আত্মজীবনীর কাহিনিকথন

সৌভিক রেজা

 

 

এই পুরাতন আখরগুলি

হাসান আজিজুল হক

 

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

ফেব্রুয়ারি ২০১৪

 

৩০০ টাকা

 

 

 

কেউ যখন আত্মজীবনী লেখেন, তখন তাঁর মধ্যে অনেক বিষয়ই হয়তো ক্রিয়াশীল থাকে; তবে দুটো বিষয় নিশ্চিতভাবেই থাকে। এর একটি হচ্ছে নিজেকে জানা,  অন্যটি হচ্ছে নিজেকে জানানো। কাকে জানানো? জানানো – আত্মজীবনী-পাঠকদের। এসবের পাশাপাশি আরো যে দুটো ব্যাপার কাজ করে তার একটি হলো আত্ম-আবিষ্কার, অন্যটি আত্ম-উন্মোচন। বলা যেতে পারে, আত্ম-আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আত্ম-উন্মোচনের পর্বটিও ঘটতে থাকে, যে-কারণে আত্মজীবনী-লেখককে ঘটনার তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে অতীতের কথা বলতে বলতে অনেক সময় বর্তমানেও চলে আসতে হয়। এটি ঘটানোর মধ্যেই লেখকের কৃতিত্ব নির্ভর করে। ‘কিছুই সহজ নয়’ – এ-কথাটি মনে রেখেও বলা যায়, আত্মজীবনী লেখার কাজটি সে-কারণেই কঠিন, কারণ সবার পক্ষে ওই আত্ম-উন্মোচনের কাজটি ঠিকভাবে করতে পারা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সংগত কারণেই প্যাসক্যাল (Roy Pascal) বলেছিলেন, আত্মজীবনীর সার্থকতা নির্ভর করে ‘the seriousness of the author, the seriousness of his personality and his intention in writing’।

 

দুই

বেশ কিছুদিন ধরেই হাসান আজিজুল হক তাঁর এই আত্ম-উন্মোচনের দুরূহ কাজটি শুরু করেছেন। প্রথমে ফিরে যাই ফিরে আসি (২০০৯), তারপরে উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২০১১) আর সর্বশেষ এই পুরাতন আখরগুলি। বইয়ের নামটিই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কে এই বইয়েই হাসান বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের লেখা কবে প্রথম পড়া, কোনটাই বা তাঁর প্রথম পড়া কবিতা, কবে প্রথম তাঁর ছবি দেখেছি, এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করা বৃথা, আমি জবাব দিতে পারব না। তবে সেটা নিশ্চয়ই আমার পাঁচ-ছ বছর বয়সের মধ্যেই। কোথায় কবে কোন জায়গায় তার হিশেব কে করবে? এজন্যে অনেক সময় এ নিয়ে আমি কোনো কথাই বলি না।’ কিন্তু হাসানের পাঠকেরা জানেন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে হাসানের ঔৎসুক্য,  ভাবনা  তাঁর বিস্তর লেখালিখির মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে।

 

