করে রাখে। টুনু মাঝেমধ্যে ঢোকে কিনা সে বলতে পারবে না। সে যখন ক্লাস এইটে ওঠে, তখন বাবা তাকে এই পড়ার ঘর তৈরি করে দিয়েছিল। ঘর বলা একে ঠিক হবে না। দক্ষিণপাশের চওড়া বারান্দাকে দুপাশে বাঁশের চাঁচ দিয়ে ঘিরে একটা পড়ার ঘর তৈরি করা হলো। আর সেখানে একটা ছোট খাটও ছিল। এখানে সে ঘুমাত। বাবার কাছে ঘুমানো বাদ দিয়ে সে এখানে শোয়া শুরু করলে বাবা খানিকটা অভিমান করেছিলেন। তবে খোকা যেন নতুন একটা জগৎ খুঁজে পেয়েছিল, পড়ার বা লেখার কিংবা নিজের মতো করে চিন্তা করার। সেজন্য সে আলাদা কক্ষে নিজের মতো করে থাকতে চেয়েছিল। প্রথমত, বাবা বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝেছিল। পড়ার ঘরের পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা জানালা। দেয়াল কেটে জানালা বানানো। খোকার মনে আছে, সে নিজে এ-জানালার মাঝখান দিয়ে বাশের শলাকা দিয়ে নেটের মতো তৈরি করে দিয়েছিল। আর ছিল মায়ের কাছে থেকে নেওয়া একটা সাদা কাপড়ের পর্দা। পর্দা প্রায়ই বাতাসে উড়তো আর জানালাটা ফাঁকা হয়ে থাকত। সে জানালা দিয়ে প্রায়ই তাকিয়ে থাকত দূরে। বিশেষ করে সোজা পূর্বদিকে কয়েক জোড়া তালগাছ তার নজর কাড়ত। জানালার সঙ্গে লাগানো ছিল কয়েকটি জিওল গাছ। তার পাতার গায়ে বাতাস লেগে অদ্ভুত এক তরঙ্গ সৃষ্টি হতো। খোকা আজো স্পষ্ট মনে করতে পারে, জিওল গাছ নিয়ে লেখা তার একটি কবিতার কথা, এক নির্জন দুপুরে সে ঘামতে ঘামতে লিখেছিল কবিতাটি। প্রথমত, তার মনে হয়েছিল এটা বোধহয় নজরুলের ‘গুবাক তরুর সারি’ পড়ে লেখা। কিন্তু পরে সে বুঝতে পারে, গুবাক তরুর বিষয় আর তার বিষয় এক নয়। তার মনে কোনো নির্দিষ্ট ভাব ছিল না, শুধূু জিওল গাছের সৌন্দর্যের সঙ্গে তার মনের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। অনেক দুপুর রাত খোকা টেবিলে বসে জানালার ধারে বসে নিজেকে নিয়ে ভেবেছে আর কিছু কিছু লাইন তৈরি হয়েছে মস্তিষ্কে। সেগুলো কবিতার লাইন কিনা তখন ভাবার সময় ছিল না। তবে বারবার সে বসেছে সেসব লাইন নিয়ে, আর মনে করেছে আরো ভালো করে কীভাবে নিজের কথাগুলো বলা যায়। কখনো মনে হয়েছে এটা কি তার একধরনের পাগলামি। সে সবার সঙ্গে মেশে চলে খেলে, তবু সবার থেকে সে আলাদা। কেন আলাদা? সেটাই কি তার লেখার মূল কারণ? হতে পারে। আবার নাও পারে। সুকান্তের কাব্য পড়তে গিয়ে কিছুদিন তার মনে সুকান্ত ভর করেছিল। তখন সে লিখত সুকান্তের মতো করে। ক্লাস এইটে ওঠার পর সে লিখে ফেলল একটি কবিতা সুকান্তের মতো করে – যখন চৌদ্দ পেরিয়েছি। মা একদিন দেখে খোকাকে বলেছিল, এটা কি তোর নিজের কবিতা হচ্ছে? কেমন যেন ধাক্কা খেয়ে খোকা বলেছিল, কিছুটা অপ্রস্ত্তত হয়ে বলেছিল, আমারই তো?

