অবচেতনের সহোদরা

[৪৮ বছর মনের ওপর পলেস্তারা পড়ার মতো যথেষ্ট সময় বলে যখন মনে হতে থাকে, ঠিক তখনি একজন বোনের আর্তি হুড়মুড় করে ধসিয়ে দেয় ভুলে-যাওয়া দেয়ালগুলোকে। আর মানুষ তখন পুরোপুরি ফিরে যায় ৪৮ বছর আগে।]

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ১৭ বছর হলে এখন ৬৫। কিন্তু গোলাম রসুলকে দেখলে কেউ তার বয়সের কথা ধারণাই করতে পারবে না। বড়জোর এটুকু বলতে পারবে যে, বয়স তার পঞ্চাশের এপার-ওপার। গোলাম রসুলের দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নেমে আবদুর রশিদ বলল – ব্যানার্জিরা গাছ বেচবে রসুলভাই। চলো কাল দেখে আসি গাছগুলো। দেখেশুনে দরদাম করা যাবে।

নিশ্চিন্দিপুরের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের একসময়ের রেশন-ডিলার আরশেদ আলীর সেজো ছেলে আবদুর রশিদ। রেশন দোকান ছাড়াও আরো ব্যবসা আছে আরশেদ আলীর; কিন্তু লাল হয়ে গেছে রেশন দোকানের কল্যাণেই। সেই স্বাধীনতার পরপরের কথা। বঙ্গবন্ধু সে-সময় সব জিনিসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রেশনে। বাজারে তখন চাল-গম-তেলের আগুনদর। লোকে বলে রেশনের জিনিস বস্ন্যাকমার্কেট করত আরশেদ আলী। আরশেদ আলীর কানেও গেছে কথাটা; কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য করে না সে এ-ব্যাপারে। করলই না-হয় সে কালোবাজারি। আরশেদ আলী তবে ছাড়বে কেন? সেও তো বঙ্গবন্ধুর দলেরই লোক, সত্তরের ইলেকশনে ভোটও দিয়েছিল নৌকায়। ওর দোকানঘরে টাঙানো থাকত বঙ্গবন্ধু আর সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ছবি। প্রথমটা অবশ্য পঁচাত্তরে পনেরোই আগস্টের পর নামিয়ে রেখেছিল আরশেদ আলী। এ থেকেই বোঝা যায়, হাওয়া বুঝে পাল খাটাতে জানে আরশেদ আলী। তারপর রেশন উঠে গেল। এলো ভিজিডি কার্ড। কিন্তু পুঁজি যা বানিয়েছিল আরশেদ আলী, তা দিয়ে নানা ধরনের ব্যবসা করে এখন এলাকার মান্যিগণ্যি লোক। এহেন বাপের সেজো ছেলে আবদুর রশিদ জন্মদাতার বৈষয়িক বুদ্ধির এক কানাকড়িও পায়নি। আরশেদ আলীর অনেক দোকান। ধরে-বেঁধে ছেলেকে কোনো দোকানে বসালে মনমরা হয়ে বসে থাকে, খদ্দেরদের ত্যাড়া কথা বলে। আরশেদ আলী ব্যাটাকে পোষ মানানোর জন্য বিয়েও দিয়েছে অল্প বয়সেই। বছর ঘুরতে না ঘুরতে রশিদের বউ একটা নাতিও উপহার দিয়েছে আরশেদ আলীকে। কিন্তু রশিদকে ব্যবসা-বাণিজ্যে আটকানো যায়নি। বিভিন্ন ব্যবসায় ফেল মেরে আবদুর রশিদ এখন কাঠের ব্যবসা করছে পার্টনারশিপে।

