॥ ৫ ॥
আড্ডা ভাঙল। প্রথম সকালের পক্ষে যথেষ্ট বেশি। যে যার ঘরে ফিরতে লাগল। উপদলগুলো তৈরি হয়ে গেল আপনা-আপনি। রুথ-কাম্বা। ইয়াকভ-জেরেমিস। অ্যালেক্স-জিনেট-ইয়েরমেন। রুবা-জেনিফার! লোরেনটিনা-আদনাশে। কেবল অমলিনীর সঙ্গে কেউ নেই, আমি ছাড়া। তাতে অমলিনীকে সঙ্গগত বলা চলে না। এ মহাবিশ্বে আমিই আমার কাছে অর্থপূর্ণ। আমার কাছেই আমি অস্তিত্বময়। তা হোক। আমার পা-ুলিপি রচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক লেখক উপনিবেশে আমিও এক অদৃশ্য অংশীদার হয়ে উঠেছি। আমার মন ভালো আছে, কারণ অমলিনীর মন ভালো। আজ সকাল থেকে যত বিতর্ক, আলোচনা, তার মধ্যকার তাত্ত্বিকতা ও বৌদ্ধিক দিকটিতে সে ভারি সন্তুষ্ট। এমনটিই সে আশা করেছিল। ঘরে ফিরে সে ভাবতে লাগল খিদে পেয়েছে কি পায়নি। সারাঘর দেখতে লাগল ঘুরে ঘুরে। এত বড় ঘরে এই পরিমিত আসবাবপত্র তার ভালো লাগছিল না। লেখার টেবিল ও আর সবকিছুই মেহগনি-রঙা প্লাই দিয়ে তৈরি। শুধু একটি টেবিল স্টিল ও প্লাস্টিকের সস্তা উপস্থিতি। এই ঘরে সেটি একেবারে মানানসই নয়। সম্ভবত খাবার টেবিল হিসেবে এটি ব্যবহারের উদ্যোগ। সে পড়ার টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ল। প্লাগ পয়েন্টগুলো খুঁজে খুঁজে উপড়ে নিল। ইলেকট্রিক কেটলি ও ল্যাম্পের সংযোগ। টেনে টেনে পড়ার টেবিলটি নিয়ে গেল জানালার দিকে। এখানে লিখতে বসলে চ্যাপেলটি চোখে পড়বে, তার সঙ্গে নদীর টুকরো। এটি সে একটু আগে আবিষ্কার করল। এখান থেকে চমৎকার লাগছে জলের ওপর রোদ্দুরের ঝিকিমিকি খেলা।
স্টিলের টেবিলটি সে টেনে আনল লেখার টেবিলের জায়গায়। ইলেকট্রিক কেটলি রাখল। চা-কফির কৌটো। জলের বোতল। তার তলানি দশা দেখে জল আনতে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। একটাই বোতল যথেষ্ট নয়। তার আরো গোটাচারেক বোতল দরকার।
ওয়ারড্রোব থেকে ইস্ত্রি করার সরু লম্বা টেবিল বের করে, তার ভাঁজ খুলে দেয়ালের এক কোণ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিলো। একটি সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিলো তার বহু ব্যবহারের দাগ। ন্যাপকিনের বাক্সটি রাখল তার ওপর। লেখার টেবিলে বই, খাতা, ডায়েরি সাজাল। স্টিলের চেয়ারটি ঘরের এক কোণে রাখল। অতিথি এলে বসতে পারবে। ধবধবে সাদা বিছানা দেখে তার হাসপাতালের কথা মনে পড়ছিল। খুব সুন্দর কারুকাজ করা কালো কাশ্মিরি শাল নিল সে। বিছানার মাঝবরাবর পেতে দিলো। এবার ঝলমলিয়ে উঠল ঘরখানা। যেন আমারই মতো, ভূমিগর্ভের নিষ্প্রাণতা থেকে প্রাণময়ী পৃথিবীতে উঠে এলো প্রেমপিয়াসী সত্তা। সে খুশি হয়ে উঠল। বোতল নিয়ে জল আনতে বেরোল।
বেরোতেই ইয়াকভের সঙ্গে দেখা। অমলিনী দেখল তার ঘরের ঠিক উলটোদিকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার দরজা।
ইয়াকভ : কোথায় যাচ্ছ?