: তোমার বুঝলাম, কিন্তু সাধারণ পাঠক কী ভাববে? তারা যখন পড়বে, তোমাকে কি আলাদা করতে পারবে সুকান্ত থেকে? তোমার কবিতা হবে তোমার মতো। তোমার কবিতা পড়ে যেন তোমাকে চিনতে পারে পাঠক।

খোকা আশ্চর্য হয়ে যায় মায়ের কথায়। তার মাইনর পাশ মা এসব জানে কী করে। সে তো নিজেও জানে না। সে তো অনুপ্রাণিত হয়েই লিখেছে, প্রেরণা এসেছে সুকান্তের কবিতা থেকে। তার প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক তার মা। বাড়ির আর কেউ তাকে এভাবে সরাসরি কথা বলে না। সে লেখে সেটা বাবা জানে, ছোটপা জানে। তবে বাবা কোনো কথা বলে না। মাঝেমধ্যে ছোটপা দু-একটা মন্তব্য করে। সে একদিন তাকে মজা করে বোধহয় বলেছিল – আগে লেখক হয়ে ওঠ, তারপর তোর লেখা পড়বো। মায়ের মন্তব্য তাকে বেশি ভাবায়। সে মাকে শুধু বলে, আমি কূল পাই না। অজস্র ভাব বিষয় মনে আসে, সবটা ধরে রাখতে পারি না। লেখার সময় সব মনে থাকে না। সবটা যে লেখা হয়ে উঠছে না, সেটা আমিও বুঝি, তবে লিখতে ইচ্ছে করে, তখন না লিখেও তো পারি না। সে মাকে সেদিন আর একটা প্রশ্ন করেছিল : আচ্ছা, মা, এই লেখাগুলোর কি কোনো মূল্য নেই? ধরো এগুলো সত্যি কিচ্ছু হচ্ছে না, তবু এগুলো তো আমারই লেখা।

মা বলেছিলেন, এ লেখারও মূল্য আছে। এগুলো তোমার লেখার ইতিহাসকে ধরে রাখবে। তোমাকে তৈরি করছে এই  লেখাগুলো। আমি যদ্দুর জানি, সব লেখকের এরকম কিছু লেখা থাকে যা তাঁর লেখার ইতিহাসকে ধরে রাখে। সে যদি সত্যি লেখক হয়ে থাকে, তাহলে এটা গুরুত্বপূর্ণ আর যদি লেখা চালিয়ে যেতে না পারে, তাহলে এগুলোর মূল্য থাকবে না কোনোভাবে। তোমাকে যদি জগৎ-সংসার অবিরাম চিন্তা করতে সুযোগ দেয় আর তুমি যদি সেগুলো লিখে যেতে পারো, তাহলে একদিন সব বাধা পেরিয়ে তুমি সত্যিকার অর্থে লেখক হয়ে উঠবে।

সেদিন খোকা আর কোনো কথা মাকে বলেনি। মনে মনে ভেবেছিল, তার ভেতরের অজস্র ভাবনাকে লিখে রাখা আর ভালোভাবে লিখে রাখার চেষ্টা তাকে করতে হবে। মা তাকে নতুন করে ভাবতে শেখাল। মা বলেছিল, ভাবনা দ্বারা সবাই কমবেশি আক্রান্ত হয়, তবে সেগুলো জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নতুনভাবে লেখার শক্তি যার থাকে সে-ই লেখক। দু-একটা লেখা পত্রিকায় ছাপা আর স্কুলে দু-একবার গল্পপাঠ নিয়ে খুব পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। সেই থেকে খোকা কিছুটা হলেও সাবধান হয়ে যায় যেন। সে অন্যের লেখা পড়ছে তবে আগের মতো আর সঙ্গে সঙ্গে লিখতে বসছে না। ক্লাস নাইন থেকে সে এটা করতে শুরু করে মোটামুটি, তবে সব সময় পারে না। সে এটাও ভেবেছে যে, যদি সে তার ছোট ছোট অনুপ্রেরণা কাজে না লাগাতে পারে, তাহলে তো সেগুলো হারিয়ে যাবে। কোনো কিছুই তো লেখার ক্ষেত্রে ফেলনা নয়। তাই মায়ের কথা গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সে এগোতে থাকে নিজের মতো করে। নিজের চিন্তা, অভিজ্ঞতা যেগুলো তাকে ভাবায়, সে তাকে সাবধানে লিখে রাখে, সব সময় যে তা কোনো লেখা হবে তা নয়, তবে এগুলো পরে কাজে লাগবে।

