আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং অন্য ঘরে অন্য স্বর

বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবহমান সময়-সমাজ-জীবন ও জীবনের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে যাঁরা এযাবৎকাল কাজ করেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭) বাংলা ছোটগল্পের এক আশ্চর্যরকম শিল্পী; তাঁকে জীবনশিল্পী বলতে দ্বিধা নেই। ছোটগল্পের শরীরে কাহিনি বা বিষয় কতখানি জড়ানো হবে, সেটা কোনো বড় কথা নয়, তার বাইরে একটা গল্পকে সময়ের দাবির কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং চরিত্র আপাদমস্তক খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করাই ইলিয়াসের গল্পের কৌশল। তিনি সর্বদা গল্পের ব্যাকরণকে দূরে ঠেলে সামাজিক সময়ের প্রেক্ষাপটে কাহিনির স্তরে খননকাজ করেন, তারপর সেখান থেকে একটা বৃহত্তর মহাকাশে তা নিক্ষেপ করেন। শুধু সমাজ-সচেতনই নন, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং উপস্থাপনের নিজস্ব শৈলীর সমন্বয়ে ইলিয়াস বরাবরই গল্পের অস্থি-মজ্জায়-করোটিতে নির্মাণ করেছেন এক উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য; বিষয়-বক্তব্য-ভঙ্গি-মেজাজের দিক থেকে তাঁর গল্প হয়ে উঠেছে এমনি এক ভাস্কর্য। তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যিক বা পূর্ববর্তী কোনো সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যায় না, যিনি তাঁর যোগ্য সহোদর। এখানেই তাঁর ভিন্নতা আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ অবধি লেখা গল্প নিয়ে প্রথম গ্রন্থ অন্য ঘর অন্য স্বর (১৯৭৬)। পরবর্তীকালে খোঁয়ারি (১৯৮২), দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫), দোজখের ওম (১৯৮৯) এবং তাঁর সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৬) অর্থাৎ পাঁচটি প্রকাশিত গ্রন্থের গল্পসংখ্যা তেইশটি, পত্র-পত্রিকায় বা অগ্রন্থিত আরো কয়েকটি নিয়ে মোটামুটি তিরিশটি গল্প লিখেছেন ইলিয়াস। তাছাড়া তাঁর রয়েছে কালজয়ী দুটি উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) ও খোয়াবনামা (১৯৯৬) এবং একটি প্রবন্ধসংকলন সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (১৯৯৭) – এই হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যসম্ভার। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে গল্পের কারিগর বলা যায়, গতানুগতিক গল্পের ধারা বা আঙ্গিক ভেঙে তিনি নতুন একটা শৈলী বা স্টাইল নির্মাণ করেছেন।

‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ নিয়ে আলোচনা করলে ধরা পড়বে তাঁর গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য ও কাঠামো কতটা মজবুত এবং সেই মজবুত কাঠামোর ওপরই তিনি নির্মাণ করেছেন শিল্প। স্মৃতিভ্রষ্ট-রোগা ও অসুস্থ ছেলে রঞ্জু। জীবনের অনেক রং তার ফুরিয়েছে; কিন্তু সে জানে না, জীবন প্রবহমান নদীর মতো। যতই ধ্বংস হোক আবার জীবনের উৎপত্তি, আবার বিকাশ পৃথিবীর লোকালয়ে। বৃষ্টির স্বর তাকে অন্যমনস্ক করলেও নিজেকে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে রাখতে চায় না। অপ্রকৃতিস্থ রঞ্জু তাই মাঝরাত্রে আব্বা-আম্মার ঘরে কী ফেলে এসেছে বলে ছুটে যায়। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পের বিষয়বস্তু এটুকুই। প্রবল ঝড় ও বৃষ্টির রাত্রে রঞ্জু রাস্তায় বেরিয়ে আসে। অবচেতন মন তার শতাব্দীর অন্ধকার পেরিয়ে যায়। রাস্তার পুলিশ যে রঞ্জুর আব্বা-দাদাকে চেনে এবং সে-কথোপকথনের ভেতর কোথাও ফাঁক থাকে না। তারপর নিঃসঙ্গ শহরের শেষে নদীতীরের শিমুলগাছের তলায় শুয়ে পড়ে রঞ্জু, তখনো প্রবল ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি। একসময় মস্ত শিমুলগাছের ডালটা বৃষ্টির ধারার মতো বিকট শব্দে রঞ্জুর ওপর ভেঙে পড়ল, ভিজে শিমুল ফুলের রাশি ওর চোখের ওপর, শুঁকবে বলে সে শ্বাস নিতে যায়; কিন্তু সে তখন সুবাস নিতে পারে না, শরীর থেকে উড়ে গেছে নবতর পাখি। অস্তিত্বের যে-সংকট, সেই সংকটের রূঢ় রূপের ইঙ্গিত রঞ্জুর বিস্ময়বোধকে কখনো শানিত, কখনো বা বিপন্ন করেছে, মানুষ যে শুধু অর্থ-সচ্ছলতার মধ্যে বাস করতে চায় না, তার ভেতরেও আরেকটি মানুষ আছে, সে চায় নিজেকে উন্মোচন করতে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সময়ের সাক্ষী হতে, এ-গল্পে ইলিয়াস নির্মোহ-নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি দিয়ে সে-সত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘প্রতিশোধ’ গল্পে দেখা যায়, হঠাৎ আবদুল গনির অসুস্থতার খবর শুনে ছেলে ওসমান ঢাকায় ছুটে আসে চট্টগ্রাম থেকে। বাড়ি এসে দেখে আব্বা সত্যি সত্যিই অসুস্থ। ওসমানের আরেক ভাই আনিস, সে বীর মুক্তিযোদ্ধা আর বোন রোকেয়া। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে আবদুল হাশেম; কিন্তু রোকেয়াকে শান্তিতে সংসার করতে দেয়নি মানুষটা। গাড়ি চালাচ্ছিল হাশেম, হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্ট। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে রাস্তার নিচে পানির মধ্যে পড়ে মারা যায় রোকেয়া। এভাবেই গল্পটা যতই সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হোক না কেন, ওসমান-আনিসের এমনকি ওদের আব্বা আবদুল গনির তা বিশ্বাস হতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে হাশেম একজন খুনি, নয়তো রোকেয়ার ছেলেবেলাকার বান্ধবী নার্গিসকে বিয়ে করতে পারত না, যে-নার্গিসের সঙ্গে ওসমানের হয়তো বিয়ে হওয়ার কথা ছিল; একটা চিঠি দিয়েছিল জীবনে নার্গিসকে। যদিও তাকে প্রেম বলা যায় না, তবু বউ মরতে-না-মরতে বউয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করাটাকে আনিস সহ্য করতে পারে না। ওসমানও সেভাবে না দেখলেও ভাইয়ের কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে দেখা যায়, হাশেমকে খুন করতে মরিয়া সে। ছাদে ডেকে নিয়ে বড় রড দিয়ে সিনেমার মতো একেবারে শেষ করে দেবে, এভাবে কী হয়! তারপরও এমনই মনস্থির করে একটা ছক কষে। অমানবিক নিষ্ঠুরতা গ্রাস