আমার মা ফৌজিয়া খাতুনের খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে। গভীর রাতে আমার মাথা হয়ে যায় তার চারণভূমি। তিনি সেখানে কিছু একটা খুঁজে বেড়ান। সেটা উঁকুন হতে পারে বা খুশকি। ঘটনা এক-দুই দিনের নয়, প্রতিদিনের। এখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে, আমার মা বাঁ হাতে হারিকেন উঁচু করে ধরে ডানহাতে আমার চুলে বিলি কাটছেন। মাঝেমধ্যে তিনি হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাড়ন্ত আলোর উজ্জ্বলতায় মায়ের ফর্সা মুখটা আগুনের মতো টকটকে। তাঁর কালো ব্লাউজের প্রান্তে সবুজ আর কমলার ছিটেফোঁটা। মায়ের শরীরে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসা আকন্দ ফুলের হালকা বুনো গন্ধ। মাকে কখনো পারফিউম লাগাতে দেখিনি। তবু শৈশব থেকেই মায়ের শরীরে এই গন্ধ আমি পেয়ে এসেছি। তবে সব সময় নয়, বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে। তিনি বারোমাস ইয়ার্ডলি নামের একটা পাউডার মাখেন। সেই পাউডারেও এই গন্ধটি নেই। কিন্তু এত ফুল থাকতে আকন্দ ফুল কেন? বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। সম্ভবত বেগুনি রঙের ছোট ছোট এই ফুলের প্রতি আমার তীব্র প্রেম আছে সেজন্য বা মায়ের সঙ্গে আকন্দ ফুলের বিশেষ কোনো যোগ।
আমার মুখের ওপর মায়ের ঝুঁকে আসা ত্রিকোণ মুখটার এক পাশে ছায়া হয়ে থাকা ডালপালার প্রতিচ্ছবি। সেখানে আমি মাকড়সা দেখি যদিও ওগুলো তার কুচো চুলের খণ্ডচিত্র। আমি জানি আমার মাথায় উঁকুন নেই। আমার চুলে খুশকিও নেই। কিন্তু কিসের বাহানায় এত রাতে আমার কাছে আসেন তিনি? রাতের গভীরতাকে ভয় পান? নাকি বাবার সঙ্গ?
‘ফৌজিয়া? কোথায় গেলে? এদিকে এসো।’ পাশের ঘর থেকে বাবার কণ্ঠ ভেসে আসছে। বাবার কণ্ঠে তরলতা। অথচ তিনি মাকে সবসময় ধমক দিয়েই ডাকাডাকি করেন। তাঁর এই তরল আহ্বানের কারণ এখন আমি বুঝতে শিখেছি। বাবার রাতের এই ডাকেই কেবল মা কেঁপে ওঠেন না, সাড়াও দেন না; কিন্তু আমার চুলে তাঁর হাতের গতি বেড়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায়।
আমার মা অপরূপ সুন্দরী। বাবাও যথেষ্ট হ্যান্ডসাম।
বাবা-মা পাশাপাশি দাঁড়ালে জুটি হিসেবে বেশ মানিয়ে যায়। বাবা মানে আমার সৎবাবা। অথচ মায়ের এটি প্রথম স্বামী। মানে আমার জন্মের বিষয়টি গোলমেলে আর কি। ঝগড়া হলে বন্ধুদের কমন গালি হলো, ‘তোর তো বাবা নেই। তুই জারজ।’ জারজ শব্দটি আমার খুব পরিচিত। শুধু বন্ধু নয়, বহুবার বহুজনের মুখে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শব্দটি শুনেছি। বন্ধুরা শুনেছে তাদের মা বা আত্মীয়স্বজনের কাছে। প্রথমদিকে এই শব্দের অর্থ না জানলেও বহুদিন হয় জানি আর এখন তো এর শানে-নজুল পর্যন্ত হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। উনিশ বছরের বাঙালি মেয়ের পক্ষে এসব বিষয়ে জানতে আর বাকিই বা থাকে কী করে? জানতে না চাইলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে নিজ উদ্যোগে জানতে বাধ্য করে। একদিন আমার বন্ধু নিশাত ওয়াটারপট আনতে ভুলে গিয়েছিল। আমি আমার বোতল থেকে পানি খেতে বললে ও বলেছিল, ‘মা তোর হাতে পানি খেতে নিষেধ করেছে। হুজুর নাকি বলেছেন, জারজদের হাতের পানি খাওয়া হারাম।’ নিশাত বেশ বোকা কিসিমের। সামান্য বুদ্ধি থাকলে সরাসরি এভাবে বলতে পারত না। অন্য বন্ধুদের অনেকেই যেমন আড়ালে-আবডালে বা একটু রেখেঢেকে বলে।
তো আমি আমার মায়ের কথা বলছিলাম। বড় হতে হতে আমার মায়ের সব কাহিনির আদ্যোপান্ত আমার জানা হয়ে গেছে। এমন নয় যে, আমার মায়ের জীবনের সব গল্প আমি তাঁর কাছেই শুনেছি। বরং সেই দায়িত্বটা আমাদের আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশী পালন করেছেন। তাঁদের সবার মুখ থেকে আমার মা সম্পর্কে যে খণ্ড খণ্ড গল্প শুনেছি সবগুলো একত্র করলে এমন একটা কাহিনি দাঁড়ায় যে, আমার মা ফৌজিয়া খাতুন ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। প্রেমিক তাঁরই প্রতিবেশী, দূরসম্পর্কের চাচা হন। একে তো সম্পর্কে চাচা, তাতে আবার বিবাহিত। ভয়ংকর প্রেক্ষাপট। আমার মায়ের পরিবার যখন সে সম্পর্কে জানতে পারে, ততদিনে আমি তাঁর গর্ভে তিন মাস পার করে ফেলেছি। চারদিকে ঢিঢি পড়ার আগেই আমার নানা মেয়েকে ছুরি দিয়ে জবাই করবেন নাকি গলায় কলসি বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন সে-বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। তখন আমার অতি বুদ্ধিমতী নানি আমার সৎবাবা কাইয়ুম সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি সম্পাদন করেন। এর মধ্যে চলে গেছে আরো চার মাস, মানে তখন আমি মায়ের পেটে সাত মাসের। চুক্তি অনুযায়ী নিজের নামে দু-বিঘা জমি লিখে দেওয়ার শর্তে ছত্রিশ বছর বয়সী বিপত্নীক কাইয়ুম সরকার মানে আমার সৎবাবা আমার কিশোরী মাকে বিবাহ করেন। চুক্তিপত্রে আরেকটি শর্ত ছিল যে, মা আর কখনো নানাবাড়ি যেতে পারবেন না।
যতই গোপন করার চেষ্টা করা হোক, শেষ পর্যন্ত ঢিঢি পড়েই গিয়েছিল। নানাবাড়ির সবার জন্য সমাজে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। শুনেছি নানা মৃত্যুশয্যায় শুয়েও মাকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছেন যেন মা জীবনে কোনোদিন সুখী না হতে পারেন। হয়তো নানার অভিশাপেই মায়ের কপালে সুখ জুটলো না।
এসব গল্প জানার পরও আমি মাকে এই সম্পর্কে কখনো কোনো কথা জিজ্ঞেস করিনি। তাঁকে জিজ্ঞেস করেও অবশ্য লাভ নেই। কারণ তিনি কিছুই বলবেন না। মায়ের জন্মই বোধহয় হয়েছে কেবল চুপ করে থাকার জন্য। শুধু মা কেন, আমি কি চুপ করে নেই? আমি কোনো কথার প্রতিবাদ করতে পেরেছি?
আমাকে বা আমার মাকে নিয়ে বাজারে প্রচলিত কেচ্ছা-কাহিনি বহুল চর্চিত। কিন্তু এসব নিয়ে আমি বা মা কখনো উচ্চবাচ্য করি না। এ কারণে তারা আক্রোশে আমাকেও চরিত্রহীনা মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। সে করুক। যাকগে, বুঝতে শেখার পর থেকে কাইয়ুম সরকারকে আমার বাবা বলে জেনে, মেনে এসেছি। এখনো মানি। আমার আরো দুই ভাইবোন আছে – নিধি আর প্রিয়ম। আমরা একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিলেও বাবা আলাদা হওয়ার কারণে ওদের থেকে আমার ভাগ্যও আলাদা। এমন নয় যে, আমার বাবা আমাকে ভালোবাসেন না। সময়ে সময়ে আমাকেও বাবা ভালোবাসেন, আদর করেন, কিন্তু সেই আদর ঠিক প্রিয়ম-নিধির মতো নয়।
আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমার কোনো খেলনা ছিল না। বাবা কিনে দিতেন না আর মায়ের সাহস ছিল না যে, বাবার বিনা অনুমতিতে একটা সুঁচ কেনেন। এখনো সেই স্বাধীনতা নেই। মা আমাকে মাঝেমধ্যে কাপড় দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিতেন। পুতুলের দু-হাত বানানো হতো ঝাড়ুর শলা দিয়ে। আমি যত্ন করে শাড়ি পরিয়ে স্বামী পুতুল স্ত্রী পুতুলের মাঝে বাচ্চা পুতুলকে আইসক্রিমের কৌটায় শুইয়ে রাখতাম। একবার বাবা লাথি দিয়ে সব ছুড়ে ফেলেছিলেন। আমার চার বছর পরে নিধির জন্ম হয়েছে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নিধির খেলনায় ঘর ভরে গিয়েছিল। আমি লোলুপদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম, ধরার সাহস ছিল না। বাবা কত যত্ন করে নিধিকে, ‘মা নিধি’ বলে কাছে ডাকেন। আমাকে কখনো মা সম্বোধন করেননি তিনি। এতে অবশ্য তেমন খেদ আমার মনে নেই।
মা ছোটবেলা থেকেই আমাকে কীভাবে কীভাবে যেন বাবার নজর থেকে আড়াল করে রাখতেন। চুরি করে রাখতেন। খেতে দিয়ে বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি খা, তোর বাবা এসে পড়বে।’ কই নিধি-প্রিয়মকে তো কখনো এভাবে বলতে শুনিনি? বরং বাবা ওদেরকে পাশে বসিয়ে মুখে তুলে মাঝেমধ্যে খাইয়ে দিতেন। মায়ের দেখাদেখি আমার মধ্যেও একটা চোর চোর ভাব চলে এসেছিল। আমিও ভাবতে শুরু করেছিলাম, বাবার আড়ালেই সবকিছু করতে হবে। বাবাকে দেখলে আমি হাতের খাবার বা অন্য যা কিছু থাকুক চট করে পেছনে লুকিয়ে ফেলতাম। এখনো সেই অভ্যাস থেকে বের হতে পারিনি।
‘ফৌজিয়া!’ বাবা আবার মাকে ডাকছেন। এখন তাঁর কণ্ঠে তরল ভাবটা কমে সেখানে আদেশ ভাব চলে এসেছে।
মায়ের মুখ অনুভূতিশূন্য। আমি চোখ পিটপিট করে চেয়ে থাকি। মা জানেন আমি জেগে আছি কিন্তু কিছু বলেন না। তিনি আমার মাথায় ক্রমাগত বিলি কাটতে থাকেন। তাঁর হাতের ভাষায় অস্থিরতা। মায়ের শরীরটাও সম্ভবত একটু একটু কাঁপছে। হারিকেনের আলো বারবার কমে যাচ্ছে; মা আবার বাড়াচ্ছেন। কেরোসিন তেল ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, সেটা নয়। বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু মা কেন যে লাইট না জ্বালিয়ে হারিকেনের আলোয় উকুন খোঁজেন সেটি আমি বুঝতে পারি না। একটা কারণ হতে পারে, ঘরের আরেক খাটে প্রিয়ম আর আমার পাশে নিধি ঘুমায়, মা হয়তো ওদের ঘুম ভাঙাতে চান না। আরেকটা কারণ, হারিকেনের প্রতি মায়ের গভীর অনুরাগ। মায়ের কাছে এ-সম্পর্কে বহুবার শুনেছি। সন্ধ্যা হলে নানুবাড়ির চারটা হারিকেনের চিমনি মা ধুয়ে-মুছে জ্বালিয়ে ঘরে ঘরে দিয়ে আসতেন। এই একটা কাজই মা নাকি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে করতেন। হয়তো সেই ভালোলাগা থেকে তিনি এখনো বেরুতে পারেননি। বা আজীবনের জন্য ছেড়ে আসা কৈশোরকে মা এভাবেই মনে রেখেছেন। মানুষ তার ভালোলাগার বিষয়টিকে আগলে আগলে জীবন কাটাতে চায়, যদিও বেশিরভাগ সময় সম্ভব হয় না।
কিন্তু ফি রাতে আমার ঘুম কেন ভাঙাবেন? মাকে অনেকবার বলেছি, ‘রাতে আমাকে এভাবে জ্বালিও না তো মা।’ মা ধমকে বলেছেন, ‘চুপ থাকো।’ প্রিয়ম-নিধির মাথায় কখনো তাঁকে বিলি কাটতে দেখিনি আমি।
‘কী হলো? বেয়াদব মহিলা! ডাকছি কানে যাচ্ছে না?’