ঘুমুতে যাওয়ার আগে খোকা তার ছোট্ট হাতে বানানো ডায়েরিতে প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখে। কর্ণফুলী কাগজ ভাঁজ করে নিজ হাতে সেলাই করে সে ডায়েরিটা বানিয়েছিল বছরতিনেক আগে, যেদিন শাহানা তাকে তার গোপন কথা বলেছিল। সে এমন কিছু সেদিন বলেছিল যে, কাউকে তা সে বলতে পারেনি। কেমন যেন একটা অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সে ছটফট করছিল মানসিক যন্ত্রণায়। তখনই সে সে-রাতে ডায়েরিটা তৈরি করে। শাহানা তাকে যা বলেছিল, তা মনে পড়লে আজো তার গা শিউরে ওঠে। একটা বাচ্চা মেয়ে তার চেয়ে দু-এক বছরের ছোট হবে, সে তাকে অদ্ভুত কথা বলেছিল। অন্তত খোকার কাছে তা নতুন অদ্ভুত আর রোমাঞ্চকর মনে হয়েছিল। কিছুটা সংকোচ নিয়ে সে চলে এসেছিল বাড়িতে। সে ভাবতে পারেনি, যে-জীবনের অভিজ্ঞতা সে পেল শাহানার কাছ থেকে, তা সে জানল কীভাবে? মেয়েরা কি আগে সব জানে? সে কেন জানে না। কদিন আগে সে জানতো না বাবা-মায়ের সম্পর্ক কী? কীভাবে তাদের জন্ম হয়? ছেলেমেয়েরা আসলে একে অন্যকে কেন পছন্দ করে। সে অন্য মেয়েদের পছন্দ করতো, তবে সে-পছন্দ বন্ধুদের মতো, আলাদা করে সে কখনো কিছু সে ভাবেনি। সে ছোট থেকে দেখতো বাবা-মা দুজন দুজায়গায় ঘুমায়। বাবা ঘুমাত লম্বা ঘরটার বারান্দায় খোকার সঙ্গে। মা ঘুমাত টুনুর সঙ্গে বড় ঘরটার বারান্দায়। কাজেই বাবা-মায়ের আলাদা কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, সে-সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা তৈরি হয়নি। ভাইবোন মিলে বড় হয়েছে। কেউ কোনোদিন এ-সম্পর্কে কিছু তাকে বলেনি। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবদের মুখে আলাদা দু-একটা কথা শুনেছে। তবে সে বুঝতে পারেনি। শেফালি আপার বিয়ের সময় তাদের এক বন্ধু তাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল – জানিস, স্বামী-স্ত্রী কী করে? কেন বিয়ে হয়? কেন ছেলেমেয়ে হয়? খোকা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। তার বন্ধু তাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিল, আমি সব জানি। আমি একদিন গোপনে দেখেছি, আমার আপা-দুলাভাইকে। আমি একদিন তোকে সব বলবো। খোকা হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি। কিছুটা হতবিহবল হয়ে পড়েছিল। শাহানার কথাটাই সে ডায়েরিতে প্রথম লেখে। বলতে কী, সেই তার প্রথম জীবনের গূঢ় কথা, যা সে অন্যকে বলতে পারেনি। পরে অবশ্য আরো অনেক কথা শাহানা তাকে বলেছিল, সে যেন বোবার মতো শুনে গিয়েছিল, তেমন কোনো উত্তর করেনি কোনোদিন, শুধু হুঁ-হ্যাঁ বলেছিল, তার কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। খোকা সেদিন যেন শিশু হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে সে শিশুর  মতো, যা দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে, বিহবল হয়, পুলকিত হয়, রোমাঞ্চিত হয়। সাধারণত সে কারো বিষয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। শাহানাকেও কোনো প্রশ্ন করেনি, কেন এরকম কথা বলতে চায় বা বলে, এসব বলা ঠিক কিনা তাও সে ভেবে দেখেনি। সে ভেবে দেখার মতো অবকাশ পায় না।

