শেওড়াপাড়ায় ধসে যাওয়া রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের ফাঁকে পড়ে থাকা হাজারখানেক গার্মেন্ট শ্রমিকের লাশ এবং আহত বা জীবিতদের ভিড়ে সোমা আখতারকে (২১) আর খুঁজেই পাওয়া গেল না! কয়েক দফায় জুরাইন কবরস্থানে যেসব নাম-না-জানা গার্মেন্ট শ্রমিকের গলিত-অর্ধগলিত বা খ–ত লাশ কবর দিয়েছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম তাদের ভেতরে, যাদের বিকৃত চেহারাটা কিছুটা হলেও বোঝা যাচ্ছিল তখন, সেই দলেও সোমা আখতার নেই। আর যাদের চেহারা একেবারেই বোঝা যাচ্ছিল না, সেখানে মেয়েটাকে শনাক্ত করতে পারার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না! ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং স্বতঃপ্রণোদিত উদ্ধারকর্মীরা এদিকে যেসব রক্তমাখা, ধুলোমাখা ছিন্নভিন্ন হাত-পা, চূর্ণ-বিচূর্ণ খুলি, খসেপড়া আঙুল, দলাপাকানো চুল ইত্যাদি কুড়িয়ে এনেছিল ইট এবং লোহালক্কড়ের ফাঁদ থেকে সেগুলো দেখে তো আর সাদা চোখে মৃত কোনো মানুষকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়! সোমা আখতারকে কোথাও খুঁজে না-পেয়ে তার প্রেমিক মোহাম্মদ বুলবুল (৩৬) তখন নিরুপায় হয়ে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে ভেঙেপড়া একটা পিলারের খ–র ওপর এবং হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে অসহায় মানুষটা।

সন্ধে ছটা পার হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকার্যের পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে ঠিক তার আগমুহূর্তেই। শেষদিনে সকাল নটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত যে-কটা লাশের চেহারা বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অথবা পরিধেয় পোশাকপরিচ্ছদ বা অলংকার দেখে মৃত মানুষগুলোকে শনাক্ত করা গেছে শেষ পর্যন্ত তাদের সস্তা কাঠের বাক্সে ভরে সৎকার করতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্রন্দনরত স্বজনরা। আর সাদা চোখে যেসব লাশ শনাক্ত করাই সম্ভব হয়নি  সেগুলোকে কোনো একটা সময়ে বিভিন্ন মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। মনুষ্যবিপর্যয়ের এলাকা থেকে ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হচ্ছে উৎসুক জনতার ভিড়। এমন একটা বিষণ্ণ পরিস্থিতিকে এদিকে আরো বিষণ্ণ করে তুলেছে বুলবুলের মতো স্বজনহারা আরো শ-দুয়েক মানুষের আহাজারি। ধ্বংসাবশেষের ওপর বাঁপাশে দাঁড়িয়ে অথবা বসে আছে তারা আশায় বা হতাশায়। পিরোজপুর থেকে সোমা আখতারের পরিবারের কোনো সদস্য ঢাকা শহরে ছুটে এসেছে কিনা তা বুঝতে পারছে না বুলবুল, কেননা তাদের কাউকেই সে চেনে না। ক্রন্দনরত বুলবুলের প্রতিক্রিয়া জনগণকে জানানোর জন্য তার দিকে তিনটা টিভি ক্যামেরা তাক করে আছে তখন। তার সামনে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে সরাসরি সম্প্রচারে কী যেন সব বলছেন সাংবাদিকরা; তাকে নানান প্রশ্নটশ্নও করছেন।

কোনো এক এপ্রিলের শেষদিকের এক সকালে ধসে পড়ে রহমান টাওয়ার। তার কিছু আগে দক্ষিণ পীরেরবাগের মডার্ন টেইলর নামের দর্জির দোকান সবে খুলেছে সেই দোকানের মালিক মোহাম্মদ বুলবুল। টেইলর মাস্টার সে নিজেই। তিনজন কারিগরের ভেতরে দুজন কারিগর – আজিজ এবং বাদশা – চলেও এসেছে কাজে। যথারীতি চা খেয়ে দিন শুরু করেছিল তারা। খদ্দেরদের সালোয়ার-কামিজ কাটার জন্য মাপজোখ করছিল; কাপড়ের ওপরে হলুদ রঙের চক দিয়ে মার্কিং করছিল বুলবুল। তখনই ছুটতে ছুটতে দোকানে ঢুকেছিল তার দোকানের তিন নম্বর কারিগর সগির। উত্তেজিত কণ্ঠে সগির তাদের সকলকে বলেছিল, শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারের পেছনে যে বিশাল বিল্ডিং আছে, রহমান টাওয়ার যেটার নাম, একটু আগেই সেটা ধসে পড়েছে। একটা ফ্লোরের ওপর ভেঙে পড়েছে আরেকটা ফ্লোর। কোনো কোনো জায়গায় দুই ফ্লোরের মাঝে খানিকটা জেগে আছে ভেঙে যাওয়া পিলার। ফ্লোর আর পিলারের ফাঁকফোকর গলে যারা কষ্টেসৃষ্টে শরীরে কাটাছেঁড়া নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছে পয়লা ধাক্কাতেই তারা নাকি দাবি করছে, ধ্বংসাবশেষে আটকে গেছে হাজারখানেক জীবিত মানুষ আর অজস্র লাশ। বুলবুলদের সগির তখন জিজ্ঞাসা করেছিল, টেইলর মাস্টার বা তার দুজন কারিগর দোকানে বসে কি কোনো বিল্ডিং ভেঙে পড়ার কড়কড় আওয়াজ শুনতে পায়নি? শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারের পেছনটা তো আর দক্ষিণ পীরেরবাগ থেকে খুব একটা দূরে নয় – বড়জোর আধা কিলোমিটার!

হয়তোবা তাদের দর্জির দোকানের তিনটা পা-মেশিনের জোর আওয়াজের কারণেই সেই সকালে অস্বাভাবিক কোনো আওয়াজই পায়নি বুলবুলরা। সগির কারিগরের সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলার আগেই বুলবুলের বুক আতঙ্কে হিম হয়ে যায়, কেননা রহমান টাওয়ারের চারতলায় নিউ ফ্যাশন অ্যাপারেলে জুনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করে তার প্রেমিকা সোমা আখতার। আজ সকাল আটটার শিফট শুরু হওয়ার ঠিক আগেই সোমা তাকে ফোন করে বলেছিল, সন্ধেবেলায় যেন সবুজ রঙের উঁচু কলার আর ভি-গলার কামিজ এবং লাল সালোয়ারটা সেলাই করে রাখে বুলবুল। সামনের মাসে সোমার একজন মামাতো বোনের বিয়ে আছে পটুয়াখালীতে। সেই বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্যই বানাতে হবে এমন বাহারি একটা পোশাক। ফ্যাক্টরির কাজ শেষ করে রাত সাড়ে আটটার দিকে পাইকপাড়ার মেসে ফেরার পথে সালোয়ার-কামিজটা ডেলিভারি নিয়ে যাবে সোমা। তাছাড়া বউয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসছে বুধবার – যেদিন সোমার ছুটি থাকার কথা, মানে যদি শিপমেন্টের চাপটাপ না-থাকে আর কি, সেদিন কীভাবে বুলবুল সোমাকে নিয়ে ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতে যাবে মিরপুরের সনি সিনেমা হলে, তা নিয়ে সোমা তাকে জুতসই একটা পরিকল্পনা করতেও অনুরোধ করেছিল।

তারপর সোমা ফোনেই বুলবুলকে জানিয়েছিল, দুর্বল রহমান টাওয়ারের ফ্লোরগুলোর পিলার এবং দেয়ালের নানা জায়গায় প্রায় এক ইঞ্চি গভীর যেসব বিশাল ফাটল ছিল সেগুলো আরো গভীর হয়েছে, আকারে আরো বিসত্মৃত হয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত শ্রমিকরা অভিযোগ জানিয়ে আসছে কদিন ধরেই। কিন্তু রহমান টাওয়ারের মালিক মেরামত করছে না ফাটলগুলো; বলছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যেই। কাজেই প্রোডাকশনের কাজ চালাতে আর কোনো অসুবিধে হবে না। বিল্ডিংটার ভগ্নদশা নিয়ে কোনো একটা টিভি চ্যানেলে রিপোর্টও হয়েছে অতিসম্প্রতি। তাই জীবনের ঝুঁকির কথা ভেবে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর শ্রমিকরা আর কাজে যোগ দিতে চায়নি পরদিন। ফ্যাক্টরিগুলোর মালিকরা তখন শ্রমিকদের শাসিয়েছে এই বলে যে, পরদিন কাজে না-গেলে কেটে নেওয়া হবে তাদের সকলের পুরো মাসের বেতন। এ কারণে আতঙ্ক নিয়েই পোশাক তৈরির কাজে যেতে হচ্ছে সোমা আখতারসহ বারোটা ফ্যাক্টরির হাজারখানেক শ্রমিককে। কাজে তাদের যেতেই হবে কেননা বিদেশে রফতানির জন্য বিভিন্ন শিফটে আজ পোশাক-আশাক তৈরি চলবে জোরদার। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সব ফার্মকেই শিপমেন্ট ধরতে হবে। আতঙ্কিত সোমা বুলবুলকে বলেছিল, কাজে যেতে সত্যিই ভীষণ ভয় করছে তার। কখন না আবার দুর্বল বিল্ডিংটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে! তাহলে তো জানটা আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে! বুলবুল মনে করতে পারে, এখন থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টা আগের বাক্যালাপ এগুলো! সেই সোমা আখতার কী অবস্থায় আছে এখন? ধ্বংসাবশেষ থেকে আগেভাগেই কি বের হয়ে যেতে পেরেছে সে? নাকি সে আটকে পড়েছে ধসেপড়া বিল্ডিংটার ইট-পাথর আর লোহালক্কড়ের ফাঁদে কোথাও? মরেটরে যায়নি তো আবার মেয়েটা?

কয়েক মুহূর্তের এমনসব ভাবনা আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল, উত্তেজিত করে ফেলেছিল টেইলর মাস্টার বুলবুলকে। তার হেল্পার ভুলুর হাতে দোকান খোলা রাখার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পীরেরবাগের জটিল অলিগলি ধরে এক দৌড়ে কাঁচাবাজারের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে আর তার তিনজন কারিগর। সবিস্ময়ে তারা দেখতে পেয়েছিল বিভিন্ন কোণে ভেঙে পড়ে আছে রহমান টাওয়ার, আর উদ্যোগী মানুষেরা ধ্বংসাবশেষের বিভিন্ন ফাঁকফোকর গলে তখন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ভেতরের দিকে, গভীর অন্ধকারে, যদি সেখানে দেখা যায় জীবিত আর মৃতদের নিশানা, উদ্ধার করা যায় তাদের! সেই দলে, চেনা-অচেনা মানুষের ভেতরে রয়েছে দক্ষিণ পীরেরবাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্ভেয়ার আইনুদ্দিন, রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী অলি মিয়া, তোরাব উকিল, রজব দারোগা, ইলেকট্রিশিয়ান বাবু, রিকশা গ্যারেজের মালিক মোসলেম মিয়া, রিকশাওয়ালা রহমত উল্লাহ প্রমুখ। এমন একটা অবস্থায় আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে বুলবুল : হায় আল্লাহ্! এইয়া কী হইলে? বিহবল মানুষজনের হাঁকডাকের ভেতরে বুলবুলের গলার আওয়াজ খুব বেশি দূরে যায় না অবশ্য। উত্তেজনা কমিয়ে নিজের মাথা ঠিকঠাক কাজ করানোর জন্য অভ্যাসবশে সে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটটা কাঁপতে থাকে তার ডান হাতের তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁকে। সেই মুহূর্তে কী করা উচিত তা সে ভাবতে সচেষ্ট হয়। তখন সকাল সোয়া দশটার মতো বাজে। সকাল আটটা পঞ্চাশের দিকে ভেঙে পড়েছে বিশাল বিল্ডিংটা। রাস্তার জ্যাম ঠেলে শত চেষ্টাতেও তখনো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা তাদের ছোট-বড় লাল রঙের ট্রাকগুলো নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকার্যও শুরু হয়নি তাই। সাংবাদিকদের কেউ কেউ আসতে শুরু করেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছোট আকারের ট্রাকগুলো  শেওড়াপাড়ার সরু অলিগলি পেঁচিয়ে গভীরে ঢুকেছিল বেশ কায়দা করেই, দুর্ঘটনার ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরেই। তাদের বড় বড় ট্রাক ঘটনাস্থল পর্যন্ত যেতেই পারেনি! কিংকর্তব্যবিমূঢ় বুলবুল শুনতে পেয়েছিল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা বলাবলি করছে : এটাকে বলে প্যানকেক কলাপস – প্যানকেকের স্তরগুলোর মতো করে একটার ওপরে আরেকটা তলা ধসে পড়েছে নয়তলা বিল্ডিংটার। তলাগুলোর ছাদ আর মেঝের মাঝখানের দেয়াল এবং পিলার সেই চাপে ভেঙে পড়েছে  – কোথাও পুরোপুরি, কোথাও বৃহদাংশে। এভাবেই বিল্ডিং ভেঙে পড়ে ভূমিকম্পের সময়। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্পে ঠিক এই কায়দায় ধসে পড়েছিল সব বিল্ডিং। এছাড়া সে এ-ও মনে করতে পারে, নানা মানুষের হাঁকডাক আর কথোপকথন শুনে কিছু পরে মোটামুটি একটা সারাংশ টানতে পেরেছিল দক্ষিণ পীরেরবাগের বর্ষীয়ান আইনুদ্দিন, তোরাব উকিল এবং অলি মিয়া : নকশা অনুযায়ী বিল্ডিংটা ছয়তলা বানানো হয়েছিল পয়লাতে। তারপর রাজউকের অনুমতি ছাড়াই বিল্ডিংটার ওপরে তোলা হয়েছিল আরো তিনটা ফ্লোর। তাই স্বভাবতই দুর্বল ছিল বিল্ডিংটার কাঠামো। মস্তবড় বিল্ডিংটায় স্থাপন করা হয়েছিল ছোট-বড় মিলিয়ে মোট বারোটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। দুর্ঘটনার দিনে       যথারীতি কাজ শুরু হলো সকাল আটটায়। বিদ্যুৎ চলে গেল সকাল আটটা পঁয়তালিস্নশের দিকে। সময়মতো শিপমেন্ট ধরতে গেলে তো আর কাজ ফেলে রাখা যায় না! কাজেই প্রথামতো চালু করা হয়েছিল গ্রাউন্ডফ্লোরের ছটা শক্তিশালী জেনারেটর। জেনারেটরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে জোরে চলতে শুরু করল ফ্লোরগুলোর হালকা ও শক্তিশালী সব মেশিন। তার মিনিট পাঁচেক পরেই প্রচ- শব্দে ভাঁজে ভাঁজে ভেঙে পড়েছিল পুরো বিল্ডিংটা হুড়মুড় করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নয়তলার ইট-পাথর এবং লোহালক্কড়ের খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে আটকে গিয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার অসহায় শ্রমিক।