মোলি : এই তো, জল আনতে।
ইয়াকভ : জল আনতে? খাবার জল? কোথায়?
মোলি : ওই দরজা ঠেলে সোজা, অপর প্রান্তে।
ইয়াকভ : আমি তো বাথরুমের কলের জল খাচ্ছি। কিছু হবে না। খেয়ে নাও। আমেরিকায় সব শুদ্ধ।
মোলি : তুমি কোথায় যাচ্ছ?
ইয়াকভ : খেয়ে আসি। সেই সকালে কী খেয়েছি, থাকে নাকি পেটে! তুমি যাবে?
মোলি : দেখি। স্নান হয়নি এখনো।
ইয়াকভ : স্নান হয়নি? এতক্ষণ কী করলে? চলো চলো। কটা বাজে দেখো একবার।
সারার দেখিয়ে দেওয়া দরজা খুলতেই অবাক হয়ে গেল অমলিনী। বাড়িটা যে কত বড় এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তার ডানদিকে পরপর ঘরগুলোয় ক্যান্টিন, গবেষণাগার, আলোচনাকক্ষ। বাঁদিকে তিনটি প্রার্থনাগৃহ। যার যখন খুশি এসে যোগ, ধ্যান, নামাজ, প্রার্থনা করতে পারে। এদিকে আরো একজোড়া লিফট। টয়লেট। অনেক অফিস, গবেষণাগার এবং সুবিশাল বলরুম। তার সামনে কয়েকটি সোফা ও টেবিল। চারদিকে বসার ব্যবস্থার ছড়াছড়ি। বলরুম পেরিয়ে পানীয়জলের কল। একটি পাত্রে ভরার, একটি মুখ লাগিয়ে খাবার। এয়ারপোর্টেও এমন ব্যবস্থা সে দেখেছে। বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। জল গড়িয়ে গলা-বুক ভিজে ওঠে। বোতলে জল ভরে সে ফিরে এলো। এতক্ষণে তার মনে হলো, দেরি হয়ে গেছে। জল আনতে যাওয়ার পথে যে-ক্যান্টিন, ছাত্রছাত্রীরাই চালায়, সেখানে গেল কিছু খাবার কিনতে। দুজন ছাত্রী স্মার্টফোনে খেলা করছিল। সে দাঁড়াতে একজন বলল, ‘তুমি কি গেস্ট?’ অমলিনী বলল, ‘হ্যাঁ। আমি রাইটার্স ওয়ার্কশপে এসেছি।’
‘তোমার ফেলোশিপ কার্ড আছে?’
‘না তো!’
‘তা হলে তোমাকে খাবার বিক্রি করতে পারব না।’
‘কিন্তু আমি তো অতিথি হিসেবে নথিভুক্ত! তাছাড়া খাবার তো আমি কিনব।’
‘আমরা দুঃখিত।’
সে ঘরে ফিরে এলো। ঘড়ি দেখল। দুটো বেজে দশ। সে ফ্রিজ খুলল। কিছু শুকনো খাবার রাখা ছিল। চকোলেট। বাদামের খাজা। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে সে খাজা চিবোতে লাগল। প্রচ- মিষ্টি। সে একবার গতরাতের বাড়তি খাবারটা দেখল। ওটা খেতে হবে ভাবলেই ভয় করছে; কিন্তু অতগুলো ডলার। না না, ফেলা চলবে না! আজ রাতে খেয়ে নেবে গরম করে।
নিচে যখন পৌঁছল সে, প্রায় সবাই এসে পড়েছে। লবি-উপচানো ভিড়। ক্যাঁচরম্যাচর, বকম-বকম, হাহা-হিহি। একটি মেয়েকে আলতো জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেরেমিস। সে ইন্দোনেশিয়ার ওকিওকি এগাগামি। রোগা, ছোটখাটো ওকির মাথায় রুমাল বাঁধা। যাকে ঠিক হিজাব বলা যাবে না।
সকালের ভারতীয় চেহারার মেয়েটিকে দেখতে পেল অমলিনী। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছে। সে এগিয়ে গেল।
অমলিনী : তুমি কি ভারতীয়? তোমার নাম কী?
