রবিউল হুসাইন
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ২০০০ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আটস্ ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে উন্মুক্ত করে এবং পরবর্তী এগারো বছর ধরে বহু চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজনের ধারাবাহিকতায় শিল্পী ও শিল্পপ্রেমিকদের কাছে এটিকে আকর্ষণীয় এবং আদরণীয় করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য, চিত্রশিল্প ও সংগীতজগতে তাঁদের প্রভূত অবদানের কথা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই। চিত্র-প্রদর্শনের পাশাপাশি সংগীতানুষ্ঠান, সিডি প্রকাশনা, শিল্পবিষয়ক পত্রপত্রিকা, সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা – এরূপ বহু সৃজনশীল কর্মকান্ডের সঙ্গে তারা জড়িত এবং দেশের শিল্পজগৎকে এভাবে দিন দিন ঋদ্ধবান করে তুলছে। মাঝে মাঝে এ-প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে শিল্পীদের নিয়ে আর্ট ক্যাম্পও পরিচালনা করে যাচ্ছে, যার ফলে দেশের সার্বিক শিল্পচর্চা ও তার বিপণন একটি বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছে বলা যায়। সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে শিল্পী, শিল্পানুরাগী, শিল্প-সংগ্রাহক – সবার মাঝে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন একটি বলিষ্ঠ শিল্প-ভূমিকা রেখে যাচ্ছে, এ-কথা স্বীকার্য। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০ ডিসেম্বর গুলশান-১-এ বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ নামে এ-প্রতিষ্ঠান আরেকটি শিল্পশালা উদ্বোধন করেছে এবং তা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্পেন প্রবাসী শিল্পী মনিরুল ইসলামের সাম্প্রতিককালে আক্রামাইন, অ্যাক্রিলিক, তেল, কোলাজ ও মিশ্র মাধ্যমের সাহায্যে বিচ্ছিন্নতা এবং ধারাবাহিকতা শিরোনামের ছবিগুলো নিয়ে। মনিরুলের ছবি নির্বস্ত্তক ও বিমূর্ত রীতিসমৃদ্ধ। তাঁর সর্বমোট চল্লিশটি ছবি অবচেতন মনের দিকনির্দেশ-অনুসন্ধানে চিরব্যস্ত ও বাঙ্ময়। ভাবনা, চিন্তা ও চেতনাকে শিল্পী বিমূর্ত ও প্রতীকী বাস্তবতায় রূপ দেন, যেখানে রং, রেখা, নির্বস্ত্তক অথচ বস্ত্তধর্মী আকার বা আধারে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনমুখী। তাই সেই রূপ জ্যামিতিক বীক্ষণে প্রতিভাসিত। শিল্পী শূন্যের মধ্যে প্রতিরূপ এবং পরিসর সৃষ্টি করেন, সেই জন্যে শূন্যতাও একটি আধারে রূপ নেয়, যেন শূন্যতারও এক জ্যামিতিক প্রতিভাসিত আকার খুঁজে পাওয়া যায়, যা