আবদুর রশিদের পার্টনার গোলাম রসুল নিশ্চিন্দিপুর বাজারের ‘পলাশ ফার্নিচার হাউজ’-এর মালিক। স্বাস্থ্যটা খুব সুন্দর। হাত-পায়ের থোকা থোকা পেশিই বলে দেয় একসময় দশাসই জোয়ান ছিল সে। এখনো অবশ্য মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি। মাথার চুল উঠে গেছে সামনে আর ওপর থেকে। শুধু কানের পাশ আর ঘাড়ের ওপর দিয়ে অল্প কাঁচা আর বেশি পাকা চুলের একটা রেখা ঘিরে রেখেছে চকচকে টাককে। গোলাম রসুল অবশ্য এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। সে এসেছে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়। ঢাকায় তার বাপ কী একটা চাকরি করত। পঁচিশে মার্চের রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ব্রাশফায়ারে মারা গেছিল। মা আর বোনকে নিয়ে গোলাম রসুল আটকা পড়েছিল ঢাকাতেই। বাধ্য হয়ে সেখানেই ছিল। কিন্তু রাজাকার আর মিলিটারিরা ওর বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর চুপ থাকেনি সে। মাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল নিশ্চিন্দিপুরে। মায়ের দূরসম্পর্কের ভাই শওকত উকিলের বাড়িতে মাকে রেখে যুদ্ধে গেল গোলাম রসুল। যুদ্ধশেষে আর ঢাকায় ফিরে যায়নি। উকিলের একমাত্র মেয়ে নয়নতারাকে বিয়ে করে এখানেই থেকে গেছে সে। এর মধ্যে শওকত উকিল মরে গেছে। দুই ছেলে এক মেয়ের বাপ হয়েছে গোলাম রসুল। যুদ্ধশেষে ঢাকায় গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজেছে বোনকে, কিন্তু পায়নি। বোনের কথা কখনো মুখে আনে না গোলাম রসুল। কিন্তু ওর ঘনিষ্ঠ লোকেরা জানে, বোনের জন্যে একটা ভীষণ নরম জায়গা আছে ওর বুকের মধ্যে।

আবদুর রশিদের কথা শুনে মুখ তুলল গোলাম রসুল। একটা ন্যাকড়ায় হাত মুছতে মুছতে বসল বেঞ্চিতে। জানতে চাইল – ব্যানার্জিদের গাছগুলো কি ভালো?

ভালো মানে! – বেঞ্চিতে একটা চাপড় মেরে বলল আবদুর রশিদ – এই তল্লাটে অমন গাছ অন্য কোথাও নেই, এ আমি হলপ করে বলতে পারি রসুলভাই। চলো না নিজের চোখেই দেখবে।

বলতে বলতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে গোলাম রসুলের দিকে বাড়িয়ে ধরল আবদুর রশিদ। গোলাম রসুল বয়সে ওর বেশ কয়েক বছরের বড়। আগে লুকিয়ে সিগারেট টানত আবদুর রশিদ। একসঙ্গে কাজ করতে হয়, বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হিসাবপত্তর করতে হয়। বারবার আড়ালে সিগারেট টানতে যেত আবদুর রশিদ। বুঝতে পেরে তার সামনেই সিগারেট খাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিয়েছে গোলাম রসুল।

আবদুর রশিদের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে দেশলাই জ্বালালো গোলাম রসুল। নিজেরটা ধরিয়ে রশিদের দিকে আগুনটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখল রাস্তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে। সেদিকে তাকিয়ে ছাপা শাড়িপরা একটা মেয়েকে দেখতে পেল গোলাম রসুল। ওর চেনা মেয়েটা। দুখু পাগলার বউ পুতুল। দুখু পাগলা অর্থাৎ দুখেন ছেলেটার রাজনীতির খাই ছিল খুব। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করত। মাকে নিয়ে থাকত। হঠাৎ একদিন বিয়ে করে বউ নিয়ে এলো। কোথা থেকে কে জানে। ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায়, শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা-সম্বন্ধী কেউ আছে কিনা তা জানে না নিশ্চিন্দিপুরের মানুষ। তাই অনেকের ধারণা, পুতুলকে তুলে এনেছিল দুখেন কোনো দূরের গ্রাম থেকে। মা আর বউ নিয়ে ভালোই ছিল দুখেন। কিন্ত মাথায় অতিবিপস্নবী রাজনীতির পোকা। সর্বহারাদের দলে নাম লিখিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। কাটা বন্দুক আর কয়েকটা থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিজিবিকে হারিয়ে বিপস্নব করবে। ছয়-সাত মাস পরে খবর এলো ধরা পড়েছে দুখেন পুলিশের হাতে। জেলে বোধহয় মাত্রাছাড়া টর্চার করা হয়েছিল। বছর দেড়েক পরে বদ্ধপাগল অবস্থায় ছাড়া পেল জেল থেকে। একেবারে বদ্ধপাগল। এখানে-সেখানে পড়ে থাকত, নিজের মনে বিড়বিড় করত। তারপরে বছর-দুই হলো উধাও গ্রাম থেকে।
কোথায় গেছে কেউ জানে না। মাঝে মাঝে গুজব শোনা যায় কেউ এখানে দেখেছে কেউ সেখানে দেখেছে – কিন্তু ওই পর্যন্তই।