সেদিন সন্ধ্যার সেই আলো-অাঁধারিতে জামগাছের তলায় খানিকটা নির্জনে খোকার হাত চেপে ধরে শাহানা বলেছিল, তোর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। বহুদিন থেকে বলতে চাই, সুযোগ হয় না। আজ বলে ফেলব, তুই কি শুনতে চাস? খোকা কথা বলার আগেই সে বলে – তুই তো কবিতা লিখিস, তা আমার কোনো কবিতা কখনো লিকিছিস? আমার দিকি ভালো করে  দেকিছিস কোনোদিন? মেয়েদের যদি না জানলি, তালি আর কী গল্প লিকবি, কী-বা পদ্য লিকবি? দ্যাখ, আমার দিকি ভালো করে দেখ, আমার মুকের দিকি ভালো করি দেখ, আমি যে তোক পছন্দ করি সেটা কি তুই কোনোদিন বুঝতি পারিছিস? হা রে আমার কবি? সে হঠাৎ করে তার ডানহাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের ওপর রাখে। আর চাপ দিয়ে ধরে রাখে খানিকক্ষণ। এক মুহূর্তে সব ঘটে যায়। খোকা কিছু বুঝতে পারে না। সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। একটা শিহরণ, সংকোচ, বিহবলতা, পুলক কিংবা কিছুটা বিনম্র আর লজ্জিত আনন্দ তাকে গ্রাস করে ফেলে। সে শাহানার কাছ থেকে তার হাতটা টেনে নেয়। তার অনুভূতি কেমন, সে বোঝাতে পারবে না কাউকে। তবে গোপন এক অনুভূতি তার রক্তের তরঙ্গে খেলা করে যায়। সে যেন অভিভূত হয়ে যায়। সে শাহানাকে কিছু বলার চেষ্টা করে। আসলে সে বলার কোনো শক্তি খুঁজে পায় না। সে শাহানার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখ রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। লাল রঙের ফ্রকের রং তার সারামুখে চিকচিক করছে। সে লক্ষ করলো, তার মুখে কোনো গ্লানির ছাপ নেই। সে ভেবেছিল শাহানা লজ্জা পেয়ে পালাবে। সে পালাল না, বরং খোকাকে চুপ থাকতে দেখে সে গোপন হাসিতে মেতে উঠল। সে খোকাকে অবাক করে দিয়ে বলল, তোকে তো হাঁদারাম মনে হচ্ছে রে। ব্যাপার কী, আমার কথার কোনো জবাব দিচ্ছিস না ক্যান। আমি খুব খারাপ মেয়ে? তাই তুই চুপ করে আচিস? আমাকে তোর সত্যি ভালো লাগে না? না লাগলে তাও বল? খোকা লক্ষ করে যে, শাহানা যেন ক্ষেপে যাচ্ছে। এবার তার কিছু বলা উচিত। তবে সে কথা খুঁজে পায় না। শুধু বলতে পারে, তোকে আমি বহুদিন থেকে পছন্দ করি। তবে সবার থেকে আলাদা  করে দেখেছি কিনা বলতে পারবো না। খোকা এটুকু বলতেই যেন হুঙ্কার দিয়ে ওঠে শাহানা – যা বের হয়ে যা এখান থেকে। কবি হয়েচেন? ওরে আমার কবি রে? সে রাগে দৌড়ে ছুটে চলে যায়। খোকা অন্ধকারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, নড়তে-চড়তে পারে না যেন। কে যেন পথ দিয়ে আসছিল, পায়ের শব্দ পেয়ে খোকা খানিকটা সম্বিত ফিরে পায়। সে অন্যমননস্ক হয়ে বাড়িরে দিকে হাঁটতে শুরু করে।

সেদিন রাতে সে একটা কবিতা লিখেছিল। সে জানে না এটা কবিতা হয়েছিল কি-না। তবে তার হাতে লেখা প্রথম কবিতার বইয়ে সে কবিতাটি রেখেছে। সে লিখেছিল, তোমার বলার অনেক কথা ছিল, আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি, না তোমার চোখ, না তোমার মুখ আমাকে কোনো শব্দ দিয়েছিল এনে আমার শাদা খাতায় : অবরুদ্ধ বাতাসে আমি ছটফট করেছি তোমার গোপন কথা জানার জন্য। তুমি বাহ্যত যা বলো তা হেঁয়ালি, আমি জানি তুমি নিজে কখনো বলবে না এ হেঁয়ালির ভেদ, আর অপ্রকাশ্য তোমার প্রেম আমি বুঝে নিতে হয়তো অপেক্ষায় থাকব।