তিন

এ-পর্বটি শুরুই হয়েছে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে। বাদ সাধছে টাকা। গ্রামের গৃহস্থের ঘরে সব থাকে, কিন্তু টাকা থাকে না। এ-বিষয়টিই হাসান বলেছেন এভাবে – ‘স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেই হলো না। টাকা লাগবে। মোটেই বেশি টাকা নয়। তা সেটাই বা আসছে কোথা থেকে? আমাদের বাড়িতে সব আছে। অনেক ধান, অনেক চাল, যব গম সরষে ডাল, কত রকমেরসব খাবার! অভাব কিছু নেই। তবে টাকা নেই। কাগজের নোট তো চোখেই দেখিনি ছোটবেলায়।’ কৃষকের হাতে নগদ টাকা হাতে থাকতো না বলেই কৃষি থেকে অন্যান্য বৃত্তিতে যাওয়ার উদাহরণ থাকলেও বাণিজ্যে যাওয়ার তেমন উদাহরণ অবিভক্ত বাংলায় তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর গায়ের পাকা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। স্কুলটা ছিল মহারানী কাশীশ্বরীর নামে। হাসান লিখেছেন : ‘রানী কাশীশ্বরী কতদিন বেঁচে ছিলেন জানি না। তাঁদের ছেলে মহারাজা শ্রীশচন্দ্র বেঁচে থাকলেও থাকতে পারেন। তিনি নাকি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষের খেতাব পেয়েছিলেন। তা হবেই তো! দেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েরাই তো রাজাদের রানী হয়। সুন্দরী মা পেয়ে একদিন রাজারাও সব সুন্দর হয়ে যায়।’ পর্যবেক্ষণটা লক্ষ করবার মতো। জীবনানন্দের কবিতার কথা মনে পড়ে : ‘পৃথিবীতে সুদ খাটে : সকলের জন্যে নয়।/ অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু-জনের হাতে।/ পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে/ সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।’ শুধু ধনী-দরিদ্র সম্পর্কই নয়, তার সঙ্গে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতার জটিল সম্পর্কও। হাসানের সংস্কৃতের পন্ডিত মশাই ক্লাসে একজন মুসলমান ছাত্রের পেনসিল হাতে নিতে রাজি যে হননি তার কারণও সেই সাম্প্রদায়িকতার বোধ। হয়তো পরিচ্ছন্নতার কথা উঠবে, তারপরও ওই জাতপাতের কথাও তো অস্বীকার করা যাবে না। আবার সেই পন্ডিত মশাই কিনা তাঁর ওই একই মুসলমান ছাত্রের কৃতিত্বে খুশি হয়ে ওঠেন। হাসান অবশ্য তাঁর ব্যাখ্যায় এইখানে মানুষের ভেতরকার ‘আলো’র কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘পন্ডিতমশাই আমাকে যে কতটা ভালবাসতেন তা বোঝানো সত্যিই শক্ত। সেই একটা আলোর কথা বলছিলাম, তার জোরেই আমি নিশ্চিত জেনে গিয়েছিলাম, সংস্কার আর ঘৃণা মোটেই এক জিনিশ নয়, সংস্কারের সঙ্গে বিরোধ হলেও গভীর ভালোবাসা প্রায়ই সম্ভব। ভালোবাসার মধ্যে কেমন একগুঁয়ে ব্যাপার আছে, সেটা মোটেই কোনো কথা শোনে না।’ হাসানের এ-ব্যাখ্যাটা একটু আবেগীয় শোনায় যেন। পন্ডিত মশাইয়ের যে-ভালোবাসা তার একটা বড়ো কারণ তো এই যে, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ‘সবচেয়ে ভালো পড়াটা ঐ ছেলেটাই (হাসান) পড়লে – গড় গড় করে মানে বলে দিলে।’ শুধু তা-ই নয়, ছেলেটা মুসলমান হলেও প্রত্যেক ক্লাসেই সে সংস্কৃতে পঁচাত্তর কি আশি করে নম্বর পাচ্ছিল। এমন এক ছাত্রকে ভালো-না-বেসে সংস্কার-মানা সরল-সহজ পন্ডিত মশাইয়ের অন্য উপায় তো ছিল না। আসলে ‘ব্যক্তি তো অখন্ড সত্তা নয়, খন্ডিত সত্তাসমূহেরই সমন্বিত প্রকাশ।’ তাছাড়া মেধাবী বা কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকের দরদ-সহানুভূতি-সহমর্মিতা তো সর্বজনীন একটা ব্যাপার। সরদার ফজলুল করিম তাঁর এক স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, তাঁদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন হরিদাস ভট্টাচার্য, যিনি আবার টিকি-পৈতাধারী ব্রাহ্মণ। এই ‘হরিদাসবাবু বাড়ির বাইরে অপর কারুর পাক করা অন্ন গ্রহণ করতেন না।… বাইরে কোথাও গেলে তিনি নিজেই রান্না করে খেতেন।