বাবা আমার পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে গোখরোর চাপা হিসহিসানি। মায়ের হাত থেমে গেছে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি। বাবা ঘরে ফিরে গেছেন। হারিকেনের সলতে কমিয়ে মা নিঃশব্দে চলে যাচ্ছেন। আমার আর ঘুম আসে না। অন্য অনেকদিনের মতোই। আমি কামরত পুরুষের জান্তব গোঙানি শুনতে চাই না, শুনতে চাই না মায়ের চাপা কান্নাও। মাথার নিচ থেকে বালিশটা নিয়ে আমি কানে চাপা দিই। তবু মায়ের কান্নার আওয়াজ আমার কানে শব্দ-বোমার মতো আছড়ে পড়ে।
আজ ছুটির দিন। কলেজ বন্ধ। ভোরে ওঠার তাড়া ছিল না। মাত্র চোখ দুটো লেগে এসেছিল। কিন্তু নিধির ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। ওর চোখেমুখে আতঙ্ক। ঘুমঘুম কণ্ঠে আমি বিরক্ত হয়ে ধমকে বলি, ‘কী হয়েছে? ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি কেন?’ ও শুধু কোনোমতে উচ্চারণ করলো, ‘মা কাঁদছে।’
‘কাঁদুক, তুই ঘুমা। মা কাঁদে না কবে?’
আমি পাশ ফিরে শুই। কিন্তু নিধি বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ও তো কেবল পনেরো বছরের। আবেগ বেশি। মায়ের দুঃখে কাঁদবেই। আমিও শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছি আমার মা ফৌজিয়া খাতুন কেমন একঘেয়ে সুরে কাঁদছেন। এ আর নতুন কি? মা প্রতিদিন বাবার হাতে কারণে-অকারণে মার খান। আর এভাবেই কাঁদেন। আমি শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিন্তু নিধি ছিঁচকাঁদুনে। অভ্যস্ত হতে পারছে না। প্রিয়ম এখনো এতকিছু বোঝে না। মায়ের কান্না দেখলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
বাবার হাতে মার খাবার বড় একটা কারণ সম্ভবত আমি। কখনো কখনো বাবাকে বলতে শুনেছি, ‘তোর জলজ্যান্ত পাপ আমার ভাত খেয়ে আমারই ঘরে বড় হচ্ছে এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর আমার জীবনে কী আছে? তোর জন্য আমাকেও জাহান্নামে যেতে হবে? আর ওই পাপকে জেনেশুনে কে বিয়ে করবে?’ বাবা কথা মিথ্যা বলেননি। ধর্ম, সমাজ, পরিবার, সবখানেই আমার মতো সন্তানকে পাপ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া আছে। যেহেতু আমার জন্মদাতা থাকলেও তার পরিচয় দেওয়ার দস্তুর সমাজে নেই। দুজন সঙ্গম করে জন্ম দিলেই তো ধর্ম বা সমাজের চোখে বৈধ হয় না। সঙ্গে তিনবার কবুল বলার সার্টিফিকেটও থাকতে হয়। আমাকে কেউ বিয়ে করবে সে-আশাও আমি করি না। আজ পর্যন্ত পরিচিত কোনো ছেলে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি, অথচ আমি যথেষ্ট মেধাবী, সুন্দরী। কারণ আমার জন্মকাহিনি কারো জানতে বাকি নেই। এই একই কারণে আমার খুব কাছের কোনো বন্ধুও নেই।
এটা সত্যি, আমার মা তাঁর অবৈধ সন্তান নিয়ে সমাজে স্বামীর সংসার করছেন, সেটা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। এই একটা কারণে আমার সৎবাবাকে মাঝেমধ্যে আমার কাছে মহৎ মনে হয়। কজন মানুষ আছে যে সাত মাসের গর্ভবতী নারীকে বিয়ে করবে, যার স্বামী বলে কেউ কখনো ছিলই না?