পরদিন সকালে টুনু এসে বলল, চল, স্কুলে যাই। স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান হচ্ছে, তুই গেলে স্যারেরা খুশি হবে। টুনুর কথা ঠিক কিনা সে জানে না। তবে প্রায় সব শিক্ষক তাকে পছন্দ করে সেটা ঠিক। যদি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয় গ্রামের অনেকেই আসবে। তার মনে পড়ে সুবল আর রাখালের কথা। ওরা দুজন ওকে খুব ভালোবাসত। ওরা যখন ক্লাস নাইনে পড়ত তখন স্কুলে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ভারতে চলে গেল। কেন গেল, সে ঠিক কারণ জানে না। তবে লোকমুখে শুনেছে, মুসলমানদের অত্যাচারেই ওরা চলে গেছে। আবার অন্যরা বলে, এখন তো দেশে কোনো সমস্যা  নেই, এখন তো কোনো মুসলমান হিন্দুদের মারছে না। সে যা হয়েছিল সে তো একাত্তরে। এখন যাওয়ার কারণ নিশ্চয় ভাগ্য বদলাবার লোভ। সে অতো কিছু জানে না, তবে সে এটা ভেবে পায় না যে, নিজের গ্রাম, জন্মভূমি ফেলে মানুষ কীভাবে চলে যায়। কেউ নিশ্চয় সামান্য কারণে যেতে পারে না। সে টুনুর কথায় রাজি হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে, যদি কারো কাছ থেকে রাখাল আর সুবলের খোঁজ পাওয়া যেত, কী মজাই না হতো। সে টুনুকে বলে, আচ্ছা, যাবো। বিকেলে স্কুলমাঠে গিয়ে দেখে, অজস্র লোক মাঠের মধ্যে। সে এক কোণে গিয়ে বসে। স্টেজের ওপর হেডস্যার ও আরো কয়েকজন শিক্ষক বসে আছেন। ছেলেমেয়েরা সামনে বসে আছে। আর তাদের পেছনে গ্রামের সাধারণ লোকজন। বিশাল মাঠের মধ্যে অনুষ্ঠান। মাইকের সাহায্যে সবকিছু শোনা যাচ্ছে। সে বসেছিল একা। হঠাৎ দেখে তার বন্ধু প্রভাত। ওর ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে ও যায়নি। সে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। ওরা মুখোমুখি বসে কথা শুরু করতেই শওকত, জুলফিকার চলে আসে। ওরা সবাই স্থানীয় একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। খোকার মাঝেমধ্যে  মনে হয়, গ্রামের কলেজ ছেড়ে ওর দূরে যাওয়া উচিত হয়নি। প্রভাত শুরু করে ওদের কথা। ওর বাবা যেতে যেতে কেন ভারতে গেল না। সে কথা বলল। সে বলল, রাখালদের এখানে প্রায় জমিদারি ছিল, সে তো তুই জানিস। সেই রাখাল ভারতে গিয়ে কামলা খাটছে। খোকা বলল, কী বলিস? প্রভাত বলে, ওরা সব জমি বিক্রি করে ওপারে ওর এক কাকার নামে জমি কিনেছিল। ওরা ওপারে গেলে   ওদের জমি ফিরিয়ে দেয়নি এবং বেশি জোরাজুরি করলে তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে বলেছে। ওর বাবা সেই দুঃখে মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত করেনি ওর কাকা। মাথা গোঁজার মতো এককাঠা জমি দিয়েছে রাখাল আর ওর ভাইবোন-মায়ের জন্য। অথচ ওই কাকা ওর বাবার নিজের ভাই। সে কয়েক বছর আগে ভারতে গিয়েছিল। রাখাল নাকি কেঁদে কেঁদে বলেছে, বাংলাদেশে হলে কয়েক হাজার লোক খেত বাবার শ্রাদ্ধে। আর এখানে আমার বাবার শ্রাদ্ধ হলো না। যে রাখালের জমিতে কয়েকশো লোক কামলা খাটতো, সেই রাখাল এখন প্রতিদিন মা-ভাইবোনের খাবার জোগাতে অন্য মানুষের জমিতে কামলা খাটে। সব অদৃষ্ট। প্রভাত প্রায় কেঁদে ফেলে। খোকা তাকিয়ে থাকে হ্যাঁ করে। সে বুঝতে পারে না, কী বলবে। জুলফিকার বলে, সুবলের কী অবস্থা। প্রভাত বলে, না, ওদের জমিজমা কেউ জালিয়াতি করে নেয়নি। তবে জমি বিক্রির টাকার বড় একটা অংশ লুট হয়েছিল বর্ডার পার হওয়ার সময়। সুবল একটা সিনেমাহলে টিকিট বিক্রি করে। খোকা বলে, থাক, আর এসব কথা শুনতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয়, একবার ওদের দেখতে যাবো। এখন তো পাসপোর্ট ছাড়া যাওয়া যাবে না মনে  হয়। শওকত কী বলিস? শওকত একবার আমাদের সবাইকে কীভাবে ফাঁক-ফোকর দিয়ে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল। সে এক মজার অভিজ্ঞতা। বিল-ঝিল-মাঠ পেরিয়ে রাতের আঁধারে পুলিশ-বিডিআরের তাড়া খেয়ে ওপারে গিয়ে উঠেছিলাম। সে-সময় দুর্গাপুজো চলছিল। সেজন্য তেমন ঝামেলা হয়নি। মোছলন্দপুর গিয়ে রাতে এক দূরাত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। পরদিন ট্রেনে করে সোজা কলকাতায়। কেউ কিচ্ছু চেনে না। শুধু দৌড়। কখনো বাসে, কখনো ট্রামে। চিড়িয়াখানা, গড়ের মাঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জাদুঘর, হাওড়া ব্রিজ – সারাদিন দৌড়ে প্রায় সব দেখে ফেললাম।