আড়াই হাজার মানুষ ঠাসাঠাসি করে কাজ করছিল এই একটা বিল্ডিংয়ে? অলি মিয়া তখন বিস্ময় প্রকাশ করেছিল : শ্রমিকদের সংখ্যাটা যে এত বেশি হবে তা তো সে কখনো ভাবেনি, বিভিন্ন আলাপের সূত্রে কারো কাছ থেকে সে এসব শোনেওনি কখনো! সে কেবল দেখেছে যে-মহল্লার ভেতরের রাস্তা দিয়ে রহমান টাওয়ারের দিকে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দলবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছে নারীশ্রমিকেরা, তারা বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে কাজে ঢুকছে, কাজশেষে বেরোচ্ছে আবার দলবেঁধেই। এ বাদে আর কিছুই সে লক্ষ করার প্রয়োজন মনে করেনি কখনো। শ্রমিকদের কাউকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনেও না! তার কথায় সায় দিয়েছিল রজব দারোগা এবং তোরাব উকিল দুজনেই। তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একদল সুবেশী ছাত্রের ভেতর থেকে একজন তখন তাদের জানিয়েছিল, এসব শ্রমিকের ভেতরে কাজের ধরনের ভাগ আছে, যেমন, তারা কেউ সিনিয়র অপারেটর, কেউ জুনিয়র অপারেটর, কেউ শিক্ষানবিশ, কেউ সুপারভাইজার, কেউ কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, কেউ কাটিংমাস্টার, কেউ আইরোনার, কেউ ফোল্ডার, কেউবা পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি। এই কর্মবিভাজন সম্পর্কে নিজের দর্জির দোকানের খদ্দেরদের কাছ থেকে বুলবুলের কিছুটা ধারণা আগেই জন্মেছিল বটে। কিন্তু সে জানত না, মৃত্যুপুরীটায় বসে এসব শ্রমিক তৈরি করছিল কমপক্ষে এগারোটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বেসিক টি-শার্ট, শার্ট, ডেনিম জিন্স প্যান্ট এবং সোয়েটার। এগারোটা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড? এতগুলো? তখন অবাক হয়েছিল নবীন ইলেকট্রিশিয়ান বাবু, কেননা সে লক্ষ করেছিল যে, মিরপুর দশ বা কাজিপাড়ার ফুটপাথের পোশাকের দোকানগুলোতে কেবল দু-তিনটা ব্র্যান্ডের বাতিল পোশাক বিক্রি হয়। সেই দু-তিনটা ব্র্যান্ডের বাইরেও যে আরো ব্র্যান্ড থাকতে পারে তা বাবুর ধারণায় ছিল না।

আশপাশের মানুষজনের এসব নানা কথা ঠিকই কানে যাচ্ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় টেইলর মাস্টার বুলবুলের। কিন্তু তখন কোনো আলোচনার ভেতরে ঢোকার মতো সুস্থির মানসিক অবস্থা তার ছিল না। ততক্ষণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের সঙ্গে উদ্ধার-তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা এবং অজস্র সাধারণ মানুষ। আর তাদের সকলের সঙ্গে কখন যে বুলবুল নিজেও ভেসে গেছে মানুষ উদ্ধারের কাজে তা সে টেরও পায়নি! তারপর সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা এক্সক্যাভেটর দিয়ে সরিয়েছে ধসেপড়া ছাদ, দেয়াল আর পিলারের টুকরোগুলো। সরকারি কর্মীবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ মিলে কখনো হাতুড়ি, শাবল আর গাঁইতি দিয়ে জেগে থাকা দেয়াল এবং ছাদের অংশবিশেষ ভেঙেছে; ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটেছে ধ্বংসাবশেষে ডুবে থাকা লোহালক্কড়; মেঝে ড্রিল করেছে কখনো ড্রিল মেশিন দিয়ে। ধসেপড়া মেঝেতে গর্ত করে সুড়ঙ্গ বানিয়ে নিচের তলাগুলোয় গিয়ে ধ্বংসাবশেষের ফাঁকফোকর থেকে তারা উদ্ধার করেছে রক্তাক্ত  জীবিতদের; পস্নাস্টিক ব্যাগে অথবা স্রেফ কাপড়ে ভরে ওপরে তুলে দিয়েছে ক্ষত-বিক্ষত, গলিত সব লাশ; কখনো কুড়িয়ে এনেছে লাশের খ–ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ; স্ট্রেচারে করে লাশ টেনে পাশের বিল্ডিংয়ে তারা নিয়ে গেছে কখনো; কখনো দড়ি বেয়ে সুড়ঙ্গে নেমে ধ্বংসাবশেষে আটকে থাকা আহতদের জন্য বয়ে নিয়ে গেছে পানির বোতল অথবা অক্সিজেন সিলিন্ডার। এসব নানা উদ্ধার-তৎপরতায় অংশ নিয়েছে বুলবুল নিজেও, যদিও রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে জীবিত এবং মৃতদের উদ্ধারের কাজে নামার পেছনে তার প্রাথমিক তাগিদ ছিল তার প্রেমিকা সোমার হদিস খুঁজে বের করা।

উদ্ধারপর্ব শুরু হওয়ার পরে মানুষের খ–বিখ- শরীর প্রত্যক্ষ করে প্রচ- বিবমিষা জেগেছে বুলবুলের। বারবার বমির দমক এসেছে লাশপচা গন্ধে। পরে নিজেকে একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি তার! উদ্ধারকাজের উন্মাদনায় সয়ে গেছে সব। তখন, সোমার হদিসের অপেক্ষায় সদাসজাগ থাকলেও, হেনা বানু, রকিবুল আলম, খোদেজা খাতুন, সালমা বেগম, আকবর হোসেন, রিক্তা আখতার অথবা করিমন বিবি এবং এমন অনেক নাম-না-জানা শ্রমিকের – তারা মৃত হোক বা আহতই হোক না কেন – আর দূরের মানুষ বলে মনে হয়নি তার কাছে! তখন কেবল একটাই উদ্দেশ্য ছিল তার : যেভাবেই হোক না কেন, মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে, তাদের লাশ পৌঁছে দিতে হবে স্বজনদের হাতে।

এভাবে কখন যে কেটে গেছে টাল-মাতাল কুড়ি-কুড়িটা দিন তা আর বলতে পারবে না কেউই! তারপর সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে উদ্ধারপর্ব। সরকার পরিচালিত কর্মপ্রচেষ্টায় সংশিস্নষ্ট সংস্থাগুলো এবং সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইটপাথর আর লোহালক্কড়ের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করেছে হাজার দেড়েক জীবিত শ্রমিককে; খুঁজে বের করেছে প্রায় নয়শো শ্রমিকের লাশ। উদ্ধারের পরে দেখা গেছে, এসব জীবিত শ্রমিকের কেউ কেউ ভয়ানকভাবে আহত হয়েছিল, যাদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে অথবা কেটে ফেলতে হয়েছে তাদের অকেজো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। যখন উদ্ধার-তৎপরতার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় তখন পর্যন্ত, অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও, সোমা আখতারসহ পঁচানববইজন মানুষের আর কোনো সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হবে কিনা তা অবশ্য সেই মুহূর্তে সঠিক করে কেউ আর বলতে পারছিল না।

উদ্ধারপর্ব বন্ধ ঘোষণার পরমুহূর্তেই বুলবুলের মনে হয়েছে : তার প্রেমিকা সোমাকে তো আর খুঁজেই পাওয়া গেল না! তবে কি সোমার খ–বিখ- দেহ মিশে গেছে; হারিয়ে গেছে ইটপাথর আর লোহালক্কড়ের ফাঁকে কোথাও? এমন ভাবনার পরেই মাথায় হাত দিয়ে সে বসে পড়ে ভেঙে যাওয়া একটা পিলারের ওপর এবং সশব্দে কেঁদে ওঠে। কিন্তু অসহায়ত্ব বা অন্তর্গত বেদনায় তো মানুষকে কেবল কাঁদলেই চলে না, তাকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামালও দিতে হয়! তাই ভাঙা পিলারটা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। ধ্বংসাবশেষ থেকে কসরত করে নিচে নেমে গিয়ে সে মুখোমুখি দাঁড়ায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তার। কর্মকর্তাকে সে জানায়, নিউ ফ্যাশন অ্যাপারেলের জুনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর সোমা আখতারকে রহমান টাওয়ারের জঞ্জালের ভেতরে কোথাও এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি! উদ্ধারপর্ব কি আর কটা দিন চালু রাখা সম্ভব নয়? পাইকপাড়ার যে-মেসে সোমা থাকে, সেখানকার একজন বোর্ডার পরী বেগম নামে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক, তাকে জানিয়েছে যে, সোমা পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার চিড়াপাড়ায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়নি। ঢাকা শহরে সোমার যেসব আত্মীয়স্বজন রয়েছে, তারাও কেউই জানে না সোমার সঠিক খবরাখবর। তাই স্বপক্ষে একটা যুক্তি দাঁড় করাতে চায় বুলবুল : এমন তো হতেই পারে, রহমান টাওয়ারের কোনো তলার গভীরে কোথাও আটকা পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সোমা আখতার! সেখানকার ধ্বংসাবশেষের জ্যামিতি হয়তো এতই জটিল যে, সেখানে উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছতেই পারেনি! ধ্বংসসত্মূপের ভেতরে আঁটোসাঁটো কোনো স্থানে শুয়ে বা বসে সোমার মতো নিঃখোঁজ মানুষেরা হয়তো নিজেদের নিসেত্মজ শরীরের ঘাম বা প্রস্রাব অথবা নিজের বা কোনো মৃতের শরীরের রক্ত অথবা শেওলা ধরা দেয়াল চুঁইয়ে-পড়া বিন্দু বিন্দু পানি খেয়ে চলেছে জীবন রক্ষা করার জন্য!

বুলবুলের আকুলতা স্পর্শ করার কারণে বিষাদের ছায়া নামে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তার মুখম-লে। বুলবুলকে সে যা বলে তার সারাংশটা এমন : সোমা আখতারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না – নিশ্চয় এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা! এমন প্রায় চুরানববইজনের খবর মিলছে না কোনো! কী আর করা যাবে এখন! বুলবুল তখন আলোচ্য কর্মকর্তাকে বারবার অনুনয় করে বলতে থাকে, সোমার বন্ধু পরী তাকে নিশ্চিত করেছে যে শেষ এপ্রিলের সেই সকালে কাজে যাওয়ার জন্য যথারীতি সোমা তাদের মেস থেকে বের হয়েছিল একদল নারী-শ্রমিকের সঙ্গে। তার হাতে রুপালি রঙের একটা টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। সোমা যে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে সেখানকার একজন দারোয়ানও দায়িত্ব নিয়েই বুলবুলকে বলেছে, সে নিজের চোখে দেখেছে, সকাল সাতটা পঁয়তালিস্নশের দিকে হাজিরা খাতায় সই করে হন্তদন্ত হয়ে প্রোডাকশন ফ্লোরে ঢুকেছিল সোমা। এরপর কি আর কোনো কথা বাকি থাকে? ধসেপড়া বিল্ডিংটার কোনো অন্ধকূপে নিশ্চয়ই আটকা পড়ে আছে সোমা!