মেয়েটি হাসল। বলল, ‘ইয়াসমিন হাসান। ফ্রম পাকিস্তান। তুমি তো অমলিনী। ইন্ডিয়ান।’
অমলিনী : সো, অ্যান ইন্ডিয়ান অ্যান্ড অ্যা পাকিস্তানি ফেস টু ফেস নাউ?
দুজনেই হাহা করে হেসে উঠল। জড়িয়ে ধরল পরস্পরকে। ধরেই থাকল, যতক্ষণ না পরস্পরের ঘ্রাণ পরিচিত হয়ে ওঠে, যতক্ষণ না যথেষ্ট উষ্ণতার আদান-প্রদান হয়। যেন তারা দুজন, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের যাবতীয় শত্রুতা মুছে না দেওয়া পর্যন্ত পরস্পরকে ছাড়বে না। কীসের এই আবেগ? কেন এই আবেগ? তারা কেউ কাউকে চেনে না। কোনো নাট্যকারের রচিত সংলাপ তারা মুখস্থ করে আসেনি। দুই প্রতিবেশী শত্রুদেশের নাগরিক, যারা সত্তর বছর আগে অভিন্ন ছিল!
অমলিনী : থ্যাংকস ফর দিস ওয়ার্ম হাগ।
ইয়াসমিন : থ্যাংকস ফর ইয়োর হার্টিয়েস্ট হাগ টু। বিশ্বাস করো, তোমার এই আলিঙ্গনের মধ্যে একটা শান্তি আছে।
অমলিনী : শুনে ভালো লাগল ইয়াসমিন। তুমি কিন্তু আমার নামটা একেবারে সঠিক উচ্চারণ করেছ।
ইয়াসমিন : আমার পক্ষে সহজ। আমার দিদিমা ভারত ছেড়ে এসেছিলেন। আমাদের পরিবার থাকত লখনৌতে। দিদিমার প্রিয় বান্ধবীর নাম ছিল শকুন্তলা। বাঙালি। কত বছর আগেকার কথা, কিন্তু দিদিমা শকুন্তলাকে ভোলেননি। আমৃত্যু দুজনের চিঠি-বিনিময় হয়েছে। ভালো কিছু রান্না করলেও দিদিমার মনে হতো, আহা, শকুন্তলা যদি থাকত!
অমলিনী : জানো, মাত্র গতকাল আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিল, কোনো পাকিস্তানি রাইটার এলে তাঁর সঙ্গে আমি কী আচরণ করব!
ইয়াসমিন : অনেকেরই কৌতূহল মোলি।
তারা পরস্পর নিবিড় চোখে তাকাল। সৃষ্টির কোনো দেশ নেই। স্রষ্টার কোনো শত্রু নেই। ঈষৎ স্থূলাঙ্গী খর্বকায় ইয়াসমিন বড় ঢলঢলে। তার চোখে গাঢ় সুরমার টান। তারও তলায় কোনো এক অজানিত দুঃখের গাঢ় কালিমা। পুনরায় চঞ্চল পায়ে ছবি তুলে বেড়াতে লাগল সে।
গুঞ্জন ছাপিয়ে একটি সরু কণ্ঠ ধ্বনিত হলো। মেডেসা মেডেসা মেডেসা মার্টিন!