শওকত বলল, এখনো যাওয়া যাতি পারে মনে হয়। তোরা যদি যাতি চাস, তাহলি দুর্গা বা কালীপুজোর সময় যাতি হবে। ওরা যেকানে থাকে তা কি প্রভাত জানিস? প্রভাত বলল, জায়গার নাম জানি। খুঁজে নিতে হবে।

খোকা আর কোনো কথা বলতে পারে না। সে যেন কেমন অসহায় বোধ করে। সে একবার ভাবে, যদি ভারতে গিয়ে দেখা হয় রাখাল বা সুবলের সঙ্গে, তাহলে ওদের সে কী বলবে? কিছু বলার বা করার কি কিছু থাকবে? সে হয়তো হাউমাউ করে কাঁদতে পারবে। আর তো কিছু পারবে না। তবু যদি সে যেতে পারে তাহলে। সেই রাখাল, যে প্রতিদিন স্কুলে এসে খোকাকে খুঁজে বের করতো, কত কথা তার খোকার সঙ্গে, যেন ফুরাত না। এমন  কোনো পুজো নেই যে, খোকাকে সে তার বাসায় ডেকে নেয়নি। কাকা-কাকি, তনুজাদিদি সবার সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ওদের বাড়ির রান্নার আলাদা স্বাদ এখনো ওর মুখে লেগে আছে। সেই তনুজাদিদি কেমন আছে। খোকাকে অন্যমনস্ক দেখে ওরা ওকে ডাকে। প্রভাত বলে চল, হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি। স্কুলের ফার্স্ট বয় এসেছে  দেখে হেডস্যার খুব খুশি হবেন। খোকা কোনো উত্তর দেয় না। সে বলে, না, আমি কোথাও যাবো না। আমি বাড়ি যাবো। প্রভাত বলে, তুই না গেলে আমাদের দিকে তাকাবে না স্যার। খোকা বলে, আমি ভেবেছিলাম যাবো; কিন্তু এখন আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

বাড়ি ফিরে দেখে, মা বারান্দায় একটা টুল নিয়ে বসে বই পড়ছে। খোকাকে দেখে মা বলেন, কোথায় গিয়েছিলি খোকা? টুনু কই? খোকা বলে, টুনু স্কুলমাঠে আছে। আমি বাড়ি চলে এলাম।

: কেন রে, তোর শরীর খারাপ?