করে, মনের কোণে একটা ঘৃণা জন্মে, বিচিত্র ভাবানুভূতি ওসমানকে পীড়া দেয়, সংকুচিত হয় নিজের কাছে। আব্বা-আম্মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে রোকেয়াকে, কষ্টও দিয়েছে অনেক। সাংবাদিকতার পয়সায় সংসার চালানো কঠিন, তারপর বামপন্থী দৈনিক ঠিকমতো বেতনও দিত না। আর এখন সময়ের ব্যবধানে সে-সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্রের চর্চা এবং ব্যবসা করে মস্ত বড়লোক হয়েছে রাতারাতি। ওসমানের মনের মধ্যে অন্যরকম প্রতিশোধস্পৃহা জাগ্রত হয়। সাবেক ভগ্নিপতি হাশেমকে খুন করতে চায় বোনকে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মেরে ফেলার জন্য। প্রেমিকা না-হলেও তার সঙ্গেই তো বিয়ের কথা ছিল নার্গিসের। সেই ভাবী কনেকে ভাগিয়ে বিয়ে করার জন্য হাশেমের প্রতি একটা গুপ্ত ক্ষোভ, একটা জিঘাংসা, আববাকে অপমান করে রোকেয়াকে দেওয়া বাড়িটি ফেরত না-দেওয়া, ওকে ঘৃণা করা, লোকটার বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে যে ভণ্ডামি ছিল, তা ধরা পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ-ফেরত কিন্তু এখন স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া প্রায় লুটেরা ভাই আনিসের সঙ্গে হাশেমের মাখামাখা-যোগাযোগের জন্য ওসমানের বড় বেশি ঘৃণা; কিন্তু পারে না। নিজে তো পেশাদার খুনি নয়, খুন করার যে দক্ষতা লাগে তা তো ওর নেই। অবচেতন মনে সে নিজের ছকে নিজেই আটকে যায়, অর্থাৎ ওসমান নিজেই মনোবিকার ও আত্মহননের সুপ্ত বাসনায় মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়। নিজের লাশ দেখে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যায়। এভাবেই গল্পটি একটা শিল্পসমৃদ্ধ গল্পের কাতারে এগিয়ে যায়, সফল গল্প হয়ে ওঠে।

‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পের পটভূমি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ। ননীদা এখানে ধোপদুরস্ত নিরামিষ একটা হিন্দু চরিত্র। বাজারে আড়ত আছে। সেই গদিতে বসে ব্যবসা করেন তিনি একজন কর্মচারী নিয়ে। কিন্তু স্থানীয় মাস্তানদের যে-বাড়াবাড়ি বা দৌরাত্ম্য তা ক্রমে সহ্যের বাইরে গেলেও মুখ বুজে ছেলের বয়সী ওসব বখে যাওয়া পাতিনেতাকে চাঁদা দিতে হয়; বিভিন্ন সম্মেলন-অনুষ্ঠান তারপর এ-আসবে কখন ও-আসবে এমন বিভিন্ন কারণে চাঁদা দেওয়াটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এভাবে চাঁদা দিতে দিতে জেরবার হলেও মুখ বুজে তোয়াজ করতে হয়, নইলে ব্যবসাটা লাটে উঠবে। কলকাতা থেকে কয়েকদিন বেড়াতে প্রদীপ এসেছে। প্রদীপ আত্মীয়তার সূত্রে ননীদার মামাতভাই। তার সামনেই চাঁদাবাজদের ছবি ধরা পড়ে, অথচ এসব মাস্তানের কারণে ননীদার কলেজপড়ুয়া মেয়ে ইন্দিরা রাস্তায় বেরোতে পারে না। কলেজে ভর্তি হয়েও ঘরবন্দি। আর তাই ননীদার বউ-বউদি ভারতে যাওয়ার জন্য মরিয়া। এদিকে পিসিমা যে সমকালের জীবন-পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। পুজো-আর্চা নিয়ে থাকেন। বাতিল হয়ে গেছে জীবনের নানাবিধ চিন্তাচেতনা। তিনি বেঁচে আছেন পূর্ববর্তী নানান ঘটনা, স্মৃতিরাশি আর অনুভূতির একজন সাক্ষী হয়ে পৃথিবীর লোকালয়ে। বাতিল হওয়া পুরনো মানুষ পিসিমা কিন্তু তার বড়দাদার স্মৃতি আঁকড়ে আছেন। ননীদার আরেক ছেলে অমিত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। ক্রিকেট খেলে। প্রবীর-মন্দিরা স্কুলে পড়ে। আরেক ছোট মেয়ে মীনাক্ষী, আর ননীদার মা অর্থাৎ প্রদীপের পিসিমা, এই নিয়ে সংসার। বিধবা পিসিমা মৃত বড় দাদা অর্থাৎ প্রদীপের বাবার স্মৃতি আঁকড়ে আছে, সমস্ত গল্পজুড়ে প্রদীপের সঙ্গে কথোপকথনে বারংবার মৃত দাদা চলে আসে। বিধবা হওয়ার পর ছেলেমেয়েসহ বোনকে নিজের বাড়ি রেখেছিল। সেই দাদার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা অঢেল। পরবর্তীকালে ক্যান্সার দেখা দিলে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সময় এগিয়ে গেলেও পিসিমা তার নিরামিষ জীবনে বড় দাদাকে খুঁজে ফেরে। নদীর টলটলে স্ফটিক পানির ভেতর যার ছায়া পড়ে, সে-ই যেন প্রদীপের বাবা। মানুষ যেন এভাবেই নিজের মধ্যে নিজেকে পরখ করে। গল্পে হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবারের কাহিনির প্রেক্ষাপট চিত্রায়ণ করতে গিয়ে মানবপ্রেমের আরেক কাহিনি অঙ্কিত হয়ে গেছে। সেখানে পিসিমা এক মাইলফলক। তার স্বর শোনা না গেলেও সাতচল্লিশের ভারতভাগের পর হিন্দু পরিবারগুলো অন্য ঘরে চলে যায়। তাদের স্বরে সেই শক্তি আর নেই। দেশত্যাগের আকাঙ্ক্ষায় নিত্যসময় উদগ্রীব, রক্তারক্তি-হিংসা-বিদ্বেষ ও শঙ্কা গ্রাস করছে এবং সেই স্বরে পিসিমা তার বড় দাদার স্মৃতিমধুর কাহিনি গেঁথে যায়। ক্রমে রাতের অন্ধকারের মতো মশারির ভেতর শঙ্কিত শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ছন্দে ওঠানামা করলেও ব্যক্তি-অস্তিত্বের মুখোমুখি ধোঁয়াচ্ছন্ন আরেক বিলীয়মান অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হয়। মানুষ যেন এভাবেই সত্যের কাছে ধরা দেয় অথবা অধরা থেকে যায় জন্ম-জন্মান্তর।

‘যোগাযোগ’ গল্পে একজন শহুরে রোকেয়াকে দেখি, যে কিনা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মহীরুহ নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। মামার অসুস্থতার সংবাদ শুনে রোকেয়া স্বরূপখালী ছুটে যায় বাপ সোলায়মান আলীর সঙ্গে। ঢাকার রোকনপুরে খোকন এবং স্বামী হান্নান থাকে। একমাস বাদে পরীক্ষার কারণে ছেলেকে সঙ্গে নিতে পারে না রোকেয়া। ওদিকে মামার যায়-যায় অবস্থা। মামাবাড়ি কদিন কাটে তার। একদিন সজনেতলায় অবচেতনমনে মৃত মাকে দেখে, যদিও মা চার-পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। এর মধ্যে একদিন টেলিগ্রাম পায়, ছাদ থেকে পড়ে খোকন গুরুতর আহত হয়েছে। মন ক্রমেই শঙ্কিত হয় এবং তারপর মাকে আবার দেখা যায়। তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় রোকেয়া। এভাবে অসম্ভব-অবাস্তব দৃশ্য বা বিষয়াদি অহর্নিশ ঘটতে থাকে। মনের মধ্যে অনেক অজানা বিপদ-আপদ কুণ্ডলী পাকায়, মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে না পারার জ্বালায় জর্জরিত হয়। তারপর ঢাকা ফিরে আসে। নিদ্রাহীন রোকেয়ার কল্পনায় অনেক রহস্য-ভৌতিকতা জন্ম নেয়। ঢাকা হাসপাতালে এসে দেখে তার খোকন শয্যাগত। তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মাকে চিনতে পারে না। অবাস্তব ও কাল্পনিক দৃশ্য যেভাবে রোকেয়ার সামনে আবির্ভূত হয়েছিল সেগুলো সময়ের সঙ্গে একটা অন্তর্গত বাস্তবতায় পরিণত হতে থাকে। অজানা-অচেনা জন্তুর মতো ছায়া নাকি অশান্ত-জীর্ণ-দুর্বল মনের বিভ্রম হতে সন্দেহ নেই। খোকন মরে গেছে। মা ও স্বামীর জবানিতে এ-তথ্য আগাম পৌঁছে দেওয়া অবাস্তব মনে হলে খোকনের চিন্তায় অস্থির-নিদ্রাহীন, সজনেতলায় মৃত মায়ের দর্শন বিকারগ্রস্ত প্রকৃতপক্ষে খোকনের আহত হওয়ারই সংবাদে রোকেয়ার ভীত হওয়ার কারণ, হয়তো সে বেঁচে নেই। হাসপাতালের বিছানায় সে গোঙায়, যন্ত্রণায়-কষ্টে মাকে চিনতে পারে না। মা তো অধীর হবেই। খোকনের গোঙানির আর এদিক-সেদিক বা এপাশ-ওপাশ করার মধ্য দিয়ে গল্পটি সমাপ্তির পথে এগিয়ে গেলেও সন্তানের চিন্তায় নিদ্রাহীন একপ্রকার
অপ্রকৃতিস্থ মা অপেক্ষা করে, কখন ডাকবে ছেলে মা বলে। মা ডাক শুনতে পায়নি শেষঅবধি, তারপরও একটা উৎকণ্ঠা কাজ করেছে। হয়তো এখুনি ডেকে উঠবে। মা ডাকের ভেতর দিয়ে নাড়িছেঁড়া ধনের যে-ভালোবাসা বেরিয়ে আসবে, সে-আনন্দে টুলে বসে প্রহর গুনছে রোকেয়া। গল্পে জাদুবাস্তবতার একটা ছোঁয়া সূক্ষ্মভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তা গল্পের অবস্থানকে শক্ত জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। টানটান উত্তেজনা আর কাব্যগন্ধী বর্ণনা গল্পের ধারাবাহিক পটভূমি থেকে টেনে আরেক আখ্যানে জটিল মনোবিশ্লেলষণে পৌঁছে দিয়েছে। গল্পের যে-জীবনোপলব্ধি, শহর ও গ্রামীণ জীবনের যে-প্রেক্ষাপট, তার ভেতর অবিরাম চড়াই-উতরাই বিষয়বৈচিত্র্যে সমষ্টিগতভাবে সবই উন্মোচিত হয়েছে বৃহত্তর পরিসরে।

‘উৎসব’ গল্পের প্রধান চরিত্র আনোয়ার আলি, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, জীবনের নানা বাঁকে দারিদ্র্য তাকে গ্রাস করে, পুরনো ঢাকার জীবন তার ভালো লাগে না, বড়ই কষ্টের এবং বিশ্রী জীবনযাপন। ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় বন্ধুর বউভাতে গিয়ে আনোয়ারের চোখ জুড়িয়ে যায়, এখানকার জীবনপ্রণালির ধরন-ধারণ তার মস্তিষ্কে কাঁটার মতো বিঁধে। ধানমণ্ডির মতো জায়গায় ধা-চকচকে চওড়া ও মসৃণ সড়ক, আলোয় উজ্জ্বল মানুষগুলো, দেশি-বিদেশি মেয়েমানুষ, চকচকে গাড়ি – সবকিছু দেখে নিজেই হীনমন্যতায় ভোগে; নিজের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। বিয়েবাড়ির সুন্দরী মেয়েদের দেখে আনোয়ার নিজেকে কুলীন ভাবে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। হাফ ডজন রূপসী ভিনদেশি ভাষায় যখন বাক্যালাপ করে, তখন তা শুনে আনোয়ারের চোখ ছানাবড়া হয়। পুরনো ঢাকার মলিন-বিমর্ষ-জীর্ণ জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মাঝরাতে ঘরে ফিরে সুন্দরের ধ্যানে