করোনাকালীন ছায়া কাটিয়ে এখন সবকিছুই অনেকটা স্বাভাবিক। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনেও লেগেছে প্রাণের ছোঁয়া। এরই মাঝে গত ২৮শে জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে পঞ্চদশবারের মতো প্রদান করা হয়েছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। এই আয়োজনের নিবেদক দেশের স্বনামখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড।

এবার চারটি বিভাগে জয়ী হয়েছেন চারজন তরুণ। তাঁরা হলেন – কবিতা বিভাগে সন্দেহ হবে না কেন গ্রন্থের জন্য কবির কল্লোল, কথাসাহিত্য বিভাগে দূর পৃথিবীর গন্ধে গ্রন্থের জন্য মাসউদ আহমাদ, প্রবন্ধ ও গবেষণা বিভাগে কৈবর্ত জাতিবর্ণের ইতিহাস গ্রন্থের জন্য নিবেদিতা রায় এবং শিশু-কিশোর সাহিত্যে কং পাহাড়ে শয়তান গ্রন্থের জন্য মাহফুজ রহমান।

মানসম্মত বই জমা না পড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্য ও গবেষণা শাখায় কোনো পুরস্কার প্রদান করা সম্ভব হয়নি বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

প্রত্যেক বিজয়ীকে দুই লাখ টাকা, একটি ক্রেস্ট ও একটি সনদ দেওয়া হয়। এবার পুরস্কার প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ও কবি খালেদ হোসাইন।

অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী হাশেম খান। আরো উপস্থিত ছিলেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের, পত্রিকাটির সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া এবং আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ এ সারওয়ার।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে কালি ও কলম এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশন দফতরে এ উপলক্ষে এবার আয়োজিত হয়েছিল দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। প্রথম দিন ২৬শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ‘কবিতা ও কথন’। এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ২০০৮  থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ বিজয়ীরা। 

কবিতা পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন – ওবায়েদ আকাশ, মোশতাক আহমেদ, টোকন ঠাকুর, রঞ্জনা বিশ^াস, সাকিরা পারভীন, পিয়াস মজিদ ও রাজীব হাসান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালি ও কলমের সহযোগী সম্পাদক মুহাম্মদ আশফাক খান। অনুষ্ঠানটির শেষাংশে সবার উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া।

দ্বিতীয় দিন ছিল পুরস্কার প্রদান ও কহে বীরাঙ্গনা নাটকের মঞ্চায়ন। এদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় বেঙ্গল সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। 

অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি বলেন, সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের নবীন কবি ও লেখকদের সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত ও গতিশীল করার জন্য এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫৪ জন কবি ও লেখক পুরস্কারটি পেয়েছেন।

তিনি আরো জানান, প্রথম দিকে এইচএসবিসি ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে পুরস্কারটি প্রবর্তিত হলেও পরবর্তীকালে কালি ও কলম কর্তৃপক্ষ এককভাবে পুরস্কারটি দিয়ে আসছিল। ২০২০ সাল থেকে এই পুরস্কারের সঙ্গে  যুক্ত হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক।

কালি ও কলমের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুড়ি বছরে পা রাখছে কালি ও কলম। একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি শ্লাঘার বিষয়।

শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর মঞ্চে এসে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন ‘কালি ও কলম’ পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর সদস্য স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।

তিনি প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করেন এই বলে যে, মানসম্মত বই জমা না পড়ায় ২০২২ সালেও মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে এই পুরস্কার প্রদান করা সম্ভব হয়নি।

ইমদাদুল হক মিলন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে আমি এই পুরস্কার প্রদানের সঙ্গে যুক্ত। গত দুই বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বিভাগে পুরস্কার দেওয়া যায়নি। এ শাখায় অত্যন্ত দুর্বল বই জমা পড়ে। আমাদের জন্য খুব বেদনার বিষয় এটি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের লেখকরা মানসম্পন্ন লেখা লিখছেন না। এবার মাত্র দুটি বই জমা পড়েছে, তা-ও যথেষ্ট মানসম্মত নয়।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, এদেশের কবিতার ধারা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা, সাহিত্যসাধনা ও সাহিত্যের সৃজনী তৎপরতায় এই পুরস্কার নবীন লেখকদের উদ্দীপিত করবে।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং কালি ও কলমের প্রকাশক শিল্পানুরাগী আবুল খায়ের বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কালি ও কলম বাংলা সাহিত্যের চর্চায় ভূমিকা রেখে আসছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে একটি সাহিত্য পত্রিকার কুড়ি বছর ধরে বিরতিহীনভাবে পথচলা নিঃসন্দেহে গৌরবের।

তিনি আরো জানান, ২০০৮ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। সে সময় থেকে এক লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে বিজয়ীদের। আবুল খায়ের বলেন, আমার মনে হয়, এবার পুরস্কারের অর্থমূল্য বাড়ানোর সময় এসেছে। তাই, আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার বিজয়ীরা দুই লক্ষ টাকা করে পাবেন। পরবর্তীকালে তিনি আবার জানান, আগামী বছর থেকে নয়, অর্থাৎ ২০২২ সাল থেকেই দুই লক্ষ টাকা করে পাবেন বিজয়ীরা।