মেডেসা : মাই ডিয়ার রাইটার্স। অ্যাটেনশন প্লিজ।
আমি মেডেসা মার্টিন। তোমাদের শত শত চিঠি লিখে বিরক্ত করেছি। তোমাদের এখানে পেয়ে আমরা যে কতখানি নন্দিত, বলে বোঝাতে পারব না। আমরা ধন্য। আমরা পুলকিত। তোমাদের সঙ্গ আমাদের সমৃদ্ধ করবে। এখন তোমাদের শহর দেখাতে নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে যাবে অ্যাঞ্জেলিনা গ্রিনবার্গ। ইয়াপের প্রাক্তন ছাত্রী, এখন কর্মী। আর এ হলো সিন্থিয়া। সিন্থিয়া মিল্কম্যান। সে-ও থাকবে।
মেডেসা, সিন্থিয়া আর অ্যাঞ্জেলিনা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ওই আমাদের ওল্ড ক্যাপিটল বিল্ডিং। আমাদের সমবেত ছবিটি সেখানেই তোলা হবে। এদিকে আইওয়া অ্যাভিনিউ। এর ঠিক সমান্তরাল জেফারসন স্ট্রিট। ইমুর পাশের রাস্তা। আরো দক্ষিণে গেলে ওয়াশিংটন স্ট্রিট, বার্লিংটন স্ট্রিট। উত্তরে মার্কেট স্ট্রিট। ওই হলো ইউ-আইওয়া লাইব্রেরি। এই আমাদের ফার্মেসি মার্কেট। এখানে ইউনিভার্সিটির অনেক হল এবং রুম আছে। তোমরা মার্কেটটা ভালো করে দেখে নাও। এরপর আমরা ডাউনটাউন বিজনেস ডিসট্রিক্টে যাব।
তারা দেখতে লাগল। ফার্মেসি মার্কেট শুধু ওষুধের দোকান নয়। সংসারের নানা জিনিস পাওয়া যায়। অনেকেই কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অমলিনী ঘুরে ঘুরে অন্য দোকানপাট দেখছিল। বেশকটি রেস্তোরাঁ। অলংকারের দোকান। ঘড়ি সারাই, সেলফোন সারাই। সে নিজের সেলফোনের গতি করতে চাইল, কিন্তু দোকানে কেউ নেই। রোববার দোকান বন্ধ। দেখে বন্ধ মনে হচ্ছে না। খোলা দোকান। কাচের আলমারিতে জিনিসপত্র। সে দেখল লোরেনটিনা, আদনাশে আর সাউথ আফ্রিকান ইধাম্বো মেইমি গয়নার দোকানে ঘুরছে। লোরেনটিনার সাজ দেখার মতো। অনেকটা ভারতীয় কুর্তির মতো কিন্তু মাটিছোঁয়া, বিভিন্ন জায়গায় ঝালর-লাগানো পোশাক। বেগুনি রং। তার ওপর ঘন পুুঁতির কাজ। হাতভরা সোনার অলংকার। গলায় পাথরখচিত নয় লহরি হার, কানে ঝুমকো। চুলেও গেঁথেছে ঝিকিমিকি। সকালে সে পরে ছিল রুপোর গয়না। অমলিনীর হাত টেনে তার বাঁহাতের চারগাছি চুড়ি দেখে বলল, ‘গোল্ড? এরকম অনেক আছে তোমার?’
অমলিনী আফ্রিকান দলটায় না ঢুকে সামনে একটা চীনা রেস্তোরাঁর বাইরে লটকানো মেন্যু বোর্ড ও তার দাম দেখতে লাগল। রঙিন সব খাবারের ছবি। দামও বেশি নয়। তিন থেকে শুরু করে পঁচিশ ডলার পর্যন্ত। ওকিওকি তার পাশে এসে দাঁড়াল। হেসে ইশারা করল, ‘যাবে?’
তারা ভেতরে গেল। সে ভাবতে লাগল খাবার নেবে কিনা। সস্তার ডিশ সব বিফ। তার অপেক্ষা না করেই ওকিওকি এক থালা খাবার নিয়ে খেতে বসে গেল। সে বেরিয়ে এলো। মেডেসা, সিন্থিয়া, অ্যাঞ্জেলিনা ও কয়েকজন রাইটার জটলা পাকিয়ে গুলতানি করছে। সে ক্লান্ত বোধ করতে লাগল। অল্প দূরে একটা লম্বা চেয়ারে জেরেমিস বসে আছে। সে জেরেমিসের পাশে বসল। জেরেমিস একটু হাসল।
জেরেমিস : বোকার মতো লাগছে।
মোলি : কেন?
জেরেমিস : এর চেয়ে আমাদের ঘুমোতে দিলে হতো না? এসব তো বাচ্চাদের চেনায়। ওই দেখো লাইব্রেরি! ওই যে ওটা মার্কেট। এরপর বলবে, ওই যে গাড়ি! ওই যে কুকুর!