মগ্ন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। বন্ধুর বাড়িতে কত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওরা বড় বড় চাকরি করে; কেউবা আমলা গোছের। একসময় আনোয়ারও ওদের সাহচর্যে ছিল। মানুষের নেশা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। তারপর তো আছে পরিবেশ-প্রতিবেশ-সাহচর্য; কিন্তু সে তো আজ সবকিছু থেকে বিচ্যুত। স্ত্রী সালেহা আনস্মার্ট। ওকে দেখে আর যৌনভাব আসে না। নিথর একটা জীবন যেন আজন্ম বয়ে বেড়াচ্ছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীবনের গতি মন্থর-স্তিমিত। তারপরও মাঝরাতে একজোড়া কুকুরের রতিক্রিয়া অবলোকন করে আনোয়ারের মধ্যে কামভাব জাগ্রত হয়। অভাবগ্রস্ত ঘিঞ্জি গলির ভেতর সংসার দুর্বিষহ নিয়মহীন পরিবেশ। বিবমিষা-ক্ষোভ-ঘৃণা অস্বাভাবিকতা জাগ্রত হয়ে ওঠে আনোয়ারের মধ্যে। এভাবে বিএ পাশ আনোয়ারের স্বপ্ন মরে গেছে। সালেহা কলতলায় দুটো ইটের ওপর ধ্যাবড়া দুটো পা রেখে গ্যালনখানেক পেচ্ছাব করে। অমন খোলামেলাভাবে মেয়েমানুষের পেচ্ছাব-পায়খানা আনোয়ারের মনঃপূত হয় না। নিজেকে সে হীনমন্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে। এভাবেই চোরাঢেকুর দিয়ে ইলিয়াস জীবনের গহবরে দৃষ্টি ফেলে দেখেছেন কালো মিশমিশে অন্ধকার। জীবনকে ভোগ করতে না পারার যে-যন্ত্রণা তা যেন গল্পের তাবৎ শরীরে ছড়িয়ে আছে।

ইলিয়াসের গল্পের বিশাল ক্যানভাস বা প্লট অবশ্য ঢাকা অর্থাৎ পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলি-চিপা রাস্তা, যাকে বলে বস্তিওয়ালাদের জীবনযন্ত্রণার চিত্রাবলি। ধা-চকচকে নতুন ঢাকা থেকে পুরনো ঢাকার মধ্যে যে অদৃশ্য একটা প্রাচীর, সে-প্রাচীর চর্মচক্ষে দেখা না গেলেও ভেদ করা সত্যিই কঠিন। কারণ মেধা-মননে তা অবশ্যই উপলব্ধি করতে হয়। আর্থিক দুর্গতির সঙ্গে জীবনপ্রণালি। নোংরা কানাগলি বা বদ্ধগলির জমে থাকা শতাব্দীর পচা পানির মতো যে মানব-মানবীর জীবনাচরণ, সেখান থেকে বের হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়, বরং বেশ কষ্টসাধ্য বলা যায়। কারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নাগরদোলার মতো ঘুরছে। কোথায় তার সঠিক গন্তব্য তা জানে না। জানার হয়তো প্রয়োজনও মনে করে না; কিন্তু মানুষের এই অবিরাম ঘুরে চলা আজন্মকাল ধরে চলছে। কোথাও তার অবস্থানের এতটুকু পরিবর্তন হয় না। একই ভূমিতে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে যাচ্ছে। আকাশ যতই বিশাল হোক বা সমতল, অথচ সে ওই স্থানেরই একটা মহীরুহ বটবৃক্ষ। পুরনো ঢাকার সঙ্গে নতুন ঢাকার যে যোজন-যোজন ফারাক, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে ইলিয়াস ‘ফেরারী’ গল্পটি রচনা করেছেন। ভয়ংকর দৃশ্যাবলির যে-বিবরণ, মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি, তার ভেতর দিয়ে প্রবহমান জীবনধারা। ইলিয়াস পুরনো ঢাকার যে-জীবনযন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করেছেন সচেতন শিল্পীর মতো, সেখান থেকে ইতিহাস-অভিজ্ঞতা এবং জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আর্থিক