… কিন্তু এই হরিদাসবাবুর বাড়িতে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যাপক হুমায়ুন কবির যখনি ঢাকা এসেছেন কোনো পরীক্ষা কার্যব্যপদেশে, তখন তাঁর স্থান হয়েছে। অন্য কোথাও তাঁকে থাকতে দেননি।’ সরদার স্যার বলছেন, এই ঘটনাটা ‘হরিদাসবাবুর অন্য ছাত্রদের কাছে ছিলো একটা বিস্ময়ের ব্যাপার।’ হাসানের বেলায়ও বিস্ময় শুধু এখানেই শেষ নয়, তাঁদের স্কুলের হেডমাস্টার অজিতবাবুর কথাই ধরা যাক। একাধারে উচ্চশিক্ষিত আর ‘চক্কোত্তী বামুন’, তিনিও হাসানের বাবার বিকেলের জলখাবারের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। আলোকিত মানুষ বলেই পারেননি, দায়িত্ববান একজন শিক্ষক হিসেবেও না-গিয়ে থাকতে পারেননি। হাসানদের বাড়িতে গিয়ে তিনিও কিন্তু এই কথাটা সবার সামনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আছে সেখানে ঈশ্বর বিরাজ করেন। আপনারা আমাকে যা খেতে দেবেন তা আমি অমৃতজ্ঞানে খাব।’ এখানে হাসানের ভগ্নিপতি, ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত, অধ্যাপক মাজেম কি খানিকটা হলেও অণুঘটকের ভূমিকা পালন করেন না? ভারতের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এই যে বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব তার কারণ এক জটিল আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এর ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বা একত্রে বসবাস করার ক্ষেত্রে তেমন একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। বলা যায়, ব্রিটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন উস্কানিতেই এই সমস্যা বিভিন্ন সময়ে সংঘাতের চেহারা নিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র এবং স্বাক্ষরতাহীন কৃষক, যে-কারণে শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে একটা তফাৎ বাস্তবক্ষেত্রে থেকেই গেছে। বাস্তবের এই অভিঘাত দেখা যায় তাদের মননজগতেও। হাসানের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে : ‘মুসলমানপ্রধান গ্রামগুলি গোরুর মাংস খায়, তার হাড়-হাড্ডি নাড়ি-ভুঁড়ি যেখানে সেখানে পড়ে থাকে। দুর্গন্ধ বের হয় গোটা পাড়া থেকে।’ অন্যদিকে ‘হিঁদুপাড়ায় এই অবস্থা নয়, … পাড়াটা একটু ছিমছাম থাকে। উঠোনের এক কোণে গাঁদা দোলনচাঁপা, সন্ধ্যামণি এই সব ফুল গাছ। এসবের একটুও খুঁজে পাওয়া যায় না মুসলমান পাড়ায়।’ তারপরও হাসান জানিয়েছেন : ‘আমাদের বাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা গাঁয়ের লোকে জানলেও এমন একজন চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ এই বাড়িতে মিষ্টিমুখ করেছেন শুধু নয়, রাতের খাওয়াটাও সেরে নিয়েছেন, সেই উনিশশ’ পঞ্চাশের দশকে এটা কম সাহসের ব্যাপার ছিল না। ছুঁৎমার্গ কম ছিল না তখন। হাড়ে-মজ্জায় শক্ত গেরো। অন্ধকার একটা জায়গায় কোনো আলো ঢোকার উপায় ছিল না।… হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নয়, সারা গাঁয়েই এরকম। অশিক্ষিত, গন্ডমূর্খ, নোংরা বামুনদেরও ছুঁতে পারত না হাড়ি ডোম মুচি।’ শুধু হাসানদের গ্রামের বা শুধু বাংলা দেশেই নয়, সারা ভারতবর্ষেরই জাত-পাতের চেহারা তখন এই একইরকম। মহারাষ্ট্রের নারী শিক্ষা ও বিধবা মেয়েদের পুনর্বাসন আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ পার্বতী অটাবলে তাঁর আত্মকথা ‘মাঝি কাহানি’তে (আমার কাহিনি) জানিয়েছিলেন, ‘নীচুজাতের কাহার বা মাঙ্গরা খড়ের ও জ্বালানি-কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে আসত তখন ব্রাহ্মণ হয়েও বাবা… মাটির কলসি থেকে তাদের জল দিতেন।… জল খেতে হলে এদের গ্রাম থেকে দু-মাইল দূরের নদীতে যেতে হতো। গ্রামের মানুষ এদের কাছে আসতে দিতো না পাছে এদের ছায়া তাদের গায়ে পড়ে।’