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা তখন উত্তর দেয় : রহমান টাওয়ারের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজে ঢোকার সময় নিশ্চয় কোনো না কোনো রেজিস্টারে সোমার উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই রেজিস্টারটা দেখতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যেত ব্যাপারটা সম্পর্কে। সেইসঙ্গে কর্মকর্তা এমনটাও বলে যে, ধসেপড়া বিল্ডিংটার জঞ্জালের ভেতরে বিলীন হয়ে গেছে সবকিছুই – সিঙ্গার বা উশা বা জুকি কোম্পানির সেলাই মেশিন, টেবিল-চেয়ার, এক্সস্ট ফ্যান, এয়ারকুলার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সুতার রিল, কাপড়ের বান্ডিল,
টি-শার্ট, শার্ট, সোয়েটার, কার্টন, শ্রমিকদের মাথার ক্যাপ, মাস্ক, টিফিন ক্যারিয়ার, মোবাইল ফোন ইত্যাদিসহ ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং কাগজপত্র। কাজেই সেক্ষেত্রে সোমা আখতারের হাজিরার প্রমাণ খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। তবে এবার নিখোঁজ মানুষের তালিকায় সোমা আখতারের নাম যোগ করা যেতে পারে। তাতে হয়তো পরিস্থিতির কোনো ইতরভেদ হবে না কোনো, রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের তালিকাটা আরেকটু দীর্ঘ হবে – এই যা! সবচেয়ে ভালো হয়, সোমা আখতারের আত্মীয়স্বজন যদি সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় আবারো তার পাত্তা লাগায়। এমন তো হতেই পারে, সেদিন সকালে রুপালি রঙের টিফিন ক্যারিয়ার হাতে মেস থেকে বের হলেও কাজে না-গিয়ে সোমা চলে গেছে অন্য কোথাও! হয়তোবা সে গাবতলী বা মহাখালী অথবা সায়েদাবাদ থেকে বাস ধরে দূরে কোথাও চলে গেছে। হতেই পারে এমনটা! মানুষ তো নানা কারণে নিজে থেকেও মিসিং হয়ে যায়! আচ্ছা! ভালো কথা – সোমা আখতারের স্বামী আছে নাকি? নাহ্! সোমার কোনো স্বামী নেই। তিন বছর আগেই তার স্বামী তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে অন্য নারীর সাথে। গুড! সন্তান? হ্যাঁ! চার বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে বটে। পিরোজপুরে সোমার মার কাছে থাকে সেই শিশু। সোমার কোনো প্রেমিকট্রেমিক আছে নাকি? বুলবুল সোজা বলে দেয় যে, সে তা জানে না! নিজের কথাটা এক্ষেত্রে সে আর উলেস্নখ করে না অস্বস্তির কারণেই। গোপন সম্পর্ক নিয়ে তো মানুষের উৎসাহের কোনো অন্ত থাকে না! শেষে দেখা গেল, এ-কান ও-কান থেকে শুনে শুনে সাংবাদিকরা সাক্ষাৎকার নিতে ছেঁকে ধরেছে তাকে! সংবাদপত্রের কাটতি বাড়ানোর জন্য তো এমনসব গরম খবরেরই প্রয়োজন! তারপর সে-খবর পৌঁছে গেল তার বউয়ের কানে! সেই জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো মনের অবস্থা এই মুহূর্তে তার নেই।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সেই কর্মকর্তার সহায়তায় নিখোঁজদের তালিকায় সোমা আখতারের নাম তুলতে গেলে দেখা যায়, তালিকার সব নিচে, পঁচানববইতম সিরিয়ালে, ইতোমধ্যেই লেখা হয়েছে সোমা আখতারের নাম। সোমার পরিবারের মানুষজন  কেউ এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকবে। বুলবুলের কাছে এটাই তখন সুখের বিষয় : কেবল সে-ই নয় – আরো কেউ কেউ মনে করছে, রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের ভেতরে হয়তোবা হারিয়েই গেছে সোমা আখতার নামে একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ। তার ধারণা হয়, উদ্ধারকার্য যেহেতু বন্ধ হয়ে গেল কাজেই সোমা আখতারসহ নিখোঁজ পঁচানববইজনের আর কোনো খবর হয়তো মিলবেই না! এমন তো হবেই যে, আর কদিন পরে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে রহমান টাওয়ারের ভেঙেপড়া ইটপাথর আর লোহালক্কড়। ধসেপড়া একটা ইমারতের চিহ্ন কি চোখের সামনে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখবে কেউ? তারপর এক্সক্যাভেটর দিয়ে দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে সমস্ত জঞ্জাল। ট্রাকে ভরে জঞ্জাল নিয়ে গাদা করা হবে শহরের বাইরে দূরে কোথাও, লোকচক্ষুর অন্তরালে, হয়তোবা কোনো খালের বুকে। সেই জঞ্জালের গাদায় ইটপাথর আর লোহালক্কড়ের খ–র মাঝে হয়তো তখন জেগে থাকবে নিখোঁজদের শরীরের হাড্ডিগুড্ডি, তাদের পরিধানের ছিন্নভিন্ন পোশাকের টুকরো – এসব। এমন একটা ছবি মনে চলে আসাতে ভয়ংকর অস্বস্তিতে শিউরে ওঠে বুলবুল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাকে তাই আর দু-তিনদিন উদ্ধারকার্য চালু রাখার জন্য আবারো অনুরোধ করে সে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা তখন তাকে উত্তর দেয় : তিন সপ্তাহ ধরে সরকার তার সীমিত সম্পদ নিয়োজিত করে হাজার দেড়েক মানুষের মূল্যবান জীবন বাঁচিয়েছে; উদ্ধার করেছে প্রায় নয়শো মানুষের লাশ। এই সদিচ্ছা আর কর্মতৎপরতার জন্য নিশ্চয় সরকার প্রশংসার দাবিদার! আর এমন তো নয় যে, খামোকাই উদ্ধারকাজের ছেদ টানা হচ্ছে! আসলে যেটা হয়েছে, বিল্ডিংটার নিচের দুটো তলার উত্তরের জানালাগুলো দিয়ে পয়লাতেই বাইরে লাফিয়ে পড়েছে অনেকেই। বেঁচেও গেছে তারা। তা কি আপনারা দেখেননি? আর সুড়ঙ্গ দিয়ে ওপরের তলাগুলোর কোনায় কোনায় আমরা গেছি, আপনারাও কষ্ট করেছেন আমাদের সঙ্গে। সেখানে কি কোনো জীবিত মানুষের সাড়াশব্দ পেয়েছেন আপনারা?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তার কথা না-মেনে নিয়ে পারে না বুলবুল। কিন্তু তার মন মানে না কোনো এক নাজুক জায়গায়।

 

দুই

রহমান টাওয়ারে যে শ-দুয়েক সাধারণ মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উদ্ধারকার্যে অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকের সঙ্গেই কাজের সূত্রে আত্মিক নৈকট্য তৈরি হয়েছে মোহাম্মদ বুলবুলের। তাদের মধ্যে কচুক্ষেতের রিকশাওয়ালা সোবহান, তালতলার ক্ষুদ্র বালু-সিমেন্ট ব্যবসায়ী আজম, মিরপুর সাড়ে এগারোর চা-দোকানদার বাবলু, বেসরকারি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আতাহার এবং সনি সিনেমা হল এলাকার চটপটি-বিক্রেতা শরিফ মিয়ার নাম বলতেই হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা শেষ হলে বুলবুল দেখতে পায়, ধ্বংসসত্মূপের নিচের দিকে কোনো একটা দেয়ালের অবশেষের ওপরে বসে গম্ভীর মুখে চা খাচ্ছে সোবহান, আজম, বাবলু আর আতাহার। বুলবুলকে দেখে ঠোঁট থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে নিয়ে বলে ওঠে আজম, ‘সোমার কোনো খবর পাইছেননি ভাইজান? অফিসারেরা বলছেনি কিছু?’

আজমের প্রশ্নের কোনো উত্তর না-দিয়ে ভেঙেপড়া ছাদের একটা খ–র ওপর মাথা নিচু করে বসে পড়ে বুলবুল। তারপর সে সোবহানের হাত থেকে জ্বলন্ত বিড়িটা নিয়ে টানতে থাকে চুপচাপ। তার চোখ থেকে নীরবে অশ্রম্ন গড়ায় তখন। তার কাঁধে মমতায় হাত রেখে সোবহান সান্তবনা দিতে চায় এই বলে, ‘মিয়াভাই! বাড়িত যান গা। আমরাও যাইতেছি। আর তো কিছু করণের নাই অহন!’

সোবহানের দিকে অশ্রম্নসিক্ত চোখে তাকিয়ে উচ্চারণ করে বুলবুল, ‘লাশটাশ পাইলেও তো কাম হইতে! মনডারে বুঝাইতে পারতাম মুই!’

সহযোদ্ধারা কোনো উত্তর না দিয়ে তখন চুপ করে চা খেয়ে চলে।

কখন যে সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে তা আর টের পায়নি মোহাম্মদ বুলবুল। আশপাশের বিল্ডিংগুলো থেকে আলো এসে রহমান টাওয়ারের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধ্বংসসত্মূপের কোথাও কোথাও ঠিকরে পড়ছে। দেখতে ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছে জায়গাটাকে এখন।  যেন এখানে, ধ্বংসসত্মূপ জুড়ে, ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য মৃত শ্রমিকের আত্মা, আহত শ্রমিকদের আর্তি এবং নিখোঁজ সব শ্রমিকের অসহায় স্বজনদের আহাজারি, প্রতীক্ষা।

কুড়ি দিন ধরে আহত মানুষ এবং মৃতদের নিয়ে টানাটানিশেষে তখন ক্লান্তিতে ভারি হয়ে আসে বুলবুলের চোখ। উদ্ধার-তৎপরতায় ব্যস্ত থাকার সময়ে দক্ষিণ পীরেরবাগের আমতলায় তার ভাড়া বাসায় সে এক রাতের জন্যও থাকার সুযোগ বের করতে পারেনি। কাজেই তাকে টানতে থাকে বিছানার সম্ভাব্য আরাম, ওম। এখন থেকে দশ-বারো দিন মতো আগে এক বিকেলে সে কেবল তার বাসায় গিয়েছিল হাতখরচের জন্য কিছু টাকা আনতে। কলা হোক বা বিস্কিট হোক অথবা একটু চা – কাজের তোড়ে খেতে তো হয়েছে এমন একটা কিছু! তাছাড়া স্নায়বিক উত্তেজনার ঘোরে সিগারেট টানাটাও বেড়ে গিয়েছিল তখন। উপরন্তু সে তার দুই সহযোদ্ধা সোবহান আর বাবলুর খাইখরচ টেনেছে সংগত কারণেই। উদ্ধার-তৎপরতায়
অংশ নেওয়ার ফলে একেবারেই রিকশা টানতে পারেনি সোবহান, চা-বিড়ির দোকানদার বাবলু তার দোকান খুলতে পারেনি একদিনও। রোজাগারপাতি ছাড়া তাদের পরিবার কীভাবে ব্যয় নির্বাহ করেছে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তা তারা জানে না, জানতে সময়ও পায়নি। উদ্ধার-তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে সেদিন রাত আটটার দিকে বিভিন্ন দিকে ছিটকে যায় সেই সোবহান আর বাবলুসহ বেশিরভাগ মানুষ, যারা নিজে থেকে অংশ নিয়েছিল উদ্ধারকাজে। তবে ভেঙেপড়া ছাদের খ–র ওপরে চুপ করে বসেই থাকে বুলবুল। রহমান টাওয়ারের ধ্বংসসত্মূপের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। অনেকক্ষণ ধরে সোমা আখতারের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাত নটার পরপর সে বাসায় ফিরে যায়। বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের সংকীর্ণ ঘরটার সেমিডাবল খাটে সটান শুয়ে পড়ে সে। নির্ঘুম কুড়িদিনের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে চোখ ছেপে ঘুম আসে তার এবং পেটে ক্ষক্ষধে নিয়েই সে ঘুমিয়েও যায় এক নিমেষেই। তার স্ত্রী রোজিনা বা তাদের আত্মজা ক্লাস থ্রিতে পড়া প্রমির সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে না সে।

বুলবুলের শরীর ঘুম চায় ঠিকই কিন্তু তার মস্তিষ্ক ঘুমায় না কিছুতেই। তার চোখে ভাসতে থাকে রহমান টাওয়ারের ধবংসসত্মূপ, একগাদা লাশ, স্ট্রেচার, এক্সক্যাভেটার মেশিন, সুড়ঙ্গ, অন্ধকার, পানির বোতল, উদ্ধারকর্মীদের হলুদ-কমলা-লাল হেলমেট, মানুষের বিচ্ছিন্ন হাত-পা-মাথা, হাতুড়ি, শাবল, সেলাই মেশিন ইত্যাদির খ–খ- সব ছবি – কোনোটা স্পষ্ট, কোনোটা অস্পষ্ট। মাঝে মাঝে তন্দ্রার ভেতরে কোথাও কোনো অতল থেকে জেগে ওঠে, আবার মিলিয়েও যায় নিখোঁজ সোমা আখতারের হাসি-হাসি মুখটা। এভাবে ঘণ্টাদুয়েক ঝিমানোর পরে তার আশপাশে কোথাও সজোরে একটা আওয়াজ উঠলে সে চোখ মেলে তাকায়। সে দেখতে পায়, তার  স্ত্রী রোজিনা কোনো কারণে দক্ষিণ দেয়ালের সঙ্গে বসানো রং চটে যাওয়া নীল রঙের স্টিলের আলমারিটা খুলছে। ব্যাপারটা যেটা হয়েছে : ডানদিকের পাল্লাটা খোলার সময় আলমারির ফ্রেমের সঙ্গে পাল্লাটা ঘষা খায় প্রতিবার। বিদ্ঘুটে একটা আওয়াজ ওঠে তখন। এই মুহূর্তে তাই বিরক্ত হয় সে এবং বিরক্ত হলেও ভয়ংকর ক্লান্তিতে ফের তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আধোঘুমের ভেতরে সে  যেন শুনতে পায়, তার কানের কাছে কেউ একজন জোর চিৎকার দিয়ে উঠছে : মরে নাই, ভাই! মরে নাই! দেখতাছেন না, রাবিশের নিচ থিকা হাতের আঙুল কয়ডা নড়তাছে! শাবলডা আনেন জলদি কইরা! রাবিশ সরাইতে হইব অহনই! আর সঙ্গে সঙ্গেই স্নায়বিক উত্তেজনায় শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে বুলবুল। বিছানার ওপরে তার চারপাশে সে শাবল খুঁজতে শুরু করে দেয় এবং সে অনির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ করে বলতে থাকে, ‘কোন হালার পো হালা মোর শাবলডা লই গেলে! কী যন্ত্রণা!’