দুরবস্থার ভেতর দিয়ে হানিফের যাত্রা। ডিসপেনসারিতে গিয়ে ডাক্তার নেই শুনে মাথার চান্দি ছলকে ওঠে। প্রতাপ কম্পাউন্ডারের ব্যবহারও তাকে বেশ পীড়া দেয়। এভাবেই সে জীবনের বাঁকে প্রবেশ করে। তার জন্য কোনো পরিবেশ অনুকূল নয়। স্বপ্নাহত একজন যুবক। জীবনের রং ধোঁয়াশে। সামনে চলার পথে নেই আলো। সবখানে সীমাহীন অন্ধকার। হানিফের বন্ধু বা অগ্রজ ডামলালু-সালাউদ্দীন-আহসানউল্লা, হাইজ্যাক-সন্ত্রাস নিয়েই থাকে, মাস্তানি করে বেড়ায় মহল্লায়; কিন্তু ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে হানিফ পলাতক। রেসকোর্স ময়দানের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সে রিকশা হাইজ্যাক করতে পারেনি, কারণ সেখানে এখন স্টুডেন্টরা জায়গা করে নিয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ ইব্রাহিম ওস্তাগার। ঘোড়াগাড়ির গাড়োয়ান ছিল আজন্ম, যদিও তার বাপ ছিল রাজমিস্ত্রি। ইব্রাহিমও কিছুদিন বাপের সঙ্গে জোগানদারের কাজ করেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোড়াগাড়ির চাকায় জীবনটাকে বেঁধে শেষ করল। দুই ছেলে হান্নান-হানিফ, এক মেয়ে ফাতিমা, মেয়েজামাই হবিবুর আলী মৃধা লালবাগ ফোরকানিয়া মাদ্রাসা থেকে হাফেজ হয়েছে। কোনো কাজকাম করে না বলে বড় ভাবি খোঁটা দেয় হানিফকে। হবিবুর মৃধাও সহ্য করতে পারে না। ওদিকে আবার ইব্রাহিম ওস্তাগারের জিনপরি দর্শন গল্পজুড়ে অন্যরকম এক ভৌতিকতার সৃষ্টি করে। মৃত্যুচিন্তা-জিনপরির সঙ্গে কথাবার্তা, খিস্তিখেউড় ভয়াবহ রোমহর্ষক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে হানিফও বেরিয়ে আসতে পারে না। সেও তার পিতার বুকে চাবুক মেরে জিনপরিদের অস্তিত্ব এবং বিচ্ছিন্ন জীবনের অংক মেলাতে চায়। মৃত্যুপথযাত্রী বাপের পাশে বসে দুলাভাই যখন কোরান শরিফ তেলাওয়াত করার জন্য বলে, জানা যায় বাড়িতে কোরান শরিফ নেই। তাই বাপের বন্ধু আমীর আলীর বাড়ি থেকে আনার সময় হানিফের ভেতর নানা চিন্তার উদয় হয়। জিনপরি থেকে পুরনো ঢাকার বদ্ধজীবন তাকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে। বিভিন্ন নর্দমা-কানাগলি দেখতে-দেখতে নিজের ভেতর নিজেই হারিয়ে যায়; কিন্তু যখন বাড়ি এসে শোনে বোনের ক্রন্দনধ্বনি, তখন বোঝে বাপ আর নেই, জিনপরিরা নিয়ে চলে গেছে তাদের সঙ্গে, তখন সে চলে যায়। অবিরাম তার চলার গতি, কোথায় যায় জানে না; কিন্তু পুরনো ঢাকার শতাব্দীর পচা-গলা জীবন থেকে চিরতরে নিষ্কৃতি পেতে চায়, সামনে যে-অন্ধকার সেখান থেকে আলোর মুখোমুখি সে দাঁড়াবে আরেক নতুন দেয়াল হয়ে। এই পালানোর মধ্যে আছে সুন্দরের প্রতীক, জীবনের অন্যরকম আঙ্গিক।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যকে এভাবেই কড়ায়-গণ্ডায় ভরিয়ে দিয়েছেন। জীবন থেকে টেনে তুলে এনেছেন কঠিন বাস্তবতাকে, যার ভেতর নিজেকে একটু একটু খেলিয়ে দেখেছেন, হয়তো জীবন মানে শুধু শানশওকতে দিনযাপন করা নয়, আরো কিছু অবশিষ্ট থাকে। সেই অবশিষ্ট নিয়েই ইলিয়াসের গল্প, ইলিয়াসের শিল্পকর্ম।