চার

ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ককে বলেছি বটে একটা আবেগীয় ব্যাপার। কিন্তু এটাও  সত্যি যে, দার্শনিক রুশো সম্পর্কে এক আলোচনায় সরদার ফজলুল করিম লিখেছিলেন, কোনো মানুষই ‘আবেগপ্রবণ বলে সহজবোধ্য নয়। মানুষের আবেগকে যুক্তি দিয়ে সবসময়ে বোঝা যায় না। আবেগকে বুঝতে আবেগের গভীরে যেতে হয়।’ আরেকটি উদাহরণ দিই। চল্লিশের দশকের কবি আবুল হোসেন পড়তেন  কৃষ্ণনগরের ‘কলেজিয়েট স্কুলে’। স্মৃতিকথায় আবুল হোসেন তাঁর অন্য ধর্মালম্বী শিক্ষকদের বিষয়ে বলছেন, ‘আমি যখন স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই, আমাদের ক্লাসে আমি ছাড়া আর কোন মুসলমান ছাত্র ছিল না।… কিন্তু সেজন্য তাদের ব্যবহারে কোনো তারতম্য কখনও দেখা যায়নি।’ হাসান যে-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলেছিলেন আবুল হোসেন বা সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিকথাতেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। বন্ধুদের মধ্যে যার সঙ্গে আবুল হোসেনের বেশি ভাব ছিল, সে হলো তাতার। ধর্মে ব্রাহ্ম। বন্ধুদের মধ্যে তাতারকে বেশি ভালো-লাগার কারণ বিষয়ে জানাতে গিয়ে আবুল হোসেন বলেছিলেন, ‘ওদের বাড়ির সবাই অনেক লেখাপড়া করেছেন, বিশেষ করে বোনেরা। বাড়িতে অনেক বই। যখনই গেছি, দেখি কেউ না কেউ কিছু একটা পড়ছেন। এই পরিবেশ আমাদের বাড়িতে ছিল না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যখন ইচ্ছে ওদের বাড়ি গেছি। খেলাধুলা করেছি, খাওয়ার সময় একসঙ্গে বসে খেয়েছি। মুসলমান বলে কেউ আমাকে ভিন্ন চোখে দেখছে অথবা ওদের ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা ভাবছে, তা আমার মনে হয়নি। এখন সেই সময়ের কথা মনে করলে অবাক হতেই হয়।’ হাসান মানুষের ভেতরকার যে-আলোর কথা বলেছেন তাঁকে অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। তার একটা প্রমাণও পাই আমরা। হাসান লিখেছেন, ‘বাংলায় আমি সেই পাঠশালা থেকে ফার্স্ট হই। দুর্গাশঙ্করবাবু এজন্যে আমাকে খুব ভালোবাসতেন। একবার সরস্বতী পুজোয় কী কী লাগবে তার তালিকা তিনি প্রত্যেকবারের মতো এবারো লিখেছেন। খুঁটিনাটি প্রায় সব লিখেছেন, শুধু বাসক ফুলের ভালো নাম ‘দ্রোণ’ লিখতে ভুলে গিয়েছেন। আমি পাশেই ছিলাম। মনে করিয়ে দিলাম।’ তারপর? হাসানের ভাষায় : ‘অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আগের জন্মে ঠিক ‘বামুন’ ছিলি, শাপভ্রষ্ট হয়ে এবার মুসলমান হয়ে জন্মেছিস। আমি অবাক হয়ে বললাম, তা কি খুব খারাপ হয়েছে মাস্টারমশাই? তিনি এই কথায় সামান্য একটু লজ্জা পেলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।’ একেই হয়তো বলে আবেগের গভীরে গিয়ে সত্যের মুখোমুখি হওয়া। যেখানে আপন-পর, হিন্দু-মুসলমান, আশরাফ-আতরাফে কোনো ফারাক থাকে না। সবারই একটি পরিচয় তখন বড়ো হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে মানুষ। এই পৃথিবীর মানুষ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচয় গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘জীবনে একটিমাত্র কথা ভাবিবার আছে যে, আমি সত্য হইব।’ এই সত্য হবার যে-সাধনা তার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই, থাকবার কথাও নয়। রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, বস্ত্তত অস্পষ্টতাই ব্যর্থতা… সেইখানেই ভূমার প্রকাশ প্রতিহত, ভূমার আনন্দ প্রচ্ছন্ন।’ উদাহরণ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘কুঁড়ি হইতে ফুল, ফুল হইতে ফল, কেবলই রূপ হইতে ব্যক্ততর রূপ।’ এইভাবেই মানুষের জীবনের সত্যিকারের সাধনা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়, প্রকাশিত হয়। হাসানের এই আত্মজীবনী পাঠ করতে গিয়ে কখনো-কখনো মনে হয় যেন বিশাল কলেবরে রচিত কোনো একটি উপন্যাসের প্রথম অংশ পাঠ করছি। হাসানের বাবা, মা, তাঁর ভাই-বোন-ভগ্নিপতি সবাই এক-একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। এটি হয়েছে তাদের পরিচয়ের সমগ্রতার গুণে, যার কৃতিত্ব এককভাবে হাসানের। নিজের গ্রামের মানুষদের সম্পর্কে হাসান লিখেছেন – ‘এ গাঁয়ের গণ্যিমান্যি মানুষ মাস্টার তাড়াতে ওস্তাদ।’ আবার বনমালীবাবু যে নিজের ইচ্ছায় স্কুল ছেড়ে দেন – তার কথাও পাচ্ছি। হাসান এবার বলছেন, ‘এই প্রথম আমাদের স্কুলের একজন হেডমাস্টার সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিলেন।’ কখনো কখনো গ্রাম, গ্রামের অধিবাসীরাও সকলে মিলে এক-একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে এই স্মৃতিকথায়। ‘অঙ্কে তো বরাবরই আমি হাঁটুভাঙা’। নবম  শ্রেণিতে ওঠার পর দুলাভাইয়ের হাত ধরে তিনি যেভাবে ইংরেজি ভাষার জগতে প্রবেশ করলেন, তা উপন্যাসের বিবরণকেও তো হার মানায়। সময় যায়, হাসানের বয়স বাড়তে থাকে। বয়ঃসন্ধিকালকে ছাপিয়ে তাঁর শরীরে ও মনে নানারকমের পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনেরও একটা অকপট স্বীকারোক্তি পাই : ‘সাপের মতো শুকনো গাছে গা-ঘষাঘষি করে খোলসটা কি বদলে নিলাম? মনে হয় তাই, আমি অন্য জগতে ঢুকছি। আছি এই জগৎটাতেই কিন্তু এর মধ্যেই তৈরি হচ্ছে অন্য একটা জগৎ। বোঝানো কঠিন। অন্য কোথাও যাচ্ছি। তার পথ সকাল-সন্ধ্যা জুড়ে। কখনো সে দূরে যায়, কখনো সে কাছে আসে। কুন্ডলী পাকিয়ে তখন আমি তার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি, নেশুড়ে চোখে জেগে যাই, বাইরে এসে ঠিকমতো পথ ঠাহর করতে পারি না। শরীরে কখনো কখনো তীব্র উত্তেজনা টের পাই, কখনো অস্থির অতিষ্ঠ হয়ে এক একটা খারাপ কাজ করে ফেলি, লাল আলোর পৃথিবী থেকে বের হয়ে আসার জন্যে। ভীষণ অবসাদ হয়। তখন একেবারে নিয়ম করে স্কুলের লাইব্রেরিতে যাই।’ Haruki Murakami-র Kafka on the Shore উপন্যাসে দেখি পনেরো বয়সের কিশোর কাফকা তেমুরা (Kafka Tamura) তার শরীরের উত্তেজনা প্রশমন করবার জন্যে হস্তমৈথুন করে। হাসানও হয়তো তেমন কিছুরই আশ্রয় নিতেন, যে-কারণে শারীরিক অবসাদের কথা তুলেছেন। তাছাড়া এসব ব্যাপারে একধরনের অপরাধবোধও হয়তো কাজ করে থাকে।

