অ্যামেলিয়া

॥ ২২ ॥

১৯ সেপ্টেম্বর

মঙ্গলবার …

পথ মসৃণ, তবু রক্ত লেগে থাকে, ভাবি স্বর্গে আছি,

         কিন্তু ছিলাম নরকে।

এক মাস পূর্ণ হলো রাইটাররা আইওয়ায় এসেছে। আজ সব শিকাগো গেল। সূর্যোদয়ের আগেই লম্বা এক বিলাসবহুল বাস এসে দাঁড়াল পার্কিংয়ে। ইয়াপের প্রতিনিধিরা তাড়া লাগলেন রাইটারদের। অমলিনী হাসিমুখে এসে দাঁড়াল তার ঘরের দরজায়। চোখে-মুখে ঘুমের আল্পনা। অনেকেই এসে বলছে, তুমি যাবে না কেন? সবচেয়ে অসহায় দেখাল সাইয়ুনকে। সে লাজুক। ইংলিশ খুব কম জানে। প্রথম থেকেই সে অমলিনীকে বন্ধু করে নিয়েছে। সে বলল, ‘শিকাগোয় একটা সুন্দর নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। বাবা বলেছিল সেটা যেন কোনো কারণেই বাদ না দিই। তুমি থাকলে দুজনে মিলে যেতাম।’

লিলি হ্বেবার দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। হেসে বলে উঠল, ‘মোলি আমাদের সঙ্গ পছন্দ করে না।’

অমলিনী প্রতিবাদ করল। ব্যঙ্গাত্মক স্বরে কথা বলা লিলির অভ্যাস।  হইহই করে বেরিয়ে গেল সব। ভোরের মিঠে হাওয়া ও নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে বাস বেরিয়ে গেল শিকাগোর উদ্দেশে।

ভেরোনিকা ও অমলিনী গেল না। ইয়াসমিনও রয়ে গেল লিখবে বলে। মাত্র দু-রাতের জন্য যাওয়া।  ২১ তারিখ বিকেলে ফিরে আসবে সবাই। অমলিনী কেন গেল না? এই এক মাস কয়েকটি কবিতা ও ইয়াপের অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় নিবন্ধগুলি ছাড়া আর কিছুই লেখেনি। সে মনোসংযোগ করতে চেয়েছিল। সবাই যখন চলে গেল, ফাঁকা করিডোরে অমলিনীর মন হু-হু করে উঠল। আর মাত্র দু-মাস। তারপর যে যার দেশে ফিরে যাবে। আর কি কখনো তাদের দেখা হবে?

এক উৎফুল্ল ছন্দে তাদের দিনযাপন শুরু হয়েছিল।

তর্ক-বিতর্ক, রাগ-অভিমান, দোষারোপ-অভিযোগ সত্ত্বেও খণ্ড খণ্ড আনন্দের মুহূর্তগুলি তাদের ক্রমশ এক নিবিড় বলয়ে পরিবেষ্টিত করছিল। তাকে ঘনতর করল বার্ন ভ্রমণ।

এর মধ্যে রাইটাররা একটা নিয়মে পড়ে গেছে। আমি দানিয়েল, আমিও সেই দলে ভিড়ে নিয়মাভিমুখী হয়ে পড়েছি। অদৃশ্য তুলি আর অপরূপ রঙে রাঙিয়ে নিচ্ছি আমার ক্যানভাস। আমার প্রেমহীন জীবনের সাময়িক পুনরুজ্জীবিত ধবধবে নির্মল পর্দা। তার ওপর ছায়া ফেলে আজো আকাশপথে উড়ে যান অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট। তিনি এক চিরউড্ডীয়মান সারসিনী। সাহসিকা সারসিনী। তিনি কখনো আমার অস্তিত্ব বিষয়ে অবহিত ছিলেন না। আমি তাঁকে স্পর্শ করিনি। তাঁর হৃদয়ে কান পেতে শুনিনি সুখ-দুঃখ-অবসাদ-আনন্দের ভাষা, যেমন আমি বিলগ্ন রয়েছি অমলিনীর সহায়। অমলিনী, অমলিনী, মলি – আমার নাতিপ্রলম্বিত জীবনে তুমি রং দিয়ো প্লিজ!