বুলবুলের চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে তার স্ত্রী রোজিনা এবং তাদের মেয়ে প্রমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। বিছানায় বুলবুলের পাশে বসে তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে রোজিনা। ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রমি। তারপর বুলবুলের খোলা বুক আর বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে রোজিনা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘খারাপ স্বপ্ন দেখছ তুমি?’

রোজিনার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বুলবুল। জটিল এসব ব্যাপার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ছোট্ট প্রমি। অনেক জিজ্ঞাস্য নিয়ে ভুরু কুঁচকে পিতা-মাতার মুখের দিকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। অন্ততপক্ষে সে এটুকু বুঝে নেয় যে, এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আসলে বড়দের বিষয়।

শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি কাটানোর জন্য এবার গোসলে ঢোকে ঘর্মাক্ত বুলবুল। বালতি থেকে কয়েক মগ পানি মাথায় ঢালার পরে তার মনে হয়, মানুষের মৃত্যু এবং ক্ষয়জনিত যে-বিবমিষা তার ভেতরে দেখা দিয়েছে তা হয়তো মগের পর মগ পানি শরীরে ঢাললে চলেও যেতে পারে! সেইমতো কল খুলে রেখে বালতি থেকে সে মাথায়-কাঁধে মগ দিয়ে পানি ঢালতে থাকে ক্রমাগত। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টামতো গোসল করার পরে সে পাশের ঘরের খাবার টেবিলে খেতে বসে। রাত তখন প্রায় একটা। টেবিলে বসে প্রমি পড়ছে তখন। এবং কী অদ্ভুত, ভাতের সঙ্গে মলাঢেলা মাছ আর আলুর ঝোল খেতে খেতে বুলবুলের মনে হচ্ছে, তার পেস্নটে যেন নড়াচড়া করছে মানুষের হাত-পায়ের বিচ্ছিন্ন আঙুল, দাঁত, খুলি থেকে
ভেঙে-যাওয়া অস্থি, দলা পাকানো রক্তমাখা চুল ইত্যাদি। তখন আর কিচ্ছুই খেতে পারে না সে। পেটে ক্ষিধে নিয়েই সে উঠে পড়ে বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়। তারপর সে তার স্ত্রীকে বলে একটা শসা কেটে দিতে এবং সে গোগ্রাসে শসা খায়।

খেয়েদেয়ে ক্লান্তিতে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়ে বুলবুল। বিবমিষা নিয়েই সে তার দুচোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করতেই ফিরে আসে রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের সব স্মৃতি। সে যেন দেখতে পায়, দড়ি বেয়ে একজন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মী আর সে অন্ধকার সুড়ঙ্গ গলে সংকীর্ণ তিনতলায় নামছে। তার হাতে জ্বলছে তিন ব্যাটারির টর্চ। কোথাও কারো ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তখনো : বাঁচাও! আঁর কোমরের ওপরে দেয়াল ভাঙি পড়ছে ভাই! নড়তে পাইরতেছি না আঁই! ভাই আঁরে বাইর করি লই যান! দয়া করেন! মানুষের গলার আওয়াজ লক্ষ করে অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে বুলবুল দেখতে পাচ্ছে, তাদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেঙেপড়া একটা দেয়াল। দেয়ালের ওপার থেকে কোনো আহতের গলার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে। বুলবুল এ-ও বুঝতে পারছে, দেয়ালটা না-ভাঙলে দেয়ালের ওপাশের আহত মানুষটাকে উদ্ধার করা যাবে না কিছুতেই। সুড়ঙ্গের ওপরের দিকে তাকিয়ে উদ্ধারকর্মীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছে বুলবুল : বড় হাতুড়িডা নিচে পাঠাইতে হইবে ভাইজান! দেয়াল না-ভাঙলে চলবে না! চিৎকারটা দিয়েই সে ধড়মড় করে উঠে বসছে তার নিজের বিছানায়; বিছানার চাদর হাতড়ে খুঁজছে কিছু।

সম্বিত ফিরলে অতঃপর বুলবুল থম মেরে বিছানায় বসে থাকে এবং উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলতে একের পর এক সিগারেট খায়। তখন তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ভেঙেপড়া একটা পিলার এবং ফ্লোরের চাপে মৃত্যুবরণ করা নাম-না-জানা একজন তরুণীর ছবি যার নূপুর পরা ডান পা-টা গোড়ালি থেকে বেরিয়ে ছিল শূন্যে, হয়তোবা এই জগতের প্রতি সুতীব্র ঘৃণায়। এমন আরো একটা ছবি তাকে আক্রমণ করে তারপর : ধ্বংসসত্মূপের এক ফাঁকে একজন পুরুষ বুকে জড়িয়ে ধরে আছে একজন নারীকে। তাদের গায়ে এসে পড়েছে কংক্রিট আর লোহার রডের ধস। তারা দুজনেই মৃত। এদিকে বুলবুলের চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে কখন যেন ছুটে এসেছে রোজিনা এবং সে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে। গম্ভীর হয়ে বিছানায় বসে থাকা বুলবুলের দিকে আবারো সপ্রশ্নে তাকিয়ে আছে দুশ্চিন্তিত রোজিনা। তবে এবার সে জিজ্ঞাসা করছে না কিছুই; মন্তব্যও করছে না কোনো।

এভাবে সেদিন সারারাত ঘুম হয় না মোহাম্মদ বুলবুলের। অস্থিরতার চাপে ঘরে বসে থাকাটা দুষ্কর হয়ে ওঠে তার পক্ষে। তাছাড়া তার এও মনে হয়, আরেকবার নিখোঁজ সোমা আখতারের খবর নেওয়াটা প্রয়োজন। এমন তো হতেই পারে যে উদ্ধার-তৎপরতা বন্ধ করা হলেও ধ্বংসসত্মূপের কোনো ফাঁকফোকর গলে সবাইকে তাজ্জব বানিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে জীবিত সোমা! এমনটা তো ঘটেছে এই দুদিন আগেই! কাজেই সূর্য উঠলে পরে হাঁটতে হাঁটতে সে রহমান টাওয়ারের ধ্বংসসত্মূপের কাছে যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখতে পায়, উদ্ধারকার্যের সমাপ্তি টানার পরে এবার নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনের জটলাটা লম্বা হয়েছে আরো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আত্মীয়স্বজন রহমান টাওয়ারের বিধ্বস্ত গেটের মুখে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। কী করবে তা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না যেন! আর সেখান থেকে কান্নার রোল উঠছে থেকে থেকেই। নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্ধান প্রার্থনা করে যেসব লেমিনেটেড ছবি ঝুলছে তাদের কারো কারো হাতে সেখানে এবার যোগ হয়েছে নতুন নতুন সব ছবি। সেসব এনলার্জ করা ছবির ভিড়ে হাসিমুখে সকলের দিকে তাকিয়ে আছে সোমা আখতার। সোমার ছবিটা দেখে গভীর বেদনায় থমকে যায় বুলবুল। আহা! কী দুঃখজনকভাবে জলজ্যান্ত একজন মানুষ নিখোঁজদের কাতারে চলে গেল! যে বয়স্কা মানুষটা সোমার ছবিটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছে তাকে সে চেনে না। বয়স এবং চেহারার ধরন দেখে মনে হয় সেই মানুষটা সোমার জন্মদাত্রীই হবে।

নিঃখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের শোকের মাতমের ভেতরে এখনো ধ্বংসসত্মূপটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শখানেক উৎসুক মানুষ। সেই ভিড়ের ভেতরে পাওয়া যায় বুলবুলের সহযোদ্ধা সোবহানকে। সাদা পস্নাস্টিকের ছোট কাপে চা খাচ্ছে সোবহান এবং সে তার পাশের কোনো মানুষের সঙ্গে কী নিয়ে যেন উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। সোবহানের সামনে দাঁড়াতেই সোবহান বুলবুলকে চকিতে টান দিয়ে ভিড় থেকে একটু দূরে নিয়ে যায়; তারপর বলে, শরীর ও মন ভয়ানকভাবে ক্লান্ত থাকলেও বস্তিতে নিজের ডেরায় ফিরে যাওয়ার পরে সে কিছুতেই আর ঘুমোতে পারেনি। ভাত খেতে বসে সে দেখেছে, তার পেস্নটে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে সাদা রঙের পোকাদের দল – মৃত মানুষের গলিত শরীর কুরে কুরে খায় যারা। বুলবুল তখন সোবহানকে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা সংক্ষেপে জানায়। অভিজ্ঞতার মিল দেখে কিছুটা হলেও নির্ভার বোধ করে তারা দুজনেই। তখন সপ্রশ্নে বুলবুলের দিকে চেয়ে থাকে সোবহান। সোবহান যেন বলতে চায় : এসব উদ্ভট দৃশ্য কেন দেখছে সে? এ-প্রশ্নটার উত্তর বুলবুলেরও অজানা। তাই তারা পরস্পরের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অনাবশ্যকভাবে তাকিয়ে থাকে জনতার জটলার দিকে। তারপর একসময়ে সোবহান এগিয়ে যায় জটলা বরাবর কারো সাথে কথা বলার জন্য।

তখন নিখোঁজ সোমা আখতারের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়ের কথা মনে পড়ে যায় বুলবুলের। মিরপুর চোদ্দো নম্বরের ইকোনো গার্মেন্টের জুনিয়র মেশিন অপারেটর পরী বেগম বুলবুলের অনেক পুরনো খদ্দের। পরী বেগমের মাধ্যমে বুলবুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল সোমার। পরী বেগমের সঙ্গে মোহাম্মদ বুলবুলের দর্জির দোকানে কামিজ বানিয়ে নিতে সোমা এসেছিল এখন থেকে বছর দুয়েক আগে। কামিজ বানিয়ে নেওয়ার জন্য হলুদ রঙের আড়াই হাত বহরের তিন গজ কাপড় সে নিজেই কিনে নিয়ে এসেছিল। গজফিতা দিয়ে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সোমার কামিজের মাপ নিয়েছিল বুলবুল। বুলবুলের স্পষ্ট মনে পড়ে, ইঞ্চিতে কামিজের মাপটা ছিল এমন : লম্বা – চুয়ালিস্নশ, ছত্রিশ বুক, তিরিশ কোমর, পাছা – আটত্রিশ এবং ঘের – চবিবশ। গৌরবর্ণাকে প্রথম দর্শনেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল বুলবুলের। পরী আর সোমা চলে যাওয়ার পর বুলবুলের মনে আকাঙক্ষা জেগেছিল যে, সোমা আখতার বারবার পোশাক গড়িয়ে নিতে আসুক না তার কাছে! মেয়েটার সঙ্গে একটু খাতিরটাতির জমানোর চেষ্টা করলে ক্ষতি কী? এর আগে বুলবুল পোশাক বানানোর সূত্রে সুফিয়া নামে আরেকজন গার্মেন্ট শ্রমিকের সঙ্গে দিল্লাগি করেছিল কিছুদিন। সুফিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে এখন আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বুলবুলের। সুফিয়াই আর যোগাযোগ রাখতে চায়নি। কাজেই তার দোকানে সোমার উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য বুলবুল ইচ্ছে করেই সোমার দেখিয়ে দেওয়া ডিজাইন অনুযায়ী ছোট মাপে হলুদ রঙের চাঁদগলা-কামিজটা বানায়। বিভিন্ন বর্ডার আর ঝুলের ভাঁজে সে অনেকখানি বাড়তি কাপড় রেখে দেয় অবশ্য। দুদিন পরের রাতে ফ্যাক্টরি থেকে পাইকপাড়ার মেসে ফেরার পথে ব্যস্তসমস্ত সোমা তার পোশাক ডেলিভারি নিয়ে যায়। তার পরদিন কাজশেষে বুলবুলের দর্জির দোকানে এসে সোমা রেগে টং : উলডাপালডা জামা বানাইলেন কা? এই ছোড জামা কেডায় পড়বে? মুই না কেলাশ ফোরে পড়া মোর ছোট বইন?