 

পাঁচ 

এই অপরাধকোধ বা অবসাদ – তাকে যা-ই বলি না কেন, হাসান আশ্রয় নেন পড়াশোনার জগতে। এটি শুধু স্কুলের পড়াশোনা নয়, তার বাইরের যে একটা বিশাল জগৎ রয়েছে, সেই জগৎকে জানবার পাঠ। এই স্মৃতিকথার একটা বড় অংশ জুড়ে সেই পাঠ আর পাঠের প্রতিক্রিয়ার বিবরণ পাচ্ছি। যদিও যব গ্রামে বাস করে বই সংগ্রহ সহজ ছিল না। হাসান জানাচ্ছেন : ‘বই খুবই দুষ্প্রাপ্য জিনিস অবশ্য। গাঁয়ে একশোটা বাড়ির মধ্যে হয়তো নববুইটা বাড়িতেই কোনো বই নেই।… বেশি ক্ষিধে নিয়ে খেতে গেলে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়া হয়ে যায়। আমি তো আর বাছি না, বই পেলেই গোগ্রাসে গেলা – ভালো মন্দ যা-ই হাতের কাছে আসে। ব্যাঙের দেশ, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি… যার কাছে যা পাওয়া যায়।’ তার সঙ্গে মজার একটি বিষয়ও জুড়ে দেন তিনি – ‘এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অন্য কোনো জিনিশই তোমাকে দেবে না কিন্তু বই দিতে কেউ তেমন আপত্তি করবে না। এমনকি একবার দিয়ে ফেললে ফেরত চাইতে পর্যন্ত ভুলে যাবে।’ কী বই পড়ছেন হাসান? পড়ছেন বিখ্যাত সব বইয়ের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। দু-একটার নাম উল্লেখ করা যাক : আম অাঁটির ভেঁপু, বৈকুণ্ঠের উইল, অরক্ষণীয়া, দত্তা, রামের সুমতি, মেজদিদি, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস।