নাহ্! নিধি কেঁদেই যাচ্ছে। আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। মায়ের কান্নার শব্দ থেমে গেছে। আমি রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হই। মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত হাতে রুটি বেলছেন। আমি পেছন থেকেই বুঝতে পারি, কান্নার দমকে মা কেঁপে কেঁপে উঠছেন; কিন্তু তাঁর হাত থেমে নেই। সময়মতো টেবিলে নাস্তা না দিতে পারলে আবার মার খাবেন। আমি মাকে আলতো করে ছুঁই। মা একটু থেমে আবার রুটি বেলতে থাকেন। পাশেই এক চুলায় রুটি সেঁকা চলছে, অন্য চুলায় ভাজি। আমি রুটি উলটে দিই। মা কথা বলেন না। মা রুটি বেলে বেলে তাওয়ায় দিতে থাকেন, আমি সেঁকে সেগুলো হটপটে তুলতে থাকি।
মায়ের জন্য আমার খুব করুণা হয়, মায়া লাগে, আবার প্রচণ্ড রাগও হয়। মাঝেমধ্যে ঘৃণাও করি মাকে। করুণা হয় মাকে যখন কাঁদতে দেখি আর রাগ হয় যখন দেখি বাবার সব অন্যায় মা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছেন। আবার যখন আমার নিজের কথা ভাবি, মায়ের ওপর তীব্র ঘৃণা হয়। আমি আসলে বুঝতেই পারি না, মাকে ভালোবাসি কি না। তবে আমি সব থেকে বেশি খুশি হই, যখন মাকে হাসতে দেখি। কিন্তু মাকে আমি খুব কম সময় হাসতে দেখেছি। কেবল মাসুক স্যারের সঙ্গে যখন থাকেন, তখন মাকে দেখতে সব থেকে সুখী লাগে। তাঁর প্রতিটি অঙ্গ থেকে হাসি ঠিকরে বের হয়।
মাসুক স্যার আমাদের স্কুলের অংকের শিক্ষক। তাঁর চেহারা বা আচরণে বিশেষত্ব তেমন কিছু নেই। আর দশজন পুরুষের মতো সাধারণ। কিন্তু মা তাঁকে দেখলে এত খুশি হয়ে যান কেন আমি বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়, মাসুক স্যার না হয়ে বাবার বাইরে অন্য যে-কোনো পুরুষের সঙ্গ পেলেই মা খুশি হয়ে যেতেন। এটা হয়তো যাবতীয় অশান্তি থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা। মাসুক স্যার প্রতি সন্ধ্যায় নিধি আর প্রিয়মকে পড়াতে আসেন। কিন্তু আমি জানি পড়ানো তাঁর আসল উদ্দেশ্য নয়। তাঁর উদ্দেশ্য আমার মা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা দুজনে নিচু স্বরে কথা বলেন। মায়ের মুখে তখন যে-ভাষা ফুটে ওঠে সেই ভাষা পড়ার মতো বয়স আমি বেশ আগেই পেরিয়ে এসেছি। তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে দেখতে আমার ভালো লাগে। আমি চোখ বন্ধ করে মায়ের পাশ থেকে বাবাকে সরিয়ে দিব্যি মাসুক স্যারকে বসিয়ে দিই। আমি আমার মায়ের ওই একটি সুখ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না বলে চুপ করে থাকি।
‘মা।’
আমি আস্তে করে ডাক দিই।
মা হাতের বেলন কিছু সময় থামান কিন্তু জবাব দেন না।
‘মা কী হয়েছে? আজ আবার বাবা কেন মেরেছে?’