বুলবুল তখন গোবেচারার ভাব ধরে সোমার চোখে তাকিয়ে মিথ্যে করেই সোমাকে বোঝায় যে সত্যিই ভীষণ গলতি হয়ে গেছে তার এবং তার জন্য সে আন্তরিকভাবেই দুঃখিত! প্রতিদিন গার্মেন্ট-শ্রমিক এবং পীরেরবাগের বউ-ঝিদের কুড়ি-পঁচিশটা জামাকাপড় বানাতে গেলে মাঝেমধ্যে মাপে প্যাঁচ লাগতেই পারে! তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, কেননা কামিজের সব বর্ডারের ভেতরে এবং ঝুলের ভাঁজে রাখা আছে অনেকখানি বাড়তি কাপড়। কাজেই সহজেই সোমার দেওয়া মাপে এবার কামিজটা ঠিকঠাক করে ফেলা সম্ভব। যেহেতু এটা বুলবুলের নিজের ভুল কাজেই মেরামতের জন্য তো আর সোমাকে বাড়তি খরচ দিতে হচ্ছে না! এমন মোক্ষম যুক্তির পরে মেরামতের জন্য সোমা বুলবুলকে তার নয়া কামিজটা দিয়ে যায়। কামিজের সেলাই খুলে নিজের হাতে এবার সঠিক মাপে কামিজ সেলাই করে ফেলে বুলবুল। পরদিন খুশি মনে সোমা হলুদ রঙের নতুন কামিজটা নিয়ে যায়।

মাস দেড়েক পরে পরীর সঙ্গে আবারো বুলবুলের দোকানে একটা চুড়িদার সালোয়ার গড়িয়ে নিতে আসে সোমা। তার হাতে তিন হাত বহরের দুই গজ বেগুনি রঙের একটা কাপড়। গজফিতা ধরে সালোয়ারের লম্বা, হাঁটু, সেকম এবং মুহুরির মাপ নিয়ে রাখে বুলবুল। দুষ্টুবুদ্ধি করে সোমার এঁকে দেওয়া ডিজাইন অনুযায়ী চুড়িদার সালোয়ার না-বানিয়ে বুলবুল এবার বানায় ঢিলে একটা সালোয়ার। ডেলিভারি নেওয়ার সময়ে এমন গড়বড় দেখে স্বভাবতই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সোমা। বুলবুল তাকে কথা দেয়, সালোয়ারটার কলি খুলে সে সহজেই সেটাকে চুড়িদার সালোয়ারে রূপান্তরিত করতে পারবে। হাঁটু, হাঁটুর নিচে এবং হাঁটুর ওপরের দিকে ঊরুর মাপ টাইট করলেই হলো। সোমা যেন কষ্ট করে পরদিন ফ্যাক্টরি থেকে তার পাইকপাড়ার মেসে ফিরে যাওয়ার পথে সালোয়ারটা নিয়ে যায়। তবে কথা থাকে এই, যেহেতু এটা বুলবুলের নিজেরই ভুল এবং সে-কারণে তকলিফ হয়েছে সোমার কাজেই বুলবুল এবার আর সালোয়ার বানানো বাবদ মজুরি দাবিই করবে না। তাতে করে খুশিই হয় সোমা। কিন্তু সমস্যাটা হয় অন্য জায়গায় : চুড়িদার সালোয়ারের কাট সম্পূর্ণত আলাদা এবং ঢিলে সালোয়ার খুলে চুড়িদার সালোয়ার বানাতে গেলে কাপড় নষ্ট হবে বিস্তর। তার চাইতে নতুন কাপড় কিনে চুড়িদার সালোয়ার বানিয়ে ফেলাটাই ভালো। কাজেই উপায়ান্তর না-দেখে বুলবুল মিরপুর দশ নম্বর থেকে নিজে তিন হাত বহরের দুই গজ কাপড় কিনে নিয়ে আসে। তারপর সে সোমাকে নতুন করে চুড়িদার সালোয়ারটা বানিয়ে দেয়। সোমা এসব বিভ্রাটের কথা কিছুই জানতে পারে না।

তার একমাস মতো পরে সোমা একটা ভয়েল এবং একটা ফাইভ-সিক্সটি ফাইভ থানকাপড় নিয়ে আসে বুলবুলের দর্জির দোকানে। উদ্দেশ্য, কমলা রঙের মেট্রোগলার বস্নাউজ আর গাঢ় নীল রঙের পেটিকোট গড়িয়ে নেওয়া। সঙ্গে কোনো ব্যবহৃত বস্নাউজ আনেনি বলে সোমার বস্নাউজের মাপ নিতে বুলবুলকে ফিতা ধরতেই হয়। বস্নাউজের গলা, পুট, হাতা, পুটহাতা এবং আস্তিনের মাপ নেওয়ার সময়ে ইচ্ছে করেই সোমার ফর্সা ঘাড় আর ডান বাহু আলগোছে স্পর্শ না-করে সে আর পারেই না! ছাতির মাপ নেওয়ার সময় কামিজের নিচে সোমার উদ্ধত ছত্রিশ ইঞ্চি বুকের দিকে নজর দিয়ে কামনায় মাথা গরম হয়ে যায় তার। সোমা তা লক্ষ করে বলে মনে হয় না। সে যাই হোক, বস্নাউজটা কাটার সময় সে দুহাত বহরের এক গজ চার গিরা কাপড়ের ওপরে সোমার গায়ের মাপের চেয়ে কিছুটা বড় মাপেই বস্নাউজটার সামনে, পেছনে এবং গলার অংশে চক দিয়ে মার্কিং করে। মার্কিংটা এমন যে, সেলাইয়ের ভাঁজে এক সেন্টিমিটারের ওপরে কোনো কাপড় থাকবে না। তারপর আজিজ কারিগরকে দিয়ে সে গড়িয়ে নেয় বস্নাউজটা। পরদিন রাতের বেলায় ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার পথে বুলবুলের দর্জির দোকানে সোমা থামে। বস্নাউজ ডেলিভারি নেওয়ার আগে বস্নাউজটা খুলে উলটোপালটা মাপ দেখে সে রাগে বোম হয়ে যায়। কপট দুঃখে দুঃখিত হয়ে তখন বুলবুল বলে, আর কখনো মাপে বা ডিজাইনে ভুল হবে না তার। তাকে যেন ভুল শুধরানোর জন্য সোমা শেষবারের মতো একটা সুযোগ দেয়। ব্যাদান মুখে রাজি হয় সোমা। বড় মাপের বস্নাউজ খুলে এবার বেশ কসরত করেই সঠিক মাপে কমলা রঙের মেট্রোগলার বস্নাউজটা কাটে বুলবুল এবং আজিজ কারিগরের হাতে না-দিয়ে পা-মেশিনে বসে নিজেই যত্ন করে বস্নাউজটা সেলাই করে ফেলে সে। সঠিক মেরামতি দেখে এবার খুশিই হয় সোমা।

মজুরি বাবদ এবারো সোমার কাছ থেকে আর টাকা নিতে চায় না বুলবুল। সে বুঝতে পারে, অস্বস্তিতে পড়েছে সোমা। দীঘল চোখ মেলে সোমা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কা? মজুরি লইবেন না কা? ভুলভাল কাম হরছেন, ফের এইয়া মেরামতও হরছেন, খাটনি হইছে না আমনের?’

সোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে তার তিনজন কারিগরের চোখে তাকিয়ে তাদের বাইরে চলে যাওয়ার সংকেত দেয় বুলবুল। বুলবুলের গোপনীয়তা বিধান করতে পা-মেশিন থেকে উঠে চলেও যায় তারা। একটা বস্নাউজের বোতামঘর এবং মুড়ি সেলাইয়ে ব্যস্ত হেল্পার ভুলুকে চা আনতে পাঠিয়ে তারপর সে সোমার প্রশ্নের উত্তর করে এভাবে, ‘আমনে বরিশালের মানুষ, মুইও তাই। আমনের সঙ্গে কি আর ট্যাহাপয়সার সম্পর্ক বানাইতে হইবে নেকি?’

‘খোদেজাও তো বরিশালের মাইয়া! ওই যে যেই মাইয়াডা নিকি ফ্যাশানের আইরোনার! তার ডেরেস বানাইতে তা হইলে টাহা নেতে আছেন কা?  আমনের ধারে তো আমনের বন্ধু পরীরও টাহার মাফ হয় না?’ এই বলে ভুরুটুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে সোমা।

বুলবুল তখন বেজায় ঝামেলায় পড়ে যায়। সোমার অকাট্য যুক্তি খ-ন করতে না-পেরে শেষ পর্যন্ত সে সত্য কথাটা বলেই ফেলে, ‘আমনেরে আমি খুব ভালো পাই!’

সে-কথা শুনে বুলবুলের উঁচু কাটিং-টেবিলের সামনের চেয়ারটায় মাথা নিচু করে বসে কিছু একটা ভাবতে থাকে সোমা। হেল্পার ভুলু চা নিয়ে এলে তারা দুজনে চুপচাপ চা খায়। একপর্যায়ে সোমা বুলবুলকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ডেরেস বানাইতে বইসা ইচ্ছা হইরা বারবার ভুল করতে আছেন, তাই-ই না? মনের কথা সোজা হইরা বললে কী আমনের মাথা কাডা যাইতে?’

চুপই করে থাকে সলজ্জ বুলবুল। একটু থেমে বিহবল সোমা তাকে জানায়, এক বছর আগে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। তার একটা মেয়ে আছে দুবছর বয়সী। মেয়েটা সোমার মার সঙ্গে থাকে পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার চিড়াপাড়ায়। এদিকে বুলবুল সোমাকে জানায়, সে বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক, তার স্ত্রী জীবিত। সেই থেকে বুলবুলের সঙ্গে সোমার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়েছিল। ফ্যাক্টরির কাজ থেকে যেদিন সত্যি সত্যিই ছুটি মিলছিল সোমার (মানে, ছুটিছাটা বা শিফটের তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই তার!) সেদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে একটু হেঁটে বেড়ানো, পূরবী সিনেমা হলে কদাচিৎ সিনেমা দেখতে যাওয়া, শাড়ি কিনতে যাওয়া হকার্স মার্কেটে, বুলবুলের বউ বাকেরগঞ্জে তার পিত্রালয়ে বেড়াতে গেলে সোমার সঙ্গে ফাঁকা বাসায় মাঝেমধ্যে যৌনতা বিনিময় ইত্যাদি যোগাযোগ নিয়ে মহানন্দেই ছিল বুলবুল। কাঠামোগত ত্র‍ুটির কারণে রহমান টাওয়ার ধসে পড়ার পর নিখোঁজ হয়ে গেল সেই সদাহাস্যময় মেয়েটা! হয়তোবা নয়তলা রহমান টাওয়ারের ভেঙেপড়া ফ্লোর, দেয়াল আর পিলারগুলোর ইট আর লোহার খাঁচার কোনো  গোলকধাঁধায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে মেয়েটার শরীর। মানুষের শরীর তো আসলে খুবই পলকা! হয়তোবা বিকৃত লাশগুলোর কোনো একটা সোমা আখতারেরই ছিল, যে লাশগুলোকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম! জুরাইনে যেসব বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কবর দেওয়া হয়েছে তার ভেতরে হয়তোবা মানুষের হাতের  কোনো একটা বিচ্ছিন্ন আঙুল সোমার, গোড়ালি থেকে কেটে যাওয়া  কোনো একটা পায়ের পাতা হয়তোবা সোমারই হবে, হয়তো হাঁটু থেকে খুলে যাওয়া মালাটা বা খ–ত কানটা তার, হয়তোবা থেঁতলে যাওয়া মু-ু নয়তো পাঁজরের হাড় অথবা ক্ষত-বিক্ষত নাড়িভুড়িটা একসময়ে সোমারই দেহের অংশ ছিল!

বিধ্বস্ত রহমান টাওয়ার থেকে ফেরার পরে সেই রাতে খেতে বসে আবার সবকিছু গুলিয়ে যায় বুলবুলের। সোবহানের দেখা শব কুরে কুরে খাওয়া বীভৎস পোকাগুলো যেন এবার ঘুরে বেড়াচ্ছে তার নিজেরই ভাতের পেস্নট জুড়ে! আর তার নাকে এসে লাগছে পচে যাওয়া শবের উৎকট গন্ধ! কাজেই আর ভাত খাওয়া হয় না তার। দুটো পাইনাপেল বিস্কিট খেয়ে সে শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনে রহমান টাওয়ারের দুর্যোগের এন্তার সংবাদ দেখতে থাকে। জীবিত বা মৃত সোমা আখতারকে ধ্বংসসত্মূপের ভেতরে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলে অবশ্যই তেমন একটা অভাবনীয় ঘটনা টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার করা হবেই হবে। তাই টেলিভিশনের সামনে রাত জেগে বসে থাকা।

টেলিভিশন দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে যায় তা আর বুঝতে পারে না বুলবুল। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। কে যেন তার কানের কাছে চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিল : ভাইজান! আমার পা দুইখান করাত দিয়া কাইটা দেন। তা হইলে আমি পিলারের নিচ থেইকা বাইর হইয়া যাইতে পারুম! হ্যাঁ! চারতলার জঞ্জালে আটকে পড়া সেই মানুষটার গায়ে কালো স্ট্রাইপ দেওয়া লাল রঙের ফুলশার্ট ছিল। একটা পিলার ভেঙে পড়ে থেঁতলে গিয়েছিল তার কোমর। তার কোমর থেকে নিচের অংশটা পিলারের আড়ালে ঢাকা ছিল বলে তা আর বুলবুলদের চোখে পড়ছিল না কোনোভাবেই। আহত মানুষটা বারবার বুলবুলদের দলের উদ্ধারকর্মীদের বলছিল : আমারে বাঁচান ভাই! আমার দুইটা ছোট ছোট পোলা আছে! আমি মইরা গেলে তাদেরে দেখনের কোনো মানুষ থাকব না! মানুষটা তার নাম বলেছিল – আকবর হোসেন। বুলবুল আর বাদশাসহ আরো অনেক মানুষ মিলে দুঘণ্টা ধরে হাতুড়ি, শাবল আর গাঁইতি মেরে, কখনো ইলেকট্রিক করাত চালিয়ে পিলারটাকে খানিকটা সরাতে পেরেছিল। টর্চের আলোতে তখন দেখা গেল, আকবর হোসেনের ধরের নিম্নভাগ আগেই আলাদা হয়ে গেছে তার কোমর থেকে। পুরনো রক্তে ভিজে আছে সাইফুলের শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে ফেলা রাবিশ। আর তাদের উদ্ধারকাজের উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার ফাঁকে কখন যে আকবর হোসেনের মৃত্যু ঘটেছে তা খেয়ালই করেনি বুলবুলরা! রহমান টাওয়ার ধসে পড়ার চতুর্থ দিনে এই ঘটনাটা ঘটেছিল।