এভাবেই তাঁর হাতে আসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজকাহিনী। তারপর কোঠাঘরের এক কোণে বসে ‘পড়তে শুরু করেছি সকাল নটায়, গায়ে জ্বর, গরম নিঃশ্বাস।’ এই বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া হাসান জানিয়েছেন এক অন্যবদ্য ভাষায় : ‘কে বলেছে বই সোনায় মোড়া হয় না! কে বলেছে বইয়ের পাতায় হিরে মানিক মুক্তো ঝলমল করে না? এ কেমন গল্প, এ কেমন ভাষা? গায়েব গায়েবি দিয়ে শুরু, শিলাদিত্যের রানী সূক্ষ্ম বস্ত্রের উপর সোনার সুতোয় নকশা অাঁকছেন রাজার জন্য আঙুলে সুঁচ ফুটে গেল রানীর। এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এল আঙুলের মাথা থেকে, তাড়াতাড়িতে ধুতে গিয়ে সেই এক ফোঁটা রক্ত ফিকে হয়ে ছড়িয়ে গেল গোটা কাপড় জুড়ে। শিলাদিত্য, বাপ্পাদিত্য, হাম্বীর রাজস্থানের বীর রাজাদের গল্প। বইটা শেষ করে যখন বন্ধ করলাম, চারিদিকে বিকেলের আলো সোনার মতোই ঝরে পড়ছে পৃথিবীতে।’ শুধু ভাষা-ই নয়, হাসানের এই বলবার ভঙ্গিটিও অসামান্য। হবেই-বা না কেন? অবন ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘গল্প কানে শোনার জন্যে ছবি চোখে দেখার জন্যে’ এইটে মেনে নিয়েই তো তিনি শিশুসাহিত্য রচনা করতে নেমেছিলেন। সার্থক যে হয়েছিলেন, সেটি হাসানের বিবরণ পাঠ করলেই আর সন্দেহ থাকে না। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে বইটি পাঠের প্রথম প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে হাসান লিখেছেন : ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম তখনো জানি না। গদ্যও এরকম হয়? এত প্রসন্ন-হাসিভরা গদ্যভাষা তো জীবনে শুনিনি।’ বইয়ের প্রতি সেই বয়সেই হাসানের কী অপরিসীম মমতা আর ভালোবাসা-ভালোলাগা জন্মে গেছে, যখন তিনি বলেন – ‘বই পড়তে পড়তেই এক একটা দেশ জেগে উঠছে, এখানে-ওখানে-সেখানে, হাজার হাজার, কোটি কোটি, মানুষে পশুতে জন্তুতে কানায় কানায় ভরা সব দেশ – তার কাছে কত তুচ্ছ আমাদের যবগ্রাম। তবু বুঝতে পারি, আমারও একটা ঠাঁই আছে এখানে। আমি আজো ঠাঁই হারাইনি। সেখান থেকেই আমি বুঝতে পারি, পৃথিবী লাটাইয়ের মতো ঘুরছে। আমার চারপাশেই ঘুরছে ভাবলে দোষ কি?’ স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পাশাপাশি পড়া চলছে বিদেশি বইয়ের অনুবাদ এরিখ মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে থ্রি কমরেডস, দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, দি ব্রাদার্স কারামাজভ, গোর্কির মা, তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস এসব বইয়ের কিছু কিছু তার ওই বয়সে পড়া উচিত ছিল কিনা সে-প্রশ্ন তুলেও হাসান স্বীকার করেছেন যে, বই পড়ে তিনি একেবারে শূন্য হাতে ফেরেননি। ফেরার কথাও নয়। হাসান লিখছেন – ‘বেছে বেছে এই বইগুলির নাম লিখলাম তার একটাই কারণ, দীর্ঘ জীবন পার করে এসেও ভুলতে পারলাম না বইগুলো। পাথরে খোদাই হয়ে থাকার মতো যেন জীবনের চিরপ্রাপ্তি তখনই ঘটে গিয়েছে।’ কথাগুলো মনে রাখবার মতো বটে। চিরকালীন সত্যের অন্য আরেক রকম আলো যেন এখানে পাওয়া যায়। প্রুস্ত (Marcel Proust) তাঁর এক উপন্যাসে বলেছিলেন, ‘Every reader finds himself. The writer’s work is merely a kind of optical instrument that makes it possible for the reader to discern what, without this book, he would perhaps never have seen in himself.’  নিজেকে নিজের মতো করে দেখার জন্যে বই একটা আয়না বটে। আবার বেশি-বেশি বই পড়বার বিপরীতেই আজকের এই হাসানকে অবস্থান নিতে দেখি : ‘একটা কথা আজকাল খুব মনে হয়, গোগ্রাসে গাদা গাদা বই পড়া কতটা ভালো? বুক ফুলিয়ে এ-কথাটা কি বলা উচিত – আমি প্রত্যেক দিন একটি করে বই শেষ করি? একটা লাইব্রেরি শেষ হতে না হতে আর একটা লাইব্রেরি ধরি।’ তাহলে কী করা উচিত? হাসানের পরামর্শ : ‘আমার এমন ধারণা হয়েছে, নিজের অভিজ্ঞতাই আমাকে শিখিয়েছে, মোটেই ওরকম করে বই পড়া ঠিক নয়, হাতির মতো দিনে আড়াই মণ ঘাস খাওয়ার চেয়ে সিংহের মতো কয়েক কিলো মাংস খাওয়াই ভালো।’ হাসান আরো বলেছেন, ‘বই পড়ার একটা খারাপ দিক হলো, যে-কোনো নেশার মতো এটাও নেশা। নেশায় যারা পড়ে তারা অকর্মার ধাড়ি হয়ে যায়। সর্বকর্মে অনিচ্ছা, সকাল দুপুর রাতে চরম অলস মানুষেরাই এরকম বই পড়ে। তাতে মানও থাকে আবার বলার সুখের জন্যে বুক ফুলিয়ে বলাও যায় যে জীবনে আমি দশ পনেরো হাজার বই পড়েছি। তাতে হয়েছে কী? যে-লোকটা পড়েছে তার কি চারটে হাত-পা গজিয়েছে, নাকি চুলের তলায় শিং গজিয়েছে?’। সবাই হাসানের এই মতের সঙ্গে একমত হবেন, তেমন আশাও করি না।