: না, আমার শরীর ঠিক আছে। রাখালের কথা শুনে, সুবলের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল।

: কী আর করবি, আমাদের আর করার কী আছে বল? যেভাবে দেশ চলে, আমাদের তা মেনে নিতে হয়। অবশ্য ওরা কেন গেছে ওপারে, তা আমি জানি নে। না গেলেও বোধহয় পারত। শুনেছি, ওপারে গিয়ে ওরা বড় বিপদে পড়েছে।

খোকা বলে, মা, আমি এইমাত্র সব শুনলাম। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে।

খোকা সব কথা মাকে ধীরে ধীরে বলে। মা শুনে গম্ভীর হয়ে যান। বই পড়া বাদ দিয়ে কী একটা কাজে যান।

খোকা নিজের ঘরে গিয়ে বসে। বাড়ি এসেছিল মায়ের চিঠি পেয়ে। মা অবশ্য তাকে তেমন কিছু বলেননি। তবে সে বাড়ি এসে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে নানা খবর শুনে। শুনেছে, বাবা ছোটপারও বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এখন লেখাপড়া বাদ দিয়ে তার বিয়ে কেন দেবেন সে বুঝতে পারে না। এ-পাড়ায় শুধু তাদের বাড়ির  মেয়েরা ওপরের দিকে পড়ে। মায়ের ইচ্ছা প্রবল। বাবারও ইচ্ছা ছিল। হয়তো সংসারের খরচ বাবা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। শুধু ধান-পাট বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালানো বেশ মুশকিল। বড়ভাই দেখে, কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছে না। সে ছোটপাকে দেখে। মা তাকে কিছু কিছু বলেছে, সবটা না। সে কিছুটা অনুমান করে নিতে পারে। বাবা অবশ্য তাকে টাকা নিয়মিত দিচ্ছে।

একটু পরে মা খোকার ঘরে ঢোকে। এখন বাড়িতে কেউ নেই। চারিদিকে বেশ সুনসান। মা খোকাকে কী কথা বলবে, সে কিছু অনুমান করতে পারে বটে তবে এখন মনে হচ্ছে মা নতুন কিছু বলবে, যা সে কোনোদিন আন্দাজ করেনি।

মা বলেন, খোকা তুই নিয়মিত লেখাপড়া করতে পারছিস?  কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

খোকা মায়ের এ-জাতীয় প্রশ্ন শুনে খানিকটা থতমত খায় যেন। সে উত্তর দেয়, কেন? তোমার এরকম মনে হচ্ছে কেন?

: তুই তো লেখালেখি করছিস পত্রপত্রিকায়। তাছাড়া তোর বাবা ঠিকমতো টাকা দিচ্ছে তো তোকে?

: তুমি কী চাও, আমি লেখালেখি ছেড়ে দিই? আর হ্যাঁ, বাবা টাকা দিচ্ছে আমাকে।

: তুই লিখবি, সেটা তো আমিও চাই। আমি চাই আমার ছেলে বিখ্যাত কবি হবে; কিন্তু তার জন্যও তো আগে লেখাপড়া করতে হবে ভালোভাবে। না হলে নিজের জন্য ক্ষতি, আমাদের জন্যও ক্ষতি।

খোকা ঠিক বুঝতে পারে না, মা ঠিক কী বলতে চায়। মা কি তাহলে তার পত্রিকায় উপন্যাস লেখার খবরটা জেনে গেছে। মামার মাধ্যমে মা তা জানতেই পারে। খোকা চুপচাপ থাকে দেখে মা আবার বলেন – তোকে তো বলেছি, তোর ছোটপার বিয়ের জন্য তোর বাবা উঠেপড়ে লেগেছে। ভাবটা আমার মোটেও ভালো ঠেকছে  না। আমি শুনেছি তোর বাবা গোপনে আবার বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। আমি জানি না কাকে। নানা লোক তাকে বুদ্ধি দেয়। আমি তো খুব ভয় পাচ্ছি। তোর বড়ভাই থাকলে কথাগুলো তাকে বলতাম। সে তো বাড়ি আসে না।

মায়ের কথা শুনে খোকার মাথায় বাজ পড়ার মতো হলো। সে বলল, মা তুমি অহেতুক চিন্তা করছ। আমি এটা বিশ্বাস করি না।