এই তিন মাসের প্রাত্যহিক পরিকল্পনা সুন্দর মুদ্রিত করে প্রত্যেক রাইটারকে দেওয়া আছে।

সোমবার, ২৮ আগস্ট পোমেরানজ সেন্টারে রাইটার্স প্রেজেন্টেশন দিলো হাসিন, ইয়াকভ, কাম্বা ও কাওরি। এরপর থেকে দিনগুলো নিয়মে বাঁধা হয়ে গেল।

সোমবার। বিকেল ৩টা থেকে ৫টা রাইটার্স প্রেজেন্টেশন। সন্ধ্যায় পার্টি।

মঙ্গলবার। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা। সাপ্তাহিক বাজার। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা রান্না করতে যাওয়া।

বুধবার। ৫০তম বর্ষকেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠান। সান্ধ্য পার্টি।

বৃহস্পতিবার। ওই। ওই।

শুক্রবার। সকাল ১১-৩০ থেকে দুপুর ১টা, পাবলিক লাইব্রেরিতে আলোচনা সভা।

দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪-৪০, অনুবাদের ক্লাস, শাম্বাগ হাউজ।

বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা রাইটারদের মৌলিক রচনা পাঠ।

শনিবার। ৫০তম বর্ষকেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠান। সান্ধ্য পার্টি।

রোববার। বিকেল ৪টা থেকে বিকেল ৫টা, প্রেইরি লাইটস বুক স্টোরে রাইটারদের মৌলিক রচনা পাঠ।

সন্ধে ৭টা থেকে রাত ৯টা, রাইটার ও ফিল্মমেকারদের আনীত বা নির্মিত ফিল্ম প্রদর্শন।

এর মধ্যে অধিকাংশ পার্টিতে যোগ দেওয়া সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত। ভেরোনিকা ও অমলিনী কোনোটিতে যায়নি। জেনিফার ও সাইয়ুন বাছাই কয়েকটিতে গিয়েছিল। অবশিষ্ট মহিলা রাইটাররা প্রতিটি পার্টিতে যোগদান করেছে। প্রচুর সাজগোজ করেছে। অনেক রাতে মদ্যপানের মৌতাতে কোলাহল করতে করতে ফিরেছে। পুরুষ রাইটারদের মধ্যে কাম্বা মাত্র দুটি পার্টিতে গিয়েছিল। বেশির ভাগ সময় সে দরজায় ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ ঝুলিয়ে রাখছে। ইয়াকভ ও জেরেমিস বাছাই পার্টি করেছে। জিয়াং সারাক্ষণ কবিতা লিখছে। চ্যাং, রুবা ও হাসিন প্রগাঢ় বন্ধুত্বে জড়িয়ে পার্টিতে, বারে, আড্ডাঘরে, নিজের ঘরে প্রচুর মদ্যপান করছে। বাকিরা নিয়মিত পার্টি করে, মদ খায়, পার্টি না থাকলে বারে যায়, মদ্যমথিত স্বরে কোলাহল করতে করতে, স্খলিত পদবিক্ষেপে টলতে টলতে মধ্যরাতে ফেরে! প্রতিটি সকালে আড্ডাঘরে কোলাহলপূর্ণ আড্ডা জমে। কখনো হাসি, কখনো তর্ক, কখনো আলোচনা বা স্রেফ মনের কথা। কোনো কোনো সন্ধ্যায় বসে গানের আসর। ইয়াকভ, জেরেমিস, অমলিনী, রোজানা শুরু করে। আস্তে আস্তে অন্যরা জুটে যায়। বার্ন পার্টিতে যাওয়ার দিনটা ছিল রবিবার। সারাদিন ডেনদের ফসলক্ষেতে বেড়ানো ও খানাপিনা। 

সকালবেলা আটটার সময় বেরিয়ে পড়তে হবে। ঠিক সময়ে বেরুতে সবচেয়ে বেশি মুশকিলে পড়ে মোলি ও হারিক। সফলভাবে প্রাতঃকৃত্য না করে অমলিনী নিশ্চিন্তে বাইরে যেতে পারে না। এর জন্য তাকে বহু সাধ্যসাধনা ও পরিকল্পনা করতে হয়। একেবারে রাত থাকতে উঠে সে পরপর দু-গ্লাস ইসবগুলের ভুসি মেশানো জল খেল। চা খেল এক পট। কফি মেকারে জল চাপিয়ে ঘরখানা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিল। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সবুজ সুন্দর মাঠ। অমলিনীর মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। তাদের বাড়ির কাছে এমনই এক মাঠ ছিল। এই সকালে সেই মাঠে কেউ নেই, এখানকার মতো, প্রায় অসম্ভব। সেখানে ভোরের বেলা দুধ দুইয়ে গরুগুলোকে মাঠে বেঁধে রেখে আসে গোপালক পরিবারগুলি। ছাগল বন্ধনহীন ঘাস খায়। কতিপয় বুড়ি বাঁশের চুবড়ি নিয়ে ঘোরে ফেরে গোবরের সন্ধানে। বেলা গড়ালে ছেলেরা খেলতে আসে যখন, তাদের দেশের মাঠ আর আমেরিকার এই আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ একাকার হয়ে যায়!