শূন্য তবে পরিপূর্ণ মনোবীক্ষায় তা উপস্থাপিত হয়। শূন্যতার অদৃশ্য পরিসর নিয়ে শিল্পীর এই শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া তাঁকে এবং তাঁর ছবিকে বা সৃষ্টিকে বিশিষ্ট ও অনন্য করে তুলেছে, যা প্রণিধানযোগ্য। বিচ্ছিন্নতাকে শিল্পী এমনভাবে সংযোজিত করে তোলেন, যা গ্রন্থিত হয় এক সুচারু ধারাবাহিকতায় এবং আপাতপৃথকীকরণ প্রতিবেশ যদিও অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ বলে মনে হয়। তথাপি কয়েকটি সঠিক ও নির্ভুল রৈখিক বা বর্ণিল যোগসূত্রে এক জাদুময় অবাস্তব বাস্তবতায় পর্যবসিত হয়ে তা পূর্ণাঙ্গে উপস্থাপিত হতে থাকে। বিভিন্নতা বা বিচ্ছিন্নতাকে একত্রিত করে তাকে সুচারু রূপে সৃষ্টি করার শিল্প-সৃজনীগুণ শিল্পী মনিরুলের সহজাত এক শিল্পবৈশিষ্ট্য বলা যায়। বৈচিত্র্যের মধ্যে এক একত্রিত রূপ ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে শিল্পী তাঁর শিল্প সৃষ্টি করে যাচ্ছেন, যেখানে বিস্তীর্ণ পরিসরের বড় ভূমিকা লক্ষ করা যায়। এবারের প্রদর্শনীতে ছবির বর্ণ বেশ উজ্জ্বল বিভায় পরিস্ফুটিত। তাঁর ছবি বাহুল্যবর্জিত, সরল ও প্রত্যক্ষ কিন্তু সার্বিকতায় পরোক্ষ অনুভবের পরিচয় দেয়। অবাস্তব বাস্তবতায় শিল্পী তাঁর ছবি সৃষ্টি করলেও সেগুলো নির্বস্তকতার আবরণে ঢাকা পড়ে থাকে। তাই সৃষ্টিগুলো চোখের সঙ্গে সঙ্গে মন, ভাবনা আর বুদ্ধি দিয়ে অবলোকন করার দাবি রাখে। চোখে যা দেখি সেগুলো সরাসরি বোধকে উজ্জীবিত করে তোলে, সেটি বস্ত্তগত বা নির্বস্ত্তক যা-ই হোক না কেন। চোখের দেখাকে সহজেই পরিচিহ্নিত করা যায়, যেহেতু সেগুলো চেনা বা জানা কোনো বস্ত্ত, জড় বা অজড়, প্রাণী বা নিষ্প্রাণী, প্রকৃতি বা অপ্রকৃতির। এর বিপরীতে মনের আকুতি, অনুভূতি, অনুভব, দুঃখ, হাসি, সুখ, আনন্দ, অসম্মান, অবহেলা, অপমান, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ – এসবের সুলুকসন্ধানে বস্ত্তগত অবয়বের ব্যবহার অকার্যকর হয়ে দেখা দেয়। তাই নির্বস্ত্তক জ্যামিতিক গড়ন-গঠন-রং, রেখা, বিন্দু, বর্গ, ত্রিভুজ, বৃত্ত ইত্যাদি আকারের সাহায্য নিতে হয়, সঙ্গে শূন্য পরিসর, বর্ণবিভা, বৈষম্য, অবৈষম্য – এসব তো আছেই। শিল্পী তাঁর প্রাগুক্ত উপাদান নিয়ে অনুভূতি অনুভবের বিভিন্ন অনিঃশেষ প্রতিলিপি নিজের মতো করে সৃষ্টি করে যান। প্রথমে দর্শক তা দেখে বোঝেন না, যেহেতু সেগুলো চোখের দেখার মাধ্যমে পরিচিতি – স্থানীয় নয়, সেগুলো অনুভূতি ও অনুভব নিয়ে মানবিক অবচেতনার। তাই সেগুলো বিমূর্ত, অবিমিশ্র নির্বস্ত্তকতার এবং অবাস্তবতার। সেগুলো দেখার নয়, ভাবনা ও চিন্তার