 

ছয়

হাসানের এই বইয়ের আরেকটি বিশেষত্ব তাঁর ভাষা। হাসানের গদ্য তাঁর নিজস্ব রূপের লাবণ্য-রেখার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত, যা পাঠককে তার বোধের গভীরতায় আর উপলব্ধির প্রগাঢ়তায় নিয়ে যায়। ভাবনার বাহনও তো ভাষা, সে-ভাষা একান্তই হাসানের নিজের। যেন কোত্থাও একটু কমতি নেই, ভারসাম্যহীনতা নেই। সেই ভাষা কখনো পেশল, কখনো পেলব, কখনো তীর্যক, কখনো কটু, আবার কখনো চিত্রকল্পময়। ভাষা আমাদের কী দেয়? – এরকম এক প্রশ্নের জবাবে হাসান বলেছিলেন, ভাষা আমাদের সব দেয়। সে-কারণেই ‘জীবনে মানুষের পক্ষে ভাষা অপরিত্যাজ্য, সুনির্দিষ্ট, নিশ্চিত নির্দেশক। সর্বকর্মপারদর্শী নিত্যদিনের অন্নজল।’ আবার ভাষার এ-দিকটিকেও তিনি ভুলে যাননি : ‘তরল, আকারহীন বা আকারধারী, দ্বিধাগ্রস্ত, আলোছায়ায় দুর্জ্ঞেয়তায় ঘেরা সে যতটা মূর্তকে নির্দেশ করতে পারে, ঠিক ততোটাই কিংবা আরো বেশি অমূর্তকে প্রকাশের ইঙ্গিত করতে সক্ষম।’ আর এই সক্ষমতাকেই বলা যায় ভাষার একটা প্রধান শক্তি। মুখের ভাষাকে হাসান এই স্মৃতিকথায় কী অবলীলায়ই-না ব্যবহার করেছেন! যেন তাকে আলতো করে মুখ থেকে তুলে এনেছেন। আর সে-ভাষাতেই একটা পরিবেশ-পরিস্থিতির গোটা চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। শুধু যে স্মৃতিকথার এ-খন্ডে, তা নয়; আগের দুটি থেকেও যদি উদাহরণ দিই, তাহলেও আমাদের কথার সত্যতা পাওয়া যাবে :