 

 

তিন

রহমান টাওয়ারের উদ্ধার-তৎপরতা শেষ হওয়ার পরে প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এত দিনেও ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না বুলবুলের! কী যন্ত্রণা! মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে সে পীরেরবাগ আর শেওড়াপাড়ার পথে পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাও সময় কাটছে না তার। তারপর রহমান টাওয়ারের নির্জন ধ্বংসাবশেষের সামনে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকছে চুপচাপ। হয়তো সে তার প্রেমিকা সোমা আখতারকেই খুঁজে ফিরছে মনে মনে! হয়তোবা সে ভাবছে অন্য কথাও : ভুল জায়গায় ড্রিল না-করলে নিশ্চয় কাটা পড়ত না এক্স গার্মেন্টের হেল্পার সুরুজ মিয়ার ডান পা-টা, চারতলার একটা দেয়ালের পিছে আটকাপড়া আটজন মানুষকে কোনোভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করতে পারলে হয়তোবা তাদের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো, কিংবা জঞ্জালের ভেতরে আবক্ষ ডুবে থাকা গোলাপি কামিজ পরা মেয়েটার পিঠ ভেদ করে যদি লোহার রডটা ঢুকে না-যেত তবে হয়তো তাকে কোনো না কোনোভাবে টেনে বের করা যেত। কিংবা মগবাজারের রংমিস্ত্রি আনসারের কথাই ধরা যাক। বুলবুল এখন বুঝতে পারে, চারতলার গভীরে আটকেপড়া আটজন মানুষকে উদ্ধারের জন্য আনসারকে একা পাঠানোটা মোটেই ঠিক হয়নি। শেওড়াপাড়ার একটা রড-সিমেন্টের দোকান থেকে ধার করে আনা পুরনো অক্সিজেন-সিলিন্ডারটা হঠাৎ অকেজো হয়ে পড়াতে দম বন্ধ হয়ে মারা গেল আনসার। সে আর ভেঙেপড়া ফ্লোর এবং পিলারের ফাঁকফোকর গলে সুড়ঙ্গের দিকে ফিরে আসার শক্তি পায়নি। তারপর এসব ভাবনার ভেতরে কোনোদিন হয়তো শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে ডাল-পরোটা খেতে বসছে বুলবুল। পরোটার অর্ধাংশ খাওয়ার পরেই তার নাকে এসে লাগছে মানুষের পচা মাংস আর রক্তের দুর্গন্ধ এবং সে বেসিনে গিয়ে বমি করে দিচ্ছে হয়তোবা। অজানা এক অস্থিরতা নিয়ে আবার সে হাঁটছে শেওড়াপাড়া থেকে দক্ষিণ পীরেরবাগের রাস্তায় রাস্তায়। সচরাচর এভাবেই শুরু হচ্ছে তার দিনগুলো। তারপর বাসায় গিয়ে অস্থিরতা নিয়ে ফের শুয়েবসে থাকা, বিকেল বা সন্ধ্যায় ফের একটু দাঁড়িয়ে থাকা রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের সামনে গিয়ে। রাতগুলো কাটছে অনিদ্রায়, দুঃস্বপ্নে।

শুয়ে-বসে-হেঁটে মহাবিরক্ত হয়ে, মন না-চাইলেও, তার দর্জির দোকান খোলার পরিকল্পনা নেয় বুলবুল। সে তার তিনজন কারিগর এবং হেল্পারকে দোকানের সামনে চলে আসতে খবর দেয়। দীর্ঘদিন পরে দোকান খুলে দেখা যায়, উঁচু কাটিং টেবিল, চেয়ার, তিনটা পা-মেশিন এবং শো-কেসটা ধূসরিত হয়েছে রাজ্যের ধুলোয়। এই নিয়ে বুলবুল ভুলুকে বেদম গালাগাল করে। তার মোদ্দা কথা হলো : রহমান টাওয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজাক করেছ, না? কারো তো কোনো উপকারে লাগোনি! দোকানটা খুলে একটু ঝাড়মোছ করে রাখলে কী এমন ক্ষতি হতো তোমার? দীর্ঘক্ষণব্যাপী ভৎর্সনা চলার ফাঁকে আসবাবপত্র ও পা-মেশিনের ওপরে জমে থাকা ধুলো ঝেড়ে ঘরটা ভালোমতো ঝাঁট দিয়ে ফেলে মস্নানবদনের ভুলু।

কাটিং টেবিলের উঁচু চেয়ারটায় অনেকদিন পরে বসলে বুলবুলের চোখ চলে যায় বাঁয়ের দেয়ালে আনুভূমিকভাবে বসানো লম্বা হ্যাঙ্গারটার দিকে যেখানে ঝুলছে গোটা বিশেক সালোয়ার-কামিজ, বস্নাউজ, পেটিকোট, ফ্রক, সেমিজ ইত্যাদি এবং শিশুদের কিছু পোশাক। এলাকার বউ-ঝি এবং শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নারী-শ্রমিকরা একদা এসব পোশাক বানানোর অর্ডার দিয়েছিল। রহমান টাওয়ার ধসেপড়ার পর থেকে মডার্ন টেইলর বন্ধ ছিল বলে পোশাকগুলো আর খদ্দেরদের হস্তান্তর করা যায়নি। আর এও ঠিক যে, তার বেশিরভাগ খদ্দের, মানে রহমান টাওয়ারের বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নারী-শ্রমিকেরা, হয় মৃত্যুবরণ করেছে, নয়তো নিখোঁজ হয়েছে অথবা আহত হয়ে শুয়ে আছে পঙ্গু হাসপাতাল বা এমন কোথাও। যেমন, নীল আর হলুদ ছিটের কামিজ এবং নীল সালোয়ারটা বানাতে দিয়েছিল রহমান টাওয়ারের জঞ্জালে মৃত রিক্তা বানু। মৃত সালমা বেগম কমলা কামিজ-সবুজ সালোয়ার বানাতে দিয়েছিল কদিন আগেই। মেরুনের ওপরে সাদা ছিটের সালোয়ার-কামিজ গড়িয়ে নেওয়ার জন্য অর্ডার দিয়েছিল করিমন বিবি। করিমন বিবিরও মৃত্যু হয়েছে রহমান টাওয়ারের ইটপাথরের নিচে পিষ্ট হয়ে। আর আহত হাসি বেগমের দুটো পা-ই কেটে ফেলতে হয়েছে ইতোমধ্যে। নিশ্চয় হাসি বেগম আর ডেলিভারি নিতে আসবে না তার অর্ডার দেওয়া সালোয়ার-কামিজ, অন্ততপক্ষে সালোয়ারটা আর তার প্রয়োজন পড়বে না। কাটিং টেবিলের ঠিক ওপরের তাকে এখনো রাখা আছে রহমান টাওয়ারের ধ্বংসসত্মূপে নিখোঁজ সোমা আখতারের রেখে যাওয়া সবুজ আর লাল রঙের থানকাপড়। সবুজ কাপড়টা দিয়ে ভি-গলার কামিজ বানাতে চেয়েছিল সোমা আর লাল কাপড় দিয়ে চুড়িদার সালোয়ার। সোমা চেয়েছিল, যে-দিনগুলোতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচ চলবে সে-দিনগুলোতে, সব ঠিকঠাক থাকলে, সে লাল-সবুজ পোশাকটা পরবে। হয়তো সোমা আখতারও আর কোনোদিন সালোয়ার-কামিজটা বানিয়ে ফেলার তাগাদা দিতে বুলবুলের দর্জির দোকানে আসবে না বা ফোনও করবে না। সোমার  রেখে যাওয়া কাপড়ের পাশেই মোটা একটা খাতা পড়ে আছে এখনো যেখানে বুলবুল তার খদ্দেরদের জামাকাপড়ের মাপজোখ লিখে রাখে এবং খদ্দেরদের কাছে শুনেশুনে ডিজাইনও এঁকে ফেলে সেইসঙ্গে। সেই খাতাটার ভাঁজে রয়ে গেছে সোমার রেখে যাওয়া কামিজের একটা ডিজাইন। ময়লা রুল-টানা কোনো খাতার পাতায় পেনসিলে কামিজের ডিজাইন নিজেই এঁকে নিয়ে এসেছিল সোমা, রহমান টাওয়ার ধসে পড়ার দিন চারেক আগে। সোমা কড়া সুরে তাকে বলেছিল, এই ডিজাইনই যেন সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়! কোনো বেচাল সহ্য করা হবে না! তারপর থেকে দুর্ঘটনার দিন সকাল পর্যন্ত সোমার সঙ্গে আর সামনাসামনি দেখা হয়নি বুলবুলের, ফোনে আর মেসেঞ্জারে নিয়মিত কথা হয়েছে মাত্র।

এসব ক্ষতির কথা ভাবতে ভাবতে নিজের চেয়ারে বসে উদ্ভ্রান্তের মতো সিগারেট টানতে থাকে টেইলর মাস্টার মোহাম্মদ বুলবুল। রহমান টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষে উদ্ধারকাজে বুলবুলের সঙ্গে অংশ নেওয়া বাদশা, তারই একজন কারিগর, তখন তাকে বলে, ‘রাইতের বেলা ঘোম হয় নেই ভাইজান! আইজ আর কাম করব লয়। বাড়িত চলে গিলেম আমি।’ এই বলে হন্তদন্ত হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে যায় পাবনার বাদশা। রহমান টাওয়ারের উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে বুলবুলের মতো বাদশারও ঘুমের সমস্যা চলছে। তাই বাদশাকে আটকাতে কুণ্ঠিত বোধ করে বুলবুল। বুলবুলের আরেক সহযোদ্ধা সগিরও পা-মেশিনে বসে একটা ফ্রক সেলাই করতে করতে ঘুমে ঢুলছে তখনো। সগিরের চোখমুখ ক্লান্তিতে ভেতরে বসে গেছে বাদশা আর বুলবুলের মতোই।

পরিস্থিতি বিচারে দর্জির দোকান খোলার চতুর্থ দিনেই বুলবুল ঘোষণা দেয়, আপাতত তবে তাদের দোকান না-হয় বন্ধই থাকুক!  টেইলর মাস্টার বা কারিগরদের কারো তো কাজে মন বসছে না। তাছাড়া তাদের বাঁধা খদ্দেরদের বেশিরভাগই যখন আর পোশাক বানানোর ফরমায়েশ দিতে আসছে না এবং নতুন খদ্দেরও জমে উঠছে না তার দোকানকে কেন্দ্র করে তবে এই মুহূর্তে নিয়ম করে কাজে আসার কোনো মানে নেই। শুধু শুধু চারটা লাইট আর একটা ফ্যান চালিয়ে রেখে বিদ্যুতের বিল দেওয়ার মানেটা কী? চোরাই বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষেত্রে বিল দেওয়ার প্রশ্ন নেই বলে যুক্তি দেয় সিনিয়র কারিগর আজিজ। আজিজ কারিগর বলে, এখানে রুটিরুজির প্রশ্ন জড়িত আছে। কাজেই দোকান বন্ধ রাখা চলবে না। তাছাড়া দোকান বন্ধ রাখলে তাদের নিয়মিত খদ্দেররা পোশাক বানিয়ে নেয়ার জন্য পূর্ব পীরেরবাগের আমিন দর্জি বা মোশারফ দর্জির দোকানে চলে যাবে, নতুন খদ্দেরদেরও ধরা যাবে না সেই ক্ষেত্রে। আজিজ কারিগর তাই একটা সমাধান দেয় তখন : সে আর হেল্পার ভুলু মিলে দোকান খোলা রাখবে। যেহেতু বুলবুল, সগির আর বাদশা ভীষণ ক্লান্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে, কাজেই তারা
না-চাইলে কিছুদিন দোকানে না-বসুক। সগির আর বাদশা সেলাইয়ের কাজ না-করলে কোনো টাকা পাবে না, বুলবুল দোকানের মালিক হিসেবে হিস্যা পাবে নিয়মিত। আজিজের পরামর্শই সাব্যস্ত হয়।