মোলি : রেগে আছ দেখছি।
জেরেমিস : এ তো পুঁচকে শহর! এত চেনানোর কী আছে? স্যান্ডউইচ পাওয়া যাবে বলল, সেটা কোথায়?
হংকংয়ের জিয়াং জাও জেংকে দেখতে পেল অমলিনী। তাইওয়ানের চ্যাং চুন চেনের সঙ্গে ঘুরছে। গাট্টাগোট্টা চ্যাঙের মাথা ন্যাড়া। চিবুকে ছাগলদাড়ি। চৈনিক চেহারা। চার ফুট উচ্চতা। একটি কালো কাপড় অনেকটা লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে উত্তরীয়। তাকে দেখলে বৌদ্ধ-সন্ন্যাসী মনে হয়।
অমলিনী : হাই জিয়াং। হাই মঙ্ক।
জিয়াং : হাই মোলি। মঙ্ক কে?
মোলি : চ্যাং, তোমাকে আমি মঙ্ক বলে ডাকতে চাই। তুমি কি আপত্তি করবে?
চ্যাং : নো ইংলিশ। ম্যান্ডারিন।
মোলি : ইউ মঙ্ক। বুড্ডিস্ট মঙ্ক।
চ্যাং : হা হা হা! মঙ্ক! বুদ্ধা? ইউ বুড্ডিস্ট?
মোলি : না, আমি হিন্দু। ইন্ডিয়ান।
চ্যাং : ইউ ইন্ডিয়ান? ইউ শিভা?
জেরেমিস : শিভা? তুমি কি শিয়া? হিন্দুরা শিয়া হয়?
মোলি : না। শিভা, মানে ভগবান শিব। হিন্দুদের মূল তিন দেবতার একজন। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু প্রতিপালক, শিব প্রলয়কারী আবার স্রষ্টা। এছাড়া নারী-দেবতা আছেন। শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
জেরেমিস : কতজন দেবতা তোমাদের?
মোলি : শুনেছি তেত্রিশ কোটি।
জেরেমিস : তেত্রিশ কোটি? পাগল নাকি তোমরা?
মোলি : একশ কুড়ি কোটি মানুষের দেশে তেত্রিশ কোটি দেবতা। ঠিকই তো আছে।
জেরেমিস : সবার নাম জানো?
মোলি : অসম্ভব। কেউ জানে না। আমাদের দেশ বিস্ময়কর জেরেমিস। এখানে নিরন্তর দেবতার জন্ম হয়। একটা পাথর, একটা গাছ, কোনো গাছের শিকড়, ঢিবি যা কিছুই আঞ্চলিক দেবতা হয়ে উঠতে পারে। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া জড়িত কিংবা কল্পিত কোনো গল্প, মিথ দেবদেবীর জন্ম দেয়। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিষেধ নেই। পণ্ডিতরা বলেন, হিন্দুধর্ম আসলে একটা সংস্কৃতি। হিন্দুদের মধ্যে একেশ্বরবাদী আছে, নিরীশ্বরবাদী আছে, বহুত্ববাদী তো আছেই।
জেরেমিস : খুবই আগ্রহব্যঞ্জক।
জিয়াং : আমার কোনো ধর্ম নেই।
চ্যাং : আমারও নেই। কিশোর বয়সে আমি একবার সন্ন্যাসী হবো বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। ছয় মাস একটা মঠে ছিলাম। তখনই আমি বুঝেছি ধর্ম কিছু নিয়মকানুন মাত্র। সেটা তো একজন নিজের মতো করে তৈরি করতে পারে। আমার ধর্মে কোনো আগ্রহ নেই।
চলো, চলো, চলো! আহ্বান এলো আবার। শবনম, রোজানা, লোরেনটিনা, ইরাকের হারিক এল ওমের ইতোমধ্যেই অনেক বাজার করেছে। তারা থলে বইতে বইতে চলল।
এই আমাদের বিজনেস ডিসট্রিক্ট। দেখো কতরকম দোকান। বড় হোটেল শেরাটন। ওই আমাদের আইওয়া পাবলিক লাইব্রেরি। বিভিন্ন বিষয়ের যে-সেমিনার, তা ওখানেই করব আমরা। এদিকে ডেবিকিউ স্ট্রিটের মুখে ব্যাংক, যেখানে তোমাদের অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। তারপর আমরা যাব প্রেইরি লাইটস বুক শপ। ওই যে দেখছ ব্রেড গার্ডেন, ওটা খুব ভালো বাজার। খুব কাজে আসবে তোমাদের।