সাতটা বাজতেই রাইটাররা প্রাতঃরাশের ঘরে হামলে পড়ল। অমলিনী কফি পান করে স্নানঘরে প্রবেশ করল। এলোমেলো চুল নিয়ে হারিক তখন দ্রুত দাঁত মাজছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সকালের খাবার নিয়ে এলো ঘরে। একটা গোটা ডিম মুখে পুড়ে চিবোচ্ছে। স্যুটকেস থেকে এক-একটা পোশাক নিচ্ছে আর ছুড়ে ফেলছে বিছানায়। কোনোটা মনমতো হচ্ছে না। কোন পোশাকে তাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখাবে কিছুতেই স্থির করতে পারে না সে। ফলে সব কাজে দেরি হয়ে যায়। তার দরজায় টোকা পড়ছে। শবনম কর্কশ কণ্ঠে হাঁক পাড়ছে – ‘হোয়াত আর ইউ দুয়িং? ইউ অলতাইম লেত। কাম হারিক কাম। পিকআপ কার ইজ অ্যাবাউত তু স্তার্ত।’ দড়াম করে দরজা খুলল হারিক। শবনমের পেছন থেকে ইয়াসমিন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও মাই গশ! তুই করছিসটা কী!’

হারিক কচ্কচ্ করে আপেল খেতে খেতে বলল, ‘আরে কী পরব ভেবে পাচ্ছি না।’

শবনম : সাঁতারের পোশাক পর। ইরাকের হারিক এখানে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

ইয়াসমিন : হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে ভুট্টাক্ষেতে সাঁতরাবি!

শবনম : ভুট্টাক্ষেত? আমরা কি ভুট্টাগাছ দেখতে যাচ্ছি নাকি?

ইয়াসমিন : না তো কী? হোয়াইট হাউস যাচ্ছি?

শবনম : যাওয়ার তো কথা।

ইয়াসমিন : সেটা আজ নয় বন্ধু। আমরা বার্ন পার্টিতে যাচ্ছি। ক্ষেত খামার গোশালা অশ্বশালা দেখতে।

হারিক : দেখ তো, এই টপ চলবে?

শেষ পর্যন্ত একটা কালো পোশাক নিয়েছে হারিক।

ত্বক-কামড়ানো জিন্স ট্রাউজারের ওপর কালো শার্ট। চুল খোলা।

কলার খোসা ছুড়ে ঘরের কোণে ফেলে কলা খেতে খেতে বেরিয়ে এলো হারিক। এতো তাড়াহুড়োয় মুখের প্রসাধন ভোলেনি কেউ।

দশখানা গাড়ি বোঝাই হয়ে চলেছে ইয়াপের রাইটার ও সদস্যরা। একসময় শহর ছেড়ে সবুজ ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে থাকা মসৃণ পথ বেয়ে তারা চলতে লাগল।

কাব্যসাহিত্যের শোভাযাত্রা। কবি-সাহিত্যিকের মর্যাদাপূর্ণ বহর। কনভয়। এমন সমাদর, এমন গুরুত্ব, এমন নিশ্চিন্ত জীবন এই রাইটাররা নিজের দেশেই কি কখনো পেয়েছে?

ইয়াকভ, মোলি, কাম্বা, লিলি এক গাড়িতে। চালকের আসনে অ্যাফ্রো-আমেরিকান জর্জ। তার পাশে ইয়াপের সদস্য ম্যাট।

ইয়াকভ বলে উঠল, ‘মোলি একটা গান গাও প্লিজ।’

কাম্বা বলল, ‘ওয়ান ফ্রম বব ভিলান।’

মোলি গুনগুন করে ধরল –

Hey, Mr. Tambourine Man, play a song for me

I’m not sleepy and there is no place I’m going to…

দারুণ, দারুণ! সবাই হইহই করে উঠল। জর্জ পর্যন্ত গলা মেলালো। জর্জের গলা গমগম করে উঠল। উদাত্ত ও সুরেলা। অমলিনীর মনে হলো, তার নিজের দেশের প্রিয় গায়ক জর্জ বিশ্বাস স্বয়ং গাইছেন বব ডিলানের গান। সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বিভাসিত হতে লাগল আশ্চর্য সুর ও মনমাতানো কথা।

Take me on a trip upon your magic swirling ship

My senses have been stripped

My hands can’t feel to grip

My toes too numb to step

Wait only for my boot heels to be wandering

I’m ready to go anywhere. I’m ready for to fade…  (চলবে)