আর এদিকে যা হওয়ার তাই ঘটল। শাশুড়িকে নিয়ে থাকে পুতুল। বাপের বাড়ির কথা নেই মুখে। রাত-বিরেতে ঘরের দরজায় টোকা, ফিসফিস করে ডাকা শুরু হলো কদিন বাদেই। শাশুড়িরও  নাকি সায় ছিল। খেয়ে তো বাঁচতে হবে। কিছুদিন পর জানা গেল ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে বুড়ো চৌধুরীর ছেলে খোকা চৌধুরী মজমা করছে রোজ পুতুলের ঘরে। আরো অনেকের চোখ ছিল পুতুলের ওপর, কিন্তু খোকা চৌধুরীর সঙ্গে পাল্লা দিতে যাবে কে? অমন বুকের পাটা নিশ্চিন্দিপুরে কারো নেই। কিন্তু হালে শোনা যাচ্ছে, খোকা চৌধুরীর সঙ্গে আর বনিবনা নেই পুতুলের। ব্যানার্জি-গিন্নির কাছে আশ্রয় নিয়েছে পুতুল। কাজকাম করে, থাকে ব্যানার্জিদের বাড়িতেই। ব্যানার্জিদের বাড়িতে অবশ্য বেশি লোক নেই। শুধু বুড়োবুড়ি দুজন আর সরকারমশাই। ব্যানার্জিরা আগে এই তল্লাটের জমিদার ছিল। দুই ছেলের একজন ডাক্তার, একজন ঠিকাদার। একজন থাকেন ইরানে, একজন ঢাকায়। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে ওপারে। বহরমপুরের এক বনেদি পয়সাওয়ালা ঘরে। এখানকার বিশাল বাড়ি আর সম্পত্তি আগলে রেখেছে দুই বুড়াবুড়ি আর তাদের পরিবারের সঙ্গে ষাট বছরের সম্পর্কযুক্ত সরকারমশাই।

আবদুর রশিদের ঘাড়ে একটা থাবড়া মারল গোলাম রসুল। চমকে উঠে পুতুলের ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাল সে। হেসে উঠে বলল গোলাম রসুল – কী রে! চোখ দিয়ে যে চাটছিস মেয়েটাকে। অবশ্য তুই যে চান্স নিতে গেছিলি, সে-খবরও আমি জানি।

মুখ কাঁচুমাঁচু করে ফেলল আবদুর রশিদ – কী যে বলো রসুলভাই। আল্লাহর কিরে, অমন বদচিন্তা আমার মনে আসেনি কখনো।

গোলাম রসুল বলল, জানি বাবা জানি। চিন্তা তোর মাথায় ঠিকই এসেছিল। তুই তো কিছুদিন ঘুরঘুরও করেছিস। পারিসনি শুধু ওই খোকা চৌধুরী আর তার দুই সাগরেদ হীরু আর অনন্ত গু-ার ভয়ে।

 