ডাউনটাউন ভ্রমণ শেষ করে তারা যখন আবার ইউ-আইওয়া পৌঁছল, তখন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর জমায়েত। জোরে গান বাজছে। কেউ বাঘ সেজেছে। কেউ ভালুক। কেউ স্রেফ জোকারের মুখোশ লাগিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে। কচি-সরল মুখগুলোয় খুশির ঝলক। অমলিনীর মনে হলো, এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে শারীরিক মিলনের স্বাদ পেয়ে গেছে, কিন্তু মনের সারল্য মোছেনি। এভাবে বাঘ-ভালুক সেজে আমোদ করার কথা ভারতের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ভাবতেও পারে না। তারা অনেক বেশি আত্মসচেতন, সমাজসচেতন এবং পরিণতমনস্ক। অবশ্য এই স্টুডেন্টরাও পরিণতমনস্ক নয় এ-কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আবার ভারতেও সব ছাত্রছাত্রীই সমাজসচেতন, এমনটা বলা যায় না। তবু মনে হয় এখানকার ছাত্ররা অনেক বেশি স্বাধীন, অনেক বেশি সহজ। আমেরিকান সংস্কৃতিতে ছোটদের ‘না’র অসহনীয় অকারণ শাসন নেই। এটা করো না, ওটা করো না, এখানে যেও না, ওর সঙ্গে মিশো না – এমন অগুনতি নিষেধ ওদের সংস্কৃতির মধ্যে নেই। ছোটদের বুঝতে দিতে হয়। অনুভব করাতে হয়। এখানে ওদের আছে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা এবং উত্তর পাওয়ার অধিকার।
সেসব নব্য ও পুরনো ছাত্রদলে তারা মিশে রইল। হরিণশিশুর খেলায় একদল পরিণত মোষ। মেডেসা, সিন্থিয়া ও অ্যাঞ্জেলিনা তাদের একটি বিশাল তাঁবুতে নিয়ে এলো। লাউড স্পিকারে নবাগতদের উদ্দেশে ভাষণ চলছে। কে সেই ভাষণ দিচ্ছেন, কোথা থেকে দিচ্ছেন কিছুই বোধগম্য হলো না অমলিনীর। ছাত্রদের কেউ তাদের সম্ভাষণ করল না। এমনই ভাবলেশহীন যেন তাদের দেখাই যাচ্ছে না।
তাঁবুটিতে সারি সারি গামলায় রাখা পাউরুটি, চিকেন, বিফ, সালাদ, সস। তারা পরপর দাঁড়িয়ে ইচ্ছামতো সালাদ, চিকেন বা বিফ স্যান্ডউইচ বানিয়ে ঘাসের ওপর বসে খেতে লাগল। বরফে চুবোনো ঠান্ডা পানীয়র ক্যান খুলে ঢালতে লাগল গলায়। আমাদায়ুং সু আং হঠাৎ বলে উঠল – ‘সো, উই আর ইন আমেরিকা।’
অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিস জুন অল্প হাসল। কাম্বা ঘালোন্দা স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বলল, ‘তোমাদের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারটা কী?’
আমাদায়ুং : স্মার্টফোন খোলো, অসংখ্য খবর পেয়ে যাবে।
কাম্বা : সে তো আছেই। কিন্তু খবর এক বস্তু, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞতা অন্য জিনিস। ঠিক আছে, তুমি আলোচনা করতে চাইছ না, কিছু মনে করো না। জেরি সাইনফিল্ড কী বলেছে জানো? ওঃ’ং ধসধুরহম ঃযধঃ ঃযব ধসড়ঁহঃ ড়ভ হবংি ঃযধঃ যধঢ়ঢ়বহ রহ ঃযব ড়িৎষফ বাবৎুফধু ধষধিুং লঁংঃ বীধপঃষু ভরঃং ঃযব হবংিঢ়ধঢ়বৎ.