এবং অনুভবের, বিশাল এক বোধের। তাই এগুলোর প্রতিফলন দুর্জ্ঞেয় বা দুর্বোধ্য বলে মনে হয় সাধারণত। চোখের দেখা যদি মূর্ত হয়, তাহলে মনের দেখা বিমূর্ত, তাই বিমূর্ত বা অবাস্তবতার রূপ, রং, রেখা এবং আকারে হয়ে মনের বিভিন্ন অবস্থা ও অনুভূতির অনুকৃতিতে ধরা পড়ে, যেখানে বুদ্ধি, বিবেচনা ও বিজ্ঞতা সামনে এসে দাঁড়ায়। শিল্পী মনিরুল ইসলামের ছবি তাই অনুভবের এবং অন্তর্গত অন্তরের। তাঁর ছবি বিশুদ্ধ বিমূর্ততায় প্রতিফলিত ঠিক, তবে মাঝে মাঝে প্রকৃতি বা মনুষ্য অবয়বের নির্বস্ত্তক কাঠামোয় বস্ত্তগত বিশেষণে রূপ দিয়েছেন এবং তা সম্পূর্ণত প্রায় অবাস্তবরূপে। বিমূর্ত প্রকাশবাদী মাধ্যমে শিল্পী তাঁর বিষয়কে ধরেছেন, তবে বিশুদ্ধ সম্পূর্ণতায় নয়, যেমন দেখা গেছে এমনটি – মুখ, আমার কৃষ্ণপ্রেমের বসতি, সংগীতশিল্পী, আকাশ এবং পৃথিবী যেখানে ওপরের বাঁদিকে পুরো এক উড়োজাহাজ বেশ বৈসাদৃশ্যগোচর বলে মনে হয়। এছাড়া কালো আয়না, কালো প্রেমিক, বৈমানিক, শারীরবিদ, যান্ত্রিক মানব, মঙ্গলগ্রহের প্রলুব্ধতা, ষাঁড়যোদ্ধা, বসন্তে নারী ইত্যাদিতেও এসব দেখা যায়। ক্যানভাসের আকার আয়ত, লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি। রং ও রেখা পরিমিত, পরিশীলিত, বুদ্ধিদীপ্ত ও ভাবনাসঞ্চারী। ছবিগুলো উজ্জ্বল এবং অস্বচ্ছ তুলির সাবলীল-ক্ষিপ্র পরিচালনায় সমৃদ্ধ। বিশুদ্ধ বোধের বিমূর্ত প্রতিচ্ছায়া খুব উপভোগ্য হয়ে দেখা দেয় এসবে এবং শিল্পীর শিল্পকুশলতা, নান্দনিক প্রকাশ এক স্বতঃস্ফূর্ততায় কেন্দ্রীভূত, যেমন – শরতের অলীক কল্পনা, শিল্পী ও তাঁর জগৎ, নীল গ্রহ, ভক্তি ও সন্দেহ, লেবু-স্রোত, আহ্ প্রিয় সবুজ, ভবিষ্যবচন, রুপালি ভ্রমণ, জলধ্বনি, প্রেতনৃত্য, মাঝরাতে বিস্ময়, মরচেপড়া ইতিহাস, দুপুরের ভূত, লালবর্ণে ছায়া, বেগুনি দর্পণ শীর্ষক শিল্পসুষমায়। বলা যায়, এ-ছবিগুলোর শিল্পকুশলতায় শিল্পীর প্রকৃত পরিচয়টি খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। শিল্পী অবাস্তব জগতের ভেতর বাস্তবতা খুঁজে ফেরেন আবার বাস্তবতার মধ্যে অবাস্তবতাকে। বলা যায়, দুটি পরিসর একে অপরের পরিপূরক হিসেবে শিল্পীর কাছে ধরা দেয় এবং তিনি তাঁর শিল্পসত্তা ও শিল্পক্ষমতা দিয়ে সেগুলোকে পরিস্ফুটিত করার চেষ্টা করছেন খুব সার্থকতার সঙ্গে এবং জানেন কোথায়, কখন, কেন ও কতদূর গিয়ে থামতে হবে, যা সব শিল্পমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ দৃশ্য বা অবয়বে তিনি অসাধারণত্ব অন্বেষণ করেন, যা লুকোনো আছে বা থাকে সেসবের আড়ালে বিমূর্ত বা মূর্তের ছদ্মবেশে। তার গড়ন-গঠন যেমন রেখাপ্রধান, তেমনি রং-লেপন পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়, স্বাভাবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রবণ ও সাবলীল। আবার বিভিন্ন বস্ত্তর টুকরো জোড়া দেওয়ার যে কোলাজ-পদ্ধতি সেটাও তিনি ব্যবহার করেছেন ছবিতে। কোনো জিনিসই শিল্পীর কাছে ফেলে দেওয়ার বা বর্জন-পরিত্যক্তের নয়। সাধারণ আপাতমূল্যহীন কফি বা চায়ের রং, চাল, মার্বেল বা ইটের গুঁড়ো, ডিমের খোসা, মাটির প্রলেপ, কাগজের ঠোঙা, বোর্ড, কাপড়ের অব্যবহৃত টুকরো – এসব অবলীলাক্রমে সরাসরি ছবিতে একটি বৈচিত্র্যময় প্রতিবেশ সৃষ্টি করে অসাধারণত্ব নিয়ে আসা বা সৃষ্টি করার সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করেন। তিনি সবসময় এসব নিয়ে বলা যায় প্রায় সর্বক্ষণ ছবি সৃষ্টির নানা দিক ও কৌশল নির্মাণে সচেষ্ট থাকেন। মানবিক অবচৈতনিক অনুভূতি, দেশ ও বিদেশের নিসর্গ, নদী, সমুদ্র, বৃক্ষরাজি, প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, দিনানুদৈনিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনাবলি, প্রকৃতির শান্ত ও অশান্ত বিভিন্ন রূপবৈচিত্র্য, মানুষের প্রতি মানুষের, পশু-পাখি-প্রাণীর প্রতি মানুষের অবিচার, অনাচার, অত্যাচার, অনধিকার চর্চা – সবকিছু শিল্পীর বোধানুভবের ভেতর দিয়ে তাঁর ছবিগুলোকে প্রভাবান্বিত করে তোলে। প্রকৃত শিল্পীর মন সবসময় অপরিতৃপ্ত অনুসন্ধিৎসু, অসম্পূর্ণ ও অবিমিশ্র। শিল্পী মনিরুল ইসলাম কোনোক্রমেই তাঁর ব্যতিক্রম নন, বরং এক উজ্জ্বল প্রতিভূ। বিততি, নেতিবাচক ঘটনাবলি, মানসিক কষ্ট এসব স্বাধীনতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, দেশ, মা, মাটির প্রতি কোনোরূপ ধারাবাহিকতাহীন ও বিবেচনাহীন বিরূপতা থেকেই উৎসারিত হয়, শিল্পীর সচেতনমনে তার প্রভাব পড়ে এবং সেখান থেকেই স্বতঃউৎসারিত ফল্গুধারায় শিল্পসৌন্দর্য এক নান্দনিক সৃষ্টির মধ্যে বিপরীতক্রম হিসেবে দেখা দেয়। শিল্পীর শিল্প-উৎস শুধু সুন্দরতার মধ্যেই বিকশিত হয় না, তার উৎসভূমি অসুন্দরতার মধ্যেও হয়ে থাকে – এটাই আধুনিকতার মূলকথা। শিল্পী মনিরুল ইসলাম তাই সরলতা-জটিলতা, সুন্দর-অসুন্দর, মানুষ-প্রকৃতি, মূর্ত-বিমূর্ত, চেতনা-অবচেতনা – এসবের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফিরছেন একজন উৎসর্গীকৃত শিল্পী-পথিকের মতো নিরলসভাবে নিরন্তর – এখানেই তাঁর শিল্পক্ষমতার প্রয়াস ও অধ্যবসায় সবাইকে আকৃষ্ট ও চমৎকৃত করে এবং এই বৈচিত্র্যময় একীভূত শিল্পরূপ-উপস্থাপনা সে-কথা প্রমাণ করে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.