দুই

পরদিন সকালে ব্যানার্জিদের বাগানে এলো দুজন। আবদুর রশিদ গেল সরকারমশাইকে খুঁজতে। তিনিই গাছ দেখাবেন, দামদস্ত্তর করবেন; কিন্তু সরকারমশাই বাজারে গেছেন। অবশ্য ফেরার কথা কিছুক্ষণ বাদেই। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল ওরা।

বাগানটা ব্যানার্জিদের বাড়ির পেছনদিকে। বিরাট বড় বাগান। আম-কাঁঠাল, কড়ই আর শিমুলের গাছ। বাগানের পরই বিরাট পুকুর। গোটা এলাকাই দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এখন অবশ্য পাঁচিল ভেঙে পড়েছে এখানে-ওখানে। পুকুরের ঘাটের অবস্থাও সেরকম। পুকুরের ধারে চিৎ হয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগল গোলাম রসুল। পাশে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল আবদুর রশিদ। হঠাৎ উলটো দিকের ঘাটে চোখ আটকে গেল ওর। সিঁড়িতে বসে গা ডলছে পুতুল। মুখ তুলে ওদের দিকে পিছন ফিরে টুপ করে ডুব দিলো বারকয়েক। তারপর ঘাটে উঠে চুল মুছল, আঁচল চিপল পিছন ফিরেই। ভেজা কাপড়ের নিচে দেহের বাঁকগুলো স্পষ্টই বোঝা যায়। নিজের অজামেত্মই ঢোক গিলল আবদুর রশিদ। শরীর বটে মেয়েটার। চট করে গোলাম রসুলের দিকে তাকাল আবদুর রশিদ। চোখ বুঁজে চিৎ হয়ে আছে সে। মুখ তুলে আবার পুতুলের দিকে তাকাল আবদুর রশিদ। পুতুল ততক্ষণে ব্যানার্জি বাড়ির খিড়কি দুয়ারের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

এই সময় আরো লোকের উপস্থিতি অনুভব করল আবদুর রশিদ। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন মানুষ। ভালো করে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে। খোকা চৌধুরী আর তার দুই সঙ্গী হীরু, অনন্ত। অনমেত্মর হাতে ওর সবসময়ের অস্ত্র – সাইকেলের চেইন। দৌড়ে গিয়ে খোকা চৌধুরী জাপটে ধরল পুতুলকে। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা ঝোপের দিকে।

ছেড়ে দাও আমাকে, ছেড়ে দাও বলছি – চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। এতক্ষণে বোধহয় তন্দ্রামতো লেগেছিল গোলাম রসুলের। পুতুলের চিৎকার শুনে চোখ খুলল। ভয়ে উত্তেজনায় এরই মধ্যে কাঁপতে শুরু করেছে আবদুর রশিদ। কোনোমতে বলল – খোকা চৌধুরী … পুতুলকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে!

পুতুলের চিৎকার শোনা গেল আবার – ভাই তোমরা আমাকে বাঁচাও!

‘ভাই’ শব্দটা কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক শক খাবার মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গোলাম রসুল। একরোখা ষাঁড়ের মতো ছুটল ঝোপের দিকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তার পিছু নিল আবদুর রশিদও। ঝোপের কাছে গোলাম রসুলের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে হীরু আর অনন্ত। বলল – এদিকে আইসেন না। মাগিটার বড় বাড় হইছিল। টাইট দিয়ে চলে যাব আমরা।

রাগে ফুলছে গোলাম রসুল – এ কি মগের মুলস্নুক পেয়েছ? মেয়েছেলেকে জোর করে …

কথা শেষ না হতেই মুখিয়ে উঠল অনন্ত – যা খুশি করব আমরা। ও কি আপনার বউ না বেটি যে নাক গলাতে আইছেন?