পুরস্কার বিজয়ী লেখক ও কবিদের অভিনন্দন জানিয়ে চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, কালি ও কলমের শুরুটাই ছিল অত্যন্ত দীপ্তিময়। আমি শুরু থেকেই এ-পত্রিকার পাঠক ও গ্রাহক। প্রথম সংখ্যা থেকেই পত্রিকাটি চমকে দিয়েছিল। পাঠের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে। দেশ ও মানুষকে চিনতে পারে। এই জন্য আমাদের পাঠ ও পাঠ-উপাদান দরকার।

তিনি বলেন, আমি বিশ^াস করি, নতুন লেখকরা তাঁদের আরো অনেক সৃষ্টি দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ আর আমার মতো পাঠকদের উজ্জীবিত করবেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, কালি ও কলম যে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

হাশেম খান বলেন, এদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের সবচেয়ে বড় আসর ছিল ‘বেঙ্গল ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’। এই আয়োজন করেছিলেন শিল্প-সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ আবুল খায়ের এবং তা সফলভাবে বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, হঠাৎ করে এমন আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে। এমনটা কাম্য নয়।

তিনি আরো বলেন, এদেশের চিত্রশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও আবুল খায়েরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না কষেই বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁর এমন মহৎ প্রয়াসের ক্ষেত্রে সকল বাধাবিঘ্ন দূরীভূত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন হাশেম খান। 

আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ এ সারওয়ার বলেন, আমার একটা বিশ^াস দৃঢ় হয়েছে, পৃথিবীতে মানবকল্যাণের জন্য যত চিন্তা রয়েছে এর প্রতিটারই একটা সমাপ্তি আছে। মানুষের শৈল্পিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অবমুক্তি ঘটলে এ সমাজের ইতিবাচক বিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা যারা অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত তারা এই ক্ষেত্রে সৃজনশীল-মননশীল কাজে সাহস-শক্তি জুগিয়ে যেতে পারি।

বিজয়ী চার তরুণ অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, এ-পুরস্কার তাঁদের সাহিত্যচর্চার প্রতি দায়বদ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ নিরপেক্ষতা ও মানের দিক দিয়ে অনন্য।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকে কালি ও কলম পত্রিকাটি এর গুণ-মান ধরে রেখেছে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের আকস্মিক চিরপ্রস্থানের পরও পত্রিকাটি সংশ্লিষ্টরা এর মান একটুও পড়তে দেননি।

তিনি বলেন, নবীনদের সাহিত্যচর্চাকে পরিচর্যা ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ‘কালি ও কলম’ পুরস্কার নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তিনি আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এছাড়া যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের সবাইকে জানান আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

সবশেষে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের অভিনন্দন জানান। সুব্রত বড়ুয়া বিশেষভাবে স্মরণ করেন কালি ও কলমের দুই প্রাণপুরুষ ড. আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতকে। তিনি বলেন, তাঁদের প্রচেষ্টায় এই পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাভাষী পাঠকদের মধ্যে পত্রিকাটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। তাঁদের চলে যাওয়ার পরও কালি ও কলম পরিবার চেষ্টা করে যাচ্ছে যেন পত্রিকার মানে কোনো অবনমন না ঘটে। পাঠকদের অনুকূল সাড়ায় বোঝা যাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি।   

অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় পর্বে পরিবেশিত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য অনুসরণে শুভাশিস সিনহার নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় কহে বীরাঙ্গনা। নাটকটির চারটি পর্ব – ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’, ‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’, ‘জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা’ এবং ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’। ভারতীয় লোক-ইতিহাসের চারজন বহুচর্চিত নারীচরিত্র দ্রৌপদী, শকুন্তলা, দুঃশলা ও জনার লেখা চিঠির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলে নাটকের কাহিনি। অসাধারণ অভিনয়শৈলীর মধ্য দিয়ে জ্যোতি সিনহা ফুটিয়ে তোলেন দ্রৌপদী, শকুন্তলা, দুঃশলা ও জনার মনোবেদনা, ক্ষোভ, অভিমান। তাঁর অভিনয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংগীত, বাদ্য ও আলোক প্রক্ষেপণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই পরিবেশনা। 

নাটকটির ভাব-মুদ্রা-রূপায়ণে ছিলেন অরুণা সিনহা, শ্যামলী সিনহা, শ্রাবণী সিনহা, মনীষা সিনহা, আশা সিনহা ও স্বাগতা। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন শর্মিলা সিনহা। বাদ্য-আয়োজনে ছিলেন বিধান চন্দ্র সিংহ, বাবুচান সিংহ, লক্ষ্মণ সিংহ, সুনীল সিংহ ও উজ্জ্বল সিংহ। মুদ্রাবিন্যাস – জ্যোতি সিনহা, বিধান চন্দ্র সিংহ; আলোক প্রক্ষেপণ – মো. শাহজাহান মিয়া; দৃশ্যসজ্জা – আলী আহমেদ মুকুল, সজলকান্তি সিংহ; পোশাক পরিকল্পনা – জ্যোতি সিনহা।

এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় আইএফআইসি-নিবেদিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২২’-এর আয়োজন।

Leave a Reply