মা বললেন, না হলেই তো আমি খুশি হই। কিন্তু পুরুষলোকের একবার বিয়ের হাউস হলে তা থামানো যায় না।

মাকে বিষণ্ণ মনে হলো খোকার। মা আর কথা না বলে চলে গেল।

রাতে সে বাবাকে দেখলো। তার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। বাবাকে তার আগের মতো মনে হলো। একবার ভাবল ছোটপাকে বলবে। আবার ভাবল, ছোটপাকে জানালে সে কষ্ট পাবে। মা ওকে বলেনি। কাজেই তাকে বলা ঠিক হবে না। বাবা ওকে ভয় পায় আবার ভালোবাসে। তাই তার বিয়ে না দিলে বাবা এ-কাজটি করতে পারছে না, এরকমই বোধহয় মা ইঙ্গিত করেছিল। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসলে সে ছোটপা আর টুনুর কাছে বসে। ছোটপা উপন্যাসটা পড়ে শেষ করতে পারেনি। সে মুখ গুঁজে  পড়ছে। টুনু তার কী যেন একটা হোমওয়ার্ক করছে। মা রান্নাঘরে। বাবাকে সে কি বলবে কথাটা? যদি সত্যি না হয়, তাহলে বাবা সম্পর্কে বাজে ধারণা করার জন্য তার কত খারাপ লাগবে, ভাবতে সে ভয় পায়। তাকে চলে যেতে হবে হোস্টেলে। ক্লাস চলছে। ফিজিক্স স্যার খুব কড়া মানুষ। সত্যি সে হয়তো তার কোর্সে ফেল করবে।

খোকা নিজের ঘরে গিয়ে বসে। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। সে পৃথিবীকে মানুষকে দেখে মহাআগ্রহ নিয়ে। এই প্রথম তার খুব খারাপ লাগল মানুষ সম্পর্কে। এ-অভিজ্ঞতার তার কোনো দরকার ছিল না। সে প্রাণপণে চায়, ব্যাপারটা যেন সত্যি না হয়। সে ভাবে, এ নিয়ে আর কারো সঙ্গে কথা বলবে না। বরং কাল সকালে সে কীভাবে যাবে কলেজে, তাই সে ভাবতে চায়। ভাবতে চায় কিন্তু সে ভাবতে পারে না।

সকালে উঠে সে মা আর বাবাকে বলে রওনা দেয়। সবার সঙ্গে কথা হয়। টুনুর সঙ্গে তেমন কথা হয় না বলে সে দুঃখ করে। সে অন্যভাবে তাকে বোঝায়। ছোটপাকে সে বলে, সীমাবদ্ধ পড়ে যেন চিঠি লেখে। বাবা বলে, তোর কি খুব তাড়া। আর কটা দিন থেকে গেলে পারতিস। মা কিছু বলে না। চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ভ্যান থেকে ট্রেনে উঠে সে কিছুটা নিশ্চিত হয়। এবার সে একবারে পৌঁছে যাবে। প্রতিবার যেমন সে নিসর্গ দেখে দেখে যায়। এবার সে আর নিসর্গ দেখে আনন্দ পায় না। কে যেন তার আনন্দ হরণ করে নিয়ে গেছে। জীবনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল মনে করত, এখন তাকে বোঝা মনে হচ্ছে। চোখ বুজে থাকতে থাকতে সে এবার বাড়ি এসে ঘটে যাওয়া সবকিছু দেখতে পায়। প্রভাত, রাখাল, সুবোধ, বাবার কথা, ছোটপার কথা, এমনকি শাহানার কথা তার মনে হয়। সে কি এসব নিয়ে লিখতে পারবে? এই অবগাহনে তার কী প্রাপ্তি ঘটল? হয়তো সব একসময় থিতু হয়ে আসবে। আবেগ অদৃশ্য হবে, থাকবে জীবনের কিছু উপলব্ধি। তা দিয়ে দু-একটি চরণ হয়তো বেরিয়ে আসবে। সে-চরণগুলো মানুষ গ্রহণ করবে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে চলে। ট্রেন তাকে নিশ্চয় তাকে আজকের গন্তব্যে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে কি তার সত্যিকার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে?