অমিয় চক্রবর্তীর চিঠি : নরেশ গুহকে

পূর্বলেখ ও টীকা : ভূঁইয়া ইকবাল

পত্র ৩৩

THE UNIVERSITY OF KANSAS

LAWRENCE, KANSAS, USA

DEPARTMENT OF ENGLISH LANGUAGE

AND LITERATURE

July 1st 1952

 

প্রিয়বরেষু,

নরেশ,

তাড়াতাড়িতে কয়েক লাইন এই কবিতার পান্ডুলিপির সঙ্গে পাঠাই। কিছু কবিতা বাদ দিয়েছি – কিছু যোগ করেছি। সমগ্র বইয়ের নাম হবে ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’। প্রথম অংশের নাম ‘‘ছড়ানো  মার্কিনি’’; দ্বিতীয় অংশের ‘‘ভারতী’’; তৃতীয় অংশের ‘‘য়ুরোপা’’; চতুর্থ অংশে ‘‘পারাপার’’। প্রত্যেক অংশের নাম একটি স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় বড় অক্ষরে থাকবে, অর্থাৎ মধ্যে চারটি নাম সংযুক্ত পৃষ্ঠা বিভাগ স্বরূপে বসবে।

‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ অংশে আরো  অনেক কবিতা যোগ হবে। সেগুলি ‘‘কবিতা’’ পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে সংগ্রহ কোরো। শেষ ক’বছর এই দেশ থেকে যে-সব কবিতা ‘‘কবিতায়’’ ছাপিয়েছি সবই ঐ অংশে যাবে। ঐ অংশের প্রথম কবিতা ‘‘ধান চাও, ধান হবে’’ এবং দ্বিতীয় কবিতা ‘‘লাল মনসা’’। তা ছাড়া পান্ডুলিপিতে যে-ভাবে কবিতা সাজিয়েছি সেইভাবেই পর-পর সব কবিতা ছাপা হবে।

Signet Pressএর চিঠি এখনো পাইনি। তুমি এই পান্ডুলিপি ওঁদের কাছে নিয়ে যেয়ো।

যখন ছাপা আরম্ভ হবে, তুমি first proof সব দেখে দিলে নিশ্চিন্ত হই। পাত্লা কাগজে সমস্ত বইয়ের final proof আমাকে air mailএ পাঠালে ভালো হয় – আমি একবার সবটা ছাপার পূর্বে দেখতে চাই। পরের ডাকেই আমি air mailএ ফেরৎ পাঠাব। আমি 10th September পর্যন্ত ঘুরব – আমার ঠিকানা C/O  James Bristol, American Friends Service Committee, 20 South 12th Street, Philadelphia, Pennsylvania, USA। 10th Septemberএর পর থেকে আমার ঠিকানা বরাবর University of Kansas, Lawrence, Kansas, USA.

বইয়ের lay-out, cover এবং কাগজ ইত্যাদি বিষয়ে সম্পূর্ণভাবেই Signet Pressএর রুচি ও নির্ধারণের উপর নির্ভর করতে পারি। Faber & Faber  যে-ভাবে Eliot প্রভৃতির বই ছাপায় (Murder in the Cathedral etc.) সেই রকম সহজ, সুন্দর বই বেশ মানাবে। এই চিঠির উত্তর আমাকে দিয়ো। পান্ডুলিপি পেয়েছ এবং সব ব্যবস্থা কী ভাবে এগোচ্ছে তা জানালে অত্যন্ত আনন্দিত হব। তুমি আমার প্রীতি জেনো। তোমার প্রথম কবিতার বই কবে এসে পৌঁছবে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছি।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

পত্র ৩৪

 

Pendle Hill

Wallingford, Pennsylvania

 

Till Sept 10 1952

 

Address :

C/o James Bristol

American Friends Service

20 South 12th Street

Philadelphia, Pen

July 10/52

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ,

এর মধ্যে নিশ্চয়ই আমার পাঠানো ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’-র সম্পূর্ণ পান্ডুলিপি এবং সংলগ্ন পত্রখন্ড পেয়েছ। কয়েকদিন পরে বইয়ের ‘‘উৎসর্গ’’ – কয়েক লাইন – পাঠাব।

১) ‘‘প্রেম যুগে যুগে’’ নামক সংকলন গ্রন্থ থেকে (বুক এম্পোরিয়ম প্রকাশিত?) আমার কবিতা ‘‘পারাপার’’ অংশে যোগ ক’রে দিয়ো।

২) সমগ্র First proof অথবা Final proof আমাকে পাঠালে আমি অবিলম্বে আবার হাওয়াই ডাকে ফেরৎ দেব। একবার আমার দেখা দরকার। First proof হ’লে Corrections যোগ করা সহজ হবে।

৩) ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ অংশে সম্প্রতি (শেষ দুতিন বছরের) প্রকাশিত বাকি কবিতা যোগ হবে। ‘‘কবিতায়’’ এই দেশ থেকে পাঠানো কবিতা।

৪) ‘‘য়ুরোপা জাহাজে’’ নামক কবিতা ‘‘য়ুরোপা’’-অংশে বসবে।

৫) আশা করি কবিতার টাইপ পাইকা হবে – চোখে যাতে সহজ পাঠ্য হয়। ছোট অক্ষরে ছাপা কবিতায় কবিতা চাপা পড়ে।

সিগনেট প্রেস্ ছাপা সম্বন্ধে কী ঠিক করলেন জানলে বিশেষ আনন্দিত হব। ছাপার সময়, বইয়ের আকার ইত্যাদি বিষয়ে জানতে একান্ত উৎসুক রইলাম।

এখানে এখন ভারতবর্ষীয় গরম – এখানে আরো গায়ে লাগে। তবে হঠাৎ ঠান্ডা হতে বাধা নেই। পথে পথে ঘুরতে বেরিয়েছি – ঠিক এখন কিছুদিন এই রমণীয় স্থানে নির্জন বাস করছি। তোমাদের খবর দিয়ো।

প্রীতি নমস্কার জেনো।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

 

পত্র ৩৫

 

The George F. Baker Pavilion

The New York Hospital

525 East 68th Street

New York 21, N Y

8th Sept. 1952

 

Address

1604 University Drive

Lawrence, Kansas

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ, সম্প্রতি ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনার ফলে পায়ের জখম নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছি। Wisconsinএ বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম, একটা গভীর গর্তের মধ্যে প’ড়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙেছি। জোড়া লাগছে, কিন্তু দুই হপ্তা হয়ে গেল আরো দিন ৭/৮ এই হাসপাতালে বাকি, – তারপরেও দুই যষ্টির সাহায্য নিয়ে হাঁটতে হবে আরো মাস কয়েক। ঐ ভাবেই ১৯শে এরোপ্লেনে ওঠে Kansas পৌঁছব কারণ ২০ সেপ্টেম্বরে য়ুনিভার্সিটি খুলছে।

বিশ্বের চলাচলের পক্ষে গোড়ালি যে এত প্রয়োজনীয় বস্ত্ত এই প্রথম আবিষ্কার করলাম। সামনে হাসপাতালের জানালার ওপারে New Yorkএর East River (পূর্বী নদী) বিনা পদক্ষেপে উজ্জ্বল ধারায় ব’য়ে চলেছে, তার সচলতা আর আমার বিপদাবস্থা দুয়ের তুলনামূলক নানা চিন্তার দীর্ঘ অবসর পেয়েছি। প্রকান্ড সহরের মধ্যে দেয়ালে মোড়া শান্তি ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভোগ করি কিন্তু এই শান্তির চেয়ে চলন্ত বিশ্ববেদনা অনেকাংশে শ্রেয়। ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা এখনো যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু তারও চেয়ে বেশি যন্ত্রণা এই বর্তমান বন্দী-দশা।

সবখনই আমার ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ বইয়ের ভবিষ্য আবির্ভাব এখনো দৃষ্টিগোচর কিনা তাই ভাবি – ছাপা আরম্ভ হতে কতদিন তা কি তুমি জানাবে? দিলীপবাবুকে আমার গভীর ব্যগ্রতা জানিয়ো এবং তাঁকে আমার নমস্কার জানিয়ো। এই আকস্মিকতার সংসারে কখন কী হয় – বইখানি দুচোখে দেখতে পেলে বড়োই তৃপ্তি ও সার্থকতা অনুভব করব। প্রুফ আমার কাছে Kansasএর ঠিকানায় (হয় University বা বাড়ির ঠিকানায় – সঙ্গে দিলাম -) পাঠালে ফেরৎডাকেই পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

‘‘মানস সরোবর’’ আর ‘‘সংজ্ঞাহীন রাত্রে জেগে উঠে যাবো দেশান্তর’’ – এই দুটো কবিতা তাহলে উদ্ধার হল না – পরে কখনো আবিষ্কার হলে ভবিষ্যৎ কোনো কাব্যগ্রন্থে যোগ করব। আমার কাছে কপি নেই।

‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’-র বিষয়ে বিশেষ উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছি।

প্রীতিনমস্কার জেনো –

 

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

পুনশ্চ

তোমার পাঠানো ‘‘দুরন্ত দুপুর’’ কাব্য এই মাত্র সেমন্তী হাতে ক’রে নিয়ে এল। খুবই ভালো লাগবে মনে হচ্ছে। পরে তোমাকে লিখব।

 

 

পত্র ৩৬

The University of Kansas

Lawrence, Kansas USA

Department of English Language

and Literature

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ

তোমার চিঠি পেলাম। ইতিমধ্যে দিলীপবাবুকে আমি দু’তিনটি চিঠি লিখেছি, – ছাপানোর বিষয়ে তিনি যেরকম যা সমীচীন মনে করেন তাই ঠিক হবে। – বই শীঘ্র বেরোলে আমি মুক্তি পাই।

আমি প্রস্তাব করেছিলাম ভারতী অংশ ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ থেকে বাদ দিয়ে ‘‘দূরযানী’’র দ্বিতীয় সংস্করণে জুড়ে দিতে। কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত দিলীপবাবু ঠিক করেন ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ বইয়েই ভারতী অংশ ছাপা হলে সুরের বৈচিত্র্য এবং সামাজিক চিন্তার পরিপ্রেক্ষিত ভালো ফুটে উঠবে তাহলে আমি তাতে অবশ্য সম্পূর্ণ রাজি আছি। স্মল্ পাইকায় তাহলে সমগ্র বই শীঘ্র ছেপে বেরোতে পারে। তুমি এই চিঠি এখনই দিলীপবাবুকে দেখিয়ো।

গদ্যসংগ্রহ বিষয়ে আমার বহুদিনের ইচ্ছা এবং বেদনা রয়েছে – সিগ্নেট প্রেসের শুভেচ্ছায় যদি ঐ বই বেরোয় তাহলে তৃপ্ত হই। দিলীপবাবুকে আমি আরো কয়েকটি প্রবন্ধের নাম দিয়ে লিখেছি – তুমি পাবে। পুলিনবাবুকে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসা কোরো। ‘‘সংকেতে’’ শুধু ‘‘চলো যাই’’ নয়, আরো দুটো দীর্ঘ প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। তাছাড়া চতুরঙ্গ, কবিতা, বৈশাখী, প্রবাসী, মাসিক বসুমতী (কবি বিমলবাবুর পত্রিকার নাম মনে পড়ছে না, তাতেও প্রবন্ধ বেরিয়েছিল, অনুসন্ধান কোরো) ইত্যাদি। ‘‘দেশ’’ পত্রিকার দুএকটা পূজা সংখ্যায় গদ্য দিয়েছিলাম। প্রুফ দ্রুত দেখে দিতে পারি, কিম্বা সম্পূর্ণ ফাইল প্রেস্ কপি তৈরি হলে তা যদি পাই তাহলে দেখেই হাওয়াই ডাকে ফেরৎ পাঠাব। (‘‘গানের গান’’ প্রবন্ধটা উদ্ধার কোরো…)

আয়ুব সাহেবের শারীরিক শঙ্কার কথা শুনে বিশেষ দুঃখিত হলাম। তাঁর ঠিকানা আমাকে জানিয়ো। তাঁর প্রবন্ধের বই শীঘ্র বেরোনো বিশেষ দরকার। বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য বাড়বে।

একটা কথা : (‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’র ‘‘ছাত্র’’ ‘‘ছাত্রী’’ নামক দুই কবিতার এক বড়ো নাম বস্বে ‘‘কলাম্বিয়া য়ুনিভার্সিটি’’ – কবিতা দুটোর পৃথক subtitle ‘‘ছাত্র’’ এবং ছাত্রী। উৎসর্গের কবিতায় এক লাইনে আছে ‘‘পূজার মন্দিরে আমি’’ – তার জায়গায় বদ্লে দিতে চাই ‘‘পূজার মন্দিরে স্মরি’’)

কবিতা আরো নানা রং ছন্দ নিয়ে জমে উঠছে – কিন্তু এখন লিখতে ভয় পাই – আগে অন্য বইয়ের অতিথি সৎকার না হলে আগন্তুকের জায়গা কোথায়?

ভারতীয় নতুন টিকিটগুলি পেয়ে খুব খুশি হলাম। কিন্তু আমাদের প্রাচীন কবি প্রভৃতির চিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক ব’লে মনে সাড়া দেয় না।

তোমাকে আমার একটা ফোটো পাঠালাম। কাজ-চলা গোছ ব্যাপার – হাতের কাছে ছিল তাই খামে পুরে দিলাম।

তোমার ‘‘দুরন্ত দুপুর’’ যতোই পড়ছি আরো ভালো লাগছে – এর সূক্ষ্ম সুর ক্রমেই মনে প্রবিষ্ট হয়। একটু অন্য সুরের কবিতাও এই বইয়ে গ্রথিত হলে ভালোই হত – লোকে ‘‘সামাজিক চেতনা’’র দাবিতে চতুর্মুখ পঞ্চমুখ –  কিন্তু যেমন আছে এতে সুন্দর একটি লীরিকে বাজানো রৌদ্রোজ্জ্বল বেলার কোমলতা ও পরিব্যাপ্ত সরস চিত্তের কারুণ্য ভ’রে উঠেছে। উৎকৃষ্ট কবিতা এতে আছে।

প্রীতি নমস্কার জেনো।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

পুনশ্চ

দিলীপবাবুকে বোলো বইগুলি ছাপানো বিষয়ে তাঁর মতামত বিবেচনাবোধই প্রামাণিক। আমি উৎসুক হয়ে বইয়ের অপেক্ষা  করছি \

 

পত্র ৩৭

Amiya Chakravarty

Departments of English & Humanities

University of Kansas

 

Lawrence, Kansas

10th February 1953

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ,

আমি হতাশ হয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করছি, ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ ছাপা হবে কিনা তারি সন্ধানে। কিন্তু কোনো খবরই পেলাম না। ভাবছি cable পাঠাব, কিন্তু নিজের গরজে সবাইকে উপদ্রুত করতে দ্বিধাবোধ করি। তুমি দিলীপবাবুর কাছ থেকে জেনে নিয়ো তিনি কী ঠিক করলেন। যদি অনিবার্য কারণে সিগ্নেট প্রেস থেকে বই বার করা সম্ভব না হয় তাহলে আমার বিনীত অনুরোধে পান্ডুলিপি চেয়ে নিয়ো। অন্য কোনো ব্যবস্থা করা ছাড়া কী উপায়। এতে অবশ্য আমার মন এতটুকুও স্বস্তি পাবে না। কিন্তু কবিতা লিখে এতকাল ফেলে রাখা আর ঠিক হবে না। নতুন যে-সব রচনা নতুন ভঙ্গীতে দ্বারে এসে উঁকি মারে তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা ক’রে আরো নিরাশ হতে হয়।

গদ্যরচনা সংগ্রহ সম্বন্ধেও জানিয়ো। একটি ছোটোখাটো বিচিত্র প্রবন্ধের সংযুক্ত গ্রন্থ তো সহজেই তৈরি হতে পারে। তুমি কি সংগ্রহের কাজ শেষ করেছ? আমি যে তালিকা পাঠিয়েছিলাম তাতে তোমার তালিকার বহির্ভূত দুটি একটি মাত্র প্রবন্ধ ছিল – দুয়ের যোগে যা জমেছিল তাতে একটি বইয়ের পক্ষে যথেষ্ট। এদিকে ওদিকে আরো দুটো একটা লেখা প্রক্ষিপ্ত আছে –  কোনো ভবিষ্যৎ সংস্করণে ইচ্ছা হলে তা যোগ করা সম্ভব। যাই হোক, সেটা কোনো সমস্যা নয়। ছাপা হবার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা সেইটে আমার এখন জানা দরকার। মানুষ কদিনই বা বাঁচে। যেটুকু যা সংসারে দিতে চাই সেই সামান্য দামকেও নিজের হাতে সংসারে পৌঁছিয়ে দিয়ে বিদায় গ্রহণ করতে হয়।

বুদ্ধদেববাবুকে দিল্লীর ঠিকানায় কয়েকটি শ্লেষ রসাত্মক চতুর্দশপদী কবিতা পাঠিয়েছি – ‘‘কবিতা’’ পত্রিকার জন্যে। তিনি তোমার কাছে পাঠাবেন। তুমি নিজে যদি প্রুফ দেখে দাও তাহলে নিশ্চিন্ত হই।

তা ছাড়া আরেকটা কবিতা এই সঙ্গে রইল : সাম্প্রতিককাল এবং নকল ভারতীয় ‘‘মিশনারি’’ সম্পর্কিত বেদনা ও উষ্মা তাতে প্রকাশ পেয়েছে। এই লেখাটা ‘‘চতুরঙ্গ’’ বা ‘‘পরিচয়’’, বা অন্য কোনো বহুপ্রচলিত আধুনিকপন্থী অথচ প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় দিয়ো – ‘‘কবিতা’’ পত্রিকার জন্যে যা পাঠিয়েছি তার উপর এটা চাপালে ওজন বেড়ে যাবে, আমার কবিতার প্রতিও সুবিচার হবে না। বিশেষ প্রাসঙ্গিক এই কবিতা জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করতে চাই – অনেকের কাছে দ্রুত পৌঁছয় এমন কোনো কাগজে দিয়ো।

তোমার কাব্যগ্রন্থের একটা চার-পাঁচ পৃষ্ঠা সমালোচনা লিখেছি – আধুনিক কবিতার আঙ্গিক সমস্যা ইত্যাদির দিক থেকে। কোনো সময়ে পাঠিয়ে দেব। লেখবার সময় ক্বচিৎ-কদাচিৎ পাই। ‘‘প্রাণ রাখিতে সদাই প্রাণান্ত’’ – এই ছুটে-চলা উর্ধনিশ্বাসের দেশে সমাহিত চেতনা মেলে দিয়ে কিছু করা কি সহজ ব্যাপার? এরা বলে ‘‘নাক জলের উপরে রাখা’’ এই চেষ্টাতেই ভবসমুদ্রে মানুষের সব বিদ্যাবুদ্ধি খাটাতে হয়। কথাটা ভেবে দেখো। একটু অসাবধান হলেই সভ্যতার সলিল অবলুপ্তি। চীন সংক্রান্ত পশ্চিমী চালচলনের লক্ষণ ভালো নয়। মন অত্যন্ত আহত হয়ে থাকে – মধ্যে মধ্যে নিজেকে একান্ত নিঃসঙ্গ মনে হয়। সেই বেদনা ‘‘চতুর্দশপদী’’র হালকা ভঙ্গীর তলে তলে অনুভব করবে – বুদ্ধদেববাবুর কাছে আজই পাঠালাম।

প্রীতি জেনো।

অমিয় চক্রবর্তী

 

 

মারী মূর্তি

অমিয় চক্রবর্তী

 

নিশ্চয় অনেক ভালো ক্যান্সসের ক্লিষ্ট মাঠে গিয়ে

ভূলুণ্ঠিত শষ্য-হাতে অদৃশ্য চোখের জলে মানা

দগ্ধ প্রজ্ঞা : অনাবৃষ্টি। তার পরে সেই দীক্ষা আনা

যার মন্ত্রে ট্র্যাক্টর, বৈদ্যুৎ কোদাল কাস্তে নিয়ে

অন্নরূপা আবির্ভূতা; ভূত-পাথরের মূর্তি নয়,

বিজ্ঞানে কল্যাণে সন্ধি, ল্যাবরেটরির পরিচয়

কর্মযোগে। দক্ষিণেশ্বরের কালি জিহবা নিরুত্তর

লাল হয়ে রোন্ ভক্তঘেরা, উত্তরসাধক চলে

মূর্তিহানা দলে দলে, জানে তারা কৃষির ঈশ্বর

মাটিতে বীজের শক্তি, আদ্যা শক্তি, চিত্তে তেজো বলে

উদ্ভাবিত সংঘতায় দেশে দেশে। মারী-জয়ী তারা

সবাই জানে নি ধ্রুব যেখানে জীবন পূর্ণ ধারা

বয় শুধু কাটা-খালে, ট্যুব্-ওয়েলে নয়, তারো পারে

পারমিতা, তবুও এদের হাতে মনে চারিধারে

পথ খোলা, যে-পথে পরমা গতি লোকে লোকে গান

অধিষ্ঠান সর্বজনে, অবিগ্রহ। সূক্ষ্ম প্রতারক,

গুরু-পূজা, আপ্ত বাক্য, অধিকারীভেদ গুণগান

শুধু হাসি নয়, অপমান এরা বোঝে। বিশ্বলোক

ঘরে ঘরে স্বাধিকার, নরজন্মে সমান সম্মান

– ধিক্ মার্কিনে এসে মিথ্যা ধর্মে পূর্বী প্রচারক \

 

লরেন্স্

ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩

 

যদি ছাপাও তাহলে নিজে প্রুফ দেখে দিয়ো – তাহলে নিশ্চিত হবো।

 

 

পত্র ৩৮

Amiya Chakravarty

Departments of English & Humanities

University of Kansas

Lawrence, Kansas

March 21/ 1953

 

কল্যাণীয়েষু

তোমার চিঠিতে চিঠিতে ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ ছাপা হবার খবর পেয়ে সুখী হলাম। খুব পাৎলা কাগজে প্রুফ যদি পাঠানো সম্ভব হয় আমি সংশোধন ক’রেই ফেরৎ পাঠাব। কবিতার বইয়ে ভুল-ত্রুটি থাকা অমার্জনীয়। সবখানি একত্র দেখা লেখকের পক্ষে দরকার : সমস্ত বইয়ের প্রুফ দেখলে আমি পাঠকের প্রতি সুবিচার করতে পারব।

পরের পৃষ্ঠায় উৎসর্গের নূতন কপি পাঠালাম – তুমি নিজের হাতে দিলীপবাবুকে দিয়ো।

‘‘চতুর্দশপদী’’ (নরেন্দ্রের দুঃস্বপ্ন) এই সংগ্রহে না যাওয়াই ভালো। বই এম্নিতেই যথেষ্ট দীর্ঘ হয়েছে। তা ছাড়া ঐ কবিতার সহযোগী অন্য ধরনের রচনা পরে কোনো বইয়ে যেতে পারবে।

‘‘পারাপার’’ নামক ছোট কবিতার নাম বদ্লিয়ে ‘‘পরিণাম’’ ক’রে দিয়ো।

‘‘বিনিময়’’ ও ‘‘শিল্প’’ মার্কিনি-অংশে না দিয়ে অন্য কোনো অংশে দিয়ো যেখানে ভালো মেলে। ‘‘পারাপার’’ অংশে যেতে পারে। এমন জায়গায় বসিয়ো যেখানে তোমার মতে ভালো মানায়। (যদি কোনো কারণে ‘‘মার্কিনি’’ অংশকে বড়ো করা ঠিক মনে হয়, তাহলে এই অংশেরই মধ্য-দিকে কোথাও বসিয়ো। এমন কিছু  যায়-আসবে না।)

যামিনীবাবুর ঠিকানা জানিনা – এই সঙ্গে তাঁর জন্যে একটা চিঠি দিলাম। আর যাই হোক, প্রচ্ছদে যেন খুব সাদা-সিধে নকশা – মানুষের মুখ বিবর্জিত – গাছপালা বা ছক-কাটা সহজ কিছু অাঁকা হয়। কিছুই না থাকলেও ক্ষতি নেই। আর বইয়ের নাম যেন হাতের লেখার অক্ষরে না হয়ে ছাপার অক্ষরে বসে। বিজ্ঞাপন যদি দিতে হয়, আলাদা মলাটের কাগজে দেওয়া চলে, বইয়ের গায়ে নয়। কিন্তু মলাটের কাগজে বোধ হয় খরচ বাড়বে। তাহলে অন্যত্র, অর্থাৎ কাগজপত্রে, ক্যাটালগে বিজ্ঞাপনই যথেষ্ট। (রবীন্দ্রনাথ ‘‘খসড়া’’ ও ‘‘দুই মুঠোর’’ উপরে যে-প্রবন্ধ ‘‘প্রবাসী’’তে লিখেছিলেন তার থেকে দুএক লাইন বিজ্ঞাপনের কাজে উদ্ধৃত হতে পারে। তাছাড়া আমাকে লেখা দুএকটি চিঠিতে সাধারণভাবে আমার কবিতা সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, তার থেকে উদ্ধৃতিও ভালো মানাবে। কিন্তু আমাকে লেখা তাঁর চিঠিপত্র রবীন্দ্ররচনাবলীর কোনো খন্ডে বেরিয়েছে কি? আমি খোঁজ পাইনি।

এখন উৎসর্গের কবিতা

 

উৎসর্গ

গাব্রিয়েলে মারিয়া –

 

য়ুরোপে যুদ্ধ-ভাঙা তীব্রতায় দুঃখজয়ী তুমি

দেখেছ প্রাণের তীর্থভূমি;

অন্তরের ক্ষমা দিয়ে প্রেম দিয়ে আলো জ্বেলে পথে

চলেছ সংসারে পুণ্যব্রতে;

অনন্তের সঙ্গী যিনি মাটির-স্বর্গের শুভক্ষণে

তাঁকে যুগ্ম জেনেছ জীবনে –

পূজার মন্দিরে স্মরি’ এ কবিতা পাঠাই তোমায়

নিয়ো তুমি, দিয়ো তাঁরি পায় \

 

তুমি এটা কপি করে সিগনেট প্রেসে দিয়ো। প্রীতিনমস্কারান্তে

তোমাদেরই

অমিয় চক্রবর্তী

 

পুনশ্চ

এদেশে দিলীপ রায় মহা উৎপাত করছেন। তিনি পন্ডিচেরি আশ্রম ভেঙে বেরিয়েছেন, নিজের শিষ্যদের নিয়ে হরিদ্বারে আশ্রম খুলবেন।  তার জন্যে মার্কিনে টাকা ও আধ্যাত্মিক বিজ্ঞাপন দরকার। যে বেচারি মহিলাকে স্বামী ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে চিরবিচ্ছিন্ন করে সঙ্গে সঙ্গে এদেশে ঘোরাচ্ছেন তিনি ভারতীয় হলেও ভারতীয় নাচ প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি নাকি medium – তাঁর automatic writingএর যোগে দিলীপ রায় ঝুড়ি ঝুড়ি মীরার ভজন (হায়রে মীরাবাই!) পরলোক থেকে পাচ্ছেন। ভুল হিন্দি এবং অবিশ্বাস্য নিকৃষ্ট সেই রচনা সাংঘাতিক [বাংলা] মৃত কবিতায় এবং অপকৃষ্ট ইংরেজিতে তর্জমা করে তিনি Aldous Huxey প্রভৃতি সাহিত্যিকের ঘাড়ে চেপেছেন – তাঁরা কতদূর ধিক্কৃত… করছেন বুঝতেই পারো।

ওস্তাদি গান ও ভজন দুচারটে দিলীপ রায় ভালোই গান করেন। কিন্তু নিজের রচনা ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচনা যেভাবে ও ভঙ্গীতে অন্তহীন বিস্তার ক’রে চলেন তার অত্যাচার অসহ্য। পন্ডিচেরি থেকে এই সং ও নকল সাধুর নির্লজ্জতা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এই আধ্যাতিমক গুন্ডামির তুলনা কোথায়?

 

 

পত্র ৩৯

University

Lawrence

Kansas

21st March 1953

 

 

নরেশ,

সঙ্গের চিঠি দিলীপবাবুকে দিয়ো। তুমি প্রকাশকের নানা পর্বের যে ইতিহাস দিয়েছ তাতে আশ্চর্য হইনি, দুঃখিত হয়েছি। আমাদের দেশে এখনো সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠা পাঠক বা ছাপাখানার মহলে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক দেরি। যাই হোক, তুমি এই বইখানি ছাপার ভার নিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছ। কবিতা লিখে তা বইয়ে না বার করার মানে হয় না – এর জন্যে যদি ঔৎসুক্য বোধ করি সেটা আত্মপরতা নয়, স্বাভাবিক সৃষ্টিশীল ইচ্ছা।

পরে আবার লিখব। তোমার বইয়ের সমালোচনাও পাঠাব।

(আমার গদ্যসংগ্রহ যথাশীঘ্র পাঠালে আমি স্বস্তি পাই – একটা শেষ দায়িত্ব আমার শোধ হয়)। ছড়ানো মার্কিনির প্রুফ পেলে সঙ্গে সঙ্গে হাওয়াই ডাকে ফেরৎ দেব। অতটা প্রুফ air mailএ পাঠাতে ছাপাখানার কিছু খরচ হবে। কিন্তু উপায় কি।

নতুন কবিতা ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’র ‘‘মার্কিনি’’ অংশ যোগ ক’রে দিয়েছ তা ঠিকই হয়েছে। ‘‘য়ুরোপা জাহাজে’’ কবিতাটাও তারই অন্তর্গত।

আরো নতুন ধরণের কবিতা জমে উঠছে কিন্তু এখন ভাবতেই ভয় করে। আগে এই বইয়ের উদ্ধার হোক। আসল কথা কবিতার বই বছর খানেক বা দুয়েক পরে পরে বার করা উচিত – বেশি দিন জমে উঠতে দেওয়া কিছু নয়।

তোমার নতুন বই বেরোবে জেনে বিশেষ সুখী হলাম। গদ্যও বই করে ছাপিয়ো।

তোমাকে যে একটা কবিতা সেদিন পাঠিয়েছিলাম সেটা কোন্ পত্রিকায় দিলে? শেষ পর্যন্ত ‘‘কবিতা’’ পত্রিকাতেই ওটাও বেরোলে ক্ষতি নেই।

তোমার চিঠিতে দেশের অনেক খবর পেলাম। সুখবর না হলেও দেশের খবর তো।

আজ এই পর্যন্ত।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী।

 

পত্র ৪০

Dept of English

University of Kansas

Lawrence, Kansas

April 1/ 1953

 

প্রিয়বরেষু

শুধু দু’লাইন। বক্তব্য :

১) ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ কতদূর এগোলো? (এক একবার মনে হয়েছিল বইয়ের ঐ নামে লোকে না ভাবে মার্কিনি প্রপাগান্ডা ঐ কাব্যে নিহিত! তাহলে বইয়ের নাম ‘‘দুই পারে’’ করে দিতাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস ও ভাবনা এমন কিছু নয়।)

২) তুমি যদি একটু কষ্ট ক’রে দেশী দৈনিকে ও সাপ্তাহিকে প্রকাশিত দিলীপ রায়ের আমেরিকা ভ্রমণ সংক্রান্ত বৃত্তান্তের (বাংলা এবং ইংরেজিতে) কাঁচি-ছাঁটা টুকরো আমাকে মধ্যে মধ্যে পাঠাও তাহলে বিশেষ উপকৃত হব। একটু বিশেষ দরকার।

বইয়ের খবর পাবার আশায় রইলাম। তোমাকেও শীঘ্র আরেক পত্র পাঠাচ্ছি।

প্রীতিনমস্কার

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

 

পত্র ৪১

University of Kansas

Lawrence, Kansas

২৫ এপ্রিল ১৯৫৩

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ,

তোমার চিঠি পেয়ে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। মাসের পর মাস চ’লে গেল, এর মধ্যে বিশ্বসংসারে কত বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটে যায় অথচ একটি সামান্য বাংলা পুঁথি ছাপার খবর নেই এতে প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম একটা শেষ টেলিগ্রাম পাঠিয়ে খবর জেনে নিই। এমন সময় তোমার চিঠি এল। গীতায় বলেছেন ‘তিতিক্ষ স্ব’ – জর্মানিতে বলে ‘Wurtey konnen’। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘ধৈর্য তোমার রাজপথ’। আশা করছি শেষ পর্যন্ত ফল ফলবে।

এই চিঠিতে কেবল দুচারটে কথা লিখতে চাই। আশাকরি যামিনীবাবু বইয়ের কভারের জন্যে বিরল তুলির টানে পারাপারের দুই তীর, একটি দুটি সিন্ধুগামী পাখী গোছের কিছু এঁকে দিয়েছেন। ওঁর আঙুলে চিরন্তন-মডার্ন কিছু ইঙ্গিত ফুটে উঠবেই। আমারও ইচ্ছে খুব সুস্পষ্ট সাদাসিধে একটি কভার হয় – অত্যন্ত বিরল এবং কভারের বেশির ভাগই কেবলমাত্র শূন্যের ছোপ। আমাকে কভারের প্রুফ পাঠিয়ো দিয়ো।

তাহলে ‘পারাপার’ নামই রইল। মধ্যে একটি অংশের নাম অবশ্য ‘ছড়ানো মার্কিনি’-ই থেকে যাবে।

প্রুফ দেখবার সময় উৎসর্গের কবিতায় ‘পূজার মন্দিরে স্মরি’ বদলিয়ে ‘চির-মানবেরে স্মরি’ ক’রে দিয়ো। নয়তো প্রুফ এলে আমি ক’রে দেব। তাছাড়া ‘‘য়ুরোপা জাহাজে’’ কবিতায় যেখানেই ‘অনস্তি’ কথাটা আছে ‘অনাস্তি’ ক’রে দিতে হবে।

প্রুফের জন্য বিশেষ উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করব। বুঝতেই পারো। আমার লরেন্সের মেয়াদ ফুরিয়ে এলো – জুনের আগে আগেই তাই প্রুফ ইত্যাদি ফেরৎ দিতে চাই। এরপর থেকে আমার ঠিকানা C/o American Express Co., 649 Fifth Avenue, New York, N.Y. (জুনের প্রথম থেকে)। আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে পড়াবো, ঘুরব – September থেকে Boston Universityতে অন্তত বছর খানেকের মতো যোগ দিচ্ছি। পরে ঠিকানা পাঠাব। (যেখানেই থাকি American Express তৎক্ষণাৎ আমাকে চিঠি পাঠিয়ে দেবে।)

তুমি নতুন পত্রিকার জন্যে ছোট কবিতা চেয়েছ – এই সঙ্গে পাঠালাম। অন্য কবিতাটি ‘চতুরঙ্গে’ দিয়ে ভালোই করেছ। ‘চতুরঙ্গ’ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলে খুব ভালো হবে – তুমি হাল ধ’রে থেকো…

প্রীতিনমস্কারান্তে

 

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

পত্র ৪২

Boston University

Boston, Massachusetts

২৫ মে ১৯৫৪

 

প্রিয়বরেষু

বুদ্ধদেববাবুর চিঠি থেকে মনে হচ্ছে আমার একটি দীর্ঘ চিঠি তুমি পাওনি। এদিকে আমি তোমার উত্তরের বিশেষ অপেক্ষায় ছিলাম। বাংলার কবি-সম্মেলনের বিষয়ে উৎসুক হয়ে আনন্দ জানিয়েছিলাম। তাছাড়া কিছু কাজের কথা ছিল। দেখি, কতদূর মনে পড়ে।

আমি পত্র-রূপী সমালোচনায় তোমার কাব্যের বিবিধ পরিচয় ব্যক্ত করতে পারিনি। চিঠিতে বা কথাবার্তায় যেমন হয়, ঝোঁক পড়েছিল বিশেষ কয়েকটি প্রসঙ্গের উপর। তোমার সূক্ষ্ম উদ্ভাবনশীল কবি-ধর্ম নূতন কাব্য সংগ্রহে আরো বিচিত্র হয়ে প্রকাশ পাবে সেই উল্লেখ ছিল আমার প্রবন্ধের টুকরোয়। আমি সেই সংগ্রহের প্রতীক্ষায় আছি। তুমি নিজের সৃষ্টিস্বভাবের পথে এগিয়ে যাবে; প্রত্যেক কবির পথ স্বতন্ত্র।

জনশক্তির কথা লিখেছিলাম : তারও ঢেউ কাব্যে পৌঁছায় ব্যক্তিবিশেষের শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে, স্বরূপী শিল্পের প্রসাধনে। এর জন্যে ভিড়ে অবতীর্ণ হবার দরকার নেই, বিশ্বব্যাপারকে তুমি প্রসারিত সম্বন্ধের ঘনিষ্ঠতায় গ্রহণ করবে। ‘‘সবর্বমেবাবিশন্তি’’ – সেই প্রবেশের পথ বাহিরের নয়, আত্মিকতার। মানবিকতার ধর্ম কবির জীবনে কর্মে সত্য হয়ে উঠলে সেই একই কালে তাঁর রচনায় তা চারিয়ে যায়। জনসমুদ্রের ঢেউ যাঁরা কষ্ট ক’রে গোনেন তাঁদের চেষ্টার ছায়া পড়ে তাঁদের কাব্যে, বোঝা যায় তাঁরা অভিষিক্ত নন।

দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু মনে হয় যে-চিরন্তন বাঙালি সংসারে আমার জন্ম, যার মর্মলোকে আজো আমি জীবিত, সেখানে আরো একটি মহান্ পর্ব তৈরি হয়ে উঠছে। যখন নবীন বাংলার যুগোত্তম রূপ উদ্ঘাটিত হবে তখন আমি থাকব না, কিন্তু তোমরা তার স্রষ্টা, তোমাদের চোখে তার জ্যোতি এসে ঠেকবে, সার্থক হবে তোমরা। মধ্যে আরো দুঃখের পরীক্ষা আছে, বাংলাদেশে আরো বিদীর্ণ আলোড়ন চলবে, কিন্তু সেই দুঃখকেই যেন আমি এবং আমার সতীর্থরা চিত্তে বহন করে যাই – তোমরাও সেই দুঃখের বাহক, তবু তোমাদের কালে পুনরুজ্জীবনের ভারতবর্ষ আবার যথার্থ মুক্ত হয়ে দেখা দেবে। এই আমার বিশ্বাস। আমরা বিশ্বজোড়া সংঘাতের চরম রূপ দেখে যাব, – ভারতবর্ষে সেই সংঘাত একান্ত হয়ে ওঠার কথা কেননা ভারতবর্ষ যথার্থ বিপ্লবী, যথার্থ তামসিকের সভ্যতা। অতঃপর তোমাদের অপরাহ্ণ জীবনে দেখবে হঠাৎ স্নিগ্ধতর যুগের আবির্ভাব। তপোজয়ী স্নিগ্ধতার কথা বলছি, যা দুঃখে কেনা, শ্রেয়োময়, যা সত্যে সঞ্জাত অরুণস্পর্শী।

নিজের কথা বলি। কিছুদিন ধ’রে নূতন সহজতার একটি কাব্যধারা অনুসরণ ক’রে চলেছি, চলাফেরার সুরে গাঁথা প্রতিফলিতের কাব্য। আরো জমুক। এখন পাঠাবো না। একটি ছোট গ্রন্থাকারে গোটাপঁচিশ কবিতা ছাপাবার ইচ্ছে আছে।

সৃষ্টির রাজ্য বড়োই অদ্ভুত ব্যাপার। আমার দাবি কতটুকুই বা, সামান্য একটু খেলামাত্র, কিন্তু এর থেকেই বুঝতে পারি রহস্যের নিবিষ্টতা। অপরিসীম। হয়তো ডিনারের ভিড়, আলোর উজ্জ্বল  ক্লান্তি, তারি মধ্যে চোখে-দোলা বাহিরের জানলায় অলিভের ছায়াগলি। কোথাও বা মনোময় দৃষ্টি, সহৃদয় কথার স্পর্শ, তার চারদিকে প্রবাসীর নির্জন ঘের। কবিতা লেখবার মধ্যরাত্রে এই সব কিছু কী হয়ে ভাষা নেবে কিছুই বলা যায় না, অাঁচ করাও যায় না। হয়তো সবসুদ্ধ মিলে জাগে কেবল একটি ঘরে-ফেরানো বাঁশি, যা ছবি বা ভাবনার সঙ্গে আপাত মেলে না। হয়তো প্রসঙ্গ যাই থাক্, দেখা দেয় আরেকটু গাঢ় কেবলমাত্র কথার লাবণী, ছলছল চোখে অঞ্জনের মতো। যেমন ধ্বনি। বুঝতে পারি প্রকান্ড আরণ্যিক বেদনাকে বেঠোভেন কীভাবে কেবলমাত্র ধ্বনির জালে বাঁধলেন – যা বাঁধা পড়ল তাও ধ্বনি। এই ক’রেই রাগরাগিণীর সৃষ্টি হয়েছে। দৈবের কৃপায় আমরা কথা দিয়ে কথাকে ছুঁয়ে যাই। নিয়ম দিয়ে ব্যাকরণকে পাওয়া যায়, তারও চেয়ে যা ধ্রুব, যা ধ্রুবপদ, তা এড়িয়ে যায়। হয়তো এর ভাষা সত্তায়। অর্থাৎ হওয়া ছাড়া হওয়ানোর উপায় নেই।

আজ আর বেশি লিখব না। আমার গদ্য সংগ্রহ বিষয়ে জানিয়ে তুমি আমাকে গভীর উৎসাহ দিয়েছিলে। আমার  চিঠি যখন তুমি পাওনি মনে হয়, আবার দুএকটা তথ্য এইখানে তুলি। তুমি যে তালিকা দিয়েছিলে তাতে যোগ হবে (১) উড়ো তর্ক – য়ুরোপীয় সামরিক সাহিত্য (বৈশাখী ১৩৫০-এর সংখ্যায় বেরিয়েছিল, – দৈবাৎ আমার কাছেও কাঁচি-ছাঁটা কপি আছে – ওখানে সহজেই পাবে। (২) শেষ লেখা এবং আরোগ্য রবীন্দ্রনাথের এই দুই কাব্যের উপর ‘‘প্রবাসী’’তে প্রকাশিত ক্ষুদ্র প্রবন্ধ। (৩) ‘‘বসুমতী’’-পত্রিকায় ছাপা সুভাষচন্দ্রের চিঠি-সংযুক্ত আমার রচনা – এটা বিশেষ রাখতে চাই।

তাছাড়া ‘‘প্রবাসী’’তে বহু আগের ফাইলে (১৯৩০-৩২ (?) সালের বাংলা বছরে) পাবে ‘‘মস্কৌএর চিঠি’’ এবং ‘‘কাবুলের চিঠি’’। সম্পাদকীয় সমস্ত ব্যাপারে তোমার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করব। এখান থেকে প্রুফ দেখা, সাজানো, বা সংস্কার কাজের কোনো প্রক্রিয়াই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন যদি প্রসাধন কাজে লাগি, ঐ সব পুরোনো লেখা তাহলে একেবারেই বদলে যাবে। তার উপযুক্ত সময়ও নেই। কাজটাও অনুচিত। তুমি যেটুকু যা দরকার বোধ করো, লাইন ভেঙে দিয়ো বা একত্র কোরো। দরকার মতো কথা ছেঁটে দিয়ো বা বিকল্পে বদল কোরো। তোমার উপর নিশ্চিন্ত হয়ে এই মরমী দায়িত্ব আমি অর্পণ করছি। কোন্ প্রবন্ধ কোথায় বসবে তাও তুমি ঠিক কোরো। দিলীপবাবু এবং নীলিমা দেবীর পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান হবে। এই আমার দরবার রইল।

মধ্যে নির্মল চট্টোপাধ্যায় কয়েক ঘণ্টার জন্যে এসেছিলেন – হঠাৎ দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল। বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে শীঘ্রই ন্যুইয়র্কে আবার দেখা হবে। বস্টনে যখন এসেছিলেন আমার গৃহদ্বারের কাছে দুজনের একটা ছবি কোনো বন্ধু তুলেছিলেন। তোমাকে এই সঙ্গে পাঠাই।

তোমার খবর দিয়ো।

আমার গদ্য সংগ্রহের ছাপা-সুরু খবর দিয়ে যদি লিখতে পারো তাহলে গভীর তৃপ্তি পাব। বেশি কিছু আর আমার করবার সময় নেই। যেটুকু সামান্য কিছু করেছি, চেষ্টা করেছি, তার প্রতীক দেখে যাবার ইচ্ছা। এটা মায়া বলতে পারো, কিন্তু আমরা খানিকটা এই জীবনের যোগমায়ায় যুক্ত – সহজে তা ঘুচবে কেন।

 

প্রীতিনমস্কারান্তে তোমাদের অমিয় চক্রবর্তী

 

 

 

পত্র ৪৩

Africa  July 9/ 55

 

প্রিয়বরেষু,

গভীর আফ্রিকায় এসে পৌঁছেছি। আজ প্রকান্ড কঙ্গো নদী পার হলাম ফেরি-বোটে। কাল পৌঁছব লাম্বারেণিতে, ডাক্তার Schwietzerএর কাছে। সেইখানে তিনি প্রাণকে শ্রদ্ধার মন্ত্র শুনেছিলেন; অর্ধশতাব্দী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই কর্মতীর্থে। আশা করি খুব ভালো আছ।

এই মাসেই দেখা হবে।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

পত্র ৪৪

BOSTON UNIVERSITY

BOSTON 15, MASSACHUSETTS

March 20/ 55

 

প্রিয়বরেষু,

তোমার রোগশয্যা এবং আরোগ্যের খবর পেলাম।- ইতিমধ্যে আমার মনের প্রার্থনা এবং গভীর শুভকামনা নিশ্চয় তোমার কাছে পৌঁছেছে। তোমার প্রথম চিঠি পেয়েই আমার অন্তরের নিবিড় আশীর্বাণী মনে মনে তোমাকে পাঠিয়েছি – যেন প্রাণের নিরাময় নিত্যশক্তির আশীর্বাদ তোমাকে স্পর্শ করে। তোমার দ্বিতীয় পত্র পেয়ে তৃপ্ত হয়েছি।

আলাদা ডাকে তোমাকে একখানি বই পাঠালাম। আজ শিকাগো যাচ্ছি, সেখান থেকে তোমাকে আবার লিখব।

তুমি সেরে ওঠো, প্রাত্যহিক জীবনে অতি দ্রুত পুনঃপ্রবেশ কোরো না – আরোগ্যের প্রশমিত ছন্দ আরো কিছুদিন চলুক্। শরীর-মনের এই সূক্ষ্ম জাগ্রত অবস্থায় হয়তো নূতন কিছু কবিতা না লিখে পারবেনা। কিছুকাল আগে – দুবছরের বেশি হলো – এক দুর্ঘটনায় পায়ের গোড়ালি ভেঙে আমি মাস দুয়েক ন্যুইয়র্ক হাসপাতালে ছিলাম – তখন বিশেষ এককতার স্বচ্ছ চেতনায় জেগে উঠে কিছু কবিতা লিখেছিলাম। (‘‘পালা-বদলে’’ দেখতে পাবে।) পরেও প্রায় তিনমাস বেদনায় খুঁড়িয়ে হেঁটেছি অথচ অনেক বার মনে হয়েছিল চেতনার দিক থেকে যেন নূতন ক’রে চলার অভিজ্ঞতা হল। সবসুদ্ধ যা লাভ করা যায় তা স্পষ্ট বলবার নয় – কিন্তু পরবর্তী লেখায় ভাবনায় তা চারিয়ে যায়। তোমার নূতন পর্য্যায়ের রচনার জন্যে উৎসুক থাকব।

‘‘পালা-বদল’’ ছাপবার সময় তোমার সহায়তা কামনা করব। কিন্তু এখন তুমি সম্পূর্ণ সেরে ওঠো – ‘‘কাজের কথা’’ এখন নয়।

পূর্ণ মঙ্গল ইচ্ছা তোমাকে পাঠাই।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

 

পত্রধৃত প্রসঙ্গ

 

পত্র ৩৩

২৯-সংখ্যক পত্রের টীকায় বলেছি, শেষ পর্যন্ত ওই কাব্যের নাম পরিবর্তিত হয়; পারাপার নামে প্রকাশিত ওই বইয়ের চতুর্থ অংশের নামও বদ্লে ‘‘দুই তীর’’ রাখা হয়। ‘‘ছড়ানো মার্কিনী’’ অংশের প্রথম কবিতা ‘‘মাটি’’; দ্বিতীয় কবিতা কবির প্রস্তাবিত ‘‘লাল মনসা’’ই ঠিক আছে।

Signet Press – পারাপার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশ পায় (১৩৬০)।

 

পত্র ৩৪

‘‘য়ুরোপা জাহাজে’’ কবিতাটি ‘য়ুরোপা’ অংশের সূচনা কবিতা।

 

পত্র ৩৫

‘‘মানস সরোবর’’ কবিতা ঘরে ফেরার দিন বইয়ের অন্তর্গত হয় (প্রথম সংস্করণ ১৩৬৮; দ্বি-স ১৩৭১)।

দুরন্ত দুপুর – নরেশ গুহর প্রথম বই (সিগনেট প্রেস, ১৯৫২)। অমিয় চক্রবর্তীর দীর্ঘ পত্রে সমালোচনা কবিতা-য় বেরোয় ১৩৬০ এর পৌষ সংখ্যায়; ‘‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’’ শিরোনামে সংকলিত সাম্প্রতিক বইয়ে।

 

পত্র ৩৬

‘‘ছড়ানো মার্কিনী’’ নামে পরিকল্পিত বইয়ের তথ্য দেখুন ২৯ ও ৩০ সংখ্যাক পত্রের টীকায়।

দূরযানীর ২য় সংস্করণ হয় নি; ১ম সং. সিগনেট প্রেস থেকে ১৩৫১ সনে বেরোয়।

‘‘গানের গান’’ প্রবন্ধ – সাম্প্রতিক বইয়ে আছে। আইয়ুব সাহেব – আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২) তাঁর বই আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, পথের শেষ কোথায়, পান্থজনের সখা ও Poetry and Truth ইত্যাদি। অমিয় চক্রবর্তী ও আইয়ুব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনে ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন।

উৎসর্গের কবিতায় ‘‘পূজার মন্দিরে আমি’’ বা প্রস্তাবিত পরিবর্তিত রূপ ‘‘পূজার মন্দিরে স্মরি’’ কোনোটাই নেই।

দুরন্ত দুপুর – পূর্বপত্রের (৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫২) টীকায় উল্লিখিত।

 

পত্র ­৩৭

গদ্যরচনা সমগ্র ­- এই পত্ররচনার দশ বছর পর প্রবন্ধের বই সাম্প্রতিক প্রকাশ পায় (নাভান, ১৯৬৩)। ‘লেখকের মন্তব্যে’ বিরাম মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ও নরেশের সহায়তার উল্লেখ আছে।

বুদ্ধদেব বাবুকে দিল্লীর ঠিকানায় ­ – ১৯৫২-৫৩ সালে বুদ্ধদেব বসু ইউনেসকো-পরিচালিত প্রকল্পে দিল্লিতে এক বছর নিযুক্ত ছিলেন।

চতুরঙ্গ – হুমায়ুন কবির (১৯০৬-৬৯) ও বুদ্ধদেব বসুর যুগ্ম সম্পাদনায় ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত উচ্চমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। কয়েক সংখ্যা পর থেকে হুমায়ুন কবির একাই সম্পাদনা করেন।

পরিচয় – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)-সম্পাদিত (১৯৩১-৪৩) সাহিত্যপত্রিকা। তোমার কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা – ৩২-সংখ্যক পত্রের টীকা দেখুন।

‘মারী মূর্ত্তি’ নামে একটি কবিতা সংযুক্ত এই চিঠির সঙ্গে।

দ্র. পালাবদল।

পত্র ৩৮

‘‘চতুর্দশপদী’’ (নরেন্দ্রের দুঃস্বপ্ন) – ঘরে ফেরার দিন কাব্যে (১৩৬৮, দ্বি-স ১৩৭১ বঙ্গাব্দ) গৃহীত।

‘‘পারাপার’’ বদ্লিয়ে ‘‘পরিণাম’’ করে দিয়ো – নাম বদল হয় নি। পারাপার বইয়ের শেষ কবিতা। দেখুন, কবিতাসংগ্রহ ১, পৃ ২৫৪।

‘‘বিনিময়’’ ও ‘‘শিল্প’’ কবিতা-দুটি শনাক্ত করতে পারিনি।

রবীন্দ্রনাথ ‘‘খসড়া’’ ও ‘‘দুই [এক] মুঠো’’র উপরে যে-প্রবন্ধ – রবীন্দ্রনাথ এই দুই কাব্য-অবলম্বনে লেখেন ‘‘নবযুগের কাব্য’’ (প্রবাসী, চৈত্র ১৩৪৬) : ‘‘আমি আনন্দ পেয়েছি অমিয়চন্দ্রের কাব্যে তাঁর স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে। এই স্বাতন্ত্র্য সংকীর্ণ পরিধি নিয়ে নয়। অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য আছে এর মধ্যে – বৃহৎ বিশ্বের মধ্যে আছে এর সঞ্চরণ।’’ (গ্রন্থপরিচয়, কবিতাসংগ্রহ ১, পৃ ৩০০।)

রবীন্দ্র-রচনাবলী – কবির চিঠিপত্র রচনাবলীতে সংকলিত হয় নি। বিশ্বভারতী ছিন্নপত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলী, ১৯ খন্ডে চিঠিপত্র, পথে ও পথের প্রান্তে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথের চিঠি/ পারুল দেবীকে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কল্যাণীয়েষু প্রশান্ত, মিত্র ও ঘোষ নিজের কথা, বাংলা একাডেমী রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র ও পাঠক সমাবেশ রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্রাবলী প্রকাশ করেন।

অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি বিশ্বভারতীর চিঠিপত্রের একাদশ খন্ডে সংকলিত; রবীন্দ্রনাথকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর চিঠি (নরেশ গুহ-সম্পাদিত) প্রকাশ করেছেন প্যাপিরাস কবির চিঠি কবিকে নামে (কলকাতা, ১৯৯৫)।

দিলীপ রায় (১৮৯৭-১৯৮০) – দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) পুত্র সংগীতজ্ঞ, ছান্দসিক দিলীপকুমার রায়। বিলেতে, জার্মানিতে, ইতালিতে সংগীত অধ্যায়ন করেন। আবদুল করিম, ফয়েজ খাঁ, পন্ডিত ভাতখন্ডে প্রমুখের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বসু, নেহরু, গান্ধী, রঁলা, রাসেল প্রমুখের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৫০ পন্ডিচেরীতে অরবিন্দ আশ্রমে বাস করেন। শেষ জীবনে পুনের শ্রীহরিকৃষ্ণ মন্দিরে সন্ন্যাস জীবনযাপনকালে তাঁর সাধনসঙ্গিনী ছিলেন শিষ্যা সাধিকা ইন্দিরা।

পত্র ৩৯

দিলীপবাবু – দিলীপকুমার গুপ্ত (ডি. কে. ১৯১৮-৭৭) সিগনেট প্রেসের প্রকাশক। কিছুকাল হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। অমিয় চক্রবর্তীর দূরযানী ও পারাপার এবং নরেশ গুহর দুরন্ত দুপুর গ্রন্থের প্রকাশক। মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের পারিপাট্যে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলি বাংলা প্রকাশনা জগতে পঞ্চাশের দশকে পাঠকদের সশ্রদ্ধ মনোযোগ লাভ করে। রুচিশীল প্রকাশনায় তাঁকে সহায়তা করতেন সত্যজিৎ রায়।

 

পত্র ৪০

‘দুই পারে’ – শেষ পর্যন্ত বইয়ের নাম হয় পারাপার।

পত্র ৪১

অহর্নিশ পত্রিকার নরেশ গুহ সংখ্যায় (২০০৯) সংকলিত এই পত্রের (২৫ এপ্রিল ১৯৫৩) টীকা লিখেছেন স্বয়ং নরেশ :

১৯৪৮-৪৯ সাল থেকে বছর সাতেক আমি সিগনেট প্রেস নামক বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রন্থসম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলাম। ঐ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবার পূর্বেই সিগনেট প্রেস ‘দূরযানী’ নামে অমিয় চক্রবর্তীর একটি নতুন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সিগনেট প্রেসে যোগ দেবার পরে আমার আগ্রহে দিলীপ গুপ্তরা অমিয় চক্রবর্তীর বহু নতুন কবিতা নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করতে সম্মত হন। কিন্তু আমেরিকা থেকে পরপর কবির অনেক চিঠি এলেও বইটির দ্রুত প্রকাশ সম্ভবপর করা হ’য়ে উঠেছিলো না। অমিয়বাবুর আকাঙ্ক্ষা ছিলো বইটির মলাট অাঁকবেন শিল্পী যামিনী রায়। যামিনী রায় নিজেও রাজী হয়েছিলেন। দিলীপ গুপ্ত মহাশয়ও যামিনী রায়কে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু সিগনেট প্রেস সংক্রান্ত সমস্ত শিল্পকর্ম বিষয়ে তাঁর একটি নিজস্ব ধারণা ছিল। এবং সেই সব কাজ সম্পর্কে তিনি পুরো নির্ভর করতেন সত্যজিৎ রায়ের উপরে। সে-বিষয়ে অন্য কারো পরামর্শ তিনি গ্রহণ করতেন না। প্রথমে বইয়ের আলাদা নাম স্বয়ং কবি প্রস্তাব করলেও দিলীপ গুপ্ত মহাশয়ের অভিপ্রায় অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত নাম হলো ‘পারাপার’। পরের বই ‘পালা-বদল’।

১ ‘চতুরঙ্গ’ সম্পাদক হুমায়ুন কবির মহাশয় তখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে আতাউর রহমান সাহেব আমাকে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেবার প্রস্তাব করেন। বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করি। বুদ্ধদেবও আমাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনো দুর্লঙ্ঘ বিশেষ কারণবশত শেষ পর্যন্ত কবির সাহেবের অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারিনি। ‘চতুরঙ্গে’র পুনরুজ্জীবনে আমি সহায়তা করলে অমিয় চক্রবর্তী নিজেও যে খুশী হন তার উল্লেখ আছে এই চিঠিতে।

 পত্র ৪২

কবি সম্মেলন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে ১৯৫৪-র ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কবিতা সম্মেলন। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা পাঠ করেন নরেশ। জীবনানন্দ দাশ নিজের কবিতা পাঠ করেছিলেন।

পত্র-রূপী সমালোচনা – নরেশ গুহর দুরন্ত দুপুর কাব্যের সমালোচনা ‘‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’’ (কবিতা, পৌষ ১৩৬০)।

নীলিমা দেবী – সিগনেট প্রেসের অন্যতম কর্ণধার।

 পত্র ৪৩

অহর্নিশ পত্রিকায় (২০০৯) প্রকাশকালে নরেশ গুহ এই পত্রের টাকায় লেখেন :

জগদ্বিখ্যাত সংগীতশাস্ত্রী চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক অ্যালবার্ট শোয়াইটজারের সঙ্গে গভীর সৌহার্দ্য ছিলো কবি অমিয় চক্রবর্তীর। ১৯৫২ সালে এই মনীষীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। … আফ্রিকার গহন অরণ্যে প্রধানত কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নির্মিত এই হাসপাতালে শোয়াইটজারের সঙ্গ পাওয়ার জন্য অমিয় চক্রবর্তী মাঝে-মাঝে আফ্রিকায় চলে যেতেন। এ চিঠি সেখান থেকে লেখা।

 পত্র-৪৪

‘‘পালা-বদল’’ – নাভানা থেকে ১৩৬২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত অমিয় চক্রবর্তীর নবম কাব্য; কবিতাসংগ্রহ ২-এ সংকলিত।