ঝট করে মা মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকান। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বরফের মতো জমে যাই। তাঁর দুই ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে কোনো জন্তু কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল। তাঁর চোখ রক্তাক্ত। সেই আহত চোখে রাজ্যের ঘৃণা উপচে পড়ছে।
কয়েক মুহূর্ত! আচমকা মা আমার চুল ধরে পাগলের মতো পেটাতে থাকেন। তাঁর হাতের বেলন আমার পিঠে এসে পড়ছে আর মনে হচ্ছে পিঠের সব হাড় আমার ভেঙেচুরে যাচ্ছে।
‘মুখপুরি! তোর জন্য আমার জীবনে এত কষ্ট। হারামির বাচ্চা হারামি, এত মানুষ মরে তুই মরতে পারিস না? তাহলে আমি যেদিকে দুই চোখ যায় চলে যেতে পারতাম!’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে মায়ের মার খাচ্ছি। তবু যদি মা শান্তি পায়। মা সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমাকে ছেড়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। তিনি বিলাপের সুরে বলতে থাকেন, ‘আমার কাছে কেউ কখনো জানতে চায়নি, আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল। এতটুকু ছিলাম আমি। কী বুঝতাম? হারামি ইরফান চাচা আমাকে একা পেয়ে রেপ করেছিল। শুনতে পাচ্ছিস তুই? রেপ করে তোকে জন্ম দিয়েছে। তুই জারজ! তুই জারজ! ওই হারামির কিছুই হলো না, আমার জীবন দেখ কীভাবে কাটছে? হতভাগী, তুই মর! মর তুই।’
আমার চোখ জ্বালা করছে। মাকে রান্নাঘরে রেখে আমি ধীরে ধীরে ঘরে চলে আসি। নিধি এখন ঘুমুচ্ছে। ওর পাশে শুয়ে থাকি আমি। আমার মাথা শূন্য। সেখানে কিছুই নেই। মা কি বললেন আর কি ঘটনা ঘটেছিল কিছুই আমাকে কোনো ভাবনায় ফেলতে পারছে না। আমার শুধু মনে হচ্ছে, খুব ক্লান্ত আমি। আমার একটু ঘুম দরকার।
মনে হয় মরণের ঘুম ঘুমিয়েছিলাম। আমাকে কেউ ডাকেনি, কেন ডাকেনি জানি না। মা হয়তো চেয়েছেন আমি ঘুমাই। আচমকা একটা লোমশ হাতের স্পর্শে আমি কেঁপে উঠি। ঘরে জমাট অন্ধকার। তার মানে রাত হয়ে গেছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি জানি এই হাত কার? আজ থেকে নয় সেই আট বছর বয়স থেকে এই হাতের স্পর্শ চিনি আমি। আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমার সৎবাবা আমাকে আদর করেন, প্রচণ্ডভাবে আদর করেন তিনি। কিন্তু সেই আদর বাবার হাতের নয়। পুরুষের আদর। আমার সৎবাবার এক হাত আমার মুখে চাপা দেওয়া আর এক হাত শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি নিঃসাড়ে পড়ে থাকি।
হুট করেই দরজা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরময় আকন্দ ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে। আমার মুখ থেকে বাবার হাত সরে গেছে। তবু আমি চিৎকার করি না। দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে শুয়ে থাকি। দরজায় মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বাঁ হাতে মুখের কাছে হারিকেন উঁচু করে ধরে আছেন, আরেক হাতে মাছকাটা বঁটি। এই সময় মায়ের হাতে কখনো হারিকেন দেখিনি। সম্ভবত বিদ্যুৎ নেই। বাবা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। হারিকেনের আলোয় আমার অত্যন্ত হ্যান্ডসাম সৎবাবাকে পৃথিবীর কুৎসিততম ভালুকের মতো লাগছে। মায়ের মুখ আগুন-গনগনে; কিন্তু আমার চোখ তাঁর চোখে স্থির হয়ে থাকে। মায়ের এই ঘোলাটে চোখ আমি কখনো দেখিনি। একেই বোধহয় ঘোরলাগা চোখ বলে। বাবা ধীরে ধীরে ঘরের কোণের দিকে সরে যাচ্ছেন। মা দরজা ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাবা দেয়াল ঘেঁষে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর চোখ বিস্ফারিত, কিন্তু মুখে কোনো ভাষা নেই। বহুদিন পর আমার দু-চোখ উপচে পানি পড়ছে। আট বছর বয়সে আমি আমার বাবার অন্যরকম আদর প্রথম টের পেয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমি চিনেছিলাম আমার বাবা আর নিধির বাবা এক নয়। আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার আদর বেড়েছে। আমি মাকে বলেছিলাম। কিন্তু মা কখনো বাবার সামনে প্রশ্ন রাখতে পারেননি। সাহস পাননি হয়তো। মায়ের প্রতি আমার ঘৃণা তৈরির এটাই বড় কারণ। আমি সব সময় বাবার ভয়ে তাঁকে পিছিয়ে থাকতে দেখেছি। আজই প্রথম বাবার সামনে এগিয়ে যেতে দেখছি। এই প্রথম বাবার চোখের দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে আছেন মা। আমার মা ফৌজিয়া খাতুন এই প্রথম স্ত্রী থেকে নারী হয়ে উঠেছেন। আমি যেন মাকে নয়, আকন্দ ফুলের বিশাল ঝাড় দেখতে পাচ্ছি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.