আর সহ্য করতে পারল না গোলাম রসুল। চটাস করে চড় মারল অনমেত্মর গালে। স্তম্ভিত হয়ে গেল অনন্ত। হীরু আর আবদুর রশিদও কম অবাক হয়নি। এই তল্লাটে কেউ অনন্তর গায়ে হাত তুলতে পারে! তার ওপরে এই প্রায়-বুড়ো, নিশ্চিন্দিপুরের অস্থানীয় গোলাম রসুল। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে কোমর থেকে ছোরা বের করল হীরু। ভাঁজ খুলছে। জোয়ান বয়সে ঘুসি মেরে ঝুনো নারকেল ছিলেছে গোলাম রসুল। সেই রকমের ওজনের একটা ঘুসি ছুড়ল হীরুর মুখ লক্ষ্য করে। কাটা কলাগাছের মতো ধপাস করে মাটিতে পড়ল হীরু। হাত থেকে ছুরি ছিটকে চলে গেছে দূরে। হাতের চেইন ঘুরিয়ে মারল অনন্ত। সরে দাঁড়িয়েছিল গোলাম রসুল। তবু ডান ভুরুর কাছে কপাল ছুঁয়ে গেল চেইন। সঙ্গে সঙ্গে চামড়া ফেটে রক্ত বেরোল। কিন্তু ভ্রম্নক্ষেপ না করে অনন্তর কবজি ধরে মোচড় দিলো গোলাম রসুল। ফট শব্দ তুলে ভাঙল কবজির হাড়। পেছনদিকে কষে একটা লাথি মারতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনন্ত। তারপর উঠে দাঁড়িয়েই ছুট দিলো বাগানের গেটের দিকে। এদিকে হীরু সবেমাত্র মাথা তুলতে যাচ্ছে। তার চোয়াল বরাবর লাথি হাঁকাল গোলাম রসুল। এক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অনন্ত যেদিকে গেছে সেদিকেই দৌড় লাগাল হীরু।

ঝোপের ওপাশে গাঁ-গাঁ শব্দ হচ্ছে। বোধহয় খোকা চৌধুরী মুখ চেপে ধরেছে পুতুলের। টর্পেডোর মতো ছুটে গেল গোলাম রসুল।

পুতুলকে চিৎ করে ফেলে ওর ওপর উঠে বসেছে খোকা চৌধুরী। শাড়ি, বস্নাউজ ছিঁড়ে ফেলেছে। কোমরের কাছে হাত দিয়ে পেটিকোটের ফিতে ধরে টানছে। ঝাঁকড়া চুল মুঠি করে ধরে খোকা চৌধুরীকে টেনে তুলল গোলাম রসুল। তারপর ধাঁই করে বসাল ঝুনো নারকেল-ছেলা ঘুসি। পড়ে গিয়েও এক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াল খোকা চৌধুরী। চোখে আগুন জ্বলছে – আমার কাজে নাক গলানোর শাস্তি তুমি পাবে। চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে যদি নিশ্চিন্দিপুরছাড়া না করি তো …

অনন্তর ফেলে যাওয়া চেইনটা তুলে নিয়ে এগোচ্ছে গোলাম রসুল। দেখতে পেয়ে মুখের কথা শেষ না করেই ছুট লাগাল খোকা চৌধুরী। বলা যায় না বাবা। যে-মূর্তি ধরেছে গোলাম রসুল – জানে মেরে ফেলতে পারে!

 

তিন

মাঝরাতে দাওয়ার বাঁশের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছে গোলাম রসুল। একা। কপালে লিউকোপস্নাস্ট দিয়ে তুলো লাগানো। তারার আলোয় ঝকঝক করছে আকাশ। আটচলিস্নশ বছর আগে ফিরে গেছে সে। একাত্তরের সেই রাতটাও এমনি তারাজ্বলা ছিল। সেদিনও বাতাসে ভেসে এসে গোলাম রসুলের কানের পর্দায় আছড়ে পড়েছিল দুটো শব্দ – ‘ভাইজান বাঁচাও!’

সেদিন কিছুই করতে পারেনি গোলাম রসুল।

আজ এত বছর পরে বোধহয় একটু সান্তবনার শান্তি নিয়ে ঘুমাতে পারবে সে।