তারপর এক সপ্তাহ মতো পরে পেটের দায়ে দর্জির কাজে ফিরে আসে সগির ও বাদশা কারিগর দুজনেই। টেইলর মাস্টার বুলবুল অবশ্য প্রতিদিনই দোকানে এসে বসে থাকে চুপচাপ। তার কোনো কাজেই মন নেই। তাই মহল্লার বউ-ঝিদের কাছ থেকে অল্প কিছু বানাইয়ের কাজ যেসব আসে – সালোয়ার-কামিজ, বস্নাউজ বা সায়া বা ছোটদের পোশাক-আশাক – সেগুলোর মাপ নেয় সিনিয়র কারিগর আজিজ। আজিজ নিজেই ডিজাইন অনুযায়ী কাপড়ে মার্কিং করে, কাঁচি বসিয়ে কাপড় কাটে। তারপর তিন কারিগর ভাগেজোগে সেলাই করে ফেলে সেগুলো। খদ্দেরদের কাছ থেকে মজুরি গ্রহণ করে সগির। মজুরি বাবদ অল্পবিস্তর যা টাকা আসে সেই টাকাপয়সা দিনশেষে সগির দিয়ে দেয় বুলবুলের কাছে। এভাবে টেনেটুনে সংসার চলতে থাকে তাদের সকলের।

 

 

চার

প্রায় পাঁচ মাস পরে এক্সক্যাভেটর এবং বুলডোজার দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ধসেপড়া নয়তলা বিল্ডিংটার ফ্লোর, পিলার, ছাদ এবং দেয়ালের খ–বিখ- অংশ। নিচু হয়ে যাওয়া জায়গাটাতে ভরে উঠেছে লাগাতার বৃষ্টির পানি। তাই জায়গাটাকে এখন একটা বিশাল পুকুর ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কেউ বলবে না যে এখানে একদা বড় ইমারতের অস্তিত্ব ছিল। শহর থেকে দূরে, মাতুয়াইলে, যেখানে রাবিশ ফেলে রাখা হয়েছে তার ফাঁকে ফাঁকে এখনো দেখা যায়, পড়ে আছে মানুষের অস্থি, সালোয়ার বা কামিজ বা ওড়না বা ক্যাপের টুকরো-টাকরা, তোবড়ানো পানির বোতল, সেলাই মেশিনের ভাঙা অংশ, সুতার রিল, ছেঁড়াফাটা কার্টন ইত্যাদি। এখনো মৃত এবং নিখোঁজদের স্বজনেরা লেমিনেট করা ছবি হাতে বিল্ডিংটার ধ্বংসসত্মূপের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে কখনো কখনো; আহাজারি করে। বিভিন্ন মর্গে জমিয়ে রাখা লাশগুলোর কিছু ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা গেছে বটে এবং লাশগুলোকে সৎকারের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেছে তাদের স্বজনেরা। শনাক্ত করা যায়নি এমন অনেককে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। প্রায় পঁচিশজন শ্রমিকের কোনো হদিস আর পাওয়া যায়নি; খুঁজে পাওয়া যায়নি পিরোজপুরের সোমা আখতারকেও। এদিকে অনেকদিন আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে রহমান টাওয়ারের মালিককে। তার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে পাঁচটা ফৌজদারি মামলা।

দক্ষিণ পীরেরবাগের টেইলর মাস্টার মোহাম্মদ বুলবুলের রুচি কিছুটা ফিরলেও তার মস্তিষ্ক এখনো ঘুমায় না। সময় কাটানোর জন্য রাত জেগে সে টেলিভিশনে টকশো কিংবা হিন্দি মুভি দেখে। তাতে করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলে বিরক্ত হয় তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রী রোজিনা। রোজিনার লাগাতার বিরক্তির আরো একটা বিশেষ কারণ আছে বটে : গেল চার-পাঁচ মাস ধরে ঘষাঘষি, ডলাডলি করলেও আর শরীর জাগছে না বুলবুলের। সেটা কেন হচ্ছে না তা আর বোধগম্য হয় না রোজিনার কাছে, বুলবুলের কাছেও নয়। ছত্রিশ বছরের মরদটার সবকিছু শেষ হয়ে গেল? এত জলদি? কেমন কথা এটা? রোজিনার পরিচিত কোনো মেয়ের স্বামীর তো এমন দুরবস্থা হয়নি? তবে? এ বিষয়ে আলোচনা, রাগারাগি আর তারপর চিকিৎসা নেয়ার কথা বলতে বলতে ইতোমধ্যে ক্লান্ত হয়েছে রোজিনা। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে গভীর অপরাধবোধ অসুখী করে ফেলেছে বুলবুলকে। টেলিভিশন দেখতে দেখতে শেষরাতের দিকে তার ঝিমানি আসে খানিকটা। তারপরে হয়তোবা একটু ঘুম, ফের চোখ খুলে চেয়ে থাকা সিলিংফ্যানের দিকে, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা, হয়তোবা আবারো একটু ঝিমানি বা একটু অগভীর ঘুম – এই চলছে অনেকদিন থেকেই। স্বাভাবিকভাবে জীবন চালানোর জন্য এত স্বল্প মাত্রার ঘুম শরীরের জন্য যথেষ্ট হয় না বইকি! তবে শরীর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দিনের বেলায় – দর্জির দোকানে গিয়ে কাটিং টেবিলের উঁচু চেয়ারটায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে থেকে থেকেই সে ঝিমায়।

রহমান টাওয়ারের উদ্ধার-তৎপরতায় অংশ নেওয়া সগির কারিগর সুস্থির হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু বাদশা কারিগর এখনো তার ভাতের থালায় শব কুরে খাওয়া পোকা নড়তে-চড়তে দেখে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না বলে ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছে বাদশা। তাছাড়া অদ্ভুত এক পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে তার – দিনের ভেতরে কতবার যে তার পেটে ব্যথা ওঠে তার কোনো ইয়ত্তা নেই! কাজেই পায়খানায় যাতায়াতটা বেড়ে গেছে আজকাল। সে অনেকক্ষণ ধরে পায়খানায় গিয়ে বসে থাকে; তীব্র ব্যথায় কোঁকায়। আর তার পাতলা পায়খানা হয় তখন। এসব নানা অস্থিরতায় প্রায়ই সে কাজে যাওয়া বন্ধ রাখছে। তালতলার ছোট্ট একটা স্যাঁতসেঁতে ঘরে সে শুয়েশুয়ে টিভি দেখে বেশিরভাগ সময়ে; কথাবার্তা বলে না পরিবার-পরিজন কারো সঙ্গেই তেমন একটা। বাদশার অনুপস্থিতি নিয়ে আজিজ কারিগর গরগর করলেও বাদশাকে কিছুই বলে না বুলবুল। আজিজ কারিগরের অসমেত্মাষের কারণও আছে : ফের তাদের দর্জির দোকানে কাপড়চোপড় বানাতে আসতে শুরু করেছে অত্র এলাকার বিভিন্ন গার্মেন্টের নতুন নতুন নারী-শ্রমিক। কাজের পরিমাণ বেড়েছে বলে তিনজন কারিগরের একজন না-থাকলে বাকি দুজনের ওপর সেলাইয়ের বাড়তি চাপ পড়ে বইকি! দ্বিতীয় সমস্যা হলো, টেইলর মাস্টার বুলবুল আজকাল এতই এলোমেলো হয়েছে যে, কাপড়ের ওপরে মার্কিং করা বা কাপড় কাটার সময় প্রায়শই সে ভুলভাল করে বসছে। এ নিয়ে খদ্দেরদের অভিযোগ থামছে না। কাজেই ব্যবসা চালু রাখার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে খদ্দেরদের পছন্দের ডিজাইনমাফিক কাপড় মার্কিং করে ফেলছে আজিজ কারিগর স্বয়ং, মার্কিং অনুযায়ী কাপড়ও কাটছে সে আগের মতোই। এ নিয়ে বুলবুলের ভেতরে কোনো বিকার লক্ষ করা যাচ্ছে না অবশ্য। বুলবুল মাঝেমাঝেই সোমা আখতারের রেখে যাওয়া সবুজ আর লাল থানকাপড়দুটো তাক থেকে বের করে কাটিং টেবিলটায় বসিয়ে রেখে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তাছাড়া মাপজোখের খাতার ভেতর থেকে সোমার আঁকা ডিজাইনটা বের করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাটাও তার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বুলবুলের উদ্ভ্রান্তির দিকটা বুঝতে পারে বলে প্রায়শই তাদের দর্জির দোকানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তিত হয় আজিজ কারিগর এবং তাদের হেল্পার ভুলু। বুলবুলকে কদিন পরপরই পরামর্শ দেয় আজিজ কারিগর : হুইনছেননি ওস্তাদ! সোমার কাপড় দুইখান সামনেথন সরাই লন। কাপড় লই পড়ি থাইকলে কি আর সোমা ফিরি আইসবনি? আর ব্যবসাই বা চলব কী করি? আজিজের পরামর্শে অবশ্য কোনোই কাজ হয় না! সবুজ আর লাল রঙের থানকাপড় যা দিয়ে সালোয়ার-কামিজ বানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল সোমা আখতারের জন্য সেগুলো সামনে রেখে চুপচাপ বসেই থাকে বুলবুল।

মাঝেমাঝে মোহাম্মদ বুলবুলের দর্জির দোকানে বেড়াতে আসে রহমান টাওয়ারের উদ্ধারকাজের সহযোদ্ধারা – কখনো চটপটি- বিক্রেতা শরিফ মিয়া, কখনো চায়ের দোকানদার বাবলু, কখনোবা সোবহান রিকশাওয়ালা। দোকানে বসে তারা বাদশা, সগির আর বুলবুলের সঙ্গে গল্প করে এটা-ওটা নিয়ে আর চা-বিড়ি খায়। রহমান টাওয়ারের ধ্বংসে মৃত, জীবিত আর নিখোঁজ মানুষদের নিয়েও তারা কথা বলে; দুঃখ করে। কখনোবা জুরাইন কবরস্থানে তারা মৃতদের কবর জিয়ারত করতে যায়। ক্ষুদ্র বালু-সিমেন্ট ব্যবসায়ী আজম এতই ব্যস্ত থাকে যে পীরেরবাগের দিকে সে তেমন একটা আসতে পারে না। তবে সে কখনো কখনো ফোন করে বুলবুলের খবরটবর নেয়, নিজের খবরও দেয়। দু-একটা কথা বলা বা শোনার পরে চুপ করে থাকে বুলবুল আর আজম দুজনেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আতাহার পরপর দুটো সেমিস্টার ড্রপ করার পরে কোনো রকমে শেষ করেছে তার মাস্টাসপর্ব। সে পড়তে চলে গেছে টরন্টোর কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আতাহার বলে, আজকাল নাকি কাউকে ফোনটোন করতে ভালো লাগে না তার! তাই বুলবুলই কালেভদ্রে ভাইবার বা ইমো অথবা হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে তাকে।

 

পাঁচ

এমন একদিন রাতে দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকার দারোয়ান মুসা রাস্তায় টহল দিতে দিতে দূর থেকে দেখতে পায়, মোহাম্মদ বুলবুলের মডার্ন টেইলরে আলো জ্বলছে। রাত তখন প্রায় একটা। ঘণ্টা তিনেক আগে যথারীতি বন্ধ হয়ে গেছে রাজুর মুদিদোকান, মোদাসসেরের ইট-বালু-সিমেনেটর ঘর, সফিউলের সেলুন, আকবরের মোবাইল ফোন রিচার্জ ও বিকাশ করার দোকান ইত্যাদি। সাধারণত, একই সময়ে শাটার নামানো হয়ে যায় বুলবুলের দর্জির দোকানটারও। তাহলে এত রাতে ওই দোকানটা খোলা রাখা হয়েছে কেন? দোকানে চোরচোট্টা পড়ল না তো আবার? মুসার এমন সন্দেহের পেছনে সুস্পষ্ট একটা কারণ আছে বইকি! কদিন আগেই তো রাজুর মুদিদোকানের শাটার ভেঙে মালসামান চুরি করে নিয়ে গেছে কেউ! ব্যাপারটা কী তা সরেজমিন দেখার জন্য তাই জোর পায়ে সামনে এগিয়ে যায় মুসা। দোকানের সামনে দাঁড়ালে সে দেখতে পায়, কাটিং টেবিলে বসে একমনে কাঠের লম্বা স্কেল দিয়ে কোনো কাপড় মাপামাপি করছে বুলবুল। টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা রঙের চক, গুলিসুতো, কাটিম, ববিনকেস, গজফিতা, কাঁচি ইত্যাদি।

উৎসুক মুসা তখন বুলবুলকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এত রাইতে কী করতে আছেন ভাইজান? বাইড়তে যাইবেন না আমনে?’