আমাদায়ুং : নিজের চরকায় তেল দাও তো। তোমার নাইজিরিয়ায় সমস্যা নেই? তোমরা তো বর্ণবিদ্বেষী। ওঃ! তুমিও তো মুসলিম! তাই বলো!
কাম্বা : আমি মুসলিম। তো? সমস্যা কোথায়? আমি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি। আমার ধর্ম আমাকে কাউকে ঘৃণা করতে শেখায়নি।
আমাদায়ুং : গুলি মারো। আমি এসব আলোচনা চাই না। কবিতা লিখি, তাই আমি এখানে।
মোলি : এখান থেকে আমরা কোথায় যাব?
অ্যালিস : আমাদের ছুটি। আমি ব্রেড গার্ডেন যাব। যাবে তোমরা কেউ?
মোলি : চলো আমি যাব। কিছু খাবার-দাবার কেনা দরকার।
অ্যালিস : আমাকেও কিনতে হবে।
মোলি : তুমি সপরিবারে আছ?
অ্যালিস : হ্যাঁ। শুধু ইয়াপ তো নয়, আমি এখানে একটা বৃত্তি পেয়েছি। গবেষণা করছি। প্রায় নমাস থাকতে হবে। অ্যাপার্টমেন্ট নিতে হলো কারণ আমার মেয়ে আর স্বামী প্রায়ই চলে আসতে পারবে। মেয়েটা এত পুঁচকে, বেশিদিন ছেড়ে থাকা যায় না।
খাওয়া শেষ করে একটি হাফ লিটার জলের বোতল ব্যাগে পুরে নিল অমলিনী। সে, অ্যালিস, সাইয়ুন, চ্যাং, জিয়াং ও নিবাস চলল ব্রেড গার্ডেন। আইওয়ার মূল শহর এলাকা ডাউনটাউন। জায়গাটাকে গ্রাম বললেও ভুল হয় না। অমলিনী খুবই বিস্মিত হচ্ছিল ভেবে যে, এখানে ওয়ালমার্ট নেই কেন। প্রশ্নটা সে অ্যালিসকে করে ফেলল। অ্যালিস বলল, ‘এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল। শহরের আরো অংশ রয়েছে। অনেক দূরে দূরে একেকটি জায়গা। খুবই ছড়ানো। আমেরিকায় জায়গার অভাব নেই। তাই দেখো, সবই কেমন বিশাল। অনেকখানি জুড়ে। ওয়ালমার্ট ইত্যাদি সবই আছে। দশ-পনেরো কিংবা পঁচিশ মাইল দূরে।’
ব্রেড গার্ডেন একটি মার্কেট এবং রেস্তোরাঁ। বাইরে চেয়ার-টেবিল পাতা। উলটোদিকে ছোট্ট একটি প্লে পার্ক। ছোট্ট বাচ্চারা খেলছে। তারা দেখল, রাইটারদের অনেকেই এসে বসেছে। কারো সামনে খাবার।
চ্যাং : স্যান্ডউইচ অখাদ্য।
অ্যালিস : দেখো, এখানে কাঁচা এবং রান্না করা, সবরকম খাবার আছে।
মোলি : আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। একটু চাল যদি পেতাম!
তারা ঘুরে ঘুরে বাজারের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। অমলিনী পাউরুটি, ডিম, মাখন, নুডলস, বিস্কুট, মাশরুম, ক্যাপসিকাম নিল। হঠাৎ চ্যাং লাফাতে লাফাতে এলো তার কাছে। ‘ইউ? রাইস? কাম, কাম! সি! রাইস! টেক, টেক!’
মধ্যবয়সী চ্যাং শিশুর মতো বিস্মিত ও উত্তেজিত। মোলি এক প্যাকেট চাল নিল। চ্যাং আবার তাকে ডাকতে লাগল। ‘সি। লুক, লুক।’ [চলবে]
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.