ক. ‘বাইরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুর। জনপ্রাণী নেই আশেপাশে। আমরা খড়ের চালের ঠান্ডা ছায়ায় বসে আছি। মাঝে মাঝে হুশ করে ধুলোভরা বাতাস আসছে, দূরে পাকুড়গাছ থেকে সেই বাতাসের ঝম ঝম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু পাগলা নাপিত কঠিন রাগ রাগ মুখ করে দাঁত চেপে বারে বারে আমার মাথাটা তার ময়লা ধুতি-পরা দুই ঊরুর মাঝখানে গুঁজে দিচ্ছে। আমার খুব উমুড়ি-গুমুড়ি লাগছে, হাঁপু-চুপু করছি – ওই মাথায় সাবান মাখিয়ে দিলে যেমন হয় – আমি মাথা সরিয়ে আনতে চাই আর পাগলদা আঃ বলে ফের ঠেসে ধরে দুই ঊরুর মাঝখানে। একটা লোহার চেয়ারে বসে বাবা দেখছেন। তাঁর আবার সায় পাগলা নাপিতের দিকেই, চুল্বুল্ করছিস কেন, বোস্ না একটু স্থির হয়ে।’      (ফিরে যাই ফিরে আসি : ২০০৯)

খ. ‘সত্যিই গাঁ-টা এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন? বোশেখ মাসে কালবোশেখি হয় বটে, তাই বলে প্রত্যেক দিন? বিকেলবেলায় ঝড়, সব লন্ডভন্ড, সব তছনছ। ভেজা রাস্তা দারুণ পেছল। বাড়ির খড়ের চাল, টিনের চাল কোথায় উড়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মতো খড়ের বড় বড় পালুই মুখ থুবড়ে পড়ছে। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে সব ঠান্ডা। কালো রাত, তারাভরা চুমকি বসানো আলো আয়নার মতো আকাশ। রাতটা কাটলেই একটুখানি সকাল, এইটুকুনি মাত্র। একটু পরেই বাঘের মতো রোদ, কাঠফাটা রোদ। মাঠঘাট আগুন গরম। চোঁ চোঁ করে বড় বড় পুকুরের পানি শুকিয়ে আসছে।’

(উঁকি দিয়ে দিগন্ত, ২০১১)

হাসানের গদ্য যেন মধুক্ষরা। তা আবার মুখের স্বাদকে মিইয়ে দেয় না, নষ্ট করে না। ভারসাম্যের কথা সে-কারণেই বলেছি। এত বড় ভাষা-কারিগর দুই বাংলাতেই এখন বিরল। ভাষার যে অমোঘতা সেটি হাসানের গদ্য পাঠ করলে বোঝা যায়। হাসান নিজেই স্বীকার করেছেন, সেই ছোটবেলা থেকেই ‘মনে হয়, ভাষা বোঝার একটা ক্ষমতা ছিল আমার।’

সাত

এই স্মৃতিকথা শেষ হচ্ছে কোথায়? জীবনের একটি অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে, যা প্রত্যেক সংবেদনশীল মানুষের অমোঘ নিয়তি। ‘জীবন যেমন দেখায় তেমন নয়, যেভাবে কাটে বলে মনে হয় সেরকমও নয়। কোনো ভালো বই পড়লে একটু অন্য মানুষ হয়ে ওঠে কি সে?’ এই প্রশ্নগুলো এমনই যে, তার কোনো-একটি সত্য উত্তর কারো জানা নেই। হাসানেরও নেই। স্মৃতিকথা শেষ হচ্ছে এভাবে : ‘আমি ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে এখন।’ এক কিশোরের একটা মানসিক অস্থিরতার ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হচ্ছে আত্মজীবনীর এই অংশটুকু। যেন-বা ভূমিকম্প ঘটে গেছে তার জীবনে : ভেতর-বাহির দুই দিক থেকেই। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘নিজের সত্য পরিচয় পাওয়া সহজ নয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতরকার মূল সূত্রটি ধরা পড়তে চায় না।’ সেই পরিচয়ের সমগ্রতাকে তুলে ধরবার একটা শৈল্পিক প্রয়াস দেখতে পাই এই পুরাতন আখরগুলির মধ্যে। এই লিখনগুলি পুরাতন আখরে ঠিকই, তবে হাসান আজিজুল হকের অসামান্য লেখনীতে সেগুলো আরো নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যেন অন্য-কোনো-এক ‘সৌরভে-ভরা’। এই আত্মকথা অন্য কারো মতো নয়, একেবারে হাসানের নিজের মতো। নিজের জীবনের মতো।