উত্তরে খুব সংক্ষেপে বুলবুল বলে, একটা স্পেশাল অর্ডার এসেছে পোশাক গড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আজ রাতের ভেতরেই শেষ করতে হবে কাজটা। বুলবুলের জবাবে খুব একটা অবাক হয় না মুসা দারোয়ান। সে তো দেখেছে, দুই ঈদ, পয়লা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডে অথবা পয়লা বৈশাখের মতো পার্বণের আগের দিনগুলোতে রাত জেগে কাজ করে থাকে দর্জির দোকানের কারিগরেরা। তখন তাদের হাতে স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও অর্ডার থাকে অনেক বেশি। তেমন কোনো পার্বণ সামনে না-থাকলেও নিশ্চয় জরুরি কোনো কাজ পড়ে গেছে বুলবুলের! এমনটা ভাবার পর মুসা দারোয়ান তার হাতের লাঠিটা নাচাতে নাচাতে হুইসেল বাজিয়ে এলাকায় টহল চালিয়ে যাওয়ার জন্য সামনে এগিয়ে যায়।

তার পরদিন রাত দুটোর দিকে মুসা দারোয়ান দেখতে পায়, কাটিং টেবিলে ঝুঁকে পড়ে খুব মনোযোগে বুলবুল কাঁচি দিয়ে কোনো কাপড় কাটাকাটি করছে। মুসা দারোয়ান বুঝে নেয়, গেল রাতের মতো করেই স্পেশাল অর্ডারের কোনো কাজ করছে বুলবুল। কাজেই তাকে আর কোনো প্রশ্ন করে বিরক্ত করে না মুসা দারোয়ান।

তৃতীয় রাতেও দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকা টহল দিয়ে বেড়ানোর সময় মুসা দারোয়ান দূর থেকে সেলাই মেশিনের ঘরঘর আওয়াজটা শুনতে পায়। মডার্ন টেইলরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখা যায়, সেই রাতের শেষ প্রহরে পা-মেশিনে বসে কোনো পোশাক সেলাইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে বুলবুল। হতেই পারে সেটা। মুসা দারোয়ান ভাবে, যে যার কাজ করছে করুক। অন্যের কথা না-ভেবে বরং পীরেরবাগের রাস্তাগুলোতে আরেক পাক পাহারার কাজ সেরে নেওয়া যাক। তারপর মোসলেম মিয়ার রিকশা আর ভ্যানের গ্যারেজের কোনো একটা টুলে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে সে ঝিমিয়ে নেবে একটু।

চতুর্থ রাতে নির্জনতা ফুঁড়ে ফের বুলবুলের দর্জির দোকান থেকে উঠে আসে সেলাই মেশিনের ভোঁতা আওয়াজ। গত তিন রাতের অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাপারটাকে ধর্তব্যের ভেতরে আর ধরে না মুসা দারোয়ান। আর তাছাড়া তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল বিধায় মোসলেম মিয়ার গ্যারাজের আশ্রয় থেকে বাইরে বেরোনোটাও সম্ভব ছিল না। শেষরাতে বৃষ্টি থামলে ফের টহলে বের হয়েছিল সে। টহল শেষ করে রাস্তার কাদাপানির ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বুলবুলের দর্জির দোকানটার সামনে দিয়ে মোসলেম মিয়ার গ্যারাজে ফেরার সময় সে দেখতে পায়, পা-মেশিনে বসে একমনে বুলবুল সেলাই করে চলেছে কোনো পোশাক। তখন সুবেহ সাদেক, পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। তারপর মোসলেম মিয়ার গ্যারাজে প্রতিদিনের মতো মুসা দারোয়ান ঘুমোতে যায়। শুতে যাওয়ার আগে তার মনে হয়, প্রস্রাব করে নেওয়াটা ভালো। তা না-হলে ঘুম গাঢ় হয়ে পড়লে আবার  প্রস্রাব করতে উঠতে হবে, যেটা চরম বিরক্তিকর একটা কাজ। ইদ্রিসের চায়ের দোকানের পেছনের ডোবার ধারে বসে প্রস্রাব করে উঠে দাঁড়ানোর পর সে প্রত্যক্ষ করে, অনতিদূরের মডার্ন টেইলরের সামনে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা কী তা বোঝার জন্য দর্জির দোকানের সামনে গিয়ে সে দেখতে পায়, দোকানের ভেতরে মোহাম্মদ বুলবুলের সঙ্গে কথা বলছে সাদা রঙের কিস্তি টুপি পরা বর্ষীয়ান আইনুদ্দিন। আইনুদ্দিনের পাশে টুপি মাথায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে অলি মিয়া, তোরাব উকিল এবং রজব দারোগা।

দর্জির দোকানের সামনের জটলার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা ইলেকট্রিশিয়ান বাবুর কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইলে বাবু মুসা দারোয়ানকে জানায় : আমতলা মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে ফেরার পথে তারা দেখতে পায়, একটা সবুজ কামিজ এবং একটা লাল সালোয়ার হাতে ধরে বারবার কামিজ আর সালোয়ারটার দিকে তাকিয়ে দেখছে বুলবুল। বুলবুল তখন তার কাটিং টেবিলের পিছের চেয়ারটায় বসে ছিল। শুধু তাই-ই নয়, সে অনর্গল কথা বলে চলেছে অদৃশ্য কারোর সাথে। কাজেই বুলবুলের সমস্যাটা কী, সেটা বুঝে দেখার জন্য বুলবুলের দোকানে আটকে গেছে তারা সকলেই। সমবেত মানুষজনের একই প্রশ্ন, উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত : পাগল হয়ে গেল নাকি বুলবুল দর্জি?

ঘটনাটার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসা দারোয়ানেরও একই কথা মনে হয় : সত্যিই তো! মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি মানুষটার? তা না-হলে সে এমন উলটোপালটা কাজ করতে যাবে কেন? কাজেই ঔৎসুক্য নিয়ে মুসা দারোয়ান ঢুকে যায় মডার্ন টেইলরের ভেতরে। সে শুনতে পায়, বুলবুলকে বোঝাচ্ছে তোরাব উকিল : তারা সকলেই নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে যে কাটিং টেবিলের সামনের টুলটায় কোনো মেয়ে কেন, কোনো মানুষই বসে নেই! ভুল বকছে বুলবুল – সেটা পরিষ্কার। মুসা দারোয়ান লক্ষ করে, নির্ঘুম বুলবুলের চোখ লাল হয়ে আছে ক্লান্তিতে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে তাকাচ্ছে একবার কাটিং টেবিলের সামনের টুলটার দিকে, আরেকবার তোরাব উকিল ও আইনুদ্দিনের চোখ বরাবর। ক্ষীণকণ্ঠে তোরাব উকিলকে বলছে বুলবুল, সে নিশ্চিত, হলুদ কামিজ আর কমলা সালোয়ার পরে এবং সাদা ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে তার সামনের চেয়ারে বসে আছে সোমা আখতার।

সোমা আখতার? নাম শুনে তো চেনা মনে হচ্ছে না মোটেই! কী তার পরিচয়? তখন বুলবুল তাদের জানাচ্ছে, এই সেই সোমা আখতার যে জুনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করে নিউ ফ্যাশন অ্যাপারেলে। শেওড়াপাড়া বাজারের পেছনে যে রহমান টাওয়ার আছে না, সেখানকার চারতলায় সোমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার চিড়াপাড়া নামের ছোট্ট একটা গ্রামে। তাকে চেনেন না আপনারা? দক্ষিণ পাইকপাড়ায় বিভিন্ন গার্মেন্টেসের নারী-শ্রমিকদের সাথে একটা মেসে সে ভাড়া থাকে। প্রতিদিন সকালবেলায় টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দলবেঁধে তারা সকলে পাইকপাড়া থেকে শিমুলতলার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেউ কাজে যায় শেওড়াপাড়ায়, কেউবা কাজীপাড়ায়। মৃত গার্মেন্ট-শ্রমিক শিলু পারভিন সোমা আখতারের মেসমেট ছিল। এক রাতে গাবতলী থেকে বাসে চেপে পলাশবাড়ি থানায় তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল শিলু পারভিন। শিলু পারভিনকে মনে আছে আপনাদের? গোবিন্দগঞ্জ পার হওয়ার পরে বাসেই শিলু পারভিন পয়লাতে ধর্ষিত হয়েছিল; খুন হয়েছিল তারপর। মনে আছে, একদা ওভারটাইম ডিউটি করার সময় নির্জন প্রোডাকশন ফ্লোরে সোমা আখতারকে যৌননির্যাতন করেছিল একজন সুপারভাইজার? এ নিয়ে সোমা মালিকপক্ষকে অভিযোগ জানানোর সাহস পর্যন্ত পায়নি! সরকার সোমা আখতারের জন্য ছয় হাজার চারশো টাকা মতো মজুরি বেঁধে দিলেও তাকে মাসকাবারে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মতো দেয় ফ্যাক্টরির মালিক। এই অর্থের ভেতরে বাসাভাড়া আছে, স্বাস্থ্যভাতাও আছে। বেতনের ইনক্রিমেন্ট পেতে তার বিলম্ব হয় সকল সময়ে, বোনাসের বেলাতেও তাই। ফ্যাক্টরির মালিক কেন এই কাজটা করে যাচ্ছে দিনের পর দিন তা তো আপনারা সকলেই জানেন! তা নিয়ে আর কথা না-ই বা বলি! এই সেই সোমা আখতার যে আর সব গার্মেন্ট শ্রমিকের সঙ্গে ন্যায্য মজুরির দাবিতে শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে পিকেটিং করেছে বহুবার; সেস্নাগান দিয়েছে গলা ফাটিয়ে। সোমাকে দেখেননি আপনারা কেউ? সে কী কথা?

বুলবুল হয়তো আরো অনেক কিছুই বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় আইনুদ্দিন। তারপর আইনুদ্দিন হতাশ ভঙ্গিতে বুলবুলকে বলছে, ‘সোমা আখতাররে আমরা চিনি না বাপ! তারে আমরা কেউই দেহিও নাই কুনুদিন! কিন্তু কী হইছে তুমার? তুমার সামনের টুলে তো কেউই বইসা নাই! ভালো কইরা তাকায়া দেহ তুমি! আর যেই রহমান টাওয়ারের কথা কইতেছ তুমি সেইডা তো ভাইঙ্গা মাটির সঙ্গে মিশায়া দেওয়া হইছে মাসদুয়েক আগেই! সেইখানে অহন হা-কইরা তাকায়া আছে ইয়া বড় একখান পুকুর! এইসব কী কইতেছ তুমি?’

কাটিং টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে আইনুদ্দিনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে বুলবুল। তার চোখে উঁকি দিচ্ছে তীব্র অবিশ্বাস। তারপর কাটিং টেবিলের সামনের টুলের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কাউকে লক্ষ করে তখন বুলবুল বলছে, ‘কী সোমা? কথা কইতে আছ না কা? তোরাব চাচারা কেউই তোমারে দেখতে পাইতেছে না কা – বলবা তুমি মোরে? চুপ হইরা খালি বইসা থাকলে চলবে নেকি?’

একটু থেমে আবারো বলছে বুলবুল, ‘দেহ, তুমার দেয়া ডিজাইন ঠিকঠাক ফলো করছি মুই! কামিজে কলার লাগাইছি, ভি-গলা দিছি, সালোয়ারখান বানাইছি ঢিলা কইরা। এইবার কিন্তুক তুমার সালোয়ার-কামিজের মাপ একদম ঠিকঠাক – ছোটও হইবে না, বড়ও হইবে না। দেখপা তুমি! মনে ধরছে সবুজ কামিজ-লাল সালোয়ারডা? সোমা! তুমি কথা কইতে আছ না কা? কী হইলে তুমার?’

এবার জটলার মানুষদের কিছু বুঝতে আর বাকি থাকে না : সোমা আখতার নামে বুলবুলের কোনো খদ্দের ছিল। রহমান টাওয়ারের ধ্বংসসত্মূপের ফাঁদে হয়তোবা মেয়েটা মৃত্যুবরণ করেছে! তাকে নিয়েই হয়তো বুলবুল কথা তুলছে বারবার! তখন তাদের মনে প্রশ্নটা আরো ঘনীভূত হয় : সোমা আখতারকে কেবল বুলবুল দেখতে পাবে, আর তারা কেউ দেখতে পাবে না – তাই কি সম্ভব? এর অর্থ খুবই সোজা : মাথার চেম্বারে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে বুলবুলের। এমন তো আজকাল শোনাই যাচ্ছে যে, রহমান টাওয়ারে যেসব সাধারণ মানুষ উদ্ধারকার্যে অংশ নিয়েছিল তাদের কেউ কেউ তীব্র মানসিক চাপের শিকার হয়েছে, কেউ কেউ আবার হারিয়ে ফেলতে বসেছে ভারসাম্য। তেমন একটা কিছুতেই নিশ্চয় আক্রান্ত হয়েছে বুলবুল! এই মুহূর্তে তবে তাদের কী করার আছে? এখন, এই ভোরবেলায়, ঘুম থেকে শরিফ ডাক্তারকে ডেকে তুলবে নাকি তারা? বয়স কম হলেও শরিফ ডাক্তারের হাত খুব ভালো।

এইসব নিয়ে যখন জোর আলোচনা চলছে, তখন ইলেকট্রিশিয়ান বাবু দোকানের রুপালি জগটা গড়িয়ে এক গস্নাস পানি ঢেলে খেতে দেয় বুলবুলকে। বুলবুল বিনা বাক্যব্যয়ে তার চেয়ারে বসে পানি খায়। তার চোখ তখনো ভয়ানক চঞ্চল – খুঁজছে কিছু চারদিকে। পানি দিয়ে একটা গামছা ভিজিয়ে বুলবুলের মুখম-ল মুছে দেয় তোরাব উকিল। তারপর তোরাব উকিল বুলবুলকে বলে, ‘বাজান! চলো! তুমারে তুমার বাইড়তে রাইখা আসি গিয়া। তারপর শরিফ ডাক্তাররে ডাইকা নিয়া আসুমনে। ওই বাবু! রিকশা ল তো একখান!’

পাশের গ্যারাজ থেকে তখন রহমত উল্লাহ তার নিজের রিকশাটা নিয়ে আসে। রিকশায় করে বুলবুলকে বাসায় নিয়ে যায় তোরাব উকিল। তারপর শরিফ ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসে রজব দারোগা। শরিফ ডাক্তারের পরামর্শে মোহাম্মদ বুলবুলকে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগ থেকে কিছু পরেই মোহাম্মদ বুলবুলকে তিনতলার একটা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় নিবিড় মানসিক চিকিৎসার জন্য।